রুশ কবিতা: প্রতীক্ষিত ক্রান্তিকাল

রুশ কবিতা: প্রতীক্ষিত ক্রান্তিকাল

১৯১৭ সালের বিপ্লব রাশিয়ার জীবনযাত্রা, ইতিহাস সব কিছু অকস্মাৎ বদলে দেয়, সাহিত্যের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে ধারণারও পরিবর্তন শুরু হয়। কিন্তু বিপ্লব-পরিকল্পনার অনেক আগে থেকেই রাশিয়ার সাহিত্যে একটা আমূল পালাবদল প্রতীক্ষিত ছিল।
গত শতাব্দীর প্রথম খণ্ডেই রুশ কবিতার স্বর্ণযুগের অভ্যুদয় ও অবসান। এই স্বর্ণযুগের সম্রাট ছিলেন পুশকিন, এ ছাড়া প্রায় কাছাকাছি প্রতিভাধর জুকভস্কি এবং ব্যাটিয়োস্কভ। পুশকিন একই সঙ্গে সাম্রাজ্য ও স্বাধীনতার সভাকবি, তিনি রাশিয়ার লোকসংগীত, পল্লিগাথার সঙ্গে মিলিয়েছিলেন সমগ্র ইউরোপীয় ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠ ফসল, তাঁর অবিশ্বাস্য ক্ষমতাবলে রুশ কবিতা হয়ে ওঠে একই সঙ্গে মন্দাকিনী ও ফল্গু। রাজনৈতিক কবিতা রচনার জন্য তিনি নির্বাসিত হয়েছিলেন, সেই নির্বাসন তার ক্ষেত্রে সুফলা হয়েছিল, নির্বাসনকালে লেখা তাঁর দীর্ঘ কবিতাবলীতে রোমান্টিসিজম, সৌন্দর্যবন্দনা এবং বাস্তবতার অপূর্ব সমাহার দেখা যায়।
১৮৩৭ সালে পুশকিনের মৃত্যুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রুশ কবিতার স্বর্ণযুগের অবসান হয় বলা যায়। পুশকিনের সময় আর একজন বিপ্লবী তরুণ, লেরমেনটফ কবিতায় বিদ্রোহ আনার চেষ্টা করেছিলেন ঠিকই, বাসনার তীব্রতা এবং অহংকৃত নৈঃসঙ্গ ফুটে উঠেছিল লেরমেনটফের কবিতায়, কিন্তু মাত্র সাতাশ বছরে তার মৃত্যু অকস্মাৎ সেই বিপ্লবে ছেদ এনে দেয়। পুশকিন কবিতার সঙ্গে সঙ্গে চমৎকার গদ্যকাহিনীও লিখেছেন, তখনকার রাশিয়ার সেই কিশোর-গদ্য ক্রমে অতিকায় দানবের রূপ নিয়ে জেগে ওঠে, কবিতাকে দমন করে গদ্যের এমন প্রভুত্ব গত শতাব্দীতে পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায়নি। ১৮৪০-এর পর অনেকেরই ধারণা হয়েছিল যে রাশিয়ায় কবিতার দিন শেষ হয়ে গেছে। পুশকিন এবং গোগোলের গদ্য রচনা অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, পরবর্তী দুতিন দশকে আস্তে আস্তে দেখা দিলেন, ডস্টয়েফস্কি, টুর্গেনিফ, গনচারফ এবং টলস্টয়। তখন আর কবিতা কে পড়ে। এঁদের রচনায় সামাজিক বাস্তবতা এমন মর্মভেদী এবং সত্য হয়ে দেখা দেয় যে, তখন বহু সমালোচক কবিতার বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে ধরে বলেছিলেন যে, সেসব কবিতা লেখার কোনওই মানে হয় না, যার সঙ্গে সামাজিক বাস্তবতার কোনো সম্পর্কই নেই। এমনকী, একজন সমালোচক এসময় বলেছিলেন, একজোড়া জুতোর দামের চেয়েও শেকসপিয়ারের রচনাবলী কম মূল্যবান! টলস্টয়ও লিখেছিলেন, শেকসপিয়ারের রচনা শুধুমাতাল, বেশ্যা আর খুনোখুনিতে ভরতি, ওর মধ্যে কোনও সাহিত্য নেই। ফলে এই সময় কবিতা খানিকটা মুখচোরা হয়ে পড়েসমাজের অনুশাসন মেনে কিংবা নিছক দেশের উপকারের জন্য কবিরা কখনও কলম ধরতে চাননি, কখনও হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে রাজি হননি। ফলে রাশিয়ায় সেই সময় কবিতা নিষ্প্রভ হয়ে গদ্যের উদ্ভাসিত জ্যোতি প্রত্যক্ষ হয়। তারপর সিম্বলিস্টরা এসে এই প্রায়ান্ধকারের অবসান ঘটায়।
গদ্যের এই জয়যাত্রার যুগে মাত্র দু’জন বড় কবির দেখা পাওয়া যায়। এই দু’জন দুদলের প্রতিনিধি। একদল সমাজবাস্তবতাবাদী, অপর দলের তখনও বিশ্বাস আর্ট ফর আর্টস সেক। এই দ্বিতীয় দল তখন কোণঠাসা, কিছুটা ধিকৃত, এঁদের মধ্যে প্রধান, আফানাসি ফেট-মধুর ললিত ভাষায়, প্রকৃতি, প্রেম ও বিষাদের কবিতা লিখে কিছু লোকের মন জয় করেছিলেন। তবু, ফেট-কে অবশ্য বিপ্লবের বহু আগেই রি-অ্যাকশনারি আখ্যা পেতে হয়েছিল। প্রথম দলের প্রধান কবি নেক্রাসফ প্রভূত জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তখনকার গদ্যবাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। নেক্রাসফের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, দেশের দুঃখ-দুর্দশা, সামাজিক অপব্যবহার এর বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবার জন্যই কবিতা লেখা উচিত। অনুগামীদের তিনি ধমকে বলেছিলেন, তোমাকে কবি না হলেও চলবে, কিন্তু তোমাকে দেশের খাঁটি নাগরিক হতেই হবে।
রাশিয়ার কবিতার জগতে এরকম বিশৃঙ্খলা চলেছিল গত শতাব্দীর শেষ দশক পর্যন্ত। ১৯১৭র সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর, সাহিত্যকে সমাজবাস্তববাদী হতেই হবে এমন যে দাবি ওঠে, দেখা যাচ্ছে সেটা আকস্মিক বা ঠিক জোর করা নয়, এরকম প্রত্যাশা রাশিয়ায় গত শতাব্দীর মধ্যভাগেই জেগেছিল এবং শুরু হয়েছিল। সে চেষ্টা অবশ্য ধারাবাহিক হয়নি, বাস্তবতা ও আদর্শের চিৎকারে পুরোপুরি হাঁপিয়ে ওঠার পর ১৮৯০ সালে আবার কবিতায় আধুনিক আন্দোলন শুরু হয়। একদল কবি বাস্তবতার বাড়াবাড়ি অগ্রাহ্য করে ফিরতে চাইলেন হৃদয় গহনে, সামাজিকের বদলে ব্যক্তিগত দুঃখবোধ, অতীন্দ্রিয় অনুসন্ধান, রহস্যের বন্দনা, ইত্যাদি প্রবেশ করল কবিতা। ফ্যাঁ দ্য সিয়ে—অর্থাৎ শতাব্দী-শেষের কবিতায় যে চরিত্রলক্ষণ প্রকাশ পেয়েছিল ফরাসি কবিতায়, রাশিয়াতেও তার প্রভাব দেখা গেল, এই আধুনিক আন্দোলনের নাম দেওয়া হয়েছে সিম্বলিজম, বহু শক্তিমান কবির অভ্যুদয় হল, সমালোচকরা এই পর্বের নাম দিয়েছেন রুশ কবিতার দ্বিতীয় স্বর্ণযুগ। কিন্তু প্রথম স্বর্ণযুগের পুশকিন কিংবা লেরমেনটফের তুল্য মহান শক্তিধর কবি এঁদের মধ্যে একজনও ছিলেন না বলে, একে রুপোলি যুগ বলাই ভাল। রুশ বিপ্লবের আগে পর্যন্ত এই কবিরাই প্রধান স্থান অধিকার করে ছিলেন।
সিম্বলিস্ট আন্দোলনের প্রথম দলের কবিরা, ভাষার তীক্ষ্ণতা, শব্দঝংকার, ছন্দবৈশিষ্ট্য নিয়েও বেশি কারিকুরি দেখিয়েছেন। এঁদের পরবর্তী কবির দলই প্রকৃত অর্থে সিম্বলিস্ট, এঁদের মধ্যে সকলকে ছাড়িয়ে উঁচুতে উঠে আসেন আলেকসান্দার ব্লক, বিংশ শতাব্দীর প্রকৃত রুশ কবিতার তিনিই প্রথম স্তম্ভ।

আলেকসান্দার ব্লক

[বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত রুশ কবিতায় দুটি পর পর স্পষ্ট সাহিত্য আন্দোলনের বিকাশ দেখা যায়। এই দুটি আন্দোলনেরই জন্ম পশ্চিম ইউরোপের অন্য দুটি দেশে। ফরাসি দেশ থেকে সিম্বলিস্টদের কবিতা ও রচনাদর্শ অনুপ্রাণিত ও পুনরুজ্জীবিত করে রুশ কবিতা, ব্লক এই ধারার অন্তর্গত। এর কিছু পরেই, ইতালির ফিউচারিস্ট আন্দোলনের ঢেউ-ও এসে পৌঁছায় রাশিয়ায়, এবং এ আন্দোলনের নেতা হিসেবে দেখা দেন মায়াকভস্কি।
আলেকসান্দার ব্লকের জন্ম ১৮৮০-তে। রাশিয়ার সিম্বলিস্ট কবিদের মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ, আজ পর্যন্ত রুশ কবিতায় তার প্রবাহ অপ্রতিরোধ্য। বোদলেয়ার, মালার্মের প্রভাবে রাশিয়ায় সিম্বলিস্ট কবিরা জেগে ওঠেন। বোদলেয়ার প্রচারিত করেসপন্ডেন্স অর্থাৎ লৌকিক ও অলৌকিক জগতের মধ্যে একটা সত্য যোগসূত্র আছে, একমাত্র কবিরাই ব্যক্তিগত প্রতীকে তা প্রকাশ করতে পারেন, রুশ কবিরাও এ ধারণা গোড়ার দিকে মেনে নিয়েছিলেন। পরে কবিদের নিজস্ব প্রতিভায় তা অনন্যতা পায়। তিনি কবিতায় সুরের সর্বাত্মক প্রাধান্য বিশ্বাস করনে।
১৯১৭র বলশেভিক বিপ্লবে তিনি উৎসাহের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন, বস্তুত ১৯০৫ সাল থেকেই বিপ্লবের প্রস্তুতি ও প্রচেষ্টার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে তিনি শান্তি ও সংগীতময় জগৎ পেয়ে যাবার আশা করেছিলেন। কিন্তু বিপ্লবের ঠিক পরেই যে অবধারিত বিশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক দুর্যোগ দেখা যায়, তাতে তিনি বিষয় হয়ে পড়েন। দেশের কোথাও তখন সুরের উপযোগী আবহাওয়া নেই, সুতরাং শেষ জীবনে তারও বুক থেকে সুর হারিয়ে যায়, কবিতা লেখার সব প্রেরণা থেকে নিঃস্ব হয়ে তার মৃত্যু মাত্র ৪১ বছরে, ১৯২১ সালে।]

নামহীন একটি কবিতা

তুষার গোধূলিতে একটি কালো কাক
রৌদ্রে পীত কাঁধে কৃষ্ণ মখমল
একটি সুরময় কণ্ঠে মৃদু গান
আমাকে শোনাল সে দক্ষিণাঞ্চলে রাত্তিরের গান।

হৃদয় লঘু, এল কামনা বাধাহীন
সাগর যেন আজ জানাল সংকেত
অতল পাতালের থেকে অনন্তে
কীটেরা উড়ে যায় সঘন শ্বাস ফেলে।

বরফ-মেশা হাওয়া, তোমার নিশ্বাস
আমার নেশাখোর ওষ্ঠাধর…
ভ্যালেন্টিনা, তুমি স্বপ্ন, তারা!
তোমার দোয়েলেরা কেমনে গান গায়…

