০৫-৬. কেলেঙ্কারি কাণ্ড

পার্থ নেমে দেখতে গিয়েছিল। উত্তেজিত মুখে ফিরেছে। বিস্ফারিত চোখে বলল, কেলেঙ্কারি কাণ্ড! কাল রাত্তিরে নাকি চোর এসেছিল আর্ট গ্যালারিতে।

সহেলি প্রায় আঁতকে উঠেছেন, কী সর্বনেশে কথা! এখানে চোর ছ্যাঁচোড় আছে নাকি?

মন্দ লোক কোথায় নেই দিদি? মিতিন থামাল সহেলিকে। পার্থকে জিজ্ঞেস করল, কীভাবে বোঝা গেল? দরজা-জানলা কিছু ভেঙেছে?

হ্যাঁ। পিছনের একটা জানলা। শুধু কাচ নয়, লোহার গ্রিলও নাকি কেটেছে।

রাতে পাহারা ছিল না?

থাকে তো। আর্মড গার্ড। তার নাকি রাত আটটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত ডিউটি। সকালে যার ডিউটি সে নাকি এসে রাতের গার্ডটাকে দেখতে পায়নি। এপাশে-ওপাশে খুঁজছিল, তখনই আবিষ্কার করে ভাঙা জানলাটা। ভয় পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে এখানকার কর্তাকে জানায়। তিনি এসে পুলিশে ফোন করেন। তারপর পুলিশ চারদিক তন্নতন্ন করে খুঁজতে গিয়ে দেখতে পায় লোকটাকে। একটা ঝোপের মধ্যে হাত-পা-মুখ বাঁধা অবস্থায়।

ও, মিতিন একটুক্ষণ ঝুম মেরে রইল। ফের প্রশ্ন করেছে, তা কী-কী খোওয়া গিয়েছে?

সেটাই তো ভারী অদ্ভুত। এখানকার ম্যানেজারসাহেব নাকি গ্যালারি ঘুরে দেখেছেন। কিছুই নাকি চুরি যায়নি।

তাই বুঝি? চোর তা হলে এল কেন?

গড নোজ। পুলিশও তো অবাক।

কে বলল তোমায় এত সব?

সিকিওরিটির লোক। সে বেচারা তো ঘাবড়েছে জোর। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জানতেহল। ভিতরে নাকি পুলিশের বড় অফিসার আছেন। ম্যানেজারসাহেবের সঙ্গে তার বাতচিত চলছে এখন, পার্থ কাঁধ ঝাঁকাল, আর কী, গ্যালারি আজ বন্ধ। চলো, আমরাও কাটি।

অবনী হতাশ গলায় বললেন, ছবিগুলো তা হলে দেখা যাবে না?

উপায় নেই অবনীদা। ওরা নাকি ভিজিটর অ্যালাউ করছে না। আমাদের আগে তিন-চারটে গাড়ি এসেছিল, তারাও ব্যাক করেছে।

হুম, মিতিন আবার ভাবল দু’-এক সেকেন্ড। ভুরুতে ভাঁজ ফেলে বলল, আমি একবার ট্রাই নিয়ে দেখব?

লাভ নেই। চৌকাঠও পেরোতে পারবে কিনা সন্দেহ।

তবু দেখি, এসো তো সঙ্গে।

দোতলা বাড়িটার দিকে এগোল মিতিন। টুপুর-পার্থও চলেছে পিছু পিছু। যেতে যেতে বাড়িটাতে চোখ বোলাচ্ছিল টুপুর। বেশ বড়সড়ই। পুরনো, তবে বোঝা যায় রক্ষণাবেক্ষণ ভাল। বারান্দায় উঠেই প্রকাণ্ড দুয়ার। বন্ধ। মাথায় প্লেট সাঁটা নিকোলাস রোয়েরিখ হল। তিন-চারজন উর্দিধারী ঘোরাফেরা করছে বারান্দায়, তাদের গ্রাহ্যের মধ্যে না এনে মিতিন সোজা অফিসের দরজায়।

গলা বাড়িয়ে মিতিন বলল, মে আই কাম ইন?

হোয়াই? অন্দর থেকে ইংরেজিতেই পালটা প্রশ্ন উড়ে এল, দেখতে পাচ্ছেন না, আমরা এখন ব্যস্ত?

সেই জন্যই তো আসতে চাই। আমি বোধহয় আপনাদের কিঞ্চিৎ সাহায্য করতে পারি।

তাই নাকি? স্বরটা খানিক নরম হল, আসুন।

 ছিমছাম আধুনিক অফিসঘর। কাচের টেবিল, কম্পিউটার, রিভলভিং চেয়ার শোভিত। দেওয়ালে বেশ কয়েকটা ফোটোগ্রাফ। তিন দাড়িওয়ালা সাহেব, এক স্বর্ণকেশী মেম আর রূপসি দেবিকারানি। টুপুর আন্দাজে বুঝে নিল, কালো টুপি পরা সাধু সাধু চেহারার মানুষটি নিশ্চয়ই নিকোলাস রোয়েরিখ। বাকি দু’জন সম্ভবত তার ছেলে, সোনালি চুল শ্বেতাঙ্গিনী নিকোলাসের স্ত্রী হেলেনা।

ঘুরনচেয়ারে কপালে হাত চেপে বসে মধ্যবয়সি ম্যানেজার সাহেব। উলটো দিকে এক আই পি এস। ফরসা শক্তপোক্ত চেহারা, সরু গোঁফ, নিখুঁত কামানো গাল, বয়স বছর চল্লিশ। তিনিই ভারী গলায় বললেন, শুনি আপনাদের বক্তব্য।

একটু সময় লাগবে, মিতিন ঠোঁটে হাসি হাসি ভাব ফোটাল, বসতে পারি?

