শুঁটকি বাহিনী – পরিচ্ছেদ ৪

০৪.

মাকড়সা!

কালো, কুৎসিত, রোমশ অসংখ্য মাকড়সা কিলবিল করছে বয়ামটার মধ্যে। হেঁটে বেড়াচ্ছে বয়ামের দেয়ালে, একে অন্যের গায়ের ওপর।

মুসার নাকের কাছে বয়ামটা ঠেলে দিল টেরি। ঝাঁকি দিল বয়ামে। বয়ামের দেয়াল বেয়ে ওঠা মাকড়সাগুলো খসে পড়ল তলায়। প্রচণ্ড আক্রোশে খামচা-খামচি শুরু করে দিল।

মুসাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে টেরি, বুঝতে পারল কিশোর। থাবা দিয়ে টেরির হাত থেকে কেড়ে নিল বয়ামটা। মাকড়শাগুলো দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল, এত মাকড়সা জোগাড়ের কারণ? ভেজে খাও নাকি তোমরা?

খিকখিক করে হাসল টেরি। আমরা খাব কেন? তোমার দোস্তকে খাওয়াতে নিয়ে এলাম।

সাংঘাতিক রসিকতা করে ফেলেছে যেন টেরি। হাসাহাসি শুরু করে দিল তার দোস্তরা।

ভড়কে গেল মুসা। সর্বনাশ! সত্যি সত্যি খেতে বলবে নাকি!

ঘাবড়ে গেছে রবিনও। শুঁটকি-বাহিনীকে বিশ্বাস নেই। ওদের পক্ষে সব সম্ভব। মুসার জন্যে দুশ্চিন্তায় সাদা হয়ে গেল তার মুখ।

সেদিন বাজির কথা বললে না, কিশোরকে বলল টাকি। সেজন্যেই তো নিয়ে এলাম।

ভাল করেছ, আড়চোখে মুসার দিকে তাকাল কিশোর।

মুসার মুখ দেখে মনে হলো বেহুশ হয়ে যাবে। পোকা-মাকড়ের মধ্যে মাকড়সাকে সবচেয়ে বেশি ভয় তার। ভয়ঙ্কর-দর্শন প্রাণীগুলোর ওপর থেকে চোখ সরাতে পারছে না। একনাগাড়ে কামড়া-কামড়ি, খামচা-খামচি করে যাচ্ছে। অদ্ভুত ওগুলোর কুস্তি-যুদ্ধ।

তা কি করতে হবে মুসাকে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

কিছুই না, জবাব দিল টেরি। বয়ামের মধ্যে ওর হাতটা কেবল পাঁচটা মিনিট ঢুকিয়ে রাখতে হবে।

হাঁ হয়ে গেল মুসা। উঠে দৌড়ে পালানোর কথা ভাবতে লাগল। কানে এল কিশোরের কথা, কোন সমস্যা নেই। পাঁচ মিনিট কেন, পাঁচ ঘণ্টা বয়ামে হাত ঢুকিয়ে রাখতে পারবে মুসা। রবিনের দিকে তাকিয়ে সমর্থন চাইল, কি বলো, রবিন? মুসাকে আমরা চিনি।

মিনমিন করে কি বলতে গেল রবিন। তাকে থামিয়ে দিয়ে কিশোর বলল, মাকড়সাকে তুমি ভয় পাও, এই তো বলতে চাও? তা তো পাই। আমিও পাই। কিন্তু মুসা পায় না।

কিশোর, দোহাই তোমার, থামো!-বলতে গেল মুসা। বলতে পারল না।

মাকড়সাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। ভুরু নাচাল কিশোর, ভাবছ কি? ঢোকাও হাত। তোমার কতটা সাহস, দেখিয়ে দাও না শুঁটকিগুলোকে!

এক বিন্দু সাহস নেই আমার, তুমি তো ভাল করেই জানো!-বলতে ইচ্ছে করলু মুসার, পারল না। দাঁত চেপে রাখতে রাখতে চোয়াল ব্যথা হয়ে গেছে। মুক্তির উপায় খুঁজছে। উঠে ছুটে পালাবে দরজা দিয়ে? উঁহু, স্কুলে আর যেতে পারবে না পরদিন। টিকতে পারবে না রকি বীচে। রবিনের দিকে তাকাল অসহায় চোখে। সেখানেও সাহায্যের কোন আশা দেখল না। হঠাৎ কি যেন কি হয়ে গেল মগজে। ঝটকা দিয়ে হাত বাড়াল, দেখি, দাও বয়ামটা!  

সরিয়ে নিল কিশোর, আরে রাখো রাখো। আগে কথা শেষ করে নিই। টেরির দিকে তাকাল সে, কি বুঝলে? ভেবেছিলে মুসা আমান মাকড়সা দেখলেই কুঁকড়ে যাবে? বমি করে ফেলবে? কিংবা ছুটে পালাবে? কোনটাই তো করল না ও। প্রমাণ কি হলো না, ও যে ভয় পায়নি?

না, হলো না, জোরে জোরে মাথা নাড়ল টেরি। হাত ঢোকাতেই হবে। এবং পাঁচ মিনিট রাখতে হবে। এটাই শর্ত।

কত টাকা বাজি?

