শুঁটকি বাহিনী – পরিচ্ছেদ ১৮

১৮.

ছাড়ো! ছাড়ো আমাকে! গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করল মুসা, ভয় নয়, হুমকি। কেঁচোর মত শরীর মোচড়াচ্ছে, ছটফট করছে, আ য লাশের বাহু থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে। নইলে ভূতগিরি। ঘুচিয়ে দেব আজ জন্মের মত!

কিন্তু চোখ বোজা, সবুজ দানবটা ছাড়ল না ওকে। ঝাড়া লাগতে জট পাকানো চুলের বোঝা থেকে ঝরঝর করে ঝরে পড়তে লাগল মাছির সাদা সাদা শুয়াপোকা। পচা মুখটা নিয়ে এল চোখের সামনে। বাহুর চাপ আরও বেড়েছে। চাপ দিয়ে ভর্তা করে দেবে যেন হাড়-পাজরা।

হুটোপুটি শোনা গেল পেছনে।

কোনমতে ঘাড় ঘুরিয়ে মুসা দেখল, সামান্য সুযোগের পুরো সদ্ব্যবহার করেছে টেরিরা, পড়িমড়ি করে জানালার দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। মজা দেখার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকার কথা কল্পনায়ও আনছে না আর ওরা।

সবার আগে জানালার কাছে পৌঁছল কডি। মুহূর্তে উড়ে চলে গেল যেন বাইরে।

মুসার কোমর জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করতে লাগল সবুজ মড়াটা।

সেসব দেখার সময় নেই নিটু আর হারল্ডের। কার আগে কে জানালা টপকাবে এই নিয়ে হুড়াহুড়ি শুরু করল। ধাক্কা দিয়ে দুজনকে দুই পাশে ফেলে বেরোনোর চেষ্টা করল কিশোর। তাতে গেল সব জট পাকিয়ে, তিনজনের কেউ বেরোতে পারল না। মাথার ওপর দিয়ে ডাইভ দিল টাকি। কপাল ঠুকে গেল চৌকাঠে। ব্যথাটাকে পাত্তাই দিল না সে। ডিগবাজি খেয়ে গিয়ে পড়ল, জানালার বাইরে। ফাঁক পেয়ে তার পর পরই বেরিয়ে গেল টেরি। ওর ঠ্যাং ধরে বেয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিল কিশোর। পারল না। পড়ে গেল মেঝেতে। টেরির পর একে একে বেরোল নিটু আর হ্যারল্ড।

হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। জানালায় উঠে বসল। চিৎকার করে ডাকতে লাগল, টেরি! টাকি! কডি! তোমাদের ঈশ্বরের দোহাই লাগে! আমাকে নিয়ে যাও। ফেলে পালিও না…

কিন্তু কেউ তার কথার জবাব দিল না। কাদা-পানিতে জুতো ফেলার ছপছপ শব্দ শোনা যাচ্ছে কেবল।

লাফিয়ে অন্যপাশে নেমে গেল কিশোর। তার জুতোর শব্দও মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে।

চুপ হয়ে গেছে মুসা। তাকে নড়তে-চড়তে না দেখে সবুজ মড়াটাও শান্ত হয়ে গেছে। চাপ দিচ্ছে না আর। ঝটকা দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে পিছিয়ে এল মুসা।

দৌড়ে এল জানালার কাছে। মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিল জানালার বাইরে।

আবছা অন্ধকারে অনেকগুলো ছায়ামূর্তিকে ছুটে যেতে দেখল পাতাবাহারের বেড়ার দিকে।

মড়াগুলোর দিকে ফিরল আবার মুসা। মুচকি হাসি ফুটেছে মুখে। সবুজ মড়াটাকে উদ্দেশ্য করে বলল, পালিয়েছে সব। চলো, এই সুযোগে কেটে পড়া যাক।

 টান দিয়ে মুখ থেকে মুখোশটা খুলে নিল সবুজ মড়া। বেরিয়ে পড়ল রবিনের হাসিমুখ। কিশোর কোথায়?

ভঙ্গি দেখে যে কেউ ভাববে ভূতের তাড়া খেয়ে পালিয়েছে, হাসতে হাসতে বলল মুসা। ওর কাণ্ড দেখেই আরও ভড়কে গেছে শুঁটকি-বাহিনী।

কাণ্ড তুমিও কম করনি। উহ্, দুজনে মিলে যা শুরু করলে, হাসি চেপে রাখাই কঠিন হয়ে গিয়েছিল আমার জন্যে!

তোমাদের অভিনয় আরও ভাল হয়েছে, মেঝেতে চোখ পড়ল মুসার। মাছির পোকাগুলোর দিকে। অনড় পড়ে আছে। আজকাল প্ল্যাস্টিক দিয়ে কত রকমের জিনিস যে তৈরি করছে খেলনাওলারা। মুখ তুলল। দারুণ হয়েছে। ছদ্মবেশ। কারও বাপেরও চেনার সাধ্য ছিল না। …সত্যি সত্যি ভূত ভেবে আরেকটু হলে আমিও পালাচ্ছিলাম!

*

আধঘন্টা পর।

স্যালভিজ ইয়ার্ডে তিন গোয়েন্দার ব্যক্তিগত ওঅর্কশপে গাদাগাদি করে বসেছে ওরা সাতজন। কিশোর, মুসা, রবিন, তাদের দুই বন্ধু টম ও বিড, এবং ওদের দুজনের বন্ধু বারটি আর ডিউক।

হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে গেছে ওদের। তা-ও থামছে না হাসি। হসির দমকে কয়েকবার করে পানি এসেছে চোখের কোণে। মুছেছে, আবার হেসেছে।

ও, হাসতে হাসতেই কাহিল হয়ে গেছি! মুসা বলল। কিশোর, আর সহ্য করতে পারছি না। ফ্রিজে কিছু নেই তোমাদের?

বসো। নিয়ে আসছি।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই গোট চারেক পিৎসা আর বড় এক জগ। কমলার রস নিয়ে হাজির হলো কিশোর।

খাবারের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল সবাই। খিদে পেয়েছে সবারই।

খেতে খেতে মুসা বলল, কিশোরের প্ল্যানটা যে এ ভাবে কাজে দেবে, ভাবতে পারিনি। সত্যি বলতে কি, শুরুতে তো রাগই হচ্ছিল আমার ওর ওপর, টেরির দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শত্রুতা করছে ভেবে।

আর এখন? হেসে জিজ্ঞেস করল রবিন।

 সেটা কি বুঝিয়ে বলতে হবে?

না, তা হবে না। তোমার রাগ হয়েছে, তাতে আর দোষ কি, ওর আচরণে আমিই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি, তোমার ভয়ের রোগটা সারানোর জন্যেই এই চালাকি করেছিল সে…

প্রশংসাটা বেশি হয়ে যাচ্ছে, বাদ দাও এবার, হাত তুলল কিশোর। মুসা, তোমার ভয়টা গেছে তো?

এক্কেবারে মাথা কাত করল মুসা।

 আর কিছুকে ভয় পাবে না কখনও?

 জীবনেও না।

তা তো হলো, বিড বলল। কিন্তু শুঁটকির গোষ্ঠী বাজির টাকা মিটিয়েছে?

দেবে আর কখন? হাসতে হাসতে বলল কিশোর। প্রাণ নিয়ে পালানোর পথ পাচ্ছিল না, আবার টাকা। জানালার কাছে যা হুড়াহুড়িটা করল… দৃশ্যটা মনে করে হো-হো করে হেসে উঠল আবার সে।

হাসিটা সংক্রমিত হলো সবার মাঝে।

আরেক দফা হাসাহাসি আর চোখ মোছামুছির পর কিশোর বলল, চিন্তা নেই, আশা করি কাল স্কুলেই আদায় করে ফেলতে পারব টাকাটা।

যদি দিতে না চায়?

তোমরা তো আছই। আবার এমন এক প্যাঁচে ফেলব, সেধে এসে পায়ে ধরে দিয়ে যাবে।

*

খেয়েদেয়ে কিশোরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্যালভিজ ইয়ার্ড থেকে বেরিয়ে এল মুসা, রবিন, টম, বিড ও তাদের বন্ধুরা। গেট পর্যন্ত তাদের এগিয়ে দিয়ে গেল কিশোর।

সবাই এক জায়গায় থাকে না। একসঙ্গে যতদূর যাওয়া যায়, গেল, তারপর আলাদা হয়ে যার যার বাড়ির দিকে রওনা হতে লাগল একে একে।

সবার শেষে আলাদা হলো মুসা আর রবিন।

নির্জন রাস্তা ধরে হনহন করে হেঁটে চলল মুসা। একটা জায়গায় দুধারে গাছের সারি। ঘন ঝোঁপঝাড়। তার মধ্যে দিয়ে চলে গেছে পথ।

সেখানটায় এসে থমকে দাঁড়াল মুসা। ভয়ে ভয়ে তাকাল অন্ধকারের দিকে। বুঝতে পারছে, মুখে যতই বলুক ভয় পাবে না, ভূতের ভয় সে মন থেকে তাড়াতে পারবে না কোনদিন।

চারপাশে তাকাল অন্য কোন পথচারী আছে কিনা সেই আশায়। কিন্তু এত রাতে কে আর বেরোবে অকারণে। কাউকে দেখল না।

অনন্তকাল ধরে দাঁড়িয়েও থাকা যায় না। দোয়া-দরূদ পড়ে ফুঁ দিয়ে নিল বুকে। তারপর যা থাকে কপালে ভেবে দিল ভো দৌড়।

টেরির কপাল খারাপ, দৌড়টা দেখতে পেল না। এ মুহূর্তটার জন্যে। পঞ্চাশ হাজার ডলার বাজি ধরতেও দ্বিধা করত না তাহলে সে।