২২. ওয়ারতি প্রাপ্তি

ওয়ারতি প্রাপ্তি
বাইশা অধ্যায়

১. শিক্ষা সম্পর্কে পূর্ব ধারণা

১৯৫৬ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর জনাব আতাউর রহমান খাঁর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ কোয়েলিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। কংগ্রেস পার্টি, প্রগ্রেসিভ পার্টি ও তফসিলী ফেডারেশন এই তিনটি হিন্দু দলও এই মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। আমিও একজন মন্ত্রী হই। শিক্ষা-দফতরের ভার নেই।

মন্ত্রী হইলে শিক্ষা-দফতরের ভার নিব, এটা আমার অনেক দিনের শখ। এ শখের বিশেষ কারণ এই যে প্রাইমারি শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার দাবি বাংলার জনগণের অনেক দিনের পুরান দাবি। প্রাক-স্বাধীনতা যুগে প্রজা-সমিতির সৃষ্টি হইতেই আমরা প্রতিটি সভা সম্মিলনীতে এই দাবি করিয়া আসিতেছিলাম। প্রজা নেতা হক সাহবের প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে আমরা বহুবার এ প্রশ্ন তুলিয়াছি। পাকিস্তান হাসিলের পরও বহু সভা-সম্মিলনে এসব কথা বলা হইয়াছে। মন্ত্রীরাও ওয়াদা করিয়াছেন। কিন্তু আশ্চর্য, খুব কম করিয়া হইলেও ত্রিশটা বছর ধরিয়া আমরা যেখানে ছিলাম সেইখানেই আছি। প্রাইমারি শিক্ষা আজও বাধ্যতামূলক হয় নাই।

তাছাড়া আমাদের শিক্ষা সম্বন্ধে আমার নিজস্ব কতকগুলো মতবাদ ছিল। সার আশুতোষ মুখার্জীর মতবাদ ও মার্কিন শিক্ষা-পদ্ধতিই বোধ হয় আমার মত প্রভাবিত করিয়াছিল। আমি কোনও শিক্ষাবিদ বা বিশেষজ্ঞ নই। সামান্য শিক্ষকতা যা করিয়াছি তাতে অভিজ্ঞতা বলিয়া বড়াই করা যায় না। শিক্ষা সম্বন্ধে বিশেষ পড়াশোনা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়াছি, তাও বলা যায় না। তবু শিক্ষার মত গুরুতর ব্যাপারে আমি কতকগুলি মত পোষণ করি, এটা বিস্ময়ের ব্যাপার। কিন্তু সাহিত্যিক ও সংবাদিকদের সব ব্যাপারেই কিছু-কিছু মত থাকে। বিশেষতঃ সাংবাদিকদের। সম্পাদকীয় লিখিতে হইলে সম্পাদকদিগকে সব বিষয়ে পন্ডিত হইতে হয়। এঁরা সব-ব্যাপারে সকলের নিয়োজিত উপদেষ্টা। এঁরা জিন্না সাহেবকে রাজনীতি সম্বন্ধে গান্ধীজীকে অহিংসা সম্বন্ধে, আচার্য প্রফুল্প চন্দ্রকে রসায়ন সম্বন্ধে, ডাঃ আনসারীকে চিকিৎসা সম্বন্ধে, হক সাহেবকে ওযারতি সম্বন্ধে, শহীদ সাহেবকে দলীয় রাজনীতি সম্বন্ধে, মওলানা আদকে ধর্ম সম্বন্ধে, এমনকি জেনারেল দ্যগলকে যুদ্ধ-নীতি ও স্ট্যালিনকে কমিউনিযম সম্বন্ধে উপদেশ দিয়া থাকেন। সেই উপদেশ না মানিলে কষিয়া গালও তাঁদের দিয়া থাকেন। উপদেশ দেওয়া এদের কর্তব্য ও ডিউটি। ঐ জন্যই তাঁরা সম্পাদক। ঐ জন্যই ওঁদেরে বেতন দেওয়া হয়। মাস্টারদেরে বেতন তেমন দেওয়া হয়। বেতনের বদলে এরা ছাত্রদেরে পাঠ দেন। সম্পাদকরাও দেশের রাষ্ট্র নায়ক ও চিন্তা নায়কদের পাঠ দেন। সম্পাদক মাস্টার, নেতারা ছাত্র। কিন্তু পাঠশালার মাস্টার-ছাত্র এরা নন। কলেজের বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার-ছাত্র। প্রতিদিন সকালে ক্লাস হয়। কলেজের অধ্যাপকরা যেমন পরের বই-পুস্তক পড়িয়া নিজেরা তৈয়ার হইয়া ক্লাসে লেকচার দেন, সম্পাদকরাও বই-পুস্তক ঘাঁটিয়া ঐ ঐ বিষয়ে ওয়াকিফহাল হইয়া সম্পাদকীয় ফাঁদিয়া থাকেন। আমিও প্রায় ত্রিশ বছরকাল ঐ কাজ করিয়াছি। কাজেই কোন বিষয়ে কিছু-না-জানিয়া সর্ববিষয়ে পণ্ডিত হইয়াছি। যাকে বলা যায় : ‘জ্যাক অব-অল-ট্রেডমাস্টার-অব-নান।‘

