২৮. ঘনঘটা

ঘনঘটা
আটাইশা অধ্যায়

১. পার্টি-ফণ্ডের কেম্পেইন শুরু

শেষ পর্যন্ত ১৮ই অক্টোবর (১৯৫৭) ১৪ জন মন্ত্রীর চুন্দ্রিগড়-মন্ত্রিসভা গঠিত হইল। আমরা বিদায় নিলাম। বিদায়ের আগে লিডার একটা প্রেস-কনফারেন্স করিলেন। আমাদের যাওয়ার কথা নয়। তবু আমরা দুই-একজন গেলাম। কনফারেন্সের কাজ আগেই শুরু হইয়া গিয়াছিল। দেখিলাম, রিপোর্টাররা শহীদ সাহেবকে নানারূপ প্রশ্ন করিতেছেন। শহীদ সাহেব কষিয়া জবাব দিতেছেন। তিনি মন্ত্রিত্বের তোয়াক্কা করেন না; বড় একটা আদর্শের জন্যই তাঁর মন্ত্রিত্ব স্যাক্রিফাইস করিতে হইয়াছে। এসব কথা তিনি খুব জোরের সংগেই যুক্তিতর্ক দিয়া বুঝাইলেন। আমি খুশী হইলাম।

কোনও কোনও সংবাদিক বন্ধু আমাকে জানাইলেন : মর্নিং নিউযে’র রিপোর্টার আমার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ করিয়াছেন। ঐ রিপোর্টার বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করিয়াছেন। তাঁর বাণিজ্য মন্ত্রী লাইসেন্স পারমিট বিতরণ করিয়া চার কোটি টাকা পার্টি-ফণ্ড তুলিয়াছেন একথা তিনি অবগত আছেন কি না? আমি স্বাভাবিক কৌতূহলে বন্ধুদেরে জিগাসা করিলাম : শহীদ সাহেব কি জবাব দিলেন? বন্ধুরা বলিলেন : বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ধীর কণ্ঠে জবাব দিয়াছেন : আপনার কাছেই আজ সর্বপ্রথম এই কথা শুনিলাম।

পরদিন ‘মনিং নিউযে’ ঐ প্রশ্নোত্তর ছাপা হইল। শুধু তাই নয়। বাণিজ্য দফতরে আমার উত্তরাধিকারী মন্ত্রী মিঃ ফযলুর রহমান মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিয়াই একটি প্রেস কনফারেন্স করিলেন। অন্যান্য কথার মধ্যে তিনিও ঐ চার কোটি-ফও ভোলার অভিযোগের পুনরুল্লেখ করিলেন। তবে তিনি সোজাসুজি কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রী না বলিয়া আওয়ামী লীগ মন্ত্রীরা বলিলেন। আমি তখনও সরকারী মন্ত্রি-ভবনেই আছি। ফযলুর রহমান সাহেব তখনও নিজের বাড়িতেই আছেন। আমি কাগটা পড়িয়াই তাঁকে ফোন করিলাম। লাইসেন্স বিতরণে আমার প্রবর্তিত নয়া কানুনে, এবং আই, সি, এর সাহায্যের, সব লাইসেন্স বিতরণের ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের, এসব কথা শুনিয়া তিনি বলিলেন : ভাই, আমি সব কথা জানি। আপনে মনে কিছু করিবেন না। আমি বাণিজ্য দফতরে আগেও মন্ত্রিত্ব করিয়াছি। আপনার বিরুদ্ধে আমি কিছু বলিতে পারি না। বলিও নাই। শুধু প্রাদেশিক মন্ত্রীরে একটু খোঁচা দিয়া রাখিলাম।

আমি বন্ধুবরের রসিকতার জবাবে রসিকতা করিয়াই বলিলাম : খোঁচার টার্গেট আপনার যেই থাকুক, ওটা কিন্তু লাগিয়াছে সাহায্য দাতাদের গায়। কারণ লাইসেন্স প্রাপকরা তাঁদেরই বাছাই-করা লোক। জবাবে ফযলুর রহমান সাহেব শুধু বলিলেন : তাই নাকি? এটাত জানিতাম না। আমি গম্ভীরভাবে বলিলাম : ফাইলপত্র দেখুন। এবং পযিশন ক্লিয়ার করিয়া একটা বিবৃতি দিন। টেলিফোন রাখিয়া দিলাম।

করাচির কাগযগুলির বেশির ভাগই এ ব্যাপারটা লইয়া রোজ আওয়ামী লীগ পার্টির ও ব্যক্তিগতভাবে আমার বিরুদ্ধে প্রচার-প্রপাগাণ্ড চালাইয়া যাইতে লাগিল। ফযলুর রহমান সাহেব ‘পযিশন ক্লিয়ার’ করিয়া কোনও বিবৃতি দিলেন না। আমি অগত্যা লিডারের অনুমতি চাহিলাম মর্নিং নিউযের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করিতে। আমার বিরুদ্ধে ‘মর্নিং নিউযের আক্রোশ আছে, একথাও তাঁকে বলিলাম। ঘটনাটা এই: নিউয প্রিন্ট কনটোলার শিল্প দফতরের অধীন। পূর্ব-পাকিস্তানের প্রায় সব কয়টা দৈনিকের এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কোনও কোনও দৈনিকের পক্ষে আমার কাছে নালিশ করা হইল যে নিউয প্রিন্টের ব্যাপারে তাঁরা সুবিচার পান না। অডিট বুরোর রিপোর্ট মোতাবেক প্রচার সংখ্যা অনুসারে সবাই কাগ পান, এটাই ছিল আমার বিশ্বাস। এঁদের অভিযোগে কাজেই নিউ প্রিন্ট কনট্রোলারের রিপোর্ট তলব করিলাম। তাঁর রিপোর্টের সমর্থনে কনট্রোলার মিঃ আবদুল আযিয আমার নিকট কাগ-পত্র দাখিল করিলেন। আমি ঐসব কাগ-পত্র দেখিয়া প্রয়োজন মত প্রতিকার করিলাম। কিন্তু ঐসব কাগয-পত্র দেখিতে-দেখিতে একটা ‘কেঁচু খুঁড়িতে সাপ’ দেখার ব্যাপার ঘটিয়া গেল। দেখিলাম, কত পৃষ্ঠার কাগয, শুধু তাই দেখিয়া নিউযপ্রিন্টের কোটা ঠিক করা হয়। ‘ডন’, ‘পাকিস্তান টাইমস’, ‘পাকিস্তান অবযারভার’, ‘আজাদ’, ‘ইত্তেফাক’, ‘মর্নিং নিউয’ সবারই এক হিসাব। আমি কনট্রোলারকে বলিলাম : এটা কি আপনার বিবেচনায় আসে নাই যে অন্য সব কাগযই ডবল-ডিমাই; একমাত্র ‘মনিং-নিউযই’ ডবল ক্রাউন? ডবল-ডিমাই ও ডবল ক্রাউনে কত তফাৎ আপনি জানেন? কনট্রোলার ভুল স্বীকার করিলেন। হিসাবে মর্নিং নিউযের কোটা অনেক কমিয়া গেল। এতদিন যে মর্নিং নিউয’ অতিরিক্ত নিউয প্রিন্ট নিয়াছে, তার ব্যবহার কিভাবে হইয়াছে, এর মধ্যে বজ্জাতি আছে কি না, থাকিলে বজ্জাতিটা কার, এসব কথা স্বভাবতঃই আসিল। শেষ পর্যন্ত ‘মনিং নিউযে’র কিছু হইল না উপরের তলার ধরাধরিতে। কিন্তু কোটার বাড়তিটা তার আর থাকিল না। এই বাড়তি কাগ দিয়া তারা এতদিন কি করিত, তা আল্লাই জানেন। কিন্তু এটা কমিয়া যাওয়ায় আমি যেন তাদের জানী দুশমন হইয়া গেলাম। মালিকদের দুশমন হইবার কারণ বুঝা যায়। কিন্তু জার্নালিস্টদের দুশমন কেন হইলাম, তা বুঝিতে আমার অনেক দিন লাগিয়াছিল।

যা হোক, লিডারকে এসব কথা বলিবার পরে তিনি হাসিয়া বলিলেন : আইনের দিক হইতে বলিতে গেলে তোমার মামলা খুবই ভাল। কিন্তু তুমি রাজনীতিক। রাজনীতিককে এমন পাতলা-চামড়া হইলে চলে না। দুর্নীতির অভিযোগ কোন নেতার বিরুদ্ধে না হইয়াছে? বিদেশে জর্জ ওয়াশিংটন, লিংকনের কথা বাদ দিলেও এ দেশেরও গান্ধীজিন্না-সি.আর.দা-সুভাষচন্দ্র-ফযলুল হক এমনকি তোমার নেতা এই সুহরাওয়ার্দী পর্যন্ত কে রেহাই পাইয়াছেন? কে কবে গিয়াছেন মানহানির মামলা করিতে? কেউ যান নাই। একটু থামিয়া একটা অট্টহাসি দিয়া বলিলেন : হ, পূর্ব বাংলার এক নেতা মানহানির মামলা করিয়াছেন। জিতিয়াছেনও। তুমি যদি আমাদের সবাইকে ছাড়িয়া তাঁর অনুরণ করিতে চাও, যাও তবে মামলা কর গিয়া।

মামলা করার উৎসাহ পানি হইয়া গেল, তার বদলে একটা লম্বা বিবৃতি দিলাম। যে ‘মর্নিং নিউযে’র অভিযোগের জবাবে ঐ বিবৃতি, সেই কাগযটি ছাড়া আর সব কাগযই মোটামুটি আমার বিবৃতি ছাপাইলেন। করাচির ‘ডন’ ও ঢাকার ইত্তেফাক আমার পূরা বিবৃতি ছাপিয়া আমাকে কৃতজ্ঞতা-পাশে বাঁধিলেন।

২. আসল মতলব ফাঁ

এদিকে নয়া প্রধানমন্ত্রী মিঃ চুন্দ্রিগড় তাঁর প্রথম বেতার ভাষণেই যুক্ত-নির্বাচনের বদলে পৃথক-নির্বাচন পুনঃপ্রবর্তনের সংকর ঘোষণা করিলেন। এই বেতার ভাষণে তিনি দুইটি দাবি করিলেন। এক, মুহতারেমা মিস ফাতেমা জিন্না চুন্দ্রিগড় মন্ত্রিসভাকে সমর্থন দিয়াছেন। দুই, রিপাবলিকান পার্টি পৃথক-নির্বাচনে সম্মত হইয়াছে।

মুহতারেমা মিস ফাতেমা জিন্না পরের দিনই এক বিবৃতি দিয়া মিঃ চুন্দ্রিগড়ের দাবি অস্বীকার করিলেন। ফলে মিঃ চুল্লিগরে দুইটা লোকসান হইল। প্রথমতঃ তিনি ব্যক্তিগতভাবে অসত্যবাদী প্রমাণিত হইলেন। দ্বিতীয়তঃ তাঁর মন্ত্রিসভার নৈতিক শক্তি অনেকখানি কমিয়া গেল।

রিপাবলিকানদের অনেকেই আসলে মুসলিম লীগার। সুতরাং তাঁরা পৃথক নির্বাচনে সম্মত হইয়াছেন শুনিয়া বিস্মিত হইলাম না। কিন্তু ডাঃ খান সাহেব প্রভৃতি কতিপয় নেতাকে আমি নীতিগতভাবেই যুক্ত নির্বাচনের সমর্থক করিয়া জানিতাম। তিনিও পৃথক নির্বাচনে সম্মত হইয়াছেন এটা বিশ্বাস করিলাম না। ঢাকা হইতে মিঃ হামিদুল হক চৌধুরী খবরের কাগয়ে বিবৃতি দিয়া চুন্দ্রিগড়-মন্তিসভাকে সমর্থন করিলেন। কিন্তু সংগে-সংগেই যুক্ত-নির্বাচন প্রথা বজায় রাখিবার অনুরোধও তিনি করিলেন। নয়া মন্ত্রীদের মধ্যে আমি বাছিয়া-বাছিয়া সৈয়দ আমজাদ আলী, মিয়া যাফর শাহ, আবদুল লতিফ বিশ্বাস প্রভৃতিকে এ ব্যাপারে জিগাসাবাদও করিলাম। আকার ইংগিতে ক্যানভাসও করিলাম। ভরসাও তাঁরা মোটামুটি দিলেন। চুন্দ্রিগড়-মন্ত্রিসভার প্রথম কেবিনেট বৈঠকে যুক্ত-নির্বাচন-প্রথার বদলে পৃথক নির্বাচন চালু করিবার প্রস্তাব সম্পর্কে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হইতে পারে নাই, এ সংবাদ পড়িয়া কতকটা আস্তও হইলাম।

শাসনতন্ত্রের বিধান অনুসারে আইন-পরিষদের আগামী বৈঠক ঢাকায় হইতে বাধ্য। সেই বৈঠকে যুক্ত-নির্বাচন-প্রথাকে বাঁচাইয়া রাখার শেষ চেষ্টা করিব ভাবিতেছিলাম। এমন সময় মন্ত্রিসভা ঠিক করিলেন যে নবেম্বর মাসেই নির্বাচন-প্রথা বদলাইবার জন্য পরিষদের একটা বৈঠক তাঁরা করাচিতেই করিবেন। আমরা বিপদ গণিলাম। কিন্তু চেষ্টা ছাড়িলাম না।

. আত্মঘাতী পরনিন্দা

এদিকে ধর্মের ঢোল বাতাসে বাজিয়া উঠিল। আমরা শত্রুদের বিরুদ্ধে কিছু না করিলেও স্বয়ং এইড-দাতারা মাঠে নামিলেন। বাণিজ্য মন্ত্রী মিঃ ফযলুর রহমানের বিবৃতিতে বলা হইয়াছিল : আই.সি.এ.এইড বাবত লাইসেন্স বিতরণে দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করা হইয়াছে। পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মিঃ ল্যাংলি এক বিবৃতিতে বলিলেন : বাণিজ্যমন্ত্রীর এই অভিযোগ গুরুতর। ইহা কার্যতঃ মার্কিন অফিসারদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ। কারণ পূর্ব-পাকিস্তানে নয়া-শিল্প বাবত লাইসেন্স বিতরণের জন্য যেসব শিল্প ও তার দরখাস্তকারী নির্বাচন করা হইয়াছে, তা করিয়াছেন আই.সি.এ.’র প্রেরিত প্রজে লিডারগণ নিজেরা। এ অবস্থায় ঐ নির্বাচনে যদি কোনও দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করা হইয়া থাকে, তবে আই.সি.এ.রঅফিসাররাই করিয়াছেন। অতএব এ বিষয়ে অনুসন্ধান করা মার্কিন সরকারের কর্তব্য। সে অনুসন্ধান হওয়া সাপেক্ষে আই.সি.এ. এইড দেওয়া স্থগিত রাখিবার জন্য আমার সরকারকে সুপারিশ করিয়া আমি তারবার্তা পাঠাইলাম।

চুন্দ্রিগড়-মন্ত্রিসভা ব্যস্ততার সংগে তড়িৎগতিতে এক বিশেষ যরুরী বৈঠকে মিলিত হইলেন। মিঃ ল্যাংলিকে অনেক প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা হইল। প্রস্তাবে বলা হইল আই. সি. এ. অফিসারদের বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র অভিযোগ করিবার ইচ্ছা ক্ষুণাক্ষরেও বাণিজ্যমন্ত্রীর ছিল না। তিনি শুধু আওয়ামী লীগ-নেতাদের দোষী করিতে চাহিয়াছিলেন। তবু যদি আই.সি.এ. অফিসাররা ও মিঃ ল্যাংলি মনক্ষুণ্ণ হইয়া থাকেন, তবে মন্ত্রিসভা সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করিতেছেন। মিঃ ল্যাংলি যেন তাঁর সুপারিশ প্রত্যাহার করিয়া এইড বজায় রাখেন।

কিন্তু মার্কিন সরকার তাঁদের সিদ্ধান্ত বদলাইলেন না। চুন্দ্রিগড় মন্ত্রিসভা শেষ পর্যন্ত উক্ত ‘ইণ্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনারি এইড’কে ‘কমোডিটি এইড’ এ রূপান্তরিত করিতে রাখী হইয়া মার্কিন সরকারের নিকট প্রস্তাব পাঠাইলেন। তবু মার্কিন সরকার সেই পাঁচ কোটি টাকার সাহায্য দিতে রাযী হইলেন না। বরঞ্চ উহা চূড়ান্তরূপে বাতিল ঘোষণা করিলেন। কিন্তু মার্কিন সরকার যদি রাযী হইতেনও তথাপি শিয়োন্নয়নের দিক হইতে উক্ত এইড মূল্যহীন ও অবান্তর হইত। চুন্দ্রিগড় মন্ত্রিসভা অবশ্য ভরশা দিয়াছিলেন যে পাকিস্তানের নিজস্ব অর্জিত বিদেশী-মুদ্রা হইতে পূর্ব-পাকিস্তানের পরিকল্পিত শিল্পগুলি স্থাপন করিবেন। কিন্তু কেউ তাতে বিশ্বাস করে নাই। মুখ ও মন্ত্রিত্ব রক্ষার জন্য ওটাকে তাঁদের ভাওতা মনে করিয়াছে। শেষ পর্যন্ত ওটা ভাওতাই প্রমাণিত হইল। পূর্ব-পাকিস্তানে ৫৮টি নয়া-শিল্প প্রতিষ্ঠার যে পরিকল্পনা পূর্ব-পাক সরকার করিয়াছিলেন, তা আর কার্যকরী করা হইল না। প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের বিশেষ সাহস ও উদ্যোগে পূর্ব-পাকিস্তানের নিজস্ব কোটা হইতে বিদেশী মুদ্রা দিয়া উক্ত ৫৮টি শিল্পের মধ্যে মাত্র ৩/৪টি স্থাপন করা সম্ভব হইয়াছিল। প্রতিপক্ষীয় রাজনীতিক নেতাদের ও পার্টির বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা করিতে গিয়া দায়িত্বশীল ব্যক্তির অসাবধান উক্তির ফলে দেশের কি অনিষ্ট হইতে পারে, এই ঘটনাটি তার প্রমাণ স্বরূপ ইতিহাসের পৃষ্ঠায় দুরপনেয় হইয়া থাকিবে।

৪. নির্বাচনে বাধা

পূর্ব-পাকিস্তানের এই সর্বনাশ করিবার পর চুন্দ্রিগড়-সরকার গোটা পাকিস্তানের সর্বনাশ করার কাজে হাত দিলেন। প্রধানতঃ যুক্ত-নির্বাচন-প্রথা বাতিল করিয়া পুনরায় পৃথক নির্বাচন-প্রথার প্রবর্তনের যিকির তুলিয়াই মুসলিম লীগ-নেতারা মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিয়াছিলেন। মন্ত্রিসভা গঠন করিয়াই তাঁরা নির্বাচন-প্রথা সংশোধনী বিল ও নির্বাচনী আইন সংশোধনী বিল রচনা করিয়া ফেলিলেন। বিস্ময়কর অসাধারণ অদূরদর্শিতার (অথবা দূরদর্শিতার?) দরুনই এটা তাঁরা করতে পারিলেন। তাঁরা ভুলিয়া গেলেন?

(১) ভোটের লিস্ট সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নূতন করিয়া রচনা করিতে হইবে।

(২) হিন্দু-মুসলিম আসনের হার ও সংখ্যা নির্ধারণ করিতে হইবে।

(৩) হিন্দু-মুসলিম জনসংখ্যার জন্য ১৯৫১ সালের আদমশুমারির উপর নির্ভর করিলে পূর্ব-পাকিস্তানের মুসলমানদের উপর সাংঘাতিক অবিচার করা হইবে। কারণ ঐ আদমশুমারির পরে এই সাত বছরে বহু হিন্দু পাকিস্তান ছাড়িয়া গিয়াছে।

(৪) অতএব নূতন করিয়া আদমশুমারির দরকার হইবে; অথবা ১৯৬১ সালের আদমশুমারি-তক অপেক্ষা করিতে হইবে।

(৫) সাধারণ নির্বাচন পাঁচ বছরের জন্য পিছাইয়া দিতে হইবে।

আমরা বলিলাম বটে এটা মুসলিম লীগ-নেতাদের অদূরদর্শিতা; কিন্তু অনেক বুদ্ধিমান লোক বলিলেন এটা তাঁদের দূরদর্শিতা। কারণ সাধারণ নির্বাচন পিছাইয়া দেওয়াই বুদ্ধিমান লোকদের উদ্দেশ্য। তাঁদের কথা সত্য হইতে পারে। মুসলিম লীগ নেতারা নির্বাচনকে ভয় পান, সেটা তারা অতীতে বহুবার প্রমাণ করিয়াছেন। পূর্ব পাকিস্তানে ৩৫টি উপ-নির্বাচন আটকাইয়া রাখিয়াছিলেন। নয় বছর তাঁরা শাসনতন্ত্র রচনা আটুকাইয়া রাখিয়াছিলেন। ৫৪ সালের পূর্ব-বাংলার সাধারণ নির্বাচনের ঘা তখনও শুকায় নাই। এটা ত মুসলিম লীগ নেতাদের নিজেদের ভাব-গতিক। তার সংগে যোগ দিয়াছিলেন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্যা। সাধারণ নির্বাচনের সাথে সাথেই তাঁর আয়ু শেষ হইবে, এ আশংকা তাঁকে ভীষণরূপে পাইয়া বসিয়াছিল।

৫. চুন্দ্রিগড়মন্ত্রিসভার পদত্যাগ

এসব কারণে চুন্দ্রিগড়-মন্ত্রিসভা পূর্ব-পাকিস্তানের মেজরিটি মেম্বারদের সাহায্য হইতে বঞ্চিত হইলেন। প্রেসিডেন্ট মির্যা প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও ডাঃ খান সাহেবের নেতৃত্বে ও প্রভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের রিপাবলিকান দলে ভাংগন ধরাইতে পারিলেন না। ফলে চুন্দ্রিগড়-মন্ত্রিসভার বিলগুলি বিলে পড়িল। তাঁরা কেন্দ্রীয় আইন-সভায় মেজরিটি করিতে পারিলেন না। অনেক টিলামিছি করিয়া শেষ পর্যন্ত ১১ই ডিসেম্বর। আইন পরিষদের বৈঠক দিলেন। কিন্তু নিশ্চিত পরাজয় জানিয়া তার আগেই পদত্যাগ করিলেন।

আমাদের নেতা শহীদ সাহেব একমাত্র যুক্ত নির্বাচন প্রথায় সাধারণ নির্বাচন দেওয়ার শর্তে রিপাবলিকান মন্ত্রিসভা গঠনের অফার দিলেন। আমাদের কয়েকজনকে দিয়া রিপাবলিকান নেতাদের আশ্বাস দেওয়াইলেন। জনাব আতাউর রহমান, মুজিবুর রহমান ও আমি বিনা-মন্ত্রিত্বে শুধু যুক্ত-নির্বাচন-প্রথায় অবিলম্বে সাধারণ নির্বাচন করার শর্তে রিপাবলিকান মন্ত্রিসভা সমর্থন করিতে সম্মত হইলাম। যুক্ত-নির্বাচন বাদী পূর্ব পাকিস্তানী অন্য যে কোনও ব্যক্তি বা দলকে মন্ত্রিসভায় নিতে আমাদের আপত্তি নাই, তাও জানাইয়া দিলাম। শুধু আমরা আওয়ামী লীগের কেউ মন্ত্রিত্ব নিব না এই কথায় আমরা দৃঢ় থাকিলাম।

তাই হইল। ফিরোজ খাঁ-মন্ত্রিসভা গঠিত হইল। তাঁরা তাঁদের ওয়াদা রক্ষাও করিলেন। সর্বদলীয় সম্মিলনীর বৈঠক ডাকিয়া প্রধানমন্ত্রী ফিরোয় খাঁ নুন ১৯৫৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি সাধারণ নির্বাচনের চুড়ান্ত দিন-তারিখ ঘোষণা করিলেন।

৬. আওয়ামী লীগে গৃহ-বিবাদ

মন্ত্রিত্ব যাওয়ার পর আমার যথারীতি বরাবরের কর্মস্থল ও ওকালতির জায়গা ময়মনসিংহে ফিরিয়া যাওয়ারই কথা। ইতিমধ্যে করাচি ত্যাগ করিয়া ময়মনসিংহে যাওয়ার পথে ভায়রা-ভাই খোন্দকার আবদুল হামিদ এম, এল, এর মধ্যস্থতায় কয়েকদিনের জন্য জনাব কে. জি, আহমদ সাহেবের আতিথেয়তা গ্রহণ করিয়া ঢাকায় থাকিয়া গেলাম। প্রধানমন্ত্রী বন্ধুর আতাউর রহমান খা ও অন্যান্য বন্ধুরা আমাকে ময়মনসিংহের বদলে ঢাকায় থাকিতে এবং হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করিতে অনুরোধ করিলেন। লিডারও ঐ একই পরামর্শ দিলেন। তিনি আরও বলিলেন রাজনৈতিক প্রয়োজনে আমাকে ময়মনসিংহের চেয়ে ঢাকায় থাকিতে হইবে। কিন্তু সবার উপরে কাজ করল নিজের অহমিকা। এর হাত হইতে বোধ হয় কোনও সাধারণ মানুষই রক্ষা পায় না। এই অহমিকা আমাকে বলিল : বড়-বড় সব নেতাই ত রাজধানীতে থাকেন। তুমি কেন রাজধানীতে থাকিবে না? তুমি ত এখন আর একটা জেলার নেতা নও। সুতরাং আর চিন্তা-ভাবনার কিছু নেই। ঢাকাই ঠিক হইল। বাড়ি ভাড়া করিলাম। লাইব্রেরি ময়মনসিংহ হইতে ঢাকায় লইয়া আসিলাম।

কিন্তু ওকালতি শুরু করা সম্ভব হইল না। প্রথম কয়দিন হাইকোর্টে যাতায়াত করিয়াই কয়েকটা ব্রিফ পাইলাম। আলীপুরে প্র্যাকটিস করিবার সময় যাঁরা আমার জুনিয়র ছিলেন তাঁরা অনেকেই ইতিমধ্যে এ্যাকটিসের দিক দিয়া আমার সিনিয়র হইয়া গিয়াছেন। তবু বয়সে আমি তাঁদের অনেক বড় বলিয়া, একটা এক্স-মিনিস্টার বলিয়া এবং সম্ভবতঃ বিচারপতিদের অনেকেই আমারে ‘সম্মান করেন বলিয়া ওঁদের দুই একজন আমাকে সিনিয়র এনগেজ করিলেন। কিন্তু অল্পদিন মধ্যেই আমাদের পার্টি রাজনীতিতে, কাজেই মন্ত্রিসভায়, এমন ঝামেলা বাঁধিয়া গেল যে আমি দিন-রাত তাতে ব্যস্ত হইয়া পড়িলাম। আমার বাসা চর্বিশ ঘন্টার রাজনীতিক আখড়ায় পরিণত হইল। মণ্ডকেলও জুনিয়ররা ঢুকিতেই পারেন না। বেশ কয়টা এডজোর্নমেন্ট নিয়া অবশেষে ব্রিফ ও বায়নার টাকা ফেরত দিলাম। লিডার বলিলেন, আগামী নির্বাচনের আগে ওকালতির আশা ছাড়িয়া দেওয়াই ভাল। শুধু কথায় নয়, কাজেও তিনি নিজে তাই করিলেন। ঢাকাকেই তিনি তাঁর প্রধান বাসস্থান বানাইলেন। কাজেই আমিও ওকালতির আশা আপাততঃ ত্যাগ করিলাম। কয়েকটা বাই-ইলেকশন ছিল। আমরা তাই লইয়া ব্যস্ত হইলাম। সবকয়টা বাই-ইলেকশনেই আমরা জিতিলাম।

কিন্তু ইতিমধ্যে গৃহ-বিবাদের অশান্তি আমাদের পাইয়া বসিয়াছিল। আতাউর রহমান সাহেব ও মুজিবুর রহমান সাহেবের মধ্যে ব্যাপারটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে নামিয়া পড়িয়াছিল। দুইজনই আদর্শবাদী দেশপ্রেমিক। দুই-এর দক্ষ পরিচালনায় আওয়ামী লীগ-মন্ত্রিসভা এক বছরে অনেক ভাল কাজ করিয়াছে। ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা, ওয়াপদা, আইডবলিউ-টি-এ, ফিল্ম কর্পোরেশন, জুট মার্কেটিং কর্পোরেশন ইত্যাদি নয়া-নয়া শিল্প ও সংস্থা স্থাপন এবং খুলনা ও নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড, কাপতাই পানি-বিদ্যুৎ এই ধরনের আরদ্ধ স্কিমগুলি ত্বরান্বিত করণ, বর্ধমান হাউসে আইন মাফিক বাংলা একাডেমি স্থাপন ইত্যাদি গঠনমূলক কাজ তাঁরা করিয়াছেন। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা ইহাদের পার্লামেন্টারি সদাচার। নির্বিচারে সমস্ত রাজ-বীর মুক্তিদান, নিরাপত্তা আইনসমূহ বাতিলণ, নিয়মিতভাবে উপনির্বাচন অনুষ্ঠান, নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করার উদ্দেশ্যে অফিসারদিগকে কঠোরভাবে রাজনীতিমুক্ত রাখা, নির্ধারিত সময়ে আইন-পরিষদের বৈঠক ডাকা, বিনা-বাজেট-মনযুরিতে খরচ না করা, ইত্যাদি সকল ব্যাপারে আদর্শ গণতান্ত্রিক সরকারের উপযোগী কাজ করিয়াছেন।

এই সর্বাংগীন সদাচারের মধ্যে চাঁদের কলংকের মতই ছিল আতাউর রহমান মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত বিরোধ। এই বিরোধের সবটুকুই ব্যক্তিগত ছিল না, অনেকখানিই ছিল নীতিগত। কিন্তু কতটা নীতিগত আর কতটা ব্যক্তিগত, তা নিশ্চয় করিয়া বলা এখন সম্ভব নয়, তখনও ছিল না। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়কে নষ্ট করিয়া দেওয়ার জন্য অনেকেই দায়ী ছিলেন। কতকগুলি নীতিগত বিরোধও দায়ী ছিল। কিন্তু সবার চেয়ে বেশি ও আশু দায়ী ছিল মুজিবুর রহমানের। একগুয়েমি। ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তফ্রন্ট ভাংগিয়া দেওয়ার মূলেও ছিল মুজিবুর রহমানের কার্যকলাপ। মুজিবুর রহমানের নিজের কথা ছিল এই যে ঐ পাঁচমিশালী আদর্শহীন ম্যারেজ-অব-কনভিনিয়েন্স যুক্তফ্রন্ট ভাংগিয়া আওয়ামী লীগকে প্রকৃত গণ-প্রতিষ্ঠান হিসাবে বাঁচাইয়া তিনি ভালই করিয়াছেন। পক্ষান্তরে অনেকের মত, আমার নিজেরও, যুক্তফ্রন্ট ভাংগিয়া তিনি পূর্ব-বাংলার বিপুল ক্ষতি করিয়াছেন। এপক্ষে-ওপক্ষে বলিবার কথাও অনেক আছে। বলিবার অনেক লোকও আছেন। কিন্তু শেষ কথা এই যে যুক্তফ্রন্ট ভাংগা যদি দোষের হইয়া থাকে তবে সে দোষের জন্য মুজিবুর রহমানই প্রধান দায়ী। প্রায় সব দোষই তাঁর। আর ওটা যদি প্রশংসার কাজ হইয়া থাকে তবে সমস্ত প্রশংসা মুজিবুর রহমানের। তবে যুক্তফ্রন্টের বিরোধের সুযোগ লইয়া পরাজিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা যে পূর্ব-বাংলার উপর গবর্নরী শাসন প্রবর্তন করিয়াছিলেন, যুক্তফ্রন্ট ভাংগার ফলে যে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে পূর্ব-বাংলার দাবি-দাওয়া গৃহীত হইতে পারে নাই, এবং সেই হইতে ১৯৫৮ সালে দেশের চরম দূর্দৈব আসা পর্যন্ত সমস্ত ঘটনাকে যে যুক্তফ্রন্ট ভাংগার বিষময় পরিণাম বলা যায়, এটা দল-মত-নির্বিশেষে প্রায় সবাই স্বীকার করিয়া থাকেন। তবু এর বিচারের জন্য ইতিহাসের রায়ের অপেক্ষা করিতে হইবে।

৭. লিডারের দূরদর্শিতা

কিন্তু ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লিডার যখন আমাকে আতাউর রহমান মুজিবুর রহমান বিরোধের কারণ নির্ণয় ও প্রতিকার নির্দেশ করিতে আদেশ করেন, তখন একমাস পরে চরম বিপদের কথা কল্পনাও করিতে পারি নাই। তথাপি মুজিবুর রহমানের কাজ-কর্ম আমার ভাল লাগিতেছিল না। তাঁর প্রতিষ্ঠান-প্রীতি আসলে নিজের প্রাধান্য-প্রীতি বলিয়া আমার সন্দেহ হইতেছিল। আমার নিজেরও এ ব্যাপারে অভিযোগ ছিল। কেন্দ্রে আমাদের মন্ত্রিত্ব যাওয়ার পরে লিডার প্রতিষ্ঠানের সংগঠনের দিকে অধিকতর মনোযোগী হইলেন। লিডারের বিপুল সংগঠনী প্রতিভা ও অমানুষিক পরিশ্রম সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের আদর্শ-উদ্দেশ্য ও সংগঠন লইয়া লিডারের সংগে আমার শুধু মতভেদ নয়, বিরোধও অনেক হইয়া গিয়াছে। মন্ত্রিত্ব যাওয়ার পরে তিনি আমাকে একদিন খুব সিরিয়াসলি বলিলেন : তুমি অন্য সব কাজ ফেলিয়া আওয়ামী লীগকে ইংলণ্ডের লেবার-পার্টির ধরনে গড়িয়া দাও। আমি প্রতিবাদ করিবার আগেই আমার পেটের কথা তিনি বুঝিয়া ফেলিলেন। বলিলেন : মানে, গড়িব আমিও, তুমি শুধু প্ল্যান দাও। আমি হাসিলাম। লিডার বুঝিলেন। আমি দায়িত্ব নিলাম। তিনি অতঃপর ইংলন্ডের লেবার পার্টির হিস্ট্রি, সংগঠন, আদর্শ ইত্যাদি বিষয়ক কয়েকখানি পুস্তক আমাকে দিলেন। আমি দায়িত্ব গ্রহণ করিয়া লিডারকে বলিলাম : এ দায়িত্ব পালন করিতে হইলে আমাকে পার্লামেন্টারি রাজনীতি হইতে মুক্তি দিতে হইবে। তিনি হাসিয়া ইংরাজীতে বলিলেন : পুলের নিকট আসিলেই তা পার হইব। আমি পার্টি সম্বন্ধে অধ্যয়ন শুরু করিলাম। এ খবর আতাউর রহমান-মুজিবুর রহমান উভয়েই রাখিতেন। কাজেই তাঁদের সংগেও আমার আলোচনা চলিল। একদিন কেন্দ্রীয় আইন-পরিষদের বৈঠকের সময় করাচিতে সমারমেন্ট হাউস নামক মেম্বরমেসে কতিপয় প্রথম কাতারের আওয়ামী নেতার সামনে আতাউর রহমান প্রস্তাব দিলেন যে আমার পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতিত্ব গ্রহণ করা উচিৎ। মওলানা ভাসানীর পদত্যাগের পর কয়েকমাস ধরিয়া ঐ পদ খালি ছিল। ভাইস-প্রেসিডেন্ট মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ স্থলবর্তী হিসাবে কাজ চালাইয়া যাইতেছিলেন। সবাই উৎসাহের সাথে আতাউর রহমানের প্রস্তাব সমর্থন করিলেন। পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে প্রতিষ্ঠানের অফিসবিয়ারাররা মন্ত্রিত্ব বা অন্য কোনও সরকারী পদ গ্রহণ করিতে পারেন না। পার্লামেন্টারি রাজনীতি হইতে সরিয়া যাইবার উপায় হিসাবে এই একটা বড় সুযোগ। লিডারের দেওয়া পার্টি-সংগঠনের দায়িত্বও এতে পালন করিতে পারি। আমি আতাউর রহমানের প্রস্তাবে তাই মোটামুটি সম্মতি দিলাম।

কিন্তু কয়েকদিন পরেই আমরা করাচি থাকিতেই জানিতে পারিলাম মুজিবুর রহমান ইতিমধ্যে ঢাকা ফিরিয়া ওয়ার্কিং কমিটির এক সভায় মওলানা তর্কবাগীশকে স্থায়ী সভাপতিত্বে বহাল করিয়াছেন। আতাউর রহমান কাগমে প্রকাশিত খবরটার দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলিলেন : দেখলেন ভাইসাব, আপনেরে সভাপতি করায় সেক্রেটারির অসুবিধা আছে।

ঘটনাটা ছোট কিন্তু তুচ্ছ নয়। অথচ ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য খুবই এমবেরেসিং। সমালোচনা করা কঠিন; প্রতিবাদ করা আরও কঠিন। অথচ আতাউর রহমানের অভিযোগ সত্য। সত্যই মুজিবুর রহমানের মধ্যে এই দুর্বলতা ছিল যে তিনি যেটাকে পার্টি-প্রীতি মনে করিতেন সেটা ছিল আসলে তাঁর ইগইম আত্ম-প্রীতি। আত্ম-প্রীতিটা এমনি আত্মভোলা’ বিভ্রান্তিকর মনোভাব যে ভাল-ভাল মানুষও এর মোহে পড়িয়া নিজের পার্টির, এমন কি নিজেরও, অনিষ্ট করিয়া বসেন। আমি যখন কংগ্রেসের সামান্য একজন কর্মী ছিলাম, তখনও উঁচুস্তরের অনেক কংগ্রেস নেতার মনোভাব দেখিয়া বিশিত ও দুঃখিত হইতাম। তাঁদের ভাবটা ছিল এই ‘স্বরাজ দেশের জন্য খুবই দরকার। কিন্তু সেটা যদি আমার হাত দিয়া না আসে, তবে না আসাই ভাল। আমার বিবেচনায় মুজিবুর রহমানের মধ্যে এই আত্ম-প্রীতি ছিল খুব প্রবল। এটাকেই তিনি তাঁর পার্টি-প্রীতি বলিয়া চালাইতেন। এই জন্যই আতাউর রহমানের সহিত তাঁর ঘন-ঘন বিরোধ বাধিত। এই বিরোধে উভয়েই আমার বিচার চাহিতেন, অর্থাৎ সমর্থন দাবি করিতেন। সে বিচারে আমি অযোগ্য প্রমাণিত হইয়াছি। নিরপেক্ষ সুবিচারের ‘ভড়ং’ দেখাইতে গিয়া আমি অপরাধ করিয়াছি বলিয়া এতদিনে আমার মনে হইতেছে।

৮. বিরোধের কারণ

১৯৫৮ সালের গোড়ার দিকেই এই বিরোধ পাবলিকের আলোচনার বিষয়বস্তু হইয়া পড়ে। জুন মাসের প্রাদেশিক পরিষদ বৈঠকে আমরা সরকার পক্ষ ভোটে হরিয়া যাই। কে, এ. পির সাথে প্রায়-সমাপ্ত ব্যবস্থাটা শেষ মুহূর্তে ভাংগিয়া দেওয়ার এটাই ছিল প্রথম শাস্তি। ন্যাপের ভোটের উপর আমাদের গবর্নমেন্ট নির্ভরশীল ছিল। তারা ছিল পিছুটান। এন্টি-গ্লিং ক্লোডোর অপারেশনে প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান রাযী হওয়ায় হিন্দু সমর্থকদের অনেকেই বিরুদ্ধে গেলেন। আমাদের সংগীন অবস্থা সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল। লিডার আমাকে গোপনে তদন্ত করিয়া রিপোর্ট দিতে বলেন : কার দোষ? কি কারণে এই বিরোধ সৃষ্টি হইয়াছে? লিডারের তখন পুরা সন্দেহ হইয়া গিয়াছে যে মুজিবুর রহমান নিজে প্রধানমন্ত্রী হইবার জন্য আতাউর রহমানের অযোগ্যতা ও অজনপ্রিয়তা প্রমাণের চেষ্টা করিতেছেন। এর মধ্যে তদন্ত করিবার কি আছে? লিডার নিজেই দুইজনকে পৃথক-পৃথকভাবে জেরা-যবানবন্দি করিলেই ত হয়। আমি তাই বলিলাম। লিডার জবাব দিলেন, তিনিও ও-ধরনের সবই করিয়াছেন। এখন আমি কি করিতে পারি তাই দেখিতে চান। আমি সাধ্যমত চেষ্টা ও ‘তদন্ত’ করিলাম। তদন্তের বিষয় ছিল উভয় বন্ধুর সাথে প্রাণ খুলিয়া দেশের মানে পূর্ব-বাংলার ভবিষ্যৎ নির্মাণে আওয়ামী লীগের ভূমিকা এবং সেই পটভূমিকায় তাঁদের উভয়ের কর্তব্য। উভয়েই খুব জোরের সংগে যে সব কথা বলিলেন তার সারমর্ম গিয়া দানা বাঁধিল দুইটি পৃথক শাসননীতিতে। আতাউর রহমান প্রধানমন্ত্রী। তাঁর দায়িত্ব শৃংখলাবদ্ধ দক্ষ এডমিনিস্ট্রেশন। জিলা-মহকুমা শাসকবৃন্দ হইতে আরম্ভ করিয়া সেক্রেটারিয়েট পর্যন্ত সকল অফিসার রাজনীতিক পার্টিবাযি, মেম্বরদের প্রভাব ও কর্মীদের চাপমুক্ত অবস্থায় নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি মত কাজ করুন, প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা এই। দলীয় কর্মী ও মেম্বরদের হস্তক্ষেপ তিনি পসন্দ করিতেন না। পার্মানেন্ট অফিশিয়ালরা সর্বদাই রাজনীতিক প্রভাবমুক্ত থাকিবেন, অন্যথায় পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থা চলতে পারে না, এই মত তিনি দৃঢ়ভাবে পোষণ করিতেন।

পক্ষান্তরে মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারি। এ বিষয়ে তাঁর মত সুস্পষ্ট। প্রতিষ্ঠানকে জনপ্রিয় ও শক্তিশালী করা তাঁর দায়িত্ব। নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করা এবং দলীয় সরকারকে দিয়া সেসব ওয়াদা পূরণ করান প্রতিষ্ঠানের নেতা হিসাবে তাঁর কর্তব্য। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে দেখা গিয়াছে, মুষ্টিমেয় ‘অফিসার ছাড়া সকলেই মুসলিম লীগ মনোভাবাপন্ন। আওয়ামী লীগ সংগঠনের উপর আগে তাঁরা শুধু যুলুমই করেন নাই, আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় আসাটাও তাঁরা পসন্দ করেন নাই। তাই নানাভাবে আওয়ামী মন্ত্রিসভাকে ডিসক্রেডিট করাই এদের সংঘবদ্ধ ইচ্ছা। এঁদের দিয়া আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি ও কর্মপন্থা সফল করাইতে হইলে ইহাদের উপর আওয়ামী লীগ কর্মীদের সজাগ দৃষ্টি রাখা দরকার। এই উদ্দেশ্যে জিলা ও মহকুমা অফিসারদের উপর আঞ্চলিক আওয়ামী লীগের যথেষ্ট প্রভাব থাকা আবশ্যক।

প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের এইরূপ শক্তিশালী করিতে চাহিতেছেন; পার্টির প্রধানমন্ত্রী তাতে বাধা দিতেছেন। সেক্রেটারির ন্যরে জিলা আওয়ামী লীগ বড়, প্রধানমন্ত্রীর কাছে জিলা ম্যাজিস্ট্রেট বড়। এটা আসলে শাসনান্ত্রিক প্রশ্ন নয়, শাসনতান্ত্রিকও বটে। পার্টি বড় না, মন্ত্রিসভা বড়? প্রশ্নটা কিন্তু আকারে ও এলাকায় আরও বড়। পার্টি বড় না, আইনসভা বড়। আইনতঃ নিশ্চয়ই। আইন-সভা বড়। কারণ আইনসভার সার্বভৌমত্বের, সরেইন্টি-অব-দি লেজিসলেচারের, উপরই গণতন্ত্রের বুনিয়াদ। কিন্তু ন্যায়তঃ পার্টি বড়। পার্টিতে আগে সিদ্ধান্ত হইবে; আইন-সভা সেই সিদ্ধান্তে অনুমোদনের রবার স্ট্যাম্প মারিবে মাত্র। কারণ অপযিশন দলের মেম্বাররাই শুধু সরকারী বিলের বিরুদ্ধে যাইতে পারেন, পযিশন’ দলের মেম্বররা পারেন না। পার্টি গবর্নমেন্ট চালাইতে পার্টি ডিসিপ্লিন দরকার। পার্টি ‘পযিশনে’ আসে নির্বাচনে মেজরিটি করিতে পারিলে। নির্বাচনে জয়ী হইতে গেলে নির্বাচনী ওয়াদা বা মেনিফেস্টো দেওয়া দরকার। সে মেনিফেস্টো কার্যকরী করা পার্টির নৈতিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব। কাজেই সে দায়িত্ব পালনের উপায় নির্ধারণ ও আইন-রচনার কাজটা পার্টিতে স্থির হওয়া দরকার। পার্টির মেম্বররা কাজেই আইন পরিষদে দাঁড়াইয়া পার্টি-সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাইতে পারেন না। এই ভাবেই পার্টি গবর্নমেন্ট কার্যতঃ আইন-পরিষদের সভারেইনটিকে পার্টি-প্রতিষ্ঠানের সভারেইনটিতে পরিণত করেন। এটা গণতন্ত্র ও পার্টি গবর্নমেন্টের চিরন্তন অন্তর্বিরোধ, ইটার্নেল কন্ট্রাডিকশন। ইহার সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরিয়া করিয়া আসিতেছেন। কিন্তু তাঁদের সমাধানের আশায় আমরা বসিয়া থাকিতে পারিনা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও পার্টি-সেক্রেটারির বিরোধ এমন আসন্ন হইয়াছে যে এটা এখনি মিটানো দরকার। আমি লিডারকে তদনুসারে আমার মত জানাইলাম। আমার অভিমত অনুসারে ‘দোষ কার’ প্রশ্নের মীমাংসার কোনও সূত্র পাওয়া গেল না। আমার মতে উভয়ের দোষ ফিফটি-ফিফটি। আমার একটা সুনাম বা বদনাম ছাত্রজীবন হইতেই ছিল। আমি নাকি কোনও বিতন্ডায় এক পক্ষ নিতে পারিতাম না। বলিতাম : এটাও সত্য, ওটাও সত্য। সেজন্য কলিকাতায় বন্ধুমহলে, বিশেষতঃ সাংবাদিক-মহলে, আমার অপর এক নাম ছিল ‘মিঃ এটাও সত্য ওটাও সত্য। মুসলিম লীগের ত্রিশের দশকের সাম্প্রদায়িক নীতির জন্য আমি ঘোরর মুসলিম লীগ-বিরোধী ছিলাম। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব আমাকে অতিশয় ভাবাইয়া দেয়। এই সময় হইতে প্রায় তিন বছর কাল আমার রাজনীতিক চিন্তায় ভাবান্তর ঘটে। এই সময় আমি যা-যা বলিতাম, তারই নাম দিতেন বন্ধুরা : কংগ্রেসও ঠিক, মুসলিম লীগও ঠিক; জাতীয়তাও ঠিক, সাম্প্রদায়িকতাও ঠিক; পাকিস্তানও ঠিক, অখণ্ড ভারতও ঠিক।

অবশ্য আমার মত অতটা বিদঘুঁটে ছিল না। তবু সুবিচারী র‍্যাশনালিস্ট হিসাবে আমার। সুনাম রক্ষার জন্য ঐ বদনাম বহনের মত স্যাক্রিফাইসটুকু করিতাম। ফলে বুদ্ধিমান গোঁড়ারা আমাকে র‍্যামনালিস্ট না বলিয়া এম্বিভ্যালেন্ট (মতহীন লোক) বলিতেন গোঁড়ামির বদনামের চেয়ে এই বদনামটাকে আমি অধিক সম্মানজনক মনে করিতাম।

লিডার কিন্তু আমার নিরপেক্ষতায় খুশি হইলেন কিন্তু। হাসিয়া বলিলেন : বিবদমান দুই পক্ষেরই দুশমন হওয়ার এমন সোজা রাস্তা আর নাই। কিন্তু আমি এদেরে লইয়া করি কি? আমি সহজ উত্তর দিলাম : নির্বাচন পর্যন্ত স্টেটাস কোও, যেমন আছে তেমনি, বজায় থাক।

৯. লিডারের দুশ্চিন্তা

লিডারের দুশ্চিন্তা দূর হইল না। তিনি তখন সেন্ট্রাল সার্কিট হাউসে থাকিতেন। একদিন খুব সকালে টেলিফোনে ডাকিলেন। গিয়া দেখিলাম, আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় আরও অনেকেই আসিয়াছেন। কিন্তু সবার সাথে লিডার এক সাথে দেখা করিবেন না। পৃথক-পৃথক দেখা করিবেন। আমাকেই বোধ হয় প্রথম ডাকিলেন একদম মেটার-অব-ফ্যাক্ট বিষয়ী আলাপ। প্রধানমন্ত্রী ও সেক্রেটারির বিরোধের ফলে পার্টি ও প্রতিষ্ঠানের দ্বিধাবিভক্তি, বিভিন্ন জিলায় তার প্রতিক্রিয়া (লিডারও এই সময় জিলায়-জিলায় সফর করিতেছিলেন, তাঁর ফলে মন্ত্রিসভার সংকটজনক অবস্থা, আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে (১৯৫৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের দিন ঠিক হইয়া গিয়াছে) আমাদের আভ্যন্তরীণ বিভেদের কুফল ইত্যাদি সংক্ষেপে অথচ দক্ষতার সংগে আমাকে বুঝাইয়া দিলেন। সবই ঠিক। সুতরাং মতভেদের ফাঁক নাই। লিভারের সংগে একমত হইলাম। তিনি শুইয়াছিলেন। এইবার উঠিয়া বসিলেন। বলিলেন : আমি চিন্তা করিয়া ঠিক করিয়াছি তোমাকেই প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব নিতে হইবে। আতাউর রহমানের দ্বারা আর চলিতেছেনা।আমি তাজ্জব হইলাম। তলে-তলে অবস্থা এতটা খারাপ হইয়াছে? এই পরামর্শ লিডারকে কে দিয়াছে। আমি মনে-মনে খুবই গরম হইলাম। কিন্তু বাহিরে শান্ত থাকিয়া লিডারের সংগে তর্ক জুড়িলাম। আধ ঘন্টা চল্লিশ মিনিটের মত তর্ক করিয়া লিডারকে বুঝাইবার চেষ্টা করিলাম : (১) নির্বাচনের মাত্র পাঁচ মাস আগে প্রধানমন্ত্রী বদলাইয়া লাভের চেয়ে লোকসান হইবে বেশি; (২) নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব নিতে ব্যক্তিগতভাবে আমার ঘোরতর আপত্তি আছে; (৩) আতাউর রহমানের উপর বেশির ভাগ দলীয় সদস্যের আস্থা নষ্ট হইয়াছে, কথাটা মোটেই সত্য নয়। প্রথম দফার পক্ষে যুক্তি দিলামঃ আতাউর রহমান-বিরোধী এই অভিযান দলাদলির ফল। এই উপদলীয় কোন্দলে লিডারের সারেন্ডার করা উচিত নয়। তার বদলে নির্বাচনের পরে যাকে খুশি প্রধানমন্ত্রী করিও এই কথা বলিয়া সব থামাইয়া দেওয়া লিডারের উচিৎ। যদি তিনি তা না করেন তবে উপদলীয় কোন্দল আরও বাড়িবে; আতাউর রহমানের সমর্থকরা এই অপমান শুইয়া গ্রহণ করিবেন না। নূতন আকারে উপদলীয় কলহ দেখা দিবে। দ্বিতীয় দফার পক্ষে আমার যুক্তিটা ছিল নিতান্ত ব্যক্তিগত। সাধারণ নির্বাচনের মাত্র পাঁচ মাস আগে প্রধানমন্ত্রিত্ব আমার কাঁধে ফেলিলে আমার রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটিবে। আতাউর রহমান তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বে যত ভাল কাজ করিয়াছেন, তাঁর প্রশংসাটুকু থাকিবে তাঁরই। আর তিনি যদি কোন খারাপ কাজ করিয়া থাকেন, তবে, তার নিন্দাটুকু সবই আসিবে আমার ঘাড়ে। কাজেই যিনি এ সময় আমার উপর প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব চাপাইতে চান, তাঁকে আমার পরম হিতৈষী বলা চলে না। তৃতীয় দফায় আমার যুক্তি ছিল এই যে আওয়ামী লীগ দলীয় মেম্বরদের প্রায় সকলেই আতাউর রহমানের সমর্থক, এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা-জাত ধারণা। সুতরাং তাঁর প্রতি অধিকাংশ মেম্বরের আস্থা নাই, এ কথা সত্য নয়। লিডারকে অন্যরূপ ধারণা যাঁরা দিয়াছেন তাঁরা ভূ খবর দিয়াছেন।

লিডারের মুখে স্পষ্ট পরিবর্তন লক্ষ্য করিলাম। আমি সাহস পাইয়া আরও কিছু কথা বললাম। আসন্ন আইন পরিষদের বৈঠকে আমাদের স্ট্রাটেজি ও আগামী নির্বাচন সম্পর্কে আমাদের কর্তব্য আলোচনা করিলাম। মনে হইল আতাউর রহমান বিরোধী মতটা তাঁর অনেকখানি নরম হইয়াছে। আমি বিদায় হইলাম।

নেতাদের যাঁরা অন্য রুমে অপেক্ষা করিতেছিলেন তাঁদের মধ্যে সবার আগে ডাক পড়িল দলের চিফ হুইপ মিঃ আবদুল জব্বার খদ্দরের। আমি তাঁর সাথে খুব জোরে মুসাফেহা করিয়া বিকালে আমার সংগে দেখা করিতে বলিলাম। তিনি লিডারের কামরায় ঢুকিলেন। সমবেত অন্যান্য বন্ধুদের জেরা এড়াইয়া দ্রুতগতিতে গিয়া নিজের গাড়িতে উঠিলাম। পথে সমস্ত ব্যাপারটা দুহরাইলাম। কলনায় একটা আন্দায় করিলাম। না, যেকোনও শক্তি দিয়া এই পতন রুখিতেই হইবে। খদ্দরকে আসিতে বলিয়াছিলাম বিকালে। তার বদলে তিনি আসিলেন তখনই। আমার বাসায় ফিরার বড়জোর এক ঘন্টা পরেই। তিনি আসিয়া লিডারের সাথে তাঁর আলাপের রিপোর্ট করিলেন। মোটামুটি প্রায় একই কথা। প্রধানমন্ত্রী বদলাইতে হইবে। ঐ প্রসংগে লিডার আমার নাম করায় তিনি আর বিকাল পর্যন্ত ধৈর্য রাখিতে পারিলেন না। তিনি মনে-মনে ধরিয়া লইয়াছিলেন, আমি রাযী হইয়াছি। তিনি আতাউর রহমান সাহেবের একজন ঘোর সমর্থক। কাজেই আমাদের সে মর্মে অনুরোধ করিতেই তাঁর আসা। আমি হাসিয়া সব কথা বলিলাম। যুক্তিও দিলাম। তিনি নিশ্চিন্ত হইয়া বাড়ি গেলেন।

১০. বিরোধের পরিণাম

সেক্রেটারি শেখ মুজিবুর রহমানকে টেলিফোনে ধরিলাম। রাতে আসিতে বলিলাম। তিনি আসিলেন। হাসিমুখে তাঁর প্রতি চরম রাগ দেখাইলাম। তীর উপর অসাধু উদ্দেশ্য আরোপ করিলাম। এক ঢিলে দুই পাখি মারিবার চমৎকার ব্যবস্থা করিয়াছ, ভাই। তিতা সুরে হাসিমুখে বলিলাম। তিনি অবাক হইলেন। অবাক হইবার ভংগ করিও না। আমি বলিলাম।আতাউর রহমানকে বেইযযত করিয়া তাড়াইয়া আমাকে সেখানে পাঁচ মাসের জন্য বসাইয়া অযোগ্য প্রমাণ করিয়া নির্বাচনের পরে নিজে প্রধানমন্ত্রী হইবার বেশ আয়োজনটা করিয়াছ। আমি কঠোর বিদ্রুপাত্মক ভাষায় বলিলাম। তিনি বিষম ক্রুদ্ধ হইলেন। বলিলেন : মুরুব্বি মানি বলিয়া যা-তা বলিবেন না। শ্রদ্ধা রাখিতে পারিব না। তর্ক করিলাম। যার-তার যুক্তি দিলাম। রাগারাগি সাটা-সাটি করিলাম। এক স্তরে আমার উপর রাগ করিয়া তিনি উঠিয়া পড়িলেন। জোর করিয়া বসাইলাম। যতই রাগ করুন, শেষ পর্যন্ত শান্ত হইলেন, যখন আমি পরিণামে দেশের অবস্থা ও পার্টির পরাজয়ের কথা বলিলাম। যত দোষই তাঁর থাক, তিনি দেশকে ভালবাসেন। পার্টিকেও। সুতরাং শেষ পর্যন্ত উভয়ে শান্তভাবে একমত হইলাম। যেকোনও ত্যাগ স্বীকারের দ্বারা আমাদের দলীয় ঐক্য বজায় রাখিতে এবং আতাউর রহমান-মন্ত্রিসতাকে পদে বহাল রাখিতে হইবে। ইতিমধ্যে দুই-তিনবার মন্ত্রিসভার ওলট-পালট হইয়াছে। আমাদের মন্ত্রিসভা কায়েম করিবার জন্য হক সাহেবকে গবর্নরের পদ হইতে সরাইয়া বুড়া বয়সে তাঁকে অপমান করিতে হইয়াছে। বন্ধুবর সুলতান : উদ্দিন আহমদকে হক সাহেবের স্থলে গবর্নর করিয়া আনিতে হইয়াছে। বামপন্থী আদর্শবাদী ন্যাপ-পার্টি তিন-তিনবার পক্ষ পরিবর্তন করিয়াছে। এর কোনটাই আমাদের জন্য প্রশংসার কথা নয়। এসব ব্যাপারেই মুজিবুর রহমান ও আমি একমত হইলাম। আমার কোনও সন্দেহ থাকিল না যে মুজিবুর রহমান সত্যই অন্ততঃ আগামী নির্বাচন পর্যন্ত আতাউর রহমান মন্ত্রিসভার স্থায়িত্ব কামনা করেন। আমি লিডার ও আতাউর রহমানকে আমার মত জানাইলাম।

ইতিমধ্যে ১৯৩ ধারা জারি হইয়াছিল। লিডারের চেষ্টায় আগস্ট মাসের শেষ দিকে আতাউর রহমানকে মন্ত্রিসভা গঠনের কমিশন দেওয়া হইল। নয়া মন্ত্রিসভা গঠিত হইল বটে, কিন্তু আতাউর রহমান আমাকে জানাইলেন, মন্ত্রী নিয়োগে তীর মত টিকে নাই। লিডারই মন্ত্রীদের তালিকা, এমন কি তাঁদের দফতর বন্টন পর্যন্ত সবই, করিয়াছেন। তিনি অভিযোগ করিলেন, লিডার মুজিবুর রহমানের পরামর্শ মতই এসব করিতেছে। এই দুঃখে তিনি একবার প্রধানমন্ত্রিত্বের এই বোঝা বহিতে অস্বীকার করিতে চাহিলেন। আমি তাঁকে অনেক অনুরোধ করিয়া ‘বিদ্রোহ’ হইতে বিরত করিলাম। কিন্তু আতাউর রহমান শান্ত হইলে কি হইবে, মিঃ কফিলুদ্দিন চৌধুরী ক্ষেপিয়া গেলেন। তিনি আমার বাসায় আসিয়া পদত্যাগের হুমকি দিলেন। আগে রেভিনিউ, সি.এণ্ড বি. ও লেজিসলেটিত তিন-তিনটা দফতর ছিল তাঁর। তাঁকে না জানাইয়াসি, এন্ড বি, দফতর কাটিয়া নিয়া নয়া মন্ত্রী মিঃ আবদুল খালেককে দেওয়া হইয়াছে। প্রসংগতঃ উল্লেখযোগ্য যে মিঃ আবদুল খালেক আমার বিশেষ স্নেহ-ভাজন ছোট ভাই। তিনি যোগ্যতার সাথে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব করিয়াছেন। আমরা যারা এক সময় কেন্দ্রে মন্ত্রিত্ব করিয়াছি, তাঁদের কারও পক্ষেই আর প্রাদেশিক মন্ত্রী হওয়া উচিত নয়। একথা আমি নীতি হিসাবে লিডারের কাছে এবং পার্টি-বৈঠকে বলিয়াছি। তবু খালেক সাহেবকে একহ্মপ জোর করিয়া এই নয়া মন্ত্রিসভায় নেওয়া হইয়াছে এবং তাঁকেই সি, এন্ড বি, দফতর দেওয়া হইয়াছে। মিঃ কফিলুদ্দিনের অভিযোগ, এটা মুজিবুর রহমানের কাজ। তিনি অপমানিত হইয়াছেন। কাজেই আর মন্ত্রিত্ব করিবেন না। কফিলুদিন বয়সে আর সবার বড় হইলেও আমার ছোট। কাজেই তাকে ধমকাইলাম। বেগাৰ্তা করিলাম। হাতে ধরিলাম। বলা যায় পায়েও ধরিলাম। কারণ বড় ভাই ছোট ভাই-এর হাত ধরাকেই পা ধরা বলা যায়। অবশেষে কফিলুদ্দিন শান্ত হইলেন।

১১. লিডারের ভুল

কিন্তু আমার মন শান্ত হইল না। মাত্র পাঁচমাস বাকী ইলেকশনের। এ সময়ে শ্রদের রদ-বদলের কোনও দরকারই ছিল না। তার উপর প্রধানমন্ত্রীর অমতে এটা করা আরও অন্যায় হইয়াছে। এটা আমাদের পার্টির দুর্ভাগ্যের লক্ষণ; পতনেরও পূর্বাভাস। আমার আশংকার কথা লিডারকে বলিলাম। তিনি ভুল বুঝিলেন। ভাবিলেন, আতাউর রহমানের কথামত আমি লিডারকে এসব কথা বলিতেছি। লিডারের এক শ’ একটা গুণের মধ্যে এই একটা সাংঘাতিক দোষ। তাঁর মত ডেমোক্র্যাটও খুব কম নেতাই আছে। আবার তাঁর মত ডিক্টেটরও খুব কম দেখিয়াছি। তাঁর চরিত্রের অন্তর্নিহিত এই বৈপরীত্য লক্ষ্য করিয়াই আমি লিডারকে কথায়-কথায় বলিতাম। ইউ আর এ ডিক্টেটর টু এস্টাব্লিশ ডেমোক্র্যাসি। তিনি অনেক সময় হাসিতেন। কিন্তু দুই-একবার গম্ভীরও হইয়া পড়িতেন। তাঁর অসাধারণ প্রতিভা ও অসংখ্য গুণের জন্য আওয়ামী লীগ উপকৃত হইয়াছে যেমন, তাঁর দুই-একটা দোষের জন্য তেমনি আওয়ামী লীগের এবং পরিণামে দেশের ক্ষতিও হইয়াছে অপরিসীম। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায়, ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সম্প্রসারিত সভার সর্বসম্মত অভিমতের বিরুদ্ধে তিনি মোহাম্মদ আলী বগুড়ার কেবিনেটে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিলেন। মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পর এক সাংবাদিকের ঐ প্রকার প্রশ্নের জবাবে বলিলেন : আওয়ামী লীগ আবার কি? আমিই আওয়ামী লীগ। সাংবাদিক আবার প্রশ্ন করিলেন? এটা কি আওয়ামী লীগের মেনিফেষ্টা-বিরোধী না? জবাবে লিডার বলিলেন : আমিই আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টো এই ঘটনার পরে লিডারের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাতেই দুঃখ করিয়া বলিলাম : কার্যতঃ আপনিই আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের ‘মেনিফেস্টো’ এটা ঠিক, কিন্তু প্রকাশ্যে ও-কথা বলিতে নাই। তাতে আওয়ামী লীগের মর্যাদা ও বাড়েই না, আপনারও না। জিন্না সাহেব মুসলিম লীগের ডিক্টেটর-নেতা ছিলেন। কিন্তু কোনও দিন তা মুখে বলেন নাই। বরং কংগ্রেস ও বড়লাটের সহিত আলোচনা করিতে গিয়া সব সময়েই বলিতেন : ওয়ার্কিং-কমিটির সাথে পরামর্শ না করিয়া আমি কিছু বলিতে পারিব না। লিডার নিজের ভুল স্বীকার করিয়া আফসোস করিয়াছিলেন। কিন্তু অনিষ্টটা তখন হইয়া গিয়াছে। অতীতের ভুলের অভিজ্ঞতায় তিনি ভবিষ্যতে ভুল করিতে বিরত হইতেন না। একই ধরনে একই কারণে তিনি পুনঃ পুনঃ একই রকম ভূল করিতেন। ১৯৫৭ সালের আগস্ট মাসে কৃষক-শ্রমিক পার্টির মেজরিটির সাথে গবর্নর হক সাহেবের সমর্থন দেওয়ায় আওয়ামী লীগের একটা বোঝাপাড়া হয়। এই বোঝাঁপড়ায় কে, এস, পিনোন্না মিয়া-মোহন মিয়া গ্রুপ সুহরাওয়ার্দী-নেতৃত্ব মানিয়া নেন। লিডার নিজেই সে বোঝাঁপড়া অনুমোদন করেন। তারপর হঠাৎ বিনা-কারণে এই বোঝাঁপড়া ভাংগিয়া দেন। বুঝা গেল মুজিবুর রহমানের পরামর্শেই তিনি এটা করিলেন। তাতে লিডার শুধু নিজেকেই ছোট করিলেন না। আওয়ামী লীগ, আওয়ামী মন্ত্রিসভা ও পূর্ব-পাকিস্তানের ভবিষ্যৎও বিপন্ন করিলেন। আমার বিবেচনায় এটা ছিল বিশাল ব্যক্তিত্বশালী লিডারের নিতান্ত শিশু সুলভ দুর্বলতার দিক। ১৯৫৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইস্কান্দর মির্যার কথায় আমাদের সর্বসম্মত অনুরোধ ঠেলিয়া ‘এক ইউনিট’ ব্যাপারে রিপাবলিকান পার্টির সহিত শত্রুতা রু করিয়াছিলেন। ফলে কয়েকদিনের মধ্যেই সুহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার পতন হয়। বেশ কিছুদিন পরে বড় দেরিতে তিনি মির্যার ষড়যন্ত্র ধরিতে পারিয়াছিলেন। ১৯৪৭ সালে পূর্ব-বাংলার লিডার ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের সময় হইতে আরম্ভ করিয়া এই দশ-এগার বছর লিডারকে একই রকম শিশু-সুলত ভুল করিতে দেখিয়া আমার বড় দুঃখ হইত। অত দুঃখেও আমি রসিকতা করিয়া একদিন বলিয়াছিলাম স্যার, খোদাকে অসংখ্য ধন্যবাধ, আপনার বিবি নাই। তিনি বিস্মিত হইয়া বলিলেন : কেন? আমি বলিলাম : থাকিলে অনেকবার আপনার বিবি তালাক হইয়া যাইত। হাদিস শরিফে আছেঃ একই রকমে কোনও মুসলমান তিনবার ঠকিলে তার বিবি তালাক হইয়া যায়। হাদিসটা সহি কি যইফ জানি না। তবে তাতে মূল্যবান উপদেশ ও প্রচুর অন্ন রস আছে। তা লিডার আগে ছাত-ফাটা অট্টহাসি করিলেন। পরে গম্ভীর হইয়া বলিলেন ‘জীবনে শুধু জিতিলেই চলে না, হারিতেও হয়। জান, মহত্বের জয়ের চেয়ে হারই বেশি।‘

১২. লজ্জাস্কর ঘটনা

যা হোক মন্ত্রিসভা গঠন করিয়াই আইন পরিষদের বৈঠক ডাকিতে হইল। স্পিকার আবদুল হাকিম সাহেবের প্রতি আমাদের পার্টি-নেতাদের আস্থা ছিল না। তাঁর উপর একটা অনাস্থা-প্রস্তাবও দেওয়া হইয়াছিল। সে প্রস্তাব বিবেচনার সুবিধার জন্য নিজে হইতে ডিপুটি-স্পিকারের উপর ভর দিয়া সরিয়া বসা তাঁর উচিৎ ছিল। তিনি তা না করিয়া নিজেই সে প্রস্তাব বাতিল করিয়া দিলেন। এই ভাবে স্পিকারের সাথে প্রত্যক্ষ সংঘাত লাগায় মুজিবুর রহমান আমাকে বলিলেন : ডিপুটি-স্পিকারকে শক্ত করিয়া আমাদের পক্ষ করিতে হইবে। ডিপুটি-স্পিকার শাহেদ আলী আমার ক্লাস ফ্রেণ্ড ও হোস্টেল-মেট। আমরা উভয়ে অনার্স দর্শনের ছাত্র বলিয়া আমাদের হৃদ্যতাও ছিল আর সকলের চেয়ে গভীর। তিনি ইতিপূর্বেও হাউসে প্রিয়াইড করিয়াছেন এবং আমাদের পক্ষেই রুলিং দিয়াছেন। কিন্তু স্পিকার ছিলেন তখন বিদেশে। এখন স্পিকার দেশে হাযির। তাঁর সাথে আমাদের পার্টির সংঘাত। এই অবস্থায়ই তাঁকে বুঝাইয়া একটু মযবুত করিয়া দিতে মুজিবুর রহমান আমাকে ধরিলেন। আমি ডিপুটি স্পিকারের বাড়ি গেলাম। অনেক কথা হইল। তিনি মযবুত হইলেন।

ডিপুটি স্পিকারের সভাপতিত্বে হাউস শুরু হইল। হাউস শুরু হইল মানে অপযিশন দলের হট্টগোল শুরু হইল। শুধু মৌখিক নয়, কায়িক। শুধু খালি-হাতে কায়িক নয়, সশস্ত্র কায়িক। পেপার ওয়েট, মাইকের মাথা, মাইকের ডান্ডা, চেয়ারের পায়া-হাতল ডিপুটি-স্পিকারের দিকে মারা হইতে লাগিল। শান্তিভংগের আশংকা করিয়া সরকার পক্ষ আগেই প্রচুর দেহরক্ষীর ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। তাঁরা হাতে চেয়ারে ডিপুটি স্পিকারকে অস্ত্র-বৃষ্টির ঝাঁপটা হইতে রক্ষা করিতে লাগিলেন। অপযিশনের কেউ-কেউ মঞ্চের দিকে ছুটিলেন। তাঁদের বাধা দিতে আমাদের পক্ষেরও স্বাস্থ্যবান শক্তিশালী দু-চারজন আগ বাড়িলেন। আমার পা ভাংগা ছিল। তাই না যোগ দিতে পারিলাম মারামারিতে, না পারিলাম সাবধানীদের মত হাউসের বাহিরে চলিয়া যাইতে। নিজ জায়গায় অটল-অচল বসিয়া বসিয়া-সিনেমায় ফ্রি স্টাইল বক্সিং বা স্টেডিয়ামে ফাউল ফুটবল দেখার মত এই মারাত্মক খেলা দেখিতে লাগিলাম। খেলোয়াড়দের চেয়ে দর্শকরা খেলা অনেক ভাল দেখে ও বুঝে। আমি তাই দেখিতে ও বুঝিতে লাগিলাম।

যা দেখলাম, তাতে ভদ্রের ইতরতায় যেমন ব্যথিত হইলাম; বুদ্ধিমানের মুখতায় তেমনি চিন্তিত হইলাম। গণপ্রতিনিধিরা বক্তৃতা ও ভোটের দ্বারা দেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করিবার দায়িত্ব লইয়াই আইনসভায় আসিয়াছেন। গুন্ডামি করিয়া কাজ হাসিল করিতে আসেন নাই, ভাল কাজ হইলেও না। শিক্ষিত ভদ্র ও সমাজের নেতৃস্থানীয় বয়স্ক লোকেরাও কেমন করিয়া ইতরের মত গুন্ডামি করিতে পারেন, চেনা-জানা সুপরিচিত, সমান শিক্ষিত ভদ্র সহকর্মী ডিপুটি স্পিকারের উপর সমবেতভাবে মারাত্মক অস্ত্রের শিলাবৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে পারেন, তা দেখিয়া আমার সারা দেহমন ও মস্তিষ্ক বরফের মত জমিয়া গিয়াছিল। সে বরফেরও যেন উত্তাপ ছিল। আমারও রাগ হইয়াছিল। সে অবস্থায় আমার হাতে রিভলভার থাকিলে আমি নিজের আসনে বসিয়া আক্রমণকারীদের গুলি করিয়া মারতে পারিতাম। ওঁরা সবাই আমার সহকর্মী শিক্ষিত ভদ্রলোক। অনেকেই অন্তরংগ বন্ধু। তবু তাঁদের গুলি করিয়া মারিতে আমার হাত কাঁপিত না। নিছক অক্ষমতার দরুন অর্থাৎ রিভলভারের অভাবে তা করিতে পারি নাই। করিতে পারিলে আমিও ওঁদেরেই মত গুন্ডা আখ্যা লাভের যোগ্য হইতাম। বেশকম শুধু হইত ওঁদের হাতে মাইকের মাথা, পেপার ওয়েট আমার হাতে রিভলভার। বুঝিলাম ওঁদেরও মনে আমারই মত রাগ ছিল। সে রাগের কারণ ডিপুটি স্পিকার অন্যায়ভাবে সরকার পক্ষকে সমর্থন করিতেছিলেন। ডিপুটি-স্পিকারকে হত্যা করিবার ইচ্ছা অপযিশন মেম্বরদের কারও ছিল না নিশ্চয়ই। এমনকি, অমন অসভ্য গুন্ডামিতে যাঁরা অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁদের সকলে জানিয়া-বুঝিয়া ইচ্ছা করিয়া ঐ আক্রমণ করেন নাই। আমি নিরপেক্ষ দর্শকের দৃষ্টি দিয়াই দেখিয়াছি, হামলাকারীদের অনেকেই স্পন্টেনিয়াসলি, নিজের অজ্ঞাতসারেই, যেখন শুধু দেখাদেখি পাটকেল নিক্ষেপ করিতেছেন। এটা যেন হাটের মার। সবাই মারিতেছে, আমিও একটা মারি, ভাবটা যেন এই। কিন্তু ফল কি হইতেছিল? দেহরক্ষীরা চেয়ারের উপর চেয়ার খাড়া করিয়া ডিপুটি স্পিকারের সামনে প্রাচির তুলিয়া ফেলিয়াছিলেন। সে প্রাচিরটা ভেদ করিয়া হামলাকারীদের পাটকেল ডিপুটি স্পিকারের মাথায় নাকে মুখে লাগিতেছিল। শাহেদ আলী কোনও বীর বা ডন-কুস্তিগির পাহলওয়ান ছিলেন না। সাদাসিধা শান্ত-নিরীহ ছোট কদের একটি অহিংস ভাল মানুষ ছিলেন তিনি। দর্শনের ছাত্র না শুধু। চলনে-আচরণেও ছিলেন দার্শনিক। ওকালতি বা রাজনীতির চেয়ে স্কুল-কলেজের মাস্টারি করাই তাঁকে বেশি মানাইত। এমন লোকের উপর অমন হামলা। দেহরক্ষীরা চেয়ারের পাহাড় না তুলিলে তিনি ঐ মঞ্চের উপরই মরিয়া একদম চ্যাপ্টা হইয়া যাইতেন। পরের দিন হাসপাতালে তিনি সত্য-সত্যই মারা যান। এই হত্যাকাণ্ডের আদালতী বিচার হয় নাই। ভালই হইয়াছে। বিচার হইলে অনেক মিয়ারই শাস্তি হইত। দেশের মুখ কালা হইত। কিন্তু আদালতী বিচার না হইয়া গায়েবী বিচার হইয়াছে। তাতে দেশের মুখ কালা হইল কিনা পরে বুঝা যাইবে; কিন্তু দেশের অন্তর যে কালা হইয়াছে সেটা সংগে সংগেই বোঝ গিয়াছে। ঐ ঘটনার পনর দিনের মধ্যেই মার্শাল ল। শাহেদ আলীর অপমৃত্যুকে মার্শাল ল প্রবর্তনের অন্যতম কারণ বলা হইল। অর্থাৎ পরের ঘটনার জন্যই আগেরটা ঘটিয়াছিল বা ঘটান হইয়াছিল। আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভাকে সমর্থন করিতে গিয়া শাহেদ আলী নিহত হইলেন অপযিশনের টিল-পাটকেলে। অথচ পূর্ব বাংলার দুশমনরা তখনও বলিলেন এবং আজও বলেন : আওয়ামী লীগই শাহেদ আলীকে হত্যা করিয়াছে। কোন্ পাপে এ মিথ্যা তহমত। দুর্ভাগ্য একা আসে না। তার মানে, দুর্ভাগ্যের কারণ বা কর্তা যাঁরা তাঁদের যেন শনিতে পাইয়া বসে। শনিতে ধরে উভয় পক্ষকেই। কারণ দুর্ভাগ্যের মধ্যেও এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দোষ দেয়। ঢাকায় এই কেলেংকারিতেও আমাদের পাপের ভরা পূর্ণ হইল না। করাচিতেও দরকার হইল যত নষ্টের গোড়া মির্যার আর এক চাল। সরল সোজা আয়েশী প্রধানমন্ত্রী ফিরোয নুনকে দিয়া বলাইলেন : আওয়ামীদের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় ঢুকিতে হইবে। মন্ত্রিসভার দায়িত্ব বহন করিতে হইবে। বাহির হইতে সমর্থন দিয়া ফপরদালালি টন্ কামারি করিতে দেওয়া হইবে না। এসব কথায় আওয়ামী লীগ নেতাদের কান না দেওয়া উচিৎ ছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় না যাওয়ার অনেক কারণ ছিল। তার মধ্যে প্রধান কারণ আওয়ামী লীগ মন্ত্রিত্বে অংশ না নিয়াই নূন-মন্ত্রিসভার সমর্থন দিবে এই চুক্তি হইয়াছিল। এই ত্যাগের বদলা যুক্ত-নির্বাচন প্রথায় আগামী সনের ১৫ই ফেব্রুয়ারি সাধারণ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হইয়াছে। নির্বাচনের আগে আইন-পরিষদের আর কোনও অধিবেশন হওয়ার দরকার নাই। নূন-মন্ত্রিসভা বিনাবাধায় মন্ত্রিত্ব চালাইয়া যাইতেছেন। তবু আওয়ামী লীগকে মন্ত্রিসভায় যাচিয়া জায়গা দেওয়ার প্রস্তাবকে স্বভাবতঃই সন্দেহের চোখে দেখা উচিৎ ছিল এবং খুব ভাবিয়া-চিন্তিয়া কাজ করা কর্তব্য ছিল। আওয়ামী লীগকে লইয়া খেলা করিবার জন্যই যে মির্যা এই প্রস্তাব দেওয়াইয়াছেন, এটা ছিল সুস্পষ্ট। করাচির খবরের কাগযগুলি গোড়া হইতেই বলা শুরু করিল আওয়ামী লীগের মন্ত্রী নেওয়া হইবে বটে, কিন্তু সহরাওয়ার্দী ও আবুল মনসুরকে নেওয়া হইবে না। এই ধরনের ‘সংবাদ’ ছাপিয়া মির্যর দল গোড়া হইতেই লিডার ও আমাকে বেকায়দায় ফেলিলেন। এ অবস্থায় আমাদের মুখ দিয়া মন্ত্রিত্বে না। যাওয়ার কথাটা কেমন অশোভন দেখায় না। বন্ধুরা ভাবিবেন আমরা নিজেরা যাইতে পারিব না বলিয়াই বুঝি বিরোধিতা করিতেছি। এ রিস্ক নিয়াও বাধা দিলাম। আতাউর রহমান, মানিক মিয়া ও আমি বিরোধিতা করিলাম। যতদূর জানি লিডারও এ সময়ে মন্ত্রিত্বে যাওয়ার বিরোধী ছিলেন। এটা যে মির্যার একটা চাল, এ কথায় মুজিবুর রহমানও আমার সাথে একমত ছিলেন। কিন্তু কেন জানি না, কার বুদ্ধিতে বুঝি নাই, মুজিবুর রহমান আমাদের কাউকে না জানাইয়া কয়েকজন হবু মন্ত্রী লইয়া হঠাৎ করাচি চলিয়া গেলেন। মন্ত্রিত্বের শপথ নিলেন। ভাল পোর্টফলিও পাওয়া গেল না বলিয়া চার-পাঁচ দিন পরে পদত্যাগ করিলেন। সেই রাত্রেই মার্শাল ল। কি চমৎকার প্ল্যান্ড ওয়েতে সব কাজ করা হইয়াছিল। প্ল্যানটা ছিল সুস্পষ্ট। স্বার্থান্ধ ছাড়া আর সবাই বুঝিয়াছিলেন। লিডারও বুঝিয়াছিলেন। কিন্তু সেই দুর্বলতার জন্য তিনি এবারেও দৃঢ়ভাবে ‘না’ বলিতে পারেন নাই। ১৯৪৮ সালের আগস্টে, ১৯৫৪ সালের এপ্রিল ও অক্টোবরে লিডারের যে সামান্য দুর্বলতায় দেশ ও আওয়ামী লীগ চরম বিপদের সম্মুখীন হইয়াছিল, ১৯৫৮ সালের অক্টোবরেও সেই একই দুর্বলতা আমাদের কাল হইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *