দুলালের গল্প

দুলালের গল্প

দুলাল নামে একটি ছেলে পটোলডাঙায় বাস,
গরম গরম পটোলভাজা খায় সে বারো মাস।
পটোলডাঙার চারদিকেতে পটোলগাছের বন,
ডাল ধ’রে তার নাড়লে পড়ে, পটোল দু-চার মণ।
পাড়তে পটোল ছিঁড়তে পটোল মোটেই মানা নেই,
বারণ কেবল পটোল তোলা—আইন হচ্চে এই।
অটল ঘোষের পিসীর ননদ পটোল তুলেছিল,
ইস্কুলে তাই অটল ঘোষের নামটি কেটে দিল।
যাক্ সে কথা। বলচি এখন গল্প দুলালের;
মন দিয়ে খুব শোনো যদি বুদ্ধি হবে ঢের।

দুলাল ব’লে একটি ছেলে পটোলডাঙায় ধাম,
বাপ হচ্চেন জ্যোতিষচন্দ্র, গৌরী মায়ের নাম।
তিনকড়ি আর সাধনচন্দ্র দুলালের দুই চাচা,
আড়াই হাতী খদ্দরেতে দেয় না তারা কাছা।
দুলালচাঁদের আছে আবার ফুটফুটে পাঁচ বোন,
বীণা, রাণু, বুলু, দুলু—এই নিয়ে চার জন।
আর একটি বেরাল-ছানা নামটি গেছি ভুলে,
দেখতে যেন মোমের পুতুল, গাল দুটো তুলতুলে।
এ সব ছাড়া দুলালচাঁদের আছে অনেক জন
জেঠতুতো আর মাসতুতো আর পিসতুতো ভাই-বোন।
থাক্ সে কথা। মন দিয়ে খুব শোনো এখন ভাই—
বলচেন যা দুলালচাঁদের ন-পিসে মশাই।

দুলালচন্দ্র ছিল যখন সাত বছরের ছেলে,
একদিন সে লুচি দিয়ে পটোলভাজা খেলে।
পাকা পাকা পটোল তাতে ক্যাঁচর ক্যাঁচর বিচি,
বিচি খেয়ে মুখ বেঁকিয়ে দুলাল বলে—“ছি ছি,
রইব না আর কোলকাতাতে পটোলভাজার দেশে,
যাচ্চি আমি পণ্ডিচেরি মাদ্রাজীদের মেসে।”
এই না ব’লে টিকিট কিনে দুলাল তাড়াতাড়ি
কটকেতে চ’লে গেল সেজপিসীর বাড়ি।
ভাবেন তখন দুলালচাঁদের তিন-নম্বর পিসে—
উড়ের দেশে এ ছেলেটির বিদ্যে হবে কিসে।
অনেক খুঁজে মাষ্টার পেলেন, নামটি বাঞ্ছা ঘোষ,
নাকটা একটু থ্যাব্‌ড়া-পানা, এই যা একটু দোষ।
বললে দুলাল—“আপনার সার নাকটা কেন খাঁদা?
আপনি যদি পড়ান আমার বুদ্ধি হবে হাঁদা।”
বাঞ্ছানিধি হতাশ হয়ে ফিরে গেলেন ঘরে,
নাক-লম্বা গোবর্ধন এলেন দু-দিন পরে।
দুলাল বলে—“আপনার সার খাঁড়ার মতন নাক,
নাকের খোঁচায় শেষে আমার বুদ্ধি ছিঁড়ে যাক!”
গোবর্ধন বরখাস্ত হলেন চাকরি থেকে,
পিসে তখন ব’লে দিলেন চাপরাসীকে ডেকে—
জলদি লে আও এসা মাষ্টার নাক নেই যার মোটে,
কটক পুরী দিল্লি লাহোর যেখান থেকে জোটে।”

চাপরাসীটা পাগড়ি বেঁধে বন্দুক ঘাড়ে ক’রে
অনেক দেশে দেখলে খুঁজে একটি বছর ধ’রে।
তার পরেতে ফিরে এসে বললে—“হুজুর সেলাম,
নাক নেই যার এমন মানুষ কোত্থাও না পেলাম।
কিন্তু অনেক চেষ্টা ক’রে দুলালবাবুর তরে
ধরেচি এই ওস্তাদকে মহানদীর চরে।
নাকের বালাই নেই, কিন্তু আওয়াজটি এঁর খাসা,
শিখিয়ে দিতে পারবেন খুব উর্দু ফার্সী ভাষা।”
চাপরাসী তার লাল বটুয়ার মুখ করলে ফাঁক,
অবাক হয়ে শুনলে সবাই গুরুগম্ভীর ডাক।
আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল লম্বা দুটো ঠ্যাং,
বটুয়া থেকে লাফ দিলে এক মস্ত কোলা ব্যাং।
ব্যাং বললে—“আয় রে দুলাল পড়বি আমার কাছে।”
কোথায় দুলাল? লেপের ভেতর ঐ যে লুকিয়ে আছে।
দুলালচাঁদের রকম দেখে কষ্ট পেয়ে মনে,
ব্যাং বেচারা পালিয়ে গেল খণ্ডগিরির বনে।
দুলাল তখন ইষ্টিশানে গিয়ে এক্কেবারে
কোলকাতাতে রওনা হ’ল পুরী-প্যাসেঞ্জারে।

পটোলডাঙায় দু-তিন বছর হয়ে গেল শেষ,
বিস্তর বই পড়লে দুলাল, বুদ্ধি হ’ল বেশ।
কিন্তু হঠাৎ একদিন তার খেয়াল হ’ল মনে—
“এখানে নয়, পড়ব আমি শান্তিনিকেতনে।”
ভালমানুষ হলেও দুলাল বড়ই জেদী লোক,
যা চাইবে করবেই তা যেমন ক’রেই হোক।
ছোটকাকার সঙ্গে দুলাল জিনিস-পত্র নিয়ে,
শান্তিনিকেতনের ক্লাসে ভর্তি হ’ল গিয়ে।
ইংরিজী আর বাংলা কেতাব পড়লে একটি রাশ,
পাটীগণিত ব্যাকরণ আর ভূগোল ইতিহাস।
দিনুঠাকুর শিখিয়ে দিলেন গানের অনেক সুর,
তাকাগাকি শিখিয়ে দিলেন কায়দা যুযুৎসুর।
নন্দলালের কাছে দুলাল আঁকতে শিখলে ছবি,
আর সমস্ত যা যা আছে শিখিয়ে দিলেন কবি।

অনেক রকম শিখলে দুলাল শান্তিনিকেতনে,
গায়ে হ’ল ভীষণ জোর আর অসীম সাহস মনে।
গোমড়া-মুখো মাষ্টার যাঁর সদাই হাতে বেত,
নাকে কথা বলেন যাঁরা—ভূত পেত্নী প্রেত,
পা-ফাটা সেই কানকাটা যে থাকে খেজুর গাছে,
ছোট ছেলের কান ধ’রে যে যখন-তখন নাচে,
বাঘ ভালুক সাপ ব্যাং আর ভিমরুল আর বিচ্ছু—
এসব দেখে দুলালের আর ভয় করে না কিচ্ছু।
কারণ, দুলাল জানে ওরা সবাই জুয়োচ্চোর,
আর, দুলালের সাহস আছে, গায়ে ভীষণ জোর।

তারপরেতে বোশেখ মাসের তেসরা রবিবারে,
ঠিক দুপ্পুরবেলা যখন ভূতে ঢেলা মারে,
সকল দিক নিঝুম যখন রোদ্দুরে কাঠফাটে,
জুজুর খোঁজে দুলাল গেল তেপান্তরের মাঠে।
জুজু তখন ঘুমুচ্ছিল ভিজে গামছা প’রে;
সাড়া পেয়ে বেরিয়ে এল ষাঁড়ের মূর্তি ধ’রে—
কাঁধের ওপর মস্ত ঝুঁটি, শিং দুটো খুব লম্বা,
দৌড়ে এসে ঘাড় বেঁকিয়ে ডাক ছাড়লে—হম্বা।

তেড়ে গিয়ে বললে দুলাল—“শোন্ রে জুজু হাঁদা,
চেহারা তোর ষাঁড়ের মতন, বুদ্ধিতে তুই গাধা।
যুযুৎসুতে শিক্ষা আমায় দিলেন তাকাগাকি,
জুজুর বুদ্ধি নিয়ে আমার সঙ্গে লড়বি নাকি?
শিং ধ’রে তোর দুমড়ে দিয়ে লাগাই যদি চাড়,
হুমড়ি খেয়ে পড়বি তখন ওরে গর্দভ ষাঁড়।
আমার সঙ্গে লড়তে এলি মুখ্‌খু কে তুই রে?
জানিস, আমি পটোলডাঙার দুলালচন্দ্র দে!”

ফটাস ক’রে ষাঁড়ের তখন পেটটা গেল ফেটে,
ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন মানুষ একটি বেঁটে।
পরনে তাঁর পেন্টুলুন হ্যাট কোট নেকটাই,
হাতে একটি নিরেট খাতা চামড়ার বাঁধাই।
বুকের ওপর দশটা মেডেল, ফাউন্টেন পেন ছ-টা,
হাত-ঘড়িতে কেবল দেখেন বাজল এখন ক-টা।

দুলাল জানে ভদ্রলোকের সঙ্গে ব্যবহার;
দু-হাত তুলে বললে তাঁকে—“মশাই নমস্কার।
মাপ করবেন, আপনাকে সার গাল দিয়েচি যা—
ষাঁড়ের পেটে আপনি ছিলেন তা তো জানতুম না।”

ঘাড়টি নেড়ে জবাব দিলেন জুজু মহাশয়—
“ছেলেদের সব কাণ্ড দেখে বড়ই দুখ্‌খু হয়।
এই দুপুরে জিওমেট্রির অঙ্ক-কষা ফেলে
রোদ্দুরেতে টো-টো কর, কেমন তুমি ছেলে?
পরখ ক’রে দেখচি তোমার বিদ্যে কত দূর,
এই চারটে কোশ্চেনের দাও দেখি উত্তুর—
তিরিশ টাকায় ছ-মণ হ’লে আড়াই সেরের কি দাম?
বল দেখি শাজাহানের চারটি ছেলের কি নাম?
বল দেখি কোন দেশেতে আছে শহর মক্কা?
বল দেখি সন্ধি কি হয়—‘এতদ্’ ছিল ‘ঢক্কা’?”

