শুঁটকি বাহিনী – পরিচ্ছেদ ১

০১.

গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে সাইকেল চালাচ্ছে মুসা। হঠাৎ এমন বিকট এক চিৎকার দিয়ে উঠল, আশেপাশে কেউ থাকলে রীতিমত আঁতকে যেত।

তার মনে হলো, ঘাড়ের ওপর একটা মাকড়সা পড়েছে। রোমশ পায়ের খোঁচা লাগছে।

ঝট করে হাত উঠে গেল ঘাড়ের কাছে। কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছিল সাইকেলটা। ব্রেক কষে পা নামিয়ে দিয়ে দাঁড় করাল।

হাত দিয়ে বুঝল, মাকড়সা নয়, একটা মরা পাতা। প্রচণ্ড রাগ হলো। দলামোচড়া করে ছুঁড়ে ফেলে দিল পাতাটাকে।

রাগ হলো নিজের ওপরও। ডাক্তারের কথার প্রতিধ্বনি করল সে মনে মনে, দেখো, মুসা, এই অকারণে ভয় পাওয়াটা ছাড়তে হবে তোমাকে। নইলে কোনদিনই আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে না। ভয়কে প্রশ্রয় দিলেই ভয় বাড়ে। যত দিন যাবে, এই ভয় পাওয়ার রোগটা বাড়তেই থাকবে তোমার। মনে রেখো, বার বার মানুষের একই দুর্ঘটনা ঘটে না।

কিন্তু যদি ঘটে!

নিজেকে আবার ধমক লাগাল মুসা। গ্রীনহিলসে থাকতে স্কুলে তোতলা মুসা খেতাব হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় খেতাবটা ছিল ভূত-কাতুরে। দুটোরই কারণ-ভয়।

এখানেও যদি সেটা চালু করতে না চাও তো সাবধান হয়ে যাও আজকে থেকেই, নিজেকে বোঝাল সে। নিজেই নিজের ভীতুপনার কথা ঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দিও না। জানতে দিও না তুমি পোকা-মাকড় দেখলে ভিরমি খাও, ভূত দেখলে বেহুঁশ; ভয় পেলে তোতলানি ছাড়া কথা বেরোতে চায় না!

গ্রীনহিলস থেকে চলে এসেছে মুসারী। তার বাবা এখন থেকে রকি বীচেই কাজ করবেন ঠিক করেছেন। রবিনরা এসেছে আরও আগেই।

রকি বীচ মিডল স্কুলে পড়ে রবিন আর কিশোর। মুসাও সেখানেই ভর্তি হয়েছে। আজ তার নতুন স্কুলে প্রথম দিন।

গাছপালার ভেতর দিয়ে চলে গেছে পথ। সকালের ঠাণ্ডা বাতাস লাগছে গালে। সূর্যটা এখনও একটা লাল বলের মত বাড়িঘরের ছাতের ওপর ভাসছে। গাছের পাতায় উজ্জ্বল লাল আর হলুদের মিশ্রণ। এ বছর শীতটা বোধহয় তাড়াতাড়িই পড়তে যাচ্ছে।

একটা বড় গাড়ি চলে গেল পাশ দিয়ে। তাতে বোঝাই ছেলেমেয়ে আর কুকুর। ছেলেমেয়েগুলোও চেঁচামেচি করছে, কুকুরগুলোও। পাল্লা দিয়ে। মুসাকে দেখে জানালার কাঁচে থাবা তুলে দিয়ে ঘেউ ঘেউ শুরু করল একটা কুকুর। একটা মেয়ে জানালা দিয়ে হাত বের করে নাড়ল তাকে উদ্দেশ্য করে।

চেনে না, অতএব হাত নাড়ার জবাব দিল না মুসা। গীয়ার বদল করল। রাস্তা এখানে বেশ ঢালু।

কিছুদূর এগিয়ে দেখল রাস্তার দুই পাশ ধরে হাঁটছে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে। পরনে পরিষ্কার জামা-কাপড়। পিঠে ব্যাকপ্যাক। কলরব করতে করতে স্কুলে চলেছে ওরা। বেশির ভাগই তার বয়েসী।

ওদের দিকে নজর থাকায় রাস্তার পাথরটা চোখে পড়েনি তার। সামনের চাকার নিচে পড়ল। লাফিয়ে উঠল চাকা। অনেক চেষ্টা করেও কোনমতেই সামলাতে পারল না। পড়ে গেল।

পাকা রাস্তায় পড়েছে। প্রচণ্ড ব্যথা পেল। ঝটকা দিয়ে দুই হাত উঠে গেল ওপর দিকে। সাইকেলটা পড়ল তার গায়ের ওপর। হ্যাঁন্ডেলের একটা পাশ খোঁচা মারতে লাগল পাঁজরে।

ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল সে। সাইকেলটা ঠেলে সরাতে গেল গায়ের ওপর থেকে।

এই সময় গাড়িটাকে আসতে দেখল।

 একটা বাচ্চার তীক্ষ্ণ চিৎকার কানে এল। গাড়িতে রয়েছে বাচ্চাটা।

মাথা উঁচু করল মুসা।

পেছনের সীটে বসা বাচ্চাটাকে দেখতে পেল। ড্রাইভিং সীটে কেউ নেই।

ঢাল বেয়ে সোজা তার দিকে ছুটে আসছে গাড়িটা। ক্ষণিকের জন্যে হতবুদ্ধি হয়ে গেল মুসা। আতঙ্কিত।

বাচ্চাটার চিৎকার বাস্তবে ফিরিয়ে আনল তাকে। চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। সাইকেলের হ্যাঁন্ডেলটা কাত হয়ে পড়ল রাস্তার ওপর। পা দিয়ে ঠেলে যতটা পারল সরিয়ে দিল রাস্তা থেকে। গাড়ির চাকার নিচে পড়লে আর চালানোর যোগ্য থাকবে না।

দ্রুত নেমে আসছে গাড়িটা।

রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে চোখ মিটমিট করতে লাগল মুসা। সত্যি কি ড্রাইভার নেই?

ভাল করে দেখল। না, সত্যি নেই।

মাত্র কয়েক ফুট দূরে আছে আর গাড়ি।

 চিৎকার করে কাঁদছে বাচ্চাটা।

আরেকটা চিৎকার কানে এল মুসার। ওপর দিকে রাস্তার মাথার দিকে তাকাল সে। আমার খোকা! আমার খোকা! বলে চিৎকার করতে করতে পাগলের মত ছুটে আসছে এক মহিলা। হাত ছুঁড়ছে ওপর দিকে। সোনালি চুল ঝাঁকি খাচ্ছে ঘাড়ে। লাল জ্যাকেটের কোনা বাতাসে উড়ছে।

বড় করে দম নিল মুসা। সরে গেল একপাশে।

আসছে গাড়িটা! আসছে!

 ভাবছে না সে। ভেবেচিন্তে কাজ করার সময় নেই এখন।

 নিজেকে তৈরি করে নিল সে। শক্ত হয়ে গেল প্রতিটি মাংসপেশি।

গাড়িটা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হাত বাড়িয়ে ধরতে গেল ড্রাইভারের পাশের দরজার হাতল।

মিস করল।

দরজায় বাড়ি লাগল হাতটা। প্রচণ্ড ব্যথা পেল। কিন্তু টু শব্দ করল না। ঝাঁপ দিল গাড়িটাকে লক্ষ্য করে। বডিতে বাড়ি খেয়ে পড়ে গেল রাস্তার ওপর। হাঁটুতেও ব্যথা পেল। তা-ও শব্দ করল না।

চেঁচামেচি কানে আসছে রাস্তার দুই পাশ থেকে। মুখ ফিরিয়ে মহিলাকে দেখতে পেল। বাচ্চার নাম ধরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসছে।

গাড়ির দিকে তাকাল মুসা। দ্রুত গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে। নিচের দিকে রাস্তার শেষ মাথায় আরেকটা রাস্তা আড়াআড়ি ক্রস করেছে প্রথমটাকে। লাল ট্র্যাফিক লাইট জ্বলছে। রাস্তা পেরোচ্ছে ছেলেমেয়েরা। বেশ ভিড় ওখানটায়।

জলদি ওঠো, মুসা!-নিজেকে তাগাদা দিল সে। বাচ্চাটাকে বাঁচাও!

লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল মুসা। ঢাল বেয়ে ছোটা কঠিন। রাস্তায় পড়ে আছে আলগা পাথর। পা পড়লেই সড়াৎ। কোন কিছুই দমাতে পারল না। তাকে। মাথা ঘুরছে। বাচ্চাটার তীক্ষ্ণ চিৎকার বাজছে কানের পর্দায়। পৌঁছে গেল গাড়ির কাছে।

পেছনে থেকে কিছুই করতে পারবে না। পাশে যেতে হবে।

দুই হাত সামনে বাড়িয়ে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল।

হাতলটা ধরতে চায়।

নাহ! আর বোধহয় পারা গেল না! পারল না ধরতে!

চোখ পড়ল রাস্তা পেরোতে থাকা ছেলেমেয়েগুলোর ওপর।

সরো! সরো তোমরা! ওদের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল সে।

গাড়ির পেছনের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে খুদে খুদে গোলাপী রঙের আঙুলগুলো দিয়ে কাঁচ আঁকড়ে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করছে বাচ্চাটা।

নিজের অজান্তেই গতি বেড়ে গেল মুসার।

 জোরে…আরও জোরে…

থাবা দিয়ে ধরতে গেল আবার হাতলটা। আবার মিস করল!