শিক্ষা সম্বন্ধেও কাজেই আমি অনেক কথা লিখিয়াছি। আগে না থাকিলেও লিখিতে-লিখিতেই বোধ হয় পরে একটা মতবাদ গড়িয়া উঠিয়াছে। এই মতবাদটা আমার অনেক দিনের। সুতরাং যত দিন যাইতেছে, আমি যত বুড়া হইতেছি, আমার মত তত পাকা হইতেছে। অনেকে বলিলেন : ‘মুঢ়ের মতবাদ ও-রূপ দৃঢ় বা গোড়া হইয়াই থাকে। তা যাই হোক, আমার দৃঢ় মতবাদটা এই :

সাধারণ শিক্ষাকে সহজ ও সস্তা করিয়া অল্প সময়ের নির্দিষ্ট মূদ্দতের মধ্যে দেশের নিরক্ষরতা দূর করার স্বপ্ন আমার অনেক দিনের। প্রাইমারি শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার কথা আমি আমার কলেজ-জীবন হইতে ভাবিয়া আসিতেছি। প্রথম সুযোগেই রাজনৈতিক সভার (প্রজা-সমিতির প্রস্তাবরূপে গ্রহণ করাইয়াছি। এটাত গেল প্রাইমারি ও এডান্ট এডুকেশনের কথা। শুধু প্রাইমারি সম্বন্ধেই নয়, মধ্য ও উচ্চশিক্ষা সম্বন্ধেও আমার দৃঢ় ও একগুয়ে মত ছিল এবং এখনও আছে। আমার মতে এ দেশে শিক্ষার চেয়ে পরীক্ষায় বেশি কড়াকড়ি করা হয়। যথেষ্ট স্কুল কলেজ নাই। যা আছে তাতেও শিক্ষক নাই। সময় মত বই-পুস্তক পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায়, তাও খরিদ করিবার সাধ্য খুব কম অভিভাবকেরই আছে। ফলে পড়াশোনা হয় না কিন্তু পরীক্ষার সময় প্রশ্নকর্তা ও পরীক্ষকদের উস্তাদি দেখে কে? প্রশ্নকর্তা ও পরীক্ষকদের উস্তাদি ও পাণ্ডিত্য যাহির করিবার এইটাই সময়। ইয়া-ইয়া উস্তাদি প্রশ্ন। যা পড়ান হয় নাই, তার উপরও প্রশ্ন। এমন কঠিন যে প্রশ্নকর্তারাই তার উত্তর দিতে পারিতেন না খুঁজিয়া-খুঁজিয়া প্রশ্ন করার আগে। তর্ক করিয়া দেখিয়াছি, অনেক শিক্ষক-অধ্যাপকই এ বিষয়ে আমার সাথে একমত। কিন্তু পরীক্ষার প্রশ্ন করিবার বা খাতা দেখিবার সময় ও-সব কথাই ওঁরা ভুলিয়া যান। তখন বলেন, শিক্ষার উন্নত মানের কথা। যেমন শিক্ষক-অধ্যাপক তেমনি গবর্নমেন্ট। এক ব্যাপারে শিক্ষক-সরকারের সম্বন্ধু একেবারে অহি-নকুল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষকরা সরকারী ও আধা-সরকারী দফতরের কেরানীর মাহিয়ানাও পান না। তাঁদের মাইনাটা বাড়াইয়া দিবার কথা বলিলেই সরকার বলেন, তহবিলে টাকা নাই। শিক্ষা কত দাবি-দাওয়া ও ধর্মঘট করিলেন, জনসাধারণ কত আন্দোলন করিল, ‘সরকার’ কান পাতিলেন না। এইখানে শিক্ষক-সরকারের সম্বন্ধটা শোষিত শোষকের তিক্ত সম্পর্ক। কিন্তু ছাত্র ফেল করাইবার বেলা এই শোষিত-শোষকদের মধ্যেই দেখা যায় ঐক্যমত ও সংহতি। .. শিক্ষার মানের দোহাই দিয়া এই যে পরীক্ষা-নীতি চলিতেছে, তার ভয়াবহ পরিণামের কথা যেন কেউ ভাবিতেছেন না। প্রতি বছর শিক্ষাবোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় অর্ধেকের বেশি ছেলেকে ফেল করাইয়া দেশের কি ঘোরতর অনিষ্ট করিতেছেন, সেজন্য যেন কারও মাথাব্যথা নাই। শিক্ষকের মান ও মর্যাদার জন্য, শিক্ষকতাকে আকর্ষণীয় করিবার জন্য শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির যৌক্তিকতা স্বীকার করিয়াও সরকার তাঁদের মাইনা বাড়ান না টাকার অভাবের যুক্তিতে। কিন্তু পরীক্ষা সহজ ও বাস্তববাদী করিতে অর্থাৎ বেশি ছাত্র পাস করাইতে টাকার অভাবের প্রশ্ন উঠে না। তবু সে ফেল করান হয়? পরীক্ষকরা করান উস্তাদি-পান্ডিত্য দেখাইবার জন্য। কিন্তু সরকার করান কেন? দুই-একজন উচ্চপদস্থ ক্ষমতাসীন লোকের সাথে আলোচনা করিয়া বুঝিয়াছি ও তাঁরা ছাত্র ফেল করান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে। তাঁরা বলেন, অত লোক ম্যাট্রিক-গ্রাজুয়েট হইলে তাদেরে চাকুরি দেওয়া সম্ভব হইবে না। দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়িয়া যাইবে। দেশে বিপ্লব ও এনার্কি আসিবে। কমিউনিষ্টাও আসিয়া পড়িতে পারে। অতএব শিক্ষা কনট্রোল হওয়া দরকার। বুঝিলাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবদান খাদ্য কনট্রোল হইতেই আসিয়াছে শিক্ষা নট্রোল। কনট্রোল ডেমোক্রেসিও ওটারই পরিণাম। কিন্তু তখনও দেশে আসে নাই।

