টাইম ট্রাভেল – পরিচ্ছেদ ২৩

২৩.

আবার ক্লিনিং রুমে নিয়ে আসা হলো তিন গোয়েন্দাকে।

ঘরে ঢুকেই ঝাড়া দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিল মুসা। কিশোরকে যে রোবটটা ধরেছে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিশোরকে ছাড়ানোর পর দুজনে মিলে রবিনকে ছাড়াল। তারপর দিল দৌড়।

আচমকা মুসাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রবিনকে লক্ষ্য করে ডাইভ দিল কিশোর। তাকে সঙ্গে নিয়ে পড়ল মেঝেতে। ঠিক ওই মুহূর্তে দুটো সাদা আলোকরশ্মি ছুটে গেল ওদের মাথার ওপর দিয়ে। অল্পের জন্যে বাঁচল।

ঘাড় ফিরিয়ে মুসার কি অবস্থা দেখল কিশোর।

মুসাও উপুড় হয়ে শুয়ে আছে মাটিতে।

হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আবার ছুটতে শুরু করল ওরা। পালানোর পথ খুঁজছে।

কোন পথ দেখতে পেল না।

পালানোর কোন উপায় নেই।

একধারে জটলা করছে কয়েকজন রোবটমানব। সেদিকে গেলে ধরা পড়তে হবে নিশ্চিত।

এখানে থাকলে

কিন্তু ভাবার সময় পেল না কিশোর। চিৎকার করে উঠল, সরে যাও!

আবার তিনটে আলোকরশ্মি ছুটে এল ওদের দিকে। অল্পের জন্যে বাঁচল এবারও। কাঁধে আগুনের আঁচের প্রচণ্ড তাপ লাগল কিশোরের। রশ্মিটা সামান্য নিচে নামলেই গায়ে লাগত তার, হাওয়া হয়ে যেত সে।

এদিকে দিয়ে এসো! চিৎকার করে উঠল মুসা।

হতভম্ব একজন রোবট-টেকনিশিয়ানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বাঁক নিয়ে কতগুলো বাক্সের পেছনে ঢুকে গেল সে। রবিন ছুটল তার পেছনে।

ক্ষণিকের জন্যে ফিরে তাকাল কিশোর! এগিয়ে আসছে তিন প্রহরী। ওদের হাতে লেজার-পিস্তল উদ্যত। কিন্তু ট্রিগার টিপতে সাহস পাচ্ছে না। কেন সেটা বোঝা যাচ্ছে। টিপলেই রশ্মি গিয়ে লাগবে কাঁচের বাক্সের গায়ে। হাওয়া হয়ে যাবে বাক্সে ভরে রাখা রোবটশিশুরা।

মুসা আর রবিনের মত কিশোরও কাজে লাগাল সুযোগটা। ছুটে বাক্সের পেছনে চলে এল।

দরজাটা চোখে পড়ল। সেদিকেই ছুটছে মুসা আর রবিন। বেরোনো• যাবে ওটা দিয়ে? পেছন থেকে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

চেষ্টা করে দেখা যাক। আর তো কোন উপায়ও নেই। ছোটা বন্ধ করল না মুসা।

পেছনে কানে আসছে চিৎকার আর পদশব্দ। দরজার কাছে সময়মত পৌঁছতে পারবে কিনা বুঝতে পারল না কিশোর। ভারী দম নিল সে। তারপর প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল দরজাটার দিকে। ছোটাও কঠিন। আয়না বসানো মেঝেতে পিছলে যেতে চায় পা।

ওদের ধরতে না পারায় হই-হট্টগোল আর চিৎকার-চেঁচামেচি বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। দুপদাপ পা ফেলে ছুটে আসছে বহু লোক।

খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল মুসা আর রবিন। ওদের সামান্য পরেই কিশোরও বেরোল।

কানে এল মুসার চিৎকার। পরক্ষণেই রবিনের। দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছে। মুসা। সামলাতে না পেরে তার গায়ের ওপর গিয়ে পড়েছে রবিন।

সামনে খোলা জায়গা নেই। দরজাও নেই।

মরিয়া হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর, আলমারি! একটা আলমারিতে ঢুকেছি আমরা।

তারমানে দরজাটা ছিল মস্ত আলমারির।

 আর কোন পথ নেই, ককিয়ে উঠল রবিন। আটকা পড়লাম!

আলমারির দেয়ালে রূপালী রঙের একটা হাতলের ওপর দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে। কিশোরের। আচমকা হাত বাড়িয়ে হাতলটা ধরে হ্যাঁচকা টানে নিচে নামিয়ে দিল।

মুহূর্তে দুদিক থেকে পিছলে সরে এসে লেগে গেল আলমারির দরজা। চালু হয়ে গেল আলমারি।

চেঁচিয়ে উঠল মুসা, আলমারি নয়, আলমারি নয়, কোন ধরনের লিফট।

অনন্তকাল ধরে যেন নেমেই চলল লিফটটা। আসলেই চলছে কিনা যখন সন্দেহ হতে লাগল ওদের, ঠিক সেই সময় ঝাঁকি লাগল। স্থির হয়ে গেল লিফট। পিছলে দুদিকে সরে গিয়ে আবার খুলে গেল দরজা।

লিফট থেকে বেরিয়ে এল ওরা।

ফুটবল মাঠের সমান বিশাল একটা জায়গায় ঢুকল। কাঁচে ঢাকা মস্ত গম্বুজের মত ছাত। অসংখ্য গোলকশান দেখতে পেল সেখানে। সারি দিয়ে রাখা। হেলিকপ্টার কিংবা বিমান রাখার ছাউনির মতই এটা গোলকন রাখার ছাউনি। গোলকগুলোর গায়ে নাম লেখা টাইম ট্রাভেল। আলাদা করে বোঝার জন্যে নম্বর দেয়া রয়েছে, যেমন টাইম ট্রাভেল-১, টাইম ট্রাভেল-২, ইত্যাদি।

সেগুলোর দিকে ছুটল ওরা।

একটা গোলকের ওপর চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়াল রবিন। এই কিশোর, দেখো, আমাদেরটা না? নম্বর মিলে যাচ্ছে।

নিচের ঠোঁট কামড়াল কিশোর। গোলকশানটার দিকে তাকিয়ে বলল, সে রকমই তো মনে হচ্ছে। আমাদের নয় ওটা, ডক্টর মুনের। তবে ওটাই নিয়ে গিয়ে লেকের পানিতে লুকিয়ে রেখেছিলাম আমরা।

গোলকনটার দিকে দৌড় দিল সে।

এ জিনিস চালানোর ওস্তাদ হয়ে গেছে এখন মুসা। দরজা খুলে উঠে পড়ল। কিশোর আর রবিন উঠে বসতেই লাগিয়ে দিল দরজাটা। প্রথমেই টিভি মনিটরটা অন করে দিল। ল্যাবরেটরির ভেতর থেকে ছুটে বেরোতে দেখল প্রহরীদের।

কিশোরের দিকে তাকাল মুসা, কোন সুইচটা টিপব? আজ আর ভুল করতে রাজি না।

সেদিনকার কথাটা মনে পড়ে গেছে এখন তিনজনেরই। কিশোর বুঝতে পারল, বুদ্ধি স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারানো স্মৃতিও ফেরত এসেছে। প্রচণ্ড গরম পড়েছিল সেদিন। মুসা প্রস্তাব দিয়েছিল, লেকের পাড় থেকে হাওয়া খেয়ে আসতে। কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে নিষিদ্ধ এলাকায় ঢুকতেই গোলক্যানটার কথা পাড়ল কিশোর। অনেকদিন চড়া হয় না। লেকের পানিতে লুকানো আছে। পানি থেকে তুলে চেপে বসেছিল ওটাতে ওরা। কিশোর প্রস্তাব দিয়েছিল, চড়াই যখন হলো, বেড়িয়ে আসা যাক। কিন্তু কোথায় বেড়াবে? অনেক সুইচের মধ্যে বড় একটা লাল সুইচ আছে। সেটাই টেপার সিদ্ধান্ত নিল। যা থাকে কপালে ভেবে ওই সুইচটাই টিপে দিয়েছিল। এবং তারপর তো কয়েক মাস ধরে চরম ভোগান্তি••এখানে আসার পর ডক্টর মুন ওদেরকে বোকা করে কাউকে সঙ্গে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের গোলকনিটা রেখে দিয়েছিলেন এখানেই…

আরে বলো না, কোনটা টিপব? মুসার উত্তেজিত কণ্ঠ ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল কিশোরকে। জলদি বলো! চলে এসেছে তো ওরা।

নিচের ঠোঁটে ঘন ঘন চিমটি কাটতে লাগল কিশোর। মনিটরের দিকে তাকিয়ে দেখল গোলকযানের কাছাকাছি চলে এসেছে প্রহরীরা। বলল, লালটাই টেপো আবার। টেলিভিশনের সুইচ অন-অফ করার মত মনে হচ্ছে জিনিসটা। একবার টিপলে অন, পরের বার টিপলে অফ। একবার টিপে ডক্টর মুনের। হেডকোয়ার্টারে পৌঁছেছি, নিশ্চয় দ্বিতীয়বার টিপলে আগের জায়গায়-অর্থাৎ যেখান থেকে এসেছে সেই লেকের পানিতে ফিরে যাবে যানটা।

যদি না যায়? অন্য কিছু করে? রবিন বলল।

কিছুই করার নেই, জবাব দিল কিশোর। এখানে থাকলেও মরতে হবে। তারচেয়ে চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি। ঝুঁকিটা নিতেই হবে।

হাত বাড়াল মুসা।

একবার দ্বিধা করে টিপে দিল লাল সুইচটা।

কয়েকটা সেকেন্ড যেন কিছুই ঘটল না। তারপর একটা ঝাঁকুনি। মনিটরে দেখা গেল চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল প্রহরীরা। তারমানে গম্বুজ থেকে বেরিয়ে এসেছে গোলকন।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কিশোরের দিকে তাকিয়ে রবিন বলল, ভাগ্যিস বোকার অভিনয় করার বুদ্ধিটা বের করেছিলে। আর কোনভাবেই ফাঁকি দেয়া যেত না ওদের।

হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল মুসা, আমার অভিনয়টা কেমন হয়েছে?

এত বাস্তব অভিনয় হলিউডের সবচেয়ে বড় অভিনেতারাও করতে পারবে কিনা সন্দেহ, হেসে বলল কিশোর। ডক্টর মুন তো বটেই, গাজুল-মাজুলের মত রোবটমানবেরাও শেষ পর্যন্ত সেই ফাঁকিতে পড়ে গেল। এরচেয়ে ভাল অভিনয় আর কি হতে পারে?

ঝপ করে পানিতে পড়ার শব্দ হলো একসময়। মনিটরে দেখতে পেল ওরা একটা পরিচিত লেক।

পানিতে ফাপা বলের মত ভেসে রইল গোলকযানটা।

নিরাপদেই রকি বীচে ফিরে এসেছে। কিন্তু বিশ্বাস হতে চাইছে না ওদের। শেষে দরজা খুলে উঁকি দিয়ে দেখে এল রবিন।

জরুরী কণ্ঠে কিশোর বলল, তাড়াতাড়ি এটা ডুবিয়ে দিয়ে চলো পালাই এখান থেকে। বলা যায় না, যে কোন মুহূর্তে টাইম ট্রাভেলার নিয়ে আমাদেরকে ধরতে হাজির হয়ে যেতে পারে ডক্টর মুনের রোবটবাহিনী। চলো চলো, জলদি করো!

যানটাকে তীরের কাছাকাছি নিয়ে আসা হলো। সুইচ টিপে লম্বা মইয়ের মত সিঁড়ি বের করে তীরে ঠেকাল মুসা। নেমে পড়ল তিনজনে। বাকি কাজ। এখন রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে সারতে হবে। পকেট থেকে ছোট্ট যন্ত্রটা বের করল কিশোর। গোলক্যানের কন্ট্রোলবোর্ডের ওপরেই রাখা ছিল। নামার আগে পকেটে ভরেছে। সুইচ টিপে প্রথমে মই সূরাল। তারপর দরজা বন্ধ করল। সবশেষে আরেকটা সুইচ টিপতেই নিঃশব্দে পানিতে তলিয়ে গেল যানটা।

.

দুই দিন পর।

স্কুলে হাজির হয়েছে তিন গোয়েন্দা।

মামলায় স্কুল কর্তৃপক্ষ হেরেছে। আবার ভর্তি করে নিতে বাধ্য হয়েছে। তিনজনকে।

অংকের ক্লাসে একটা কঠিন সমীকরণ দিয়ে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার ক্রেগ, কে করতে পারবে? মুসা, তুমি পারবে?

মাথা নাড়ল মুসা, এত কঠিন অংক আমাকে দিয়ে হবে না, স্যার।

অবাক হলেন মিস্টার ক্রেগ। রবিনের দিকে তাকালেন। তুমি পারবে?

চেষ্টা করে দেখতে পারি, স্যার।

ব্ল্যাকবোর্ডে এসে চক দিয়ে অংকটা করল রবিন। ফিরে তাকাল মিস্টার ক্রেগের দিকে।

মাথা ঝাঁকালেন তিনি, ঠিক পথেই এগিয়েছিলে, কিন্তু দুটো জায়গায় ভুল রয়ে গেছে। ক্লাসের দিকে তাকালেন তিনি। ভুল দুটো আর কেউ ধরতে পেরেছ? শুধরে দিতে পারবে?

রয় বা শারিয়া কেউ জবাব দিল না। একমাত্র হাত তুলল কিশোর। সে এসে ঠিক করে দিয়ে গেল অংকটা।

হাসি ফুটল মিস্টার ক্রেগের মুখে। কি ব্যাপার? আজ মুসা পারলই না, রবিন ভুল করল, করতে পারলে কেবল তুমি। সেই আগের মত। ঘটনাটা কি?

হেসে জবাব দিল কিশোর, আবার আমাদের মগজ স্বাভাবিক হয়ে গেছে, স্যার। প্রথমে মগজ ভোতা করার ওষুধ দিয়ে বোকা বানিয়ে দেয়া হয়েছিল আমাদের, তারপর মগজ উন্নত করার ওষুধ খেয়ে হয়ে গেলাম ক্ষতিকর রকম বুদ্ধিমান। দুটো ওষুধের পরস্পরবিরোধী রিঅ্যাকশনেই সম্ভবত আবার স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে এসেছে আমাদের মগজ। একেবারে আগের মত। অরিজিন্যাল আমরা।

পরস্পরবিরোধী রিঅ্যাকশনের ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।

ভাল ব্যাখ্যা আমিও দিতে পারব না, স্যার। তবে বিষে বিষক্ষয়ের মত হয়েছে ব্যাপারটা। এর সঠিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সম্ভবত আঙ্কেল জ্যাক দিতে পারবেন।

হু, মাথা ঝাঁকালেন মিস্টার ক্রেগ। দেখি, একদিন মিস্টার জ্যাককেই গিয়ে ধরব। কি ওষুধ দিয়ে তিনি এই কাণ্ড করিয়েছেন, জানতে হবে। যাই হোক, আবার যে তোমাদেরকে আগের অবস্থায় ফিরে পেয়েছি, এতে আমি খুব খুশি। ক্লাসের দিকে তাকালেন তিনি। তোমরা কি বলো? হাততালি দিয়ে মিস্টার ক্রেগের কথা সমর্থন করল সবাই।