শুঁটকি বাহিনী – পরিচ্ছেদ ১৫

১৫.

পরের রাতে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে মুসা। এর একটা বিহিত Wil করতেই হবে। বন্ধ করতে হবে এই যন্ত্রণা। এ ভাবে সারাক্ষণ মানসিক চাপের মধ্যে থাকার চেয়ে তোতলা মুসা হওয়া বরং অনেক ভাল।

কিশোরকে ফোন করল সে। তৃতীয়বার রিঙ হতে তুলে নিল কিশোর, হালো, কিশোর পাশা বলছি।

আমি। মুসা।

ও, মুসা। কি খবর? থার্ড চ্যাপ্টারের অঙ্কগুলো মিলছে না তো?

জাহান্নামে যাক অঙ্ক! অঙ্ক নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না আমি। এত মানসিক চাপ নিয়ে হোমওঅর্ক করা যায় না।

মানসিক চাপ? অবাক হলো কিশোর। কিসের?

 কিসের, জানো না?

টেরির ফাইন্যাল চ্যালেঞ্জ।

অ, হাসল কিশোর, ওটা কোন চাপ হলো নাকি? যাব আবার। লাশের কফিনে শুয়ে দেখিয়ে দেবে তুমি। ব্যস, হয়ে গেল। পাঁচশোটা কড়কড়ে ডলারও এসে যাবে, তুমিও হিরো হয়ে যাবে স্কুলে। কেউ আর তোমাকে তোতলা মুসা বলে খেপাবে না।

খেপালে খেপাক! মড়ার সঙ্গে শুতে পারব না আমি। মর্গের মিথ্যে কথাটা কেন বললে ওদের?

মুসা, এখন এ সব সাধারণ কথা নিয়ে আলোচনার সময় নেই। অঙ্কগুলো শেষ করতে হবে। রাখি? পরে দেখা হবে।

ফোন রেখে দিল কিশোর।

রাগে জ্বলতে লাগল মুসা। রবিনকে ফোন করল।

সব কথা শুনে রবিন বলল, কিশোরের কাজ-কারবার আমারও কেমন অবাক লাগছে। কিন্তু বিনা কারণে তো কিছু করে না ও। ওর মনে কি আছে ও-ই জানে।

টেরির এই শয়তানিটা বন্ধ করা দরকার।

হ্যাঁ, দরকার।

তাহলে কিছু একটা করো। সাহায্য করো আমাকে। আমি ভাবলাম, রকি বীচে এসে কত না আরামে থাকব। কিন্তু এ যে গ্রীন হিলসের চেয়েও খারাপ অবস্থা।

অস্থির হয়ো না, মুসা। টেরির দল তোমার কিছু করতে পারবে না।

রবিনের কথায় খানিকটা সান্ত্বনা পেল মুসা।

ফোন রেখে দিয়ে বিছানায় বসল।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বেজে উঠল আবার। ভাবল রবিন করেছে। কিন্তু কানে ঠেকানোর সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল একটা ব্যঙ্গভরা কন্ঠ, কি ব্যাপার, মু মুসা? কার সঙ্গে এত বকরবকর করছিলে? তোমার প্রেতাত্মার সঙ্গে?

টা-টা-ট্টাকি!

হ্যাঁ, টা-টা-ট্টাকি! শোনো, টেরি বলেছে, ফাইন্যাল বাজিটা হবে কাল রাতে। ফিউনরল পারলারেই। কাল রাত, মনে রেখো। ভুললে, বাজি হারবে।

*

পরদিন। পাশাপাশি হাঁটছে কিশোর আর মুসা। পরিষ্কার রাত। সেদিনের মত বৃষ্টি নেই। তবে কনকনে ঠাণ্ডা। একফালি ফ্যাকাশে চাঁদ ভেসে বেড়াচ্ছে বাড়ি-ঘরের ছাতের ওপর নীলচে-ধূসর আকাশে। গাছগুলো আজ শান্ত, নিথর।

টেরিদের বাড়ির বাইরে তাকে আর তার বন্ধুদেরকে পাওয়া গেল। কিশোরদের জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। কিশোররা আসতে সবাই মিলে দল বেঁধে চলল ফিউনরল পারলারে।

নিটু আর হ্যারল্ড একটা টেনিস বল লোফালুফি করতে করতে চলেছে। ধরতে গিয়ে বার বার মিস করছে নিটু। অন্ধকার লন থেকে গিয়ে খুঁজে খুঁজে বের করে আনছে বলটা।

 টেরি, টাকি, কডি তিনজনেই গম্ভীর। আজ রাতে ওরা ফালতু কিছু করতে চায় না।

আগের দিনের দুশো, আজকের পাঁচশো-মোট সাতশো ডলার, এনেছ? জানতে চাইল কিশোর।

টেরি বলল, জেতো আগে, তারপর দেখা যাবে।

তারমানে টাকাটা তোমার মেরে দেয়ার ইচ্ছে?

মোটেও না। তুমি টাকা এনেছ কিনা, তাই বলো।

টাকার প্রয়োজন হবে না আমাদের, দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল কিশোর। কারণ বাজিটা হারছি না আমরা। মুসার পিঠে চাপড় দিয়ে বলল, মুসা, রবিন আর আমার একটা সমস্যাই হবে।

কি?

এতগুলো টাকা কি করে খরচ করব।

 অ, তাই তো! এতক্ষণ খেয়াল করলাম না, আশ্চর্য! রবিন কোথায়?

শরীর খারাপ। জ্বর। সেদিন রাতে ঠাণ্ডা লেগেছে। শুয়ে আছে কম্বলের তলায়।

আহহা, মিস করল। দেখতে পারল না। আজকের দেখাটাই সবচেয়ে জরুরী ছিল।

দেখো, কিশোর বলল, তোমাকে আগেভাগে বলে দিচ্ছি, কোন রকম ফালতু নাটক করতে যাবে না। দেখতে দেখতে অসহ্য হয়ে গেছি। সত্যিকারের ভয় দেখানোর মত কিছু করতে পারলে করো, নইলে চলো, চলে যাই। ফিরে গেলে সব টাকা এবারেও মাপ করে দিতে রাজি আছি আমি।

তারমানে ঘাবড়ে গেছ! খিকখিক করে হাসল টেরি। মানে মানে কেটে পড়তে চাইছ। তা হবে না। কালটুটাকে মু-ম্মুসা বানিয়েই ছাড়ব আমি।…আজকে আর নকল কিছু নয়। একটা আসল লাশ আছে।

হাঁটার সময় হঠাৎ ফুটপাতের কিনার থেকে মুসাকে ধাক্কা মেরে রাস্তায় নামিয়ে দিল কুডি। কি, কালটু, লাশের কথা শুনে পানি আছে কলজেতে? সত্যি কথাটা স্বীকার করে ফেলো না ছাই।

এমন জোরে এক ধাক্কা মারল কিশোর, ফুটপাত থেকে রাস্তায় পড়ে একেবারে চিত হয়ে গেল কডি। এবার হাত দিয়ে দেখো তো তোমার কলজেতে পানি আছে নাকি?

উঠে দাঁড়াল কডি। ঘুসি পাকিয়ে ছুটে আসতে গেল কিশোরের দিকে। ততক্ষণে সামলে নিয়েছে মুসা। রুখে দাঁড়াল কডিকে।

ঘটনা অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে দেখে ধমক দিয়ে কডিকে থামাল টেরি।

নীরবে পথ চলল এরপর সবাই। আর কোন অঘটন ঘটাল না।

পাতাবাহারের বেড়ার ধারে পার্কিং লটের পেছনে আগের দিনের জায়গায় এসে দাঁড়াল ওরা। অন্ধকারের মধ্যে বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে যেন ফিউনরল পারলারটা। আজ রাতে বৃষ্টি নেই। বাতাসও নেই। সব কেমন থমথমে। এক ধরনের ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা। মৃত্যুর মত নিথর।

টেরির পিছু পিছু পেছনের জানালাটার দিকে এগিয়ে চলল সবাই। পার্কিং লটের পাকা চত্বরে জুতো ঘষার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।

বিল্ডিঙের পেছনের ঘন অন্ধকারের মধ্যে এসে ঢুকল ওরা। বন্ধ জানালাটা খুলল টেরি। মুসাকে ইঙ্গিত করল আগে ভেতরে ঢোকার জন্যে।

দ্বিধা করতে লাগল মুসা। কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, সত্যি সত্যি লাশ আছে?

মাথা ঝাঁকাল টেরি। আছে। সত্যিকারের মড়া। আজ সকালে রেখে গেছে। সেজন্যেই তো আজকে আসতে বললাম।

মড়াটা এখনও তাজা, রসিকতার ঢঙে বলল হ্যারল্ড।

কেউ তার কথায় হাসল না।

ভ্যান থেকে কালো ব্যাগে ভরে সেদিনকার লাশ নামানোর দৃশ্যটা মনে পড়ল মুসার। সেদিন অবশ্য ভেতরে টেরি ছিল। কিন্তু দৃশ্যটা ভয়ানক। গায়ে কাঁটা দিল তার।

টেরি বলল, যাও, মু-ম্মুসা। আজ দেখব তোমার সাহস কেমন। জলদি করো। কে, কখন লাশ রাখতে চলে আসবে ঠিক নেই। ঠেলা দিয়ে মুসাকে জানালার চৌকাঠে তুলে দিল সে। যাও, যাও, তোমার কাজ শুরু করো।

শেষবারের মত সবার দিকে ফিরে তাকাল মুসা। ভঙ্গি দেখে মনে হলো চিরকালের জন্যে যাচ্ছে, আর কোনদিন দেখা হবে না ওদের সঙ্গে।

তারপর লাফ দিয়ে নামল ভেতরে।