নিশ্চয়ই।

শুধু মিতিন নয়, পার্থ-টুপুরও ঝুপঝাপ বসল চেয়ারে। গলা ঝেড়ে মিতিন বলল, আমার নাম প্রজ্ঞাপারমিতা মুখোপাধ্যায়। সঙ্গে আমার হাজব্যান্ড আর বোনঝি। বাইরে গাড়িতে আমার দিদি-জামাইবাবু আর ছেলে রয়েছে। আমরা কুলু-মানালি বেড়াতে এসেছি।

ওকে। ওয়েলকাম টু আওয়ার ভ্যালি। আমি কুলুর এস-পি আশুতোষ শাহ। নাউ প্রসিড।

শুনলাম, কাল রাতে কে বা কারা এই গ্যালারিতে হানা দিয়েছিল?

 আশুতোষ যেন পলক জরিপ করলেন মিতিনকে। কেটে কেটে বললেন, ইয়েস। থ্যাঙ্ক গড, কিছু চুরি যায়নি। তবে ঘটনাটায় আমরা বিশেষ বিচলিত।

আমিও। কারণ আমার মনে হচ্ছে, আপনাদের ধারণাটা সঠিক নয়।

 মানে?

এক সেকেন্ড, বলেই ঝটাক ঢাউস ব্যাগখানা খুলল মিতিন। পেনড্রাইভটা বের করে আশুতোষকে বাড়িতে দিয়ে বলল, আপনি কি এটা একটু চালাবেন?

কী আছে এতে?

প্লিজ, একবার ওপেন করে দেখুন।

ম্যানেজারকে পেনড্রাইভখানা দিলেন আশুতোষ। অন করা হল কম্পিউটার। যথাস্থানে পেনড্রাইভ লাগানোর পর ছবির ঝাঁক ফুটে উঠেছে মনিটরে।

ম্যানেজার বিস্মিত স্বরে বললেন, এ তো নিকোলাস সাহেবের পেন্টিং।

গ্যালারিতে নিকোলাস সাহেবের ক’টা পেন্টিং আছে?

সাঁইত্রিশটা।

 এখানে দেখুন, সাঁইত্রিশখানা ছবিই আছে।

 হ্যাঁ তো! তাই তো!

ভাল করে লক্ষ করুন। সাঁইত্রিশটার মধ্যে তিনখানা আলাদা ভাবে চিহ্নিত করা আছে। উইথ ক্রস মার্কস।

হ্যাঁ, আছে।

আপনি কি অনুগ্রহ করে ওই তিনটে পেন্টিং আর একবার চেক করে আসবেন? পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে?

ম্যানেজার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখে তাকিয়ে। একবার মিতিনকে দেখছেন, একবার আশুতোষকে। ঢোঁক গিলে বললেন, আপনি কী সন্দেহ করছেন, ম্যাডাম?

দেখে আসুন না, প্লিজ।

আশুতোষ উঠে দাঁড়িয়েছেন। ম্যানেজারকে বললেন, চলুন, আমিও যাচ্ছি সঙ্গে।

দু’জনে বেরিয়ে যেতেই পার্থ নিচু গলায় বলল, জোর একটা ঢিল ছুড়ে দিলে তো! লাগে তুক, না লাগে তাক!

না স্যার। দুইয়ে দুইয়ে চারই হয়, পাঁচ নয়।

এক মিনিট গেল, দু মিনিট, চার মিনিট। চোরা টেনশনে ছটফট করছিল টুপুর। বসে থাকতে পারল না, উঠে গিয়ে ফোটোগ্রাফগুলো দেখছে কাছ থেকে। পরিচয় দেওয়া আছে ফোটোর তলায়। জন্ম-মৃত্যুর তারিখও। জানা গেল নিকোলাসের বড় ছেলের নাম ইউরি।

টুপুর চাপা গলায় মিতিনকে জিজ্ঞেস করল, ইউরিও কি পেন্টার?

না। উনি ছিলেন মহাপণ্ডিত। এশিয়া আর ইউরোপের মোট তিরিশখানা ভাষা জানতেন। সংস্কৃত আর তিব্বতি ভাষায় ইউরির লেখা ডিকশনারিও আছে।

ফ্যামিলিটা হেভি তো! প্রত্যেকেই রত্ন!

তবে বাবাই সবার সেরা। কাল রাত্তিরে ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখছিলাম, নিকোলাস রোয়েরিখ শুধু চিত্রশিল্পী নন, দার্শনিক, কবি, লেখক ও ভূপর্যটক। মধ্য এশিয়া থেকে এই হিমালয়, এরিয়াটার মধ্যে উনি প্রায় বারো হাজার মাইল হেঁটেছেন।

পার্থ বলল, আমিও একটা ইন্টারনেটের ইনফরমেশন দিতে পারি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্মারকচিহ্নগুলো রক্ষা করার জন্য নিকোলাস রোয়েরিখ একটা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। পরে ওই ব্যাপারে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়। রোয়েরিখ প্যাক্ট।

টুপুর বলল, সত্যি, কুলুতে না এলে এত খবর…

বাক্য শেষ হল না। হুড়মুড়িয়ে ঢুকেছেন ম্যানেজার। প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, গজব হো গয়া! গজব হো গয়া!

মিতিন তাড়াতাড়ি বলল, শান্ত হন স্যার। কী দেখলেন বলুন?

ওই তিনখানা ছবি বদল হয়ে গিয়েছে! পিছন থেকে ফ্রেম খুলে আসলি পেন্টিং হটিয়ে নকলি ছবি পুরে দিয়ে গিয়েছে শয়তানরা। আমি এখন কী করি? আমি এখন কী করব? ও, আমার সুইসাইড করতে ইচ্ছে করছে।

আহা, আপনি ভেঙে পড়লে তো চলবে না। মন শক্ত করে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা স্থির করুন।

আশুতোষ শাহ দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আস্তে আস্তে চেয়ারে এসে বসলেন। তীক্ষ্ণ চোখে দেখছেন মিতিনকে। খর গলায় বললেন, আপনি পেনড্রাইভটা কোত্থেকে পেয়েছেন?

হাতে এসে গেল, মিতিন নিরুত্তাপ, চান্স অকারেন্স।

 জবাব ঠিকঠাক পেলাম না। খুলে বলুন।

কুলুর এক প্রাইভেট কটেজে। যেখানে আমরা উঠেছিলাম। আগে যারা ছিল, তারা ফেলে গিয়েছিল। সম্ভবত ভুল করে।

পেনড্রাইভ দেখে আপনি বুঝে ফেললেন, এখানে ছবি চুরি হবে?

না। তবে একটা কোনও গড়বড় হতে চলেছে, এমনটা আমি অনুমান করেছিলাম।

আশ্চর্য অনুমানশক্তি তো আপনার! আশুতোষের গলায় শ্লেষ, আপনি কী করেন বলুন তো? সি বি আই-টি বি আইতে আছেন নাকি?

উঁহু। তবে প্রায় ওই ধরনেরই কাজ, মিতিন ব্যাগ থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে দিল, এতে আমার পেশা লেখা আছে।

কাৰ্ডখানায় চোখ রেখে থমকেছেন আশুতোষ। বিড়বিড় করে বললেন, ডিটেকটিভ এজেন্সি? থার্ড আই? আপনি চোর-ডাকাত ধরে বেড়ান?

রহস্যের সমাধানও করি, মিতিন আলতো হাসল, তবে পদে পদে আপনাদের সাহায্য তো লাগেই। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অনেক অফিসারের সঙ্গেই আমায় যোগাযোগ রাখতে হয়। আমাদের গোয়েন্দা বিভাগের আই জি অনিশ্চয় মজুমদার তো আমায় অত্যন্ত স্নেহ করেন। আমার মোবাইলে ওঁর নাম্বার আছে, কথা বলে দেখবেন?

না-না, প্রয়োজন নেই, আশুতোষের মুখের কাঠিন্য অনেকটা কেটেছে। কী একটা ভাবলেন যেন। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, এনিওয়ে, আপনাকে ধন্যবাদ। ভাগ্যিস পেনড্রাইভটা আপনার হাতে পড়েছিল! নইলে ছবির বদল তো ডিটেক্টই হত না!

হ্যাঁ। পাকা হাতের নকল তো, চট করে তফাত বোঝা দায়।

আপনি জানলেন কী করে? আপনি তো নকল ছবি দেখতে যাননি?

কারণ ছবিগুলো যিনি কপি করেছেন, তাকে আমি চিনি। তার হাতের কাজ আমি দেখেছি। তাকে যে ছবিগুলো আঁকতে দেওয়া হয়েছিল, তাও আমি জানি।

কে তিনি?

এখানকারই এক আর্টিস্ট। কুলুর শাস্ত্রীনগরে বাড়ি। নাম বৈজনাথ রাই।

আপনি তাঁর সন্ধান পেলেন কীভাবে?

সংক্ষেপে বৈজনাথের কাহিনিটা আশুতোষকে বলল মিতিন। শুনে আশুতোষ মহা উত্তেজিত। বললেন, জব্বর একটা ক্লু দিয়েছেন তো! এক্ষুনি আমি বৈজনাথকে পাকড়াও করছি।

মিতিন বলল, কেন? কোন গ্রাউন্ডে?

যে লোকগুলো চুরির সাসপেক্ট, উনি তাদের নকল ছবি সাপ্লাই দিয়েছেন। এটাই তো যথেষ্ট কারণ।

কিন্তু বড় বড় পেন্টারের ছবি কপি করা তো কোনও অপরাধ নয়।

হতে পারে। তবে সেই ছবি যখন কোনও গ্যালারিতে আসলের জায়গায় ঠাঁই পায় গ্যালারির কর্তাদের অগোচরে, তখন সেটা আর আদৌ নির্দোষ থাকে কি? তা ছাড়া বৈজনাথকে ধরে আনার আর একটা যুক্তিও আছে। পেটে চাপ দিলে ভুসভুস করে দুই চোরের হদিশ বেরিয়ে আসতে পারে।

আমি কিন্তু যতটুকু দেখেছি, বৈজনাথকে আমার খুব একটা সন্দেহজনক মনে হয়নি। ইচ্ছে হলে তাকে গ্রেপ্তার করতেই পারেন। তবে তার আগে কি লোক দুটোকে চেজ করা বেশি জরুরি নয়? মিতিন সোজা হয়ে বসল, চুরি তো হয়েছে সেই রাত্তিরবেলা, তাই না?

হ্যাঁ। দুটো নাগাদ। যদি সিকিওরিটি গার্ডের জবানবন্দি সঠিক হয়।

কেন মিস্টার শাহ? তার কি ভুলভাল স্টেটমেন্ট দেওয়ার সম্ভাবনা আছে?

বিলক্ষণ। আতঙ্কে তার যা জবুথবু দশা! কিছুই তো তার মুখ দিয়ে বেরোয় না। প্রচুর ধমকে-ধামকে, বাবা-বাছা করে, জানা গেল, একটা শব্দ শুনে সে নাকি ওই সময় গ্যালারির পিছন দিকে দৌড়েছিল, তখনই দুটো লোক তার উপর ঝাঁপায়। তারপর তার হাত-পা-মুখ বেঁধে, শখানেক মিটার তফাতে এক ঝোপে ফেলে দেয়। ওই গার্ডের কথার উপর নির্ভর করে একেবারে ঠিকঠাক সময়টা কি বোঝা সম্ভব?

তাও যদি সময়টা রাত তিনটে বা রাত একটাও হয়, তা হলেও তো ন’-দশ ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে। চোর দুটো পালানোর জন্য কত সময় পেয়ে গিয়েছে ভাবুন!

হুম! আশুতোষের কপালে মোটা ভাঁজ পড়ল, যদি মান্ডি পৌঁছে গিয়ে থাকে, তা হলে তো আমার নাগালের বাইরে। মান্ডি থেকে সিমলা, চণ্ডীগড়, কাংড়া ভ্যালি, যেদিকে খুশি পালাতে পারে।

তা হলে উপায়?

নাক কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড ভাবলেন আশুতোষ। ঠোঁট ছুঁচলো করে বললেন, সনাতন পদ্ধতিতে এগোই। এখনই চারদিকে মেসেজ পাঠিয়ে দিচ্ছি। এমনকী চণ্ডীগড়েও।

রোটাং পাস? ওদিক দিয়েও তো…

 হ্যাঁ। কেলংকেও জানাব। সর্বত্র রেড অ্যালার্ট জারি হয়ে যাক। পথে প্রতিটি গাড়ি চেক করুক পুলিশ, আশুতোষের চোয়াল শক্ত হল, আর ব্যাটারা যদি কোনও ভাবে কুলুভ্যালিতে থাকে, তা হলে তো আমার মুঠোয়। বেরোনোর সব রাস্তা সিল করে দিচ্ছি। বাই দা বাই, লোক দুটোর যেন কী গাড়ি?

মারুতি ভ্যান।

কালার? নম্বর?

 সেগুলো তো বিভব শর্মা, মানে কটেজের মালিক বলতে পারবেন।

তার নম্বর আপনাদের কাছে আছে?

কার্ড আছে।

দিন। লোকাল টিভি চ্যানেলকেও খবর পাঠাচ্ছি, আধ ঘণ্টা পর পর যেন নিউজটা প্রচার করে।

লোক দুটোর আইডেন্টিটি কিন্তু আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। শুধু নামটুকু যা আছে। সেটাও ফলস হতে পারে।

নো প্রবলেম। বিভব শর্মার সঙ্গে কথা বলছি। বাছাধনদের ছাড় নেই।

পালানোর আর একটা পথও কিন্তু আছে মিস্টার শাহ। ভুন্টার এয়ারপোর্ট।

সেখানেও নির্দেশ চলে যাচ্ছে। এখন অবশ্য আর ফ্লাইট নেই। সকালের ফ্লাইটে যদি না পালিয়ে থাকে। এনিওয়ে, দেখছি।

মিতিনের থেকে কার্ডটা নিয়ে তড়াক চেয়ার ছাড়লেন আশুতোষ। দ্রুত পায়ে বেরোচ্ছেন বাইরে। মিতিন প্রায় পিছন পিছন দৌড়োল, মিস্টার শাহ, একটা অনুরোধ ছিল।

আশুতোষ ঘুরে তাকালেন, বলুন?

যদি ভাঙা জানলার ওদিকটা একটু সরেজমিন করি, আর সিকিওরিটিটার সঙ্গে একবার কথা বলি?

খুব কৌতূহল হচ্ছে নাকি?

বোঝেনই তো, ধান না ভানলে ঢেঁকির শান্তি হয় না!

আশুতোষ হেসে ফেললেন, ওকে। দেখুন ঘুরে ঘুরে।

.

০৬.

রোয়েরিখ শিল্প প্রদর্শনশালার সামনের প্রাঙ্গণে এখনও পুলিশের জটলা। অদূরে টুপুরদের গাড়ি। ফাঁকা। অবনী, সহেলি, বুমবুম, কেউ নেই। গেলেন কোথায় সকলে?

খানিকটা তফাতে পুলিশ জিপের ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলছিল টিঙ্কু। ভিতর থেকে টুপুরদের বেরিয়ে আসতে দেখে এগিয়ে এসেছে। ঘাড় চুলকে বলল, বড়াসাবরা সকলে উপরে গিয়েছেন। মিউজিয়াম দেখতে।

পার্থ জিজ্ঞেস করল, উরুসবতী?

হাঁ জি৷ উধার ভি বহুত বড়িয়া বড়িয়া চিজ আছে।

কতক্ষণ গিয়েছেন?

আধা ঘণ্টা, টিঙ্কু ঘড়ি দেখল, এই গ্যালারি তো আজ আর খুলবে না। ওদের ডেকে আনব? এখন রওনা দেবেন?

একটু পরে। আমরা আরও খানিকক্ষণ এখানে থাকছি।

টিঙ্কুর চোখে-মুখে পলকা বিস্ময়। তবে কোনও প্রশ্ন করল না।

 মিতিন পার্থকে বলল, তুমিও মিউজিয়ামটা ঘুরে আসবে নাকি?

কতটা উঠতে হবে?

বোধহয় এক-দুশো মিটার। চাইলে যেতে পারো। আমি ততক্ষণ এদিকে…

আমাকে ভাগাতে চাইছ?

তা কেন? ভাবছিলাম, না দেখে পরে যদি আফশোস করো!

 তুমি যাবে না?

তোমাদের মুখে ডিটেলে শুনে নেব।

বুঝলাম। তুমি কেসটায় ভিড়তে চাইছ!

 ঠিক তা নয়। জাস্ট একটু বোঝার চেষ্টা। কীভাবে কী ঘটল।

বেড়াতে বেরিয়ে মিছিমিছি বখেড়ায় ঢুকছ৷ করো যা খুশি।

 ঈষৎ অপ্রসন্ন মুখে পার্থ চলে গেল। দেবদারু আর পাইনে ছাওয়া উপরে ওঠার রাস্তাটা ধরেছে। মিতিন হাসল মৃদু। টুপুরকে বলল, দাঁড়া এক সেকেন্ড। ম্যানেজারসাহেবকে ডেকে আনি।

টুপুর মনে মনে বেজায় খুশি। পার্থমেসোকে সরিয়ে তাকে সঙ্গে রাখল মাসি! অর্থাৎ কিনা তাকেই মিতিনমাসি সত্যিকারের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাবছে! কিন্তু লোক দুটোকে মাসি এখন ধরবে কী করে? পুলিশই বা কোথায় কোথায় ধাওয়া করবে? নিজের বাহনে বসে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে চতুর্দিকে নির্দেশ পাঠাচ্ছেন আশুতোষ শাহ। তবে তাতেই কি সাফল্য মিলবে? এমন তো হতে পারে, লোক দুটো মারুতি ভ্যানখানা ছেড়ে দিয়েছে! বাসে বা অন্য কোনও উপায় যদি ধাঁ মেরে থাকে?

ভাবনার মাঝেই মিতিনের পুনরাগমন। ভীত-সন্ত্রস্ত ম্যানেজার সাহেবসহ। টুপুরকে ডেকে নিয়ে তার সঙ্গে গ্যালারির পিছন পানে চলল মিতিন। হাঁটতে হটতে ভদ্রলোককে বলল, আপনার নামটা কিন্তু এখনও জানা হয়নি স্যার।

আমি কিষানলাল দুগগার।

কত দিন গ্যালারির চার্জে আছেন?

তা প্রায় ষোলো বছর। শুধু আর্ট গ্যালারি নয়, পুরো হল, এস্টেটটারই আমি দেখাশোনা করি। এখানকার ট্রাস্টি বোর্ড আমাকে নিয়োগ করেছেন, কিষানলাল জোরে শ্বাস ফেললেন, এর আগে কখনও এরকম বাজে ঘটনা ঘটেনি। ট্রাস্টি বোর্ডকে যে আমি কী কৈফিয়ত দেব?

ইন্টারনেটে দেখছিলাম, বোর্ডে নাকি অনেক বিদেশিও আছেন?

হ্যাঁ। নানান দেশের। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি, স্পেন, চিন, জাপান। শুরুতে তো বোর্ডে দু’জন বাঙালিও ছিলেন। জগদীশচন্দ্র বসু আর রবীন্দ্রনাথ টেগোর।

টুপুর চমৎকৃত। বলল, ও বাবা, এ তো তা হলে সত্যিই বিশাল ব্যাপার!

অবশ্যই।

এক প্রকাণ্ড সিডার গাছের কাছে এসে থামলেন কিষানলাল। টুপুরকে বললেন, ওই পাথরের মূর্তিগুলো দেখছ, এঁরা কুলুর রক্ষক। স্থানীয় মানুষদের এরকমই বিশ্বাস, কালী, কার্তিক, নরসিংহ, সকলেই কুলুর অভিভাবক। ঘোড়ার পিঠে মূর্তিটা গুগা চহ্বাণের। ইনি সমস্ত দেবতাদের নেতা। এখানকার ভাঙাচোরা মন্দির থেকে নিকোলাস সাহেব মূর্তিগুলো সংগ্রহ করে এনেছিলেন। পুরোহিত এসে এখনও প্রতিদিন পুজো করেন, শাঁখ বাজান, মূর্তিতে চন্দন লেপেন।

কথায় কথায় একটু যেন সহজ হয়েছেন কিষানলাল। খোলামেলা মন্দিরখানা পেরিয়ে পায়ে পায়ে বাড়িটার পিছনে পৌঁছেছেন। সামনেই একটা গ্যারাজ, দেখে মনে হয় সারানো হয়েছে সম্প্রতি। গ্যারাজের ঠিক পরেই। কাচভাঙা জানলা।

মিতিন আঙুল তুলে বলল, ওটাই ব্রেক করেছিল নিশ্চয়ই?

 হ্যাঁ ম্যাডাম। নিখুঁত কেটেছে। দেখুন, পাশে কাচটাও পড়ে।

 টুপুর বলল, কাচটা তো আস্তই আছে। এত সুন্দর ভাবে কাটল কী করে?

জায়গাটা পরখ করতে করতে মিতিন বলল, পেশাদার হাতের কাজ। নির্ঘাত সঙ্গে ডায়মন্ড পয়েন্টেড যন্ত্র ছিল। তবে লোহার গরাদ কাটা হয়েছে হ্যান্ড ড্রিলে।

কিষান বললেন, তখনই বোধহয় আওয়াজ হয়েছিল। যা শুনতে পেয়ে প্রসাদ দৌড়ে আসে।

একটা জিনিস কিন্তু চোখে পড়ার মতো, মিতিন ঘাড় ঘোরাল, আপনাদের জানলাটা শুরু হয়েছে মাটির প্রায় পাঁচ ফুট উঁচু থেকে। জানলার হাইটও মোটামুটি ছ’ফুট। এত বড় একটা অংশ একেবারে মাপে মাপে কাটা রীতিমতো কঠিন কাজ।

বোধহয় জানলার কার্নিশে চড়েছিল।

কিন্তু কার্নিশও তো বেশ সরু। দাঁড়ানো মুশকিল, বলতে বলতে ঘাসে উবু হয়ে বসেছে মিতিন। আঙুল চেপে চেপে দেখল কী যেন। কিষানলালকে ডেকে বলল, এখানে ছোট ছোট দুটো গর্ত রয়েছে।

কীসের?

সম্ভবত সঙ্গে ফোল্ডিং মই এনেছিল। মেটালের। মই রাখার দাগটাই এখানে তৈরি হয়েছে।

তাই তো! আপনাদের পাহারাদারকে ঠিক কোনখানটায় অ্যাটাক করেছিল ওরা? সেটা তো ঠিক বলতে পারব না, কিষানলাল একটু থমকে থেকে বললেন, তবে ওকে কোথায় পাওয়া গিয়েছে, সেই জায়গাটা দেখাতে পারি।

চলুন তবে। ওই স্থানটিও দর্শন করে আসি।

গ্যারাজ পেরিয়ে হাত দশেক পরে ঢল নেমেছে। খুব একটা উঁচু-নিচু নয়, হাঁটা যায়। অল্প গিয়ে শুরু হয়েছে আগাছা, ঝোপঝাড়। বুনো ফুল ফুটে আছে যত্রতত্র। তারই মাঝে খানিক ঘন গাছগাছালি। সেখানে গিয়ে থামলেন কিষানলাল। বললেন, ওখানেই প্রসাদ পড়ে ছিল।

টুপুর বিস্ময়ের সুরে বলল, এত দূর টেনে এনেছে?

তাও তো প্রসাদের কপাল ভাল। আর পাঁচ-ছ’ হাত গেলেই খাদ। ফেলে দিলে প্রসাদের আর চিহ্নই থাকতে না।

যাক বাবা, লোক দুটো আর যাই হোক, খুনে নয়।

 প্রসাদের বন্দুকটাও হাতায়নি। ঝোপের পাশে পড়ে ছিল।

মিতিন কোনও মন্তব্য করল না। চুপচাপ পর্যবেক্ষণ করছে ঝোপঝাড়। তরতরিয়ে কয়েক পা হাঁটল। সামনে যাচ্ছে, পিছনে যাচ্ছে। ঝুঁকে পড়ে দেখল কী যেন। তারপর হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, এবার আপনাদের প্রসাদের সঙ্গে একটু কথা বলা যাক।

চওড়া কাঁধ, মাঝারি হাইটের হিমাচলি, প্রসাদ ডোগরা, এখন একটি টুলে বসে। পরনের নীল উর্দি ধুলোমাটি মাখা। কেমন যেন ঝিমোচ্ছে মাথা নামিয়ে। তার পাশে দাঁড়িয়ে এক বন্দুকধারী।

পাহারাদারদের ঘরটিতে ঢুকে মিতিন কিছুক্ষণ স্থির চোখে জরিপ করল প্রসাদ ডোগরাকে। অল্প গলা উঠিয়ে বলল, এই যে প্রসাদজি, শুনছেন?

মুখ তুললেন বছর পঞ্চাশের মানুষটি। অতি কষ্টে চোখ খুলে বললেন, আমাকে ডাকছেন?

হ্যাঁ। আপনার সঙ্গে একটু গল্প করব যে।

কোনও সাড়াশব্দ নেই।

কিষানলাল ঈষৎ কড়া স্বরে বললেন, সিধে হয়ে বোসো প্রসাদ। ম্যাডাম যা প্রশ্ন করবেন তার জবাব দাও।

সামান্য টানটান হলেন প্রসাদ। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, হাঁ ম্যাডামজি, বোলিয়ে?

কাল যখন শব্দটা পেলেন, তখন ঠিক কোথায় ছিলেন?

 বাহার। ব্যালকনিমে।

একাই ছিলেন?

হাঁ জি৷ মেওয়ালাল তখন মিউজিয়ামে চরকি দিচ্ছিল।

 মিতিন ঘুরে কিষানলালকে জিজ্ঞেস করল, রাতে কি এখানে দু’জন গার্ডই থাকে?

কাল সোমবার ছিল। আমাদের মিউজিয়াম আর গ্যালারির সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তাই পাহারাদারিটাও সেদিন একটু ঢিলে থাকে। অন্যদিন উপরে নীচে দু’জন করে সিকিয়োরিটি ঘোরে। সোমবারই শুধু একজন।

ও। চোর তা হলে আটঘাট বেঁধেই এসেছিল, মিতিন ফের প্রসাদে ফিরল, যারা আপনাকে আক্রমণ করেছিল, তাদের দেখলে চিনতে পারবেন?

রাতের আন্ধেরায় আচ্ছাসে মালুম হয়নি ম্যাডাম। আর ও লোগ তো প্রথমেই আঁখে পট্টি ডেলে দিল।

চেঁচালেন না কেন?

 বহুত ডর গয়া থা ম্যাডাম। ওরা বলছিল, আওয়াজ করলেই জানে মেরে দেবে।

তার মানে, মুখ-হাত-পা বাঁধার সময়ও আপনি আটকাতে পারেননি?

ঘাড় নামিয়ে দু’দিকে মাথা নাড়লেন প্রসাদ।

মিতিন আবার প্রসাদকে জরিপ করে বলল, আপনি তো বাড়ির ফ্রন্টে ছিলেন আর ওরা নিশ্চয়ই গাড়িতে এসেছিল! আগে কোনও ইঞ্জিনের আওয়াজ পাননি?

নেহি ম্যাডামজি। ও লোগ শায়দ পয়দল…

তা হলে তো আপনার সামনে দিয়েই ঢুকেছিল বলতে হয়!

নেহি জি৷ পিছে যাওয়ার আউর ভি রাস্তা আছে। যেখানে সাহেবের সমাধি, ঔহিসে ভি ওঠা যায়।

মিতিন কিষানলালের দিকে তাকাল। কিষানলাল সায় দিলেন ঘাড় নেড়ে। বললেন, হ্যাঁ ম্যাডাম। নীচে প্রোফেসর রোয়েরিখের সমাধিক্ষেত্রটি প্রায় অরক্ষিত। ওখানে একটা স্মৃতিস্তম্ভ আছে। নানান সময় লোকাল মানুষজন মহর্ষি নিকোলাসের উদ্দেশে ফুল টুল দিতে যায়। তারা নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করে না, যেদিক সেদিক থেকে উপরে উঠে পড়ে। মূলত তাদের কথা ভেবেই ওপাশটা সেভাবে ঘেরা হয়নি।

ও, মিতিন ফের প্রসাদকে নিয়ে পড়ল, ভাইসাব, লোকগুলো আপনাকে ঝোপে টেনে নিয়ে গিয়েছিল, তাই তো?

হাঁ জি।

আপনার হাত ধরে টেনেছিল? না পা ধরে?

প্রসাদ যেন এবার থতমত। ফ্যালফ্যাল তাকাচ্ছেন।

মিতিন নিচু হয়ে বলল, স্মরণ করুন, স্মরণ করুন।

ফ্যাকাশে ঠোঁট নড়েছে প্রসাদের। ঘোর ঘোর গলায় বললেন, ইয়াদ নেহি ম্যাডাম। ডরকে মারে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলাম।

হু, মিতিন সোজা হল, কৌতূহল মিটেছে মোটামুটি। এবার কি আপনার অফিসে গিয়ে একটু বসতে পারি?

শিয়োর। তার আগে একবার গ্যালারিতে যাবেন নাকি?

ওখানে তো শুধু নিকোলাস সাহেবেরই পেন্টিং?

ছেলেরও আছে। আই মিন, সভেতোস্লোভ সাহেবের। এগারোটা।

এখন আবার গ্যালারি খুলবেন? আমার হাজব্যান্ড আর জামাইবাবুরও ছবিগুলো খুব দেখার ইচ্ছে। ওরা মিউজিয়াম থেকে ফিরলে নয়… যদি তখন আপনার অসুবিধে না থাকে।

নো প্রবলেম। তা হলে এখন একবার দোতলায় চলুন।

গিয়ে লাভই হল টুপুরের। উপরতলাটাও কম দর্শনীয় নয়। মূল বাড়ি ঘিরে একটি সম্প্রতি নির্মিত বারান্দা, সেখান থেকে কাচের জানলা দিয়ে দিব্যি দেখা যায় অন্দরটা। এদিকে-ওদিকে রোয়েরিখদের থাকার ঘর, দারুণ সুন্দর সুন্দর আসবাব, কাঠের তাকে বই, অসংখ্য শো-পিস, পেন্টিং, স্কাল্পচার। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড স্ফটিকও রাখা আছে।

টুপুর আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করল, দেবিকারানিও কি এখানেই থাকতেন?

অল্পদিনের জন্য ছিলেন। তারপর উনি আর সভেতোস্লাভ ব্যাঙ্গালোরে চলে যান, মানে এখনকার বেঙ্গালুরু।

কেন?

 বেঙ্গালুরুতেও রোয়েরিখদের অনেক সম্পত্তি ছিল। ওঁরাই দেখাশোনা করতেন সম্পত্তিটার। বিশাল জমি, আঙুরখেত।

কথা বলতে বলতেই নেমেছে তিনজনে। অফিস ঘরে ফিরে কিষানলালের মুখে আবার চিন্তার মেঘ। করুণ স্বরে বললেন, কী হবে ম্যাডাম? ছবি তিনটে উদ্ধার হবে তো?

যদি কালপ্রিটরা ধরা পড়ে! মিতিন ঠোঁট ওলটাল, সেটা তো এস পি সাহেবের দায়িত্ব।

আপনি তো দেখলেন, কথা বললেন। কী বুঝছেন?

 প্রচুর ছক টক কষে লোক দুটো এগিয়েছে।

তা তো বটেই। কিন্তু আপনি তো একজন গোয়েন্দা, আপনি একটু আলাদা করে ব্যাপারটা দেখতে পারেন না?

উচিত হবে কি? মিস্টার আশুতোষ শাহ ক্ষুণ্ণ হবেন। চটেও যেতে পারেন।

এস পি সাহেবকে জানানোর দরকার কী? তা ছাড়া ওঁর সঙ্গে তো আপনার একটা সুসম্পর্ক হয়ে গিয়েছে। প্রয়োজন পড়লে তখন না হয়… কিষানলাল দরজার দিকে ঝলক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, আসলে কী জানেন ম্যাডাম? পুলিশের উপর আমার তেমন আস্থা নেই। ওরা যত গর্জায়, তত বর্ষায় না। তাই বলছিলাম।

দেখি, আপনাকে কতটুকু সাহায্য করতে পারি।

প্লিজ ম্যাডাম। আপনার মুভমেন্ট বলে দিচ্ছে, আপনি কতটা এফিশিয়েন্ট। প্লাস, ঘটনার আগে থেকেই আপনি ব্যাপারটা গেস করেছেন, টেবিলে পড়ে থাকা পাথরের পেপারওয়েটটা নাড়াচাড়া করছেন কিষানলাল। স্বগতোক্তির ঢঙে বললেন, তিন-তিনখানা রোয়েরিখ সাহেবের পেন্টিং! ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে কত যে দাম কে জানে! হয়তো পাঁচ কোটি, হয়তো দশ কোটি, হয়তো তার চেয়েও বেশি!

কিছু মনে করবেন না মিস্টার দুগগার, এমন মূল্যবান জিনিসকে আপনারা এত হেলাফেলা করে রেখেছেন কেন? আর একটু টাইট সিকিয়োরিটির বন্দোবস্ত করা কি উচিত নয়? আরও আশ্চর্যের বিষয়, গ্যালারি থেকে যে কেউ পেন্টিং-এর ফোটো তুলে নিতে পারে?

সে তো ইন্টারনেটেই দেওয়া আছে ম্যাডাম!

উঁহু। পেনড্রাইভের ফোটোগুলোর কোয়ালিটি আলাদা। দেখেই বোঝা যায়, অতি উচ্চমানের প্রফেশনাল ডিজিটাল ভিডিও ক্যামেরায় তোলা।

হ্যাঁ, সেটা অবশ্য অসম্ভব নয়। তবে পেশাদার ক্যামেরায় ফোটো তোলার অনুমতি কিন্তু আমরা দিইনা। ওই পারমিশন দেওয়ার মালিক হিমাচল প্রদেশের সরকার। কিংবা মস্কোর ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার অফ দা রোয়েরিখস।

তাই নাকি?

হ্যাঁ ম্যাডাম। বছরে দু-চারজনের বেশি ওই ধরনের ক্যামেরা নিয়ে আসেও না। তাদেরও অধিকাংশ বিদেশি।

গত এক-দু’ বছরে যাঁরা ফোটো তুলে নিয়ে গিয়েছেন, তাদের তালিকা আপনার কাছে আছে?

অবশ্যই। আমি নিয়মিত রেজিস্টার মেনটেন করি।

 কাইন্ডলি যদি লিস্টটা একটু দেখান।

অসুবিধে কী! এ তো গোপনীয় কিছু নয়!

উঠে বেঁটে আলমারিটা খুলে একটা লম্বা বাঁধানো খাতা নিয়ে এলেন কিষানলাল। মিতিনকে দিয়ে বললেন, এতেই আছে। সিরিয়ালি৷

শেষ থেকে শুরু করল মিতিন। হঠাৎই চোখের মণি স্থির। পরক্ষণে দৃষ্টি স্বাভাবিক। রেজিস্টার ফেরত দিল কিষানলালকে। আলমারিতে খাতাখানা তুলছেন কিষানলাল, ফের আশুতোষ শাহর আবির্ভাব। গমগমে গলায় বললেন, আপনি এখনও যাননি?

মিতিন হেসে বলল, আমার টিম উপরের মিউজিয়ামে। তারা ফিরলেই…

এবার কোথায় প্ল্যান? মানালি?

তেমনই তো ইচ্ছে।

যান, এনজয় দা টুর। এদিকে আমি ততক্ষণ দুই ওস্তাদকে তাড়া করি। স্ট্র্যাটেজি রেডি। বন্দোবস্তও কমপ্লিট। শুধু প্রাইভেট গাড়ি নয়, কুলু থেকে বেরোনোর বাস, ট্রাক, সব চেক করতে বলেছি, আশুতোষ ঘড়ি দেখলেন, যাই, এবার কুলু যাত্রা করি। ওই বৈজনাথ রাইকে ঝটপট কব্জা করতে হবে। নইলে তিনি আবার কখন উধাও হয়ে যান!

একটা সাজেশন রাখব এস পি সাহেব?

 বলুন?

বৈজনাথজি ভাল পোর্ট্রেট আঁকেন। যদি তাকে দিয়ে লোক দুটোর স্কেচ করিয়ে নেন।

ওটা তো ঘাড় ধরে করাব, আশুতোষ চোখ তেরচা করলেন, তবে বৈজনাথের স্কেচের উপর কি পুরোপুরি নির্ভর করা যায়? তিনি যদি নিজেই অপকর্মে যুক্ত থাকেন, তা হলে তো ভুলভাল ছবি এঁকে আমাদের মিসগাইডও করতে পারেন।

না, মিস্টার শাহ, বৈজনাথজি বোধহয় অতটা খারাপ লোক নন। কথা বললেই বুঝবেন।

এটা কি ডিটেকটিভের সার্টিফিকেট?

ধরুন তাই, মিতিন মৃদু হাসল, আর একটা কথাও বলতে পারি। প্রসাদ নামক পাহারাদারটিকে আর একবার কড়া করে জেরা করুন। হয়তো আরও কিছু তথ্য পাবেন।

বলছেন? তা হলে ব্যাটাকে তুলেই নিয়ে যাই?

আর জাস্ট একটা রিকোয়েস্ট। আপনার মোবাইল নম্বরটা যদি দেন।

লিখে নিন।

মোবাইলে নম্বরটা তুলছিল মিতিন, তিরবেগে ঘরে বুমবুমের প্রবেশ। হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, কী গো মা, চলো। আর কতক্ষণ এখানে থাকবে?

আলতো করে ছেলের চুল ঘেঁটে দিল মিতিন, তোদের ঘোরাঘুরি কমপ্লিট? এবার খিদে পেয়েছে, অ্যাঁ?

খিদে শব্দটা বুঝি নাড়িয়ে দিল টুপুরকে। উত্তেজনায় টের পায়নি এতক্ষণ, সত্যিই পেট চুঁইছুঁই করছে।