ভীষণা এ পৃথিবী! বড়ই ছোট এই বুকের তুলনায়!
তোমার চুম্বনের প্রলাপ জড়ানো,
জিপসি গানে গানে অন্ধকার ফাঁদ,
আকাশে উল্কার সবেগে উড়ে যাওয়া।


সুরদেবীর উদ্দেশ্যে
(শেষ অংশ)

রাত্রি, রাজপথ, আলল, একটি ওষুধের দোকান
একটি অর্থহীন মিটমিটে বাতি।
যদি তুমি বেঁচে থাকো আরও এক সিকি শতাব্দীতে
সব কিছুই তবু এই রকম থাকবে। এর থেকে মুক্তি নেই।
তুমি মরে যাবে, আবার সব কিছু নতুন করে শুরু করে দেখো
সব কিছুরই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, সেই পুরনো কালের মতন;
রাত্রি, খালের জলে বরফ-মেটানো ছোট ঢেউ, সেই
একটি ডাক্তারের দোকান, রাজপথ, সেই আলো।
.
আনা অখমাতোফা

[রুশ দেশে সিম্বলিজম ও ফিউচারিজম এই দুই আন্দোলনের মাঝখানে আর এক সংক্ষিপ্ত কাব্যাদর্শ দেখা দিয়েছিল, যার নামকরণ হয়েছিল অ্যাকমেয়িজম, এর আয়ু মোটামুটি ১৯১০ থেকে ১৯১৭। সিম্বলিস্টদের বিরুদ্ধে এঁদের বক্তব্য এই ছিল যে, লৌকিক ও অলৌকিকের যোগাযোগের ধারণা ভুল, কবির যাবতীয় জ্ঞান এই মাটির পৃথিবীকে কেন্দ্র করেই। কবিতায় এঁরা শব্দের নানা অর্থ পরিহার করে নির্দিষ্ট একটি অর্থকেই প্রকাশ করতে চান। আফ্রিকার আদিবাসীদের গান, অজানা বিদেশি রীতির প্রতি রোমান্টিক মোহ, প্রেম, বীরত্ব, আত্মত্যাগ প্রভৃতি সরল বিষয় ছিল এদের বৈশিষ্ট্য। আনা অখমাতোফা এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েই প্রথম রচনা শুরু করেন।
তার জন্ম ১৮৮৮-তে। আসল নাম আনা আন্দ্রিয়েফনা গোরেঙ্কো। ২৬ থেকে ২৯ বছর বয়সের মধ্যেই তিনি প্রভূত সুনামের অধিকারিণী হয়েছিলেন। অ্যাকমেয়িস্ট দলের প্রধান কবি গুমিলেফের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এর কিছু পরেই একটি পারিবারিক ট্র্যাজিডিতে তিনি আঠারো বছর কবিতা লেখা ছেড়ে চুপ করে ছিলেন। তাঁর স্বামী গুমিলেফ প্রথম মহাযুদ্ধের সময় অসম সাহসে লড়াই করেছেন, কিন্তু শেষ দিকে বলশেভিকদের বিরুদ্ধবাদী হয়ে পড়েন। সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে কবি গুমিলেফকে গুলি করে মারা হয়।
দীর্ঘকাল পরে, দ্বিতীয়বার বিয়ে করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তিনি আবার কবিতা লিখতে শুরু করেন এবং সোভিয়েট রাশিয়ায় শ্রেষ্ঠ জীবিত কবির সম্মান পান। তাঁর নায়কহীন একটি কবিতা নিউইয়র্ক থেকেও প্রকাশিত হয়েছে ১৯৬০ সালে।]

সায়াহ্নে
(অংশ)

বাগান থেকে সুরের ধারা ছড়িয়ে যায়
শব্দহীন ব্যথায়
টাটকা, কটু সাগর ঘ্রাণ ভেসে আসে
বরফে গড়া পিরিচে রাখা ঝিনুকে।

সে বলেছিল, আমি তোমার আন্তরিক সখা—
শুধু আমার পোশাকে তার হাত
আলিঙ্গনের চেয়েও এ যে অন্যরকম,
একটুখানি ছোঁয়া।

এমনি করেই মানুষ তার পোষা বিড়াল, পাখি
ছুঁয়ে আদর করে
এমনি করেই মানুষ দেখে সার্কাসের নটী।
সোনালি তার লঘু চোখের শান্ত পাতার নীচে
রয়েছে শুধু হাসি।

আলগা ধোঁয়ার আড়াল থেকে বাজে করুণ বীণা
যেন আমায় বলে:
স্বর্গে জানাও নতি, কারণ আজই প্রথম তুমি
একা পেয়েছ তোমার দয়িতাকে।


‘নায়কহীন একটি কবিতা’ থেকে
১৯১৩-র সেন্ট পিটার্সবার্গ

ক্রিসমাস-জোয়ার উজ্জ্বল হয়েছে উৎসবের আলোয়,
শকট উলটে যায় ব্রিজ থেকে, সমগ্র লোকের শহর
ভেসে যাচ্ছে কোন অজানা লক্ষ্যে, নেভা নদীর
নিম্ন স্রোতে অথবা উত্তরণে, যেখানেই হোক, তার
কবর থেকে অনেক দূরে। গ্যালারনায় রাস্তার তোরণ
অন্ধকারে রেখাচিত্রার্পিত, গ্রীষ্মের বাগানে একটি আবহাওয়া-যন্ত্র
ধাতব সুরে গান গায়, উজ্জ্বল রূপালিচাঁদ হিম হয়ে
আসে রুশিয়ার রূপালি যুগে।
প্রতিটি রাজপথে একটি ছায়া ধীরে এগিয়ে আসে
প্রতিটি গুল্মের কাছে, সেইজন্য অন্ধকার
ঘনায় বসবার-ঘরে, খোলা-মুখ ফায়ার প্লেস থেকে
আর তাপ আসে না, ফুলদানিতে শুকিয়ে যায়
লাইলাক ফুল। এবং সমস্ত সময় জুড়ে দম আটকানো,
হিমশীতল, কামুক এবং অশুভ যুদ্ধপূর্ব দিনগুলির
বাতাসে একটি দুর্বোধ্য ঘর্ঘর শব্দ লুকানো…কিন্তু
সেই শব্দ তখন শূন্যগর্ভ শুনিয়েছিল…ঠিকমতো
কানে এসে পৌঁছোয়নি, হারিয়ে গেছে
নেভার তুষার-স্রোতে।
মানুষ যেন তখন আচ্ছন্ন, কোনো ভয়ংকর
রাত্তিরের আয়নায় সে নিজেকে তখন চিনতে চায়নি,
আর সেই প্রবাদময় নদীতীরে, ক্যালেন্ডারের নয়,
বাস্তব বিংশ শতাব্দী এগিয়ে আসছিল।
.
বরিস পাস্তেরনাক

