শুঁটকি বাহিনী – পরিচ্ছেদ ৫

০৫.

বের করার জন্যে হাত মোচড়াতে শুরু করল মুসা। শক্ত হয়ে গেছে মুঠো।

যত চেষ্টা সব বিফল। হাত আর বেরোল না।

 দুই মিনিট, ঘোষণা করল টাকি।

কি করছ তুমি? ভুরু নাচাল টেরি। হাত নাড়াচ্ছ কেন ওরকম করে?

 মাথা ঝাঁকাল মুসা।

দেখলে তো? হাসিমুখে টেরির দলের দিকে তাকাল কিশোর। মুসার সাহস দেখলে! পাগলের মত কামড়াচ্ছে, তা-ও হাত বের করছে না ও!

পারলে তো কখন বের করে ফেলতাম!-কাঁদতে ইচ্ছে করছে মুসার।

আবার বের করার চেষ্টা করল হাতটা। পারল না। আটকেছে ভালমতই।

রবিন শঙ্কিত হয়ে আছে, বিষের ক্রিয়ায় কখন চোখ উল্টে দিয়ে পড়ে যায় মুসা। ভয়ঙ্কর এ খেলা ভাল লাগছে না তার।

বুড়ো আঙুলে কামড় মারল একটা মাকড়সা। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করল মুসা। চিৎকার করল না।

বের করা দরকার হাতটা! কি করা যায়। বাড়ি মেরে ভেঙে ফেলবে নাকি বয়ামটা?

কিশোর কোন সাহায্য করবে না, বুঝে গেছে। রবিনের দিকে তাকাল।

অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রবিন। একেবারে চুপ। বোবা হয়ে গেছে যেন। কি করবে সে-ও বুঝে উঠতে পারছে না। একটা ব্যাপার বুঝতে পারছে, টেরির কাজিন নিনা সত্যি কথাই বলেছে, যতই হেসে উড়িয়ে দেয়ার ভান করুক না কেন কিশোর। আজ যদি মুসা বাজিটা হারে, খেপানো শুরু হবে তাকে। গ্রীনহিলসের মত এখানেও জীবনটা নরক হয়ে যাবে ওর।

মুসার হাতের দুই পাশ দিয়েই এখন ওঠানামা করছে মাকড়সাগুলো। কব্জির কাছে ঘোরাফেরা করছে।

আবার তীক্ষ্ণ ব্যথা। আবার কামড়।

হাতটা বের করতে না পারলে নিস্তার নেই।

মাথা ঘুরছে মুসার। ঘরটা পাক খাচ্ছে চরকির মত। বেহুঁশ হয়ে যাবে না তো!

সুড়সুড়ি আর চুলকানি কোনমতে সহ্য করেছে। কিন্তু কামড়? এক কামড় খেয়েই তো মরতে বসেছিল। ভয়টা তখন থেকেই বেড়েছে। ভয় পাওয়াটা রোগ হয়ে গেছে। গ্রীনহিলসে নদীর ধারে বসে মাছ ধরছিল। গাছের ওপর থেকে টুপ করে ঘাড়ে পড়েছিল একটা মাকড়সা। কামড়ে দিল। থাবা দিয়ে ওটাকে ঘাড় থেকে ফেলে তীক্ষ্ণ ব্যথাটা ডলে সারানোর। চেষ্টা করেছিল সে। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা শুরু হলো। মাথা ঘুরতে লাগল। এবং বেহুঁশ।

চব্বিশ ঘণ্টা পর হাসপাতালে জ্ঞান ফিরল। ডাক্তার বললেন, ভাগ্যিস ওটা ব্ল্যাক উইডো স্পাইডার ছিল না। তাহলে মরে যেত মুসা। তবে যেটাতে কামড়েছে সেটাও কম বিষাক্ত নয়। মুসার ভাগ্য ভাল, সময়মত চিকিৎসা পেয়েছে। নইলে বাঁচা কঠিন হয়ে যেত।

তিন দিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল সে। কামড়ের জায়গাটায় টিপ দিলে ব্যথা লাগত। এক মাসেরও বেশি ছিল সেই ব্যথা। সবই জানে কিশোর। তারপরেও মাকড়সার বয়ামে হাত ঢোকাতে তাকে বাধ্য করল!

মাথা ঘুরছে। তারমানে এই মাকড়সাগুলোও বিষাক্ত!…যাচ্ছে…বেহুঁশ হয়ে যাচ্ছে ও…

পাঁচ মিনিট! ঘোরের মধ্যে শুনতে পেল টাকির ঘোষণা।

মাথা ঝাড়া দিল মুসা। পরিষ্কার করতে চাইল ভেতরটা।

গুঙিয়ে উঠল টেরি। মাথা নেড়ে তিক্তকণ্ঠে বলল, জিতেই গেল!

একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে লাগল পাঁচজনেই। হতাশ।

দুই হাত মাথার ওপর তুলে নাচতে লাগল কিশোর। চিৎকার করে বলল, রবিন, আমার জিতে গেছি! জিতে গেছি! পেয়ে গেলাম পঞ্চাশটা ডলার! ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন টাকার জন্যেই এতসব করেছে সে।

মুসার দিকে তাকাল। হয়েছে, মুসা। সময় শেষ। হাত বের করে আনো।

ঢোক গিলল মুসা। গলাটা শুকিয়ে তুষের মত খসখসে হয়ে গেছে। হৃৎপিণ্ডটা এত জোরে লাফাচ্ছে, কথা সরছে না মুখ দিয়ে।

বয়ামের মধ্যে ওর হাত আটকে গেছে যখন বুঝতে পারবে, কি করবে টেরি? বলবে, না হয়নি, আবার নতুন করে শুরু করো?

জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট চেটে মুসা বলল, না, বের করব না। আমার মজা লাগছে। আরও কিছুক্ষণ রাখব।

আঁ! হাঁ হয়ে গেল টেরি।

সব কটা চোখ এখন মুসার দিকে। সবগুলো চোখে বিস্ময়। ওর হাতের দিকে তাকাল রবিন। হাত বেয়ে উঠে আসছে মাকড়সাগুলো। বিড়বিড় করল, পাগল হয়ে গেল নাকি!

ঠিক, তা-ই হয়েছে! চিৎকার করে উঠল কডি। আতঙ্কে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তারমানে ভীতু…

কিশোর তার কথা কানেও তুলল না। দেখলে তো, টেরির পিঠে এত জোরে থাপ্পড় মারল সে, উপুড় হয়েই পড়ে যাচ্ছিল টেরি, আমাদের মুসা আমানের সাহস! পাঁচ মিনিট ওর জন্যে কিছু না। ও আরও রাখতে চায়। আরও পাঁচ মিনিট হয়ে যাক। কি বলো?

কিশোর, প্লীজ… বলতে গেল মুসা।

শুনল না কিশোর। দাও, টাকা দাও, টেরির দিকে হাত বাড়াল সে। পঞ্চাশ ডলার। কি ভেবে ফিরিয়ে আনল হাতটা। দাঁড়াও দাঁড়াও, সময়টা যেহেতু ডাবল করা হবে, টাকাটাও ডাবল…

কিশোর…কাতর অনুনয় ফুটল মুসার চোখে।

টাকার জন্যে ভাবছ তো? কিশোর বলল। কোন চিন্তা নেই। তোমার কাছে এখন না থাকলে আমি দিয়ে দেব। তবে আমারও দেয়া লাগবে না। জানি তো, তুমি হারবে না। টেরির দিকে তাকাল, কি, একশো ডলারের কথা শুনেই ঘেমে যাচ্ছ?

কি যে বলো! ঠিক আছে, দেবো একশো! রাজি হয়ে গেল টেরি।

মুসার হাতের ওপর হাঁটাহাঁটি করছে মাকড়সাগুলো। আবার কুট করে কামড়ে দিল একটা। ব্যথায় দপদপ করছে হাতটা।

মারা যাচ্ছি আমি!-হাল ছেড়ে দিল মুসা। আর বাঁচব না! আজ এই ঘরেই আমার মৃত্যু হবে! হায় খোদা, শেষ পর্যন্ত মাকড়সার কামড়ে মরণ লেখা ছিল আমার কপালে!

পরের বার অন্য কিছু ভেবে বার কোরো, টেরিকে উপদেশ দিচ্ছে কিশোর। তবে পারবে না। কোন কিছুকেই ভয় পায় না মুসা, হেসে রবিনের দিকে তাকাল। সমর্থনের আশায় বলল, তাই না, রবিন?  

মুখ চুন করে আছে রবিন। বুঝতে পারছে, টেরিকে খোঁচাচ্ছে কিশোর! উস্কে দিচ্ছে। প্রকারান্তরে সে নিজেই প্রস্তাব দিচ্ছে, আরেকটা বাজি হোক।

দশ মিনিটও শেষ।

হাসি উধাও হয়ে গেছে টেরি-বাহিনীর।

টেরিকে বলল কিশোর, যাও, তোমাদের একশো ডলার মাফ করে দিলাম। নিতে লজ্জা লাগছে। এত সহজ বাজি। মনে হচ্ছে টাকাটা নিলে ঠকানো হবে তোমাদের।

তাই নাকি? অপমানে মুখ কালো হয়ে গেল টেরির। বেশ, মনে থাকল কথাটা। পরের বার যাতে ভয় পায়, এমন কিছুই নিয়ে আসব।

বাজির টাকাটাও বাড়াতে হবে তাহলে।

বাড়াব। যত বলল। এত সহজে ছাড়া পাবে না ও।

হ্যাঁ, সুর মেলাল টাকি, পরের বার ওকে মু-ম্মুসা বানিয়েই ছাড়ব।

দলবল নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গেল টেরি।

মুসার দিকে তাকিয়ে হাসল কিশোর, কত সহজেই না টাকা রোজগার করা যায়, তাই না?

আমি যাচ্ছি মারা, আর তুমি করো টাকার চিন্তা! ককিয়ে উঠল মুসা। জলদি খোলো আমার হাত! বয়ামে আটকে গেছে!

মাথা ঝাঁকাল কিশোর, কিছু যে একটা হয়েছে, বুঝতেই পারছিলাম।

তাহলে পাঁচ মিনিটের পরই বিদেয় করে দিতে পারতে ওদের, ঝঝাল কণ্ঠে বলল রবিন।

জবাব দিল না কিশোর। মুসাকে বলল, তোমার হয়েছে আমাজনের বাদরের অবস্থা। জানো না কি করে বাদর ধরে ওরা?

দোহাই তোমার, কিশোর, লেকচার থামাও! চিৎকার করে উঠল মুসা। আগে বয়ামটা খোলার ব্যবস্থা করো। নইলে আজ ঠিক কবরে যেতে হবে আমাকে।

খোলার ব্যবস্থাই তো করছি। না শুনলে বুঝবে কি করে কেন আটকে আছে হাতটা? আমাজনের শিকারিরা একটা বাঁশের মধ্যে ফল রেখে দেয়। বানরে হাতটা ঢোকায়। ফলটা তুলে নিয়ে যতই বের করতে চায় হাত আর বেরোয় না। ফলও ছাড়ে না, হাতও বেরোয় না। প্রথমে লোভ, তারপরে আতঙ্ক। মাথা যায় গরম হয়ে। কি করবে বুঝতে পারে না। শিকারি এসে ধরে ফেলে। কেন এমন হয় জানো? হাতটা ঢোকানোর সময় আঙুলগুলো সোজা থাকে, সরু থাকে, ফলটা তুলে নিলেই মুঠো বড় হয়ে যায়, বাঁশের ফাঁকে আটকে যায়…

হাতের দিকে তাকাল মুসা। এখনও মুঠো করে আছে। খুলে নিল আঙুলগুলো। সহজেই বেরিয়ে এল হাতটা। ধপাস করে বসে পড়ল সোফায়। আ-আ-আমি একটা গা-গাধা!

গা-গাধাই হও আর যা-ই হও, সত্যি তোমার সাহস আছে…

ইয়ার্কি মারছ! আমি এদিকে মরে যাচ্ছি….উহ! হাত ডলতে লাগল মুসা।

 দেখি, কি হয়েছে? এগিয়ে এল কিশোর। হাতটা তুলে নিল। বাপরে, কি ফোলা ফুলেছে! আগে বের করা গেলে এটাও দেখাতাম টেরিদের-তোমার সাহসের আরও বড়াই করা যেত; এত যন্ত্রণার পরেও বের করনি বলে। যাকগে, যা গেছে গেছে…।

কিশোরের কাণ্ড দেখে রেগে গেল রবিন, তোমার হলো কি, কিশোর!…ফালতু কথা বাদ দিয়ে আগে দেখো কোন ক্রীমটিম আছে কিনা।

আছে, আছে। নিয়ে আসছি। দৌড়ে চলে গেল কিশোর।

মুসার দিকে তাকাল রবিন, বেশি ব্যথা করছে?

ব্যথার চেয়েও চুলকাচ্ছে বেশি।

হু, তারমানে বিষাক্ত না মাকড়সাগুলো।

 তা তো নয়ই। আমাকে যেটা কামড়েছিল সেটার মত হলে কখন মরে যেতাম…

আঁউক! করে এক চিৎকার দিয়ে উঠল মুসা।

 কি হলো! লাফ দিয়ে এগিয়ে এল রবিন।

জবাব না দিয়ে পাগলের মত জামার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে হাতড়াতে শুরু করল মুসা। একটা মাকড়সা বের করে এনে ছুঁড়ে ফেলে দিল মেঝেতে। রাগের চোটে পা দিয়ে মাড়িয়ে ভর্তা করল। কার্পেট নষ্ট হওয়ার পরোয়া করল না। মেরিচাচীর বকা খাবে এখন কিশোর। দুঃখ অনেকটা কমল ওর।

ক্রীম নিয়ে ফিরে এল কিশোর। হাতটা লম্বা করো, মাখিয়ে দিই।

ওষুধের প্রভাবে চুলকানিটা কমল। তবে কামড়ের কারণে যে সব জায়গা ফুলে গেছে ওগুলো ফুলেই রইল।

মাকড়সাগুলো বিষাক্ত ছিল না, দেখেই চিনেছিলাম… কিশোর বলল। বাথরূমে গিয়ে ঠাণ্ডা পানি ঢালো, সেরে যাবে। আমি দেখি, ফ্রিজে কি কি পাওয়া যায়।

থাক, আর লোভ দেখাতে হবে না, উঠে দাঁড়াল মুসা। গরু মেরে জুতো দান!

বাথরূমে এসে ঢুকল মুসা। পানি ঢালায় সত্যি কাজ হলো। আয়নার দিকে তাকাল। কি রকম বিকৃত করে রেখেছে মুখটা। স্বাভাবিক করল। পরক্ষণে একটা কথা মনে পড়তে আপনাআপনি বিকৃত হয়ে গেল আবার।

হুমকি দিয়ে গেছে টেরি, পরের বার আর এত সহজে ছাড়বে না। কি নিয়ে যে হাজির হবে, খোদাই জানে!