তুমিই বলো।

তুমি বলো।

দশ লাখ হলে কেমন হয়? হেসে বলল কডি।

কঠিন কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর, তোমাকে বেচলে হবে দশটা পয়সা? ফুটানি তো করো টেরির পয়সায়।

জ্বলে উঠল কডির চোখ। মুখ কালো করে ফেলল। কিন্তু কিশোরের কথার জবাব দিতে পারল না।

পঞ্চাশ ডলার? টাকি বলল।

তোমাকেই বা কথা বলতে কে বলেছে? খেঁকিয়ে উঠল কিশোর। আমি টেরির মুখ থেকে শুনতে চাই।

টেরি বলল, আমার আপত্তি নেই।

বয়ামটার দিকে তাকাল রবিন। দেয়াল বেয়ে উঠছে কালো কালো মাকড়সাগুলো। খসে পড়ছে। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিচেরগুলোর সঙ্গে মারামারি বেধে যাচ্ছে। যে যাকে পারছে কামড়াচ্ছে। বিষাক্ত হলে সর্বনাশ হবে। মস্ত ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে কিশোর। মুসাকে এ ভাবে বিপদের মধ্যে ঠেলে দেয়ার কারণ বুঝতে পারছে না।

আমারও না, টেরির কথার জবাব দিল কিশোর। তবে আরেকটু বেশি হলে ভাল হত। যাকগে, টাকাটা তো আসলে কিছু না। তোমরা দেখতে চাইছ মুসার সাহস।

দাও বয়ামটা, হাত বাড়াল টেরি।

দিয়ে দিল কিশোর।

টেবিলে রাখল সেটা টেরি। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ধাতব মুখটা খুলে ফেলল। সহকারীদের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, ঘড়ি দেখবে কে?

আমি, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল টাকি। অতি আগ্রহ তার। নিজের হাত ঘড়িটা নিয়ে এল চোখের সামনে।

মুসার দিকে তাকাল টেরি। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, পাঁচ মিনিট।

ঘড়ি ঠিক আছে তো ওর? কিশোরের প্রশ্ন।

 মাথা ঝাঁকাল টেরি, না থাকলে আরও পাঁচ-ছয়টা ঘড়ি আছে।

সবাই ঘিরে এল মুসাকে।

মাঝখানে এসে দাঁড়াল কিশোর। মুসার দিকে তাকিয়ে সাহস দিল, দাও হাত। কি হবে? মাকড়সার বিষেও যে তোমার কিছু হয় না দেখিয়ে দাও ওদের। গ্রীনহিলসে তো এতবড় মাকড়সাটা কামড়েছিল, মারা গেছ? মরনি। এগুলোর কামড়েও কিছু হবে না তোমার। নিশ্চিন্তে হাত ঢোকাও।

কিশোরের আচরণ অদ্ভুত ঠেকছে মুসার কাছে। ও তার সঙ্গে শত্রুতা করছে, না তার ভাল চায়, বুঝতে পারছে না। গ্রীনহিলসে বেড়াতে যাওয়া কিশোরের সঙ্গে রকি বীচের এই কিশোরকে মেলাতে পারছে না সে। কোথায় যেন একটা গণ্ডগোল!

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে টাকি। সেকেন্ডের কাটাটা বারোর ঘরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল, শুরু!

লম্বা দম নিল মুসা। হাত কাঁপছে। বয়ামের মধ্যে ঢোকানোর সময় দেখে ফেলবে না তো ওরা!

আঙুলের মাথা ঢোকাল প্রথমে। ঠাণ্ডা লাগছে কাঁচের ছোঁয়া। চোখ বন্ধ করে আচমকা হাতের পুরোটাই ঠেলে দিল ভেতরে।

কয়েক সেকেন্ড কিছুই ঘটল না।

তারপর হাতের উল্টোপিঠে সুড়সুড়ে অনুভূতি। চোখ মেলে দেখল হাত বেয়ে উঠতে শুরু করেছে মাকড়সাগুলো।

নিজের অজান্তেই গোঙানি বেরিয়ে এল মুখ থেকে। ঠেকাতে চেয়েছিল। পারল না। সেটা ঢাকার জন্যে জোর করে হাসি ফোঁটাল মুখে।

কপালে ঘাম জমছে। বেশি হয়ে গেলে ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়বে। ঘামাটা কি দেখতে পাচ্ছে কেউ?

না, বয়ামের মধ্যে হাতটা ছাড়া আর কোনদিকে চোখ নেই কারও।

হাতের তালুতে সুড়সুড়ি দিচ্ছে মাকড়সাগুলো। রোমশ পাগুলো বেয়ে বেয়ে উঠে আসছে কব্জির কাছে।

তিরিশ সেকেন্ড! ঘোষণা করল টাকি।

 মুসার মনে হলো তিরিশ বছর।

কম করে হলেও বারোটা মাকড়সা এখন আঁকড়ে ধরে আছে তার হাত। চামড়া চুলকাচ্ছে। সারা শরীরেই চুলকানিটা ছড়িয়ে পড়ল যেন।

এক মিনিট! চিৎকার করে জানাল টাকি।

এখনও চার মিনিট বাকি, টেরি বলল। হাসিমুখে মুসার দিকে ঝুঁকল। কি বের করে আনবে? না পারবে?

পারবে না!-বুঝে গেছে মুসা।

হাতের উল্টোপিঠে নাচানাচি শুরু করেছে মাকড়সাগুলো। কাঁটা কাঁটা রোমের খোঁচা লাগছে। দুটো মাকড়সা কব্জি পার হয়ে বেয়ে বেয়ে উঠে আসতে লাগল কনুইয়ের কাছে। থাবা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল ওগুলোকে। পা ধরে তুলে নিয়ে গিয়ে জানালা দিয়ে দুটোকেই বাইরে ফেলে এল কিশোর।

কুট করে কামড় মারল একটা মাকড়সা। ঝাঁকি দিয়ে হাতটা বের করে আনতে চাইল মুসা।

পারল না। বয়ামের মধ্যে আটকে গেছে হাতটা।