খিলাফত ও অসহযোগ
দুসরা অধ্যায়
১. রাজনীতির পট-ভূমি
আমাদের বাদশাহি ফিরিংগিরা কাড়িয়া নিয়াছে, এই খবরে আমার মনে ফিরিংগি বিদ্বেষ জন্যে বোধহয় আমার জ্ঞানোদয়ের দিন হইতেই। কিন্তু চাচাজী ও দু-চার জন জেহাদী মৌলবীর প্রভাবে কৈশোরে ফিরিংগি বিদ্বেষের জায়গা দখল করে শিখ-বিদ্বেষ। এই শিখ-বিদ্বেষ ইংরাজের প্রতি আমার মন বেশ খানিকটা নরম করিয়া ফেলে।
এই নরম ভাব কয়েকদিন পরেই আবার গরম হইয়া ইংরাজ-বিদ্বেষ দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠে। আমি তখন দরিরামপুর মাইনর স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। এই সময় ঢাকা বিভাগের স্কুল ইন্সপেক্টর মিঃ স্টেপটন আমাদের স্কুল পরিদর্শন করিতে আসেন। কয়েকদিন আগে হইতেই আমরা স্কুল ঘর ও আংগিনা সাজানোর ব্যাপারে পরম উৎসাহে খাঁটিতেছিলাম। নির্দিষ্ট দিনে সাধ্যমত পনির জামা কাপড় পরিয়া পরম আগ্রহে এই ইংরাজ রাজপুরুষকে দেখিবার জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। একজন শিক্ষকের সেনাপতিত্বে কুইক মার্চ করিয়া খানিকদূর আগবাড়িয়া গেলাম সাহেবকে ইস্তোল করিতে। জীবনের প্রথম এই ‘সাহেব’ দেখিতেছি। নূতন দেখার সম্ভাবনার পুলকে গরম রোমাঞ্চ হইতে লাগিল।
শেষ পর্যন্ত সাহেব আসিলেন। হাঁ সাহেব বটে। উঁচায় ছয় ফুটের বেশী। লাল টকটকা মুখের চেহারা। আমার খুব পছন্দ হইল। মাস্টার সেনাপতির নির্দেশে সোৎসাহে সেলিউট করিলাম। সাহেবের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বাড়িয়া মমতায় পরিণত হইল সাহেবের সংগীটিকে দেখিয়া। সাহেবের সংগীটি একজন আলেম। তার মাথায় পাগড়ি, মুখে চাপ দাড়ি, পরনে সাদা আচকান ও সাদা চুড়িদার পায়জামা। সাহেব যখন সাথে আলেম নিয়া চলেন, তখন নিশ্চয়ই তিনি মনে মনে মুসলমান। আমি ভক্তিতে গদগদ হইলাম। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার তুল ভাংগিল। আমাদের স্কুলের সেকেন্ড পন্ডিত জনাব খিদিরুদ্দিন খাঁ সাহেবের নিকট নিলাম, লোকটা কোনও আলেম-টালেম নয়, সাহেবের চাপরাশী। শিক্ষক না হইয়া অন্য কেউ একথা বলিলে বিশ্বাস করিতাম না। তাছাড়া পভিত সাহেব আমাকে বুঝাইবার জন্য লোকটার কোমরের পেটি ও বুকের তকমা দেখাইলেন। আমার মাথায় আগুন চড়িল। স্টেপল্টন সাহেবের উপর ব্যক্তিগতভাবে এবং ইংরাজদের উপর জাতিগতভাবে আমি চটিয়া গেলাম। অদেখা শিখ-বিদ্বেষের যে ছাই-এ আমার ফিরিংগি-বিদ্বেষের আগুন চাপা ছিল, চোখের-দেখা অভিজ্ঞতার তুফানে সে ছাই উড়িয়া গেল। আমার ইংরেজী-বিদ্বেষ দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। শালা ইংরাজরা আমাদের বাদশাহি নিয়াও ক্ষান্ত হয় নাই। আমাদের আরও অপমান করিবার মতলবে আমাদের পোশাককে তাদের চাপরাশীর পোশাক বানাইয়াছে! এর প্রতিশোধ নিতেই হইবে। আমি তৎক্ষণাৎ ঠিক করিয়া ফেলিলাম, বড় বিদ্বান হইয়া ইনস্পেক্টর অফিসার হইব। নিজে আচকান পায়জামা-পাগড়ি পরিব এবং নিজের চাপশারীকে কোট-প্যান্ট-হ্যাট পরাইব।
এর পর-পরই আরেকটা ঘটনা আমার ইংরাজ-বিদ্বেষে ইন্ধন যোগাইল। আমাদের স্কুলের খুব কাছেই ত্রিশাল বাজারে এক সভা। শহর হইতে আসেন বড় বড় বক্তা। আমাদের শিক্ষক খিদিরুদ্দিন খাঁ পন্ডিত সাহেবের নেতৃত্বে আমরা ভলান্টিয়ার। বক্তাদের মুখে শুনিলাম, ইটালি নামক এক দেশের রাজা আমাদের খলিফা তুরস্কের সুলতানের ত্রিপলি নামক এক রাজ্য আক্রমণ করিয়াছেন। কথাটা বিশ্বাস হইল না। কারণ ইটালির রাজার রাজধানী শুনিলাম নোম। রোমের বাদশাহ তুরস্কের সোলতানের রাজ্য দখল করিতে চান? এটা কেমন করিয়া সম্ভব? দুই জন ত একই ব্যক্তি! মাথায় বিষম গন্ডগোল বাধিল। সেটা না থামিতেই আরেকটা। সভায় যখন রুমী টুটি পোড়াইবার আয়োজন হইল, তখন টুপির বদলে আমার মাথার আগুন ধরিয়া গেল। প্রথম কারণ বহুদিন ধরিয়া আমি একটি লাল রুমী টুপি ব্যবহার করিয়া আসিতেছি। এটি আমার টুপি না, কলিজার টুকরা। দ্বিতীয় কারণ আমার বিশ্বাস, এই টুপি খলিফার দেশেই তৈয়ার হয়। বক্তাদের জ্বালাময়ী বক্তৃতায় উদ্দীপ্ত ও উন্মত্ত ছাত্র বন্ধুরা যখন রুমী টুপি পোড়ইতে লাগিল এবং তাদের চাপে শেষ পর্যন্ত আমি যখন আমার বহুদিনের সাথী সেই রুমী টুপিটাকে আগুনে নিক্ষেপ করিলাম, তখন আমার মনে হইল নমরুদ বাদশাহ যেন ইব্রাহিম নবিকে আগুনের কুন্ডে ফেলিয়া দিলেন। ইব্রাহিম নবির কথা মনে পড়িতেই আমার অবস্থাও তাঁর মত হইল। ইব্রাহিম নবি যেমন নিজের জানের টুকরা পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি করিয়াছিলেন, আমিও যেন আজ আমার কলিজার টুকরা লাল কুমী টুপিটাকে তেমনি নিজ হাতে কোরবানি করিলাম। বেশ-কম শুধু এই : জিবরাইল ফেরেশতরা বেহেশতী দুম্বা বদলা দিয়া ইসমাইলকে বাঁচাইলেন, কিন্তু আমার রুমী টুপিটার বদলা দিয়া কেউ এটা বাঁচাইল না। দুঃখে ক্ষোভে আমার চোখে পানি আসিল। আমার কলিজার টু লাল রুমী টুপিটা পোড়াইবার জন্য দায়ী কে? এই ইটালি। ইটালি কে? খৃষ্টানত? নিশ্চয়ই ইংরাজ। ইংরাজের প্রতি, বিশেষ করিয়া তাদের পোশাকের প্রতি, আমার রাগ দ্বিগুণ বাড়িয়া গেল।
২. পরস্পরবিরোধী চিন্তা
