শুঁটকি বাহিনী – পরিচ্ছেদ ১৬

১৬.

সঙ্গে সঙ্গে নাকে এসে ধাক্কা মারল ফরমালডিহাইডের বিশ্রী, তীব্র বা গন্ধ। আগের দিনের চেয়ে অনেক বেশি। নাক টিপে ধরল সে। মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে লাগল।

 পেছনে খসখস শব্দ। তারপর জুতো পায়ে ধপ করে নামিয়ে নামল কেউ। বাইরে যারা ছিল সবাই জানালা গলে এক এক করে ঢুকতে শুরু করেছে।

আলো জ্বেলে দিল টেরি। ছাত থেকে ভূতের জ্বলন্ত কানা চোখের মত তাকিয়ে রইল ম্লান আলোটা। রহস্যময় করে তুলল ঘরের পরিবেশ। আলো আঁধারির খেলা। লম্বা লম্বা, উদ্ভট ছায়া সৃষ্টি করেছে টেবিল আর কফিনগুলোর আনাচে-কানাচে।

মুসার মনে হলো ওই ছায়ার মধ্যে ঢুকলে আর জ্যান্ত বেরোনোর আশা নেই। দ্বিধা করতে লাগল সে। কিশোরের দিকে তাকাতে মাথা ঝাঁকাল সে।

সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে কফিনের সারির দিকে এগোল মুসা। সবগুলোর ডালা নামানো। মলিন আলোতেও চকচক করছে কালো পালিশ করা বাক্সগুলোর গা।

কাঁধে হাতের চাপ পড়ল। ফিরে তাকাল মুসা। পিত্তি জ্বালানো কুৎসিত হাসিতে ভরে গেছে টেরির মুখ। সমস্যাটা কি তোমার? এত দ্বিধা কেন? ভয় লাগছে?

জবাব দিল না মুসা। কফিনের সারির ওপর দৃষ্টি স্থির। কাঁধে হাতের চাপ বাড়ল। চাইলে সুযোগ একটা দিতে পারি তোমাকে। ফিরে তাকাল মুসা। সুযোগ? মাথা ঝাঁকাল টেরি। বুঝতে পারছি, প্যান্ট ভেজানোর সময় হয়েছে তোমার। মেঝেতেও পড়বে। পরিষ্কার করবে কে? তারচেয়ে তোমাকে বেরিয়ে যেতে দেয়া উচিত।

হেসে উঠল তার সঙ্গীরা।

কার প্যান্ট খারাপ হয় আজ, দেখা যাবে, রহস্যময় কণ্ঠে বলল মুসা। ফালতু কথা বাদ দিয়ে কোটাতে ঢুকতে হবে তা-ই বলো! ।

চোখের পাতা সরু সরু হয়ে এল টেরির। গলাবাজিটা থাকবে না হে, কা-কা-কালটু মিয়া! বুড়োটা মরেছে বড় সাংঘাতিক মরা। ক্যান্সারে ভুগে ভুগে জ্যান্ত থাকতেই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল শরীরটা। তোমাকে অবশ্য বেশিক্ষণ সঙ্গ দিতে হবে না ওকে। হাত মেলাবে। তারপর কফিনে ঢুকে দুই গালে চুমু খাবে। ব্যস।…এসো আমার সঙ্গে।

মুসা ভয় পেয়েছে কিনা বুঝতে পারল না টেরি। অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ল, ভয় তো পেয়েছ বোঝাই যাচ্ছে। টাকাটা দিয়ে দাও আমাদের, চলে যাও। এখন দিলে আর পাঁচশো দিতে হবে না; আগের বার যেটা ছিল, দুশো-সেটা দিলেই চলবে।

মুসা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুঁটকিটার বকবক শুনছ কেন? ফরমালডিহাইডের চেয়ে বেশি দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে ওর গা থেকে, বমি আসছে আমার, শীতল কণ্ঠে কিশোর বলল। যাও, সেরে ফেলো কাজটা।

ফ্যাকফ্যাক করে হাসল টেরি। একটু পরেই বোঝা যাবে কার গা দিয়ে বেশি গন্ধ বেরোয়। ধোপাও ধুতে চাইবে না তোমাদের কাপড়।

কোন কফিনটাতে ঢুকতে হবে? জিজ্ঞেস করল মুসা।

একটা কফিনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল টেরি। সাহায্য করতে ডাকল টাকিকে। দুজনে মিলে চেপে ধরে তুলতে শুরু করল ভালাটা।

লাশটার ওপর চোখ পড়ল মুসার। ধড়াস করে উঠল বুকের মধ্যে।

চিত হয়ে শুয়ে আছে লাশটা। কালো স্যুট, সাদা শার্ট, কালো টাই। দুই পাশে লম্বা হয়ে পড়ে আছে হাত দুটো। আঙুলগুলো মোমের মত ফ্যাকাশে।

মাথার চুল উঠে গেছে রোগের কারণে। পাতলা ফুরফুরে চুলগুলো যত্ন করে আঁচড়ে দেয়া হয়েছে পেছন দিকে। ঠেলে বেরিয়ে আছে বড় বড় লাল তিলে ভরা কপাল। চোয়াল বসা। মুখে মাংস বলতে নেই। চোখ বোজা। ঠোঁটের রঙ দেখে মনে হয় ড্রাকুলার মত রক্ত খেয়েছিল, শুকিয়ে কালচে– বাদামী হয়ে আছে। মারা যাওয়ার আগে মুখের মধ্যে রক্ত চলে এসেছিল। বোধহয়, সেখান থেকেই দুএক ফোঁটা বেরিয়ে ঠোঁটে লেগে গেছে। মুখের চামড়ার রঙটাও স্বাভাবিক নয়, ফ্যাকাশে কমলা।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল মুসা। তারপর কফিনের ওপর ঝুঁকল।

 যাও, কিশোর বলল, কোন অসুবিধে নেই। সব ঠিক আছে।

ফিরে তাকাল মুসা, কি-কি-কিন্তু লা-লা-লাশটা যদি সত্যি সত্যি খামচে ধরে?

হেসে উঠল কডি। মুসার দিকে আঙুল তুলে বলল, কা-কা-ক্কালটু মুসার চেহারা দেখো। আজকে সত্যি সত্যি পেসাব করে দেবে।

হেসে উঠল নিটু আর হ্যারল্ড।

লাশের পায়ের দিকটাতে রয়েছে টাকি। ডালা থেকে হাত সরায়নি। সে হাসল না। লাশটার চকচকে কালো জুতো আলোয় চমকাচ্ছে। অস্বস্তিভরে তাকিয়ে আছে সেদিকে।

মুসাকে ডাকল টেরি, নাও, হাত মেলাও বুড়োর সঙ্গে। যদি সাহস থাকে।

ঢোক গিলল মুসা। লাশটার দিকে তাকিয়ে আছে চিন্তিত ভঙ্গিতে। মুখ তুলে দেখল বাকি কফিনগুলো।

ওগুলোর দিকে তাকাচ্ছ কেন? এটাতে ঢুকতে বলা হচ্ছে তোমাকে। পারবে? জিজ্ঞেস করল টেরি। নাকি হার স্বীকার করে নেবে? এটা কিন্তু সত্যি সত্যি লাশ। আজ আর কোন ফাঁকিবাজি নেই।

কফিনগুলো দেখাল মুসা, ওগুলোতে লাশ নেই?

আছে হয়তো, জানি না থাকলেও বহুদিনের। পচা-গলা। মুচকি হাসি ফুটল ঠোঁটে, কেন, তাজাটা পছন্দ হচ্ছে না? পচাগুলোর গালে চুমু খাবে?

তাড়াতাড়ি মুখ ফেরাল মুসা। আ-আমি…ঠিক আছে, ঢুকছি!

প্রথমে হাত মেলাও, তারপর ভেতরে ঢোকো। কোলাকুলি করো, দুই গালে চুমু খাও, এবং বেরিয়ে এসো।

ভারী দম নিল মুসা। বাতাসটা আটকে ফেলল ফুসফুসে, ছাড়ল না। তারপর আস্তে বাড়িয়ে দিল ডান হাতটা। চোখ বুজল।

ভাবছে, সত্যি সত্যি মরা মানুষের সূঙ্গেই হাত মেলাতে যাচ্ছে?

ধরল হাতটা। বাপরে! কি ভয়ানক ঠাণ্ডা! তারমানে আসল লাশই!

চোখ মেলল।

ঝাঁকি দাও, টেরি বলল।

ঝাঁকি দিল মুসা। একবার। দুবার। শক্ত হয়ে গেছে হাতটা। নড়তে চাইল না।

কি বুঝলে, পচা শুঁটকি? ভুরু নাচাল কিশোর। তোমরা হেরে যাচ্ছ, লিখে রাখতে পারো।

দেখাই যাক না, টেরি বলল, মাত্র তো শুরু করেছে। এবার ভেতরে ঢোকো। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ো লাশটার ওপর।

দ্বিধা করতে লাগল মুসা।

কডি বলল, ভয় পাচ্ছে কা-কা-কালটুটা…

চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল মুসা। ডান হাতটায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। ঠাস করে শব্দ হলো। মাগ্লোহ্! বলে মুখ চেপে ধরল কডি। ভয়ানক স্বরে মুসা বলল, সাবধান করে দিলাম। কোনদিন যদি আর ওভাবে ব্যঙ্গ করো, একটা দাঁতও রাখব না, মনে রেখো।

আহত নেকড়ের মত জ্বলে উঠল কডির চোখ। পাল্টা আঘাত হানার জন্যে হাত তুলতে গিয়েও থমকে গেল। মরফিকে কিভাবে পিটিয়েছে মুসা, শুনেছে টাকির মুখে।

ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে গেছে টেরি-বাহিনী। মুসার এই রূপ দেখেনি আর। নতুন দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে।

কডিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে ঘুরে দাঁড়াল মুসা। কফিনের মধ্যে ঝুঁকল। প্রচণ্ড রাগ মনে। পাথর হয়ে গেছে যেন মনটা। দুনিয়ার কোন কিছুকেই আর পরোয়া করে না এ মুহূর্তে। কমলা রঙের ভয়ঙ্কর মুখটাকেও আর ভয়ানক লাগছে না দেখতে। সহজেই চুমু খেতে পারবে ওই গালে।

সব কটা চোখের দৃষ্টি এখন মুসার ওপর।

কফিনের কিনার খামচে ধরে উঠতে যাবে, ঠিক এই সময় মচমচ করে উঠল কি যেন।

থমকে গেল সে। সোজা হয়ে দাঁড়াল।

 আবার মচমচ।

ফিরে তাকাল মুসা। টেরির চোখে ভয় দেখতে পেল। তার দোস্তদের চোখেও।

কিসের শব্দ? ফিসফিস করে বলল টাকি। জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে।

নিশ্চিত হলো মুসা, আজ আর কোন চালাকির মধ্যে যায়নি টেরির দল। তাহলে ঘাবড়াত না। সত্যিকার লাশের সঙ্গেই মুসাকে কোলাকুলি করতে নিয়ে এসেছে ওরা।

আবার শব্দ।

অন্য কফিনগুলোর দিকে তাকাল মুসা।

একটা কফিনের ডালা নড়ে উঠতে দেখল। আরেকটা। তারপর আরেকটা। ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে কফিনগুলোর ডালা।