শুঁটকি বাহিনী – পরিচ্ছেদ ৮

০৮.

সোমবার লাঞ্চের সময় ক্লাস থেকে বেরিয়ে ক্যাফিটেরিয়ার দিকে। রওনা হয়েছে মুসা আর কিশোর। রবিনকে দেখতে পেল না। সে বেরিয়েছে ওদের আগে। ডেকে নিয়ে গেছে নাইনথ গ্রেডের মরফি।

হলের মোড় ঘুরতেই কানে এল হই-চই, রাগত চিৎকার।

অন্যপাশে এসে টাকিকে দেখতে পেল মুসা আর কিশোর। ওদের দেখে চিৎকার করে বলল, জলদি যাও! রবিনকে পেটাচ্ছে মরফি।

দৌড়ে গেল দুই গোয়েন্দা। রবিনের কলার চেপে ধরেছে মরফি। বিশালদেহী ছেলেটার সঙ্গে পাত্তাই পেল না রবিন। তাকে শূন্যে তুলে নিয়ে গিয়ে ঠেসে ধরল টাইলস বসানো দেয়ালে।

ছাড়ো! ছাড়ো আমাকে ছাড়া পাওয়ার জন্যে ছটফট করছে রবিন।

খলখল করে হেসে উঠল মরফি, না ছাড়লে কি করবে? মারবে? মারো! মারো!

রবিনকে মাটিতে নামাল সে। কাঁধ দিয়ে প্রচণ্ড এক গুলো লাগাল রবিনের বুকে। কলার ছাড়ল না। হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল একটা লকারের কাছে। হ্যাঁচকা টানে লকারের দরজা খুলে তার মধ্যে ঠেসে ভরতে শুরু করল।

অ্যাই, মরফি! ও কি করছ! এতক্ষণে যেন সংবিত ফিরে পেল কিশোর। ধমকে উঠল, ছাড়ো ওকে! রবিনকে সাহায্য করার জন্যে এগোতে গিয়েও কি ভেবে এগোল না। থমকে গিয়ে মুসার দিকে তাকাল, হাঁ করে চেয়ে দেখছ কি? ছাড়াও না ওকে! শিক্ষা দিয়ে দাও মরফিকে!  

আ-আ-আমি! এখানে সবার সামনে তোতলানো নিরাপদ নয়, ভুলে গেছে মুসা। পিছিয়ে গেল এক পা।

যাও! যাও! মুসাকে ঠেলে দিল কিশোর। একমাত্র তুমিই ওর সঙ্গে পারবে।

হা হা, যাও না, হিরো মিয়া, টাকি বলল। তুমি তো কোন কিছুকেই ডরাও না। গায়ে-গতরেও বড়ই। একচোট দেখিয়ে দাও মরফিটাকে। বড় বাড় বেড়েছে পাজিটার। যাকে পায় তাকেই মারে।

ঢোক গিলল মুসা, কিন্তু…আমি…আমি…

আরে আমি আমি করছ কেন? তোমার বন্ধুকে পেটাচ্ছে দেখতে পাচ্ছ না? বন্ধুর জন্যে মায়া-দরদ নেই? নাকি ভয় পেয়ে গেলে?

যাও, আবার মুসার পিঠে ঠেলা মারল কিশোর। মরফি তোমার কাছে নস্যি। তুষের মত উড়িয়ে দাও ওকে। ভেঙে চুরচুর করো!

লকারে ঢুকিয়ে রবিনকে ঠেলতেই আছে মরফি। বুকে হাত দিয়ে ঠেসে ধরে রেখে বলল, বলল, গু খাই!  

তা কেন বলব! হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রবিন। ফুসফুসে চাপ পড়াতে গলা দিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ বেরোল।

হাতটাকে মুঠো করে তার বুকে প্রচণ্ড এক গুতো মারল মরফি। ব্যথায় কাতরে উঠল রবিন। আবার বলল মরফি, বলো জলদি, গু খাই! নইলে ছাড়ব না।

না, বলব না!

তাতে যেন খুশিই হলো মরফি। রবিনকে অত্যাচার করার সুযোগ পেল। ওর পেটে ঠেসে ধরল মুঠো পাকানো হাতটা। জোরে চাপ দিতে লাগল।

আর্তনাদ করে উঠল রবিন।

তুমি কি, মুসা? তিরস্কার করল কিশোর। এখনও যাচ্ছ না! প্রচণ্ড এক ধাক্কা মারল মুসার পিঠে।

মরফির গায়ের ওপর গিয়ে পড়ল মুসা।

হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল মরফি। কোনমতে সামলে নিল। ঝাড়া মেরে পিঠ থেকে সরিয়ে দিল মুসাকে। তারপর সোজা হয়ে ঘুরে দাঁড়াল।

পিছিয়ে গেল মুসা।

হেসে উঠল টাকি, ভয় পেয়েছে, ভয় পেয়েছে, তোতলাটা ভড়কে গেছে…

কিন্তু ওর মুখের কথা শেষ হলো না। মাথা নিচু করে তীব্র গতিতে ছুটে গেল মুসা। মরফির পেটে লাগল মাথাটা। হুক করে সমস্ত বাতাস বেরিয়ে। এল মরফির মুখ দিয়ে। ব্যথায় নীল হয়ে গেল মুখ। নিগ্রোর খুলির ভয়ঙ্কর আঘাতে বাঁকা হয়ে গেছে। দমল না তারপরেও। হাত বাড়াল মুসার কলার ধরার জন্যে। সরে গেল মুসা। প্রচণ্ড রাগে অন্ধ হয়ে তাকে ধরার জন্যে ছুটে এল সে।

চট করে এক পাশ থেকে একটা পা সামনে বাড়িয়ে দিল কিশোর। কারও চোখে পড়ল না সেটা। মরফিরও না। হোঁচট খেয়ে উড়ে গিয়ে মেঝেতে পড়ল সে।

ছেলেমেয়েরা ঘিরে দাঁড়িয়েছে ওদের। দুই দলেরই সমর্থক আছে। হট্টগোল করছে সবাই। চেঁচিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে।

মরফি পড়ে যেতেই হাততালি দিতে শুরু করল মুসার পক্ষের সমর্থকরা। হাসতে লাগল। শিস দিল।

কাবু হয়ে গেছে মরফি। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল। মুখ টকটকে লাল।

হঠাৎ জেগে ওঠা আবেগ কেটে গেছে মুসার। ভয়টা ফিরে এসেছে। মরফি যখন হুমকি দিল, দেখে নেব আমি! ছাড়ব না!-এক পা পিছিয়ে গেল মুসা।

সামনে এসে দাঁড়াল কিশোর। এখনও বাহাদুরি? বড় বড় কথা! যাও যাও, যা পারো কোরো। মুসা আমান কাউকে ভয় পায় না।

জ্বলে উঠল মরফির চোখ। পারলে কিশোরকেই মেরে বসে। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারল না। লকার থেকে রবিনও বেরিয়ে চলে এসেছে ততক্ষণে। তিনজনের সঙ্গে কোনমতেই পারবে না বুঝে মানে মানে কেটে পড়ল ওখান থেকে।

তার সঙ্গে চলে গেল তার সমর্থকরা।

বাকি সবাই প্রচুর চিৎকার-চেঁচামেচি করছে। কেউ শতমুখে প্রশংসা করতে লাগল মুসার। কেউ বা এসে পিঠ চাপড়ে দিয়ে আন্তরিকতা প্রকাশ করল।

চারপাশে তাকিয়ে টাকিকে কোথাও দেখল না কিশোর। মুচকি হাসল সে। টেরির আরেকটা প্ল্যান বরবাদ হয়েছে।

*

লাঞ্চের পর আবার ক্লাস। সবাই আরেকবার হিরোর সম্মান দিতে লাগল মুসাকে। মেজাজটা তাই ওর ফুরফুরে লাগছে। আত্মবিশ্বাস ফিরে আসতে শুরু করেছে। যে ভাবে এগোচ্ছে, এখানে তাকে তোতলা মুসা বলার সাহসই পাবে না হয়তো আর কেউ। বিশেষ করে মরফিকে পেটানোর পর।

কিন্তু ক্লাস শেষে এমন একটা ঘটনা ঘটল, আবার চুরমার হয়ে গেল তার বিশ্বাস। ফিরে এল পুরানো ভয়টা। ঘণ্টা বাজার পর ক্লাস থেকে বেরিয়ে লকারের দিকে এগোচ্ছে, হঠাৎ কানে এল টেরি আর টাকির কথা। নিজের নাম শুনে থমকে দাঁড়াল মুসা। কান খাড়া করে শুনতে লাগল।

টাকি বলছে, সত্যি করবে?

নিশ্চয়ই, জবাব দিল টেরি। মরফি হাদাটা যে এমন করে কেঁচে দেবে সব কে জানত!…তবে আমি কেলোটাকে মু-ম্মুসা না বানিয়ে ছাড়ব না।

একটা থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। মনে হলো, টেরি আর টাকি তাকে দেখেছে। তাই নিজেরা কথা বলার ছলে ইচ্ছে করেই এ সব শোনাচ্ছে।

কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে, টেরি, টাকি বলল। এত ভয়ানক!…নাহ এতটা করা ঠিক হবে না।

এতটাই করব! শুধু তাই না, দরকার হলে আরও ভয়ঙ্কর কিছু করতেও দ্বিধা করব না আমি।