টাইম ট্রাভেল – পরিচ্ছেদ ৩

০৩.

স্কুল ছুটির পর দেখা কোরো তোমরা আমার সঙ্গে, ক্লাসে গম্ভীর ভঙ্গিতে আমাদের বললেন ক্লাসটিচার মিস্টার ক্রেগ।

কিন্তু আমরা তো কিছু করিনি! অবাক হয়ে প্রতিবাদ জানালাম। জানামতে শাস্তি দেয়ার জন্যেই কেবল স্কুল ছুটির পর কাউকে থাকতে বলেন ক্লাসটিচার।

মিস্টার ক্রেগ শিক্ষক হিসেবে খুব ভাল। ভদ্রলোক। সব ছাত্রছাত্রীরাই তাকে পছন্দ করে। আমরাও করি।

দেখা করতে বলেছেন যখন, করতেই হবে।

স্কুল ছুটির ঘণ্টা বাজল। সব ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে গেল। বসে রইলাম কেবল আমি, মুসা আর রবিন।

তিনটে পরীক্ষার খাতা বের করলেন মিস্টার ক্রেগ। মুখ তুলে তাকালেন তোমাদের খাতা।  

মাথার চুলে হাত বোলালেন তিনি। চোখের পাতা সরু করে তাকালেন খাতাগুলোর দিকে। তারপর ঘোষণা করলেন, এই সেমিস্টারের অংক পরীক্ষায়ও সাংঘাতিক খারাপ করেছ তোমরা। পুরোপুরি ফেল।

ঢোক গিললাম। রবিন গুঙিয়ে উঠল। আর মুসা চোখ নামিয়ে তাকিয়ে রইল নিজের জুতোর দিকে

তিনজনেই এতটা খারাপ করবে কল্পনাই করতে পারিনি, নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন তিনি। এতটা খারাপ তো তোমরা ছিলে না কখনও। কি হয়েছে তোমাদের, বলল তো?

নির্বাক হয়ে রইল মুসা আর রবিন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, জানি না, স্যার। কিছুই ঢোকে না মাথায়। কিছু বুঝতেও পারি না। অনেক কিছুই মনে থাকে না। অতীতের অনেক কথা মনে করতে পারি না। মনে হয় বিসুরণ ঘটেছে। আমাদের।

কিন্তু বিস্মরণের সঙ্গে বোকামির সম্পর্ক কি?

 জানি না, স্যার, বিড়বিড় করে বললাম।

বোকার মত মাথা চুলকে যাচ্ছে রবিন।

মুসা কোন কথা বলছে না।

খাতাগুলো আমাদের সামনে নাড়তে নাড়তে জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার ক্রেগ, অন্য সব কথা থাক। অংকে তোমরা কেন খারাপ করেছ, সেটা বরং পর্যালোচনা করে দেখি। খাতাগুলো ডেস্কে নামিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, তোমাদেরকে যে রিভিউ শীটগুলো দিয়েছিলাম, পড়েছ ওগুলো?  

পড়েছি, স্যার, একসঙ্গে জবাব দিলাম তিনজনে।

বহুত মাথা ঘামিয়েছি এ নিয়ে, রবিন বলল।

কিন্তু এত কঠিন, যোগ করল মুসা, কিছুই বুঝতে পারিনি।

চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন মিস্টার ক্রেগ। তোমাদের যে কিছু হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই আমার। সাহায্য দরকার? প্রয়োজন মনে করলে আমি তোমাদের সাহায্য করতে পারি। কি করতে পারি, বলো?

কি জানি, তা-ও তো বুঝতে পারছি না, স্যার, মাথা চুলকানো বেড়ে গেল রবিনের।

আসলে, অংক আমাদের মাথায় ঢোকে না, স্যার, আমি জবাব দিলাম। অংক একেবারেই বুঝি না।

তুমি অংক বোঝা না এ কথা বিশ্বাস করতে বলো আমাকে? ভুরু কুঁচকে বললেন মিস্টার ক্রেগ। আসলে পড়ালেখা বাদ দিয়ে নিশ্চয় গোয়েন্দাগিরি নিয়ে বেশি বেশি মেতে উঠেছ। পড়াশোনায় পুরো ফাঁকি দিচ্ছ।…যাকগে, যা হবার হয়েছে। এবারকার মত ছেড়ে দিলাম। এখন থেকে লেখাপড়ায় ভালমত মনোযোগ দেবে। কি, বুঝেছ?

বুঝেছি, স্যার, মিস্টার ক্রেগকে এ ভাবে রেগে যেতে দেখে অবাক হলাম

কয়েক মিনিট পর স্কুল থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম তিনজনে।

গরমকাল। অথচ প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া বইছে। রাস্তার মোড় পেরিয়ে এসে হাসাহাসি হই-চই কানে এল। টেরি আর তার দুই দোস্ত টাকি ও কড়ি খেলছে। আমাদের দেখে ফিরে তাকিয়ে টিটকারি দিতে শুরু করল ওরা। ইদানীং ওরাও আমাদের চেয়ে ভাল রেজাল্ট করে।

এতটা বোকা কি করে হয়ে গেলাম আমরা? বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে আপনমনেই বিড়বিড় করল রবিন।

ফিরে তাকাল মুসা, মাথার মধ্যে কিছু নেই আমাদের। মাঝে মাঝে এতই মন খারাপ হয়ে যায়, ইচ্ছে করে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাই।

কিশোর থামলে রবিন বলল, এবার আমার কথা শোনো…

.

কিশোর যেদিনকার কথা বলল, সেদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে হলঘরে ঢুকতেই দেখা হয়ে গেল রিনিতার সঙ্গে।

রিনিতা আমার ছোট। আমার খালাত বোন। আমাদের বাড়িতে থাকতে এসেছে। ওর মা মারা গেছেন ক্যান্সারে। বাবা একসঙ্গে নিজের কাজকর্ম আর মেয়ের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে গেছেন। শেষে মাকে অনুরোধ করেছেন মেয়েটাকে কিছুদিন দেখাশোনা করার জন্যে। একটু গুছিয়ে নিয়েই আবার তিনি মেয়েকে নিয়ে যাবেন।

রিনিতাকে নিয়ে এসেছে মা। স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে।

কার্পেটে পা ছড়িয়ে বসে খেলছে রিনিতা। হাতের কাছে, আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা রঙের অসংখ্য প্লাস্টিকের টুকরো। আমার দিকে তাকিয়ে মাতব্বরি চালে ভুরু নাচাল। এত দেরি কেন?

রিনিতা আমাকে সব সময় খোঁচায়। নানা ভাবে যন্ত্রণা দেয়। একটা কথা বলতে পারি না। বললেই গিয়ে দশখান করে বানিয়ে বানিয়ে মার কাছে বিচার দেয়। মাও রিনিতার পক্ষ নিয়ে আমাকেই বকে। রাগে গা জ্বলে। মনে মনে ভাবি, এই বিচ্ছ মেয়েটাকে বাড়িতে নিয়ে আসাটাই হয়ে গেছে এক মস্ত ভুল।

 যাই হোক, রিনিতার প্রশ্ন শুনে আগে হলে হয়তো রেগে উঠতাম। জবাব দিতাম, সেটা জেনে তোমার কি লাভ? নিজের চরকায় তেল দাও। কিন্তু ইদানীং বোকা হয়ে যাওয়ার পর কেমন মানসিক ভাবেই দুর্বল হয়ে পড়েছি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিনমিন করে জবাব দিলাম, স্কুলের পরেও থাকতে হয়েছে।

কেন? ফেলটেল করেছ নাকি? ঠাসানি দিয়েছে টিচার?

 প্রশ্নটা এড়ানোর জন্যে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি করছ?

হাঁদা নাকি? মুখ ঝামটা দিল রিনিতা। দেখছ না খেলছি প্লাস্টিকের টুকরোগুলো দিয়ে প্রথমে একটা ঘর বানাব। বাস স্টেশন। তারপর একটা বাস। স্টেশনের সামনে রাখব। কিন্তু দেখো না, ঠিকমত জোড়াই লাগাতে পারছি না। মায়ার জন্যে অপেক্ষা করছি। ও এলে একটা ব্যবস্থা হবেই।

দেখি, আমাকে দাও তো।

দূর, আমার হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিল রিনিতা, তুমি কি লাগাবে? তুমি তো একটা হাঁদা। কালকে মনে নেই, সাধারণ একটা বাক্স বানাতে দিলাম, তাই পারলে না। স্কুলে এত দেরি করলে কেন? পড়া পারেনি বলে টিচার আটকে নাকি?

ঘাবড়ে গেলাম। কোন প্রসঙ্গই সহজে ভোলে না রিনিতা। ওর এ সব কথা, মার কানে গেলে জিজ্ঞেস করতে আসবে। তখন পড়ব আরও বিপদে। থাক থাক, সাহায্য করতে চেয়েছিলাম, ভাল লাগল না, রিনিতাকে বলে তাড়াতাড়ি পালিয়ে এলাম সেখান থেকে।