টাইম ট্রাভেল – পরিচ্ছেদ ১০

১০.

জানালার ঠিক বাইরেই ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে ঘরের ভেতরে নজর রেখেছে দুই জোড়া চোখ।

মাজুলের দিকে ঘুরল গাজুল। নাহ্, এই অপদার্থগুলোকে দিয়ে হবে না। তিনটেই গাধা, গাধা, গাধা!

বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল সে। থু থু করে থুতু ফেলল মাটিতে।

তারমানে মগজশক্তি রসায়নেও কোন কাজ করছে না? জানালা দিয়ে আবার ক্লাসরূমের ভেতরে তাকাল মাজুল।

উঁহু, করছে না। মানুষ হলো একেবারে নিচু জাতের প্রাণী। বুদ্ধিশুদ্ধি বলতে কিছু নেই ওদের।

কি আর করা, মাজুল বলল। অকারণে আর এদের পেছনে লেগে না থেকে চলো আর কাউকে খুঁজি। এ স্কুলের কোনটাকে দিয়েই মনিবের কোন কাজ হবে না। বুদ্ধিমান মানুষ দরকার আমাদের। বুদ্ধিমান গোলাম।

.

মগজের ওষুধটা তো কাজ করছে না, আঙ্কেল, টেলিফোনে ককিয়ে উঠল রবিন।

তাকে বলো, মগজ খুলছে না আমাদের পাশে থেকে বলে দিল কিশোর।

বলো, আগের মতই বোকা রয়ে গেছি,মুসা বলল।

কিশোরের ঘরে বসে কথা বলছে ওরা।

তোদেরকে ধৈর্য ধরতে বলেছিলাম, আঙ্কেল বললেন। গবেষণাগারে কোনও ধরনের মেশিন চলছে। সেটার গর্জনকে ছাপিয়ে চিৎকার করে কথা বলতে হচ্ছে তাকে।

কিন্তু আমরা তো ঠিকঠাকমতই ওষুধ খেয়েছি, বলো না, কিশোর বলল। কাজ হচ্ছে না কেন? যা ভয়ঙ্কর একটা দিন কাটিয়েছি…আর…আর…

বরং আগের চেয়ে বোকা হয়ে গেছি, ফোনে আঙ্কেলকে জানাল রবিন।

এটা তোর ভুল ধারণা, আঙ্কেল জবাব দিলেন। তা ছাড়া এ ধরনের মগজ উন্নয়নকারী ওষুধগুলো রাতারাতি কাজ করে না। রক্তের সঙ্গে পুরোপুরি মিশে যেতে প্রচুর সময় নেয়। তোদেরকে এখন…

মেশিনের শব্দ থামল।

কিসের শব্দ হচ্ছিল, আঙ্কেল? জিজ্ঞেস করল রবিন।

ব্লেন্ডার মেশিন, আঙ্কেল জানালেন। গাজরের রস মেশাচ্ছি।

কিন্তু…আমরা কখন বুদ্ধিমান হব? রবিন নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। কালকে আমাদের অংক পরীক্ষা। আমরা চাইছি ভাল একটা গ্রেড পেতে।

ভাল, গ্রেড তো পরের কথা, কিশোর বলল। পাস করব কিনা সন্দেহ। আমি শুধু পাস করলেই খুশি।

ঘাড় কাত করে মুসাও কিশোরের সঙ্গে একাত্ম হলো। সেকথা আঙ্কেলকে জানাল রবিন।

পাস করবে না মানে? আঙ্কেল বললেন। অবশ্যই পাস করবে। কি বলেছিলাম তোদের, ভুলে গেছিস? ভাল করে পড়ালেখা করতে হবে। বেশি বেশি করে পরিশ্রম করতে হবে। ওষুধটার কথা মন থেকে উধাও করে দিয়ে একেবারে ভুলে যেতে হবে। তারপর দেখ না, কি ভাবে কাজ করছে। আগামীকালকের। পরীক্ষার জন্যে ভাবনা নেই। পাস করে যাবি।

কিন্তু, মাথা চুলকাল রবিন, এতক্ষণেও কি রক্তে মিশে যায়নি?

বললাম তো ওষুধটার কথা ভুলে যেতে, আঙ্কেল জ্যাক বললেন। কাল আবার ফোন করিস আমাকে। আমি জানি, কালকে তোরা ভাল খবর দিতে পারবি।

তাকে ধন্যবাদ আর গুডবাই জানিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখল রবিন।

ভাল খবর, তিক্তকণ্ঠে বিড়বিড় করল কিশোর। মেঝেতে রাখা ব্যাকপ্যাকটাতে ধা করে এক লাথি মারল, যেন সমস্ত দোষ ওটার। ভাল খবরটা কি আকাশ থেকে পড়বে? অংকে তো গোল্লা পাব।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। কোন চ্যাপ্টারটা পড়তে হবে তাই তো জানি না।

স্কুলের কাউকে ফোন করে জেনে নেব নাকি? রবিন বলল। রয়, কিংবা শারিয়া, কিংবা অন্য কেউ বলব আমাদের সঙ্গে এসে বসে পড়তে?

মাথা খারাপ নাকি তোমার? কিশোর বলল। ওরা আমাদের সঙ্গে বসে কস্মিনকালেও পড়বে না। আমাদের বোকামিকে ওরা রীতিমত ভয় পায়, এড়িয়ে চলে। বুঝতে পারো না সেসব? ব্যাকপ্যাকে আবার লাথি মারতে গিয়ে আঙুলে পেল ব্যথা। আঁউ করে উঠল।

এ সব রাগারাগি আর চিন্তা-ভাবনা করার চেয়ে এসো বসে বসে পড়ি, রবিন বলল। আঙ্কেল কি করতে বলেছেন, শুনলে না? মন দিয়ে পড়তে বলেছেন। ওষুধের কথা ভুলে যেতে বলেছেন।

হু, চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কিশোর। বের করো তো দেখি অংক বইটা। আর রিভিউ শীটটা।

গলাটা শুকিয়ে গেছে, মুসা বলল। কোকটোক কিছু আনো না।

যাচ্ছি,  বলে দরজার দিকে রওনা হলো কিশোর।

বারান্দায় বেরিয়েই উহ করে এক চিৎকার দিয়ে বুক চেপে ধরল।

কি হলো, কি হলো! বলে দৌড়ে এল মুসা ও রবিন।

হাসি শোনা গেল গলির মাথা থেকে। বলে উঠল হাসি হাসি একটা বালককণ্ঠ, ডার্টটা এত জোরে আঘাত করবে বুঝতে পারিনি।

জ্বলন্ত চোখে সেদিকে তাকাল কিশোর। চিৎকার করে উঠল, তুমি কখন এলে?

রবিন আর মুসাও বারান্দায় বেরিয়ে এসেছে। বারান্দার মাথায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল আট বছর বয়েসী ছেলেটাকে। ওর নাম ডন। মেরিচাচীর বোনের ছেলে। ওর বাবা আইব্রাম হেনরি স্টোকার অনেক বড় বিজ্ঞানী। অ্যারিজোনায় থাকে ডনরা। মাঝে মাঝেই বেড়াতে আসে সে। বেশির ভাগ সময়ই একা আসে।

কোথায় পেলে ওই ডার্ট? রাগে আবার চিৎকার করে উঠল কিশোর। ডার্ট কোন খেলনা জিনিস হলো না। আরেকটু..আরেকটু হলেই তো খুন করে ফেলেছিলে আমাকে।

 না, তা করব কেন? এগুলো খেলনা ডার্ট, এগিয়ে আসতে আসতে জবাব দিল ডন।

কিন্তু ব্যথা তো কম লাগল না, রাগ যাচ্ছে না কিশোরের। আর লাগালেও ঠিক হৃৎপিণ্ডের ওপরে।

তাই তো লাগাব, মেঝে থেকে ডার্টটা কুড়িয়ে নিতে নিতে নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিল ডন। তাতে পয়েন্ট বেশি। পঞ্চাশ পয়েন্ট। তবে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট মাথায় লাগাতে পারলে। মাথায় একশো। পেটে তিরিশ। হাতে আর পায়ে দশ পয়েন্ট করে।

ভাগো এখান থেকে ধমকে উঠল কিশোর। বুকের আহত জায়গাটা ডলতে ডলতে বলল, আবার কেন মরতে এসেছ এখানে? একা এলে নাকি?  

কিশোরের ধমকে হাসি মুছল না ছেলেটার। বরং মজা পাচ্ছে। তার কাজ সে করে ফেলেছে। হ্যাঁ, একা। থাকব কিছুদিন। বাবা গেছে বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে। ফিরতে দেরি হবে।

তারমানে জ্বালিয়ে মারবে! বিড়বিড় করল কিশোর। নিজের জ্বালাতেই বাঁচি না…

তার কথা যেন কানেই ঢুকল না ডনের। মুসার দিকে তাকাল, ডার্ট ছোঁড়াছুঁড়ি খেলবে নাকি, মুসাভাই?

নাহ, শুকনো কণ্ঠে জবাব দিল মুসা। কালকে অংক পরীক্ষা। পড়তে হবে।

পরীক্ষা দিয়ে আর কি করবে। ফেল করবে জানা কথা। তারচেয়ে এসো, ডার্ট খেলা যাক..

ধৈর্য হারাল কিশোর। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, তুমি যাবে এখান থেকে।

চমকাল না ডন। স্নায়ুর জোর সাংঘাতিক। ভুরু কুঁচকে কিশোরের দিকে তাকাল, কি হয়েছে তোমার, কিশোরভাই? অমন করছ কেন?  

জবাব দিল না কিশোর।

কিন্তু তার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বোধহয় বুঝতে পারল ডন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। আর কিছু না বলে চলে গেল সে।