[পাস্তেরনাক সম্পর্কে বহু আলোচনা হয়ে গেছে, এখন তার পুনরুল্লেখ অবান্তর। মুখ্য তথ্যগুলি এই: জন্ম ১৮৯০, পিতা ছিলেন খ্যাতিমান চিত্রকর, প্রথম কবিতার বই বেরোয় ১৯১৪ সালে, কোনও সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত করেননি, প্রায় ১৯৩৪ সাল থেকেই ১৯৫৩-তে স্টালিনের মৃত্যু পর্যন্ত, যখন সরকারের পক্ষ থেকে সোভিয়েট রাশিয়ার লোকদের প্রতি নানান অনুশাসন জারি হতে থাকে, তিনি কবিতা লেখা বা প্রকাশ বন্ধ রেখেছিলেন, এই সময় বিদেশি সাহিত্যের বিশেষত শেকসপিয়ার অনুবাদ করেছেন। তাঁর উপন্যাস ড. জিভাগো রাশিয়ায় নিষিদ্ধ হলেও গোপনে ইতালিতে ছাপা হয় ১৯৫৭ সালে, পরে ইংরেজিতে। ১৯৫৮-তে তার নামে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা ও প্রত্যাখ্যান, ১৯৬০-এ ভগ্নহৃদয় মৃত্যু। তাঁর রচনা রাশিয়ায় অন্যায় ভাবে নিষিদ্ধ করা এবং রাশিয়াকে সমালোচনা করার জন্য পশ্চিমি সভ্যতা তার রচনাকে যেরকম অস্ত্রের মতন ব্যবহার করেছে—এই দুই বিষয়েই তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন। বাংলায় পাস্তেরনাকের কবিতার সার্থক অনুবাদ করেছেন বুদ্ধদেব বসু। পাস্তেরনাকের একটি কবিতা সংগ্রহ বাংলায় অনুবাদ ও প্রকাশ করেছেন নচিকেতা ভরদ্বাজ।]

হ্যামলেট

ফিসফাস মিলিয়ে গেছে। আমি এসে মঞ্চে দাঁড়িয়েছি
দরজার ফ্রেমের গায় ভর দিয়ে কান পেতে শুনি
দূরাগত প্রতিধ্বনির ভিতরে কোন বাণী,
কোন উপাদান, গল্প আগুয়ান আমার জীবনে।

রাত্রির গ্রহণ-আলো এখন আমার মুখে স্থির
সহস্র অপেরা-গ্লাস এদিকে ফেরানো
যদি বা সম্ভব হয়, তবে আব্বা, পিতা,
এ পেয়ালা আমার সম্মুখ থেকে নিয়ে যাও তুমি।

আমার পছন্দ হয় তোমার এ কঠিন রচনা
এই ভূমিকায় আমি অভিনয়ে যথেষ্ট সহজ
কিন্তু দেখো, এসময় অন্য নাটকের মধ্য পথ—
এখন আমার সেই রূপান্তরে মুক্তি পেতে চাই।

যদিও প্রতিটি দৃশ্য সুচিন্তিত, পূর্ব নির্ধারিত
যেখানে শেষের অঙ্ক, সেখানেই অবিচল শেষ।
আমি এক, সব কিছু ড়ুবে যায় কপট বিশ্বাসে
মাঠের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া—এক জীবন শেষ করা নয়।


শীতের রাত্রি

সারা পৃথিবীর উপর দিয়ে
ছড়িয়ে গেল তুষার,
ছড়িয়ে গেল প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত
মোমবাতিটা টেবিলের ওপর জ্বলে যায়
মোমবাতি জ্বলে।

যেমন আগুনের শিখার দিকে উড়ে যায়
গ্রীষ্মের পতঙ্গের ঝাঁক
বাইরের মিহি বরফ ঝাঁক বেঁধে ছুটে আসে জানলার দিকে।

হিম ঝঞ্ঝা বৃত্ত হয়ে ঘোরে,
তির পাঠায় জানলার শার্সিতে
মোমবাতিটা টেবিলের ওপর জ্বলে যায়
মোমবাতি জ্বলে।

ঘরের উজ্জ্বল ছাদে ছায়া পড়ে;
দু’ দিকে মোড়া হাত, দু’ দিকে মোড়া পা
দু’ দিকে মোড়া নিয়তি।

ধপ করে শব্দ হয়ে দুটো জুতো পড়ল মাটিতে
পোশাকের ওপর কান্নার ফোঁটার মতন মোম
ঝরে পড়তে লাগল রাত্রির আলো থেকে।

আর সব কিছুই হারিয়ে গেল
ধূসর-সাদা তুষার কুয়াশায়
মোমবাতিটা টেবিলের ওপর জ্বলে যায়
মোমবাতি জ্বলে।

কোণ থেকে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগল
মোমের শিখায়
তখনি পরীর মতন, লোভের উত্তাপ তুলে ধরল দুটি ডানা
ক্রুশকাষ্ঠের ভঙ্গিতে।

বারবার মোমবাতিটা টেবিলের ওপর জ্বলে যায়
মোমবাতি জ্বলে।
.
ভলাদিমির মায়াকভস্কি

[জনতার রুচির গালে এক থাপ্পড়—এই নামে একটি ইস্তাহার বেরুল ১৯১২ সালে। নতুন সাহিত্য অভিযান শুরু করে যে চারজন তরুণ কবি এই ইস্তাহারে স্বাক্ষর করেছিল তাদের মধ্যে ১৯ বছরের ছোকরা মায়াকভস্কিই সবচেয়ে তেজি। ইতালির মেরিনেত্তি যে ফিউচারিস্ট আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তার প্রভাব এসে পড়ে রাশিয়ায়, কবিতার পূর্ব সংস্কার ভেঙে একদল কবি বিপ্লব করলেন। যা কিছু তথাকথিত কবিত্বময়, প্রথাসিদ্ধ সুন্দর, সেইসব আবরণ খুলে ফেলে এঁরা কবিতাকে রক্তমাংসের, সমসাময়িক জীবনের ও যথাযথ আবেগের প্রকাশ হিসেবে দেখতে চাইলেন। তারপর ১৯১৭ সালে এসে গেল রুশ বিপ্লব। মায়াকভস্কির মধ্যে একটা বেপরোয়া, তেজি, উদ্দাম-হৃদয় ছিল, তিনি ঝাপিয়ে পড়লেন বিপ্লবের মধ্যে। এবং রুশ বিপ্লবের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে স্বীকৃত হলেন। তার জোরালো ও উচ্চকণ্ঠ শব্দ ও ছন্দ ব্যবহারের ক্ষমতা ও ঝোঁক, তার কবিতাকে বিপ্লবের প্রেরণা হিসেবে জনতার কাছে পৌঁছে দেয়।
কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না, বিপ্লবীরা আসলে জন্মরোমান্টিক। সাম্যবাদী বিপ্লবের মধ্যে রোমান্টিকতার স্থান সামান্য, কিন্তু যে সমস্ত কবি ও লেখক প্রথমে এই বিপ্লবে যোগ দিয়েছিলেন, তারা সকলেই এসেছিলেন এক প্রকার রোমান্টিক প্রেরণাবশত। এইজন্যই এইসব সাহিত্যকারদের মধ্যে অবিলম্বেই আত্মহত্যা, নির্বাসন ও স্বপ্নভঙ্গের হিড়িক পড়ে যায়। বিপ্লবের মধ্যে একটা প্রবল ভাঙাচোরা আছে—যা শিল্পকে সব সময়েই আকর্ষণ করে, কিন্তু পরবর্তী গঠনের যুগে শিল্পী নিশ্চিত খানিকটা উদাসীন। কারণ, তার বুকের মধ্যে ব্যক্তিগত বিপ্লব থেকেই যায়। বিপ্লবের কবিতাগুলির জন্যই মায়াকভস্কি বিখ্যাত, কিন্তু তার প্রেমের কবিতাবলী, ভয়ংকর আবেগ, আত্মঘাত, অপমানবোধ, ক্রোধ ও করুণা প্রার্থনা ইত্যাদির মিশ্রণে পৃথিবীতে অনন্যস্বাদ।
১৯৩০ সালে মায়াকভস্কি আত্মহত্যা করেন। বয়স মাত্র ৩৭, তখন তিনি খ্যাতি ও সম্মানের উচ্চশিখরে। তার নোট বইয়ের মধ্যে যে কটা অসমাপ্ত কবিতা পাওয়া যায়, তার দুটি টুকরোও আমরা এখানে উপস্থিত করেছি।]

আমাদের যাত্রা

বিপ্লবের দামামা বেজে উঠুক ময়দানে
উচ্চে তোলো সারবন্দি অহংকারী মাথা
বিশ্বময় সব শহর ভাসিয়ে দেবো বানে
দ্বিতীয় মহাপ্রলয় আজ ছড়াবে সবখানে।
দিনের বাহন হেলে পড়েছে অতি
বৎসরের গরুর গাড়ি ঢিমে
গতি আমাদের দেবতা, শুধু গতি
হৃদয়গুলি দামামা সম্প্রতি।

আমরা সোনার চেয়েও দামি, জানি
বুলেট যেন ভ্রমণ, বুকে বেঁধে না
গানে আমরা হয়েছি শস্ত্রপাণি
গলার সুরে সোনালি ঝনঝনা।
ধূসর মাঠ, আনো তোমার সবুজ
দিনের জন্য পথ বানাও ঘাসের
হে রামধনু, এবার নীলাকাশের
ঘোড়া ছোটাও বৎসরের, সঘন নিশ্বাসের।

তারায় ভরা আকাশ আজ ম্লান
ওদের ছাড়াই আমরা লিখি গান।
সপ্ত ঋষি! শোনো এ দাবি জানাই
আমরা স্বর্গে জীবন্ত যেতে চাই!
চালাও ফুর্তি! গান করো! উৎসব!
বসন্ত ঋতু প্রত্যেক ধমনীতে
হৃদয়ে এখন তোলো যুদ্ধের রব
ধাতুর দামামা হৃদয়ের বৈভব।


অসমাপ্ত


এখন রাত একটা।
তুমি নিশ্চয়ই বিছানায় শুয়ে আছ
অথবা, হয়তো, তুমিও আমার মতো…
আমার কোনো তাড়াহুড়ো নেই।
এখন কোনো মানে হয় না, এক্সপ্রেস টেলিগ্রাফ পাঠিয়ে
তোমাকে জাগিয়ে তোলা বা বিরক্ত করার


আমি জানি শব্দের ক্ষমতা, আমি জানি শব্দের মাদকতা
সেই শব্দ নয়, যা থিয়েটারে হাততালি পায়,
সেই শব্দ যা কফিন ফেটে বেরিয়ে দারুময় চার পায়ে হাঁটে
কখনো কখনো হোক তোমাকে বাতিল করে, ছাপা হয় না, প্রকাশক জোটে না
কিন্তু শব্দ তো অশ্বারোহী, বন্ধু দৃঢ় করে ছুটে যায়
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাজে সেই শব্দ
রেল ট্রেনও একসময় হামাগুড়ি দিয়ে আসে কবিতার
বিবর্ণ হাতে চুম্বন করার জন্য।
আমি জানি শব্দের ক্ষমতা। কখনো তাকে দেখায় খুব সাধারণ
নর্তকীর পায়ের কাছে ঝরে পড়া পাপড়ির মতন
কিন্তু মানুষ তার নিজের আত্মায়, ওঠে, হাড়ের মধ্যে…
.
সার্গেই এসেনিন

আমার মা-কে লেখা চিঠি

বুড়ি, তুমি কি এখনো বেঁচে রয়েছ?
আমিও বেঁচে আছি। আমি তোমায় ভালোবাসি
আমি তোমায় আশীর্বাদ করি তোমার ছোট্ট ওই বাড়িতে
বাণীর অতীত সায়াহ্নের আলোক ঝরে পড়ুক!
লোকে আমায় চিঠি লিখেছে, তোমার চোখে মুখে
—যদিও খুব লুকোতে চাও,উৎকণ্ঠা, ভয়
আমার জন্য, আমার জন্য অধীর প্রতীক্ষায়
তোমার নাকি জীবন কাটে? বেরিয়ে এসে পথে
পুরনো কথা শরীরে মুড়ে আমার জন্য তাকিয়ে থাক দূরে?
কখনও বুঝি সন্ধেবেলা নীল অন্ধকারে
হৃদয় কাঁপে আশঙ্কায়, প্রতিদিনের একই আশঙ্কায়
সরাইখানার মারামারিতে এই বুঝি কেউ আমার
বুকের মধ্যে ধারালো একটা ছুরি বসিয়ে দিল।
বুড়ি, আমার মামণি, তুমি ভয় করো না, এসব
কিচ্ছু না, এ তো শুধুই ঘূর্ণী, মায়ার খেলা।
আমি কি এমন পাঁড় মাতাল হয়ে গিয়েছি, ভাবো?
তোমায় শেষ দেখার আগেই হঠাৎ মরে যাব?
আমি তোমার আগের মতোই ভালোবাসার আছি
এখন আমার দিবস জুড়ে একটি মাত্র স্বপ্ন
কখন আমি অস্থিরতা, দুঃখ ছিঁড়ে বেরিয়ে
তোমার কাছে গ্রামের সেই বাড়িতে ফিরে যাব।
ফিরব আমি, যেদিন তোমার ছোট্ট সাদা বাগান
বসন্তের অনুকরণে ছড়াবে বহু শাখা
তখন যেন খুব সকালে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ো না তুমি আমার
যেমন তোমার স্বভাব ছিল আট বছর আগে।
যে সব স্বপ্ন মিলিয়ে গেছে তাদের জাগিয়ো না
যে সব সাধ সত্য হয়নি, তাদের ছুঁয়ে কী লাভ!
আমার এই নিয়তি ছিল, এমন দুঃখ পাওয়া
জীবন আমার শুরুই হল যন্ত্রণার দিনে।
আমাকে তুমি বলো না আমার প্রার্থনার মন্ত্র,
অতীত কালে ফেরা আবার অসম্ভব আমার।
তুমিই শুধু একা আমার সাহায্য ও শান্তি
তুমিই শুধু আমার কাছে বাণীর অতীত আলো।
আমার জন্য অমন আর ভাবনা করবে না তো?
অমন করে থেকো না আর আমার প্রতীক্ষায়
দুয়ার খুলে বেরিয়ে এসে পথের দিকে চেয়ে
পুরনো কথা শরীরে মুড়ে দাড়িয়ো না আর তুমি।


শেষ কবিতা

হে বন্ধু, বিদায়
প্রিয় বন্ধু, তুমি আছ আমার হৃদয়ে…
আমাদের পূর্বনির্ধারিত এই বিদায় মুহূর্ত
ধরে আছে ভবিষ্যতে মিলন শপথ।
বিদায়, হে বন্ধু, কোনো কথা নেই, হাতে নেই হাত
দুঃখিত হয়ো না, শোকে বাঁকিয়ো না ভুরু
এ জীবনে মৃত্যুর ভিতরে কোনো নতুনত্ব নেই
অবশ্য একথা ঠিক, বেঁচে থাকা খানিকটা অভিনব বটে।

[যদিও মা-কে লেখা চিঠিতে এসেনিন বলেছিলেন, আমি সেরকম বদ্ধ মাতাল হইনি যে তোমার সঙ্গে দেখা না করে হঠাৎ মরে যাব—কিন্তু তিনি কথা রাখেননি। এলোমেলো দুর্দান্ত স্বভাবের লোক ছিলেন এসেনিন, হঠাৎ নাটকীয় ভাবে বিয়ে করলেন ইসাভোরা ডানকানকে। কিন্তু শিল্পের সৃষ্টি ও মানুষের জীবনকে ধ্বংস করার জন্যই তো ওসব নারীর জন্ম। সারা পৃথিবীকে তখন অকপট সৌন্দর্যের স্পন্দনে কাপিয়ে দিয়েছিল যে নারী, তাকে বিয়ে করল এক সাতাশ বছরের কবি। ইসাডোরার বয়স তখন চল্লিশ পার এবং অন্তত চল্লিশ জন পুরুষকে নিভৃতে দেখেছেন। সেই বিবাহবন্ধন টিকে ছিল মাত্র দেড় বছর। এর পর থেকে এসেনিন অবিরাম মদ্যপান শুরু করেন, জীবনযাত্রার সমস্ত নিয়ম ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তারপর একদিন লেনিনগ্রাডের এক হোটেলে হাতের শিরা কেটে ফেললেন। নিজের হাত থেকে বেরিয়ে আসা ফোয়ারার মতন রক্তধারায় কলম ড়ুবিয়ে লিখলেন শেষ কবিতা। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলেন। তখন কবির বয়স মাত্র ৩০, তখন ১৯২৫ সাল।
এসেনিনের জন্ম ১৮৯৫-তে, বয়েসের হিসেবে তিনি যদিও পাস্তেরনাক বা মায়াকভস্কির পরে, কিন্তু এসেনিন যেন রাশিয়ান কবিতার একটি হারিয়ে যাওয়া অধ্যায়। তখন মায়াকভস্কির প্রবল প্রতাপ, এসেনিন তার নেতৃত্ব বা প্রভাব মানতে চাননি, তিনি এজরা পাউন্ড প্রভৃতি ইমেজিস্টদের ধরনের আন্দোলন আনতে চাইলেন রাশিয়ায়। কিন্তু তার মানসিকতা ছিল অন্যরকম, ফলে এই দ্বিধার মধ্যে তাঁর কবিতা যথার্থ মর্যাদা পরবর্তীকালে পায়নি। এসেনিন বর্তমান অনুবাদকের প্রিয় কবি।
এসেনিন ছিলেন চাষার ছেলে, নাগরিকতার সবগুলো বিষ গ্রহণ করেও তিনি গ্রামের শ্যামলতার জন্য চিরদিন উন্মুখ ছিলেন। রুশ বিপ্লবের সময় তিনি সাগ্রহে অংশ গ্রহণ করেন এবং শ্রেণীহীন সমাজ ছিল তার কাম্য। কিন্তু দেশের অগ্রগতির জন্য যখন গ্রাম ভেঙে আধুনিক কলকারখানা, বিদ্যুৎ ইত্যাদি তৈরি শুরু হয়, তখন তিনি অযৌক্তিকভাবে কিছুটা নিরাশ হয়েছিলেন। দেশের উন্নতির জন্য অরণ্য বিনাশ করে ইস্পাত কারখানা স্থাপন করা দরকার, কিন্তু তবুও দু-একজন কবি থেকে যাবেই যারা ইস্পাতের সমস্ত উপকারিতা ভোগ করেও সেই লুপ্ত অরণ্যের জন্য শোক করবে। বন্যা বন্ধ করার জন্য নদীতে বাঁধ দিতেই হবে, তবু দু-একজন কবি নদীর সেই উগ্র, ভয়ংকর রূপ আর দেখতে পাওয়া যাবে না ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলবেই, তা বলে, এদের প্রগতির বা সভ্যতার শত্রু বলা যাবে না, এরাই ধনুকের ছিলা রাখে টান।]
.
এফগেনি এফতুশেংকো

[রুশ বিপ্লবের বছর পনেরো পর থেকেই শুরু হয় রাশিয়ার সাহিত্যের সবচেয়ে দুঃসময়ের কাল। সাহিত্যের ওপর আদর্শবাদের জুলুম এসে সৃষ্টিশীল লেখকদের চুপ করিয়ে দেয়। ১৯৪৯ সালে সমস্ত সাহিত্যের গ্রুপগুলোকে জোর করে ভেঙে তৈরি হয় একমাত্র রাষ্ট্রশাসিত সোভিয়েট লেখক সমিতি এবং যেসব রচনায় সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদের স্পষ্ট ছাপ নেই, তা তৎক্ষণাৎ বাজেয়াপ্ত হতে থাকে। এই সময়ই আইশাক বাবেল তিক্ত হাস্যে বলেছিলেন, এখন খাটি লেখকদের দেখাতে হবে, হিরোইজম অফ সাইলেন্স। ততদিন এসেনিন এবং মায়াকভস্কি আত্মহত্যা করেছেন, পাস্তেরনাক ও অখমাতোফা চুপ।
স্টালিনের শিল্প-বিরোধ শাসন ও লাভেন্তি বেরিয়ার পুলিশ চক্র শেষ হলে জেগে ওঠে রাশিয়ার দ্বিতীয় লেখক সম্প্রদায়। এরা বিপ্লব চোখে দেখেনি, বিপ্লবের পরবর্তী দুঃখ ও নিষ্পেষণ সহ্য করেনি, এরা সুসময়ের ফসল ভোগ করছে। সুতরাং শিল্পে সাহিত্যে এরা স্বাধীনতা ও বিশ্ব আত্মীয়তার দাবি জানিয়েছিল। এই নবীন দলের প্রধান কবি এফতুশেংকো এবং ভজনেসেনস্কি। কুশ্চফের আমলে পশ্চিমের জানলা কিছুটা খুলে যায়, রুশ সংস্কৃতিদলের সঙ্গে ইউরোপ ভ্রমণ করার সময় এফতুশেংকো রাশিয়ার বাইরে সারা পৃথিবীতে পরিচিত হন। প্যারিসের একটি পত্রিকায় তার অতিসচেতন আত্মজীবনী ছাপা হতে থাকে।
তরুণ এফতুশেংকোর কবিতা সরল ও ধ্বনিপ্রধান। তাঁর কবিতার বই লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে, হাজাৰ হাজার লোক শুনেছে তার কবিতা পাঠ। তাঁর আবেগ সহজে মর্মভেদ করে। তিনি এমন কথাও বলেছিলেন, আমি কমিউনিজম জানি না, ভালোবাসা জানি। ইয়ং কমিউনিস্ট লিগ থকে তার নাম কেটে দেওয়া হয়েছিল, তাও গ্রাহ্য করেননি।
কিন্তু কুশ্চফকে যতটা উদার মনে করা হয়েছিল, শেষদিকে সে ধারণা তিনি নিজেই ভেঙেছেন। একটি চিত্রপ্রদর্শনীতে তার ফিলিস্টিনিজম নিশ্চয়ই সকলের মনে আছে। অতিরিক্ত স্বাধীনতার বাড়াবাড়ির জন্য পশ্চিম ভ্রমণের মাঝপথেই এফতুশেংকোকে দেশে ফিরিয়ে এনে ধমকে দেওয়া হয়। ক্ষমা প্রার্থনা করে এফতুশেংকো কমিউনিজম ও সোভিয়েট রাশিয়ার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য জানান। তার কবিতা এখনো তারুণ্যের দীপ্তি ও দুঃসাহসময়।]

সীমান্তের বিরুদ্ধে

পৃথিবীর সব সীমান্ত আমায়
বিরক্ত করে।
আমার বিশ্রী লাগে যে আমি কিছুই জানি না
বুয়েনোস এয়ারিস কিংবা নিউ ইয়র্ক
সম্পর্কে।
আমার ইচ্ছে করে এলোমেলোভাবে
ঘুরে বেড়াই লণ্ডনের পথে পথে,
কথা বলি মানুষের সঙ্গে আমার ভাঙা ভাঙা
ভাষায়।
বালকের মতন আমার ইচ্ছে হয়
সকালবেলার প্যারিসে
বাসে চড়ে বেড়াতে
এবং
আমি চাই একটি শিল্প
যা আমারই মতন
পরিবর্তনশীল।


একটি কবিতা

আমি ভিজে মাটির ওপর শুয়ে থাকব
আমার কোদালটাকে জড়িয়ে।
মুখের মধ্যে একটা ঘাসের শিস
টক টক ঘাস।
এই অভিশপ্ত জমিকে খুঁড়তে খুঁড়তে
এত জোরে—যাতে কোদালটা ভেঙে যাবে প্রায়,
ক্লান্ত হয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ব,
কিন্তু ঘুমের প্রশ্নই তো ওঠে না।
কী?
নিজের পায়ে দাঁড়াতেও পারো না?
দেখো তো ওই ছোট্ট পাখিটাকে!
আকাশ-নীল ব্লাউজ আর বুট পরা মেয়েটির
কাছ থেকে এই বিদ্রূপ ভেসে আসে।
এবার সে একটা বিরক্তিকর গান শুরু করবে:
‘যেদিন পাব প্রিয় তোমায়
সারা শরীরে নখের দাগ বসাব’—
তার ধূসর রঙা কোদালটা হাওয়ায় ঝলসিয়ে
কানের দুলে ঝুমঝুমে শব্দ করে
সে এইরকম চালিয়ে যাবে—যতক্ষণ না
ছেলেরা গুমরে গুমরে ওঠে।
প্রত্যেকেই হাসবে:
‘সাপিনী একটা!
আংকা, একটু চুপ করতে পারো না!’
শুধু আমি জানি,
আকাশের তারা এবং লেবুর ঝোপ জানে
যখন সে আমার সঙ্গে রাত্রি বেলা অরণ্যে যায়
লেবুর গন্ধময় রাত্রে সে কেমন নিঃশব্দে
হাত দিয়ে ঘাসগুলোকে সরায়
মাতালের মতো অসংবদ্ধ ওর পদক্ষেপ
কী দুর্বল আর অসহায়,
রৌদ্র-তা হাত দু’খানি ঝুলিয়ে
সে আমার সঙ্গে কথা বলে সুন্দর বিভ্রান্ত ভাষায়…।

.
আন্দ্রেই ভজনেসেনস্কি

স্থাপত্য বিদ্যালয়ে আগুন

স্থাপত্য বিদ্যালয়ে আগুন লেগেছে!
সেই হলঘরগুলি
সেই সব রেখাচিত্র, সব
জায়গায় আগুন, মার্জনার চিঠির
মতন, আগুন! আগুন!
লাল-নিতম্ব গোরিলার মতন
ওই উঁচুতে ঘুমন্ত কার্নিশে—
জানলা ভেঙে যায়, গর্জন করছে ঝাঁপিয়ে
পড়ার জন্য, আগুনে!

আমার ফাইনাল পরীক্ষার জন্য
পড়াশুনো করছিলুম, হ্যাঁ, আমাদের
উচিত, আমাদের খাতাপত্র, থিসিস
বাঁচানো! আমার গবেষণাগুলো
এর মধ্যেই ফাটতে শুরু করেছে তালাবন্ধ
সিন্দুকে—
বিরাট একটা কেরোসিনের বোতলের মতন
পাঁচটা গ্রীষ্ম, পাঁচটা শীত
হুস করে জ্বলে উঠল শিখায়
হে আমার মধুর যৌবন
আঃ, আমরা এখন আগুনে পুড়ছি!

পরীক্ষায় টুকলি করার জন্য ছোট ছোট
কাগজে নোট, উৎসব, দল, সব গেল,
যাচ্ছে, এই যে গেল, উঁচুতে উঁচুতে
লকলকে শিখায়—
তুমি ওইখানে রইলে, ট্যাপারির ঝোপে
একটি ছিটে গোলাপি
বিদায়! বিদায়!
বিদায় স্থাপত্য
বিদায় আগুনের শিখায়
শিশু কন্দর্পদের ছোট ছোট গোয়ালঘর
প্রাচীন জমকালো সেভিংস ব্যাঙ্ক, তোমাদের বিদায়
হে যৌবন, হে ফিনিক্স
হে মূর্খ, তোমার সার্টিফিকেটগুলো যে
সব আগুনে পুড়ে গেল!
হে যৌবন, লাল স্কার্টের মধ্যে তোমরা
তোমাদের পেছন দোলাচ্ছ, হে যৌবন
তোমরা বকবক করে জিভ দোলাচ্ছ—
বিদায়, সীমানার কাল,
মাপজোক, জীবন এই রকম
এক জ্বলন্ত উৎসব থেকে অন্য প্রজ্জ্বলনে
যাতায়াত, আমরা সবাই আগুনের মধ্যে
তুমি বেঁচে আছ– তুমি আগুনে জ্বলছ,

কোন ঘোরানো কল, কোন স্তম্ভ জেগে উঠবে
এই আগুন থেকে—
ট্রেসিং পেপারের ওপর দিয়ে প্রথম স্কি করার
দাগের মতন ছুটে যাওয়া?

কিন্তু কাল, অশুভ পাখির মতন কিচির মিচির করে,
ভোমরার চেয়ে বেশি রাগী,
এক মুঠো ছাইয়ের মধ্যে দেখা যাবে কম্পাসটাকে
হুল ফোটাবে…

সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে,
বাঃ
সবাই এবার বুক ভরে নিশ্বাস নাও।
সব কিছু শেষ?
সব কিছুর শুরু হল
এবার চলো, আমরা
সিনেমা দেখতে যাই!

[রাশিয়ার যে তরুণ কবিকুল সাম্প্রতিক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে, তাদের মধ্যে ভজনেসেনস্কি কনিষ্ঠতম, এবং এখন সমালোচকদের বিচারে, তিনিই ওই তরুণ দলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কবি। এফতুশেংকো নেতা হিসেবে প্রচুর সম্মান ও প্রচার পেয়েছেন কিন্তু শব্দজ্ঞানে ও কবিত্বে ভজনেসেনস্কিই পাঠকদের কাছে স্থায়ী আসন পাবার যোগ্য। তার বয়েস এখন তিরিশ পেরিয়েছে। ১৯৬০ সালে লেখা এই কবিতাটিই তাকে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় করেছে, বহুদিন পর রাশিয়ার কবিতায় আবার দেখা গেল যে অগ্নিকাণ্ডের জয়গান করা হয়েছে, ভাঙন নিয়ে উল্লাস ও ইয়ার্কি করা হয়েছে। শুধু সৃষ্টি, সংগঠন, সংঘবদ্ধতার নামে জয়ধ্বনি তোলা—যা ছিল সোভিয়েত সাহিত্য সম্পর্কে সরকারি নীতি, তার বাইরে বেরিয়ে এলেন এই যুবা কবিবৃন্দ। যৌবন বয়সের সাহিত্য ভাঙার দিকে যাওয়াই স্বাভাবিকধর্ম- যেকোনও দেশে।]