আমার ইংরাজ-বিদ্বেষটায় কোন স্পষ্টতা ছিল না। সে জন্য এটা বড় ঘন-ঘন উঠা-নামা করিত। অনেক সময় আমি ইংরাজের সমর্থক হইয়া উঠিলাম। উদাহরণ ‘স্বদেশী’ ব্যাপারটা। পাঠশালায় ঢুকিয়াই (১৯০৬) স্বদেশী কথাটা শুনি। মানে বুঝিয়াছিলাম কাঁচা রং পাড়ের কাপড় পরা। পাঠশালার মাস্টার মশায় ছিলেন হিন্দু। তিনি আমাদের স্বদেশী কাপড় পরিতে বলিতেন, কাপড়ের কাঁচা রং উঠিয়া যায় বলিয়া দুই-একবারের বেশি তা পরি নাই। স্বদেশী অর্থ আর কিছু তিনি তা বলেন নাই। আগের বছর ১৯০৫ সালে বড় লাট লর্ড কার্যন ময়মনসিংহে আসেন। মুরুব্বিদের সাথে লাট-দর্শনে যাই। রাস্তার গাছে-গাছে বাড়ি-ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে ইংরাজীতে লেখা দেখি : ‘ডিভাইড আস্ নট’। মুরুব্বিদেরে জিগাসা করিয়া জানিতে পারি ওসব ‘স্বদেশী’ হিন্দুদের কান্ড। মুসলমানদের খেলাফে দুশমনি। এই দুশমনিটা কি, ঘরে ফিরিয়া পরে চাচাজীর কাছে পুছ করিয়াছিলাম। তিনি ব্যাপারটা আমাদের বুঝাইবার জন্য যে সব কথা বলিয়াছিলেন, তার কিছুই তৎকালে বুঝি নাই। তবে সে সব কথার মধ্যে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ, ঢাকা রাজধানী, বাংলা ও আসাম এই কয়টা শব্দই শুধু আমার মনে ছিল। ‘স্বদেশীরা’ তবে মুসলমানদের দুশমন? ভাবনায় পড়িলাম। দরিরামপুর মাইনর স্কুলে ভর্তি হওয়ার (১৯০৯) অল্পদিন পরেই দেখিলাম, একজন ভাল মাস্টার হঠাৎ বিদায় হইলেন। খোঁজ লইয়া জানিলাম, লোকটা তলে-তলে স্বদেশী বলিয়া তাকে তাড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। আর সন্দেহ রইল না যে ‘স্বদেশী’ হওয়াটা দোষের।
এর পর-পরই ঘটে স্টেপলটন সাহেবের ঘটনাটা। ইংরাজের উপর ঐ রাগের সময়েই আমি জানিতে পারি ‘স্বদেশীরা’ ইংরাজের দুশমন। ‘স্বদেশীর’ প্রতি আমার টান হইল। তারপর যখন ইটালি, মানে ইংরাজ, আমাদের খালিফার দেশ ত্রিপলি হামলা করিল, তখন ইংরাজ-বিদ্বেষ বাড়ার সাথে আমার স্বদেশী-প্রীতিও বাড়িল। ১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাসে সম্রাট পঞ্চম জর্জের দিল্লী দরবার উপলক্ষে স্কুলের সবচেয়ে ভাল ছাত্র হিসাবে আমাকে অনেকগুলি ইংরাজী ও খানকতক বাংলা বই প্রাইয দেওয়া হয়। সে কালের তুলনায় এক স্তূপ বই। বইগুলি দুই বগলে লইয়া যখন বাড়ি ফিরিতেছিলাম তখন আতিকুল্লা নামে আমার এক বয়োজ্যেষ্ঠ মাদ্রাসার ছাত্রবন্ধু আমার প্রতি চোখ রাংগাইয়া বলিয়াছিলেন : ‘আজ মুসলমানের মাতমের দিন। ফিরিংগিরা আমাদের গলা কাটিয়াছে। তুমি কি না সেই ফিরিংগির-দেওয়া প্রাইয লইয়া হাসি-মুখে বাড়ি ফিরিতেছ?’
আমি প্রথমে মনে করিয়াছিলাম, আমার অতগুলি বই দেখিয়া বন্ধুর ঈর্ষা হইয়াছে। পরে যখন তিনি বুঝাইয়া দিলেন, ইংরাজ ‘স্বদেশী’দের কোথায় বংগ-ভংগ বাতিল করিয়াছে এবং তাতে মুসলমানদের সর্বনাশ হইয়াছে, তখন আমার ভূল ভাংগিল। বন্ধুবর আতিকুল্লা ছিলেন আমাদের সকলের বিবেচনায় একটি খবরের গেযেট, জ্ঞানের খনি। তিনি আমাকে পূর্ব-বাংলা ও আসাম প্রদেশ, রাজধানী ঢাকা ও মুসলমানদের কর্তৃত্বের কথা সবিস্তারে বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন। স্বদেশীরা কি কারণে এই নয়া প্রদেশ বাতিল করিবার আনোলন করিয়াছে, সে আন্দোলন সফল হওয়ায় আজ মুসলমানদের কি সর্বনাশ হইল, চোখে আংগুল দিয়া তা আমাকে বুঝাইয়া দিলেন। তিন বছর আগে চাচাজী যা-যা বলিয়াছিলেন, সে সব কথাও এখন আমার মনে পড়িল। তাঁরও কোনও-কোনও কথা আজ বুঝিতে পারিলাম। আতিক ভাই এইভাবে সব বুঝাইয়া দেওয়ায় ইংরাজের প্রতি বিদ্বেষ ত বাড়িলই, ‘স্বদেশী’র প্রতি আরও বেশি বাড়িল। আচকান পাগড়ির প্রতি স্টেপটন সাহেবের অপমান, ইটালি কর্তৃক আমার লাল রুমী টুপির সর্বনাশ, সব কথা এক সংগে মনে পড়িয়া গেল। ইংরাজী পোশাকের উপর আমার রাগ দশগুণ বাড়িয়া গেল। ইংরাজের দেওয়া পুস্তকগুলি কিন্তু ফেলিয়া দিলাম না।
ইংরাজী পোশাকের প্রতি এই বিদ্বেষ কালে ইংরাজী ভাষার উপর ছড়াইয়া পড়িল। মাইনর পাস করিয়া শহরের হাইস্কুলে ভর্তি হইয়া দেখিলাম, অবাক কান্ড। কি শরমের কথা! মাস্টার মশায়রা ক্লাসে ইংরাজীতে কথা কন। উকিল-
মোর হাকিমরা কোটে ইংরাজীতে বক্তৃতা করেন। শিক্ষিত লোক রাস্তা-ঘাটে পর্যন্ত ইংরাজীতে আলাপ করেন। যাঁরা বাংলাতে কথা বলেন তারাও তাঁদের কথা-বার্তায় প্রচুর ইংরাজী শব্দ ব্যবহার করিয়া থাকেন। এটাকে আমি মাতৃভাষা বাংলার অপমান মনে করিলাম। ইহার প্রতিবাদে শামসুদ্দিনসহ আমরা কতিপয় বন্ধু ও সহপাঠী মিলিয়া ইংরাজী শব্দের বিরুদ্ধে অভিযান চালাইলাম। ফুটবলকে ‘পদ-গোলক’ হইসেলকে ‘বাঁশি’ কম্পিটিশনকে ‘প্রতিযোগিতা’ ফিক্সচারকে ‘নির্ঘন্টপত্র’ রেফারিকে ‘মধ্যস্থ বা শালিস’ স্পোর্টসকে ‘খেলা বা ক্রীড়া’ লেসিং অলকে ‘ফিতা সুই’ লাইনসম্যানকে ‘সীমা নির্দেশক’ পুশকে ‘ধাক্কা’ অফসাইডকে ‘উল্টা দিক’ ইত্যাদি পরিভাষা প্রবর্তন করিয়া ফুটবল খেলার মাঠে সংস্কার আনিবার জোর চেষ্টা করিলাম। কিন্তু কাগজ-পত্র ছাড়া আর কোথায়ও ওসব পরিভাষার প্রচলন চেষ্টা সফল হইল না। তাছাড়া শুধু ফুটবলের ব্যাপারে সংস্কার প্রবর্তন হওয়ার দরুন আমাদের এই উদ্যম বিফল হইল।
৩. ধর্ম-চেতনা বনাম রাজনীতি-চেতনা
যা হোক, এই সংস্কার প্রচেষ্টায় মাতৃভাষার প্রতি টান ও ইংরাজীর প্রতি বিদ্বেষ যতটা ছিল রাজনৈতিক মতলব ততটা ছিল না। মুসলমানদের মধ্যে সাধারণভাবে এবং আমার মুরুব্বি ও চিনা-জানা মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা তখনও দানা বাঁধে নাই। ইতিমধ্যে আমরা অবশ্য ত্রিপলি লইয়া তুর্কী-ইতালির যুদ্ধে ইটালির বিপক্ষে আন্দোলন করিয়াছি। কিন্তু সে ব্যাপারেও আমার ধর্ম-প্রীতি যতটা ছিল রাজনৈতিক চেতনা ততটা ছিল না। তারপর শহরের হাইস্কুলে আসিয়া আমার ধর্ম চেতনাটা যেন এগ্রেসিত হইয়া উঠিল। এর কারণ ছিল। বংকিম চন্দ্রের লেখার সাথে পরিচিত হই এই সময়। প্রতিকূল অবস্থায় আমার রগ তেড়া হওয়াটা ছিল আমার একটা জন্মগত রোগ। অত প্রতাপশালী নায়েব মশায়কে তুই এর বদলা তুই বলা এই রোগেরই লক্ষণ। শহরে আসিয়া ঘটনাচক্রে ভর্তি হইলাম মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে। স্কুলটির পরিচালক হিন্দু। পঁয়ত্রিশ জন টিচারের মধ্যে পার্সিয়ান টিচারটি মাত্র মুসলমান। দেড় হাজার ছাত্রের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা তিন শর ও কম। স্কুলে ভর্তি হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে দুইটা টার্মিনাল পরীক্ষায় ফাস্ট-সেকেন্ড হইয়া শিক্ষকদের স্নেহ পাইলাম বটে, কিন্তু বদনামও কামাই করিলাম। একজন শিক্ষক ক্লাসে আমাকে ‘মিয়া সাব’ বলায় জবাবে আমি তাঁকে ‘বাবুজী’ বলিয়াছিলাম। স্কুলে হৈ চৈ পড়িয়া যায়। হেড মাস্টার শ্রীযুক্ত চিন্তা হরণ মজুমদারের কাছে বিচার যায়। বিচারে আমার জয় হয়। অতঃপর শিক্ষকরা ত নয়ই ছাত্ররাও মুসলমানদেরে ‘মিয়া সাব’ বলিয়া মুখ ভেংচাইতেন না। একদিন ছোট বাজার পোস্টাফিসে গেলাম পোস্ট কার্ড খরিদ করিতে। জানালায় কোন খোপ না থাকায় গরাদের ফাঁকে হাত ঢুকাইয়া পয়সা দিতে ও জিনিস নিতে হইত। আমি সেভাবে পয়সা দিলাম। পোস্ট মাস্টার হাতে পয়সা নিলেন ও কার্ড দিলেন। আমি অতিকষ্টে ডান হাত টানিয়া বাহির করিয়া তেমনি কষ্টে বাম হাত ঢুকাইয়া কার্ড নিলাম। পোস্ট মাস্টার বিস্ময়ে আমার এই পাগলামি দেখিলেন। একথাও স্কুলে রাষ্ট্র হইল।
এমনি দিনে একবার কথা উঠিল হিন্দু ছাত্রদের দুর্গা-সরস্বতী পূজার মত আমরা স্কুলে মিলাদ উৎসব করিব। শুনিলাম বহুদিন ধরিয়া মুসলিম ছাত্রদের এই দাবি স্কুল কর্তৃপক্ষ নামনযুর করিয়া আসিতেছেন। আমি ক্ষেপিয়া গেলাম। আগামী বকরিলে স্কুল আংগিনায় গরু কোরবানি করিব বলিয়া আন্দোলন শুরু করিলাম। এবার মিলাদের অনুমতি অতি সহজেই পাওয়া গেল। পরম ধুমধামের সাথে ঐ বারই প্রথম ‘হিন্দু স্কুলে’ মিলাদ হইল। শহরের মুসলিম নেতৃবৃন্দ ভাংগিয়া পড়িলেন। যথারীতি মিলাদের পরে আমি এক বাংলা প্রবন্ধ পড়িলাম। তাতে আরবী-উর্দুর বদলে বাংলায় মিলাদ পড়িবার প্রস্তাব দিলাম। মুসলমানদের মুখের অত তারিফ এক মুহূর্তে নিন্দায় পরিণত হইল। হিন্দুরা কিন্তু আমার তারিফ করিতে লাগিলেন। এই বিপদে আমাকে বাঁচাইলেন আনন্দ মোহন কলেজের আরবী-ফারসীর অধ্যাপক মওলানা ফয়যুর রহমান। পরের দিন অপর এক স্কুলের মিলাদ সভায় তিনি আমার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়া বাংলায় মিলাদ পড়াইবার প্রস্তাব সমর্থন করিলেন।
তারপর ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বাধিলে আমি মনে মনে ইংরাজের পক্ষ ইহলাম। ঐ সময় মিঃ এন. এন. ঘোষের ‘ইংল্যান্ডস ওয়ার্কস ইন ইন্ডিয়া’ নামক ইংরাজী বই আমাদের পাঠ্য ছিল। ইংরাজরা আমাদের দেশের কত উপকার ও উন্নতি বিধান করিয়াছে, ঐ বই পড়িয়া আমি তা বুঝিলাম। তাতে ইংরাজের প্রতি সদয় হইলাম।
কিন্তু বেশিদিন এভাব টিকে নাই। শিক্ষকদের প্রভাব ছাত্রদের উপর অবশ্যই পড়িয়া থাকে। এক আরবী-ফারসী শিক্ষক ছাড়া আমাদের স্কুলের পঁয়ত্রিশ জন শিক্ষকের সবাই হিন্দু। এঁরা প্রকাশ্য রাজনীতি না করিলেও কথা-বার্তায় ও চালে চলনে স্বদেশী ছিলেন। এঁদের দুই-তিন জনকে আমি খুবই ভক্তি করিতাম। এদের প্রভাব আমার মনের উপর ছিল অসামান্য। হঠাৎ একদিন একদল পুলিশ স্কুলে আসিয়া কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করিয়া নিল। এদের মধ্যে দুই-চারজন আমার সুপরিচিত। তাদের জন্য খুবই চিন্তিত ও দুঃখিত হইলাম। গ্রেফতারের কারণ খুজিলাম। ‘রাজবন্দী’, ‘অন্তরীণ’ ইত্যাদি শব্দ এই প্রথম শুনিলাম। কানে রাজনীতির বাতাস গেল। কিছু-কিছু আন্দায করিতে পারিলাম। ইংরেজের প্রতি বিদ্বেষ বাড়িল। যুদ্ধে জার্মানির জয় কামনা করিলাম। জার্মানির পক্ষে যাইবার একটা অতিরিক্ত কারণও ছিল। জার্মানির সম্রাটের উপাধি কাইযার। হাকিমভাই নামে এক ‘সবজান্তা’ বন্ধু আমাকে বলিয়াছিলেন এটা আরবী-ফারসী কায়সার শব্দের অপত্রংশ। শাহনামার কায়সার নিশ্চয়ই মুসলমান ছিলেন। সূতরাং জার্মান সম্রাটও আসলে মুসলমান এমন ধারণাও আমার হইয়া গেল। মুসলমান কায়সারকে খৃষ্টানী কাইসার বানাইবার মূলে নিশ্চয়ই ইংরাজের দুষ্ট মতলব আছে। আমরা মুসলমানরা যাতে জার্মানির পক্ষে না যাই সে জন্যই এই বদমায়েশি করিয়াছে। এই অবস্থায় যেদিন শুনিলাম তুর্কি সুলতান মুসলমানদের মহামান্য খলিফা জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে নামিয়াছেন, সেদিন এ ব্যাপারে আমার আর কোনই সন্দেহ থাকিল না। মুসলমানদের খলিফা মুসলিম বাদশা-কে সমর্থন করিবেন না? তবে কে করিবে? এর পরে সমস্ত ইচ্ছাশক্তি দিয়া জার্মানির জয় অর্থাৎ ইংরাজের পরাজয়ের জন্য মোনাজাত করিতে লাগিলাম।
৪. খিলাফত ও অসহযোগ
কিন্তু আমার মোনাজাত কবুল হইল না। অবশেষে ইংরাজই জয়ী হইল। তবে তাতে এটাও প্রমাণিত হইল যে ইংরাজের মত অতবড় দুশমন আর মুসলমানের নাই। এই সময়ে আমি ঢাকা কলেজে বি. এ. পড়ি। এস, এম, (সেক্রেটারিয়েট মুসলিম) হোস্টেলে (বর্তমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল) থাকি। খবরের কাগজ পড়ি। কমন-রুমে তর্ক-বিতর্ক করি। ল’কলেজের ছাত্র ইব্রাহিম সাহেব (পরে জজ, জাস্টিস, ভাইস চ্যান্সেলার ও মন্ত্রী) আমাদের নেতা।
১৯২০ সালে আহসান মনযিলে খেলাফত কনফারেন্স। তরুণ নবাব খাজা হবিবুল্লাহ অভ্যর্থনা-সমিতির চেয়ারম্যান। আলী ভাই, মওলানা আবুল কালাম আযাদ, মওলানা আযাদ সোবহানী, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মওলানা আকরম খাঁ, মৌঃ মুজিবুর রহমান প্রভৃতি দেশ-বিখ্যাত নেতা ও আলেম এই কনফারেন্সে যোগ দেন। ইব্রাহিম সাহেবের নেতৃত্বে আমরা ভলান্টিয়ার হই। তাঁরই বিশেষ দয়ায় আমি প্যান্ডেলের ভিতরে মোতায়েন হই। রাষ্ট্রামের কাছে দাঁড়াইয়া নেতাদের পানি ও চা দেওয়ার ফুট-ফরমায়েশ করাই আমার ডিউটি। তাতে সমাগত নেতাদের চেহারা দেখিবার এবং তাঁদের বক্তৃতা শুনিবার সৌভাগ্য আমার হয়। মওলানা মোঃ আকরম খাঁ ও মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ছাড়া আর সব নেতাই উর্দুতে বক্তৃতা করেন। মওলানা আযাদ ছাড়া আর সকলের বক্তৃতা সহজ উর্দুতে হইয়াছিল বলিয়া আমি মোটামুটি বুঝিতে পারিয়াছিলাম। কিন্তু মওলানা আযাদের ভাষা কঠিন হওয়ায় তাঁর অনেক কথাই বুঝি নাই। কিন্তু তাতে কোনই অসুবিধা হয় নাই। কারণ কথায় যা বুঝি নাই তাঁর জ্যোতির্ময় চোখ-মুখের ভংগিতে ও হস্ত সঞ্চালনের অপূর্ব কায়দায় তার চেয়ে অনেক বেশি বুঝিয়া ফেলি। ফলে কথা না বুঝিয়াও আমি মওলানা আমাদের একজন পরম ভক্ত হইয়া উঠি।
এ ঘটনার পর মাস খানেকের মধ্যে ঢাকায় দেশ-বিখ্যাত বহু নেতার শুভাগমন হয়। তন্মধ্যে মহাত্মা গান্ধী, মওলানা শওকত আলী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, বাবু বিপিন চন্দ্র পাল, মৌঃ ফযলুল হক, মিঃ আবুল কাসেম, মৌঃ ইসমাইল হোসেন সিরাজী প্রভৃতি নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেকালে আরমানিটোলা ময়দান ছাড়া করোনেশন পার্ক ও কুমারটুলির ময়দানেই মাত্র বড়-বড় জন-সভা করিবার জায়গা ছিল। আমরা ছাত্ররা দলে-দলে এই সব সভায় যোগদান করিলাম। এই সব সভার কথা যা আবছা-আবছা মনে আছে তাতে বলা যায় যে, একদিকে মহাত্মা গান্ধী ও মওলানা শওকত আলী অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে, অপরদিকে বাবু বিপিন চন্দ্র পাল ও মৌঃ ফযলুল হক অসহযোগের বিপক্ষে বক্তৃতা করিয়াছিলেন। কিন্তু তৎকালে খিলাফত ও জালিয়ান ওয়ালাবাগের জন্য জন-মত অসহযোগের পক্ষে এমন ক্ষিপ্ত ছিল যে বিরোধী বক্তারা কথায়-কথায় শ্রোতাদের দ্বারা বাধা পাইতেন। এই জন-মতের জন্যই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন অসহযোগের বিপক্ষে বক্তৃতা করিতে আসা সত্ত্বেও আন্দোলনের সমর্থনে বক্তৃতা দিয়া গিয়াছিলেন। যা হোক ১৯২০ সালের ডিসেম্বরে নাগপুর কংগ্রেস খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন সমর্থন করার পর নেতাদের মতভেদ একরূপ দূর হইয়া যায়। যাঁরা অসহযোগের সমর্থন করেন নাই তাঁরা রাজনীতির আকাশে সাময়িকভাবে মেঘাচ্ছন্ন হইয়া পড়েন। এঁদের মধ্যে জিন্না সাহেব, হক সাহেব ও বিপিন পালের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
৫. আন্দোলনে যোগদান
মৌঃ ইব্রাহিম সাহেব আমাদের সক্রিয় নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ছাত্রদের ছোট-খাট একাধিক মিটিং-এ বক্তৃতা দেন। হোস্টেলের আংগিনায় বক্তৃতা নিষিদ্ধ হইলে তিনি হোস্টেলের বাহিরে বক্তৃতা শুরু করেন। বর্তমানে যেখানে টি. বি. ক্লিনিক, এইখানে একটা মাটির টিপিতে দাঁড়াইয়া ইব্রাহিম সাহেব পরপর কয়েকদিন বৃক্ততা করেন। ইব্রাহিম সাহেব ছাড়া আমার আরেকজন সহপাঠী আমার উপর বিপুল প্রভাব বিস্তার করেন। তাঁর নাম ছিল মিঃ আবুল কাসেম। তাঁর বাড়ি ছিল বরিশাল জিলায়। পরবর্তীকালে তিনি মোখতারি পাস করিয়া আইন ব্যবসায় করিতেন। এখন তিনি কি অবস্থায় কোথায় আছেন জানি না। কিন্তু ১৯২০ সালে প্রধানতঃ তিনিই আমাকে অসহযোগ আন্দোলনে দীক্ষিত করিয়াছিলেন। এছাড়া আবুল কালাম শামসুদ্দিন তখন কলিকাতা কারমাইকেল হোস্টেল হইতে প্রতি সপ্তাহে দুই একখানা করিয়া দীর্ঘ পত্র লিখিতেন। এইসব পত্রে অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে প্রচুর যুক্তি থাকিত এবং তিনি অতি শীঘ্রই আন্দোলনে যোগ দিতেছেন এই খবর থাকিত। ইতিমধ্যে আমি মহাত্মা গান্ধীর ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’র গ্রাহক হইয়াছিলাম। গভীর মনোযোগে ও পরম শ্রদ্ধার সংগে ইহা পড়িতাম। তাঁর লেখা আমার চিন্তা-ধারায় বিপুল প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। পরবর্তী জীবনেও এই প্রভাব আমি কাটাইয়া উঠিতে পারি নাই।
ইব্রাহিম সাহেবের নেতৃত্বে আমরা অনেক ছাত্র কলেজ ত্যাগ করিয়াছিলাম। বি. এ. পরীক্ষার তখন মাত্র কয়েকমাস বাকী। টেস্ট পরীক্ষা আগেই হইয়া গিয়াছে। অধ্যাপক শ্যালির আমি খুব প্রিয় ছাত্র ছিলাম। তাঁর সবিশেষ পীড়াপীড়িতে আমি ও আরও কতিপয় বন্ধু শেষ পর্যন্ত নামমাত্র পরীক্ষা দিয়া ফলাফলের প্রতি উদাসীনতা দেখাইয়া গ্রামে চলিয়া গেলাম। কংগ্রেস-খেলাফত কমিটির নীতি ছিল ‘ব্যাক টু ভিলেজ’। অতএব তাদের নির্দেশিত পন্থী সংগঠনে মন দিলাম। ইতিমধ্যে কলিকাতা হইতে শামসুদ্দিনও ফিরিয়া আসিয়াছেন। তিনি আমার চেয়ে এক ডিগ্রি বেশি আগাইয়াছেন।বি. এ. পরীক্ষাই দেন নাই। তার বদলে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন প্রতিষ্ঠিত ‘গৌড়ীয় সর্ববিদ্যায়তনের’ ‘উপাধি’ পরীক্ষা দিয়াছেন। সুতরাং স্থানীয় কর্মীদের কাছে চরমপন্থী বলিয়া তাঁর মর্যাদা আমার উপরে। পল্লী গঠনের কাজে তাঁরই নেতৃত্বে আমরা কাজ শুরু করিলাম। একটি জাতীয় উচ্চ বিদ্যালয় ও একটা, তাঁতের স্কুল স্থাপন করিলাম। বৈরলধানীখোলা দুই গ্রামের একই যুক্ত পল্লী সমিতি হইল। শামসুদ্দিন তার সেক্রেটারী হইলেন। বৈলর বাজারে অফিস প্রতিষ্ঠিত হইল। হাইস্কুলে হইল বৈলর বাজারে দীনেশ চন্দ্র সরকারের বিশাল আটচালা ঘরে। আমি হইলাম স্কুলের হেড-মাস্টার। শামসুদ্দিন হইলেন এসিস্ট্যান্ট হেড মাস্টার। শিক্ষক-ছাত্রে অল্পদিনেই স্কুলটি গম-গম করিতে লাগিল। শামসুদ্দিনের চাচা জনাব যহিরুদ্দিন তরফদার সাহেব আমার ছোটবেলা হইতেই প্রজা আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি কংগ্রেসে খেলাফত আন্দোলনেও আমাদের মুরুব্বি হইলেন। পল্লীসমিতির প্রেসিডেন্ট ও হাইস্কুলের সেক্রেটারী হইলেন তিনিই।
৬. পল্লী সংগঠন
হাইস্কুল হইল বিনা-বেতনের বিদ্যালয়। নিতান্ত অভাবী শিক্ষকরা ছাড়া আমরা সবাই বিনা বেতনের শিক্ষক হইলাম। স্কুলের লাইব্রেরি মানচিত্র টেবিল চেয়ার বেঞ্চি ব্ল্যাক বোর্ড ইত্যাদির ব্যয় ও পল্লী সমিতির খরচের জন্য আমরা বাজারে তোলা ও গ্রামের মুষ্টি চাউল তুলিতে লাগিলাম। সারা গ্রামের ঘরে-ঘরে মুষ্টির ঘট বসাইলাম। সপ্তাহে-সপ্তাহে নিয়মিতভাবে ঘটের চাউল ভলান্টিয়ারসহ আমরা নিজের কাঁধে ও মাথায় করিয়া সগ্রহ করিতাম।
ফলে হাইস্কুল, তাঁতের স্কুল, চরখা স্কুল ও পল্লী সমিতির কাজে কৈলর বাজার জিলা-নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। জিলা-নেতৃবৃন্দের মধ্যে মৌঃ তৈয়বুদ্দিন আহমদ, শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্র মোহন ঘোষ প্রভৃতি অনেকেই আমাদের কাজ দেখিতে আসিতেন। এ অঞ্চলে পল্লী গ্রামে ইহাই একমাত্র জাতীয় উচ্চ বিদ্যালয় হওয়ায় আশে পাশের দশ মাইলের মধ্যেকার সর্ব হাইস্কুলের উচ্চ শ্রেণীর ছাত্ররা এই স্কুলে যোগদান করিল। তাঁতের স্কুলে চার-পাঁচ জন তাঁতীর পরিচালনায় ৪৫ টা তাঁতে কাপড় বুনার কাজ চলিল। নানা রং-এর সূতার টানায় মাঠ ছাইয়া গেল। ঐসব তাঁতে রাতদিন ঘর্ঘর আওয়াজ চলিল। পল্লী সমিতি হইতে বিনা মূল্যে গ্রামে চরখা বিতরণ ও তুলার বীজ বিলান হইল। আমাদের পল্লী সমিতি এইভাবে কিত দিনরাত কর্মচঞ্চল। এই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে সভা করিতাম। আমরা সপ্তাহে অন্তত একদিন। এই সব সভায় শহর হইতে দু-চার জন নেতা আসিতেন। সন্ধ্যার অনেক পরেও এই সব সভার কাজ চলিত। সভার স্থানীয় উদ্যোক্তাদের একজনের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা আগে হইতেই ঠিক থাকিত। সভা শেষে নির্ধারিত বাড়িতে উদরপূর্তি খানা খাইতাম। খাওয়া-দাওয়া সারিতে-সারিতে বেশ রাত হইয়া যাইত। তবু আরা রাত্রিবাস করিতাম না। কত কাজ আমাদের। আমরা কি এক জায়গায় সময় নষ্ট করিতে পারি? এই ধরনের কথা বলিয়া নিজেদের বুযুর্গি বাড়াইতাম। পাড়াচালের চার-পাঁচ মাইল রাস্তা হাঁটিয়া এই বুযুর্গির দাম শোধ করিতাম। শহরের নেতাদের জন্য যথাসম্ভব কাছের কোন সড়কে ঘোড়াগাড়ি এন্তেযার করিত। তাঁদের গাড়িতে তুলিয়া দিয়া আমরা বাড়ি-মুখী হইতাম। পথের কষ্ট ভুলিবার জন্য আমরা গলা ফাটাইয়া ‘স্বদেশী গান’ ও ‘খেলাফতী গযল’ গাইতাম। পাঠকদের, বিশেষত তরুণ পাঠকদের কাছে বিশ্বয়কর শোনা গেলেও এটা সত্য কথা যে, আবুল কালাম শামসুদ্দিন আর আমিও গান গাইতাম। ইয়ার্কি না। সত্যই আমরা গান গাইতে পারিতাম। তার উপর আমি বাঁশি বাজাইতে পারিতাম। বস্তুতঃ কলেজ হোস্টেলে জনাব ইব্রাহিম, কাযী মোতাহার হোসেন সাহেব প্রভৃতি উপরের শ্রেণীর ছাত্রদেরও আমি ‘ওস্তাদজী’ ছিলাম। এরা সকলেই গান গাইতেন। আসল কথা এই যে শৈশবে সব লেখকই যেমন কবি থাকে, তেমনি প্রায় সকলেই গায়কও থাকেন।
৭. আন্দোলনের জনপ্রিয়তা
যা হউক, এইরূপ কর্মোদ্যমের মধ্যে আমরা শারীরিক সুখ-স্বাদের কথা ভুলিয়াই থাকিতাম। গোসল-খাওয়ার কোন সময় অসময় ছিল না। জনগণের ও কর্মীদের উৎসাহ-উদ্দীপনা আমাদের চব্বিশ ঘন্টা মাতাইয়া রাখিত। ধনী-গরিব নির্বিশেষে জনগণ এই আন্দোলনকে নিতান্ত নিজের করিয়া লইয়াছিল। একটি মাত্র নযিরের উল্লেখ করি। এই সময় নিখিল-ভারত খিলাফত কমিটি আংগোরা (বর্তমান আংকারা) তহবিল নামে একটি তহবিল খুলেন যুদ্ধরত কামাল পাশাকে সাহায্য করিবার জন্য। ফেৎরার মত শিশু-বৃদ্ধ-নর-নারী নির্বিশেষে মাথা-পিছে দুই পয়সা চাঁদা উপর হইতেই নির্ধারিত হইয়াছিল। আমাদের এলাকার লোকেরা ফেত্রা দেওয়ার মতই নিষ্ঠার সাথে স্বেচ্ছায় এই চাঁদা দিল। ত্রিশ হাজার অধিবাসীর দুই গ্রাম মিলাইয়া আমরা বিনা-আয়াসে প্রায় এক হাজার টাকা তুলিলাম। তেমনি নিষ্ঠার সংগে শামসুদ্দিন ও আমি ঐ টাকার বোঝা মাথায় করিয়া জিলা খিলাফত কমিটিতে জমা দিয়া আসিলাম। একটি পয়সাও স্থানীয় সমিতির খরচ বাবত কাটিলাম না।