বললে দুলাল—“আড়াই সেরের পাঁচ আনা হয় দাম।
দারা সুজা আরংজেব আর মুরাদ—এই চার নাম।
সবাই জানে আরব দেশে আছে শহর মক্কা।
‘এতদ’ ছিল ‘ঢক্কা’—হ’ল সন্ধি ‘এতড্‌ঢক্কা’।”

জুজু বললেন—“ভুল করনি বেশী জবাবেতে;
শিখতে যদি আমার কাছে ফুল-নম্বর পেতে।
মন দিয়ে খুব পড় খোকা, যাচ্চি আমি আজ;
সেনেট-হলে আমার এখন আছে একটু কাজ।”
দুলাল বলে—“থামুন মশাই, অনেক সময় পাবেন।
এই গরমে দুপুরবেলা রোদে কোথায় যাবেন?
এই বারেতে আমার পালা, বলুন দেখি সার—
এই চারটে কোশ্চেনের ঠিক ঠিক আনসার—

রাবণ-রাজার দশ মুণ্ডু, নড়বড়ে বিশ হাত,
কেমন ক’রে বিছানাতে হতেন তিনি কাত?
গঙ্গা-নদী মহাদেবের জটায় করেন ঘর,
ভিজে চুলে শিবের কেন হয় না সর্দি জ্বর?
সে কোন্ ঘোড়া ডিম পাড়ে যে বাচ্চার বদলে?
ভূতের যিনি বাবা তাঁকে সক্কলে কি বলে?”

ঘাড় চুলকে জুজু বলেন—“তাইতো খোকা তাইতো,
জানতে তুমি চাচ্চ যে-সব, আমার মনে নাইতো।
আচ্ছা, তুমি দিন আষ্টেক থাক চক্ষু বুঁজে
বিস্তর বই আছে আমার, দেখব আমি খুঁজে।”

দুলাল বললে—“দুও মশাই, হেরে গেলেন, দুও!
দরকারী যা সে-সব খবর জানেন না একটুও।
বলচি শুনুন—টুকে নিন সার আপনার খাতাটিতে,
কাজে লাগবে ভবিষ্যতে সভায় স্পীচ দিতে।—

রাবণ-রাজার পাগড়ি ঘিরে ন-টা সোলার মাথা,
আঠারোটা কাঠের হাত জামার সঙ্গে গাঁথা।
শুতেন খুলে পাগড়ি জামা, নকল মুণ্ডু হাত,
অনায়াসে বিছানাতে রাবণ হতেন কাত।
মাথায় মেখে বেলের আঠা আর ঘুঁটের ছাই,
শিবের জটা ওয়াটার-প্রুফ, সর্দির ভয় নাই।
পক্ষীরাজ ঘোটকের পক্ষীরাণী যিনি,
অন্য অন্য পাখীর মতন ডিম পাড়েন তিনি।
সকল ভূতের বাবা যিনি আবাগে তাঁর নাম,
তাঁর শ্রাদ্ধে হয়ে থাকে খুবই ধুমধাম।”

জুজু মশাই বলেন তখন—“হার মানলুম খোকা,
তুমিই হ’লে পণ্ডিত, আর আমিই হচ্চি বোকা।”
এই-না ব’লে মাটির ওপর ছ-বার লাথি ঠুকে
জুজুমশাই পালিয়ে গেলেন ষাঁড়ের পেটে ঢুকে।

এই সমাচার জানতে পেরে সঙ্গীরা সব মিলে
দুলালচাঁদের পিঠ চাপড়ে খুব বাহবা দিলে।
জুজুর খবর রাষ্ট্র হ’ল পটোলডাঙা-ময়,
গোলদীঘিতে বললে সবাই দুলালচাঁদের জয়।
দুলালচাঁদের কথা এখন সাঙ্গ হ’ল ভাই,
সকল গল্প সত্যি যেমন, এ গল্পটাও তাই।
ব’লে গেলুম তাড়াতাড়ি যা মনেতে এল,
বিশ্বাস যদি না করে সেউ—বড় বোয়েই গেল।
মিথ্যে যদি বলেই থাকি, দোষটা তাতে কিসে?—
আমি হলুম দুলালচাঁদের চার-নম্বর পিসে।