১৬. কালতামামি

কালতামামি
যোলই অধ্যায়

১. বাংলার ভুল

১৯৩৮ সাল হইতে ১৯৪৮ সাল তক এই দশটা বছর শুধু একটা যুগ নয়, একটা মহাযুগ। এই উপমহাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লবী যুগ। বিপ্লবটা শুধু দেশের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্যই নয়, আমার ও আমার মত হাজার হাজার কর্মীর চিন্তার কাঠামোর জন্যও। কোথা হইতে কেমন করিয়া কিসের জন্য কি হইয়া গেল, কিছুই বোঝা গেল না। এক কাজ ছাডিয়া আরেক কাজ ধরিতে-না ধরিতেই পরেরটাও বাতিল হইয়া গেল। এক চিন্তা ছাড়িয়া আরেক চিন্তা ধরিতে-না ধরিতেই পরের চিন্তাও ভ্রান্ত প্রমাণিত হইয়া গেল। যেন সব ম্যাজিক!

কিন্তু এটা ম্যাজিক ছিল না মোটেই। এতদিন পরে পিছনের দিকে এক নজর তাকাইলে দেখা যাইবে সত্যই যেন কোনও অদৃশ্য হাতের বর্ধ-মুষ্টিতে ধরা অসহায় প্রাণীর মতই আমরা অঙ্গ চালনা করিয়াছি। কিন্তু পুতুল নাচ নয়। সত্য-সত্যই ঘোরতর জীবন-নাট্যের অভিনেতা-অভিনেত্রীর সিরিয়াস ভূমিকা। এতদিন পরে মনে হইবে, কতই না ভুল হইয়াছে! আমরা বলিব ওরা করিয়াছে; ওরা বলিবে আমরা করিয়াছি। কারও না কারও ভুল হইয়াছে নিশ্চয়ই। অথবা সত্য কথা এই যে এক ব্যাপারে তুমি ভুল করিয়া থাকিলে আরেক ব্যাপারে আমিও ভুল করিয়াছি নিশ্চয়ই। এটাই দেখা যাইবে আলোচ্য যুগের ঘটনা পরম্পরার বিশ্লেষণে।

পলাশির যুদ্ধের মত এ যুগের ভুলটাও শুরু হয় বাংলার মাটি হইতেই। ১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনের পরে কংগ্রেস যুক্ত প্রদেশ বোম্বাই ইত্যাদি প্রদেশে মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠনে অসম্মত হইয়া যে মারাত্মক ভুল করিয়াছিল, তাও শুরু হইয়াছিল কার্যত বাংলাতেই। এখানে হক সাহেবের নেতৃত্ব কৃষক-প্রজা পার্টি কংগ্রেসের সাথে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠনের যে প্রস্তাব চূড়ান্ত করিয়াছিল তা ভাঙ্গিয়া যায় তুচ্ছ বিষয়ে কংগ্রেসের মারাত্মক ভুলের দরুন। তারপর হক মন্ত্রিসভার প্রতি গোটা বাংলার এটিচুড আচার্য প্রফু চন্দ্রের উপদেশ-মত না হওয়াটা গোটা বাংলার জন্যই চরম দুর্ভাগ্যের বিষয় হইয়াছিল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ও আচার্য এর চন্দ্র একই প্যাটার্নের বাংগালী জাতির স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন। এই স্বপ্নের সাফল্যের জন্য রাষ্ট্রনায়কদের মনে যে অন্তর্মুখী দৃষ্টির (ইওয়ার্ড লুকিং) প্রয়োজন ছিল, সেটা ছিল তৎকালে একমাত্র হক সাহেবের মধ্যেই। কিন্তু সিরাজদ্দৌলাকে কেন্দ্র করিয়া যে বাংগালী জাতিত্বের পরিকল্পনা করিয়াছিল বাংলার হিন্দুরাই, বিশ শতকের তৃতীয় দশকের নয়া চিন্তা ভারতীয় জাতিত্বের বন্যায় সেই বাংগালী হিন্দুই ভাসিয়া যায়। তারা পশ্চিমমুখী হইয়া পড়ে। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনকে তারা একদিকে অখও ভারতের বিরোধী এবং অপরদিকে বাংলায় মুসলিম-রাজ মনে করিতে শুরু করে। এর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় বাংলার মুসলমানরা, এমন কি স্বয়ং হক সাহেবও, কাজে কর্মে পশ্চিমমুখী হইয়া পড়েন। বাংলা ‘অখণ্ড ভারতের রাজনৈতিক দাবা-খেলার বডিয়ায় পরিণত হয়। হক মন্ত্রিসভা প্রজাস্বত্ব আইন, মহাজনী আইন ও সালিশী বোর্ডের মারফত ধর্মসম্প্রদায়-নির্বিশেষে শোষিত জনগণের এত উপকার করিলেন, তবু হিন্দু রাষ্ট্রনেতা ও কংগ্রেসের মুখে এই মন্ত্রিসভার তারিফে একটি কথাও উচ্চারিত হইল না। বরং হক মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে তাদের রাগ ও দুশমনি বাড়িতেই লাগিল। ফলে হক সাহেব ও হকপ্রন্থী মুসলিম নেতারাও নিতান্ত আত্মরক্ষার উপায় স্বরূপ নিখিল-ভারতীয় মুসলিম নেতৃত্বের আশ্রয় লইলেন। কিন্তু হক সাহেব ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হইতেই জানিতেন, নিখিল-ভারতীয় মুসলিম নেতৃত্ব বাংগালী মুসলিম স্বার্থ বলিয়া কোনও কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করিতেন না। বাংলার মুসলিম স্বার্থও তাঁরা বিচার করিতেন নিখিল-ভারতীয় মুসলিম স্বার্থের মাপকাঠি দিয়া। ‘পূর্ব বাংলা ও আসাম’ নামক নব-সৃষ্ট মুসলিম-প্রদেশটিকে প্রতিষ্ঠিত সত্য বলিয়া ঘোষণা করিয়া প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের মধ্যে বাতিল করা হইলে এই কারণেই নিখিল-ভারতীয় মুসলিম নেতৃত্ব হইতে এই বিশ্বাস ভংগের কোনও সিরিয়াস প্রতিবাদ উঠে নাই। বিহার-যুক্ত-প্রদেশ-বোম্বাই-মাদ্রাজে কতিপয় মুসলিম আসন আদায় করিতে গিয়া মেজরিটি বাংগালী মুসলমানকে চিরস্থায়ী মাইনরিটি করিয়া লাখনৌ-প্যাকটে দস্তখত করিতে পারিয়াছিলেন তাঁরা এই কারণেই। এসব ঘটনা হক সাহেবের চোখের সামনেই ঘটিয়াছিল। ভারতীয় রাজনীতিতে আমি সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগার, বাংলার রাজনীতিতে আমি ‘অসাম্প্রদায়িক প্রজা-নেতা’ কথাটা হক সাহেব বলিতে পারিয়াছিলেন এই জন্যই। আমরা তখন তাঁকে বুঝি নাই। মানি ত নাইই। কিন্তু হক সাহেব নিজেই কি বুঝিয়াছিলেন তাঁর কথার ঐতিহাসিক গুরুত্ব?

পরে যখন তিনি বুঝিয়াছিলেন, তখন তাঁর বাহির হওয়ার পথ বন্ধ। তা সত্ত্বেও তিনি যখন বাহির হইয়াছিলেন, তখন তিনি একা। মুসলিম-বাংলা আর তার পিছনে নাই। মুসলিম লীগ নেতৃত্ব ও পাকিস্তান আন্দোলনের মোকাবিলায় হক নেতৃত্বের কৃষক-প্রজা পার্টি ও হক মন্ত্রিসভার ভূমিকার অন্তর্নিহিত বাণী ও শিক্ষা এই। এই কারণেই এই সময়কার অজানা ঘটনাবলী আমি অতি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করিয়াছি। ১৯৩৮ সালে হক সাহেবের মুসলিম লীগে যোগদান ও প্রাদেশিক লীগের সভাপতিত্ব গ্রহণ, আমাদের সকলের অত অনুরোধেও কৃষক-প্রজা সমিতির সভাপতিত্বে ইস্তফা দেওয়া, বাংলার ক্ষেত্রে মুসলিম-আন্দোলন ও প্রজা আন্দোলনকে একই আন্দোলন বলা, স্বয়ং লাহোর প্রস্তাব পেশ করা এবং শেষ পর্যন্ত জিন্না সাহেবের সহিত মুসলিম বাংলার ভবিষ্যৎ লইয়া কলহ করা ও ১৯৪১ সালের ১০ই অক্টোবরের ঐতিহাসিক পত্র লেখা ও প্রগ্রেসিভ কোয়েলিশন মন্ত্রিসভা গঠন করা ইত্যাদি সমস্ত ব্যাপার যেন যুগ ও ভাগ্য-বিবর্তনের অচ্ছেদ্য অংশ হিসাবেই ঘটিয়া গিয়াছে। এতে বাধা দিবার বা এর গতি পরিবর্তনের ক্ষমতা যেন কারুরই ছিল না। হক সাহেবের মনে কি বিপুল চাঞ্চল্যের ঝড় বহিতেছিল, তা এই সময়কার ঘটনা হইতেই বুঝা যাইবে।

২. কংগ্রেসের আত্মঘাতী-নীতি

১৯৩৭ সালে কংগ্রেস যে মারাত্মক ভুল করিয়াছিল ১৯৪৭ সালে সে ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করে তারা। কেবিনেট মিশন প্ল্যান সাবটাশ করাই এই দ্বিতীয় ভুল। পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশের সমবায়ে তিন বিষয়ের কেন্দ্রীয় সরকার সহ একটি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের যে স্বপ্ন আমরা বামপন্থী কমীরা দেখিতেছিলাম, কেবিনেট মিশনের গ্রুপিং সিস্টেম কৌশলে সাবটাশ করিয়া কংগ্রেস আমাদের সে স্বপ্ন চুরমার করিয়া দিয়াছিল।

কংগ্রেসের তঙ্কালীন প্রেসিডেন্ট পণ্ডিত নেহরু নিজ মুখে ও হাতে এই সাবটাশ কাজটি করিয়াছিলেন। সেজন্য মুসলিম লীগ-পন্থী মুসলমানরা ত বটেই এমন কি কংগ্রেস-নেতা স্বয়ং মওলানা আবুল কালাম আজাদ পর্যন্ত পণ্ডিত নেহরুর নিন্দা করিয়াছেন। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে অনেক ছোট-বড় নেতা-কর্মীও করিয়াছেন। আমিও করিয়াছি। কারণ এটা সুস্পষ্ট সত্য যে পণ্ডিত নেহরু ঐ কথা না বলিলে মুসলিম লীগ গ্রুপিং সিস্টেম গ্রহণ প্রত্যাহার করিত না। ফলে একটা আপোস হইয়া যাইত। মুসলিম লীগ গণ-পরিষদে ও কেন্দ্রীয় সরকারে প্রবেশ করিত।

কিন্তু এর আরো একটা দিক আছে। পণ্ডিত নেহরু যে কথাটা বলিয়াছিলেন, সেটা শুধু তাঁর নিজের কথা ছিল না; অধিকাংশ কংগ্রেসী হিন্দু নেতার মনের কথা ছিল। নেহরঙ্গী সরলভাবে আগেই সে কথা বলিয়া দিয়া মুসলিম-লীগারদের হুশিয়ার করিয়া দিয়াছিলেন মাত্র। সার্বভৌম গণ-পরিষদ কারও কোনও চুক্তি মানিতে বাধ্য নয়, এই কথাটাই তিনি গণ-পরিষদে বসিবার আগে গণ-পরিষদের বাইরে বলিয়া ফেলিয়াছিলেন। ধরুন, ঐ সময়ে ও-কথা না বলিয়া মুসলিম লীগ সহ গণ-পরিষদ বসিবার পরে শাসনতন্ত্র রচনাকালে পরিষদ-কক্ষে দাঁড়াইয়া তিনি যদি ভা বলিতেন, তবে কেমন হইত? মুসলিম লীগকে নিশ্চয় বেকায়দায় ফেলা হইত। গণ-পরিষদ ও কেন্দ্রীয় সরকার হইতে মুসলিম লীগকে বাহির হইয়া আসিতে হইত। নৃল করিয়া আন্দোলন শুরু করিতে হইত। তাতে সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক আরও তিক্ত হইত। ‘কেবিনেট মিশন প্ল্যান সফল হইয়াছে, কংগ্রেস লীগ উভয়ে তা কার্যকরী করিতে শুরু করিয়াছে’, এই কথা ঘোষণা করিয়া ততদিনে কেবিনেট মিশন নিশ্চিন্তে দেশে ফিরিয়া যাইতেন। কাজেই গণ-পরিষদের ভিতরকার ঐ গণ্ডগোলে নূতন করিয়া দেন-দরবার আলাপ-আলোচনা মিশন-কমিশন শুরু হইত। পণ্ডিত নেহরুর ১০ই জুলাইয়ের ঘোষণার ফলে এটা ঘটিতে পারে নাই। মুসলিম লীগ তৎক্ষণাৎ গ্যান গ্রাহ্য করিয়াছিল। ফলে বৃটিশ সরকার ১৯৪৭ সালের ৩রা জুন দেশ-বাঁটোয়ারার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। নেহরুর ঘোষণা ঐ সময় না হইয়া পরে হইলে ৩রা জুনের ঘোষণাও আরও পিছাইয়া যাইত। এতে আরও রক্তক্ষয় হইত। মুসলমানরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হইত। এটা না হইয়া যে তখনই একটা এসপার-ওসপার হইয়া গিয়াছিল, এর জন্য দায়ী পণ্ডিত নেহরু। আমার এখানকার বিবেচনায় ঐ বিবৃতি দিয়া পণ্ডিতজী মুসলমানদের উপকারই করিয়াছিলেন।

দেশ ভাগটা হাতে-কলমে হওয়ার সময় স্বভাবতঃই আমার মত নিচের তলার মুসলিম লীগ-কর্মীর কোন সক্রিয় ভূমিকা ছিল না। অন্যান্য লক্ষ-লক্ষ কর্মীর মতই আমারও ভূমিকা ছিল অজ্ঞ দর্শকের। উপরের তলায় ও ভিতরে ভিতরে সব ঘটিয়া যাইত। ঘটনার পরে আমরা শুনিতাম। কোনটায় খুশী হইতাম; কোনটায় চটিয়া যাইতাম। কিন্তু তাতে ঘটনার কোনও এদিক-ওদিক হইত না। তবু প্রধানমন্ত্রী সুহরাওয়ার্দী সাহেবের দৈনিক কাগযের সম্পাদক হিসাবে আমার একটু সুবিধা ছিল। কোনও কোনও ঘটনা ঘটিবার আগে আঁচ ও আভাস পাইতাম। নেতাদের কেউ কেউ কিছু কিছু আভাসে ইংগিতে বলিতেনও। আবার সাংবাদিকের বিশেষ অধিকার যে ‘ভৌতিন সোর্স’ তারাও কিছু কিছু সংবাদ অর্থে গুজব সরাহ করিত।

৩. প্রবঞ্চিত মুসলিম-বাংলা

ঐ সব ঘটনা হইতে আমার তখনই সন্দেহ হইতেছিল যে বাঁটোয়ারার ব্যাপারে মুসলিম বাংলার উপর সুবিচার হইতেছে না। যতই দিন যাইতেছিল ততই আমার সন্দেহ দৃঢ়তর হইতেছিল। পরে তা বিশ্বাসে পরিণত হইয়াছিল। ব্যাপারটা আমাকে খুব পীড়া দিত। যে মুসলিম-বাংলার ভোটে পাকিস্তান আসিল, ভাগ-বাঁটোয়ারার সময়ে তাদেরই প্রতি এ বঞ্চনা কেন? কোনও যুক্তি নেই। কিন্তু অবিচার চলিল নির্বিবাদে। নেতাদের অর্থাৎ জনগণের ভাগ্য-নিয়ন্তাদের চোখের সামনে, তাঁদের সম্মতিক্রমে, বাটোয়ারায় মুসলিম বাংলাকে তার প্রাপ্ত মর্যাদা ও ন্যায্য হক হইতে বঞ্চিত করা হইয়াছে। অপরের স্বার্থের যুপকাষ্ঠে মুসলিম বাংলার মানে পূর্ব বাংলার স্বার্থ বলি দেওয়া হইয়াছে। ‘কলিকাতা চাই’ আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, বেংগল পার্টিশন কাউন্সিল ও কেন্দ্রীয় পার্টিশন কাউন্সিলের দুই নীতি, দায় ও সম্পত্তি হিসাব নিকাশে শুভংকরের ফাঁকি ইত্যাদি ব্যাপারে এই জন্যই আমি অত বিস্তারিত আলোচনা করিয়াছি। ও-সব কথাই রেকর্ডের কথা বটে, তার অধিকাংশই খবরের কাগযে। প্রকাশিত তথ্যও বটে, কিন্তু ইতিমধ্যেই অনেকে তা ভুলিয়া যাওয়া শুরু করিয়াছেন। পাকিস্তান সংগ্রামে অংশ গ্রহণকারী নেতা-কর্মীদের অবর্তমানে আমাদের নয়া পুস্তের তরুণরা এ সব কথা জানিবে না। প্রাচীন কাগ-পত্র ঘাটিয়া এ সব কথা জানিবার। কৌতূহলের কোনও অজুহাতও তাদের থাকিবে না। তাই এ সব কথা একত্রে লিপিবদ্ধ করিয়া আমাদের ভবিষ্যৎ তরুণদের চিন্তার খোরাক ও জ্ঞানের মাল-মশলা হিসাবে রাখিয়া যাইবার উদ্দেশ্যেই এ সবের উল্লেখ করিলাম। দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিক ইতিহাস-কারদের কাজে লাগিবে।

এইসব বিবরণ হইতে স্পষ্ট বুঝা যাইবে যে পূর্ব পাকিস্তানের ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এই ‘কাটা-ছেঁড়া পোকায় খাওয়া’ অবস্থার জন্য রেডক্লিফের চেয়ে আমাদের নিজের প্রতিনিধি নেতাদের দায়িত্বও কম ছিল না। সুহরাওয়ার্দী সাহেব প্রধানমন্ত্রী ও বেংগল পার্টিশন কাউন্সিলের মেম্বর থাকাকালে এবং তার পরবর্তীকালের পার্থক্য হইতেই এটা বুঝা যাইবে। সুহরাওয়ার্দী সাহেব গভর্নর ক্যাসি সাহেবের মত ও সিদ্ধান্ত বলিয়া আমাদেরে যা জানাইয়াছিলেন, পাঠকগণের দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করিতেছি। সার নাযিমের হাতে তাঁর পরাজয় ঘটাইয়াছিলেন কারা? সুহরাওয়ার্দী-হীন পার্টিশন কাউন্সিল শুধু কলিকাতা ছাড়িলেন না; কলিকাতার দামে লাহোর কিনিয়া মূখের হাসি হাসিয়া বাড়ি ফিরিলেন। আর কোথায় বারাকপুর বারাসত ভাংগর বশিরহাট? কোথায় গেল দার্জিলিং? যেখানে যাইবার সেখানেই গিয়াছে। কারণ পূর্ব বাংলার স্বার্থ দেখার কেউ ছিল না। যাঁরা তৎকালে আমাদের নেতা ছিলেন তাঁরা পশ্চিমা নেতৃবৃন্দের বিশেষতঃ স্বয়ং কায়েদে আযমের মুখাপেক্ষী পদমর্যাদা-লোভ ভিখারী মাত্র। পূর্ব-বাংলার স্বার্থের কথা বলিয়া পাকিস্তানী নেতৃত্বের বিরাগভাজন হইতে কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। হক সাহেব ও সুহরাওয়ার্দী সাহেবকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হাতে নাস্তানাবু হইতে দেখিয়া এদের কেউ আর টু শব্দটি করিতে সাহস করেন নাই বলিয়াই মনে হয়। এই সুযোগে পাকিস্তানের গোড়ার দিকে পূর্ববাংলার সীমা সরহদ্দ সম্বন্ধে বাউণ্ডারি কমিশনের সামনে সওয়াল জবাব করিবার জন্য হক সাহেব ও সুহরাওয়ার্দী সাহেবের মত দেশবিখ্যাত প্রতিভাবান দেশী উকিল-ব্যারিস্টার বাদ দিয়া যুক্ত প্রদেশ হইতে অখ্যাতনামা মিঃ ওয়াসিমকে আমাদের উকিল নিযুক্ত করা হইয়াছিল। এ ধরনের ব্যবস্থার ফল যে আমাদের স্বার্থের প্রতিকূল হইবে, এটা একরূপ জানাই ছিল।

পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি এই ঔদাসীন্য শুধু জায়গা-জমি টাকা-পয়সার ব্যাপারেই সীমাবদ্ধ ছিল না। রাজনৈতিক মর্যাদাদানে কৃপণতাতেও তা প্রসারিত হইয়াছিল। তাই জাতির পিতা, স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপতি কায়েদে-আযম মোহাম্মদ আলী জিন্না পাকিস্তান সৃষ্টির দিন হইতে আটমাস পরে দেশের বৃহত্তর অংশ পূর্ব-বাংলায় ভরিফ আনিবার সময় পাইয়াছিলেন। স্বয়ং জাতির পিতাই যখন এই ভাব পোষণ করিতেন, তখন আর নীচের স্তরের নেতা ও সরকারী কর্মচারিদের কথা বলিয়া লাত কি?

৪. কেন্দ্রের ঔদাসীন্য

পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এই নিদারুণ ঔদাসীন্য ও উপেক্ষার মৌলিক কারণ ছিল এই যে, পূর্ব-বাংলাটা ছিল তাঁদের ‘ফাউ’-এর প্রাপ্তি। বাংলা তাঁদের বিবেচনা ও প্ল্যানের মধ্যে ছিল না। পাকিস্তান কথাটা সৃষ্টি হইয়াছিল বাংলাকে বাদ দিয়া। ওটা ছিল পশ্চিম পাকিস্তান অঞ্চলের মুসলিম-প্রদেশসমূহের নামের হরফের-সমষ্টি, একথা আজ সবাই জানেন। সে নামের হরফে বাংলা তখনও ছিল না। এখনও নাই। এটা শুধু চৌধুরী রহমত আলীর মত ছাত্র-তরুণের দেওয়া নাম মাত্র নয়। পাকিস্তান আদর্শের ‘স্বাপ্নিক ও রূপকার’ বলিয়া প্রশংসিত মনীষী দার্শনিক ও কবি সার মোহাম্মদ ইকবালের ঝিম। তিনি ১৯৩০ সালের এলাহাবাদ মুসলিম লীগ অধিবেশনে তাঁর ইতিহাস-বিখ্যাত সভাপতির ভাষণে এই পাকিস্তানের ভৌগোলিক আকার, আকৃতি ও সীমারেখাও বর্ণনা করিয়াছিলেন। ঐ আকার আকৃতির মধ্যে বাংলার নামগন্ধও ছিল না। পাঞ্জাব, কাশ্মীর, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশ লইয়াই তিনি ভারতীয় মুসলিম রাষ্ট্র তৈয়ার করিয়াছিলেন। ঐ ভারতীয় মুসলিম রাষ্ট্রের দাবিকে তিনি ভারতীয় মুসলিমদের জাতীয় দাবি ও চূড়ান্ত আদর্শ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছিলেন। বাংলাকে, মুসলিম বাংলাকে, তিনি শুধু ঐ চূড়ান্ত কাঠামোর মধ্যে ধরেন নাই তা নয়, তাঁর ঐ মূল্যবান অভিভাষণে বাংলার বা বাংলার মুসলমানদের কোনও উল্লেখও নাই। অথচ সার ইকবাল কথা বলিতেছিলেন ভারতীয় মুসলমানদের পক্ষে, সভাপতির অভিভাষণ দিতেছিলেন তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কফারেন্সে এবং ভারতীয় মুসলমানদের অধিকাংশ তখনও বাস করিতেছিল বাংলাতে। এই মনোভাবই ইকবাল সাহেবের বহু আগে ১৯০৬ সালে পূর্ব-বাংলা ও আসাম স্থাপনের এবং ১৯১১ সালে পূর্ব বাংলা ও আসাম বাতিলের বেলা নিখিল। ভারতীয় মুসলিম নেতৃত্বের অমার্জনীয় ঔদাসীন্য প্রকট হইয়াছিল। নিখিল ভারত মুসলিম লীগের উদ্যোক্তা-প্রতিষ্ঠাতা নবাব সার সলিমুল্লার প্রস্তাব ও অনুরোধ সত্ত্বেও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ ১৯০৬ সালের প্রতিষ্ঠা অধিবেশনে পূর্ব-বাংলা ও আসাম প্রদেশ সমর্থন করেন নাই। ১৯১১ সালের ডিসেম্বরে হিন্দু সন্ত্রাসবাদীদের বোমার ভয়ে বৃটিশ সরকার তাঁদের সে ‘সেটেলড ফ্যাক্ট’-কে আন্-সেটেল্ড ও বাতিল করেন। এরপর মুসলিম লীগের ১৯১২ সালের কলিকাতা অধিবেশনে নবাব সলিমুল্লা হাজার চেষ্টা করিয়াও মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানকে দিয়া মুসলিম বাংলার প্রতি এই বেঈমানির প্রতিবাদ করাইতে পারেন নাই। পূর্ব-পাকিস্তানের আজিকার কীট-দুষ্ট বিকলাঙ্গ চেহারা দেখিয়া আজ স্বভাবতঃই বাংগালী মুসলমান মাত্রেরই মনে পড়ে ১৯০৫ সালের পূর্ব-বাংলা ও আসাম প্রদেশের কথা। বর্তমান আকারের পূর্ব পাকিস্তানের ৫২ হাজার বর্গ মাইলের আয়তনের তুলনায় পূর্ব-বাংলা আসামের আয়তন ছিল ১ লক্ষ ৬ হাজার মাইল। ৩ কোটি ১০ লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৮৫ লক্ষ ও হিন্দু আসামী ও পার্বত্য জাতিসমূহ মিলিয়া ছিল ১ কোটি ২০ লক্ষ। মুসলমানদের সামাজিক সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের দরুন ঐ সব অমুসলমানের বিপুল সংখ্যাধিক লোক ছিল হিন্দুর চেয়ে মুসলমানের ঘনিষ্ঠ। এক দিকে মুসলিম বাংলা আসামের খনিজ-বনজ সম্পদের অংশীদার হইত। অপর দিকে আসামী ও পার্বত্য জাতিরা বর্তমানের ল্যাওড় ও বন্দহীন দুরবস্থার বদলে চাটগাঁর মত বিশাল বন্দরের অংশীদার হইত। মুসলিম-বাংলার মত এত সুখ যেন নিখিল ভারতীয় মুসলিম নেতৃত্বের কাম্য ছিল না। তারপর ১৯১৬ সালে লাখনৌ-প্যান্টের ব্যাপারে এই মনোভাবই ফুটিয়াছিল। এ সবই ডাঃ ইকবালের এলাহাবাদী ঘোষণার আগের ঘটনা। তারপর ইকবাল সাহেবের পরে ১৯৪৭ সালে পাঞ্জাব ও বাংলার দায়-জায়াদবন্টনের আগা-গোড়া ঐ একই মনোব কাজ করিয়াছিল। এই জন্যই ‘পূর্ব বাংলা ফাউ’-এর ধান। ‘ফাউ’-এর ধান টিয়ায় খাইলে গৃহস্থের আপত্তি হয় না। পাকিস্তান হাসিলের আগে এদের দরকার ছিল ভোটের। পাকিস্তান হাসিলের পর এদের দরকার পাটের। একটা শেষ হইয়াছে। আরেকটা শেষ হইতে দেরি নাই। ‘কাজের বেলা কাজী, কাজ ফুরালে পাজী।‘ পূর্ব পাকিস্তানের বরাতে তাই আছে।

পাকিস্তান হওয়ার পর পৌনে তিনটা বছর আমাকে কলিকাতা থাকিতে হইয়াছিল অবস্থা-গতিকে। কিন্তু ঐ সময়কার অভিজ্ঞতাটা আমার অনেক কাজে লাগিয়াছে। সে সব অভিজ্ঞতার অত খুটিনাটি বিবরণ দিয়াছি আমি একটা কথা বুঝাইবার জন্য। সেটা এই যে পশ্চিমবাংলা সরকার ও তথাকার ইন্টেলিজেনশিয়ার উল্লেখযোগ্য অংশ গোড়ার দিকে স্পিরিট-অব-পার্টিশন রক্ষা করিয়া চলিয়াছেন অনেক দিন পর্যন্ত। একজন পাকিস্তানী মুসলিম লীগ-কমীর মুখ হইতেই এই সত্য কথাটা বাহির হওয়া উচিৎ বলিয়াই আমি তা বলিতেছি। না বলিলে সত্য গোপনের পাপ হইত।

৫. স্পিরিট-অব-পার্টিশন

তবেই এখানে বলিতে হয় স্পিরিট অব পার্টিশন বলিতে আমি কি বুঝাইতেছি? কথাটা খোলাসা করিয়া বলা দরকার শুধু মুসলিম জনসাধারণ, মুসলিম লীগ কর্মী ও অনেক মুসলিম-লীগ নেতার জন্যই নয়, বড় বড় প্রবীণ হিন্দু-কংগ্রেস নেতার জন্যও। কারণ অত বড় বড় বুদ্ধিমান লোক হইয়াও পার্টিশনের স্পিরিটটা তাঁরাও ধরিতে পারেন নাই। এরা পারেন নাই বলিয়াই মহাত্মাজীকে বারেবারে অনশন ও শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করিতে হইয়াছিল। এই কারণেই সর্দার প্যাটেলের মত দায়িত্বশীল নেতা বলিতে পারিয়াছিলেন : ‘মুসলমানেরা পাকিস্তান চাহিয়াছিল, তা তারা পাইয়াছে। এখন তারা সব সেখানে চলিয়া যাক।’ আলীপুরের হিন্দু উকিল বন্ধুরাও আমাকে এই কথাই বলিয়াছিলেন : কিন্তু দুইটি কথার মধ্যে পার্থক্য ছিল মৌলিক। আলীপুরের বন্ধুরা বলিয়াছিলেন রসিকতা করিয়া। সর্দার প্যাটেল বলিয়াছিলেন সিরিয়াসলি। আলীপুরের বন্ধুরা বলিয়াছিলেন প্রাইভেটলি। সর্দারজী বলিয়াছিলেন পাবলিকলি। আলীপুরের বন্ধুদের কথায় কোন রাজনৈতিক তাৎপর্যও ছিল না, ফলাফলও ছিল না। সর্দারজীর কথার রাজনৈতিক তাৎপর্যও ছিল গুরুতর, ফলাফলও ছিল ঘোরতর।

শুধু সর্দারজী নন। পণ্ডিত নেহরুর মত অসাম্প্রদায়িক নেতা পর্যন্ত পার্টিশনের প্রতিক্রিয়ার ধাক্কায় মানসিক ব্যালেন্স হারাইয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন : ‘মাথার বিষ নামাইতে আমরা মাথা কাটিয়া ফেলিয়াছি।‘ এটা তাঁর ভুল। রাগের কথা–আসলে তিনি মাথা কাটেন নাই। মস্তকটিকে দুই হেমিসফেয়ারে ভাগ করিয়া রাখিয়াছিলেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই।

এতেই দেখা যাইবে যে উপরের স্তরের নেতাদের মধ্যেও একমাত্র মহাত্মা গান্ধী ও কায়েদে-আযম জিন্না ছাড়া আর কেউ গোড়ার দিকে স্পিরিট-অব-পার্টিশন হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন নাই। ঐ দুই মহান নেতা ছাড়া আরেক জন এই স্পিরিটটা বুঝিয়াছিলেন। তিনি ছিলেন শহীদ সুহরাওয়ার্দী।

এখন বিচার করা যাক স্পিরিট-অব-পার্টিশন কি? একদিকে যাঁরা বলেন, আদম-এওয়াজ ছাড়া দেশ বিভাগ মানিয়া লইয়া মুসলিম লীগ দ্বিজাতিতত্ত্বই বর্জন করিয়াছিল, তাঁরাও স্পিরিট-অব-পার্টিশন বুঝেন নাই। অপরদিকে যাঁরা বলেন, শরিয়ত-শাসিত ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবেই পাকিস্তান হাসিল হইয়াছে, তাঁরাও স্পিরিট অব-পার্টিশন বুঝেন নাই। এই না বুঝার দরুন কত রকমে কি কি অনিষ্ট হইয়াছে, সে সব কথা যথাস্থানে বলা যাইবে। মোট কথা, ইসলাম রক্ষার জন্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দরকার ছিল না। ভারতীয় মুসলমানদের রক্ষার জন্যই এর দরকার ছিল। এখানে ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম জাতির স্বার্থের পার্থক্য বুঝিতে হইবে।

ইসলাম ধর্মকে দুনিয়ায় টিকাইয়া রাখিতে রাষ্ট্র শক্তির দরকার, একথা যাঁরা বলেন, তারা ইসলামকে ধর্ম হিসাবে হোট করিয়া দেখেন। ইসলাম ধর্ম হিসাবে নিজের জোরেই বিশ্ব-জগতে প্রচারিত হইয়াছে এবং আজও হইতেছে। নিজের জোরেই চিরকাল বাঁচিয়াও থাকিবে। অতএব ইসলাম ধর্ম নয়, ভারতীয় মুসলমানদের রক্ষার জন্যই পাকিস্তানের সৃষ্টি। একাজ করিতে গিয়া আসলে মুসলিম লীগ দ্বিজাতি তত্ত্বও বিসর্জন দেয় নাই, পাকিস্তানও শরিয়তী শাসনের ইসলামী রাষ্ট্ররূপে সৃষ্ট হয় নাই। দুই জাতি’র ভিত্তিতে এই উপমহাদেশ দুইটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিভক্ত হইয়াছে মাত্র। তার একটি হিন্দু-প্রধান, অপরটি মুসলিম প্রধান। এই যা পার্থক্য।

স্পিরিট-অব পার্টিশন এই দুই রাষ্ট্র সৃষ্টির বুনিয়াদী মূলকথা। সেটা বুঝিতে হইলে আগে বুঝিতে হইবে : এই দুই রাষ্ট্র সৃষ্টি হিন্দু-মুসলিমে আপোসের ব্যর্থতার পরিণাম নয়, তাদের আপোসের ফল। হিন্দু-মুসলিম একতাবদ্ধ হইতে পারে নাই বলিয়া দেশ ভাগ হইয়াছে, এটা সত্য নয়। সত্য কথা এই যে, দুই জাতি ঐক্যবদ্ধ হইয়াই আপোসে দুই রাষ্ট্র সৃষ্ট করিয়াছে। এও বুঝিতে হইবে যে হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ করিয়া দেশ ভাগ করে নাই। বিজেতা কোনও বিদেশী শক্তিও দেশ দুই টুকরা করে নাই। জার্মানি, পোল্যাণ্ড, তুরস্ক, কোরিয়া, ভিয়েতনাম ইত্যাদি বহু দেশকে আমরা দুই টুকরা হইতে দেখিয়াছি। কিন্তু ও-সবই করিয়াছে বিজয়ী বিদেশীরা। আমাদের দেশ ভাগ করিয়াছেন স্বয়ং আমাদের নেতারা, আলোচনার টেবিলে বসিয়া, একই রেডিওতে তা ঘোষণা করিয়া।

মহাত্মাগান্ধী ও কায়েদে-আযম জিন্না উভয়েই, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যকেই ভারতের রাষ্ট্রীয় আযাদির অপরিহার্য শর্তরূপে, ‘সাইন কোয়া নন’ হিসাবে পেশ করিয়াছিলেন। শেষ পর্যন্ত ঐক্যের বলেই তাঁরা সে আযাদি হাসিল করিয়াছেন। পার্থক্য শুধু এই যে গোড়াতে উভয়ে এক খাম্বার রাষ্ট্রীয় সৌধের স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন। নানা কারণে সেটা না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তাঁরা দুই ভাষার সৌধ করিয়া গিয়াছেন।

এমনভাবে সমাধান করা ছাড়া উপায়ান্তর ছিল না। কারণ সমস্যা যত বড় হয়, সমাধানও তত বড় হইতেই হয়। ভারতের হিন্দু-মুসলিম-সমস্যার সমাধানের অ বিস্তর চেষ্টা সব নেতাই করিয়াছেন। ঐ সমস্যার মূলগত গভীরতা ও আকারের পরিব্যাপ্তি বুঝিয়াছিলেন মাত্র তিনজন নেতা৷ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, কায়েদে-আযম জিয়া ও মাহাত্মা গান্ধী। এ তিন জনের প্রথম দুইজন সমস্যাটার প্রকৃতি বুঝিয়াছিলেন কতকটা উৎপ্রেরণা বা ইষ্টিং বলে। তাঁদের কুশা বুদ্ধির কাছে সমস্যাটার প্রকৃতি সহজাত মনীষার জোরেই ধরা পড়ে। গভীরভাবে তলাইয়া এবং দীর্ঘদিন গবেষণা করিয়া বুঝিতে হয় নাই। তাই ১৯১৬ সালের লাখনৌ প্যাক্টের মাধ্যমে কায়েদে-আযম সমস্যাটা সমাধান করিতে চাহিয়াছিলেন। ১৯১৭ সালের কংগ্রেসের কলিকাতা অধিবেশন হইতেই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ও কায়েদে-আযম জিন্ন সমবেতভাবে ও একই ধরনে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পন্থায় সাম্প্রদায়িক সমস্যাটার সমাধান করিবার চেষ্টা চালাইয়া যান। কিন্তু ১৯২১ সালে মহাত্মাজী তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব বলে কংগ্রেসী রাজনীতিতে আধ্যাত্মিকতার আমদানি করার প্রতিবাদে নিরেট যুক্তিবাদী সেকিউলারি জিন্না কংগ্রেসের রাজনীতির সহিত সমস্ত সম্পর্ক বর্জন করেন। অতঃপর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন এককভাবে উভয়ের অনুসৃত নীতি চালাইয়া যাইতে থাকেন। নিখিল ভারতীয় কোন নেতার সহযোগিতা না পাইয়া দেশবন্ধু বাংলাদেশ ভিত্তিক সমাধানের সিদ্ধান্ত করেন। বেংগল প্যাক্ট তার ফল। নিখিল ভারত কংগ্রেস দেশ বন্ধুর মত গ্রহণ করেন নাই। মর্মাহত দেশবন্ধু অকালে ১৯২৫ সালে পরলোক গমন করেন। তিনি মারা গেলেও তাঁর প্রদর্শিত মূলনীতি মরে নাই। দেশবন্ধুর বেংগল প্যান্টের মূলনীতি ছিল হিন্দু-মুসলিম সমস্যার সমাধান হিন্দু-মুসলিম সমাসে নয় সন্ধিতে, সংযোগে নয় সংসর্গে, ঐক্য নয় সখ্যে, মিশ্রণে নয় যোগে, মিলনে নয় মিলে, ফিউশনে নয় ফেডারেশনে। দেশবন্ধু তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতিতে একথা স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন। এত স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন যে তৎকালে অনেক নেতাই তাতে চমকিয়া উঠিয়াছিলেন। তিনি স্পষ্টই বলিয়াছিলেন : ‘হিন্দু-মুসলিম মিলন অর্থে যদি আমি বুঝিতাম দুই সমাজের মিশ্রণ, তবে আমি কোনও দিন মিলনের কথা বলিতাম না। কারণ দুই সমাজ এক করা আমার কল্পনাতীত। আমার মতে হিন্দু-মুসলিম মিলন অর্থ রাজনৈতিক ফেডারেশন।‘

কথাটা শুধু রাজনৈতিক নয় আধ্যাত্মিকও বটে। এই জন্যই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন যেটা বুঝিয়াছিলেন বিশের দশকে, মহাত্মা গান্ধীও কায়েদে আযম জিন্না তাই বুঝিয়াছিলেন চল্লিশের দশকে। মহাত্মাজী সাধক পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও এটা বুঝিতে তাঁর কুড়ি-পঁচিশ  বছরের বেশি লাগিয়াছিল এই জন্য যে তাঁর সাধনা ছিল একরোখা হিন্দুর সাধনা। শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝিয়াছিলেন এই কারণে যে তাঁর সাধনা ছিল অহিংসার সাধনা, প্রেমের সাধনা। কায়েদে-আযমের এত সময় লাগিয়াছিল এই জন্য যে কুশাগ্র-বুদ্ধি হইয়াও তিনি ছিলেন নির্ভেজাল সেকিউলারিষ্ট। রাজনীতিতে ধর্ম কৃষ্টির আমদানির তিনি ছিলেন ঘোরর বিরোধী। তবু শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝিয়াছিলেন এই জন্য যে তাঁর সেকিউলারিযমের মধ্যে আধ্যাত্মিকতা ছিল। কারণ তিনি ছিলেন সত্যবাদী সত্যের পূজারী হক-পন্থী। পরের হক্কের প্রতি তিনি ছিলেন নিজের হকের মতই সচেতন। গণতান্ত্রিক স্বাধীন ভারতে হিন্দুর প্রাধান্য তার ন্যায় সঙ্গত অধিকার। সাম্প্রদায়িক নির্বাচন-প্রথা বা অন্য কোন সংরক্ষণ-ব্যবস্থা দ্বারা হিন্দুর সে গণতান্ত্রিক অধিকারকে সংকুচিত করিবার অধিকার কারও নাই; এই সত্যের স্বীকৃতির মধ্যেই জিন্নার সত্য-প্রিয়তার প্রমাণ বিদ্যমান।

এখন বিচার করুন, হিন্দু-মুসলিম সমস্যার বুনিয়াদী যে প্রশ্নটা দেশবন্ধু বিশের দশকে এবং মহাত্মাজী ও কায়েদে-আযম আরও বিশ বছর পরে চল্লিশের দশকে বুঝিতে পারিয়াছিলেন, তা কি ছিল? কত গভীর ছিল? কেমন বিপুল ছিল? তার সমাধানের সর্বোত্তম পন্থাইবা কি ছিল? এইটা বুঝিতে পারিলেই স্পিরিট-অব পার্টিশন বোঝা যাইবে। এই স্পিরিটটা ধরিতে পারিলেই হিন্দু-মুসলমানের ভবিষ্যৎ বংশধরগণ চিরকাল মহাত্মাজী ও কায়েদে-আযমের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকিবে। দেশ ভাগ করার অপবাদে তাঁদেরে অভিশাপ দিবে না।

কারণ ভারতের হিন্দু ও মুসলিম দুইটাই মহান মানব গোষ্ঠী। উভয়ের ঐতিহ্য গরীয়ান। উভয়ের ইতিহাস কীতি ও কৃতিত্বে প্রোজ্জ্বল। উতয়ের অতীত গৌরবের বস্তু। একদিকে দেশের তিন-চতুর্থাংশ অধিবাসী ত্রিশ কোটি হিন্দু। সুপ্রাচীন সভ্য আর্যজাতির অংশ তারা। মাত্র আট বছর আগেও এরা দীর্ঘ দুইটি হাজার বছর ধরিয়া এই উপমহাদেশের বেশির ভাগের উপর সগৌরবে অখণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করিয়াছে। এই মুদতে তারা বেদ-বেদাংগ উপনিষদ-ষড়দর্শনের মত মননশীল সাহিত্য, রামায়ণ মহাভারতের মত মহাকাব্য, শকুন্তলার মত রম্যকাব্য, মনু-সংহিতার মত আইন শা, চরক-সতের মত চিকিৎসাবিজ্ঞান রচনা ও গণিতশাস্ত্র ও জ্যোতিষী-বিদ্যা আবিষ্কার করিয়া তৎকালীন বিশ্বের চিন্তা-নায়ক রূপে স্বীকৃত ছিল। গৌতম বুদ্ধের মত ধর্মপ্রবর্তনের জন্ম তারাই দিয়াছিল। অশোক-চন্দ্রগুপ্ত-কনিক-বিক্রমাদিত্যের মত সাম্রাজ্য-নির্মাতা সুশাসক সৃষ্টি তারাই করিয়াছিল। এদের সত্যতা পশ্চিমে কাবুল-কান্দাহার ও পূর্বে মালয়-জাবা-সুমাত্রা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এমনি গৌরবমণ্ডিত এদের প্রাচীন ইতিহাস।