এ মত আমি সমর্থন করিতাম না। বরঞ্চ আমি দেশ ম্যাট্রিক, এমনকি গ্র্যাজুয়েট, দিয়া ভরিয়া ফেলিবার পক্ষপাতী ছিলাম। এ বিষয়ে সার আশুতোষের মত আমাকে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল। তিনি বলিয়াছিলেন : ‘আমি বাংলার প্রতিটি হালের পিছনে একজন করিয়া গ্র্যাজুয়েট দেখিতে চাই। স্পষ্টই দেখা যায়, গ্র্যাজুয়েটের আতিশয্যকে সার আশুতোষ ভয় করিতেন না। অতি-গ্র্যাজুয়েটে যদি দেশে কোন বিপ্লব আসেই, তবে সে বিপ্লবে দেশের কল্যাণ ছাড়া অকল্যাণ হইবে না।

শিক্ষক-অধ্যাপকদের জিগাসা করিতাম। তাঁরা কি জানেন না, পরীক্ষা পাসের সাটিফিকেটটা আসলে জীবন সংগ্রামে প্রবেশের পাসপোর্ট মাত্র চাকুরির নিয়োগপত্র নয়। তবে তাঁরা ইংরাজী আরবী ফাসী সংস্কৃতের জন্য এমনকি ইউরোপের ইতিহাস ইংল্যান্ডের ভূগোলের জন্যই বা ছেলেদেরে ফেল করান কেন? তাঁরা কি জানেন না ঐ সব বিষয় আমাদের দেশের সাধারণ নাগরিকদের বৈষয়িক জীবনের জন্য কত অনাবশ্যক? তাঁরা কি জানেন না, একটি ছেলেকে পরীক্ষায় ফেল করাইয়া প্রকারান্তরে তাঁরা কতজন ছেলের লেখা-পড়ার দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন? তাঁরা কি ভুলিয়া গিয়াছেন, অতঃপর আমাদের শিক্ষার মিডিয়ম হইবে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা? উত্তরে অনেকেই বলিয়াছেন : ও-সব শিক্ষা-দফতর ও শিক্ষা বিভাগের আইন-কানুন। শিক্ষার মিডিয়ম বাংলা করা সরকারের কাজ। শিক্ষা কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষা দফতর, এক কথায় মন্ত্রীরা, ওসব আইন-কানুনে শিক্ষার মিডিয়ম—না বদলানো পর্যন্ত তাঁদেরকিছুই করণীয়নাই।

২. ছয়দিনের শিক্ষামন্ত্রিত্ব

কাজেই স্থির করিয়াই রাখিয়াছিলাম, মন্ত্রী হইবার সুযোগ পাইলে শিক্ষামন্ত্রীই হইব। নিজে শিক্ষা মন্ত্রী হইবার আগে কি তবে কিছুই করণীয় নাই? নিশ্চয়ই আছে। তাই আমাদের নেতা হক সাহেব যেদিন বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী হইলেন, সেদিন হইতেই তাঁর পিছনে লাগিলাম। শিক্ষাকে সহজ ও সস্তা করিবার, প্রাইমারি শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করিবার এবং এডাল্ট এডুকেশনকে নৈশ শিক্ষায় পরিণত করিবার, প্রস্তাব দিতে লাগিলাম। অধ্যাপক হুমায়ুন কবির ও আমি চার বছরে বাংলার নিরক্ষরতা দূর করিবার একটি স্কিম পর্যন্ত তৈয়ার করিয়া ফেলিলাম। মাত্র ছয় কোটি টাকায় এই কাজ হইয়া যাইত। ১৯৪১ সালে বাংলার আদমশুমারিতে ‘অশিক্ষিতের’ ঘরে ‘শূন্য’ পড়িত। এসব আমার অনভিজ্ঞ ‘তরুণের স্বপ্ন’ হইতে পারে। ছিলও বোধ হয় তাই। নইলে আমাদের স্কিম কার্যকরী হইল না কেন?

কিন্তু আশা ছাড়ি নাই। ভাবনা-চিন্তাও কমে নাই। তাই বিতর্ক-আলোচনা ও পড়াশোনা করিতেই থাকিলাম। এই কাজে মার্কিন শিক্ষাপদ্ধতি ও ইউরোপীয় শিক্ষা পদ্ধতির তুলনা করিয়া কিছুটা জ্ঞান লাভ করিলাম। সেই সামান্য জ্ঞান হইতে এটা বুঝিলাম, ইউরোপ বিশেষতঃ ইংলভ, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রীস ও ইটালীতে শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য একটা শিক্ষিত কৃষ্টিবান শ্রেণী গড়িয়া ভোলা। গোটা জনসাধারণকে শিক্ষিত করিয়া ভোলা নয়। তথায় জনসাধারণের শিক্ষিত হওয়ায় কোন বাধা নাই। বরঞ্চ সুযোগ-সুবিধা আছে। ঐ সব দেশে নিরক্ষর লোক নাই বলিলেই চলে। তবু ঐ সব দেশের জনসাধারণকে শিক্ষার তালাশে শিক্ষাকেন্দ্রে যাইতে হয়। স্বয়ং শিক্ষা জনসাধারণের দুয়ারে আসে না। ফলে ঐসব দেশে শিক্ষার মান সত্য-সত্যই উন্নত। কারণ উচ্চ শিক্ষা সেখানে সকলের জন্য নয়। বিশেষ অধিকার ভোগী বিত্তশালী শ্রেণীর জন্য। এই কারণে কারিকুলাম ও সিলেবাসের দ্বারা সেখানে শিক্ষাকেও উঁচা করা হইয়াছে। পরীক্ষাও করা হইয়াছে তেমনি কড়া।

কিন্তু মার্কিন মুলুকের শিক্ষা-নীতি তা নয়। সেখানে বংশাভিজাত্য নাই; আছে ধনাভিজাত্য। সেজন্য শিক্ষা সেখানেজনসাধারণের জন্য, শ্রেণীরজননয়। এই কারণেই তথায় সাধারণ শিক্ষার মান উচ্চ নয়। শুধু উচ্চ শিক্ষার মামই উচ্চ শিক্ষা সেখানে বাস্তববাদী। শিল্প কারিগরি ও অর্থকরী বিদ্যার প্রাধান্য সেখানে বেশি। এই কারণেই প্রাইমারি ও সেকেণ্ডারি শিক্ষা ইউরোপের চেয়ে আমেরিকায় অনেক সহজ। ইংলভসহ ইউরোপের একটি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর পরীক্ষায় যেসব প্রশ্ন করা হইবে, আমেরিকায় দশম শ্রেণীতেও সেসব প্রশ্ন কঠিন বিবেচিত হইবে। ইউরোপে প্রশ্ন করা হয় শিক্ষার্থী বাদদিবার উদ্দেশ্যে। মার্কিন মুলুকে করা হয় শিক্ষার্থী বাড়াইবার উদ্দেশ্যে।

কিন্তু আমরা আমাদের দেশে ইংরেজের শিক্ষা-নীতিই আজও মানিয়া চলিতেছি। কাজেই আমাদের শিক্ষা-পদ্ধতি প্রাইমারি ও মাধ্যমিক স্তর হইতেই কঠিন করা হয়। মার্কিন জাতির প্রভাবে এবং যুগের প্রয়োজনে ইউরোপীয় জাতিসমূহও ইদানিং তাদের শিক্ষা-পদ্ধতিতে অনেক পরিবর্তন আনিয়াছে। সেখানেও শিক্ষাকে এখন অনেক বাস্তববাদী ও গণমুখী করা হইয়াছে। বিশেষতঃ সোভিয়েট রাশিয়া শিক্ষাকে আরো অধিক গণমুখী বাস্তববাদী ও বিজ্ঞানভিত্তিক করায় সব সভ্য রাষ্ট্রেই শিক্ষাকে যুগোপযোগী করা হইতেছে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগা দেশেই আজো মান্ধাতার আমলের শিক্ষা-নীতি চলিতেছে। শিক্ষার বিষয়বস্তু, শিক্ষার মিডিয়াম, বাধ্যতামূলক তিন ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা আজো লজ্জাস্করভাবেই আমাদের শিক্ষার পথকে কন্টকিত করিয়া রাখিয়াছে।

শিক্ষামন্ত্রী হইবার সময় এসব কথাই আমার মনে ছিল। কাজেই শিক্ষা বিষয়ে একটা-কিছু করিবার সংকল্প নিলাম। দুই-এক দিনের মধ্যেই শিক্ষাবিদদেরে লইয়া একটি পরামর্শ সভার ব্যবস্থা করিতে শিক্ষা দফতরের সেক্রেটারিকে নির্দেশ দিলাম।

. রাজনৈতিক বন্দীমুক্তি

মন্ত্রিসভার হলফ নেওয়ার পর আমরা প্রথম কাজ করিলাম রাজনৈতিক বন্দীদেরে মুক্তি দেওয়া। আওয়ামী লীগাররা এ বিষয়ে ২১ দফা স্বাক্ষরকারী চুক্তিবদ্ধ পার্টি। অন্যেরাও সবাই এ বিষয়ে একমত। কাজেই প্রধানমন্ত্রী তৎক্ষণাৎ কেবিনেটের এক বিশেষ সভার বৈঠক দিলেন। সর্বসম্মতিক্রমে সকল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার এবং সমস্ত নিরাপত্তা আইন-কানুন বাতিল করিবার প্রস্তাব পাস হইল। আইন বাতিলের যথা-নিয়ম ব্যবস্থা করিবার আদেশ দিয়া বন্দী মুক্তির ব্যবস্থা তৎক্ষণাৎ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্র বিভাগকে নির্দেশ দিলেন। তড়িতে সে আদেশ সব স্তর পার হইয়া গেল। আমরা মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জেলখানায় গেলাম। বন্দীরা নিজেদের খরচায় ও উদ্যোগ-আয়োজনে জেল কর্তৃপক্ষের সহায়তায় আমাদের আপ্যায়নের জন্য জেলখানার ভিতরে মন্ডপ রচনা করিয়াছিলেন। তাতে চা-নাশতার ব্যবস্থাও তাঁরা করিয়াছিলেন। মন্ত্রীদের সাথে রাজবন্দীদের সে মিলনে কি আনন্দ! কত উল্লাস। কি কোলাকুলি! প্রধানমন্ত্রী সময়োপযোগী ছোট বক্তৃতা করিলেন। জেলখানার মধ্যে পাবলিক মিটিং আর কি? নযিরবিহীন? নিশ্চয়। রাজবন্দীদের মুক্তি দিবার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাঁর গোটা মন্ত্রিসভা লইয়া জেলখানায় গিয়াছেন এর নযির ইতিহাসে আর নাই। স্বাধীনতা সংগ্রাম করিয়া যারা দেশ আযাদ করিয়াছেন (যেমন তারত),. কিম্বা বিপ্লব করিয়া যাঁরা রাজতন্ত্রের বদলে প্রজাতন্ত্র করিয়াছেন (যেমন রাশিয়া), তাঁরাও শাসনভার পাইয়াই পূর্ববর্তী শাসকদের আমলের রাজবন্দীদেরে পাহকারীভাবে খালাস দিয়াছেন। কিন্তু কেউ জেলখানায় গিয়া রাজবন্দীদেরে অভ্যর্থনা করেন নাই। আওয়ামী লীগ সরকারের এ কাজ ইতিহাসে সোনার হরফে লেখা থাকিবে। এটাকে সেন্টিমেন্টাল বলিবেন? সেন্টিমেন্টাল ত বটেই। কিন্তু উঁচু দরের সেন্টিমেন্ট। প্রতাঁকে রূপায়িত সেন্টিমেন্ট। প্রেম-ভালবাসা হইতে শুরু করিয়া মে ডে শহীদ দিবস স্বাধীনতা দেশপ্রেম ইত্যাদি ভাবালুতা যে ধরনের সেন্টিমেন্ট এটাও তাই। রাজনৈতিক অজুহাতে কাউকে বিনা বিচারে বন্দী করার বিরোধী আওয়ামী লীগ। একুশ দফার ওয়াদা এটা। এটা যে সত্যই ওয়াদা ছিল, ধাপ্পা ছিল না দেখাইবার জন্য দফতরে বসিয়া প্রধানন্ত্রী মুক্তির আদেশ দিলেই ওয়াদা পূরণ হইত। কিন্তু আওয়ামী লীগ যে সত্যই বিশ্বাস করে বিনাবিচারে কাউকে বন্দী করা অন্যায়, তা দেখান হইত না। মন্ত্রিসভার জেলখানায় যাওয়া এরই প্রতীক। এই প্রতাঁকের দরকার ছিল এবং আছেও এ দেশে। বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মী-নেতাদেরে বিনা বিচারে বন্দী করা আমাদের দেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্য। পর পর যত দল রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হইয়াছে, সবাই এই কাজ করিয়াছেন। বিরোধী দলের লোকের দেশপ্রেমে সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছেন। বিদেশীর ইংগিতে ও সাহায্যে দেশ ধ্বংস করিবার চেষ্টা করিতেছেন। এমনি সব অভিযোগ উপস্থিত করিয়াছেন। বছরের পর বছর ধরিয়া লোকজনকে বন্দী রাখিয়াছেন। তাঁদের শুধু স্বাধীনতা হইতে, দেশ সেবার অধিকার হইতেই বঞ্চিত রাখেন নাই, পারিবারিক জীবন হইতে, স্ত্রী-পুত্র-কন্যার প্রতি ফরয দায়িত্ব পালন হইতেও বঞ্চিত করিয়াছেন। ব্যক্তিগতভাবে স্বাস্থ্যতংগ করা ছাড়াও তাঁদের সংসার ও পরিবার ধ্বংস করিয়াছেন। এটা যে কত বড় নৈতিক পাপ, রাজনৈতিক অপরাধ, সে কথা জোরের সংগে বলার ও দৃঢ়তার সংগে প্রতিকার করার দরকার ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার তাই করিয়াছিলেন। ফলে দেশে রাজনৈতিক নিরাপত্তার ভাব প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। বিরোধী দলের মধ্যে বিশেষভাবে এবং জনসাধারণের মধ্যে সাধারণভাবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিবার আবহাওয়া সৃষ্টি হইয়াছিল। আরও বিশেষভাবে মুসলিম লীগ নেতাদের মধ্যে এ আশ্বস্তি আসিয়াছিল যে অতীতে আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীদের প্রতি তাঁরা যে অন্যায় যুলুম করিয়াছিলেন, আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা তার প্রতিশোধ লইবেন না।

বস্তুতঃ কথাটা উঠিয়াছিলও। আমরা কেবিনেট-সভায় যখন রাজনৈতিক বন্দী মুক্তি ও নিরাপত্তা আইন বাতিলের প্রস্তাব আলোচনা করি, তখন কোন কোন বাস্তববাদী মন্ত্রী মাত্র কয়েক মাসের জন্য নিরাপত্তা আইন বলবৎ রাখিতে বলিয়াছিলেন : তাঁরাও নীতি হিসাবে বিনা বিচারে আটক রাখার সম্পূর্ণ বিরোধী। কিন্তু তাঁদের যুক্তি ছিল এই যে যাঁরা অতীতে এইরূপ আটকাঁদেশ দিয়াছিলেন, তাঁদের কিছুদিন জেলের ভাত খাওয়াইয়া নিরাপত্তা আটকের মজা চাখান দরকার। তাঁরা খুব জোরের সংগেই বলিয়াছিলেন যে ওঁদেরে মজা চাখাইলে ভবিষ্যতে তাঁরা আর ও-রূপ কাজ করিবেন না। আর যদি ঐরূপে মজা না চাখাইয়া অমনি-অমনি ছাড়িয়া দেওয়া হয়, তবে তাঁরা ভবিষ্যতে আবার মন্ত্রীর গদিতে বসিয়াই বিরোধীদলের লোককে আটক করা শুরু করিবেন। বাস্তববাদী বিষয়ীর দিক হইতে তাঁদের যুক্তিতে জোর ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা তাঁদের ঐ যুক্তি গ্রহণ করেন নাই। অধিকাংশেই বলিলেন : রাজনৈতিক প্রতিশোধ-নীতির কোন শেষ নাই। ঐ নীতিতে গণতান্ত্রিক আবহাওয়া কোনদিনই আসিবেনা। তাতে গণতন্ত্র বিকাশের পথ রুদ্ধ হইবে।

পরবর্তীকালের শাসকদের হাতে সত্য-সত্যই আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দই বেশি মার খাইয়াছেন। এবারের যুলুম আরো বেশি। আটক ছাড়াও দুর্নীতির অভিযোগ। মামলা-মোকদ্দমা খানা-তাল্লাশি। সম্পত্তি ক্রোক। মায় সংবাদপত্র অফিসে তালা লাগান ও প্রেস বাযেয়াফতি পর্যন্ত। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মতামত তাতেও বদলায় নাই। এর পরেও তাঁরা যদি কোন দিন ক্ষমতায় যান তখনও আজিকার যালেমদেরও বিনা-বিচারে আটকের আদেশ দিবেন না।

৪. শিক্ষা-মন্ত্রিত্বের উদ্যোগ

ওযারতি পাওয়ার দুএকদিন পরেই শিক্ষাবিদদের সাথে আমার পরামর্শ সভা বসিল। শিক্ষা পরীক্ষা পাসের হার ইত্যাদি সম্বন্ধে মোটামুটি উপরে বর্ণিত-মতই আমার অভিমত প্রকাশ করিয়া বক্তৃতা দিলাম। উপসংহারে নীতিনির্ধারণের ভাষায় বলিলাম : ‘আমরা পরিণামে পরীক্ষা ব্যবস্থা উঠাইয়া দিব। তারই পরখ স্বরূপ আপনারা এবার শতকরা আশি জন, আগামী বত্সর শতকরা নব্বই জন এবং তৃতীয় বছরে শতকরা একশ’ জনই পাশ করাইবেন।

বোধ হয় সমবেত সুধীবৃন্দ স্তম্ভিত হইলেন। কেউ-কেউ বলিলেন : ‘কেমন করিয়া তা হইবে? প্রশ্নের সঠিক উত্তর না দিলেও পাশ করাইতে হইবে?

আমি জোরের সাথেই বলিলাম : ‘জি হাঁ। প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারিলেও পাস করাইতে হইবে।

অনেক যুক্তি-তর্ক ও কথা-কাটাকাটি হইল। অবশেষে একজন বলিলেন : তাতে শিক্ষার মান যে নিচু হইয়া পড়িবে।

আমি হাসিয়া বলিলাম : ‘হোক না একটু নিচু। আমাদের দেশের সবকিছুরই ত মান নিচু হইয়াছে। মন্ত্রিত্বের মান নিচু না হইলে আমি কি শিক্ষামন্ত্রী হইতে পারি? আমার বেআদবি মাফ করিবেন। শিক্ষকতার মান নিচু না হইলে আপনারই কি সকলে অধ্যাপক ও বিভাগীয় হেড হইতে পারিতেন? কেরানী প্রধানমন্ত্রী হইয়াছেন। দারোগা এস পি হইয়াছেন। মুনসেফ জাস্টিস হইয়াছেন। পাকিস্তান হওয়ার ফলেই। এই পাকিস্তান আনিয়াছে ছাত্ররা। তারাও পাকিস্তানের এক-আধটু সুবিধা ভোগ করুকনা।

শিক্ষাবিদরা বেজার হইলেন। আমি শিক্ষা-সমস্যার কথা না বলিয়া রাজনৈতিক কথা বলিতেছি, একথা মুখ ফুটিয়া বলিলেন না বটে, কিন্তু তাবেগতিকে তা বুঝাইলেন। আমি সাধ্যমত বুঝাবার চেষ্টা করিলাম যে শিক্ষার মান নিচু করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তার দরকারও নাই। কারণ শিক্ষার মান এখন নিচুই আছে। আমার উদ্দেশ্য শুধু পরীক্ষার মানটাকে নিচু করিয়া শিক্ষার মানের সমপর্যায়ে আনা। আমরা সমবেত চেষ্টায় যেদিন শিক্ষার মান উন্নত করিতে পারি, সেইদিন পরীক্ষার মানও তদনুপাতে উন্নত করিব। পরীক্ষার উদ্দেশ্য ত আসলে এই যে আমরা বছর দীঘালি ছাত্রদেরে যা পড়াইলাম, তা তারা পড়িয়াছে বুঝিয়াছে কি না তারই টেস্ট করা? তার বদলে আমরা যদি ছাত্রদেরে না পড়াইয়াই, শুধু কতকগুলো পুস্তক পাঠ্যতালিকাভুক্ত করিয়াই, সেই সব পুস্তক হইতে, অনেক সময় সেইসব পুস্তকের বাইরে হইতেও, প্রশ্ন করিয়া ছাত্রদের বিদ্যা পরখ করিতে চাই, তবে সেটা পরীক্ষা হয় না, হয় অবিচার। আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থায় তা নিষ্ঠুরতা, যুলুম। এর ফলে শিক্ষার গতি ব্যাহত হইতেছে, কত শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের সর্বনাশ হইতেছে গ্রাম্য জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার দৃষ্টান্ত দিয়া তা বুঝাইবার চেষ্টা করিলাম। শিক্ষার মান সম্পর্কে আমি বলিলাম যে শিক্ষার মানের তুলনামূলক বিচার হয় বিদেশী শিক্ষা-প্রাপ্তদের সাথে আমাদের শিক্ষা-প্রাপ্তদের মোকাবিলা হওয়ার বেলাতেই। আমাদের শিক্ষিতদের কয়জন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিদেশীদের মোকাবেলা করিবার সুযোগ পায়? দেশী বিদেশী বৃত্তি পাইয়া যে সব ছাত্র শিক্ষা ও ট্রেনিং লাক্সে জন্য বিদেশে যায়, শুধু তাদের বিদ্যাই আন্তর্জাতিক স্ট্যাণ্ডার্ডের কষ্টিপাথরে পরখ করা হয়। আমাদের দেশীয় বিভিন্ন পরীক্ষায় শতকরা একশ জনই পাস করাই আর শতকরা ত্রিশ জনই পাস কাই, উপরের দশটি ছেলে ভাল হইবেই। এরাই বিদেশে যাওয়ার চান্স পায়। তাদের প্রায় সবাই এই উপরের দশটি প্রতিভাবান ছেলের মধ্যে হইতে নির্বাচিত হয়। বাকী শতকরানব্বই জনই দেশের অভ্যন্তরে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকুরি-বাকুরি, ব্যবসা বাণিজ্য করিয়া জীবনযাপন করে। বিদেশী শিক্ষার মানের সাথে মোকাবিলা করার কোন কারণ বা সুযোগ এদের ঘটে না। ঘটিবেও না। অবিলম্বে আমাদের সকল স্তরে শিক্ষার মিডিয়ম হইবে বাংলা। তবে ইংরাজীতে কাবেলিয়ত না থাকিলে আমাদের ছেলেদের ফেল করান হইবে কেন? কাজেই আমাদের শিক্ষাবিদরা ও শিক্ষাকর্তৃপক্ষ এক কল্পিত আকাশচুম্বী শিক্ষার মানের নিরিখ দিয়া আমাদের ছাত্র-জনতাকে বিচার করিবার চেষ্টা করিয়া শুধু ভুল নয় অবিচার ও অন্যায়ও করিতেছেন। আন্তর্জাতিক উচ্চ মান দিয়া বিচার করিলে স্বয়ং আমাদের অধ্যাপক-শিক্ষকরা শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং দেশী অনেকে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও যে বিদেশীদের মোকাবিলায় পাত্তা পাইবেন না, সে কথা বলিতেও ছাড়িলাম না।

আমার শিক্ষা-নীতির কথা শুনিয়া অনেকেই বিপদ গণিয়াছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কানে কেউ-কেউ কথাটা তুলিয়াও ছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খা সাহেব এসব ব্যাপারে মূলতঃ আমার সহিত একমত ছিলেন। কাজেই তাঁর কাছে শিক্ষাবিদদের বিশেষ কোনও সুবিধা হইল না। আমি এ বিষয়ে সক্রিয় পন্থা গ্রহণের চিন্তার আলোচনা করিতে লাগিলাম।

৫. শিক্ষা-মন্ত্রিত্বের অবসান

কিন্তু আমাদের লিডার শহীদ সাহেব সব ওলট-পালট করিয়া দিলেন। তিনি কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করিলেন। আমাকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বানাইলেন। শিক্ষা প্রাদেশিক বিষয়। কেন্দ্রে ও-বিষয়ে বিশেষ কিছু করণীয় নাই। অতএব আমার ঘাড়ে চাপাইলেন কেন্দ্রের সর্বাপেক্ষা বড় দুইটি বিষয় : শিল্প ও বাণিজ্য। ৬ই সেপটেম্বর প্রাদেশিক মন্ত্রী হইয়াছিলাম। ১২ই সেপটেম্বর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হইলাম। ছয়দিনের শিক্ষামন্ত্রিত্ব হারাইয়া খুবই দুঃখিত ও নিরাশ হইয়াছিলাম। শিক্ষা পরিকল্পনার বিরাট সৌধ আমার তাসের ঘরের মতই ভাংগিয়া পড়িল। প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান স্বয়ং শিক্ষা-দফতরের ভার নিলেন বলিয়া অনেকখানি সান্ত্বনা লইয়া করাচি গেলাম।

কিন্তু অল্পদিনেই আমি শিক্ষা-দফতর হারাইবার দুঃখ ভুলিয়া গেলাম। শিল্প বাণিজ্য দফতরের বিশাল ও অসীম সাগরে ডুবিয়া গেলাম। শুধু কথার কথা নয়। সত্যই যেন এক-একটা মহাসাগর। কত বিভাগ, আর কত অফিসার! শিক্ষা দফতর ও বাণিজ্য দফতর দুইটি পৃথক এবং খানিকটা দূরে অবস্থিত। বাণিজ্য দফতর ছিল সাবেক সিন্ধু চিফকোর্ট বিল্ডিং-এ। আর শিল্প-দফতর ছিল মূল পাক সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং-এ। আমি সাধারণতঃ বাণিজ্য-দফতরে অবস্থিত মন্ত্রির চেম্বারেই বসিতাম। এটাই নাকি ছিল তৎকালের প্রথা। দুই দফতরের দুই মন্ত্রী থাকিলে অবশ্য তাঁরা যাঁরা-তাঁর দফতরেই বসিতেন। কিন্তু দুই দফতরের এক মন্ত্রী থাকিলে তিনি বাণিজ্য দফতরেই বসিতেন। আমার নিকটতম পূর্ববর্তী মিঃ ইব্রাহিম রহিমতুল্লা আমার মতই দুই দফতরের মন্ত্রী ছিলেন। তিনিও বাণিজ্য দফতরের চেম্বারেই বসিতেন। আমাকেও সেখানে বসান হইল। শিল্প দফতরের সেক্রেটারি মিঃ আবাস খলিলী ও বাণিজ্য দফতরের সেক্রেটারি মিঃ কেরামতুল্লাহ উভয়েই জাঁদরেল আই. সি. এস.। উভয়েই আমাকে ঘুরাইয়া-ঘুরাইয়া সারা আফিস দেখাইলেন এবং সকলের সাথে পরিচয় করাইয়া দিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *