টাইম ট্রাভেল – পরিচ্ছেদ ১৯

১৯.

 বাইরের আঙিনায় একটা কালো কাঁচে ঢাকা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।

কিশোর, মুসা আর রবিনকে এনে সেটাতে তুলল গাজুল। ইঞ্জিন স্টার্ট দিল।

ইয়ার্ড থেকে বেরিয়ে গাড়ির গতি যতটা সম্ভব বাড়িয়ে দিল গাজুল। শহর থেকে বেরোতে সময় লাগল না। সোজা চলল বুনো অঞ্চলের দিকে।

বনের মধ্যে ঢুকল গাড়ি। আঁকাবাকা কাঁচা রাস্তা পার হয়ে এসে ঢুকল বনের মাঝখানের এক টুকরো খোলা জায়গায়।

গাড়ি থেকে তিন গোয়েন্দাকে নামতে বলল গাজুল।

অবাক হয়ে কিশোর দেখল, খোলা জায়গাটায় বিশাল একটা গোলকের মত জিনিস দাঁড়িয়ে আছে। আটটা পা। গায়ে নাম লেখা: টাইম ট্রাভেল-৭।

নামটা স্মৃতির পাতায় কোথায় যেন অনুরণন তুলল। চেনা চেনা মনে হচ্ছে তার, কিন্তু চিনতে পারছে না গোলকটাকে। কোথায় দেখেছে এ জিনিস? মনে করতে পারল না।

গোলকের কাছে তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে এল গাজুল। মোবাইল ফোনের মত একটা যন্ত্র বের করে কথা বলল। গুঞ্জন উঠল গোলকের ভেতরে। আট পায়ের মাঝখানে একটা গোল চাকতির মত ঢাকনা খুলে গিয়ে ঝুলে পড়ল ধীরে ধীরে। মই নেমে এল গোলকের পেটের ভেতর থেকে। সেটা বেয়ে উঠে যেতে আদেশ করল গাজুল।

উঠে গেল তিন গোয়েন্দা। জিনিসটাকে স্পেসশিপের মত লাগল ওদের কাছে। ভেতরে আলো এত উজ্জ্বল, চোখ মিটমিট করতে লাগল ওরা।

চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগল কিশোর। ছোট ছোট ডজনখানেক খুপরিমত চোখে পড়ল। এমন করে সাজানো, মৌচাকের মত দেখতে। মৌচাকের ভেতরে যেমন খুপরি করা থাকে।

গাজুলকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল তারই মত আরেকজন। ধাক্কা দিয়ে দিয়ে নিয়ে গিয়ে তিন গোয়েন্দাকে ঢোকাল একটা কিউবের মত দেখতে চারকোনা ঘরে। জেলখানার দরজার মত দরজাটা ঠেলে দিল। রূপালী রঙের শিকগুলো ঝলমল করছে। মৃদু আলোকিত টিউব লাইটের মত। তালা লাগানোর শব্দ কানে এল ওদের।

এ তো দেখি খাঁচার মধ্যে এনে ভরেছে আমাদের, মুসা বলল। জানোয়ারের খাঁচা।

রূপালী রঙের একটা সরু গলি ধরে চলে গেল লোকগুলো। খাঁচার দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল গোয়েন্দারা। তীব্র আলো চোখে সইয়ে নেয়ার অপেক্ষা করছে। বুকের মধ্যে দুরুদুরু করছে হৃৎপিণ্ডটা।

নিশ্চয় এখুনি উড়াল দেবে এই জিনিসটা, রবিন বলল। আর কোনদিন আমরা আমাদের বাড়িঘর দেখতে পাব না। বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব কাউকে দেখব না। শেষ দিকে ভারী হয়ে এল তার কণ্ঠস্বর।

বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে মুসা বলল, তবু যাই হোক, ডনকে তো বাঁচাতে পারলাম। কি বলো, কিশোর?  

নীরবে মাথা ঝাঁকাল শুধু কিশোর।

সত্যি কি বাঁচাতে পারলাম?  রবিনের প্রশ্ন। কি, মনে হয় তোমার, কিশোর, মাজুল আর গাজুল কথা রাখবে?

শিওর হওয়ার তো কোন উপায় নেই। তবু ভালটাই আশা করি। ধরে নিলাম রাখবে।

তা তো বুঝলাম, দুই হাতে শিক চেপে ধরল রবিন। কিন্তু আমাদের কি হবে এখন?

এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার একটা উপায় বের করতেই হবে আমাদের, ফিসফিস করে বলল কিশোর। একবার এটা উড়ে গেলে বাড়ি ফেরার পথ চিরদিনের জন্যে বন্ধ হয়ে যাবে আমাদের।

চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল আঁচাটার চারপাশে তাকাল সে। যে দরজাটা দিয়ে ঢুকেছে ওরা সেটা ছাড়া বেরোনোর আর কোন দরজা নেই। আছে কেবল খাঁচার পর খাঁচা, ওপরে, নিচে, চারপাশে মুরগীর খাঁচা একটার ওপর আরেকটা যেমন করে সাজিয়ে রাখা হয় সেভাবে।

দরজার শিকগুলোতে হাত বুলিয়ে দেখল কিশোর। এমন ভাবে মিশে রয়েছে, দেখাই যায় না কোথায় আছে। হাত বোলাতে বোলাতে বলে উঠল সে, দাঁড়াও দাঁড়াও, কোথায় আছে বুঝতে পারছি!

দরজার শিক ধরে টান দিল সে। ঠেলা দিল। ঝাঁকি দিল। পাশে ঠেলে সরানোর চেষ্টা করল। প্রথমে ডানে, তারপর বাঁয়ে।

নাহ, নাড়াতেই পারছি না, জোরে এক নিঃশ্বাস ফেলে বলল সে।

তিনজনে মিলে ঠেললে কেমন হয়? মুসা বলল।

উঁহু, লাভ হবে না, মাথা নাড়ল কিশোর। নিরেট ধাতু। কিছুই করতে পারব না। তার ওপর রয়েছে তালা। আর মজার ব্যাপারটা হলো, তালাটা দেখতেও পাচ্ছি না আমরা। কিন্তু জানি, আছে ওটা ওখানে। কোন হুড়কো-টুড়কোও দেখা যাচ্ছে না, দেখো।

ভুরু কুঁচকে বলল রবিন, কিছুই করতে পারছি না। অথচ মজাটা দেখো, অতি বুদ্ধিমান হওয়ার কারণে স্কুল থেকেই বের করে দিল আমাদেরকে। বুদ্ধিমান হয়ে তাহলে লাভটা কি হলো?

লাভ হবে, কিশোর বলল। ভাবতে থাকলে।

তাহলে ভাবছ না কেন?

উজ্জ্বল শিকগুলোর ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাল কিশোর। গাজুলকে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখল। কখন কোনখান দিয়ে এসে উদয় হয়েছে বুঝতেও পারেনি গোয়েন্দারা। ঠিক তার পেছনে মাজুলকে উঁকি দিতে দেখল কিশোর।

গাজুল বলল, আমাদের কথা আমরা রেখেছি। ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে এসেছে মাজুল। এখন আমরা রওনা হব। স্নায়ু শান্ত করো। আমাদের যদি শোনাতে না চাও জোরে কথা বলবে না। এতক্ষণ যা যা বলেছ, কন্ট্রোল প্যানেল থেকে সব শুনতে পেয়েছি আমরা।

আমাদের ছেড়ে দিন, হাতজোড় করে অনুরোধ করল মুসা। দোহাই আপনাদের। আমরা গোলাম হতে পারব না।

হ্যাঁ, ঠিক, তার সঙ্গে সুর মেলাল কিশোর। ভাল গোলাম আমরা কোনদিনই হতে পারব না। বেকার ধরে নিয়ে যাচ্ছেন আমাদের। আপনাদের মনিব আমাদের পেয়ে মোটেও খুশি হবেন না। বরং প্রচণ্ড রেগে যাবেন। আপনারা জানেন না, আমাদের স্বভাব-চরিত্র একটুও ভাল না। কাজ করতে ইচ্ছে করে না আমাদের। কেউ আমাদের কথা শোনাতে পারে না। সব সময় খালি কুচিন্তা ঘোরে আমাদের মগজে। ক্ষতিকর চিন্তা। এ রকম শয়তান মানসিকতার কাউকে দিয়ে কি আর গোলামের কাজ করানো যায়?

কিন্তু আমরা করাব, গাজুল বলল। গোলামদের কি ভাবে কাজ করাতে হয় জানা আছে আমাদের।

মাজুলকে নিয়ে চলে গেল সে।

নিজেদের সম্পর্কে এত এখারাপ কথা বলেও লাভ হলো না। গুঙিয়ে উঠল

শিক চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল তিনজনে।

আর কিছু করার নেই, কি বলো? ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল মুসা। কোনই লাভ হলো না। কিছুই করতে পারব না আমরা।

কিন্তু উপায় আছে কিনা ভাবতে দোষ কি? রবিন বলল। অতি বুদ্ধিমান হয়ে গেছি আমরা। বুদ্ধি খরচ করে যদি নিজেদের বাঁচাতেই না পারলাম, তাহলে আর এ বুদ্ধি দিয়ে করবটা কি?

স্থির দৃষ্টিতে রবিনের দিকে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল কিশোর। ঠিক। কাজেই যদি না লাগল এত বুদ্ধি দিয়ে করবটা কি? এই বুদ্ধির জন্যেই যত যন্ত্রণা। আজ আমাদের এই দুরবস্থা। গোলাম বানানোর জন্যে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমাদেরকে।

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল তার দুই সহকারী।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নীরব হয়ে রইল তিনজনে। তাকিয়ে রইল ওদের সামনের রূপালী রঙের মৌচাকের মত খুপরিগুলোর দিকে।

তারপর ঘুরে তাকাল রবিন। বিড়বিড় করে বলল কিশোরকে, ভাবো। ভেবে বের করো না কিছু।

নাহ, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে জবাব দিল কিশোর, কোন উপায় দেখছি না। কিছুই বের করতে পারছি না। কিছু না। তোমরা চেষ্টা করো না।

তুমি পারছ না আর আমরা পারব কোত্থেকে? হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বলল মুসা।

আমি এখন ভাবতেই পারছি না কিছু, কিশোর বলল। মগজের ভেতরটা কেমন ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। স্পষ্ট হচ্ছে না কিছু। এই গোলকনটাতে ঢোকার পর থেকেই ধীরে ধীরে ভারী হয়ে যাচ্ছে মাথাটা।

কিশোরের চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রবিন। কি বুঝল কে জানে। ঢোক গিলল। চোখ বড় বড় হয়ে গেল। চিৎকার করে উঠল হঠাৎ, আমারও হচ্ছে এ রকম! মগজের ওষুধ! নিশ্চয় কার্যকারিতা হারাচ্ছে! শেষ হয়ে যাচ্ছে ওষুধের ক্ষমতা!

কাঁপতে শুরু করল খাঁচাটা। দুলতে শুরু করল। ঢেউয়ের মধ্যে পড়া নৌকার মত। পেছনে শোনা গেল ইঞ্জিনের জোরাল গর্জন। শক্ত করে শিক চেপে ধরল

থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে পুরো গোলকটা।  উড়াল দিচ্ছে এটা চিৎকার করে উঠল মুসা। উড়ে যাচ্ছে। এখন কি করব?