কুবেরের বিষয় আশয় – ২৫

॥ পঁচিশ ॥

বড় বকসার কুকুরটাকে পনের দিন অন্তর দু’টো করে ক্যাপসুল সন্দেশের ভেতর গুঁজে দিয়ে খাওয়ানো হতো। তারপর নিত্যবরাদ্দ দুধের সঙ্গে ছ’আউন্স ক্যাস্টর অয়েল। ধারাস্নান তো আছেই। তবু শ্রীমানের গরম যায় না। সন্ধ্যেবেলা ফুরফুরে হাওয়া দিতেই বেরিয়ে পড়বে রোজ। কুবের না থাকলেও কুকুরদের গরুদের যত কমেনি। এসব তার স্বামীর জিনিস বলে হাজার ঝক্কি সামলাতেও বাড়ির পোষা প্রাণীর কাজে কোথাও কোন ত্রুটি রাখেনি বুলু।

একদিন সন্ধ্যেবেলা কিসের থেকে কি হল—বড় বকসার কুকুরটা উধাও। খোঁজ খোঁজ পড়ে গেলো। কেউ কদমপুর বাজারে দেখেছে। কেউ বললো, এইমাত্র তাকে ডাকঘরের সামনে অন্য একটা কুকুরের সঙ্গে খেলতে দেখলাম। কিন্তু পাওয়া গেল না কোথাও।

পরদিন সকালে নয়ানের বাবা কান্তবাবুর কাছে আসল খবর পাওয়া গেল। সন্ধ্যেবেলা তিনি স্টেশনের ধারে বেড়াচ্ছিলেন। এমন সময় দেখেন কুকুরটা ক্রসিং—ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে। ফেরাবার চেষ্টা করতে গিয়ে কান্তবাবু প্রায় কামড় খান আর কি! তবু ধরবার জন্যে বেড় দিয়েছিলেন। কিন্তু শঙ্খ বাজিয়ে রাত আটটা এক মিনিটের ইলেকট্রিক ট্রেন ছাড়তেই শ্রীমান একলাফে ফাস্ট ক্লাসে উঠে বসেছে।

দ্বীপে পাঠাবে বলে বুলু ভদ্রেশ্বরকে ডাকিয়েছিল। অনেক কাল কোন খবর নেই। একবার ঘুরে আসুক। কিন্তু সামনে যা বিপদ তাতে কুবেরের খোঁজে পাঠানো গেল না। ভদ্রেশ্বরকে শেয়ালদায় পাঠানো হল।

ভদ্রেশ্বর ভেবেছিল, না জানি কি কাজ আছে। অনেককাল সাধুখাঁ মশাইয়ের বাড়ি যাওয়া হয় না। মেদনমল্ল দ্বীপের কাগজপত্র তৈরি করে জে এল. আর ও অফিসে তত্ত্বতালাশ করার কথা ছিল। কুবেরবাবু আসবেন। দু’জনে একসঙ্গে যাবে। কিন্তু কোথায়! ভোঁ ভা! চকদার বনে গিয়ে এদিকে আসার কথাই ভুলে গেল। ভদ্রেশ্বর জানে ধানের নেশা বড় নেশা। এই পৃথিবীতে নেশার বস্তু যে কত—তার ঠিকঠিকানা নেই। লোকে গাছপালা লতাপাতা বসায়—ফলটা পাকুড়টা ঘরে বসে পাবে বলে। নদীর জলে মাছের ডিম কোটি কোটি ভেসে বেড়ায়। ভেড়ি বাঁধ দিয়ে সেই জল কোটালে টেনে নিয়ে ডাঙায় ধরে রাখতে পারলে দেদার মাছ। ধান ছাড়ালে দেদার ধান। মাটিই সব দেয়—জলই সব দেয়। কত জিনিস বোঝে ভদ্রেশ্বর। বহরিডাঙা আদালতের থার্ড মুন্সেফবাবু কিন্তু ভদ্রেশ্বরের অবস্থা একদম বোঝেন না। আজ সাত বছর ধরে ষোল বিঘের একটা দাগের মালিকানা নিয়ে মামলা চালাচ্ছে ভদ্রেশ্বর। এ জমি ষোল আনা তার। ভেতরে তিন বিঘের দিঘি আছে। মাছ চিংড়ি বেচলেও সম্বচ্ছরে তিন-চার হাজার টাকা আসে। কিন্তু সব বন্ধ। সেই থেকে ভদ্রেশ্বরের অবস্থা খারাপ যাচ্ছে। জমিটা ফিরে পেলে ছেলে, মেয়ে, জামাই, আত্মীয়কুটু’ নিয়ে এমন মুখ শুকিয়ে আসার দশা হতো না তার। কিন্তু মুন্সেফবাবু বোঝে কোথায়।

‘সাধুখাঁ মশাই আর আসেননি?’

‘আপনি তো আমাদের কোন খবরই নেন না। জানবেন কি করে লোকটা এখানে এলো কি ফিরে গেলো দ্বীপে?’

তা জানে না ভদ্রেশ্বর। কিন্তু একসঙ্গে লঞ্চঘাটায় এসেছিল। ঘুম না ভাঙিয়ে একা একাই ভোর রাতে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু সেবার ফেরেনি তাহলে? কে জানে। কিভাবে কথাটা পাড়বে। এমন লোক বেশী দেখেওনি ভদ্রেশ্বর। পয়লাবার দ্বীপে গিয়ে মেদনমল্লর দুর্গের উঁচু দেওয়ালে চড়ে কি বেগটাই না দিয়েছিল কুবেরবাবু! নামতে চায় না। কথাবার্তা এমন বলে—যেন কতকাল দুর্গে আছে, তাবৎ তল্লাট সাধুখাঁ মশায়ের বাপকেলে সম্পত্তি। তবে হ্যাঁ, ভদ্রেশ্বর স্বীকার করে—লোকটা ডাকাবুকো আছে। দাপট লোকটার রক্তে রক্তে। এমন মানুষই বিষয়-আশয় করে। কুবেরের খবরাখবর আর ঘাঁটিয়ে জানতে সাহস হল না ভদ্রেশ্বরের। তাহলে সাধুখাঁ মশাই সেদিন একদম ফেরেননি কদমপুরে।

‘একবার শেয়ালদার গিয়ে খোঁজ নিন। বাঘা অতো লোকজন দেখে হকচকিয়ে গেছে নিশ্চয়। দু’বেলা সময়মত খাওয়া-দাওয়া করা অভ্যেস’

‘বলছেন যাচ্ছি। কিন্তু পাওয়া কি যাবে?’ কুবেরবাবুর খোঁজ পাবে বলে এসেছিল। এখন তার কুকুরের খোঁজে ছুটতে হবে। আলিপুরে জজকোর্টে কাজ আছে ভদ্রেশ্বরের। সেখান থেকে তিন নম্বর বাসে সোজা শেয়ালদা যাবে। কিন্ত এইভাবে কুকুরের পেছনে ঘোরা যায়! বেনামার গভীর জল থেকে দাগ ধরে ধরে সে জমি উদ্ধার করতে পারে ঠিকই। রাতারাতি একরারনামা বানিয়ে কোবালা রেজিস্টি বন্ধ করে দিয়ে বেচাল খদ্দের সায়েস্তা করতে পারে। কিন্তু শেকল হাতে নিয়ে এত বড় কলকাতায় অবলা জীবের সন্ধানে কোথায় ঘুরবে। আর বাঘাকে সে ছোটমত দেখেছে। এখন কেমন চেহারা কে জানে।

‘আমাদের বোধ হয় খারাপ সময় শুরু হল—’

‘ও কথা বলছেন কেন? ঘরে আর পাঁচটা প্রাণীর সঙ্গে ছিল। অসুখ-বিসুখে মরেও তো যেতে পারত।’

‘আমার খুব কুলক্ষণ মনে হচ্ছে। এতদিন এসেছি—বাঘা একদিনের জন্যেও রাতে ঘুমোয়নি। কান খাড়া করে পাহারা দিয়েছে। কেন যে এমন কুমতি হল—’

সাধুখাঁ মশাইয়ের কাছে অনেক নুনু খেয়েছে ভদ্রেশ্বর। জমি-জায়গার হাত—ফেরতে টাকা তো পেয়েছেই। উপরন্তু আজ মেয়ের ঘরের নাতির ভাত, কাল চাল বাড়ন্ত—পরশু মামলা আছে বলে দফে দফে অনেক টাকাই নিয়েছে কুবেরের কাছ থেকে। কোনদিন না বলেনি। চাইতেই পেয়েছে।

ভদ্রেশ্বর বেরিয়ে যাচ্ছিল। খবরের কাগজ হাতে দেবেন্দ্রলাল ঘরে ঢুকলো। ‘তিন তিনটে মাস কোনো খবর নেই। আমাকে তো জানাবে।’

‘বাবা এলেন কবে?’ ভদ্রেশ্বর প্রণাম করলো।

বুলু বললো, ‘এতো চিন্তার কিছু নেই বাবা। তেল-মবিল নিতে সেখান থেকে লোক এসেছে মাঝে মাঝে। খারাপ কিছু হলে জানিয়ে যেতো তারা।’

দেবেন্দ্রলাল অনেকদিন পরে এসেছে। বড় ছেলের অফিসে প্রোমোশন হওয়ায় বড় বউমা নারায়ণের জন্যে সোনার বেড় তৈরি করে শ্বশুরের হাত দিয়ে পাঠিয়েছে। নারায়ণের অভিষেক হবে। হাতের সামনে ভদ্রেশ্বরকে পেয়ে কিছু রেগেই গেল দেবেন্দ্রলাল, ‘এই তোমাদের মতো লোকজনের লাভের লোভ মেটাতে গিয়ে আমার ছেলেটা শেষে বেঘোরে প্রাণ দেবে। ওদের মা বেঁচে থাকলে একসঙ্গে এতদিন কুবের দ্বীপে গিয়ে গায়েব হয়ে থাকতে পারতো না।’ তারপর সোজাসুজি বুলুর দিকে ফিরে তাকালো দেবেন্দ্রলাল, বউমা বিয়ের পর থেকে অনেক বদলে গেছে, বোঝা যায় এইসব মেয়ে হুকুম দিয়ে লোক খাটায়, তুমি তার বউ। পরিষ্কার কোন খবর না জেনে এমন গ্যাঁট হয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাক কি করে? ছেলেমেয়েরা অব্দি বাপ দেখেনি কতকাল—‘

কথাটায় কিছু সত্যি ছিল। নিজের বাড়িতে—নিজের জায়গায় বসে বুল কোনোদিন এমন বকা খায়নি। দেবেন্দ্রলালের একটা জিনিস তার কোনোমতেই অস্বীকার করার উপায় নেই—সে কুবেরের বাবা।

এমন অস্বস্তিকর অবস্থার ভেতর বুলু ভদ্রেশ্বরকে এক রকম হট হট করে তাড়িয়ে দিল, ‘সব কিছু খোঁজ নিয়ে আজই জানাবেন। আমাদের সময় কেমন খারাপ যাচ্ছে—একা কিছুই ঠিক করতে পারছিনে।’

বুলুর চোখে তাকিয়ে ভদ্রেশ্বর কিছু বুঝতে পেরেছে। এ তল্লাটে এখন সাধুখাঁ মশাইকে যে যাই বলুক, যত পয়সাওয়ালা লোকই ভাবুক–অবস্থা যতই বদলাক ভদ্রেশ্বরের চেয়ে ভালো আর কে তাদের জানে। প্রথম প্রথম সাধুখাঁ মশাই সস্ত্রীক জায়গা দেখতে আসতেন। খালপোলের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় ভদ্রেশ্বরের চোখে পড়েছে। তখনও আলাপ হয়নি। কি সুন্দর দেখাত—জোড় বেঁধে স্বামী-স্ত্রীতে জায়গা—জমি কিনতে বেরিয়েছে। লক্ষ্মী সঙ্গে নিয়ে বাণিজ্য। সেসব ক’বছর হয়ে গেল।

ভদ্রেশ্বর চলে গেল। দেবেন্দ্রলাল তখনও রাগে গরর গরর করছিল। ভোরে দোয়ানো দুধে একটা ডিম ফাটিয়ে মিশিয়ে নিয়ে এল বুলু। তার শ্বশুর দুধের গ্লাস হাতে নিলেন ঠিকই, চোখও সকালের কাগজে—কিন্তু মন নেই বোঝাই যাচ্ছে।

বুলুর আরও একটা জিনিস ভদ্রেশ্বরকে বলার ইচ্ছে ছিল। এদেশে ডাকাতির জন্যে প্রায়ই বেঁটে দেখে খেঁজুরগাছ কেটে নেয়। ঢেঁকির কায়দায় সে জিনিসটা কয়েকবার দোল খাইয়ে ডাকাতরা বড় দরজায় ঘা মারে। এইভাবে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। কাল সকালে দেখছিল, পুকুরপাড়ের খেজুর গাছটা কারা কেটে নিয়ে গেছে। লক্ষণ খারপ। দেবেন্দ্রলাল এসে পড়াতে তা আর বলতে পারেনি। ঠিক এই সময় বাঘা উধাও। ডাকাতরা কেউ লোভ দেখিয়ে ট্রেনে তুলে নিয়ে যায়নি তো।

দেবেন্দ্রলাল চোখে ভালো দেখেন না। স্টিমার কোম্পানির চাকরি নষ্ট হওয়ার পর বাঁ চোখে ছানি পড়েছিল। পেকে উঠলে কুবের কাটাবার ব্যবস্থা করে। তারপর ডান চোখে নেত্রনালী হয়। এবার ডাক্তার বলেছে, ওষুধ দিয়ে ঠেকা দিয়ে যেতে হবে—আর কাটাকুটির বয়স নেই। বিয়ের পর পঞ্চাশ বছর পার করে দিয়ে বউ মারা গেছে।

বুলু বুড়োর মন ঘুরিয়ে দেবার জন্যে বললো, ‘ড্রাইভারকে বলি—আপনি বেড়িয়ে আসুন। এতদিন পরে এলেন, চারদিক ঘুরে দেখুন—’

দেবেন্দ্রলাল সকালে গ্যারেজ ঘর দেখেছে, ‘সব মিলিয়ে চারজন লোক তোমরা। তিন তিনখানা মোটরের কি দরকার বুলু—’

‘সে আপনার ছেলেকে দেখা হলে বলবেন। কোথায় কোথায় টাকা দিয়ে বসে আছে। কোম্পানির লোকগুলো ভুজুং দিয়ে বুঝিয়ে কিনিয়েছে। আমি বিন্দুবিসর্গও জানি না। ডেলিভারি দিতে এলে তবে জানতে পারি—’

‘লক্ষ্মীকে অভক্তি করলে বিপদ হয় বউমা—’

ঘরের জানলা দিয়ে স্টেডিয়ামের অতিকায় কাঠামো চোখে পড়ে। এ জিনিসটি কি-’দু’বার জানতে চেয়েছে দেবেন্দ্রলাল। বুলু বুঝিয়ে বলেছে।

কুবেরের এখানকার জীবন বুলুর অভ্যেস হয়ে গেছে। অসুবিধে হয় তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের। জমি-জায়গা বিষয়-সম্পত্তি করতে গিয়ে কুবেরের আগেকার জীবন আগাগোড়া ওলটপালট হয়ে গেছে—সে কথা বুলুই জানে সবচেয়ে ভালো করে। তাই, এতদিন কুবের আসেনি—দ্বীপে আছে—এ নিয়ে যে ভাবার কিছ আছে, বুলুর তা একদম মনেই আসেনি। এখন সে আর কুবের-দু’টো আলাদা কোম্পানি—তবে যৌথ নিশ্চয়। দেখাসাক্ষাৎ হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

‘জানো বুলু, ছোটবেলা থেকেই কুবের অন্যরকম। ক্লাস সেভেনে থাকতেই ভাত খেতে বসে ওর মাকে বলতো—মা, তোমার নামে ইস্কুল করবো—আর বাবার নামে বাজার বসাবো। হাটবারে ব্যাপারীদের কাছ থেকে তোলা কুড়োবো।‘

এই বিরাট কাণ্ডকারখানার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দেবেন্দ্রলালের বুক ফুলে ওঠে ছেলের জন্যে। কতটুকু মানুষ। এই বয়সেই কত কি করে বসে আছে। মাথার ওপরে কেউ নেই। চারদিকে কত বিপদ-আপদ। কত একা। আজ যদি ওদের মা বেঁচে থাকত। একবার দেখে যেতে পারত!

নিজেকে খুব স্বার্থপর লাগল দেবেন্দ্রলালের। ছেলে টাকা পয়সার নেশায় কোন্ মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর সে এখানে নিশ্চিন্তে বসে দুধ ডিম গিলছে। কি দরকার ছিল এত সব জিনিসের! মানুষের জীবনে কতটুকুই বা লাগে! শেষ অবধি দেহ রাখতে চার পাঁচ হাত জায়গাই যথেষ্ট। বাকি সবকিছু পেছনে পড়ে থাকে।

কুসুমের মুখখানি তার ঠাকুরমার মতো। স্বভাবও তাই। দেবেন্দ্রলাল এই কয়েক ঘণ্টা লক্ষ্য করেছে—তার নাতনীটি এই হাসে, এই ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে পড়ে। আবার কি কথায় হেসেও ওঠে। এই ধারার মানুষ বড় হয়েও জানতে পারে না-কি জন্যে পৃথিবীতে এসেছে। এরা খুব কষ্ট পায়।

কুসুম ঘরে ঢুকেই বললো, ‘দাদু আমি গ্নিছারিন মেকেচি।’

‘তাই নাকি?’

খুব গম্ভীর হয়ে কুসুম তার দাদুকে একটা খবর দিল, ‘গ্নিছারিন মুখে মাখে এবং কিন্তু মিষ্টি—’

‘ও। তুমি গালে জিব বুলিয়ে চেটে দেখেছ?’

এতক্ষণে বসার ঘরের গুমোট হাসির ঝর্ণায় কেটে গেল। অনেকদিন পরে দেবেন্দ্রলাল, বুলু একসঙ্গে হেসে উঠল।

বুলু অনেককাল হাসে না। বিয়ের আগে সে অন্য জগতে ছিল। সেখানে টিউশনির টাকা জমিয়ে বারো তের টাকার শাড়ি কেনার দিনগুলো ছিল উৎসবের বিয়ের পরে কুবেরকে অফিস যাতায়াতের জন্যে ট্রামের মান্থলি বাদে বাস ভাড়া বাবদে গোনাগুনতি যাতায়াত বাইশ পয়সা দিত। তারই ফাঁকে দু’জনে একসঙ্গে সিনেমা দেখার দিনগুলো ছিল খুবই উল্লেখযোগ্য। তারপর কদমপুরে জায়গা দেখতে এসে কিসের থেকে কি হয়ে গেল। তখন আর টাকাপয়সা কোনো প্রবলেম নয়। প্রবলেম হল টাইম। একদম সময় পাওয়া যায় না। আজ রেজিস্ট্রি, কাল ম্যাপ বানাতে যেতে হবে, পরশু অমুক আসবেন—জায়গা নিতে পারেন—অতএব ঘরদোর পরিষ্কার রাখা চাই। এত কাণ্ডের ভেতরে দু’জনে একটু আলাদা হয়ে যে কিছু করবে, কোথাও যাবে—তার সময় কোথায়। শেষে সে পাটও চুকলো। কিন্তু ততদিনে তার চেনাজানা কুবের সাধুখাঁ আগাগোড়া বদলে গেছে। গায়ে তেল মাখে না। মাথা আঁচড়ায় না, দাড়ি কামায় না-পারলে এই বয়সেই গলাবন্ধ কোট গায়ে দিয়ে ক্যাসবাক্সের সামনে কোনো গদিতে কুবের বসে যায়। তবে এসব তার সয়ে এসেছে।

এখন এক অজানা আনন্দ—দুশ্চিন্তাও বলা যায়, সাহেব মিত্তিরের চেহারা নিয়ে তার কাছে ছুটে আসে—সে নিজেও মাঝে মধ্যে ছুটে যায়।

সৃষ্টিধর ছোটবোনকে সরিয়ে দেবেন্দ্রলালকে দখল করল। তখন কুসুম খুব সহজ পথে তার প্লাস্টিকের পুতুলগুলোকে খাওয়াতে শুরু করল। মাথার কাছে জোড়ের জায়গা কয়েকদিনের ক্রমাগত চেষ্টায় টানা হ্যাচড়া করে খুলে ফেলেছে। সেখান দিয়ে পুতুল ছেলেমেয়েদের পেটে বালি, স্টোনচিপ, ভরে দিয়ে তাদের পেট ভরিয়ে ফেলল।

দেবেন্দ্রলালকে বারান্দায় টেনে নিয়ে গিয়ে সৃষ্টিধর কি দেখাচ্ছে। বুলু জানে মন্ত্ৰ পড়ে বিয়ের নিয়ত মত এই শ্বশুর, ছেলে সবই তার নিজের জিনিস। এসব জিনিস সে কিছুতেই অস্বীকার করতে চায় না। কুবের কষ্ট পাক—তাও বুলু চায় না। কিন্তু তবু—কিংবা কুসুম এইমাত্র যেভাবে বলেছিল, ঠিক সেইভাবে বলতে গেলে না বলে উপায় নেই—সাহেবের সঙ্গে মেলামেশা করে থাকি এবং কিন্তু ভালোই লাগে। বুল জানে এই ভালো লাগাটা কিছুকাল আগেও তার মনের মধ্যে একটা ভারী যন্ত্র হয়ে চেপে বসেছিল—যার নাম যন্ত্রণা! অথচ এখন আর তেমন কিছু মনে হয় না। হয় না বলেই পেছনে তাকাতে তার ভীষণ ভয় করে।

কুবের সাধুখাঁ নগর বসিয়ে গেছে। সেই নগর এখন আধখানার বেশী তৈরী হয়ে এসেছে। দু’একঘর লোকও বসে গেছে। নতুন নতুন বাড়ির জানলায় নতুন পর্দা। তাতে সকালের চোখ ঝলসানো রোদ পড়ে ভয়ঙ্কর সুন্দর চেহারা নিয়েছে। সৃষ্টিধরের বাবা থেকেই এই সবের শুরু। অথচ মানুষটা হিসেব, অঙ্ক, চাষাবাদের পাহাড়ে আধখানা ঢাকা পড়ে আছে। যেটুকু দেখা যায়—তাও শুধু কাজ আর কাজে ভর্তি এইটে বাকি—ওটা এখনও করা হয়নি। এমন কত কি। কুবের একদিনের জন্যেও তাকে কোন একটা আসনে বসিয়ে একটু দূর থেকে ঘুরে ফিরে দেখেনি। কুবেরের চোখে সে যে কেমন, আজও তা জানে না বুলু। এইটুকু জানে—জায়গা কেনার সময় লেখা হয়—

গ্রহীতাঃ—

শ্রীমতী বুলু সাধুখাঁ।

জওজে শ্রীকুবের সাধুখাঁ।

হিন্দু, পেশা গৃহস্থালি।

সাকিন কদমপুর।

বিক্রি-বাটার সময়েও ‘দাতা’ বলতে দলিলে ওই একই কথা লেখা হয়। উপরি বলতে তখন বহরিডাঙ্গা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের সামনে মুহুরীদের সেরেস্তায় বসে মাথায় ঘোমটা টেনে বুলু দলিলের পাতায় পাতায় পরিষ্কার করে লিখে দেয় শ্রীমতী বুলু সাধুখাঁ। দলিলের শেষ পাতায় জায়গার তপশীলের নীচে কুবেরও স‍ই করে—শ্রীকুবের সাধুখাঁ, পিতা শ্রী দেবেন্দ্রলাল সাধুখাঁ, সাং-কদমপুর।

এমন সময় উঁচু খালপাড়ে কুবের রোডের ওপর একখানা মুখ ভেসে উঠল। বুল ভয়ে কাঁটা হয়ে গেল। সাত সকালে সাহেব কি মনে করে? দূর থেকে সেও জানালায় দাঁড়ানো বুলুকে দেখতে পেয়েছে। দেখে খুশি চাপতে পারছে না।

এস.টি.সি. থেকে কেনা বিলিতি গাড়িখানা ব্যাক করে গ্যারেজ থেকে বেরিয়েই এক মোচড়ে খালপাড়ে উঠে গিয়ে ব্রেক নিল। সৃষ্টিধরের কাণ্ড। নেপাল ড্রাইভারের ভোরের দিকে বাতের আড় ভাঙে না। দু পায়ে ঝিঁঝি ধরে পড়ে থাকে। তাকে সিটে বসিয়ে দেবেন্দ্রলালকেও রাজি করিয়েছে সৃষ্টিধর। দাদুকে সারা তল্লাট দেখানো চাই।

দেবেন্দ্রলালের জানার কথা নয়, সাহেব মিত্তির কে? কেন সে সোঁদালিয়া ক্যাম্পের তেল খোঁড়ার জায়গা থেকে এতদূর আসে? রোজ না মাঝে মাঝে আসে? তবু বুলুর মনে হল দেবেন্দ্রলাল এক্ষুনি সাহেবের কাছ থেকে সব জেনে ফেলবে। তাই, সামনে আর কোন কিছু ধরে দাঁড়াবার না পেয়ে বুলু জানলার গ্রিলে লোহার তারা ফোটানো কিছু ধারালো রেখায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে হাত, বুকে চেপে ধরল—ব্যথা লাগলেও ভ্রূক্ষেপে নিল না।

রাস্তা করে দিয়ে সাহেব কুবের রোডের একপাশে নেমে দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়ি সেখানে গিয়ে ঘ্যাঁচ্ করে থেমে গেল। ছেলেটা একের নম্বরের বাঁদর হয়েছে। নিশ্চয় সৃষ্টিধর থামিয়েছে। একখানা ছোট হাত জানলা দিয়ে বেরিয়ে এসে সাহেবকে টানলো। সৃষ্টিধর আজকাল সাহেব মামা ডাকে। বুলুর শেখানো। আজই প্রথম মনে হল এসব ডাকাডাকি স্রেফ জাল। এতক্ষণে সবকিছু দেবেন্দ্রলালের চোখে জলের চেয়েও পরিষ্কার হয়ে গেছে। কান পেতে ছিল বুলু, সাহেব আর সৃস্টিধরের কথা এতদূর থেকেও কিছু শোনা যায় যদি। ঠিক সেই সময় পুজোর ঘর থেকে ঘণ্টা বেজে উঠলো। এই বাড়িটা নিয়মের রাজত্ব। মেথর নিঃশব্দে এসে বাথরুম, বারান্দা, চাতাল ধুয়ে দিয়ে চলে যায়। দোহাল সকাল বিকেলে শিস দিয়ে দিয়ে গরুগুলোকে ভুলিয়ে ভালিয়ে দুধ দোয়। ঠাকুর মশাই সিগন্যালম্যানের মত এসে প্রদীপ ধরায়, নৈবেদ্য দেয়, ঘণ্টা বাজায়—রাত হলে নারায়ণের শয়ান দেয়-কখন আসে কখন যায়-খোঁজ না নিলে জানার উপায় নেই। সাহেবকে জায়গা দিয়ে নেপাল স্টিয়ারিং থেকে সরে বসল। সর্বনাশের ষোল আনা। গাড়ি খালপোল পার হয়ে গেল।

এতবড় বাড়িতে এখন সে বলতে গেলে একেবারে একা। আজ কোন্ কথায় সাহেব যে কোথায় গিয়ে হাজির হবে, গাড়ি চালানোর হালকা চালে থাকতে থাকতে দেবেন্দ্রলালকে যে কি বলে বসবে তার ঠিক নেই। ঝকঝকে সকালবেলার এক কোণে একটুখানি কালো হয়ে উঠেছিল গোড়া থেকেই। সেই কালোটুকু এখন ধাঁ ধাঁ করে সারা আকাশ ছেয়ে ফেলেছে। আসলে সেই কালো ভাবটা তার ঘরের ভেতরকার সব কিছু আবছা করে দিচ্ছে। হঠাৎ মনে পড়ল, মাঘের শেষে তো একটা বৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল। তা হয়নি। শেষে তেমন কিছু হবে না তো আজ? আচ্ছা, দেবেন্দ্রলাল হয়ত পেছনের সিটে বসে বলছে—

‘তুমি কে? বউমার ভাইদের কারও নাম তো সাহেব ছিল না—’

‘আজ্ঞে, আমি আপনার ছেলে কুবেরবাবুর বন্ধু—‘

‘তাহলে মামা কেন? কাকা ডাকবে তো ওরা?’

‘সেই সুবাদে ওদের মায়ের সঙ্গেও আলাপ পরিচয়—’

‘ও! তা কতদিনের?’

‘মাঝে মধ্যে এসে থাকি।

বুলু জানলা ছেড়ে নড়তে পারেনি। সেখানে দাঁড়িয়েই সাহেব আর দেবেন্দ্রলাল দু’জনের হয়ে আলাপ করছিল। আর ভাবতে পারলো না। এর পর দেবেন্দ্রলাল আর কি বলতে পারে?

আসলে কিন্তু তখন সাহেব স্টিয়ারিং-এ বসে রাস্তার দু’ধারে মাত্র কয়েক বছরে কতটা বদল হয়েছে, কি কি কারখানা বসছে—তাই দেবেন্দ্রলালকে বলছিল। ‘এসব জায়গা কি ছিল আগে! আমরা তেল খুঁড়তে এসেও প্রথম প্রথম দেখেছি—এদিকটায় সন্ধ্যের পর লোকজন বেরোতো না। শুধু এক কুবেরবাবু তখন থেকেই খালপাড় কেটে রাস্তা বানাচ্ছেন, নতুন নতুন লোক এনে বসাচ্ছেন—’

সৃষ্টিধর আর জবাবের অপেক্ষায় না থেকে, যা যা জানে—পর পর বলে যাচ্ছিল। তাকে কোনক্রমে থামিয়ে দেবেন্দ্রলাল বলে ফেলল, ‘কুবেরকে তুমি শেষ দেখেছো কবে?’

‘তা বেশ কিছুদিন হবে—’

‘বছরখানেক হয়ে গেল আমি একবারও দেখিনি।’ ছেলেটিকে দেবেন্দ্রলালের ভাল লেগেছে। দু’ধারে মাঠ, মাঝে মাঝে খুচরো সব কারখানার শেড, বড় বড় গাছতলায় লরির আড্ডা—সাহেবকে বলেই ফেললো কথাটা, ‘দিন তিনেক আগে দুপুরবেলা স্বপ্ন দেখলাম—কুবের নেই। এই বুড়ো বয়সেও ঘুমের মধ্যে চোখ জলে ভরে গেল—’, সাহেব গাড়ি থামিয়ে ফেলেছে, দেবেন্দ্রলাল বোধ হয় বুঝতে পারেনি, তাই থামল না, ‘উঠে বসে দেখি ঘরে কেউ নেই। মাথার বালিশ ভিজে গেছে। নিজেকে বোঝালাম—শুক্লপক্ষে দিনের বেলার স্বপ্ন কখনো ফলে না—’

কুবেরের কথা সাহেব মিত্তির সবটুকু জানতে চায়। কিছু পড়ে থাকতে দেবে না। বুলুর কথায়-বার্তায় মনে হয় কুবেরের সে কিছু জানে না। আজ একজন ভালো লোক পাওয়া গেছে। ইনি কুবেরবাবুর বাবা। সাহেবের কাছে এখন একটা জিনিসই সবচেয়ে বড় রহস্য হয়ে দেখা দিয়েছে। বুলুর তাপের মধ্যে পৌঁছতে গিয়ে সে বার বার পিছলে নীচে পড়ে যাচ্ছে। কখনো নিষ্ঠুর, কখনো অভিনব মনে হয়। অথচ কি বা ওজন হবে বুলুর। বড় জোর আট সাড়ে আট স্টোন। পলকা—কিন্তু মুট করে ভাঙাও যায় না। এমন জিনিসের মালিক হয়ে ঘরেই ফেরে না—সে কেমন ধারার মানুষ! চাষাবাদ, জায়গা জমিতে কিসের যে এত নেশা থাকে, সাহেবের মাথায় তা কিছুতেই ঢোকে না।

‘আমার এই ছেলেটাই সবচেয়ে একা—’

সাহেব অনেকদিন পরে একজন বাবা দেখল। সামনেই গাড়ির কাচে দেবেন্দ্রলালের চোখ নাকের খানিকটা ভেসে উঠেছে। সাহেব বেল্ট দেখে নিজের বাবার ডেডবডি আইডেন্টিফাই করেছিল।

‘তোমরা কুবেরকে একটু দেখো। আমরা কেউ এখানে থাকি না—

তিন ন’র ওয়েলে কাজ হচ্ছিল। গাড়িতে বসেই দেখতে দেখতে দেবেন্দ্রলাল জানতে চাইল, ‘ওই মন্দির কিসের?’

‘রেলেশ্বর শিবের। সেবায়েত আপনাদের ব্রজ ফকির—’

‘কোন্ ব্ৰজ? সেই ম্যাজিক দেখাত যে—’

সাহেব চুপ করে আছে দেখে দেবেন্দ্রলাল বললো, ‘এখন সেবায়েত হয়েছে তা হলে—’ কুবেরের মা এই লোকটির সংস্পর্শে যেতে কুবেরকে বারণ করেছিল। স্পষ্ট মনে আছে দেবেন্দ্রলালের।

‘আপনার ছেলের বন্ধু হন খুব। ডাকবো? আলাপ করবেন?’

‘থাক, দরকার নেই।’

‘ওনার তো খুব পসার এখানে। কত ভক্ত শিষ্য যায় আসে—’

‘তাই নাকি!’

ফেরার পথে নেপাল স্টিয়ারিং-এ বসল। সাহেব থেকে গেল। অন্যমনস্ক দেবেন্দ্রলালকে আর কি কথা বলবে সৃষ্টিধর। বললো, ‘এবার বাবা এলে আর যেতে দেবো না।’

‘দাও কেন?’ ধরে রাখতে পার না-’

সৃষ্টিধর কথার নেশায় কথা বলছিল, ‘এবার বাবা এলে তার সঙ্গেই আমি চলে যাব।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *