শুঁটকি বাহিনী – পরিচ্ছেদ ১১

১১.

বরফের মত জমে গেল মুসা।

দুই হাত চোখের ওপর এনে রাস্তার দিকে তাকাল। ড্রাইভওয়ে দিয়ে V একটা ভ্যান ঢুকছে। ওটার হেডলাইটের আলো।

বুকের মধ্যে দুরুদুরু করছে মুসার। চকিতে পিছিয়ে গেল। তারপর ঘুরে দিল দৌড়। প্রায় ডাইভ দিয়ে এসে পড়ল পাতাবাহারের বেড়ার ওপর।

কে ও? জিজ্ঞেস করল টাকি।

আমি কি করে জানব? হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব দিল মুসা।

বাতাসে কম্পমান বেড়ার আড়ালে লুকিয়ে রইল সবাই। ভ্যান থেকে নামতে দেখল দুজন লোককে। কপালের ওপর টেনে দিয়েছে হ্যাট। চেহারা বোঝা যাচ্ছে না।

পেছনের দরজা খুলল একজন। লম্বা কালো একটা প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ টেনে নামাল।

লাশের ব্যাগ।

নীরবে তাকিয়ে রইল ছেলেরা। ভারী ব্যাগটা ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে গেল লোক দুজনে।

একটু আগে মারা গেছে নিশ্চয়, বিড়বিড় করল টাকি। রাতেও আসা

বন্ধ নেই। কেঁপে উঠল সে।

তুমি না বললে কেউ আসবে না? ফিসফিস করে বলল মুসা।

আসার তো কথা ছিল না। তবে ওরা বাইরের লোক। তুমি ভেতরে থাকতে থাকতে আবার যদি কেউ আসে, লুকিয়ে পোডড়া। লুকানোর জন্যে অনেক কফিন আছে। নিচু স্বরে হাসল সে। তোমার তো বেজায় সাহস। পারবে না?

নিটু আর হ্যারল্ড নীরবে হাসল।

দম আটকে রাখতে রাখতে ফুসফুস ব্যথা শুরু হয়ে গেল মুসার। মনে হলো ফেটে যাবে। ফোঁস করে ছেড়ে দিল বাতাস।

ধরা পড়ার বেশি ভয় যদি করো, কডি বলল, এখনও সময় আছে, হার স্বীকার করে নাও। কষ্ট করার আর দরকারই নেই তোমার। কি বলো?

হার স্বীকারের কথা আসছে কেন? এতক্ষণে কথা বলল কিশোর। লোকগুলো গেলেই গিয়ে ঢুকবে ও। ঢুকতেই তো যাচ্ছিল।

পারকার পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে দিল মুসা। হুডের নিচে মুখ লুকানোর চেষ্টা করল। আতঙ্কিত চেহারাটা কাউকে দেখাতে চায় না।

ফিউনরল পারলারের পাশের একটা জানালায় আলো জ্বলল। সবুজ পর্দা টানা জানালায় ভুতুড়ে লাগল আলোটা।

মিনিট দুয়েক পর আবার নিভে গেল। বেরিয়ে এল লোকগুলো। ভ্যানের কাছে এসে পেছনের দরজাটা লাগাল দড়াম করে। সামনে গিয়ে উঠে বসল।

চলে গেল গাড়িটা।

ফিরে তাকাল মুসা। সবগুলো চোখের দৃষ্টি তার দিকে।

আমি যাচ্ছি, নিচু স্বরে বলল সে।

দ্বিতীয়বার বেড়া. ফাঁক করে ঠেলে বেরোল পার্কিং লটে। এগিয়ে চলল বাড়িটার দিকে।

পেছন পেছন চলল বাকি সবাই। ভেজা, পাকা চত্বরে ওদের জুতোর শব্দ হতে লাগল।

বাড়িটার পেছনে পাতাশূন্য গাছগুলো বাতাসে দুলে দুলে যেন হাত নেড়ে তাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল ওদের।

বাড়ির পেছনে এক চিলতে ঘাসে ঢাকা জমি আছে। পাকা চতুর থেকে সরে ওখানে পা দিতেই ফচ্ করে ভেজা মাটিতে ডেবে গেল মুসার জুতো। তারপর যতবার পা ফেলল ফচ ফচ করতেই থাকল।

পেছনের জানালাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। দপদপ করে লাফাচ্ছে কপালের কাছে শিরাটা। কাঁচের গায়ে নাক ঠেকিয়ে উঁকি মেরে ভেতরে দেখার চেষ্টা করল। কিছুই দেখতে পেল না। ভেতরে অতিরিক্ত অন্ধকার। কোন রকম আলো নেই। থাকলেও পর্দার জন্যে ভেতরের জিনিস দেখা যেত না।

দাঁড়িয়ে আছো কেন? জানালা খোলো, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল টাকি। কণ্ঠস্বরে মনে হলো ভয় পাচ্ছে।

কাঁচের গায়ে পুটুর পুটুর আওয়াজ তুলছে বৃষ্টির ফোঁটা। দুই হাত বাড়িয়ে কাঠের ফ্রেম চেপে ধরে ঠেলা দিল মুসা। সহজেই ওপর দিকে উঠে গেল পাল্লাটা। দমকা বাতাসে দুলে উঠল জানালার দুদিকের পর্দা। জীবন্ত মনে হচ্ছে ও দুটোকে।

জানালার চৌকাঠের ওপর দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল মুসা। এইমাত্র যে লাশটা আনা হলো, কোথায় রেখে গেল ওটা? কিছুই চোখে পড়ছে না।

তীব্র একটা দুর্গন্ধ এসে ধাক্কা মারল নাকে।

উঁহ, কি গন্ধ! নাক কুঁচকে ফেলল মুসা।

লাশের গন্ধ, একপাশ থেকে বলল কডি। পচা, ফুলে ওঠা লাশ।

ওর কথায় কান দিয়ো না, কিশোর বলল, ওটা ফরমালডিহাইডের গন্ধ। লাশের গায়ে মাখানো হয়।

পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল মুসার। গন্ধটা সহ্য করতে পারছে না।

হার স্বীকার করবে? মুসার কাঁধে আবার আন্তরিক ভঙ্গিতে হাত রাখল টাকি। দেখো, টাকা-পয়সা হাতের ময়লা। প্রাণই যদি না বাঁচল টাকা দিয়ে কি করবে? বলো, ভয় পেয়েছ। পেয়েছি  শুধু একটা শব্দ উচ্চারণ করলেই ছেড়ে দেব।

না! তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল কিশোর। মুসা আমান ভয় পায় না! ভয় শব্দটা ওর অভিধানেই নেই। বিশ্বাস না হয় রবিনকে জিজ্ঞেস করে দেখো। কি বলো, রবিন?

নীরবে মাথা ঝাঁকাল রবিন।

 মুসা, উঠতে পারবে? ঠেলা দেব? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

না, লাগবে না, দুই হাতে চৌকাঠ চেপে ধরল মুসা। দেয়ালে পা বাধিয়ে বেয়ে উঠে গেল ওপরে। অন্যপাশে পা ঝুলিয়ে দিয়ে চৌকাঠে বসল।