॥ চৌদ্দ ॥
এদিকে একবার বন্দর হওয়ার কথা হয়েছিল। শ’খানেক বছর আগের কথা। তখন নানান সাহেব ছুটে আসে। একজন নুনের কারবারে নেমেছিল। সে চোঙ লাগানো কারখানা বসিয়েছিল। সেই সাহেবও নেই কারখানাও নেই। জঙ্গলের ভেতর বন ধোঁধলে ঢাকা ইটের পাঁজা দেখে বোঝা যায় ওখানে একদিন কিছু একটা করার চেষ্টা চলেছিল। এখন শুধু জং ধরা একটা বিরাট চোঙ কাত হয়ে পড়ে আছে। অনেক জায়গায় মরচে পড়ে গর্ত। হাওয়া দিলে চোঙ দিয়ে সমুদ্রের শব্দ আসে। সেসব কিছু নেই আর। লোকে তবু বলে কারখানা। আজ পঞ্চাশ ষাট বছর ধরে লোকে ওই নামে জায়গার নাম দিয়েছে। এখন সেখানে তেল খোঁড়ার টঙ্ আকাশের মাঝে মধ্যে এক এক জায়গায় গঙ্গা ফড়িং হয়ে বসে আছে।
পিচ রাস্তা থেকে নতুন তৈরি চওড়া মেঠো পথ সাইটে চলে গেছে। ঠাণ্ডা রাখার বাক্স বসানো বিরাট বিরাট ঘর। কাচের জানলা। তাতে দু’জন সাহেবের মাথা দেখা যাচ্ছে। হয়ত এদের কাউকে কুবের সেবারে কদমপুর লেভেল ক্রসিয়ে ডাব কিনে দিয়েছিল। সারাটা এলাকা ঘুরে এতক্ষণ ব্রজ ফকিরের চিহ্নও দেখতে পায়নি কুবের। ফেরার পথে কারখানা গাঁয়ের ভাঙা টালির স্তূপে একটা লোকের মাথা দেখা গেল, জটাজুটো, আলখাল্লা তাও ভেসে উঠল শেষে। প্রায় একশো বছরের পুরনো সাপের আড়তে ব্রজদা কি করছে?
অনেক ঘুরে কুবের সেই কারখানার কবরখানার নীচে এসে দাঁড়ালো, ‘এখানে কি করছো?’
‘কে?’ চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছিল ব্রজদার। গলা চিরে গেল। কুবেরকে দেখে শান্ত হল, ‘ওঃ! তুই! আমি ভেবেছিলাম—’
‘কাকে?’
‘তেল খোঁড়ার লোকজন আমাকে এখান থেকে তাড়াতে চায়। কাল রাতে কেরোসিন মাখানো ন্যাকড়ার বলে আগুন দিয়ে ছুঁড়ে মেরেছে অনেকবার। আমি এখান থেকে নড়বো না।
‘সাপের কামড় এনজয় করছো এখানে তাহলে!’
‘পাগল! আমি আছি এখানে নানান্ ধান্দায়-–’
কুবের তাকিয়ে আছে দেখে ব্রজ ভেঙে বললো, ‘বাবার আত্মজীবনী, অদ্বৈতের পালা, সরল পশুচিকিৎসা —তাবৎ বইপত্রের মিশেল ডাঁই দিয়ে রাখি। গাঁয়ের লোকজন কিনে নিয়ে যায়। কাজে বেরোবার সময় আমাকে দেখলে, আমার এই থান দেখে জোড়া নমস্কার করে। এখন এখানে শুধু একখানা বিগ্রহ বসাতে পারলেই হল। তা হলে কেউ আর ওঠাতে পারবে না। তোর বউদি আসার কথা ছিল—’
‘আসবে কি করে? সেদিন যে লোক পাঠিয়েছিলে আমি দেখেছি।’
কি রকম! ব্রজ দত্ত ইট গোছাতে গোছাতে থেমে গেল। একটা মঞ্চ হচ্ছে বোধ হয়। কোন ঠাকুর দেবতার গান হবে নিশ্চয়। চারদিকে বুনো লতার ঝাড়। তার মাঝখানে একখানা ছোট ত্রিপলের ছাউনি। জলের কু’জো, উনুন—একখানা বড় থালা। ভাঙা দেওয়ালে ব্রজ দত্তর জগৎ প্রপঞ্চ মারকা হাসি মাখানো একখানা ছবি।
‘আমি সেদিন তোমার খোঁজে গিয়ে বেড়িয়ে এসেছি। একটা লোক জিপে চড়ে গিয়ে হাজির। হঠাৎ চীৎকার শুনে ছুটে গেলাম। লোকটা বেরিয়ে এসেই জিপে হাওয়া হয়ে গেল। বউদি কাঁদছিল। লোকটাকে তখন ধরার উপায় নেই—’
‘লোকটাকে পেলে কি করতিস?’
ভেতরে ভেতরে চমকে গেল কুবের। সেও যা করেছে, তাতে আভার পাড়া মাথায় করে কান্নাকাটি করা উচিত। তাকেও ধরা উচিত ছিল কিন্তু—
‘আচ্ছাসে শিক্ষা দিতাম খানিকটা—’
‘কি বলতিস?’
নিজের ভেতরে তাড়াতাড়ি নেমে গিয়ে কুবের দেখল, লোটাকে বলার কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। সে নিজেও একজন কালপ্রিট। যাকে বলে দাগী আসামী।
‘বলতাম ইয়ারকির জায়গা পাওনি? পরস্ত্রীর গায়ে হাত—’
‘সবই ঈশ্বরের সম্পত্তি মনে রাখবি। আমরা শুধু মাঝে মাঝে কেয়ারটেকার—’
‘তাই বলে নিজের বউ?’
‘আভার সেদিন চলে আসা উচিত ছিল। এলে আমি এতটা অসুবিধেয় পড়তাম না। সস্ত্রীক সাধু একটা হ্যালো সৃষ্টি করে। আচমকা কেউ সাহস পায় না। তার ওপর দখল নিতে সুবিধে। কেউ এলে বলা যায়—আর এগোবে না মশায়, মেয়েছেলে আছে।’
‘তাই বলে তোমার নিজের বউ?’
‘নিজের বউ তো আমার এই নতুন নয়। আগেও হয়েছে কবার। হয়ত আরও ক’বার হবে। তাই বলে একটা ডিটারমিনেশন থাকবে না। বাই হুক আর ক্রুক আমাদের এখানে একটা ডেরা গড়ে তুলতেই হবে।’ ব্রজ দত্তর চোখে ঠিকরে বেরিয়ে এল। কুবের ভেতরে ভেতরে চমকে গেল। সে নিজেও প্রায় একইভাবে জেদ করে যে কোনভাবে কদমপুরে একটা নতুন বসতি গড়ে তুলতে চাইছে। ক’দিন পরেই গৃহপ্রবেশ। দু’একখানা বাড়ি হয়েছে মাত্র। আলো এল বলে। কিন্তু বুলু এখুনি আসতে চায় না। মা এক দমকে শ্বশুরকুলের বাড়ি ছেড়ে উঠতে পারছে না।
অথচ কুবের আজ দেড় দু’বছরে প্রায় একটা নগর বসাতে চলেছে। স্বপ্নের সেই কলবাড়ি বানাতে চলেছে। সম্বচ্ছরের ধান মলানোর মাঠ, মাছের পুকুর, গরুর গোয়াল—কত কি। এসবের কোন হয়ত মানে নেই। কিন্তু চারদিকে আষ্টেপৃষ্টে পাকাপোক্ত সব ব্যবস্থা করে চলেছে। একটা জিনিসের অভাব থেকে যাচ্ছে। নগেন বলেছিল, ‘সেঝদা সবই করছ’—কিন্তু একটা শ্মশান করা হল না আমাদের। শেষে পাবলিকের সঙ্গে সেই ওলড্ ক্যাওড়াতলা নয়ত কাশী মিত্তিরের ঘাটে যেতে হবে বুড়ো বয়সে!’
ব্যাপারটা গোড়ায় ভাবাই হয়নি তার। বড় দেরি হয়ে গেছে। শ্মশানের জন্যে কেউই জায়গাজমি কোবালা করতে চায় না!
কুবেরের আজকাল এক এক সময় খুব ভয় ধরে। আমি এখন কি করছি। কি করে চলেছি। সব যদি ফট করে ফেটে যায়—চুরমার হয়ে যায়। তখন বুলু, খোকন, নতুন বাচ্চাটা—আমি-আমরা সবাই কোথায় যাব? আমি তো প্রায় চোখ বুজে এগিয়ে যাচ্ছি। পথটা যদি নদীতে গিয়ে শেষ হয়। তখন কোথায় যাব? একদিন যদি টাকা আসা দুম করে বন্ধ হয়ে যায়। তখন কি হবে।
হঠাৎ খুটখাট আওয়াজ হতেই ব্রজদা একখানা লাঠি নিয়ে নীচের চাতালে লাফিয়ে পড়ল, ‘কে রে?’
কয়েকটা লোক দুড়দ্দাড় করে ছুটে চলে গেল।
‘দিনের বেলাতেও চোর! কুবেরকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো, ‘সাহেবের আমলের সব টালি। যে যা পারছে খসিয়ে নিয়ে গিয়ে বেচে দিচ্ছে। আগে গরুরগাড়ি নিয়ে আসত। বোঝাই দিয়ে গঞ্জে, হাটে চালান দিত। আমি এসে বন্ধ করেছি—’ ব্রজ দত্ত হঠাৎ থেমে সামনের একটা লোককে বললো, ‘এই যে সাহেব—আসুন।’
কুবের ভুত দেখলেও এত চমকে যেত না। এই লোকটাই সেদিন আভার ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছিল। আভা চেঁচাচ্ছিল, ‘এই কি প্রবৃত্তি! ছিঃ! ছিঃ!’
লোকটার নিশ্চয় কোন একটা নাম আছে। ব্ৰজদা ডাকল সাহেব বলে। সাহেব মিত্তির। ব্রজদা বললো, ‘কলকাতার কায়েত। সচ্চরিত্র সুপুরুষ। বুঝলে কুবের; দিশী লোকজনের মধ্যে এখানকার সবচেয়ে কঠিন কাজটাই করতে হয় মিত্তির মশায়ের—’
মিত্তির বিনয় করে হাসল। কুবেরদের চেয়ে এক আধ বছরের বড় হবে। হাফশার্টের বাইরে পুরন্ত দু’খানা হাত ফেঁপে ফুলে বেরিয়ে আছে। বিরাট একটা হ্যাকসর ওপর ভর দিয়ে মোটা একটা পাইপ কটকট আওয়াজ তুলে মাটির ভেতর সেধিয়ে গেল। সেদিকে আঙুল দেখিয়ে সাহেব মিত্তির বলল, ‘পাইপ মাটির নীচে চলে গেলে স্পেশাল বন্দুক দিয়ে আমি জায়গা নিরিখ করে গুলি ছুড়ি। হিসেব মত জায়গায় গুলির চোটে পাইপ ফেটে গিয়ে গ্যাস নয়ত তেল ভুস ভুস করে উঠে আসবে। ‘আমি ম্যাকম্যান—‘
‘তীরন্দাজ বলুন।’
কুবেরের রসিকতার আঁচ ধরতে না পেরে লোকটা গবেটের কায়দায় হেসে বলল, ‘গোলন্দাজও বলতে পারেন।’
গোঁফ থাকলেই লোকটাকে শিকারী বলা যেত। সেদিন একটুর জন্যে কুবেরের হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে। অবশ্য আজ আর হাত ফসকে গেছে বলে ভাবতে পারছে না। যার বউ সেই বলছে, আমার নিজে বউ তো নতুন নয়—আগেও হয়েছে ক’বার—আরও হয়ত ক’বার হবে, আসলে চাই ডিটারমিনেশন। কিসের ডিটারমিনেশন? দখলের ডিটারমিনেশন? এই জিনিসটা আমার। এটা দখলে রাখতেই হবে। যেনতেনভাবে দখলে রাখতেই হবে।
‘আপনার হাতে কি হয়েছে?’
কুবের হাত লুকোতে পারল না, ‘ও কিছু না—’
মিত্তির হাত বাড়িয়ে কুবেরের কব্জি ধরে ফেলল। সাঁড়াশির চেয়েও জোরে ধরেছে। কুবের নিজের হাতখানা বের করে আনতে পারল না।
‘ড্রিঙ্কস্ চলে?’
‘তেমন কিছু নয়। মাঝে মাঝে এক আধদিন—তাও কেউ এলে তবে।‘
‘হাঁটুতে, তলপেটে পরদিন লাল বিজগুড়ি বিজগুড়ি বেরোয়?’
লোকটা জানল কি করে? খুব অবাক হলেও মুখে শুধু বললো, ‘তা বেরোয়।’
বাঁ পায়ের প্যান্ট অনেকটা তুলে ধরে কুবেরকে দেখাল, ‘এই দেখুন। আপনার মত হয়ে আছে। কালচে কালচে ছোপ। আমারও অমন বিজগুড়ি বেরোতো। আমার আপনার লিভার ড্রিঙ্কস্ নিতে রাজি নয়। তারই ইরাপশান। সেই থেকেই এই কালো ছোপ ছোপ দাগ। ড্রিঙ্কস্ ছেড়ে দিয়ে তবে এইসব দাগদাগালির ছড়িয়ে পড়া অ্যারেস্ট করেছি—এত এক ধরনের একজিমা। বাড়তে দিলে নিস্তার নেই। ‘
ব্রজদা নির্বিকার হয়ে শুনছিল। মিত্তিরকে কুবেরের খুব বন্ধু লাগল। এতদিনে একটা দলের লোক পাওয়া গেল। নিস্তার নেই শুনলেই ভেতরটা একদম কেঁপে যায়।
‘মিত্তির এই যে ছেলেটিকে দেখছো—একে একবার আমি মানসপুত্র করেছিলাম—অনেককাল আগে। এমন ছোকরার এত টাকা পয়সা—আমাকে দত্তক নিতে পারে!’
কুবেরের খুব ভাল লাগল না কথাগুলো। বুড়ো দামড়া। সরস্বতী বউদির ওখানে তোমার দু দু’টি ছেলে গোকুলে বাড়ছে। পয়লা বউদির হেফাজতেও তোমার একটি নিজস্ব ছেলে আছে। তারা সবাই বাড়ছে। একদিন তারা বড় হবে। সবাই বড় হয়ে মাথার ওপর বাবা চাইবে। শেভ্ চাইবে। গ্যারান্টি চাইবে। আর এখন তুমি কারখানা গাঁয়ে একশো বছর আগের বাতিল কারখানার টালি আগলাচ্ছ।
‘আপনার কথা অনেক শুনেছি। ব্রজবাবু প্রায়ই বলেন।’
আমি তোমার কথা শুনিনি কোনদিন। আমি তোমাকে দৌড়ে, পালাতে দেখেছি শালা। এঁটো ডাটা না চিবোলে নয়।
‘এখানকার কাছাকাছি কিছু জায়গা ধরে রাখুন না। ভাল রিটার্ন পাবেন।’
‘আমার আর ভালো লাগে না।’
‘টায়ার্ড!’
লোকটা ধরল কি করে? এবার সত্যিই অবাক হবার পালা। মিত্তির কুবেরের হাতের দাগদাগালির মানে করে দিল এইবার।
‘আপনারই মত—তবে আরও বড় সাইজের লোক দেখেছিলাম আঙ্কেলেশ্বরে। সেখানে তখন তেল বেরিয়েছে। আমরা গুটিয়ে চলে আসব। তখন আলাপ। চল্লিশ ক্রশ করে গেছে। কুপার সাহেবের তখন চারদিকে পয়সা। বিয়ে করেনি। বলত—মিত্তির ভীষণ টায়ার্ড আমি। কিছু ভাল লাগে না। এরকম মন নিয়ে আমি বিয়ে করতে ভয় পাই—’
বাঃ! লোকটা কতসব বোঝে! অথচ সেদিন—কি ভয়ঙ্কর জ্ঞানপাপী!
‘আপনি বিয়ে করেছেন?’
‘মনে নেই।’ কুবেরকে অবাক হতে দেখে সাহেব মিত্তির বললো, ‘বাল্যবিবাহ বলতে পারেন। এখন যাই না। টক লাগে।’
‘ওঃ!’ কুবের মনে মনে বুঝল একখানা স্যাম্পেল বটে। বুলুকে তার কেমন লাগে জানতে চাইলে এক ঢোকে বলতে পারবে না। গৃহ প্রবেশের আগেই ঢালাও ফার্নিচারের অর্ডার দিয়ে বসে আছে বুলু। ইলেকট্রিক আসেনি তাতে কি। সেই আগের বুলু নয়। কুবেরই মাঝেমাঝে চিনতে পারে না।
বিকেল আসতে দেরি নেই। সাইটের ডায়নামো গর্জে উঠতেই বড় বড় ডুমগুলো জ্বলে উঠল। তখনও কড়কড় করে পাইপ নামছে আর একটা মোটা লোহার চেন গাঁটে গাঁটে ইস্পাতের দাঁত নিয়ে ওপরে উঠে আসছে। অন্য যে কোন জায়গায় এখন যেমন সূর্য থাকে তেমন একখানা সূর্যই দিগন্তে লটকানো। খানিক পরেই ঝুলে পড়বে। মিত্তির বলে ডাকতেই কারখানার কবরখানার ভাঙাচোরা গলি দিয়ে সাহেব তরতর করে নেমে গেল।
‘বলতে পারিস তোকে দেখেই আমি চলে এলাম এখানে—’
‘এখন ফিলজফি ভাল লাগছে না ব্ৰজদা। অন্য কথা বল।’
‘সত্যি বলছি। বিশ্বাস কর। আমি তোকে জায়গা দেখাতে নিয়ে এলাম। আর তুই কি না কদমপুরে মৌরসীপাট্টা করে বসে গেলি! আমি যে কে সেই কলমিলতা?’
‘আমি কি এমন হয়েছি ব্রজদা? সবাই এই এককথা বলে। তুমি, নগেন, বীরেনের বউরা। অথচ আমি তো আমিই আছি। দোষের মধ্যে শুধু কিছুটা আরাম দরকার হয় আজকাল আমার। ভিড়ের গাড়িতে চড়তে পারি না। বসতে পেলে শুতে চাই—‘
‘এখানে কিন্তু তোকে শুতে দিতে পারব না। কিছু নেই আমার। তবে মনে হয় সব হবে একে একে
‘হওয়া মানে কি মনে কর তুমি?’
ব্রজ খুব বিপদে পড়ল। বলতে গিয়ে দেখল লজ্জা করছে। তবু কোন মতে বলে দিল, ‘ধর আমার বংশধর থেকেও তো নেই। বুড়ো হলে বাবা ডাকতেও আসবে না কোনদিন। তখন আমি—বিশেষ কার তোর বউদি কোথায় যাবে? বাবার আত্মজীবনী লিখলাম। মন্দ কাটছে না! এখন যদি একটা মন্দির কি বিগ্রহের থান করে যেতে পারি—তাহলে কোনদিন ভাবতে হবে না কিছু—। কিন্তু এসবে লাগে প্রচণ্ড ডিটারমিনেশন।’
কুবের দেখল ব্রজ দত্তর চোখের শিরা ফুলে উঠছে। মাথার বাবরি তামার ঢালাই স্তূপ হয়ে থেমে গেছে। কথা ছিল, আজই বিকেলে ভদ্রেশ্বরের সঙ্গে নৌকোয় মেদনমল্ল ভাঙা দুর্গ দেখতে যাবে। নৌকোয় একরাত। ফরসা হতেই চোখের সামনে ভোর ভোর জম্বু দ্বীপ ভেসে উঠবে। জেলেরা সমুদ্রের মাছ মেরে সেখানে ফেলে ফেলে শুকোয়। সপ্তমুখী পেরিয়ে এসব কাণ্ড। ভদ্রেশ্বর জায়গা দেখাতে নিয়ে যাবে।
যাওয়া হল না। ফস করে সন্ধ্যে নেমে গেল। দূরে তাল নারকেলের ঘন আড়াল আরও অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। তার পেছনে বসতির আবছা আবছা লণ্ঠনের আলো এদিক সেদিক আনাগোনা করছে। কেউ হয়ত গোয়ালে গরু তুলে দিচ্ছে। কারও ঢেঁকিঘরের পাশে পুরনো গাদা ভেঙে দু’ তড়পা খড় নামানো দরকার। এঁড়ে বাছুরটা ইদানীং রাত বাড়লে খিদেয় ঘন ঘন পা ঠোকে। দোকায় খড় কুঁচিয়ে দিতে হবে। কত লোকের যে কত কাজ। শুধু কুবের এর ওর খবর কুড়িয়ে কুড়িয়ে বেড়ায়। তার নিজের কোন খবর নেই।
রাতের সিটের লোক এসে যাচ্ছে। মাঠের মাঝখানে খানিক জায়গায় আলো। তার মধ্যে ওভারঅল পরনে এই লোকগুলো মায়াপুরীর পাত্রমিত্র। কাউকে পরিষ্কার চেনা যায় না। ওরই মধ্যে সাহেব মিত্তিরও আছে নিশ্চয়।
ব্রজ দত্ত হাতে গড়া রুটির সঙ্গে চোঙের গায়ে লতানো জঙ্গলের বন ধোঁধলের তরকারি দিয়ে কলাই থালাখানা কুবেরের সামনে সাজিয়ে দিল, ‘খেয়ে ফেল—’
‘তাতো খেলাম। ওদিকে কদমপুরে একটা মানুষ কি খেল না খেল দেখছে কে?’
হাতের পাঁচটা আঙুলে রুটির তাড়া প্লেট হয়ে আছে। তার ওপর গরম তরকারি সাজিয়ে ফুঁ দিচ্ছিল ব্রজদা, ‘তোর খুব চিন্তে হয়? নিয়ে যা না। একটা মানুষ তো মোটে—’,
ব্রজ দত্তর চোখের নীচে কান্না কিংবা হাসিতে—নয়ত নিতান্তই ঠাণ্ডায় খানিক খানিক জায়গা ঝকঝক করে উঠেছে। একেবারে ধরে ফেলার হাসিতে কুবেরকে বললো, ‘তোর তো অনেক পয়সা আছে। রেখে দে না একটা লোককে। মোটে তো একটা মানুষ!
কথাটা খট করে মাথায় লাগল কুবেরের। টিন, নড়বড়ে ইটের থাক দেওয়াল এখুনি তাকে প্রায় ঠেসে ধরার যোগাড় হল। থালায় তখনও একখানা রুটি। একট তরকারি চাইবে ভেবেছিল। প্রবৃত্তি হল না! সামনের লোকটা রুটিতে তরকারিতে চোয়ালে একটা যে কোন বড় গরুর কায়দায় জাবর কাটছে। হঠাৎ থালখানা তুলে ধরল কুবের। দেবে মাথার ওপর এবার ঠাঁই করে বসিয়ে।
‘ওকি? মারবি নাকি?’
‘হ্যাঁ।’
তখনও বিশ্বাস হয়নি ব্রজ দত্তর। এক ঘা বসাতেই তড়াং করে দাঁড়িয়ে উঠল। তারপর কুবেরকে আচমকা চার পাঁচটা ঘুষি মেরে কাবু করে ফেলল। শেষে একটা লাথি দিয়ে এই জোড়াতালি দেওয়া ঘরের কোণে ফেলে দিল, ‘খুব বেড়েছিস?’
আর একটা লাথি মারতে যাচ্ছিল। থেমে গেল ব্রজ। কুবের কোঁকাচ্ছে। কোথায় লাগলরে বাবা। ‘এই কুবের, কুবের—’
ব্রজ একটু ভয় পেয়ে গেল। নীচে ড্রিলিংয়ের একটানা কড় কড় আওয়াজ। তার আস্তানার ভেতরে কুবেরের গোঙানি। বেচারা মুখও ধোয়নি। তার চেয়ে বয়সে ছোট। ইদানীং যে কী হয়েছে ছোকরার। লঘুগুরু জ্ঞান নেই। আচমকা থালা উঁচিয়ে এল কেন?
ড্রিলিং সাইটের কাছাকাছি খালাসীদের তাঁবুতে এক সর্দার নাড়াবুনিয়ার দিশী মোষ পোষে। তার বউকে বলে আধসের দুধ নিয়ে এল ব্রজ। খানিক ফুটিয়ে সাহেব মিত্তিরের উপহারের বোতলটা থেকে কিছুটা বাটিতে ঢেলে দিল, ‘নাও বাছাধন খেয়ে নাও। খেয়ে উদ্ধার কর এখন।’
কুবের উঠে বসে সুস্থ হয়ে উঠল। ব্রজ পেছনে ফিরে ঘরকন্না সাজাচ্ছিল। বাইরে উঠোনে একখানা পাথর পড়ে আছে। সিঁদুর মাখানো। ব্রজ ফকির নাম দিয়েছে রেলেশ্বর শিব। রেল লাইনের পাশেই কুড়িয়ে পেয়েছে সম্ভবত। পূর্ণিমার দিন জাঁকজমক করে প্রতিষ্ঠা হবে। শুধু আভা বউদির এসে পড়ার অপেক্ষা।
এখন ধাঁ করে লাথিটা বসিয়ে দিলেই হয়। তারপর দে ছুট। নইলে, এটুক বুঝেছে কুবের, ব্রজ দত্তর সঙ্গে সে সামনাসামনি পেরে উঠবে না। কিন্তু সে, নিজে নুনের কারবারি হরিরাম সাধুখাঁর বংশধর। যার নুন খেয়েছে একবার তাকে পেছন থেকে ঘা দেয় কি করে। সে যে বড় মুশকিলের ব্যাপার। হঠাৎ খুব মায়া হল কুবেরের। ব্রজ ফকিরের জন্যে মায়ায় তার মন ভরে গেল। চল্লিশ পার হয়েও থিত হয়ে বসতে পারল না কোথাও। এখন বিগ্রহ বসিয়ে থান বানিয়ে বউকে সাজাবে। জটা রাখছে! রুদ্রাক্ষ এনেছে। তেল সিঁদুর মাখাচ্ছে গুচ্ছের আম পাতায়। সামনের আঁটিসার গাছটার ডালপালা বেরিয়ে পড়ল বলে।
সে যে আজ কোথাকার কোন্ জগতে এসে পড়েছে। কত লোভ করে দূরের সাহেব নুনের কারখানা বসিয়েছিল। হয়ত হরিরাম সাধুখাঁর সঙ্গে কারবার করতে গিয়ে আলাপও হয়েছিল। শীতকালের আকাশে ছিটকে ছিটকে তারা খসছে। কোথায় কোন্ মহালোক মরে গেল। আকাশে ট্যাড়া পড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। হয়ত পাঁচ জন্ম আগে সে নিজেই সমুদ্র পার হয়ে এখানে কারখানা বসাতে এসেছিল। কিংবা সৈন্ধব লবণের কারবারে নেমে ভরাডুবির মুখে হরিরামের সন্ন্যাস হয়েছিল। কথা দিয়েছিল সাহেবকে, একদিন তোমার কারখানা দেখে আসব-গোলা ফেলে কোথাও যে ঘুরে ফিরে আসব তার ফুরসত মেলে না। কিছুদিন হল সেই হরিরাম নানা জন্ম ঘুরে ব্রজ ফকির হয়ে কারখানা দেখতে এসেছে। দেখে আর নড়ে না। সেখানে এখন নগর বসবে। ব্রজ দত্ত ঠাকুরতলা নয়ত রেলেশ্বর শিবের খান বানাবে।
বয়স বল, আয়ু বল—এই হল গিয়ে যত নষ্টের গোড়া। জিনিসটা এত কম, এত মাপা—সময় হলে ফুরোবেই। অথচ যে তখন কত কি বাকি পড়ে থাকে। এটা আধখানা, সেটা পুরো, ওটা মাঝামাঝি সে এক আজব হাল! হরিরাম নাকি নুনের বড় বড় চালানের কাগজ পড়তে পড়তে বুকে হাত রেখে তাকিয়ায় হেলে পড়েছিল। তখন গদিতে মাত্র তার ছোট ছেলে ছাড়া কেউ ছিল না।
হারিকেনের আলোয় ইটের পাঁজার ওপর থেকে বাইরে ডাঁই ঘেঁটে কুবের রজনী দত্তর জীবন ও সময় খুঁজে পেল। হাঁটকাতেই বইয়ের ছত্রিশ পাতা খুলে গেল। লাইনের শুরুতেই ব্ৰজদা লিখেছে—
‘আকাশে ইদানীং যেসব মেঘ হইতেছে তাহারা আমার বড় চেনা চেনা ঠেকে মনে হয় গত জন্মে ইহাদেরই সঙ্গে সঙ্গে কত শস্যক্ষেত্রে বৃষ্টি হইয়া ঝরিয়া পড়িয়াছি। রৌদ্র উঠতেই আবার মিলাইয়া গিয়াছি। বিকালের দিকে আষার-শ্রাবণে দুই দিগন্ত রামধনু উঠিবার জন্য জায়গাও করিয়া দিয়াছি। সেই কালের নানা রং ও আমার গায়ে লাগিয়া আছে। তাই স্বপ্ন দেখি। মানুষকে ভালবাসি। ব্রজকে পাই। আশা করি বয়স হইলে ব্ৰজও স্বপ্ন দেখিবে। সন্ধ্যাতারা আমাদের চোখকে দ্বিতীয় তারায় লইয়া যায়। দ্বিতীয় তারা তৃতীয় তারায় পৌছাইয়া দেয়। তৃতীয় তারা আমাদের তারার জঙ্গলে ফেলিয়া পালায়। তখন চারিদিকে হলুদ ছিটানো আগুনের কুচি আমাকে পাগল করিয়া তোলে। ব্রজর গর্ভধারিণী এসবের ধার ধারেন না।’
‘বাটনা বাটতে জানিস? আজ তোকে একটা রান্না খাওয়াবো।’
কুবের ঝপাং করে দশ বছর পিছিয়ে গেল। কুবের দ্য ফ্রিভলাস। কুবের দ্য ভ্যাগাবন্ড। রিজারড্ কুবের। তখন কলকাতার ফুটপাতে করপোরেশনের বকুলগাছ থেকে ফুল ঝরে পড়ে সন্ধ্যের দিকে রুমাল-চাপা গন্ধ দিত। তখন স্যান্ডো গেঞ্জির ওপর ফিমফিনে আদ্দির মোড়কে কুবের সাধুখাঁ কত অল্পে খুশী হয়ে উঠত। গাছের একটা পাতা খসে পড়লে কত মানে খুঁজে পেত তার ভেতর।
‘তারার ডালনা।’
‘মানে?’
‘এই যে লিখেছ। ‘হলুদ ছিটানো আগুনের কুচি।’ তারাগুণতির দেশের কথা—’
‘রাবিশ! বইটা রেখে দিয়ে মাথার ওপর থেকে শুকনো লঙ্কার কৌকোটা দে।’