গঠনমূলক কাজের মধ্যে আমরা চরখা ও তুলার বীজ বিতরণ এবং শালিসের মাধ্যমে মামলা-মোকদ্দমা আপোসরণের দিকেই বেশি মনোযোগ দেই। দুই গ্রাম মিলাইয়া আমরা একটি মাত্র শালিসী পঞ্চায়েত গঠন করি। আমাদের স্থানীয় নেতা যহিরুদ্দিন তরফদার সাহেব এই পঞ্চায়েতের চেয়ারম্যান হন। ইউনিয়ন বোর্ড আইন তখনও হয় নাই। কাজেই প্রেসিডেন্ট নামটা তখনও জানা হয় নাই। ডিসট্রিক্ট বোর্ড লোক্যাল বোর্ডের চেয়ারম্যানই তখন সবচেয়ে বড় সম্মানের পদ। আমরা আমাদের পঞ্চায়েতের প্রধানকেও সেই সম্মান দিলাম। পঞ্চায়েতের বৈঠক পক্ষগণের সুবিধামত এক একদিন এক এক পাড়ায় হইত। তরফদার সাহেব বরাবরের দক্ষ বিচারক মাতব্বর। তাঁর প্রখর বুদ্ধি সুচতুর মধুর ব্যবহার ও নিরপেক্ষ বিচার সকলকে মুগ্ধ করিত। অল্পদিনেই স্থানীয় মামলা-মোকদ্দমা লইয়া কোর্ট-কাছারি যাওয়া বন্ধ হইল।
তুলার চাষ জনপ্রিয় করার ব্যাপারে আমরা সরকারী সাহায্য পাইলাম। গভর্ণমেন্টকে আমরা এই সময়ে সবচেয়ে বড় দুশমন মনে করিতাম। কাজেই সরকারী সাহায্য নেওয়ার কথাই উঠিতে পারে না। কিন্তু এই সময় সদর মহকুমার এস. ডি. ও. ছিলেন নবাবদা আবদুল আলী। তিনি গায়ে চাপকান মাথায় গুম্বযী টুপি পরিতেন বলিয়া অন্যান্য সরকারী কর্মচারী হইতে তাঁর একটা আলাদা মান-মর্যাদা ছিল জনগণের কাছে। বিশেষতঃ মুসলমানদের নিকট তিনি ছিলেন অসাধারণ জনপ্রিয়। আমরা সব কংগ্রেস খিলাফত কর্মীদের ডাকিয়া চা খাওয়াইয়া আশাতীত সম্মান দেখাইয়া তিনি বুঝাইলেন, তিনিই অসহযোগ আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সমর্থক। কাজেই তিনি তুলার চাষ বাড়াইয়া দেশকে সূতায় ও কাপড়ে আত্মনির্ভরশীল করিতে চান। আমরা তাঁর কথা মানিয়া লইলাম। সরকারী তহবিলের বহু তুলার বীজ আমরা বিতরণ করিলাম।
৮. উৎসাহে ভাটা
কিন্তু আমাদের উৎসাহ এক বছরের বেশি স্থায়ী হইল না। গান্ধীজীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি-গত এক বছরে স্বরাজ আসিল না। চৌরিচূরার হাংগামার ফলে তিনি সার্বজনীন আইন অমান্য প্রত্যাহার করিলেন। কংগ্রেস নেতারা তদন্ত করিয়া রিপোর্ট দিলেন স্কুল-কলেজ ও অফিস-আদালত বয়কট ব্যর্থ হইয়াছে। এরপর ছাত্ররা জাতীয় বিদ্যালয় ছাড়িয়া দলে-দলে সরকারী ‘গোলাম-খানায়’ ঢুকিতে লাগিল। আমাদের জাতীয় বিদ্যালয়ের ও তাঁতের স্কুলের ছাত্র কমিয়া গেল। খদ্দরের কাপড় মোটা ও রং কাঁচা বলিয়া আমাদের তৈরি কাপড় বিক্রিতে মন্দা পড়িল। কারিগর শিক্ষক ও গরিব মাস্টারদের বেতন দেওয়া অসম্ভব হইয়া উঠিল। তাঁতের স্কুলের কারিগর শিক্ষকরা ছিলেন সবাই গরিব লোক। তাঁদের মাসে মাসে নিয়মিতভাবে বেতন না দিলে চলিত না। এদের বেতন বাকী পড়িতে লাগিল। তাঁতের তৈরি কাপড়গুলি নিয়মিত বিক্রি হইত না। বিক্রি হইলেও কম দাম হইত। তাতে বেতন বাকী পড়িত। বাজারের তোলা গ্রামের মুষ্টি চাউল সব ব্যাপারেই লোকের উৎসাহ কমিতে লাগিল। মাষ্টার, কারিগর ও কর্মীদের মধ্যে শৈথিল্য ও নিরুৎসাহ দেখা দিল।
আমাদের মন ও শরীরের উপর এর চাপ পড়িল। শামসুদ্দিন ছিলেন বরাবরের আমাশয় রোগী। এক বছরের কঠোর পরিশ্রম ও অনিয়মে তাঁর শরীর আরও খারাপ হইল। শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হিসাবেই তিনি ‘মোসলেম জগৎ’ নামক সাপ্তাহিক কাগজের দায়িত্ব লইয়া কলিকাতা চলিয়া গেলেন। আমি একা চরম নিরুৎসাহ ও অভাবের মধ্যে হাইস্কুল, তাঁতের স্কুল, চরখা স্কুল, পল্লীসমিতি ও শালিসী পঞ্চায়েতের কাজ চালাইতে লাগিলাম। এই দুর্দিনে ‘বড় চাচা’ যহিরুদ্দিন সাহেবের পৃষ্ঠপোষকতা ও উৎসাহ এবং ডাঃ দীনেশ চন্দ্র সরকার ও ডাঃ আক্কাস আলী প্রভৃতি উৎসাহী কর্মীদের কর্মোন্মাদনার উত্তাপই আমার কর্মপ্রেরণার সলিতা কোনও মতে জ্বালাইয়া রাখিল।
কিন্তু বেশিদিন এভাবে চলিল না। শেষ পর্যন্ত আমিও রণে ভংগ দিলাম। আস্তে আস্তে সব প্রতিষ্ঠান গুটাইয়া নিজে ময়মনসিংহ শহরে চলিয়া আসিলাম। ১৯২২ সালের মাঝামাঝি জিলার জনপ্রিয় নেতা মৌঃ তৈয়বদ্দিন আহমদ পুনরায় ওকালতি শুরু করায় জিলা খিলাফত কমিটির সেক্রেটারির দায়িত্ব আমারই উপর পড়িল। আন্দোলনে যোগ দিয়াই তৈয়বুদ্দিন সাহেব ফ্যামিলি বাড়ি পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। তাঁর বাসাই খিলাফত নেতাদের বাসস্থান ছিল। আমারও হইল। তৈয়বুদ্দিন সাহেব তাঁর বড় ভাই মৌঃ শাহাবুদ্দিন উকিল সাহেবের বাসায় খাওয়া-দাওয়া করিতেন। আমরা কতিপয় নেতা তৈয়বুদ্দিন সাহেবের বাসায় মেস করিয়া খাওয়া-দাওয়া করিতাম। নেতাদের মধ্যে যাঁদের শহরে বাড়ি-ঘর নাই তাঁরা কংগ্রেস খেলাফতের টাকাতেই খাওয়া খরচ চালাইতেন। আমারও তাই হইল। কিন্তু এটা আমার ভাল লাগিত না। বিশেষতঃ টাকার অভাবে এই সময় খিলাফত কমিটির স্বতন্ত্র অফিস উঠাইয়া কংগ্রেস অফিসেরই এক কামরায় খিলাফত অফিস করিলাম। এমত অবস্থায় নেতাদের খাওয়ার তহবিলের টাকা খরচ করিলে খেলাফত অফিসের খরচায় টান পড়িত।
৯. জাতীয় বিদ্যালয়ে মাস্টারি
অতএব আমি স্থানীয় জাতীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা গ্রহণ করিলাম। এই স্কুলের হেড মাষ্টার ছিলেন আমার শিক্ষক ও মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের ভূতপূর্ব সহকারী হেডমাস্টার শ্ৰীযুক্ত ভূপতি নাথ দত্ত। তিনি ছিলেন ঋষি-তুল্য মহাপ্রাণ ব্যক্তি। ছাত্রজীবনেই তিনি আমাকে পূত্রবৎ স্নেহ করিতেন। আমাকে পাইয়া তিনি লুফিয়া নিলেন সহকারীরূপে। তাঁর নেই-শীতল ছায়ায় ও তাঁর অভিজ্ঞ পরিচালনায় আমি শিক্ষকতা শুরু করিলাম। শিক্ষার আদর্শ ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে এবং শিক্ষকতার টেকনিক্যাল খুঁটি-নাটি ব্যাপারে এই সময় তাঁর কাছে অনেক জ্ঞান লাভ করিলাম। স্কুলের সময় তিনি ছাত্রদের যেমন বিদ্যা শিক্ষা দিতেন, স্কুল আওয়ারের পরে তেমনি তিনি আমাদিগকে শিক্ষকতা শিক্ষা দিতেন। বেতন হিসাবে আমি চল্লিশটি টাকা পাইতাম। এই টাকাতেই আমি খেলাফত নেতাদের মধ্যে রীতিমত ধনী লোক হইয়া গেলাম। নিজের পরা ছাড়া দু’একজন গরিব সহকর্মীকেও পোষিতে পরিতাম। শিক্ষকদের মধ্যে আরবী-ফারসী শিক্ষক ছাড়া। আরও দু’জন মুসলমান ছিলেন। তাঁদের নাম ছিল মৌঃ,সাইদুর রহমান ও মৌঃ আলী হোসেন। উভয়ে নিম্নশ্রেণীর শিক্ষক ছিলেন। সাইদুর রহমান সাহেব বেতন পাইতেন ত্রিশ টাকা ও আলী হোসেন পাইতেন পঁচিশ টাকা। উভয়েই আমাদের সাথে এক মেসে থাকিতেন। খেলাফত নেতা-কর্মীদের ভার তাঁদের উপরও গড়াইত।
এই সময় খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন ঝিমাইয়া আসিয়াছে। কাজেই করিবার মত কাজ আমাদের বিশেষ কিছু ছিল না। দিনের বেলা মাস্টারি করি এবং বিকাল ও রাত্রি বেলা নেতাদের বাড়ি-বাড়ি চা খাই। অগত্যা অফিসে বসিয়া আড্ডা মারি। এই সুযোগে শহরের বড় বড় নেতা যথা শ্রীযুক্ত সূর্যকুমার সোম, ডাঃ বিপিন বিহারী সেন, শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্র নাথ মৈত্রেয়, মিঃ সুধীর চন্দ্র বসু বারিস্টার (সূৰ্য্যবাবুর মেয়ের জামাই), শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্র মোহন ঘোষ ও শ্রীযুক্ত মতিলাল পুরকায়স্থ প্রভৃতির সহিত ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হই। সুরেনবাবু ‘মধু ঘোষ’ নামে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি প্রায় আমার সমবয়স্ক। সেজন্য তাঁর সাথে বন্ধুত্ব হয়। তিনি বিপ্লবীদের ‘মধুদা’ ছিলেন। ডাঃ বিপিন সেন ও সূৰ্য্য সোম আমার পিতৃতুল্য শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন। পরবর্তী জীবনে তাঁদের স্নেহও পাইয়াছিলাম অফুরন্ত। তাঁরা উভয়ে অসাম্প্রদায়িক উদার মহান ব্যক্তি ছিলেন।
এঁদের সাহচর্যে ময়মনসিংহ শহরের প্রায় বছর খানেক বড়ই আনন্দে কাটিয়াছে, সুরেন বাবু, মওলানা আযিযুর রহমান (ইনি নোয়াখালির লোক ছিলেন), মৌলবী আবদুল হামিদ দেওপুরী, অধ্যাপক মোয়াযম হোসেন, মৌঃ সাইদুর রহমান প্রভৃতি হিন্দু-মুসলমান কংগ্রেস খেলাফত নেতারা বিকালে দল বাঁধিয়া রাস্তায় বাহির হইতাম। পথচারীরা সম্ভ্রমে আমাদের পথ ছাড়িয়া দিত এবং সালাম-আদাব দিত। এমন পথ ভ্রমণে আমিই ছিলাম অন্যতম প্রধান বক্তা অবশ্য রাস্তাঘাটে। পথ চলিতে চলিতে আমার মত বকিতে কেউ পারিতেন না। আমি কোনও কোনও সময় অতি উৎসাহে বন্ধুদের সামনে করিয়া পিছন দিকে চলিতে-চলিতে বক্তৃতা করিতাম। এমন করিতে গিয়া একদিন একজন পথচারিনী মহিলার পায়ে পাড়া মারিয়া ঝটপট ঘুরিয়া হিন্দু ভংগিতে দুই হাত জোড় করিয়া মহিলাকে নমস্কার করিলাম। রাস্তায় যখন বেড়াইতে বাহির হইয়াছেন তখন নিশ্চয়ই তিনি মুসলমান নন। আমাকে এভাবে নমস্কার করিতে দেখিয়ে মহিলা হতভম্ব হইয়া গেলেন। বন্ধুরা সকলে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। কেউ কেউ বলিলেন : ‘ওটা যে বেশ্যা। একটা বেশ্যাকে তুমি সেলাম করিলে?’ আমার মুখ হইতে চট করিয়া বাহির হইল : ‘যারা বেশ্যাগামী তাদের কাছেই ইনি বেশ্যা, আমার কাছে তিনি ভদ্রমহিলা মাত্র।’ সকলে নীরব হইলেন। মেয়েটি সজল নয়নে আমার দিকে চাহিয়া রহিল।
কিন্তু বেশিদিন এভাবে চলিল না। সক্রিয় আন্দোলনের অভাবে চিন্তার প্রচুর সুযোগও পাইলাম। অবস্থাগতিকে চিন্তায় বাধ্যও হইলাম। অল্পদিনের মধ্যেই বুঝিলাম, দেশের স্বাধীনতা ও খিলাফতের জন্য সর্বস্ব ও প্রাণ বিসর্জন দিবার যে দুর্বার তাকিদে কলেজ ত্যাগ করিয়াছিলাম, সে সব ত্যাগের আজ কোন দরকার নাই। কারণ স্বাধীনতা ও খেলাফত কোনটাই উদ্ধারের কোনও সম্ভাবনা এখন নাই। মহাত্মাজী স্বরাজের মেয়াদ অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছাইয়া দিয়াছেন। মোস্তফা কামাল খেলাফত ভাংগিয়া দিয়া মহামান্য সুলতানকে দেশ হইতে তাড়াইয়া দিয়াছেন। কাজেই আমার আপাততঃ জাতীয় বিদ্যালয়ের মাস্টারিই সার হইল। বেতন চল্লিশ টাকা এতদিন মোটেই অপ্রতুল মনে হয় নাই। কারণ তৎকালে খরচও কম ছিল। তখন এক পয়সায় এক কাপ চা, চার পয়সায় পঁচিশ টা মুখপোড়া বিড়ি ও পয়সায় দুইটা দিয়াশলাই পাওয়া যাইত। তাতে সারা দিনে চার আনার বেশি খরচ করিতে পারিতাম না। তৈয়বুদ্দিন সাহেবের বাসায় বিনা-ভাড়ায় থাকিতাম। তিন-চার বন্ধুতে একত্রে মেস করিয়া খাইতাম। পাঁচ টাকার বেশি খোরাকি লাগিত না। পোশাকে বাবুগিরি ছিল না। সস্তা মোটা খদ্দরের তহবন্দ ও পাঞ্জাবী পরিতাম। একটা ধুতিতেই একটা পাঞ্জাবী ও একটা তহবন্দ হইয়া যাইত। দুই টাকা চার আনা দিয়া বছরে দুই খানা ধুতি (প্রতিটি আঠার আনা) কিনিতাম তাতেই দুইখানা পাঞ্জাবী ও দুইখানা তহবন্দ হইয়া যাইত। দুইটা পাঞ্জাবী সিলাই করিতে দর্জি নিত বার আনা। তহবন্দ সিলাইর চার্জ ছিল দুইটা দুই আনা। পাঞ্জাবীর বাদবাকী টুকরা কাপড় হইতে সচ্ছন্দে দুইটা গান্ধী টুপি হইয়া যাইত। দুইটা টুপিতে ও দুইটা তহবন্দে কখনও চার আনা কখনও বা দুই আনা দর্জিকে দিয়াই মাফ লইতাম। সুতরাং দেখা গেল, মোট সোওয়া তিন টাকা খরচ করিয়া আমার দুইটা পাঞ্জাবী দুইটা তহবন্দ ও দুইটা টুপি হইয়া যাইত। খদ্দরটা মোটা বলিয়া মজবুতও হইত। ধুইতামও নিজেই। একনম্বর ঢাকাই বাংলা সাবান ছিল পাঁচ আনা সের। দশ পয়সায় আধা সেরের একটা দলা পাওয়া যাইত। প্রতি সপ্তাহে ঐ এক দলা সাবানে সব কাপড় ধোলাই হইয়া যাইত। কখনও কখনও এক পয়সার নীল কিনিয়া নীলের ছোপ দিতাম। কেউ ‘বাবু’ বলিলে তাও দিতাম না। তবু মোটামুটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকিতাম।
সুতরাং টাকা-পয়সার অল্পতার কথা অনেকদিন মনে করি নাই। প্রথমে মনে পড়ে আদর্শহীনতার কথা। কিসের জন্য অত প্রশংসার ছাত্র-জীবন ত্যাগ করিলাম? নিশ্চয়ই চল্লিশ টাকার স্কুল মাস্টারি করিবার জন্য নয়। ন্যাশনাল স্কুলে মাস্টারি? তারই মানে কি? চরখায় সূতা কাটা ছাড়া ‘গোলামখানা’ হাই স্কুলের পঠিতব্য ও ন্যাশনাল হাই স্কুলের পঠিতব্যে পার্থক্য কি? সব বেসরকারী স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষক এবং অনেক ছাত্র আমারই মত খদ্দর পরেন। তবে পার্থক্যটা কোথায়? বিশেষতঃ ন্যাশনাল স্কুলই হোক আর ‘গোলামখানা’ই হোক মাস্টারগণকে ত ঘড়ির কাঁটা ধরিয়াই স্কুলে আসতে হয়। বিকালে ক্লান্ত দেহে শুকনা মুখে ঘরে ফিরিতে হয়।
দেশোদ্ধারের চিত্ত-চাঞ্চল্যকর দেহমন-শিহরণকারী কাজ এতে কোথায়? মনটা ক্রমেই খারাপ হইতে লাগিল। স্কুলের কাজ ছাড়িয়া দিয়া অপেক্ষাকৃত রোমাঞ্চকর রোমান্টিক কিছু করিবার জন্য মন উতলা হইয়া গেল। কিন্তু দুইটি কারণে হঠাৎ কিছু করিতে পারিলাম না। তার একটি ছাত্রের মায়া, অপরটি টাকার মায়া ছাত্রের মায়া এইজন্য যে তাদেরে আমি ভালবাসিতাম। তারাও আমাকে ভালবাসিত। সহকর্মীরাও বলিতেন, আমি ছাত্রদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। আমি তখন দাড়ি রাখিয়াছি। দাড়ি-লুংগি টুপিতে আমি দস্তুরমত একজন মুনশী সাহেব। এমন একজন মুসলমানের পক্ষে ঐ স্কুলে জনপ্রিয় শিক্ষক হওয়া আশ্চর্যের বিষয় ছিল। কারণ ছেলেদের বেশির ভাগই ছিল ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-বৈদ্য সমাজের হিন্দু ছেলে। অধিকাংশই শহরের উকিল-মোক্তার ডাক্তার প্রভৃতি ভদ্রলোকের ছেলে। এরা আমাকে এত ভক্তিশ্রদ্ধা করিত যে এদের অনেকে রাস্তাঘাটে পর্যন্ত আমাকে পা ছুঁইয়া প্রণাম করিত। অথচ হিন্দু মাষ্টাররা এই সৌভাগ্য হইতে বঞ্চিত ছিলেন। এইসব ছেলের মধ্যে চার জনের কথা আমি জীবনে ভুলিতে পারি না। দুই জন ব্রাহ্মণ, একজন কায়স্থ ও একজন বৈদ্য। এঁরা সকলেই পরবর্তী জীবনে উচ্চ-উচ্চ দায়িত্বপূর্ণ পদের অধিকারী নেতৃস্থানীয় লোক হইয়াছেন। হিন্দু ছেলেদের মধ্যে মুসলমানদের মত গুরু-ভক্তি নাই বলিয়া স্বয়ং হিন্দু শিক্ষকদেরই একটা সাধারণ অভিযোগ আছে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা এই অভিযোগ সমর্থন করে না। এই ধরনের ভক্তিমান ছেলেরা আমার হৃদয়-মন এমন জয়। করিয়াছিল যে এদের মনের দিকে চাহিয়া আমি কোনমতেই এই স্কুলের মায়া কাটাইতে পারিতাম না।
দ্বিতীয় কারণ অবশ্য এর চেয়ে কাটখোট্টা বাস্তব কারণ। মাসে মাসে যে চল্লিশটি টাকা পাই শিক্ষকতা ছাড়িয়া দিলে তা-ইবা পাইব কোথায়? খিলাফত ফন্ডে যে সামান্য পয়সা ছিল, সেক্রেটারি হিসাবে আমি অবশ্যই কোষাধ্যক্ষের নিকট হইতে তা চাহিয়া নিতে পারিতাম। কিন্তু নিজের খাওয়ার জন্য কোষাধ্যক্ষের কাছে টাকা চাওয়া আমি লজ্জার বিষয় মনে করিতাম। কাজেই স্কুলের মাস্টারি ছাড়িলে আমাকে খালি পকেটে এবং শেষ পর্যন্ত খালি পেটে থাকিতে হইবে। এটা আমার কাছে স্পষ্ট হইয়া উঠিল। এইভাবে এতদিনে বুজিলাম, দেশের স্বাধীনতাই বল, আর ধর্মের খিলাফতই বল, পেটে আগে কিছু না দিয়া দুইটার কোনওটাই উদ্ধার করা চলে না।
কলেজ ছাড়িবার সময় ল্যাংলি সাহেব ও বাপ-মা মুরুব্বিরাও এই কথাই বলিয়াছিলেন। তখন জবাব দিয়াছিলামঃ টাকা-পয়সা ও ভোগবিলাসিতা ত তুচ্ছ কথা, দেশ ও ধর্মের জন্য প্রাণ পর্যন্ত ত্যাগ করিতে পারি। এখন বুঝিতেছি, দরকার হইলে প্রাণ হয়ত সত্য-সত্যই দিতে পারি। কিন্তু তার দরকার ত মোটেই হইতেছে না। কেউত আমার প্রাণ চাইতেছে না। প্রাণ দিবার কোনও রাস্তাই তা নিজের চোখেও দেখিতেছি না। মাস্টারি ছাড়া কাজের মধ্যে ত আড্ডা মারা। উকিলরা সব কোর্টে ফিরিয়া যাওয়াতে তাঁদের বাসায়ও আগের মত আড্ডা দেওয়া চলে না। মক্কেলের ভিড়। একমাত্র চাঞ্চল্যকর কাজ কংগ্রেস-খিলাফতের সভা উপলক্ষে কলিকাতা গয়া। দিল্লী বোম্বাই যাওয়া। সেটাও আমার ভাগ্যে জুটে না। কলিকাতার পশ্চিমে আর আমার যাওয়াই হয় না। কারণ ঐ সব সভায় যাওয়ার ভাড়া ও খরচ-পত্র বহন করার মত টাকা কংগ্রেস-খিলাফত ফণ্ডে নাই। কাজেই অন্য সব কর্মী বন্ধুরা, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের নিকট হইতে টাকা যোগাড় করিয়া লয়। কিন্তু আমার তেমন কোনও বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন না থাকায় আমি কলিকাতা যাওয়ার আনন্দ হইতেও প্রায়শঃ বঞ্চিত থাকিতাম।
কাজেই সকল দিক বিবেচনা করিয়া আমি যে বাস্তব অবস্থার সম্মুখীন হইলাম, তার সোজা অর্থ এই যে, আমি খিলাফত ও স্বরাজের দোহাই দিয়া কলেজ ছাড়িয়া আসিয়া চল্লিশ টাকা বেতনের চাকরি করিতেছি। কলেজ ত্যাগের এই কি পরিণাম? এই কাজে কি স্বরাজ খিলাফত উদ্ধার হইবে? বাপ-মা মুরুব্বিদের এমন কি নিজেরে ফাঁকি দেই নাই কি? অতিশয় অস্থির-চঞ্চল হইয়া উঠিলাম। অনেক বিনিদ্র রজনী কাটাইলাম।
Leave a Reply