অপর দিকে, দেশের এক-চতুর্থাংশ অধিবাসী দশ কোটি মুসলমান। সংখ্যায় তুলনায় কম হইলেও ধর্মীয় ও সামাজিক সাম্যে যেথিত ঐক্যে শক্তিমান। মাত্র দেড়শ’ বছর আগে দীর্ঘ সাড়ে ছয়শ বছর ধরিয়া এরা গোটা উপমহাদেশে সগৌরবে প্রবল প্রতাপে শাসন করিয়াছে বিদেশী দখলকারী শক্তি হিসাবে নয়, দেশবাসী হিসাবে। এটা করিয়াছে তারা বিপ্লবাত্মক সাম্য-ভিত্তিক মানবাধিকারে নয়া জীবন-বাণীর পতাকাবাহী এক নবজাগ্রত বিশ্ব-মুসলিমের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে। নয়াযিন্দেগির এই পতাকাবাহীরা পুরা এক হাজার বছর ধরিয়া গোটা এশিয়া-আফ্রিকা ও ইউরোপের উপর অখণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করিয়াছে। বিজ্ঞান-দর্শন-সাহিত্যে শিল্পে স্থাপত্যে এরা সারা বিশ্বে সভ্যতার শিক্ষকতা করিয়াছে। এই উপমহাদেশকে এরা কৃষ্টি-শিলে, আটে-স্থপতিতে কাব্যে-সংগীতে তৎকালীন সভ্য জগতের শীর্ষ স্থানে উন্নীত করিয়াছে। গিয়াসুদ্দিন বুলবন, আলাউদ্দিন খিলজী, শেরশাহ, আকবর, শাহজাহান, আওরংজেব, হুসেন শাহ, ইলিয়াস শাহের মত সুশাসকের ও আমির খসরু-তানসেনের মত কবি-শিল্পীর জন্ম দিয়াছে এরাই। ইতিহাসের পাতা এদের এমনি উজ্জ্বল।

এরা উভয়ে আজ ইংরেজের পদানত সত্য, কিন্তু পুনরুজ্জীবনের স্বপ্নে পুনর্জাগরণের উদ্যমে উভয়েই তন্ময় ও উদ্দীপ্ত। এক দিকে হিন্দুরা উনিশ শতকের ইউরোপের নবজাগরণের আলোকচ্ছটায় জাগ্রত, রাজা রাম মোহন রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ ও দয়ানন্দের অনুপ্রেরণায় ধর্মীয় রিভাইভ্যালের উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত, বংকিম-রবীন্দ্রনাথের প্রেরণায় ইউরোপীয় আট-সাহিত্যে নব-দীক্ষিত, নওরোজী গোখেল-তিলক-সুরেন্দ্রনাথ-চিত্তরঞ্জন-গান্ধী-নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার বাণীতে উদ্বুদ্ধ; স্বাধীকার প্রতিষ্ঠায় প্রাণ বিসর্জন দিতে এদের হাজার হাজার তরুণ প্রস্তুত। যে-কোনও প্রতিবন্ধক নির্মূল করিতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

মুসলমানরাও আজ জাগ্রত। শাহ উয়ালি উল্লা-সৈয়দ আহমদ শহীদ-সার সৈয়দের শিক্ষায় তারা অনুপ্রাণিত। ওহাবী বিপ্লব, সিপাহী যুদ্ধ ও খিলাফত-আন্দোলনের মধ্যে তাদের আত্ম-প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্প পরিস্ফুট।

এই নব জাগ্রত, নয়া জীবন-বাণীতে প্রবুদ্ধ, দুই মহাজাতি স্বভাবতঃই যার তার পূর্ব-গৌরবের স্বর্ণ-স্মৃতির দিকেই তাকাইয়া আছে। যার-তার সেই ঐতিহ্যের রেনেসাঁতেই তাদের ভবিষ্যৎ মুক্তি ও উন্নতি নিহিত, এই সত্য স্বভাবতঃই তারা উপলব্ধি করিয়াছে। এ উপলব্ধি লজ্জার নয় গৌরবের। কাজেই তাতে প্রতিবন্ধকতা করা সম্ভবও ছিল না, উচিতও হইত না। বিজ্ঞানোন্বত বিশ শতকের বিশ্বব্যাপী নব চেতনায় উদ্বুদ্ধ নব্য-হিন্দুত্ব স্বাধীন ভারতের মানস-সরোবরে একটি ফুটনোম্মুখ পদ্মফুল। ঐ একই চেতনায় প্রবুদ্ধ বিশ্ব-মুসলিমের অবিচ্ছেদ্য অংশ রেনেসাঁর আযানে উদ্দীপিত ভারতীয় ইসলামী জাগরণ মুসলিম-তারতের গুলবাগিচায় একটি ফুটনোখ গোলাপ। উভয়টাই গণতন্ত্রের শুভ বাণী। বিশ্ব সভ্যতার নবীন রূপে অবদান করিবার মত সম্ভাবনা উভয়ের মধ্যেই প্রচুর। অতএব একদিকে অখণ্ড ভারতের মাথা-গুনতির একঢালা গণতান্ত্রিক মেজরিটি শাসনের বিশ্বভারতীর নামে। ইফুটনোম্মুখ গোলাপ ফুল, অপর দিকে প্যান-ইসলামিক বিশ্ব-মুসলিম হেগিমনির নামে ঐ ফুটনোম্মুখ পদ্মফুল, নিষ্পেষিত করার চেষ্টা সফলও হইত না; বিশ্ব মানবের জন্য সাধারণভাবে, ভারতবাসীর জন্য বিশেষভাবে, কল্যাণকরও হইত না।

তাই মানবকল্যাণের স্বর্গীয় ইংগিতে-অনুপ্রেরিত মহান নেতৃদ্বয় মহাত্মা গান্ধী ও কায়েদে-আযম জিন্না তাঁদের সুযোগ্য দূরদশী সহকর্মীদের সহযোগিতায় এই মহাভারতে দুইটি মহান আদর্শকেই স্বাধীনভাবে মানবকল্যাণে আত্মনিয়োগ করিবার স্থান করিয়া দিয়াছেন। ইহাই দেশ-বিভাগের মূল কথা। এটাই নয়া দুনিয়ার ‘পিসফুল কো-একযিস্টেসের’ শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের জীবন-বাণী। এটাই স্পিরিট–অব-পার্টিশন।

এইভাবে একটা হিন্দু-প্রধান ও একটা মুসলিম-প্রধান রাষ্ট্র কায়েম হইল বটে, কিন্তু উভয় পক্ষ হইতে একত্রে এবং পৃথকভাবে ঘোষণা করা হইল : ‘হিন্দু মুসলমান কংগ্রেসী-মুসলিম লীগার যে-যেখানে আছে, সেইখানেই থাকিয়া যাও।’ এ কথার সোজা অর্থ এই যে দুইটা রাষ্ট্র হইল বটে, কিন্তু উভয়টাতে হিন্দু-মুসলমানের সমান অধিকার। আরও সোজা কথায়, দুইটার একটাও শুধু হিন্দুর দেশও নয়, শুধু মুসলমানের দেশও নয়। দুইটাই আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশ।

৬. সমাধান হিসাবে

এইভাবে নেতারা যে দুইটা রাষ্ট্র সৃষ্টি করিয়াছিলেন, স্পষ্টতঃই তা ছিল হিন্দু মুসলিম সমস্যার মীমাংসা হিসাবেই। হিন্দু-মুসলিম সমস্যার সমাধানের একশ একটা উপায় ছিল। সে সব পন্থায় সমাধানের চেষ্টাও বছরের পর বছর ধরিয়া চলিয়াছিল। অবশেষে ‘দুই রাষ্ট্র’ পন্থাটাই নেতাদের কাছে উভয় জাতির কাছে, গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হইয়াছিল। তাই তাঁরা টেবিলে বসিয়া এই সমাধান গ্রহণ করিয়াছিলেন। সমাধানটা বাস্তবানুগ যেমন হইয়াছিল, অভিজ্ঞতার দ্বারা তেমনি ইহা সমর্থিতও হইয়াছিল। এটা যেন রাষ্ট্রনেতাদের জন্য ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের সম্প্রসারণ। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে বাংলার মুসলমানরা ও বিহারের হিন্দুরা গবর্নমেন্ট চালাইয়াছে। তাই বলিয়া বাংলার হিন্দুরা ও বিহারের মুসলমানরা যার-তার অধিকার হারায় নাই। এই নযিরে স্বায়ত্তশাসন প্রসারিত করিয়া ভারতে একটা হিন্দুস্থান একটা পাকিস্তান নামে দুইটা স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করিলে চলিবে নিশ্চয়ই।

কংগ্রেসের মতই মুসলিম লীগও দেশের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক শাসন চাহিয়াছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক স্বাধীন ভারতে স্বভাবতঃ এবং ন্যায়তঃ যে হিন্দু-মেজরিটি শাসন হইবে, এতে মুসলমানরা নিজেদেরে নিরাপদ মনে করিতে পারে নাই। তাই বলিয়া দেশপ্রেমিক স্বাধীনতাকামী মুসলমানরা হিন্দু-মেজরিটি শাসন এড়াইবার উদ্দেশ্যে ভারতের স্বাধীনতা ঠেকাইয়া রাখিতে ইংরাজকে সাহায্য করিতেও রাযী হয় নাই। এটাই জিন্না-নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য। তিনিই প্রথম হিন্দু ভাইকে বলিলেন : ‘চল, পৃথকভাবে তুমিও শাসন কর, আমিও শাসন করি।‘ ইংরাজকে তিনি বলিলেন : ‘ডিভাইড এণ্ড কুইট’। হিন্দু-নেতৃত্ব এতে রাযী হইলেন। ইংরাজ-সরকার তা মানিতে বাধ্য হইলেন। এরই ফলে বিনা-ব্রাদম-এওয়াজে দেশ ভাগ ও দুই রাষ্ট্র হইয়াছে। এটাই স্পিরিট-অব-পার্টিশন। আপোসে দুই রাষ্ট্র সৃষ্টিতে আসলে হিন্দু ও মুসলিম উভয় নেতৃত্বের জয়ই সূচিত হইয়াছে।

কিন্তু জনতার হৈ-চৈ-এর কানতালা-লাগা আবহাওয়ায় দুই পক্ষই পরে এটাকে যার-তার পরাজয় মনে করিলেন। হিন্দু-নেতৃত্ব তা করিলেন ভারত-মাতা দ্বিখণ্ডিত হওয়া মানিয়া নিতে হইল বলিয়া; মুসলিম নেতৃত্ব তা করিলেন ‘পোকায় খাওয়া কাটা-ছিঁড়া’ পাকিস্তান নিতে হইল বলিয়া। দুইপক্ষের চোখেই সেই যে ছানি পড়িল সেটা ভাল হওয়ার বদলে দিন-দিন বাড়িয়াই চলিল। মহান দুই জাতির পিতৃদ্বয়ের অকালমৃত্যুতে সে স্পিরিটের কথা নেতারা ভুলিয়া গেলেন। ফলে এই স্পিরিট কোথায় কিভাবে লংঘিত হইয়াছে এবং তার কি কি কুফল হইয়াছে, সে সব কথা যথাস্থানে বলা হইবে।

৭. পশ্চিমবাংলা সরকারের সুবুদ্ধি

এখানে স্পিরিট-অব-পার্টিশনের এত বিস্তারিত উল্লেখ প্রয়োজন হইয়াছে এই জন্য যে আলোচ্য মুদ্দতে আমার জ্ঞানের মধ্যে শুধু পশ্চিম-বাংলা সরকারই কাজে কর্মে এই স্পিরিট বজায় রাখিয়া চলিয়াছিলেন। এই স্পিরিটের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ দিক বাস্তু-ত্যাগ রোধ করা। অন্যান্য জায়গার মত দুই বাংলাতেও বাস্তু ত্যাগের হিড়িক চলিয়াছিল। ছয়-সাত বছর ধরিয়া যে প্রচার-প্রচারণা চলিয়াছিল, যেরূপ বিষাক্ত আবহাওয়া তাতে সৃষ্ট হইয়াছিল, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সে মনোভাবের যে বাস্তবরূপ দেখা দিয়াছিল, তার পরে শেষের ছয় মাসেই এই মহান স্পিরিট নেতৃবৃন্দ গ্রহণ করেন। কিন্তু গণ-মন এই স্পিরিট গ্রহণ করিতে পারে নাই স্বাভাবিক কারণেই। গণ-মনে এই উপলব্ধি ঘটাইবার জন্য প্রচুর ও ব্যাপক প্রচার-প্রপাগাণ্ডার দরকার ছিল। পশ্চিম-বাংলা সরকার ও জনাব শহীদ সুহরাওয়ার্দী এই মহান কাজটিই শুরু করিয়াছিলেন। ডাঃ প্রফুল্ল ঘোষ ও ডাঃ বিধান রায়ের প্রধান মন্ত্রিত্বের আমলে তাঁদের সহকর্মী মন্ত্রীদের সমবেত চেষ্টায় এই নীতিই চলিয়াছিল। আমাকে এবং অন্যান্য মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দকে তাঁরা সরকারী সাহায্যে সরকারী জীপ গাড়িতে পুলিশের সহযোগিতায় মুসলিম এলাকাসমূহে সফর করাইয়াছেন। কোনও কোনও স্থানে হিন্দু মন্ত্রী ও নেতারা আমাদের সাথে গিয়াছেন। সর্বত্র একই কথা বলা হইয়াছেঃ ‘এ দেশ আপনাদের। বা ত্যাগ করিবেন না। আপনাদের নিরাপত্তার সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করা হইয়াছে।

শহীদ সাহেবও ঠিক এই কাজটিই করিতেছিলেন। তিনি শুধু অল-ইণ্ডিয়া মুসলিম কভেনশন ডাকিয়া এই বাণীই প্রচার করেন নাই। তিনি শুধু মাইনরিটি চার্টার রচনা করিয়া উভয় সরকারের তাতে দস্তখত লইবার চেষ্টাই করেন নাই। তিনি শান্তি সেনা গঠন করিয়া উভয় বাংলায় ব্যাপক সফরের আয়োজনও করিয়াছিলেন। তিনি প্রথমে পূর্ব-বাংলা সফরে আসেন। এর অপরিহার্য আশু কারণ ছিল। পূর্ব বাংলার হিন্দুদের মধ্যেই বাস্তু-ত্যাগের হিড়িক পড়িয়াছিল বেশি। এটা ঠেকাইতে না পারিলে এই সব বাস্তুত্যাগীর চাপে পশ্চিম বাংলার মুসলমানদের জীবন অতিষ্ঠ হইয়া পড়িবার সম্ভাবনা ছিল। এই হিড়িক কমাইবার জন্যই পূর্ব-বাংলার হিন্দুদের ত্রাসের ভাব দূর করার ও নিরাপত্তা-বোধ সৃষ্টি করার দরকার ছিল। অবস্থা-গতিকে পূর্ব-বাংলার হিন্দুরা কেবল হিন্দু নেতৃবৃন্দের মুখের কথাতেই তেমন সান্ত্বনা পাইতে পারিত। সেজন্য শহীদ সাহেব তার শাস্তি সেনায় দেবতোষ দাশগুপ্ত, দেব নাথ সেন, সুব্রত রায় প্রভৃতির মত জনপ্রিয় হিন্দু নেতাদেরে লইয়াই শান্তিবাহিনী গঠন করিয়াছিলেন। একটু ধীরভাবে তলাইয়া বিচার করিলেই দেখা যাইবে, এটা পশ্চিমবাংলা বা ভারতের চেয়ে পূর্ব-বাংলা বা পাকিস্তানের জন্যই বেশি আবশ্যক ও উপকারী ছিল। মোহাজের সমস্যাটা শুধু আশ্রয়দাতা রাষ্ট্রের জন্য একটা অর্থনৈতিক বোঝা এবং পুনর্বাসনের রাজনীতির পাশবর বিপুল দায়িত্বই নয়। মোহাজের মোহাজের বাড়ায়। এক দেশ হইতে বাস্তু-ত্যাগী আসিয়া অপর দেশে বাস্তু-ত্যাগী বানায়। বাস্তু-ত্যাগীদের সত্য-সত্যই অনেক অভিযোগ থাকে বটে, কিন্তু নিজেদের বাস্তু-ত্যাগ জাস্টিফাই করিবার উদ্দেশ্যে তারা অনেক মিথ্যা গুজব ও গালগল্পও তৈয়ার করে। ফলে মোহাজের-অধ্যুষিত অঞ্চলেই সাম্প্রদায়িক তিক্ততা চরমে উঠে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব দাঙ্গা উস্কানীমূলক একতরফা হয়। মোহাজেররাই উভয় বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বেশির ভাগ ঘটাইয়াছিল, এটা আজ সাধারণ অভিজ্ঞতা।

মোহাজের-পুনর্বাসন-সমস্যা পশ্চিম বাংলা বা ভারতের চেয়ে পূর্ব-বাংলা বা পাকিস্তানের জন্য অধিকতর বিপজ্জনক গুরুত্ব সমস্যা, এটা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের কথা। পাকিস্তান নয়া রাষ্ট্র। অর্থনীতি ও শাসনযন্ত্র সকল ব্যাপারেই তাকে একেবারে শুরু হইতে শুরু করিতে হইতেছিল। তার উপর পূর্ব-বাংলা ঘনবসতিপূর্ণ ক্ষুদ্র ভৌগোলিক ইউনিট। পূর্ব-বাংলার এক কোটি হিন্দুর সব তাড়াইয়াও পশ্চিম বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা ও বিহারের আড়াই কোটি মুসলমানের স্থান হইবে না। আর এদের পুনর্বাসনের ত কথাই উঠে না। সাত কোটি (তৎকালে) লোকের দেশ পাকিস্তান ভারতে-ফেলিয়া-আসা চারকোটি মুসলমানকে জায়গা দিতে পারিবে না। অথচ পাকিস্তানের দেড়কোটি হিন্দুর স্থান করা বিশাল ভারতের জন্য মোটেই কঠিন ছিল না। বাস্তু-ত্যাগের আনুষংগিক অমানুষিক দুরবস্থা ছাড়াই এটা তার বাস্তব ভয়াবহ দিক। এইজন্য পাকিস্তানের পক্ষে বাস্তু-ত্যাগ এড়ানো ছিল বেশি প্রয়োজন। এ কাজটিতেই শহীদ সাহেব তাই আগে হাত দিয়াছিলেন। তিনি পশ্চিম-বাংলার গবর্নর ডাঃ কাটজু ও প্রধানমন্ত্রী ডাঃ প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষকে এই কারণেই পূর্ব-বাংলা সফরে অনুপ্রাণিত করিয়াছিলেন। পূর্ববাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাযিমুদ্দিন ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে দিয়া পশ্চিমবাংলা সফরের আয়োজনও তিনি করিতেছিলেন।

৮. পূর্ব-বাংলা সরকারের কুযুক্তি

কিন্তু পূর্ব-বাংলা সরকার শহীদ সাহেবকে ভুল বুঝিয়াছিলেন। শহীদ সাহেবের মত জনপ্রিয় নেতা পূর্ব-বাংলা সফর করিলে তৎকালীন রাষ্ট্র নায়কদের অসুবিধা হইবে, এটা ছিল তাঁদের মনের ভিতরের কথা। কিন্তু তাঁরা প্রকাশ্যভাবে যে কথাটা বলিলেন, সেটাও ছিল ভুল। তাঁরা বলিলেন : শান্তি-সেনা লইয়া শহীদ সাহেবের পূর্ব বাংলা সফরের তাৎপর্য হইবে এই যে, পূর্ব-বাংলাতেই সাম্প্রদায়িক অশাস্তি ও দাঙ্গা। চলিতেছে বেশি। এতে পূর্ব-বাংলা সরকারের তথা পাকিস্তান সরকারের বদনাম হইবে। কথাটা স্থূল দৃষ্টিতে এবং আপাতঃদৃষ্টিতেই সত্য। আসলে সত্য নয়। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে পূর্ব-বাংলায় অন্যান্য স্থানের তুলনায় সাম্প্রদায়িক দাংগা খুবই কম হইয়াছিল। এরূপ হয় নাই বলিলেও চলে। কিন্তু একটু তলাইয়া দেখিলেই বোঝা যাইবে যে পূর্ব-বাংলার হিন্দুদের মধ্যে বাস্তু-ত্যাগের হিড়িক পড়িয়াছিল। সাম্প্রদায়িক দাংগার ভয়ে নয়। অন্য কারণে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়ক ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের অন্তঃসারশূন্য ইসলামী রাষ্ট্র ও শরিয়তী শাসনের শ্লোগানে হিন্দুরা সত্যই ঘাবড়াইয়াছিল। জানের ভয়ে নয় মানের ভয়ে। ধর্ম ও কালচার হারাইবার ভয়ে। অর্ধশতাব্দী ধরিয়া যে হিন্দুরা দেশের আযাদির জন্য জান-মাল কোরবানি করিয়াছে, স্বাধীন হওয়ার পর তারাই নিজের ধর্ম ও কৃষ্টি-সংস্কৃতি লইয়া সসম্মানে দেশে বাস করিতে পারিবে না, এটা মনের দিক হইতে ছিল তাদের জন্য দুঃসহ। হিন্দু সভা ও জন-সংঘের হিন্দুরাজ ও শুদ্ধির শ্লোগান তারতীয় মুসলমানদের মনে যে স্বাভাবিক ত্রাসের সৃষ্টি করিয়াছিল পাকিস্তানের হিন্দুদের মনেও গোড়ার দিকে এমনি ত্রাসের সঞ্চার হইয়াছিল। এটা দূর করিয়া তাদের মধ্যে নিরাপত্তা বোধ সৃষ্টি করাই ছিল তৎকালীন আশু কর্তব্য। পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়করা শুধুমাত্র দাংগা-হাংগামাহীন শান্তি স্থাপন করিয়াই মনে করিয়াছিলেন তাঁদের কর্তব্য শেষ হইল। হিন্দু-মনে নৈতিক শান্তি আনিবার কোনও চেষ্টাই তাঁরা করেন নাই। একদিকে তাঁদের এই কাজ, অপর দিকে ভারতে প্যাটেলী মনোভাব ও নীতি উভয় দেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিকে জটিলতর করিয়া কিভাবে স্পিরিট-অব-পার্টিশনকে ব্যর্থ করিয়া দিয়াছে এটা পরবর্তী কালের ইতিহাস। এইভাবে স্পিরিট-অব-পার্টিশনকে ব্যর্থ করিয়া প্রকারান্তরে সাম্প্রদায়িক সমস্যাটিকে আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসাবে অধিকতর শক্তিশালী করিয়া জিয়াইয়া না রাখিলে শিল্প-বাণিজ্য, কৃষি-সেচ যোগাযোগ ও যাতায়াত-ব্যবস্থায় উভয় দেশকে অর্থনৈতিক দিকে কত উন্নত করা যাইত, এই বিশ বছরে সে কথা দুই দেশের বর্তমান নেতারা বুঝিতে না পারিলেও তাঁদের ভবিষ্যৎ বংশধরেরা বুঝিতে পারিবে নিশ্চয়ই।

৯. আওয়ামী লীগের আবির্ভাব

এই মুদ্দতের অপর দুইটি বিশেষ ঘটনার একটি পূর্ব-বাংলায় ‘জনগণের মুসলিম লীগ’ অর্থাৎ আওয়ামী মুসলিম লীগের পত্তন। দ্বিতীয়টি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির উন্মেষ। দুইটাই রাষ্ট্রনায়কদের ভ্রান্ত নীতির ফলে ত্বরান্বিত হইয়াছিল। বংগীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিল ভাংগিয়া দিয়া সরকার-সমর্থকদের দিয়া এড-হক কমিটি গঠন করা হয়। এইভাবে জাতীয় প্রতিষ্ঠানের দরজা জনসাধারণের মুখের উপর বন্ধ করিয়া দেওয়ায় মুসলিম লীগ-কর্মীদের সামনে আর কোনও পথ খোলা থাকে নাই। তাই তারা জনগণের মুসলিম লীগ গঠন করিয়াছিল। এটা অবশ্য পরিণামে ভালই হইয়াছিল। ছাত্র-কর্মী ও জনগণের সাহায্যপুষ্ট মুসলিম লীগ দেশ শাসনের সুবিধা পাইলে পাকিস্তানের একদলীয় শাসন কায়েম হইয়া যাইত। সাত বছরের মধ্যে ১৯৫৪ সালে যেভাবে মুসলিম লীগের পতন ঘটিয়াছিল, সে অবস্থায় ওটা হইতে পারিনা।

১০. রাষ্ট্র-ভাষা দাবি

দ্বিতীয় ঘটনা রাষ্ট্র ভাষার দাবি উত্থাপন। এটা লক্ষণীয় যে গৌড়াতে বাংলার দাবি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার দাবি ছিল না। সে দাবি ছিল বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারী ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার দাবি। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে কায়েদে-আযম পাকিস্তানের গভর্নর-জেনারেল হিসাবে পূর্ব-বাংলার সর্বপ্রথম সফরেই বলিয়া বসেন : ‘কেবল একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে’। এতেই ব্যাপারটা জটিল আকার ধারণ করে। পূর্ব-বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাযিমুদ্দিন একটা আপোস করেন। কিন্তু কায়েদে আযমের মৃত্যুর পর তিনিই গভর্নর-জেনারেল হইয়া উন্টা মারেন। এটা না ঘটিলে কি হইত? বাংলাকে পূর্ব-বাংলার সরকারী ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করিলে এবং সম্ভব-মত উর্দুকেও পশ্চিম পাকিস্তানে ঐ স্থান দেওয়ার চেষ্টা করিলে ইংরাজী যথাস্থানে বর্তমানের মতই আসল রাষ্ট্র ভাষা এবং দুই পাকিস্তানের যোগাযোগের ভাষা থাকিয়া যাইত। বাংলা ও উর্দু ভাষা দুই অঞ্চলের সরকারী ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে প্রভূত উন্নতি করিয়া জাতীয় ভাষায় পরিণত হইত। ‘রাষ্ট্র ভাষা’ কথাটা চাপাই পড়িয়া থাকিত। রাষ্ট্রনায়কদের ভূলে অকালে রাষ্ট্র ভাষার কথাটা উঠিয়া না হক মারামারি খুনাখুনি হইয়াছে। এটাও অবশ্য একদিকে ভালই হইয়াছে। রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নটা চিরকালের জন্য ফয়সালা হইয়া গিয়াছে। এখন অতি ধীরে ধীরে বাংলা ও উর্দুকে সরকারী ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার যে শকগতির নীতি চলিতেছে, এটাও আর বেশি দিন চলিবে না বলিয়া আশা করা যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *