৩০. কালতামামি

কালতামামি
ত্রিশা অধ্যায়

১. ইন্টারিম রিপোর্ট

১৯৪৮ হইতে ১৯৬৭ পর্যন্ত এই কুড়ি বছরের মুদ্দতটাকে ‘কাল’ না বলিয়া ‘মহাকাল’ বলাই উচিৎ। এই মুদ্দতে যে সব ঘটনা ঘটিয়াছে, তা অঘটনই হোক আর দুর্ঘটনাই থোক সবই মহাঘটনা। মুদ্দতটাও বিশ বছরের। প্রায় দুই যুগের সমান। দুই ডিকেড ত বটেই। অতএব এটা মহাকাল। আজও তামাম হয় নাই। কাজেই এর কাল তামামি লেখা চলে না। এ কাল আজও চলিতেছে। যতদূর নযর চলে আরও চলিবে। কাজেই আমার দেখা রাজনীতির শেষ অধ্যায় হিসাবে আমি যে কাল-তামামি লিখিতেছি, এটাকে পাঠকরা ইন্টারিম রিপোর্ট ধরিয়া লইবেন। আমার হায়াতে না কুলাইলে আমার পরবর্তীরাই এর চূড়ান্ত রিপোর্ট (উকিল মানুষ বলিয়া ‘ফাইনাল’ রিপোর্ট কথাটা ব্যবহার করিলাম না) লিখিবেন। তখন সব ব্যাপারই আরও পরিস্ক প্রেক্ষিতে টু পারসপেকটিতে দেখা যাইবে। ফলে সে চূড়ান্ত রিপোর্ট আমার আজকার ইন্টারিম রিপোর্টের সিদ্ধান্ত ওলট-পালট হইয়া যাইতে পারে। তবু আমার কথাটা বলিয়া যাওয়া উচিৎ মনে করিলাম।

কেউ-কেউ মনে করিতে পারেন, এই বিশ বছরের লম্বা মুদ্দতটাকে দুই ভাগে দুই যুগে ভাগ করিলেই ত অন্ততঃ প্রথম দিককার যুগ সম্বন্ধে একটি চূড়ান্ত কাল তামামে লেখা যাইত। এটা করাও সহজ ছিল। কারণ এই মুদ্দতের সাবেক ও বর্তমান শাসকরা এই বিশ বছরের দুই বিপরীতধর্মী যুগে ভাগ করিয়া থাকেন। অবশ্য বিপরীত মতলবে। সাবেকরা বলিয়া থাকেন, প্রথম দশ বছর পার্লামেন্টারি যুগ, আর দ্বিতীয় দশ বছর ডিকটেটরি যুগ। বর্তমানরা বলিয়া থাকেন, আগেরটা ডিকেড অব ডিকে, আর পরেরটা ডিকেড-অব-প্রোগেস। সাবেকদের যুক্তি এই যে তাঁদের আমলে দেশে গণতন্ত্র ছিল না। বর্তমান শাসা দেশরক্ষা বাহিনীর অসদ্ব্যবহার করিয়া মার্শাল ল জারি করিয়াছেন। বেআইনীভাবে শাসনতন্ত্র বাতিল করিয়াছেন। দেশবাসীর গণতান্ত্রিক অধিকার কাড়িয়া নিয়াছেন। দেশে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। বর্তমানরা জবাবে বলেন যে আগে দেশে গণতন্ত্র-টন্ত্র কিছু ছিল না। বাতিল শাসনতন্ত্রটাও ওয়ার্কেল ছিল না। রাষ্ট্র নায়কদের পদ ও ক্ষমতা লইয়া নিজেদের মধ্যে কামড়া-কামড়ি করিয়া দেশটাকে রসাতলে নিতেছিলেন। তাই বর্তমান নেতারা আগের নেতাদের ধাক্কা মারিয়া গদি হইতে সরাইয়া দেশটাকে ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা করিয়াছেন।

এই দুই পক্ষের যে পক্ষের মতই ঠিক হোক, উভয়ের মতেই এই মুদ্দতটা দুই সুস্পষ্ট যুগে বিভক্ত। এই হিসাবে আমিও দুই দলের দুই মতের সহিত এক হইয়া এই যুগকে দুই কলে ভাগ করিতে পারিতাম। কাল তামামি লেখা আমার পক্ষে সহজ হইত।

কিন্তু এই সহজ পথ ফেলিয়া আমি কঠিন পথ ধরিলাম এই জন্য যে, এই দুই দলের কারও মত আমি গ্রহণ করিতে পারিলাম না। আমার বরাবরের তথাকথিত ‘অভ্যাস’-মত এটাও সত্য এটাও সত্য বলিতে পারিলাম না। জীবনের প্রথম এইবার বলিলাম এটাও সত্য না; এটাও সত্য না। এ জন্য আমি দুঃখিত। আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় এই মুদ্দতটা আসলে দুই যুগ নয়, একই যুগ। অন্ততঃপক্ষে একই যুগের এপিঠ-ওপিঠ। আইনতঃ ও টেকনিক্যালি দুই আমলের মধ্যে যত পার্থক্যই থাকুক না কেন, কার্যতঃ পার্লামেন্টারি শাসন এদেশে কোন দিনই ছিল না। আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খাঁ পার্লামেন্টের ফ্লোরে দাঁড়াইয়া সগর্বে ঘোষণা করিয়াছিলেন। আমার বিচারে আমার পার্টি (মুসলিম লীগ) পার্লামেন্টের চেয়ে বড়। কাজেই তাঁর আমলে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র ছিল না। তবে কি এক-পার্টি-শাসন ছিল? জনগণের মুখের উপর মুসলিম লীগের দরজা সশব্দে বন্ধ করিয়া দিয়া তিনি দেখাইয়াছিলেন, তাঁর আমল পার্টি-ডিকটেটর শিপও ছিল না। তারপর প্রধানমন্ত্রীর দুর্ভাগ্যজনক হত্যাকাণ্ডের পরে পার্লামেন্ট বা মুসলিম লীগকে জিগ্গাসা না করিয়াই গবর্নর-জেনারেল নাযিমূদ্দিন যেদিন প্রধানমন্ত্রী হইলেন, সেদিনও দেশে পার্লামেন্টারি শাসন ছিল না। আইন-পরিষদে মেজরিটি থাকা সত্ত্বেও যেদিন তিনি বড়লাট গোলাম মোহাম্মদ কর্তৃক ডিসমিস হইলেন, সেদিনও দেশে পার্লামেন্টারি শাসন ছিল না। তারপর বগুড়ার মোহাম্মদ আলী যেদিন আমেরিকা হইতে গবর্নর-জেনারেলের বগল দাবা হইয়া উড়িয়া আসিয়া প্রধানমন্ত্রী হইলেন এবং পরে মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট হইলেন, তখনও দেশে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র ছিল না। এই প্রধানমন্ত্রীই যখন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে সদলবলে হারিয়া গিয়া বিজয়ী যুক্তফ্রন্টকে গবর্নমেন্ট চালাইতে দিলেন না, সেদিনও দেশে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র ছিল না। তারপর বেশির ভাগ তথাকথিত পার্লামেন্টারি নেতার নীরব ও সরব সমর্থনে গবর্নর-জেনারেল গণ পরিষদ ও পার্লামেন্ট ভাংগিয়া দিয়া যেদিন অর্ডিন্যান্স-বলে দেশ শাসন করিতে লাগিলেন, অর্ডিন্যান্স বলেই পশ্চিম পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশগুলি উড়াইয়া দিলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের পাঁচ কোটি ও সাড়ে তিন কোটি লোকের প্রতিনিধিত্ব প্যারিটি প্রবর্তন করিলেন, সেদিনও দেশে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র ছিল না। তারপর নির্বাচন করিয়া নয়, হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টে মামলা-মোকদ্দমা করিয়া যেদিন একটি নয়া গণ-পরিষদ আদায় করা হইল, চালাকি ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাস ঘাতকতা করিয়া গবর্নর-জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রী একই পশ্চিম পাকিস্তান হইতে লইয়া নয়া সরকার গঠন করা হইল এবং সেই সরকার জোড়াতালি দিয়া একটি নির্বাচন-পদ্ধতিবিহীন অসমাপ্ত শাসন রচনা করিলেন, সেদিনও দেশে পার্লামেন্টারি শাসন চালু ছিল না। এক কথায় উপরে বর্ণিত কোন সরকারই ভোটারদের নাগালের মধ্যে ছিলেন না। আট বছরে দেশে কোনও শাসনই রচিত হয় নাই। শাসন রচনার পরও দুই বছরে কোন নির্বাচন হয় নাই।

সুতরাং জেনারেল আইউব ১৯৫৮ সালে যা করিলেন তাতে তিনি কোনও গণজ্ঞ হরণ করেন নাই। এক প্যাটার্নের অগণ হইতে অন্য প্যাটার্নের অগণতন্ত্রে দেশকে নিয়া গেলেন মাত্র। আগের প্যাটার্নের অগণতন্ত্রীরা জনগণের ভোটাধিকার আইন করিয়া কাড়িয়া নেন নাই সত্য, কিন্তু কাজে-কর্মে স্বীকারও করেন নাই। নির্বাচনের নামও মুখে আনেন নাই। সে-স্থলে আইউব সাহেব আসিয়া আইন করিয়া ভোটাধিকার বিলোপ করিয়া দিয়াছেন। বলিতে গেলে আইউব সাহেবের কথাটাই সহজবোধ্য। তিনি সোজাসুজি দেশবাসীকে বলিয়াছেন : তোমরা ভোট দিতে জান না। কাজেই তোমাদের ভোটাধিকার দিলাম না। বড় সাফ কথা। কোনও হাংকি-পাংকি নাই। কথাটা আমরা সহজেই বুঝিতে পারি। এই জন্যই আইউব সাহেব বলিয়াছেন দেশবাসী যেটা ভাল বুঝে সেই মত শাসনন্ত্রই তিনি দিয়াছেন। একেই বলে সূটেড টু আওয়ার জিনিয়াস। পক্ষান্তরে সাবেক নেতারা দেশবাসীকে বলিতেন : তোমাদের ভোটাধিকার স্বীকার করি কিন্তু নির্বাচন দিবনা। এটা জনগণের বুঝা সত্যই কঠিন ছিল। সেজন্য ঐ ব্যবস্থা ‘সুটেড টু আওয়ার জিনিয়াস’ ছিল না।

অতএব দেখা গেল সাবেক আমলেও জনগণের শাসন ছিল না। বর্তমান আমলেও জনগণের শাসন নাই। জনগণ হইতে দূরে থাকিতে হইবে, এই নীতিতে দুই আমলই সমান বিশ্বাসী। এই হিসাবেই আমি এই বিশ বছরের মুদ্দতকে দুই বিপরীতধর্মী বা স্ব-ধমী পৃথক যুগ বলিয়া মানিতে পারিলাম না। তাই উভয় আমল লইয়াই একটি ইন্টারিম সালতামামি লিখিলাম।

২. পাপের প্রায়শ্চিত্ত

এবার আলোচনায় আসা যাক। রাজনৈতিক নেতারা যে অনেক পাপ করিয়াছিলেন তাতে সন্দেহ নাই। দেশবাসীর অভিযোগও তাই। নেতারা আট বছরে একটা শাসনতন্ত্র রচনা করিতে পারেন নাই। পুরাতন শাসনতন্ত্রের দেওয়া বাই-ইলেকশনগুলি পর্যন্ত আটকাইয়া রাখিয়াছিলেন। সরকারের আইনসংগত সমালোচনার জন্য অপযিশন পার্টি গঠন করিতে দেন নাই। সরকারের সমালোচকদের পাকিস্তানের দুশমন,ভারতের চর ও ইসলামের শত্রু আখ্যা দিয়া তাঁদেরে নিরাপত্তা আইনে বন্দী করিয়াছিলেন। খবরের কাগযের আফিসে তালা লাগাইয়া সাংবাদিক-স্বত্বাধিকারীদেরে জেলে আটক করিয়াছিলেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পূর্ব-বাংলার ন্যায়সংগত দাবিটাকে পশ্চিম বাংলার উস্কানি আখ্যায় গালিগালাজ করিয়াছিলেন। ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালাইয়াছিলেন। পাকিস্তানের অন্যতম স্রষ্টা শহীদ সাহেবকে বহিষ্কার করিয়াছিলেন। তাঁর গণ-পরিষদের মেম্বারশিপ কাটিয়া দিয়াছিলেন। পূর্ব-বাংলার সাধারণ নির্বাচন বিজয়ী প্রধানমন্ত্রী হক সাহেবের মন্ত্রিসভা বাতিল করিয়া তাঁকে নযরবন্দী করিয়াছিলেন। এইরূপ অন্যায়-অসংগত অগণতান্ত্রিক অত্যাচার চলে আট-আটটা বছর ধরিয়া। কিন্তু তবু এই মুদ্দতে আমাদের দেশরক্ষা বাহিনী রাষ্ট্র-শাসনে হস্তক্ষেপ করে নাই। তারপর এই আট বছরের অপমীদেরে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া যখন অবশেষে দেশে একটা শাসন রচিত হইল, যখন সমস্ত বাধা-বিঘু ঠেলিয়া নয়া শাসনতন্ত্র অনুসারে দেশময় একটা সাধারণ নির্বাচন হওয়ার দিন-তারিখ স্থির হইল, ঠিক সেই মুহূর্তে মার্শাল ল আসিল। বলা হইল ঐ শাসনতন্ত্র কার্যোপযোগী নয়। তদনুসারে ইলেকশন হইলে অনেক অর্থের অপচয় হইত। এমন কি অনেক খুন-জখম হইয়া যাইত। এর আগেই স্বয়ং রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দর মির্যা বলিয়া রাখিয়াছিলেন। এ দেশের মূর্খ জনসাধারণ ভোট দিতে জানে না। তার প্রমাণ, এই মূখেরা না বুঝিয়া ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে শতকরা সাড়ে সাতানব্বইটা ভোট দিয়াছিল। এতে প্রমাণ হইয়াছিল এরা গণতন্ত্রের উপযুক্ত নয়। এদেরে শুধু ডাণ্ডাপিটা করিয়া শাসন করা দরকার। ইলেকশনের নির্ধারিত সময়ের প্রাক্কালে অদৃশ্য হস্তের খেলা চলিল। সুন্দর কাগযে বড় বড় টাইপে সুদৃশ্য-ছাপা পোটারে বলা হইল : রিভলিউশনারি কাউন্সিল চাই। সত্য-সত্যই একদিন ‘রিভলিউশন’ আসিল। মার্শাল ল প্রবর্তিত হইল। রাজনৈতিক নেতাদের পাপের প্রতিকার করিবার জন্যই মার্শাল ল হইয়াছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু সে পাপটা করিয়াছিল কারা? আমরা যে সব কাজকে রাজনৈতিক নেতাদের পাপ মনে করি, সেই পাপের শাস্তি স্বরূপই কি মার্শাল ল হইয়াছিল? প্রশ্নটার উত্তর দিয়াছেন স্বয়ং মার্শাল ল-কর্তারা। তাঁরা মার্শাল ল করিয়া ঘোষণা করিলেন : ১৯৫৪ সালের পরে যাঁরা দেশ শাসন করিয়াছেন, বিচার হইবে শুধু তাঁদেরই। এর অর্থ এই যে, তার আগে যাঁরা দেশ শাসন করিয়াছিলেন, তাঁদের কোনও পাপ ছিল না। যাঁরা তাঁদেরে হটাইয়া নির্বাচনে হারাইয়া শাসনক্ষমতা দখল করিয়াছিলেন, অপরাধ তাঁদের। আট বছরের শাসনতন্ত্রহীন দেশকে যারা একটা শাসনতন্ত্র দিলেন অপরাধ তাঁদের। এই একটিমাত্র ব্যাপার হইতেই মার্শাল ল প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ও প্রয়োজন ধরা পড়িবে। অন্য, কিছু বিচার করার দরকারই হইবে না। মার্শাল ল প্রবর্তনের নয় বছর পর প্রেসিডেন্ট আইউব তাঁর ফ্রেসনট মাষ্টার্স নাম্য রাজনৈতিক আত্মজীবনী লিখিয়াছেন। তাতে তিনি কিভাবে মার্শাল ল আনিলেন তা না বলিলেও কি কারণে আনিলেন তা বলিয়াছেন। জোরদার কৈফিয়ৎ দিয়াছেন।.ও-ধরনের কৈফিয়ত অতীতে সব মার্শাল ল-ওয়ালারাই দিয়াছেন। ভবিষ্যতেও দিবেন। এতে কোনও নূতনত্ব নাই। ও-সবই ধরা-বাঁধা গৎ। ও-সব গতের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ কথাটা এই যে, বৃটিশ প্যাটার্নের গণতন্ত্র পাকিস্তানে ব্যর্থ হইয়াছিল। কথাটা সত্য হইলে আইউবী বিপ্লব সত্যই দরকার ছিল। সত্য হওয়াও অপরিহার্য। কারণ ওটা ছাড়া আইউবী-বিপ্লবের আর কোনও সংগত কারণ ছিল না। বেশির ভাগ দেশেই ‘বিপ্লব’ হইয়াছে ‘রাজ’ বরতরফ করিয়া ‘প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। স্বাভাবিক কারণেই ডিকটেটর বরতরফ করিবার জন্যও বিপ্লব হইয়াছে। কারণ ‘রাজা’ ও ‘ডিকটেটর’ মূলতঃ এবং গণতন্ত্রের দিক হইতে একই চিজ। আমাদের দেশে ‘রাজাও ছিল না, ‘ডিকটেটর’ও ছিল না। তবে প্রধান সেনাপতি আইউব ‘বিপ্লব করিলেন কেন? একমাত্র উত্তর : শাসনতন্ত্রে বিপ্লবী পরিবর্তন আনিবার জন্য। দেশের শাসনতন্ত্র সত্যই ‘বিপ্লব’ ছাড়া ভাংগা যায় না।

কাজেই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠিয়াছে। পাকিস্তানে গণতন্ত্রই সত্যই ব্যর্থ হইয়াছিল কি না?

. গণতন্ত্র কি ব্যর্থ হইয়াছিল?

সত্য কথা এই যে পাকিস্তান গণতন্ত্র ব্যর্থ হওয়ার পথে চলিয়াছিল। সমস্ত লক্ষণই ঐদিকে অংগুলি নির্দেশ করিতেছিল। আর কিছুদিন গেলে বোধ হয় সত্য-সত্যই ব্যর্থ হইত। তবে এটাও সত্য যে যেদিন আইউব সাহেব বিপ্লব করিলেন, সেদিন পর্যন্ত গণতন্ত্র ব্যর্থ হয় নাই। প্রয়োগই হয় নাই, ব্যর্থ হইবে কি? আট বছর ধরিয়া শাসনতন্ত্র রচনা লইয়া ছিনিমিনি খেলা হইল। পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত সরকার ডিসমিস করা হইল। কেন্দ্রেও নাযিমুদ্দিন সরকার ডিসমিস হইলেন। এবং সর্বশেষ গণ-পরিষদ ভাংগিয়া দেওয়া হইল। এর যেকোনও একটাকে বিপ্লবের অজুহাত করিয়া প্রধান সেনাপতি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করিলে তাঁর কাজের নৈতিক সমর্থন থাকিত। তিনি জনগণের সমর্থন পাইতেন। ঠিক তেমনি, তিনি যদি ১৯৫৯ সালের প্রস্তাবিত সাধারণ নির্বাচনের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করিতেন, নির্বাচনে তাঁর আশংকিত খুন-খারাবি আরম্ভ হইলে পরে তিনি যদি মার্শাল ল প্রবর্তন করিতেন, তবেই তিনি যুগপভাবে দেশবাসীর ও বিশ্ববাসীর নিকট সম্মান ও সমর্থন পাইতেন।

অথচ তিনি নির্বাচনের প্রাক্কালে মার্শাল ল করিলেন তাঁর নিজের কল্পিত ও অনুমিত বিপদ ঠেকাইবার জন্য। এমন সময় করিলেন, যখন রাষ্ট্রচালক রাজনীতিকরা অনেকবার পথভ্রষ্ট হইতে হইতে শেষ পর্যন্ত টাল সামলাইয়া লইয়াছিলেন। অতীতে অনেকবার বিপ্লব করা দরকার হওয়া সত্ত্বেও জেনারেল আইউব রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ হইতে বিরত ছিলেন। বিপ্লব না করিয়া বরঞ্চ তিনি রাজনীতিকদের সহায়তা করিয়াছেন। গণ-পরিষদ ভাংগিয়া দেওয়ার মত অন্যায় বেআইনী ও অগণতান্ত্রিক কাজ হওয়ার সময় তিনি ‘বিপ্লব’ করিয়া রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন নাই। বরঞ্চ নিজে রাজনীতিকের অধীনে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিয়াছিলেন। এতে তাঁর সাধু ইচ্ছা এবং গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর আস্থাই প্রমাণিত হইয়াছিল। দেশে গণতন্ত্র বাঁচাইবার শেষ চেষ্টায় তিনি রাজনীতিকদের সহায়তা করিবার জন্যই মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিয়াছিলেন। এসব কথা যদি সত্য হয়, তবে গণতন্ত্র যখন টাল সামলাইয়া উঠিয়াছিল, শাসন রচিত হইয়া যখন নির্বাচনের দিন-তারিখ পড়িয়াছিল, তখন তিনি তলওয়ার মারিলেন কেন? রচিত শাসনতন্ত্র অচল বলিয়া? সাধারণ নির্বাচনে খুন-খারাবি হইত বলিয়া? এতই দৃঢ় যদি তাঁর বিশ্বাস ছিল, তবে এটা প্রমাণিত হওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করিলেন না কেন? এ প্রশ্নের জবাব কেউ দেন নাই। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আইউবের বই–এও এর জবাব নাই।

কাজেই যদি মনে করা হয়, পাকিস্তান রক্ষার জন্য নয়, দেশের আর্থিক কাঠামো বাঁচানোর জন্যও নয়, ব্যক্তিগত উচ্ছাকাংখা পূরণের জন্যই প্রেসিডেন্ট আইউব রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করিয়াছেন, তবে তা নিতান্ত অযৌক্তিক হইবে না। কিন্তু সে ব্যক্তিগত উচ্চাকাংখাও দেশ-সেবার জন্য হইতে পারে। হাযার সাধু উদ্দেশ্য লইয়াও সামরিক শক্তি-বলে বা বেআইনীভাবে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের কোনও অধিকার কোনও সেনা-নায়ক বা সরকারী কর্মচারির নাই, সেটা আলাদা কথা। এখানে তা আমার আলোচ্যও নয়। এখানে আমার প্রতিপাদ্য বিষয় শুধু এই যে প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইউব নিতান্ত সাধু-উদ্দেশ্য-মিশ্রিত-ব্যক্তিগত-উচ্চাকাংখায় মার্শাল ল করিয়াছেন। তা করিতে গিয়া তিনি অনেক ভাল কাজও করিয়াছেন, অনেক খারাপ কাজও করিয়াছেন। তুলনায় যদি দেখা যায়, তাঁর ভাল কাজের ওজন খারাপ কাজের চেয়ে ভারি, তবে তাঁর তারিফ ও তাঁর কাজের সমর্থন করিতেই হইবে।

. অবিমিশ্র অভিশাপ নয়

মার্শাল ল, সামরিক বিপ্লব ও ব্যক্তিগত ডিকটেটরশিপের কোনওটাই নির্ভেজাল অভিশাপ নয়। অনেক সময় ঐ সবের দ্বারা পরিণামে দেশ ও দেশবাসী জনসাধারণের উপকার হইয়া থাকে। রাজ ও ডিকটেটরশিপের বিরুদ্ধে উপরোক্ত ধরনের বিপ্লব সর্বদাই দেশের কল্যাণ করিয়া থাকে, তাতে দ্বিমত নাই। তাছাড়াও শুধুমাত্র শাসনতন্ত্র ও সামাজিক-অর্থনীতিক কাঠামো বদলাইবার উদ্দেশ্যে বিপ্লব হইলেও তা দেশের মংগল সাধন করিতে পারে। আইউব সাহেব যদি মোটামুটি দেশের কল্যাণ করিয়া থাকেন, তবে তাঁর গোড়ার ক্ষমতা দখলের অন্যায় ও বেআইনী কাজটাও জনসাধারণ ও ইতিহাসের বিচারে ভাল কাজ বিবেচিত হইবে।

আগে তাঁর ভাল কাজগুলিরই উল্লেখ করা যাক। তিনি (১) পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্ততান্ত্রিক ভূমি-ব্যবস্থার নীতিত অবসান করিয়াছেন, (২) একবিবাহকে কার্যতঃ বাধ্যতামূলক করিয়াছেন, (৩) দুই পাকিস্তানের আর্থিক বৈষম্য স্বীকার করিয়াছেন, (৪) রেলওয়ে প্রদেশকে দিয়াছেন, ৫) কয়েকটি নিখিল পাকিস্তানীয় অর্থ-বন্টন প্রতিষ্ঠানের হেড আফিস ঢাকায় স্থানান্তরিত করিয়াছেন, (৬) শিল্পোন্নয়ন কর্পোরেশনকে দূই প্রদেশের মধ্যে দ্বিধা-বিভক্ত করিয়াছেন, (৭) পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বত্র গ্রাম্য স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন করিয়া উভয় পাকিস্তানের নিম্নস্তরের স্বায়ত্তশাসনকে একই প্যাটার্নের করিয়াছেন, (১) জাতীয় শিপিং কর্পোরেশন গঠন করিয়াছেন এবং (১০) সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের সহিত ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করিয়া বৈদেশিক নীতিকে সুসংগত করিয়াছেন।

এসবই ভাল কাজ। দেশের কল্যাণজনক ও উন্নয়নমূলক কাজ। পার্লামেন্টারি আমলের যে কোনও সরকারের জন্য এর সব কয়টা এবং যে কোনও একটা গৌরব ও অহংকারের বিষয় হইত। কারণ এর মধ্যে কয়েকটি কাজ পার্লামেন্টারি সরকারের পক্ষে করা খুবই কঠিন হইত। মুসলিম ওয়ারিসী ও বিবাহ আইন সংশোধন ও পশ্চিম পাকিস্তানের জমিদারি উচ্ছেদ এই ধরনের কাজ। পার্লামেন্টারি সব সরকারকেই জন মতের উপর নির্ভর করিতে হয়। সেজন্য সব কাজই তাঁদের করিতে হয় ধীরে-ধীরে সহাইয়া-সহাইয়া। কোনও ব্যাপারেই বিপ্লবী কোনও পরিবর্তন তাঁরা আনিতে পারেন না। পারেন না বলিয়াই প্রয়োজন-বোধে জনকল্যাণের জন্যই বিপ্লবের দরকার হয়। বিপ্লবী-সরকার প্রচলিত আইন জনমত সমাজ-ব্যবস্থা ভূঞ্জিত অধিকার কিছুই মানিয়া চলিতে বাধ্য নন। কারণ ও-সব ওলট-পালট করিবার জন্যই বিপ্লব আসিয়াছে। ঠিক তেমনি পার্লামেন্টারি সরকারকে কোনও না-কোন পার্টি বা অর্গানিযেশনের উপর নির্ভর করিতে হয়। প্রতি কাজে পার্টির অনুমোদন লইতে হয়। তারপর আইন-সভায় যাইতে হয়। সেখানে আইন পাস করাইতে হয়। বাজেট মনযুর করাইতে হয়। তারপর কার্যে পরিণত করিতে হয়। বিপ্লবী সরকারকে এসব কিছুই করিতে হয় না। কাজেই। ইচ্ছা করিলেই তাঁরা দেশের কল্যাণজনক ও উন্নয়নমূলক কাজ আশাতীত দ্রুতগতিতে করিতে পারেন। এই হিসাবে আমাদের বিপ্লবী সরকারের কাজ মোটেই আশানুরূপ হয় নাই। অন্য কাজের কথা ছাড়িয়াই দিলাম। কারণ কোনটা ভাল আর কোনটা ভাল। নয়, তা নিয়া বর্তমান সরকার ও আমাদের মধ্যে মতভেদ হইতে পারে। কিন্তু যে বিষয়ে মতভেদ নাই এবং যে কাজটা তাঁরা করিতে চান বলিয়া থাকেন, তার কথাই বলা যাক। এটা কার্টেল-প্রথা ও দুই অঞ্চলের বৈষম্য দূর করার কথা। এ দুইটা দূর হয়ই নাই, বরঞ্চ দিন-দিন বাড়িতেছে।

কিন্তু এটাও আসল কথা নয়। সরকারের ভাল-মন্দ কাজের বিচারে গণতান্ত্রিক সরকার ও বিপ্লবী সরকারের মাপকাঠি এক নয়। গণতান্ত্রিক সরকারকে ভোটাররা ভোট দিয়া গদিতে বসান। কাজেই তাঁরা যদি ভাল কাজ করেন, তবে তার জন্যও যেমন ভোটাররাই প্রশংসার অধিকারী, তেমনি ঐ সরকার যদি খারাপ কাজ করেন তবে তার নিন্দার ভাগীও ভোটাররা। এটা ন্যায়সংগতও। কারণ তেমন অবস্থায় তোটাররাই আবার ভোট দিয়া সে সরকারকে বরতরফ করিতে পারেন এবং করেনও।

৫. বিপ্লবী ও গণতান্ত্রিক সরকারের পার্থক্য

কিন্তু বিপ্লবী সরকারের কেস তা নয়। ভোটাররা তাঁদের ভোট দিয়া গদিতে বসান নাই। বিপ্লবের নেতারা নিজের ইচ্ছায়, নিজের প্ল্যান-প্রোগ্রাম লইয়া ভোটারগণের মত না লইয়া অনেক সময় ভোটারদের অমতে জোর যবরদস্তিতে, গদি দখল করেন। উদ্দেশ্য দেশের ভাল করার দরকার এই জন্য যে ভোটের সরকার দিয়া ঐসব কাজ হইতেছিল না। হওয়ার উপায়ও নাই। গণতন্ত্রী সরকার ঠিকমত দেশকে চালাইতে পারিতেছিলেন না বলিয়াই বিপ্লবের নেতারা জোর করিয়া তাঁদের হাত হইতে গদি ছিনাইয়া নিয়া নিজেরা বসিয়াছেন। কাজেই ভাল তাঁদের করিতেই হইবে। কোনও অজুহাতেই তাঁদের ব্যর্থ হওয়া চলিবে না। ব্যর্থ হইলে তাঁরা নিজেরা এবং তাঁরা একা অপরাধী হইবেন। সুতরাং ভাল কাজ করিলে তাঁরা প্রশংসা পাইবেন না। কারণ ওটা করা ছিল তাঁদের ফরয। বিপ্লবীর দায়িত্বে মজার ব্যাপার এইখানে। সফল হইলে প্রশংসা নাই কিন্তু ব্যর্থ হইলে নিন্দা আছে।

তথাপি বিপ্লবী সরকার প্রশংসা পাইতে পারেন এবং পাইয়াও থাকেন যদি তারা বিপ্লবকে জাসৃটিফাই করিতে পারেন। অর্থাৎ তাঁরা যদি এমন কাজ করেন যা কোনও গণন্ত্রী সরকারের দ্বারা সম্ভব হইত না, যত যোগ্য বা যত ভাল সরকারই হউন না কেন। যেমন রাজতন্ত্র তুলিয়া প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ধনিকদের ধন বাযেয়াফত করিয়া এক চোটে সমাজতন্ত্রের প্রবর্তন। এমন বিপ্লবী পরিবর্তন আনা ছাড়া আর কোন কাজের জন্যই বিপ্লবী সরকার প্রশংসা পাইতে পারেন না। সাধারণ মামুলি উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ত নয়ই। তাছাড়া দৃশ্যতঃ যে সব কাজ কোনও সরকারের আমলের আসলে সে কাজ তাঁদের নাও হইতে পারে। বাপ আম গাছ লাগাইয়া গেলে ছেলের আমলে তাতে যদি ফল ধরে, তবে সে উন্নতিকে ছেলের আমলের উন্নতি না বলিয়া বরঞ্চ বাপের আমলের উন্নতিই বলিতে হইবে। পাকিস্তানের বর্তমান শিয়োন্নয়নের অনেক কাজই আগের সরকাররা করিয়া গিয়াছেন। সবদেশেই অমন হইয়া থাকে। সরকারের মধ্যে একটা কনটিনিউটি একটা অবিচ্ছিন্নতা থাকিলে এই ধরনের কাজ হয় সকল সরকারের। শসা পান আগে পরেরসবসরকাররাই সমানভাবে। বর্তমান সরকার যদি আগের-আগের সব সরকারকেই ধূচিয়া গাল দিয়া সব কাজের কৃতিত্ব নিজেরা নিতে চান, তবেই এ ধরনের হিসাবের কথা উঠে। তবেই লোকের মনে পড়ে। করাচি ও চাটগা বন্দর, আদমজী জুট মিল, কর্ণফুলী পেপার মিল, খুলনা নিউযপ্রিন্ট মিল ও ডকইয়ার্ড, কেগঞ্জ সার-মিল, কাপ্তাই বাঁধ ইত্যাদি সবই আগের সরকার করিয়া পিয়াছেন। লোকে আরও মনে পড়ে যে বর্তমান সরকারের রূপপুর ঘোড়াশাল ইত্যাদি কি পচ-৪ বছরের প্রসব-বেদনার পরেও মাঝে-মাঝেই ফলস পেইন প্রমাণিত হইতেছে।

তবু এসব শিল্পিক ও আর্থিক উন্নতি-অবনতি লইয়া বর্তমান সরকার ও অপযিশন নেতৃবৃন্দের মধ্যে যে বাদানুবাদ চলিতেছে সে বিতর্কে আমি লেখক সাহিত্যিক হিসাবে এই পুস্তকে কোনও একপক্ষ অবলম্বন করিতে চাই না। ও-সবের বিচার-তার ইতিহাসের উপরই ছাড়িয়া দিতে চাই। কোনও লোক গদিতে থাকা পর্যন্ত তীর আমল সম্বন্ধে সত্যিকার নিরপেক্ষ ইতিহাস লেখা চলে না। যা চলে তা একদিকে সীমাহীন তোষামোদ, অপরদিকে পক্ষপাত দু একতরফা নিলা।

একটু গভীরভাবে ভলাইয়া চিন্তা করিলেই বুঝা যাইবে এবং বর্তমান শাসকরাও ধীরভাবে যথাসমন্ত্রে বিচার করিলে বুঝিবেন, মার্শাল আইন জারির দ্বারা যে বিপ্লব আমাদের দেশে আনা হইয়াছে মোটের উপর তাতে আমাদের লাভের চেয়ে লোকসান হইয়াছে অনেক বেশি। সে পোকানগুলির কুফল মারাত্মক, সুদূরপ্রসারী। সে সবের প্রতিকার খুব কঠিন, সংশোধন খুবই সময়সাপেক্ষ। এমন কয়টি ব্যাপারের দিকে দেশবাসী এবং বর্তমান শাসকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াই আমার এই ইন্টারিম কাল তামামি শেষ করিতে চাই।

৬. লোকসানের খতিয়ান

সংক্ষেপে এইসব লোকলানের সংখ্যাও মোটামুটি দশটি। যথা:

(১) মার্শাল ল প্রবর্তনে গণতান্ত্রিক আধুনিক রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের ইমেজ ভাংগিয়া গিয়াছে। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দুনিয়ার নযরে বর্তমানে ভারতই যে এশিয়ার একমাত্র ‘শো পিস অব ডেমোক্র্যাসি’ আখ্যা পাইতেছে, এই সাটিফিকেটের হকদার পাকিস্তানও ছিল। মার্শাল ল প্রবর্তন জাটিফাই করিতে গিয়া পাকিস্তানের সে অধিকার হরণ করা হইয়াছে।

(২) রাজনৈতিক চেতনা-সম্পন্ন গণতন্ত্রে সুশিক্ষিত এবং স্বায়ত্তশাসনের সম্পূর্ণ উপযুক্ত বলিয়া পাকিস্তানের জনগণের যে একটা সুনাম ছিল, সে সুনাম কলংকিত হইয়াছে। এটা সাংঘাতিক রকম মারাত্মক হইয়াছে এই জন্য যে পাশ্ববর্তী এবং গতকালের একই জনতার অংশ ও একই পরিবেশের সৃষ্ট ফল ভারতীয়দের সংগে তুলনায় আমাদেরে হীন ও অনুন্নত জাতি বলিয়া প্রমাণ করা হইয়াছে। এর তাৎপর্য প্রাক-স্বাধীনতা যুগের ভারতীয় হিন্দু ও ভারতীয় মুসলমানের তুলনায় হিন্দুদিগকে মুসলমানদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলিয়া সার্টিফিকেট দিয়াছে। ভারতের হিন্দুদের স্বাধীনতা আলোলনে ভারতীয় মুসলমানেরা বাধা দিয়া ইংরাজের তাবেদারি করিয়া ভারতে ইংরাজ শাসন বহাল রাখিবার চেষ্টা করিয়াছিল, হিন্দুদের এই অভিযোগ সত্য প্রমাণ করা হইয়াছে। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের বিকশিত ও প্রসারিত কাঠামোর উপর রচিত ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র বাতিল করিয়া ১৯১৯ সালের শাসনতন্ত্রের সংকুচিত কাঠামোর উপর ১৯৬২ সালের শাসন জারি করিয়া প্রমাণ রা হইয়াছে, ভারতবাসী অর্থাৎ প্রাক-স্বাধীনতার ভারতীয় হিন্দু গণতান্ত্রিক স্বায়ত্তশাসনের যোগ্য বটে কিন্তু মুসলমানরা সে যোগ্যতা আজো অর্জন করে নাই। তাদের ফের-গুরু,সে শুরু করিয়া ১৯১৯ সালের গ্র্যাজুয়েল রিয়েলিযেশন অব সেলফ গবর্নমেন্ট ট্রেনিং দিতে হইবে। সেই জন্যই ১৯১৯ সালের আগের লর্ড রিপনের আমলের মত মিউনিসিপ্যালিটি ও জি। বোর্ডে সরকার মনোনীত অফিশিয়াল চেয়ারম্যানের বিধান পুনঃপ্রবর্তন করা হইয়াছে।

(৩) পাইকারীভাবে সমস্ত রাজনীতিকদের অর্ডিন্যান্স বলে অপরাধী সাব্যস্ত করিয়া পাকিস্তানের জাতীয় নেতৃত্বই মসি-লিপ্ত করা হইয়াছে। এই ব্যবস্থাটা উপরের দুই নম্বর দফায় খুবই পরিপূরক হইয়াছে। বলা হইয়া গিয়াছে যেমন, তেমনিভারে নেতা। এই সব দণ্ডিত নেতাদের প্রায় সবাই কায়েদে-আযম ও কাস্লেদে-মিল্লাতের সহচর অনুচর সহকর্মী ও মন্ত্রী ছিলেন। ‘সহচর দিয়াই মানুষের বিচার করা যায়’ এই নীতির বলে এতে কায়েদে আযম-কায়েদে মিল্লাতেরও বিচারটা হইয়া গেল। প্রাক স্বাধীনতা যুগে হিন্দু-নেতারা মুসলিম-নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মুখে-মুখে যে সব গাল দিলে, আইউব সাহেব হাতে-কলমে প্রমাণ করিয়া দিয়াছেন।

(৪) ভোটাধিকার খাটাইবার যোগ্যতা নাই, এই অভিযোগেই পাকিস্তানের সগণের ভোটাধিকার কাড়িয়া নেওয়া হইয়াছে। এই অহমতের দ্বারা পাকিস্তানের বুনিয়াদী অসুলই উড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। তোট দিয়াই জনগণ পাকিস্তান হাসিল করিয়াছিল। কলা হইয়া গেল ওটাও ছিল ভোটাধিকার প্রয়োগের অযোগ্যতার প্রমাণ।

(৫) পাকিস্তান রাষ্ট্রের ফেডারেল কাঠামো ভাংগিয়া দিয়া সে স্থলে ঐকিক ইউনিটারি কে দাঁড় করাইয়া পাকিস্তানের মূল পরিকল্পনার ভিত্তি ভাংগিয়া দেওয়া হইয়াছে। তাতে পাকিস্তানের সংহতি ও নিরাপত্তাকে বিপন্ন করা হইয়াছে।

(৬) এতে উভয় অঞ্চলের পাকিস্তানীদের ঐক্য-বোধের মূলে কুঠারাঘাত করা হইয়াছে। তাদের মধ্যে ‘আমরা’ ও ‘তোমরা’-ভাব সৃষ্টি করা হইয়াছে। প্রেসিডেন্ট আইউব নিজে পূর্ব-পাকিস্তানীদের ‘ভারতের আদিম অধিবাসী, ধর্ম-কৃষ্টিতে হিন্দু প্রাবাধীন, চির-পরাধীন, সন্দেহপরায়ণ ও স্বাধীন জীবনযাপনে অনভ্যস্ত’ আখ্যা দিয়া এবং পূর্ব ও পশ্চিমের গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়া জাতীয় সংহতির ঘোরতর অনিষ্ট করিয়াছেন। এসব কথা বলিতে গিয়া তিনি শুধু গোটা পূর্ব-পাকিস্তানীদের উপর অবিচারই করেন নাই; সত্য ও ইতিহাসের তিনি অপমান করিয়াছেন। এই পরিস্থিতি ব্যক্তির সৃষ্ট নয়, বিপ্লবের কুফ; কারণ স্বয়ং আইউব সাহেবই বিপ্লবের অবদান।

(৭) জাতির পিতা কায়েদে-আযমের জন্মস্থান ও মৃত্যুস্থান করাচি হইতে জাতির পিতার নিজ হাতে স্থাপিত রাজধানী সরাইয়া পাঞ্জাবে নিয়া যাওয়ায় জাতির পিতার সমান, মর্যাদা ও ইমেজে আঘাত করা হইয়াছে। জাতির পিতার ইমেজ তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান এবং তাঁর শেষ ইচ্ছা ও ওসিয়ত রক্ষার দায়িত্ব-বোধ আমাদের জাতীয় ঐক্যবোদ্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপাদান। সব নব-সৃষ্ট জাতির পিতা সম্বন্ধেই একথা সত্য। ভৌগোলিক ব্যবধান ও অন্যান্য পার্থক্যের দরুন এটাই আমাদের প্রধান জাতীয় সম্পদ।

(৮) এই রাজধানী স্থানান্তরে রাষ্ট্রের রাজধানী ও কেন্দ্রীয় সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানী জনগণের নাগালের বাহিরে নেওয়া হইয়াছে। কোস্টাল ট্রাফিক ন্যাশনালাইজ করিয়া জাহাজের সংখ্যা বাড়াইয়া সাবসিডির সাহায্যে তাড়া কমাইয়া রাজধানীতে যাতায়াত পূর্ব-পাকিস্তানীদের জন্য সহজ ও সুলভ করিয়া এবং উভয় অঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যে অধিকতর প্রত্যক্ষ ও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপনের ব্যবস্থা করিয়া জনগণের স্তরে জাতীয় সংহতিকে সফল করিবার যে বিপুল সম্ভাবনা ও একমাত্র পন্থা ছিল, রাজধানীকে সমুদ্র পথ হইতে বহু দূরে সরাইয়া সে সম্ভাবনা ও পন্থা চিরতরে লোপ করা হইয়াছে।

আইউব যতগুলি সেট বিষয় আসেটল্ড করিয়াছেন, তার মধ্যে রাজধানী স্থানান্তরটাই সবচেয়ে মারাত্মক। মারাত্মক এই জন্য যে আইউব-কৃত অন্যান্য ওলট পালটের সংশোধনের মত সহজে এটার সংশোধন হইবে না। হইবে না এই জন্য যে যাদের ঘরের দুয়ারে রাজধানী গিয়াছে তাঁরা ছাড়িতে চাহিবেন না। অর্থ-ব্যয় বারবার রাজধানী স্থানান্তর ইত্যাদি অনেক কুযুক্তি দিবেন। দেওয়া শুরুও করিয়াছেন। রাজধানীর হকদার ছিল পূর্ব-পাকিস্তানীরা। শুধু জাতির পিতার খাতিরে তারা করাচিতে রাজধানী মানিয়া লইয়াছিল। পশ্চিম পাকিস্তানীরা যদি কায়েদের স্মৃতির মর্যাদা না দেয়, তবে একা পূর্ব-পাকিস্তানীরা দিলে কি লাভ? অতএব পূর্ব-পাকিস্তানীরা এখন ন্যায়তঃই চাইবে ঢাকায় রাজধানী আসুক। এটা শুধু মেজরিটির গণতান্ত্রিক দাবিই নয়, শতকরা নৰ্বইজন পূর্ব-পাকিস্তানী নব্বই বছর বাঁচিয়াও নিজের দেশের রাজধানী দেখিয়া মরিতে পারিবে না, প্রশ্নটা শুধু তাও নয়, রাজধানীর সংগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও অর্থ বন্টন ও প্রয়োগ, আঞ্চলিক অসাম্য দূরীকরণ, সরকারী-বেসরকারী চাকুরী, সাপ্লাই, কন্ট্রাকদারি, বিদেশী মিশন ইত্যাদি সমস্ত ব্যাপারই অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। অবস্থাগতিকে অন্যান্য সব কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানই পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। কাজেই পূর্ব পাকিস্তানীরা রাজধানী ছাড়া বাঁচিতে পারে না। এই জটিল সমস্যাটিই আইউব খুলিয়া দিয়াছেন।

(৯) পার্টি-রাজনীতিকে মসি-মলিন কুৎসিৎ করা হইয়াছে। প্রেসিডেন্সিয়াল বা পার্লামেন্টারি কেবিনেট যে সিস্টেমেই দেশ শাসিত হউক না কেন, রাজনৈতিক পার্টি উভয় ক্ষেত্রেই আবশ্যক। বর্তমান বিপ্লব এই দলীয় রাজনীতিকেই কুৎসিৎ মসিলিপ্ত ও বদ-সুরত করিয়াছে। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট আইউব নিজে কায়েদে-আযমের পরিচালিত ও পাকিস্তান অর্জনকারী মুসলিম লীগের নামানুসারে নিজের পার্টি খাড়া করিয়াছেন বটে কিন্তু তাতে ঐ মুসলিম লীগকে পার্টির মর্যাদা দেওয়া হয় নাই, ক্যারিকেচার করা হইয়াছে মাত্র। কায়েদে-আযম গভর্নর জেনারেল হইয়া মুসলিম লীগের সভাপতিত্বে ইস্তাফা দিয়াছিলেন। আইউব সাহেব হেড-অব-দি স্টেট হিসাবেই হেড-অব-দি- মুসলিম লীগ হইয়াছে ও থাকিতেছেন। এই মুসলিম লীগের অফিসবিয়ারাররা নির্বাচিত হন না। প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিয়োজিত ও পদচ্যুত হন। নির্বাচনে ‘মুসলিম লীগ মেনিফেস্টো’ প্রচারিত হয় না,  হয় ‘মাই মেনিফেস্টো’।

(১০) গণতন্ত্রের চেহারা খারাপ করা হইয়াছে। প্রেসিডেনশিয়াল ও পার্লামেন্টারি এই দুইটা পশ্চিমী গণতান্ত্রিক পন্থা ছাড়াও সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে যে পার্টি ডিক্টেটরশিপ চলিতেছে, তাকেও গণতান্ত্রিক বলা যায় এবং বলা হইতেছে। কারণ, সেখানে রাষ্ট্রনায়করা পশ্চিমা গণতন্ত্রের মত সোজাসুজি ভোটারদের আয়ত্তাধীন না হইলেও পার্টির সদস্যগণের কর্তৃত্বাধীন। কিন্তু আইউব সাহেব যে পদ্ধতি প্রচলন করিয়াছেন, তাতে প্রেসিডেন্ট ও তার মন্ত্রীদের উপর মুসলিম লীগ পার্টির বা আইন পরিষদের অথবা ইলেকটরেল কলেজ নামক ব্যাসিক ডিমোক্র্যাটদের কোনও ক্ষমতা নাই। কারণ ব্যাসিক ডিমোক্র্যাটরা সরকারী কর্মচারির অধীন। সরকারী কর্মচারিরা প্রেসিডেন্টের অধীন। কাজেই এটা আসলে পার্টি-ডিক্টেটরশিপনয়, ব্যক্তি-ডিক্টেটরশিপ। এটাকে ব্যাসিক ত দূরের কথা, কট্রোল ডিমোক্র্যাসি বলিলেও ‘ডিমোক্রাসি’ কথাটার অমর্যাদা করা হয়।

এইসব লোকসানের কুফলের সবগুলি মিলিয়া বা এর যে-কোনও দুই-একটা পাকিস্তানের সংহতি ও নিরাপত্তা বিপন্ন করিতে পারে এবং করিতেছে। দেশবাসীর দুর্ভাগ্য এই যে রাষ্ট্রনেতারা একজনের পর আরেকজন কেবল ভুলের উপর ভুলই করিয়া যাইতেছেন। পূর্ববর্তী সরকারের ভুল-ভ্রান্তির জন্য দেশবাসীর ভোগান্তির সীমা ছিল না। সেই ভোগান্তির অবসান ঘটাবার মহৎ উদ্দেশ্য লইয়া যাঁরা আসিলেন, তাঁরা আগের ভুলের প্রতিকারের বদলে নুতন করিয়া মারাত্মক সব ভুল করিতে লাগিলেন।

এতসব ভুল-ভ্রান্তি অন্যায়-অনাচার সহিয়াও পাকিস্তান টিকিয়া আছে। ইনশাআল্লাহ্ টিকিয়া থাকিবেও। কিন্তু এই টিকিয়া থাকায় নেতাদের কোনও কৃতিত্ব নাই। পাকিস্তান টিকিয়া আছে রাষ্ট্রনেতাদের জন্য নয়, তাঁরা সত্ত্বেও সকল দলের সকল আমলের রাষ্ট্রনায়করা চেষ্টা করিয়াও রাষ্ট্র ধ্বংস করিতে পারেন নাই খোদার ফযলে সে রাষ্ট্রের হায়াত আছে। এর শুধু টিকিয়া থাকার নয়, বাঁচিয়া থাকারও অধিকার আছে। বুদ্ধি যতই কম হউক, আর ভূল-ভ্রান্তি যতই জটিল হউক, বিশ বন্ধ সময় তা বুঝিবার জন্য যথেষ্ট। এবার সকলে মিলিয়া নয়া অভিজ্ঞতার আলোতে নব উদ্যমে পাকিস্তানকে সুগঠিত শক্তিশালী গণতান্ত্রিক আধুনিক রাষ্ট্রে ও পাকিস্তানীদের সুসংবদ্ধ মূখী ও সুশিক্ষিত নাগরিক-গোষ্ঠীতে পরিণত করিয়া ওদিককার কায়েদে আযম ও কায়েদে-মিল্লাক্সে আর এদিকের শেরে-বাংলা ও শহীদে-মিল্লাতের লাহোরের স্বপ্নকে সফল করিয়া কুন। আমিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *