টাইম ট্রাভেল – পরিচ্ছেদ ৮

০৮.

পা টিপে টিপে ওপরতলায় উঠল মাজুল আর গাজুল।

না দেখে কিসে যেন পা বেধে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল মাজুল।

 চাপা গলায় ধমকে উঠল গাজুল, আহ, আস্তে। দেখে হাঁটো। সারা বাড়ির লোক সব জাগিয়ে দেবে দেখছি।

মাজুল বলল, এখানে কেন এলে, এখনও বলোনি কিন্তু।

মগজশক্তি রসায়ন তোমারও খাওয়া উচিত, বিরক্তকঠে বলল গাজুল। আর গাধা, এখানে এসেছি শিওর হতে, ওষুধটা খেল কিনা ছেলেগুলো, ওষুধে কাজ হলো কিনা দেখতে।

ভারী পায়ে অন্ধকার হল ধরে হেঁটে চলল দুজনে। কিশোরের শোবার ঘরের সামনে এসে থামল। উঁকি দিল ভেতরে।

ওই যে একটা ছেলে, ফিসফিস করে বলল গাজুল।

 বাকি দুটো কোথায়? এ বাড়িতেই তো ঢুকতে দেখলাম। আর বেরোয়নি।

আছে অন্য কোন ঘরে। গেস্টরূমে।

নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল দুজনে। টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। তিনটে গ্লাস পড়ে আছে। সব কটাতেই লালচে ওষুধের তলানি।

একটা গ্লাস তুলে নিয়ে তাঁকে দেখল গাজুল। হাসি ফুটল মুখে। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ, খেয়েছে। তিনটে খালি গ্লাস। তিনজনেই খেয়েছে।

ফিরে তাকিয়ে দেখল বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে মাজুল।

কিশোরের মুখের কাছে ঝুঁকে দেখতে লাগল। টাইম ট্রাভেল

দেখতে দেখতে কুঁচকে গেল তার ভুরু।

হাত নেড়ে ডাকল, গাজুল, এদিকে এসো তো?  

কি হলো?

দেখো তো মরেটরে গেল নাকি!

শঙ্কিত হয়ে উঠল গাজুল। তাড়াতাড়ি বিছানার কাছে এসে দাঁড়াল। কিশোরের নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখল। ফিরে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল, উহ, পিলে চমকে দিয়েছিলো তোমাকে গাধা কি আর সাধে বলি। দিব্যি তো নিঃশ্বাস পড়ছে।

লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা চুলকাল মাজুল। নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখার কথা মনেই হয়নি।

তা তো হবেই না। হয় তোমাকেও ওষুধ খাওয়ানো দরকার, নয়তো বাড়ি ফিরে ওঅর্কশপে গিয়ে মগজটা খুলে দেখা দরকার কোথায় কি গোলমাল হলো। তোমার এ সব বোকামির কথা মনিব শুনলে হয়তো তোমাকে বিকল বানিয়েই ফেলে রাখবে। কিংবা হাওয়া করে দেবে।

ভয় দেখা দিল মাজুলের চোখে। না–না, দোহাই তোমার, বসকে বোলো না, প্লীজ। তুমি না আমার বন্ধু।

হু। এখন থেকে মাথাটা খেলানোর চেষ্টা করবে।

করব। করব।

চলো, বেরিয়ে যাই, গাজুল বলল। দেখা তো হলো।

 বাকি ছেলে দুটোকে দেখবে না?  

না, দরকার নেই। তিনটে গ্লাসে ওষুধ, তারমানে তিনজনেই খেয়েছে। আর এই ছেলেটা যখন ভাল আছে, বাকি তিনটেও থাকবে, সন্দেহ নেই তাতে।

.

কিশোর! এই কিশোর কিশোর।

ডাক শুনে চোখ মেলল কিশোর। দেখল জানালার পর্দা সরিয়ে দিচ্ছেন মেরিচাচী। রোদ এসে পড়েছে ঘরে।

ওঠ, ওঠ। আর কত ঘুমাবি? স্কুলে যাবি না? হাসলেন চাচী। হাসিটা সকালের সোনালি রোদের মতই উজ্জ্বল।

উঠে বসল কিশোর। মুখের কাছে হাত নিয়ে এসে দীর্ঘ হাই তুলল। ঘুমটা যেতে চাইছে না চোখ থেকে। হিংসে হলো চাচীর ওপর। রোজ সকালে এত হাসিখুশি থাকেন কি করে চাচী। তার মনে হতে লাগল ওরকম মেজাজে থাকতে হলে মগজ ভরা বুদ্ধি থাকা দরকার। যার যে জিনিসটার ঘাটতি থাকে সব সময় সেটা নিয়েই মাথা ঘামায় মানুষ।

.

স্কুল বাসে ওঠার পর অন্য দিনের তুলনায় পরিস্থিতির বিশেষ কোন উন্নতি হলো না ওদের বেলায়। সামনের দিকের একটা সীটে জানালার কাছে বসল কিশোর। জায়গা না পেয়ে মুসা আর রবিন চলে গেল পেছনের দিকে।

ব্যাগটা কোলের ওপর রেখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল কিশোর। দিনটা মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে। ধূসর, মেঘে ঢাকা ভারী আকাশ। বৃষ্টির সম্ভাবনা। গাছপালা আর ঝোপঝাড়ের মাথায় হালকা কুয়াশা।

ফিরে তাকাল সে। পাশের সীটে বসেছে শারিয়া আর রয়। ওদের ক্লাসের দুজন সবচেয়ে ভাল ছাত্র। নিজের অজান্তেই গুঙিয়ে উঠল সে। দা নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার ক্রসওয়ার্ড পাজল নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে ওরা।

ভাল ছাত্র বলে দুজনের খুব অহঙ্কার। প্রতিটি সূত্র এত জোরে জোরে বলছে, যাতে বাসের সবাই শুনতে পায়। বুঝতে পারে ওরা টাইমসের ক্রসওয়ার্ড পাজলের মত জটিল জিনিসের সমাধান করছে।

ক্লাসের আর কেউ এর সমাধান করতে পারে না, তিক্তকণ্ঠে ভাবল কিশোর। অসম্ভব কঠিন। সেজন্যেই বাসে উঠেই প্রতিদিন এটা নিয়ে মাথা ঘামানো শুরু করে যেন সবাইকে, বিশেষ করে কিশোবদেরকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে যে ওরা কতখানি বোকা।

হাই কিশোর, ডেকে বলল রয়, এ জিনিসটা ঠিক বুঝতে পারছি না। সাহায্য করবে?

কিশোরের দিকে তাকিয়ে পিত্তি জ্বালানো হাসি হাসল শারিয়া, আমরা বোকা বনে গেছি।

কিশোরের বলতে ইচ্ছে করল, বোকা বনলে বনেই থাকো না। কিন্তু আরেকটা জিনিস মনের কোণে খচখচ করছিল বলেই আগ্রহী চোখে ফিরে তাকাল। ওষুধে কাজ হয়েছে কিনা, ওরা বুদ্ধিমান হয়েছে কিনা বোঝা দরকার।

রয় জিজ্ঞেস করল, এমন একটা বোকা গাধার নাম বলল তো, যেটার বানান সাত অক্ষর দিয়ে হয়।

গাধা তো এক রকমই হয়, জবাব দিল কিশোর। আর সেটার বানান তিন অক্ষরে…।

উঁহু, আঙুল নাড়ল রয়, এই গাধাটার বানান সাত অক্ষর দিয়েই হয়।

হেসে কুটিকুটি হতে লাগল শারিয়া।

এটা আমার মস্ত সুযোগ, কিশোর ভাবছে, মগজটা বুদ্ধিমান হয়েছে কিনা বোঝার। বহু সময় তো পার হয়েছে। এতক্ষণে ওষুধে ক্রিয়া করে ফেলার কথা। ইস, আঙ্কেল জ্যাকের ফরমুলাটা যদি কাজ করত। জবাবটা কি হবে, ভাবতে লাগল সে।

পারছ না? হাসতে হাসতে বলল রয়। দাঁড়াও, সূত্র দিয়ে দিই। দেব?

ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর।

ঠিক আছে, দিচ্ছি,রয় বলল। কে-আই-এস-এইচ…

তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল শারিয়া, ও-আর-ই।

প্রচণ্ড রসিকতায় মজা পেয়ে হো হো করে হেসে উঠল দুজনে। ওদের সঙ্গে যোগ দিল আরও কয়েকজন ছেলেমেয়ে। শুঁটকি টেরি আর তার বন্ধুরাও রয়েছে সেই দলে।

রাগে, হতাশায়, দুঃখে চোখে পানি চলে এল কিশোরের। সীটের মধ্যে এলিয়ে পড়ল। দৃষ্টি জানালার বাইরে। ভেসে বেড়ানো কুয়াশা আর ধূসর আকাশ মনটা আরও খারাপ করে দিল তার।

এত বোকা কি করে হয়ে গেলাম আমি। ভাবছে সে। এতটাই বোকা! মগজটাতে কি হলো আমার।

পেছনের সীট থেকে শোনা গেল আচমকা রবিনের চিৎকার। হায় হায়, আমার ব্যাগ।

ফিরে তাকাল কিশোর। কি হয়েছে, রবিন?

আমার স্কুল ব্যাগ, জবাব দিল রবিন। আনতে ভুলে গেছি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুসা বলল, আমি ব্যাগ এনেছি, কিন্তু টিফিন আনিনি। ভুলে গেছি। লাঞ্চের সময় খাব কি?

সীটের সারির মাঝখান দিয়ে বাসের দুলুনির সঙ্গে সঙ্গে দুলতে দুলতে এগোল রবিন। চিৎকার করে অনুরোধ করতে লাগল ড্রাইভারকে, আমার ব্যাকপ্যাক, বই খাতা, সব বাড়িতে ফেলে এসেছি। প্লীজ, বাসটা ঘোরান। ফিরিয়ে নিয়ে চলুন। প্লীজ।

সরি, নির্বিকার কণ্ঠে জবাব দিল ড্রাইভার। বিশালদেহী একজন মোটাসোটা মহিলা। ঠোঁট থেকে ঝুলছে একটা দাঁত খোঁচানোর কাঠি। ফিরেও তাকাল না রবিনের দিকে।

কিন্তু আমার জিনিসগুলো তো দরকার, মরিয়া হয়ে বলতে লাগল রবিন। নইলে, নইলে ক্লাস করব কি করে? স্কুলে গিয়ে কি করব?

মুসাও উঠে এসেছে তার পেছন পেছন। ড্রাইভারকে অনুরোধ করতে লাগল সে-ও।

সরি নির্বিকার কণ্ঠে একই জবাব দিল মহিলা।

মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল কিশোরের। আরও দমে গেল। এত বোকা তো ছিল না ওরা। হঠাৎ করে এমন কি ঘটে গেল যে মগজের এই অবস্থা হয়ে গেল?

দিনকে দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। ভাল হওয়ার কোনই লক্ষণ নেই।

তার মনে হতে লাগল, আজকে বাসে ওঠার পর থেকে যা যা ঘটল এরচেয়ে খারাপ কিছু আর ঘটতে পারে না।

কিন্তু তার ধারণা ভুল।