7 of 8

থানা পুলিশ

থানা পুলিশ

বাড়িতে একাট ছোটমতো চুরি হয়ে গিয়েছিল, তাই নিয়ে থানার ডায়েরি করতে গিয়েছিলাম। পাড়ার মধ্যে থানা, কর্মচারীরা অনেকেই আমার পরিচিত। কাজ শেষ হওয়ার পরেও বসে গল্প করছি, এমন সময় এক ভদ্রলোক এলেন। খুব সন্ত্রস্তভাবে তিনি থানায় প্রবেশ করলেন, ঘরের ভিতরে ঢুকে দরজার কাছে একটা কোনা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলেন, এই রকম প্রায় দু’-তিন মিনিট।

‘থানায় ঢুকলেই লোকগুলো এমন সব ঘাবড়িয়ে যায়। যেন আমরা খেয়ে ফেলব।’ আমার সম্মুখস্থ দারোগাবাবু অত্যন্ত বিরক্তি সহকারে স্বগতোক্তি করলেন, তারপরে সদ্য প্রবেশকারী ব্যক্তিটিকে ডাকলেন, ‘ও মশাই, হ্যাঁ-হ্যাঁ, আপনাকেই ডাকছি। কাকে চাই? চুরি-ডাকাতি-খুন কী হয়েছে?

দারোগাবাবুর প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক টেবিলের দিকে এগিয়ে এলেন বটে কিন্তু ততক্ষণে তাঁর মুখের রং যাকে বলে চকখড়ির মতো সাদা, ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কথাকলি নাচে অত্যন্ত দক্ষ নটীরা যেভাবে সর্বাঙ্গ আন্দোলিত করে প্রায় সেইভাবে মিনিটে অন্তত তিরিশের গতিতে সমস্ত শরীর কাঁপছে।

এসে টেবিলের উপর হাতে রেখে দাঁড়ালেন। হাতের পাতা দুটো পদ্মপত্রে জলের মতো টলমল করছে, কিছুতেই স্থির থাকছে না। চিরটাকাল সসম্ভ্রমে বাইরে থেকে থানা পুলিশের সীমানা এড়িয়ে গেছেন, আজ খুবই দুর্বিপাকে পড়ে এখানে হাজির হতে বাধ্য হয়েছেন। ভদ্রলোকের মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে, না এলেই ভাল হত। এ-আমার-কর্ম নয়, এই গোছের একটা ভঙ্গি তাঁর আন্দোলিত, কম্পিত মুখের ছাপে অত্যন্ত স্পষ্ট।

দারোগাবাবু লোক খারাপ নন বরং বলা যেতে পারে বেশ ভাল লোক। পুলিশের লোক বলতে যা বোঝায় ঠিক তা নন, হৃদয়ে বেশ মায়াদয়া আছে। তিনিও আগন্তুক ভদ্রলোকের অবস্থাটা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছেন। তাড়াতাড়ি একটা চেয়ার এগিয়ে দিলেন, ‘বসুন।’

ভদ্রলোক কাঁপতে কাঁপতেই বসে পড়লেন। স্থির হওয়ার জন্যেই বোধহয় মিনিট খানেক সময় দিয়ে দারোগাবাবু ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এক গ্লাস জল খাবেন?’

‘জল’, অকূল সমুদ্রে দ্বীপ দেখতে পেলে পুরাকালের নাবিকেরা যেমন আকুল হয়ে উঠত, আগন্তুকের কণ্ঠে সেই আকুলতা ফুটে উঠল। জল এল, হাতের কাঁপুনি এখনও থামেনি। সবটা জল ঠোঁটের ভিতর দিয়ে গড়িয়ে গেল না, কিছু বাইরেও ছড়াল। জল খেয়ে নিজের অজান্তেই অত্যধিক উত্তেজনায় ভদ্রলোক কাচের গেলাস টেবিলের ওপর এত জোরে নামালেন যে, আর দেখতে হল না, গেলাসটা চৌচির হয়ে গেল।

‘দাম, আমি দাম…’ ভদ্রলোক বোধহয় বোঝাতে চাইলেন, গেলাসের দামটা তিনি দিয়ে দেবেন, কিন্তু গলা ফুটে এর বেশি কিছু শব্দ বের হল না।

অসীম নিস্তব্ধতা, একটা পুলিশ ফাঁড়ির অফিস-ঘরের পক্ষে যা প্রায় অসম্ভব বলেই বোধহয়, তারই মধ্যে মিনিট দুয়েক অতিবাহিত হল। সবাই চুপচাপ। ঘরের মধ্যে যারা ছিল সবাই আগন্তুক দুর্বলচিত্ত ব্যক্তিটিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।

দারোগাবাবুই আবার নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন, দায়িত্বও তাঁর। তিনি সরকারিভাবে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার নাম?’

ভদ্রলোকের ঠোঁট কাঁপতে লাগল, কী যেন বিড়বিড় করলেন, আমি পাশেই বসেছিলাম, আমার কানে এল, ‘জনার্দন পাল, ২৬ গোপাল মুখার্জি লেন’।

দারোগাবাবু বোধহয় ভাল শুনতে পাননি, ‘জোরে বলুন, কানে শুনতে পাচ্ছি না।’

এইবার ভদ্রলোক প্রায় স্পষ্ট করে বললেন, ‘গোবর্ধন পাল’, অবশ্য ঠোঁট তেমনই কেঁপে চলেছে।

আমার কেমন যেন মনে হল, আমি বললাম, ‘আপনি এইমাত্র জনার্দন পাল বললেন না?’

ভদ্রলোক একটু থেমে বললেন, ‘আজ্ঞে ওটা আমার বাবার নাম। এর পরেই দারোগাবাবু জিজ্ঞাসা করবেন তো, তাই বাবার নাম আর বাড়ির ঠিকানা মনে আছে কিনা, একটু ঝালিয়ে নিলাম।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *