১১-১২. একটার পর একটা ঘটনা

একটার পর একটা ঘটনা ঘটেই চলেছে নাটকীয় ভাবে। টুপুররা থানায় পৌঁছোতে না-পৌঁছোতে হঠাৎ আশুতোষ শাহের উদয়। তিনি নাকি মিতিনদের পর পরই রওনা দিয়েছিলেন কুলু থেকে। পথে গাড়ির টায়ার পাংচার হওয়ায় এইমাত্র এসে পৌঁছোলেন। মিতিনমাসির সঙ্গে বাক্যালাপে বোঝা গেল, তার নির্দেশেই মণিকরণের পুলিশ আজ তৎপর ছিল। কোথায় কখন কীভাবে পুলিশকে হাজির থাকবে হবে, তাও নাকি এস পি সাহেবকে ফোনে জানিয়ে দিয়েছিল মিতিনমাসি। কুলু ছাড়ার আগেই। শুধু কোন ফাঁকে যে মিতিনমাসি ফোনটা করেছিল, সেটা এখনও টুপুরের অজানা। ইস, কেন যে টুপুর প্রতিটি মুহূর্তে মাসিকে অনুসরণ করতে পারে না!

এখন শুরু হয়েছে আর একপ্রস্থ নাটক। রীতিমতো পিলে চমকানো। তারকুণ্ডে আর ভাটিয়ার ছদ্মবেশ খসিয়ে ফেলেছে পুলিশ, তল্লাশির পালাও শেষ। শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছেন মণিকরণ থানার ও সি সুদেশ বাংরু। তন্নতন্ন করে হাতড়েও তিনি তারকুণ্ডেদের কাছ থেকে ছবিগুলো বের করতে পারেননি।

আশুতোষ শাহ ধমকে উঠলেন, চোর ধরা পড়ল, অথচ তাদের কাছে ছবি নেই, এ হতে পারে?

ওদের বডি পর্যন্ত সার্চ করলাম স্যার। ব্যাগ থেকে শুধু তিন বান্ডিল ডলার মিলেছে। মোট তিরিশ হাজার। গুনে দেখেছি।

এত ডলার পেল কোত্থেকে?

দুটোই খুব পাজি, কিছুতেই মুখ খুলছে না।

সিধে আঙুলে ঘি উঠবে না, আঙুল বেঁকান। রুলের গুঁতো দিন।

সে কি আর বলতে হবে স্যার? কিন্তু দু’জনেই যেন ঠোঁটে তালা লাগিয়েছে।

প্রেশার জারি রাখুন। একদম ঢিলে দেবেন না।

ওকে স্যার।

সুদেশ বাংরু বেরিয়ে যেতেই আশুতোষের গলা থেকে একরাশ হতাশা ঝরে পড়ল, যাঃ, লোক দুটোকে ধরা কি তা হলে বৃথা গেল ম্যাডাম?

মিতিনের কোনও হেলদোল নেই। অবিচলিত স্বরে বলল, তা কেন মিস্টার শাহ? চুরির প্রমাণ তো মিলেছে।

কোথায়?

ডলারগুলো! ছবির বিনিময়ে ওদের যা জুটেছে।

অর্থাৎ ছবিগুলো পাচার করে দিয়েছে বলছেন?

 অবশ্যই। ছবি এখন মূল অপরাধীর জিম্মায়।

সর্বনাশ, তাকে এবার পাব কোত্থেকে?

টেনশন করবেন না, সে বাছাধন এখনও পালায়নি।

মণিকরণেই আছে?

উঁহু। কুলুতে। আপনার বাংলোর এক-দু’ কিলোমিটারের মধ্যেই।

মানে?

পুরোটা জানতে হলে এক্ষুনি যে আমাদের কুলু যেতে হবে মিস্টার শাহ।

ওসির চেয়ারে বসে ছিলেন আশুতোষ। তড়াক লাফিয়ে উঠেও কুণ্ঠিত মুখে বললেন, কিন্তু ম্যাডাম, সন্ধে নেমেছে। অন্ধকারে এখন কুলু যাবেন? তা ছাড়া সারাদিন আপনাদের যা ধকল চলছে…

উপায় নেই স্যার। রাত পোহালেই পাখি উড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।

তাই নাকি? আশুতোষের ভুরুতে ভাঁজ, আপনি শিয়োর, ছবি পাওয়া যাবে?

একশো শতাংশ নিশ্চিত।

কুলুতে ঠিক কোথায় যাবেন বলুন তো?

 বিভব শর্মার ডেরায়।

শুনেই বেজায় চমকেছেন আশুতোষ। পরক্ষণে দৃষ্টিতে একটা জিঘাংসার ভাব ফুটে উঠল, তাই বলুন। শর্মাই তা হলে কালপ্রিট! আমারও লোকটার উপর সন্দেহ ছিল।

মিতিনের ঠোঁটে এক বিচিত্র হাসি। মাথা দুলিয়ে বলল, চলুন তা হলে। আমিও আমার ব্যাটেলিয়ানকে রেডি করে ফেলি।

থানা থেকে বেরোনোর আগে উঁকি দিয়ে একবার তারকুণ্ডেদের দেখে এল টুপুর। অবিকল বৈজনাথের স্কেচের মতো না হলেও চেহারায় অনেকটাই মিল। মুন্ডু ঝুঁকিয়ে গারদে বসে আছে লোক দুটো, সামনে সুদেশ বাংরু কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে।

বুমবুমও গিয়েছিল টুপুরের সঙ্গে। চোখ বড় করে বলল, এরা তা হলে আসল চোর নয়?

উঁহু। এদের একজন বস আছে, আমরা এখন তাকে ধরতে যাব।

মানে কটেজের মালিকটাই?

হ্যাঁ রে।

ঘাড় নেড়ে টুপুর বলল বটে, কিন্তু এখনও তার ধন্দ কাটছে না। সত্যি বলতে কী, মাসির কাজের ধারা এবার যেন কেমন কেমন! ধরে নেওয়া যাক, বিভব শর্মার হাতে ছবি জমা দিয়ে তারকুণ্ডেরা মণিকরণে গা ঢাকা দিতে এসেছিল এবং এখান থেকেই কাসোল টাসোল হয়ে চম্পট দিত দু’জনে। একেবারে হিমাচল প্রদেশের বাইরে। আর সেটা ঠেকাতেই বুঝি মিতিনমাসির তড়িঘড়ি মণিকরণে গমন। কিন্তু ছবিসমেত বিভব শর্মাকে মুঠোয় না পুরে আগে তারকুণ্ডে-ভাটিয়াকে তাড়া করা কেন? পাখি উড়ে যাওয়া ব্যাপারটাই বা কী? বিভব শৰ্মা পালাবেন নাকি? লোকটার মতলব কীভাবে আগাম অনুমান করল মিতিনমাসি? কোনও ক্লু পেয়েছে? সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, ভালমানুষের মুখোশ পরা বিভব শর্মাকে ছবিচুরি-চক্রের পাণ্ডা হিসেবে সন্দেহ করছে, এটাও মিতিনমাসি কাউকে ঘুণাক্ষরে টের পেতে দিল না? উলটে শর্মার হয়ে সাফাই গাইছিল!

এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে তলপিতলপা গুটিয়ে ফের টিঙ্কুর রথে আরোহণ। টুপুররা ফিরছে কুলুতে। সামনে লালবাতি জ্বালিয়ে আশুতোষ শাহের জিপ। পাইলট কারের মতো। কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদও চলেছে সঙ্গে। পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে দর্শন দেয় হঠাৎ হঠাৎ, আবার হারিয়েও যায়। লুকোচুরি খেলছে যেন। জোছনামাখা নির্জনতায় পার্বতীর আওয়াজও বুঝি বেড়ে গিয়েছে চতুগুণ। যেন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে।

বাইরে কনকনে ঠান্ডা। জানলার বন্ধ কাচ বাষ্প মেখে ঝাপসা। টুপুর তবু ওই কাচেই চোখ রেখে বাইরেটা দেখছিল। বাকিরা কেউ ঢুলছে, কেউ বা নিছকই চোখ বুজে বসে। সত্যি তো, একদিনে এত ছোটাছুটি কারও পোষায়! আজই মণিকরণ ছাড়তে হবে শুনে সহেলি তো প্রায় ভেঙে পড়েছিলেন, এখনও তার মুখে সেই অসন্তোষের ছোঁয়া। অবনীর নিশ্চিন্ত ঢুলুনি দেখে রাগটা বুঝি আরও বেড়ে গেল। গুমগুমে গলায় বলে উঠলেন, কুলুতে তো হোটেল মেলার চান্স নেই। সুতরাং আজ নিশ্চয়ই গাড়িতেই রাত্রিবাস?

পার্থ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না না, মিস্টার শাহের সঙ্গে কথা হয়েছে। উনি আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করবেন।

কোথায়? হাজতে?

যাঃ, কী যে বলেন! পার্থ হেসে ফেলল, আমরা উঠব সার্কিট হাউসে। ভি আই পি আস্তানায়। আরামসে ঘুমোতে পারবেন।

সে কপাল কি করে এসেছি! মিতিনের যদি বাই চাপে, তো রাত দুটোয় হয়তো রওনা হতে হল কোথাও!

টেনশন করবেন না দিদি। মিতিনের বায়না আর শুনবই না। রাতটুকু বিশ্রাম নিয়ে কাল আমরা মানালি যাব। যাবই৷

যাকে নিয়ে সহেলির এত গজগজ, সেই মিতিন কিন্তু নিশ্ৰুপ। ঝড়ের আগে আকাশের মতো থমথম করছে তার মুখখানা। গাড়ি কুলুতে ঢোকার পর টানটান হয়ে বসল। বিভব শর্মার কটেজে চার চাকা থামতেই তড়াং নেমেছে। আশুতোষ শাহের সঙ্গে সোজা গেট ঠেলে অন্দরে। পিছনে দমচাপা উত্তেজনা নিয়ে টুপুর আর পার্থ।

আশুতোষকে দেখে বিভব শর্মার মুখ নিমেষে পাংশু। আমতা আমতা করে বললেন, স্যার, আপনি…? ম্যাডামের সঙ্গে…?

ভেবেছেন কী, অ্যাঁ? কুলুর মানুষ হয়ে বদ মতলব আঁটছিলেন? আশুতোষ গর্জে উঠেছেন, বের করুন, বের করুন ছবিগুলো।

ছ-ছ-ছবি… কী ছবি?

ন্যাকা সাজবেন না। আপনি তো নাটের গুরু।

কী বলছেন স্যার? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।

এক মিনিট। আমি বলছি, আশুতোষকে টপকে মিতিন সামনে এল। কেজো গলায় বিভব শর্মাকে বলল, আপনার সেই ইটালিয়ান সাহেবটি এসেছেন?

হ্যাঁ ম্যাডাম। বিকেলেই পৌঁছে গিয়েছেন। সাড়ে চারটে নাগাদ।

এখন তিনি কোথায়?

রুমে। এসেই বললেন তাকে যেন বিরক্ত করা না হয়। রাত দশটায় উনি নীচে নেমে ডিনার সেরে যাবেন।

কোন ঘরটায় আছেন উনি?

 বাঁ দিকেরটায়। কেন ম্যাডাম?

 জবাব না দিয়ে মিতিন আশুতোষকে ডাকল, চলুন। চটপট।

কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে দরজায় টোকা দিল মিতিন। মিনিট দুয়েক পর পাল্লা খুলল। নীলচে চোখ, টকটকে রং, মাঝারি উচ্চতার রবার্তো জোয়ান্নি একবার মিতিনকে দেখলেন, একবার সুট-টাই পরিহিত আশুতোষকে। রুক্ষ স্বরে বললেন, কী চাই?

আপনাকেই, মিতিনের সপ্রতিভ উত্তর, ভিতরে যেতে পারি?

 অবশ্যই না। আমি এখন ব্যস্ত আছি।

কিন্তু আমাদের যে ঢুকতে দিতে হবেই মিস্টার জোয়ান্নি। আপনার ঘরটা তল্লাশ করা যে খুবই জরুরি।

কেন? এবার রবার্তো যেন নাড়া খেয়েছেন। চোখ সরু করে বললেন, কে আপনারা?

আশুতোষ শাহকে দেখিয়ে মিতিন বলল, ইনি কুলু ডিস্ট্রিক্টের সুপারিটেন্ডেন্ট অফ পুলিশ। আমাদের কাছে খবর আছে, আপনি নিকোলাস রোয়েরিখের তিনখানা ছবি চুরি করিয়েছেন। এখন কি মানে মানে ছবিগুলো ফেরত দেবেন? নাকি আমরাই খুঁজে নেব?

রবার্তো মন দিয়ে শুনলেন কথাগুলো। তারপর হঠাৎই হা হা হেসে উঠেছেন, কী আজগুবি অভিযোগ! আমি একজন ভারতপ্রেমী বিদেশি। ওই ধরনের নোংরা কাজ আমি কখনও করতে পারি?

রবার্তোর বাচনভঙ্গিতে আশুতোষ বেশ হকচকিয়ে গিয়েছেন। অস্বস্তি ভরা চোখে তাকাচ্ছেন মিতিনের দিকে। যেন বলতে চাইছেন, মিতিনের কোনও ভুল হয়নি তো?

মিতিন কিন্তু অটল। ভুরু কুঁচকে বলল, আপনি তা হলে রুম সার্চ করতে বাধ্য করছেন?

না-না, আপনারা দেখতেই পারেন। প্লিজ কাম ইনসাইড। আমার সামান্য লাগেজ তো সামনেই পড়ে। খুলে দেখে নিন।

সত্যিই মালপত্র তেমন নেই রবার্তোর। একটা ক্যামেরার ব্যাগ আর একখানা হ্যাভারস্যাক। ঈষৎ দ্বিধা নিয়ে আশুতোষ হাত লাগালেন অনুসন্ধানে। পার্থও। ক্যামেরার ব্যাগ থেকে বেরোল ভাঁজ করা তেপায়া স্ট্যান্ডসহ একটি অতি মূল্যবান ডিজিটাল ক্যামেরা। সঙ্গে খাপে একগুচ্ছ টেলিলেন্স। হ্যাভারস্যাকে রয়েছে সাহেবের জামাকাপড়, বই আর দৈনন্দিন ব্যবহারের কিছু টুকিটাকি। আসল জিনিসগুলো না পেয়ে আশুতোষ খুলে খুলে দেখছেন ওয়ার্ড্রোব, ড্রয়ার, ড্রেসিংটেবিল। পার্থ ছুটল বাথরুমে। সিস্টার্নের ঢাকা, গিজারের মাথা। কিছুই নিরীক্ষণ করতে ভুলল না। টুপুর উঁকি দিল নিভে থাকা ফায়ারপ্লেসের অন্দরে। খাট, বিছানা, সরিয়ে সরিয়েও দেখলেন আশুতোষ। নাঃ, ছবিগুলো কোথাও নেই।

চেয়ারে বসে মিটিমিটি হাসছিলেন রবার্তো। বললেন, এখনও কিন্তু কার্পেট তুলে দেখা হয়নি। আমি কি হেল্প করব?

আশুতোষের মুখ লাল। হিন্দিতে চাপা গলায় মিতিনকে বললেন, এইভাবে আমাকে বেইজ্জত করার কোনও মানে হয়?

মিতিন রা কাড়ল না। আস্তে আস্তে ক্যামেরাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ঘাড় হেলিয়ে রবার্তোকে জিজ্ঞেস করল, আপনি বুঝি প্রফেশনাল ফোটোগ্রাফার?

পুরোপুরি নই। তবে ফোটো তোলা আমার নেশা।

ও, মিতিন তেপায়া স্ট্যান্ডখানা হাতে তুলে নিল, পাহাড়ের ফোটো তুলতেও কি আপনি স্ট্যান্ড ব্যবহার করেন?

কখনও-সখনও করি বই কী। সানরাইজ, সানসেটের সময়ে ওটা খুব কাজে লাগে।

ঝপ করে একটা পায়ার তলায় হাত রাখল মিতিন। চাড় দিয়ে ঘোরাতেই খুলে গিয়েছে পায়া। ভিতরে আঙুল ঢুকিয়ে টেনে বের করল একখানা ছবি। রোল করে পোরা ছিল পায়াটায়।

পাকানো ছবিটা খুলতে খুলতে মিতিন বলল, কায়দাটা ভালই নিয়েছিলেন মিস্টার জোয়ান্নি। কিন্তু শেষরক্ষা হল না।

রবার্তোর মুখ-চোখ পলকে বদলে গিয়েছে। দৃষ্টি দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে যেন। হিংস্র রাগে মিতিনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলেন, ত্বরিত পায়ে সরে গেল মিতিন। সঙ্গে সঙ্গে আশুতোষের হাতে উঠে এসেছে রিভলভার। সেফটি ক্যাচ তুলে দিয়ে বললেন, ডোন্ট মুভ। একচুল নড়লে গুলি করতে বাধ্য হব।

ক্যামেরা স্ট্যান্ডের বাকি দুটো পায়া থেকে মিতিন বের করল আরও দু’খানা পেন্টিং। তার হাতে যেন এখন তিন টুকরো হিমালয়। জলরঙে আঁকা। প্রতিটি ছবির তলায় নিকোলাস রোয়েরিখের স্বাক্ষর।

মিতিন বিদ্রুপের সুরে বলল, রাতটা আর সকাল হল না মিস্টার জোয়ান্নি। ভুন্টার থেকে কাল ভোরের ফ্লাইট আপনাকে ছাড়াই উড়বে। শুনে কষ্ট পাবেন, তিরিশ হাজার ডলার সমেত আপনার দুই এজেন্টও এখন পুলিশের হেফাজতে।

রবার্তো জোয়ান্নি ধপ করে বসে পড়লেন চেয়ারে। তার কাঁধ দু’খানা ঝুলে গিয়েছে।

.

১২.

রোটাং পাসের পথ যথেষ্ট দুর্গম। রাস্তাটা অসম্ভব খাড়াই এবং বেশ ভাঙাচোরা। টিঙ্কুর প্রাণপণ চেষ্টাতেও গতি বাড়ছিল না, গোঁক গোঁক করছে গাড়ি। একটা করে বাঁক পেরোয়, চরকি খেয়ে যায় মাথা। একই সঙ্গে খুলে যায় হিমালয়ের নব নব রূপ।

অবশেষে কাল বিকেলে মানালি পৌঁছেছে টুপুররা। উঠেছে একটি চমৎকার হোটেলে। হিড়িম্বা টেম্পলের কাছে। আবার ম্যাল, বিপাশাও দূরে নয়। ঘরের জানলা খুললেই পিছনে এক আপেল বাগান। লাল আভা মাখা। সোনালি আপেল গাছ থেকে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে মাটিতে। তার ওপারে হিমালয়। সার সার বরফে ঢাকা চুড়ো যেন পাহারা দিচ্ছে সুন্দরী মানালিকে। এসেই কাল রাতে টুপুররা গিয়েছিল বিপাশার পারে। সেও এক মনোহর অভিজ্ঞতা। চাঁদের কিরণে ঝিকঝিক করছে বিপাশা। যেন কুচি কুচি হিরে ভাসছে স্রোতে। জ্যোৎস্না মেখে বরফে ঢাকা পাহাড়ও কী স্নিগ্ধ তখন।

মানালি আসার পথে টুপুরদের আর একবার যেতে হয়েছিল নজ্ঞর। আশুতোষ শাহ আর কিষানলাল দুগগারের সনির্বন্ধ অনুরোধে। এমন চর্বচোষ্য খাওয়া হল, পার্থমেশোর প্রায় হাঁসফাঁস দশা। মিতিন উপহার পেল স্থানীয় শিল্পীর আঁকা হিমালয়ের একখানা ছবি। কিষানলাল নাকি রোয়েরিখ মেমোরিয়াল ট্রাস্টে আবেদনও রেখেছেন, নিকোলাসের পেন্টিং উদ্ধারের জন্য যেন একটা সম্মানজনক পারিশ্রমিক দেওয়া হয় মিতিনকে। থার্ড আইয়ের কার্ডও রেখে দিলেন কিষানলাল। আর আশুতোষ শাহ উদ্যোগ নিয়েছেন মিতিনকে একটা সংবর্ধনা জানানোর। হিমাচল প্রদেশ সরকারের তরফ থেকে। সম্ভবত ফেরার সময়ে টুপুরদের আর একবার থামতে হবে কুলুতে।

সে যাই হোক, সকলেরই মন আজ খুশিতে ঝলমল। পথের কষ্ট কেউ গায়েই মাখছেন না। সহেলি পর্যন্ত ঠাট্টা-ইয়ারকি জুড়েছেন অবনীর সঙ্গে। বুমবুমও আজ মোবাইল গেমে মত্ত নয়। হিমালয়ের এমন অমোঘ টান, সেও মোহিত হয়ে দেখছে পাহাড়-পর্বত।

পার্থ নিজের জায়গায়। সামনের সিটে। ঝাঁকুনি খেতে খেতে একটু আগে গান ধরেছিল, আকাশভরা সূর্যতারা। তার বেসুরো গলা শুনে টিঙ্কুও হেসে খুন। সংগীত ছেড়ে পার্থ এবার মজায় মেতেছে। হঠাৎই টুপুরকে বলল, তোর মাসির কিন্তু হেভি ক্যালি। হিমালয়ে এসেও একটা কেস জুটিয়ে ফেলল তো!

টুপুর বলল, মেন ক্রেডিটটা কিন্তু বুমবুমের। ভাগ্যিস ও পেনড্রাইভখানা পেয়েছিল!

আরে, শুধু পেনড্রাইভেই হয়? ওই পেনড্রাইভ খেলিয়ে খেলিয়ে কেমন একটা কেস বানিয়ে নিল। সেটা একবার ভাব। সাধে কি বলি, তোর মাসির মাথায় জিলিপির প্যাঁচ!

টুপুর হি হি হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, একটা প্রশ্ন কিন্তু তোমায় করা হয়নি মাসি।

মিতিন স্মিত মুখে বলল, কী রে?

ওই জোয়ান্নি সাহেব তোমার সন্দেহের তালিকায় ঢুকলেন কীভাবে? বিভব শর্মার কটেজে আসছেন শুনেই কি…?

ঠিক তা নয় রে। নামটা মাথায় রয়ে গিয়েছিল। আর্ট গ্যালারির রেজিস্টারে পেশাদার ফোটোগ্রাফারদের তালিকায় ওই নামটা চোখে পড়তে সন্দেহ দানা বাঁধে। তারপর যেই শুনলাম, তারকুণ্ডেদের ঘরভাড়া ক্রেডিট কার্ডে মেটানো হয়েছে, তখনই বুঝলাম, অন্য কেউ টাকা পাঠিয়েছে। কারণ, অত টাকা দেওয়া তারকুণ্ডেদের পক্ষে সম্ভব নয়। অন্তত তাদের স্টেটাস তাই বলে। পরে তো বিভব শর্মার কাছ থেকে বিল নিয়ে দেখা গেল, ওদের আর রবার্তো জোয়ান্নির ক্রেডিট কার্ডের নম্বর এক।

হ্যাঁ। মিস্টার শাহ তো দুখানা স্লিপই সিজ করলেন।

তারকুণ্ডে-ভাটিয়ার সঙ্গে রবার্তোর যোগাযোগের ওটাই তো মোক্ষম প্রমাণ রে।

আলোচনার মাঝে সহেলি ধমকে উঠেছেন, অ্যাই, তোরা কেসের গপপো থামাবি? এমন সুন্দর প্রকৃতির মাঝে চোর-ছ্যাঁচোড় নিয়ে বকর বকর ভাল লাগে?

হক কথা। টুপুর থেমে গেল। হেঁচকি তুলে টুপুরদের গাড়িও থেমেছে। রোটাং পাসের মাথায়।

গাড়ি থেকে নামল টুপুর। সঙ্গে সঙ্গে কনকনে হাওয়ার প্রবল ঝাপটা। গিরিপথ বেয়ে কী জোর বাতাস বইছে রে বাবা! ঝটিতি কুলু-টুপিতে টুপুর ঢেকেছে কান-মাথা। গলা পর্যন্ত টেনে দিল ফুলহাতা পশম জ্যাকেটের জিপার। তবু যেন বাধা মানছে না, হাড়ে গিয়ে বিঁধছে হিমকণা।

টুপুর কোনওক্রমে স্থিত করল নিজেকে। অমনি চোখ জুড়ে এক অনবদ্য দৃশ্য। দু’সারি পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে কত দূর যে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে গিরিপথ! ওই পথ দিয়েই বুঝি একসময় বাণিজ্যে যেত বণিকের দল! ওই রাস্তা দিয়েই কত যে মানুষ প্রথম পা রেখেছে ভারতের মাটিতে!

ভাবতে গিয়ে দুম করে নিকোলাস রোয়েরিখকে মনে পড়ল টুপুরের। নিকোলাস সাহেব এইসব রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। পায়ে হেঁটে। পাহাড়কে ভালবেসে রয়ে গিয়েছিলেন এই দেশে। আর এই হিমালয়কেই তিনি এঁকে গিয়েছেন জীবনভর।

হায় রে, কেন যে রবার্তো জোয়ান্নিরাও আসে এই দেশে!

***