শুঁটকি বাহিনী – পরিচ্ছেদ ৯

০৯.

 কয়েক রাত পর। মুসাদের ডাইনিং রূমের টেবিলে হুমড়ি খেয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। সবাই মিলে হোমওঅর্ক করছে। মুসার বাবা-মা বাড়ি নেই। বাড়িতে সে একা। তাই ফোন করে আনিয়ে নিয়েছে দুই বন্ধুকে। তিনজনেই গভীর মনোযোগে অঙ্কের সমস্যা সমাধানে ব্যস্ত।

এই সময় দরজার ঘণ্টা বাজল। এতটাই চমকে গেল মুসা, কাগজে চাপ লেগে পেন্সিলের সীস ভেঙে গেল। হঠাৎ করেই মনে হলো তার, নিশ্চয় টেরির দল। আবার এসেছে তার সাহস পরীক্ষা করতে।

এত আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই-মনে মনে নিজেকে বোঝাল মুসা। দেখাই যাক না আগে কে এসেছে।

উঠে দরজা খুলতে এগোল সে। পেছন পেছন চলল কিশোর।

দরজা খুলে দিল মুসা। ঠিকই অনুমান করেছে সে। টেরির বাহিনীই। ঘরে ঢুকল টাকি। গায়ে নীল জ্যাকেট। মাথায় উলের স্কি হ্যাট। বাপরে বাপ, বাইরে কি ঠাণ্ডা!

টান দিয়ে টুপিটা খুলে নিয়ে অস্বস্তিভরে চারপাশে তাকাতে লাগল সে। মুসা, সত্যি ভাই, আমি দুঃখিত। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি ওকে। থামাতে পারিনি?  

তাই নাকি? মুসার আগেই জবাব দিল কিশোর, কিসের দুঃখ? কাকে থামাতে পারনি।

উঠে এসে রবিনও দাঁড়াল ওদের পেছনে। আরে ধূর, কিসের থামাথামি! হাত নেড়ে বলল সে। বুঝতে পারছ না, নাটক করে মুসাকে ঘাবড়ে দেয়ার চেষ্টা করছে।

কিন্তু তাতে কোনই লাভ হবে না, বুড়ো আঙুল নাড়ল কিশোর। ঘটে সামান্যতম ঘিলু থাকলে এতদিনে বুঝে যাওয়া উচিত ছিল ওদের, মুসাকে ওরা ভয় দেখাতে পারবে না।

 কিন্তু, দেখো, কিশোর, শান্তকণ্ঠে বলল টাকি, মুসা তোমার বন্ধু। উত্তেজিত করে করে এ ভাবে ওকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দেয়া তোমার উচিত হচ্ছে না। তোমরা জানো না টেরি এবার কি করতে চলেছে। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি ওকে। শুনল না। সে করবেই করবে। এ বাজি তাকে জিততেই হবে।

অজানা আশঙ্কায় মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল শিহরণ বয়ে গেল মুসার। সেদিন স্কুলে আড়ালে দাঁড়িয়ে শোনা কথাগুলো মনে পড়ে গেল। ভাঁজ হয়ে আসতে চাইল হাট। টাকি যাতে বুঝতে না পারে, সেভাবে সরে গিয়ে একটা কাউচের হেলান খামচে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। ভাবছে, বাদ দেয়া দরকার এ খেলা! টেরিকে বিশ্বাস নেই। বাজি জেতার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে সে। কি করবে কে জানে!

আমি টেরির সঙ্গে একমত হতে পারলাম না বলেই তোমাদের সতর্ক করে দিতে এলাম, টাকি বলল। ভয়ানক কোন বিপদ যদি ঘটে যায় পরে আমাকে দোষ দিতে পারবে না।

ঢোক গিলল মুসা।

ভয়ানক কোন বিপদে যদি পড়ে কেউ, শীতল কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর, তো পড়বে তোমার ওস্তাদ শুঁটকি আর বাকি চামচাগুলো। মুসার কিছু হবে না। তোমার ওস্তাদকে গিয়ে বলে দাও, ইচ্ছে সে করতে পারে। তবে এবার আর টাকা মাপ করব না আমরা। দুশো ডলার যেন রেডি রাখে।

টাকাটা বরং তোমরাই নিয়ে যেয়ো পকেটে করে। মুসার দিকে তাকাল টাকি, মুসা, মনে রেখো বিপদটা তোমার হবে, আর কারও না।

কটাক্ষটা যে তাকে উদ্দেশ্য করেই করা হয়েছে, বুঝতে পারল কিশোর। তুমি আসলে বেশি কথা বলো। কে বলেছে তোমাকে ভালমানুষী দেখাতে আসতে? মুসা চ্যালেঞ্জটা নিয়েছে, যত বিপজ্জনকই হোক। ওসব বোলচাল না ঝেড়ে কি করতে হবে এখন তাকে, সেটা বলো।

হতাশ ভঙ্গিতে জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল টার্কি। টুপিটা মাথায় দিল আবার। যাবেই?

মাথা ঝাঁকাল কিশোর, হ্যাঁ।

বেশ। কোট-টোটগুলো পরে এসো আমার সঙ্গে।

*

টাকির সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। দরজায় তালা দিল মুসা। ওর বাবার কাছে বাড়তি চাবি আছে। দরজা খুলতে অসুবিধে হবে না।

অক্টোবরের ঠাণ্ডা রাত। তা ছাড়া শীতটা এবার তাড়াতাড়ি পড়াতে ঠাণ্ডাটা জাকিয়ে বসেছে। তার ওপর রয়েছে ঝোড়ো বাতাস, লনের শুকনো ঝরা পাতায় ঘূর্ণি তুলছে। পাতাহারা শূন্য গাছগুলো বাতাসের ঝাপটায় যেন পাতার শোকেই গুঙিয়ে উঠছে বারবার, বিচিত্র শব্দে আর্তনাদ করছে।

বৃষ্টির দুচারটা ঠাণ্ডা ফোঁটা এসে পড়ল মুসার কপালে। গায়ের কালো পারকাটার জিপার টেনে দিল সে। মাথায় তুলে দিল হুড।

টাকির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মোড়ে চলে এল তিন গোয়েন্দা। সশব্দে বড় রাস্তা ধরে চলে গেল একটা বাস। ভেতরে যাত্রী মাত্র। দুতিনজন।

বাসটা চলে গেলে নির্জন রাস্তা পেরোল ওরা। হাঁটতে থাকল।

কোথায় চলেছে জানে মুসা। আগেই ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে টেরি। বলার সময় টেরির তিলে ভরা মুখটার উজ্জ্বলতা কল্পনা করে মনে মনে দমে গেল সে।

একটা পার্কিং লটের পেছনে পাতাবাহারের বেড়ার কাছে এসে থামল ওরা। ওপাশে অন্ধকার লম্বা একটা বিল্ডিং। সামনে কাঠের সাইনবোর্ডের ওপর জ্বলছে হলুদ স্পটলাইট। লেখাগুলো পড়া যায়: দা এন্ডলেস স্লীপ!

অনন্ত ঘুম! বাংলায় বিড়বিড় করল কিশোর।

ফিরে তাকাল রবিন। বুঝতে পারল, বোর্ডের লেখাগুলোর বাংলা অনুবাদ করেছে কিশোর। চুপ করে রইল।

ফিউনরল পারলারটার মালিক টেরির বাবা।

বাড়িটার দিকে তাকিয়ে গায়ে কাঁটা দিল মুসার। ভেতরে কি লাশ আছে এখন? মানুষের মৃতদেহ? নিশ্চয় আছে-নিজের প্রশ্নের জবাব নিজেই দিল মনকে মুসা। ফিউনরল পারলার মানেই তো লাশ রাখা, কবর দেয়ার আগে গোসল করানো, কাপড় পরানো, সুগন্ধি মাখিয়ে কফিনে ভরার জন্যে তৈরি করার জায়গা।

পারকার পকেটে যতটা যায়, হাত দুটো ঠেলে ঢোকাল সে। পাশে দাঁড়ানো কিশোরের দিকেও তাকাতে ইচ্ছে করছে না। টেরিকে এতখানি আগে বাড়তে দেয়ার জন্যে সে-ই দায়ী। কি দরকার ছিল এ সব বাজি ধরাধরির!

অ্যাই যে, এসে গেছে আমাদের সুপারহিরো! কানের কাছে কথা বলে উঠল কডি, চাপড়ে দিল মুসার পিঠ।

এত চমকে গেল মুসা, মনে হলো দশ হাত শূন্যে লাফিয়ে উঠেছে।

ছায়া থেকে বেরিয়ে এল নিটু আর হ্যারল্ড। কডির পাশে দাঁড়াল।

 টেরি কোথায়? জানতে চাইল কিশোর।

এক ঝলক ঝোড়ো বাতাস কাঁপুনি তুলল পাতাবাহারের বেড়ায়। আধো অন্ধকারে বেড়ার ওপরের অংশের কাঁপুনি দেখে মনে হলো এঁকেবেঁকে চলে গেল একটা বিরাট সাপ। বাতাসের ঝাপটায় মাথার হুড পেছনে খসে পড়ল মুসার। সঙ্গে সঙ্গে কপালে লাগল বৃষ্টির ফোঁটা।

টেরিকে আটকে ফেলেছে, জবাব দিল টাকি।

আটকে ফেলেছে? মুসা অবাক। কই, আগে তো বলনি?

মাথা ঝাঁকাল টাকি, হ্যাঁ, আটকে ফেলেছেন, ওর বাবা। চুপি চুপি বেরোতে যাচ্ছিল টেরি, ধরা পড়ে গেছে।

মজাটা আর উপভোগ করতে পারল না আজকে, হেসে বলল কডি।

 মজা না ছাই! তেতো হয়ে গেছে মুসার মন।

চিন্তা কোরো না, মুসা, কড়ি বলল। ত্রাহি চিৎকার করে কিভাবে ছুটে পালিয়েছ তুমি, মুখে বলেই সেটার ছবি দেখিয়ে দেব আমরা ওকে।

ত্রাহি চিৎকার মুসা নয়, তোমরা করবে, গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। সেই সঙ্গে মাতম। চাপড়ে চাপড়ে রক্তাক্ত করে ফেলবে কপাল, এতগুলো টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার শোকে।

ফিউনরল পারলারের দিকে তাকাল আবার মুসা। সাধারণ দেখতে, অনেক লম্বা, একতলা একটা বাড়ি। অস্বাভাবিক কিছু নেই। কিন্তু মুসার কাছে ভয়ানক অস্বাভাবিক লাগল। কালো, অশুভ, ভুতুড়ে একটা বাড়ি-হরর সিনেমার বাড়িগুলোর মত।

ভেতরে সারি দিয়ে রাখা কফিনগুলো কল্পনা করল সে। ধাতব টেবিলে চিত করে ফেলে রাখা অসংখ্য লাশ।…কফিনের ডালা একের পর এক উঠে যেতে শুরু করল…দেখা দিল পচে বিকৃত হয়ে যাওয়া লাশের মাথা… সবুজ হয়ে যাওয়া লাশগুলো বেরিয়ে আসতে লাগল…টলছে, গোঙাচ্ছে। এগিয়ে আসতে লাগল মাংস খসে পড়া ফোলা ফোলা হাত বাড়িয়ে দিয়ে। বড় বড় ময়লা নখওয়ালা আঙুলগুলো বাঁকা করে রেখেছে তাকে খামচে ধরার জন্যে। বসে যাওয়া কোটরে নিষ্প্রাণ চোখগুলোর দিকে তাকানো যায় না…।

থামো! আর এগিয়ে না! নিজেকে ধমকে উঠল মুসা। মনে মনে। বেপরোয়া কল্পনার রাশ টেনে থামানোর চেষ্টা করল।

ঢোক গিলল একবার। মাথা ঝাড়া দিল। হাত দিয়ে মুছল বৃষ্টি ভেজা কপাল। টাকির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি করতে হবে আমাকে, বলো!