চরিত্রের অভিধান

চরিত্রের অভিধান

ভূতগ্রস্ত
ডাক্তার জ্যোতিষ মতে অশ্লেষা মঘায় চাপে গাড়ি
বসন্তের টিকা নেয় বশংবদ শীতলা পূজারী
আদার ব্যবসা ফেঁদে কলিমুদ্দি শেখ বানিয়েছে
জাহাজ মার্কা এক বাড়ি
অন্ধকারে চোখ ঢেকে শেষে আমরাও
দিনের বেলার ভূত হয়ে যেতে পারি।

কুমারী
চুম্বনের বাসনা নিয়ে প্রতিক্ষণ ঘোরে
সকলে ওরা স্বপ্নে বেঁচে আছে,
এমন লঘু দু পায়ে ওরা কোথায় যায়
কোন স্রোতের তোড়ে
কোন পাহাড়ে, কোন মেঘের কাছে!
প্রতি মুখের উজ্জ্বলতায়, অভিমানিনী স্তনে
স্পর্শ পাবার তীব্র দুঃখ, গোপন লজ্জা,
স্বপ্নে ভরে নেবে
প্রতিটি নিশ্বাস, কান্না, সুখের স্বাদ;
স্বচ্ছ চোখে, মনে
সময় ওদের চিরস্থায়ী চুম্বনের চিহ্ন এঁকে দেবে।

প্রেমিক
চোখে চোখ রাখো, বাহুতে শয়ান বাহু
ধমনী সোনায় দুই হৃৎস্পন্দন
মুখচন্দ্রিমা গ্রাসে ওষ্ঠের রাহু
পান করো এই দেহের তীব্র অমিয়; স্মৃ
তি যেন পায় রক্তবীজের আয়ু
পান করো এই দেহের তীব্র অমিয়।

প্রতিপক্ষ
রোদ্দুরে বৃষ্টির স্বাদ ওই লোকটা বেশি পেয়েছিল,
ওই লোকটা বুক ভরে আজীবন নিশ্বাস নিয়েছে
পবিত্র ঘুমের স্বাদ, সমস্ত স্বপ্নের স্বর্গ, স্বচ্ছ জীবনের
সব উপভোগ থেকে আমাকে বঞ্চিত করে
একলা ওই লোকটা গেল বেঁচে।

বারাঙ্গনা
ঘুমোবার আগে রোজ হৃৎপিণ্ড ধুয়ে মুছে
যত্নে তুলে রেখো
গোপন সিন্দুকে
এবং চাবির গোছা ছুড়ে দিও স্বর্গের দরজায়।

লেখক
অত্যন্ত কুটিল চোখ, বক্র নখে চিরে দেয় জীবনের পবিত্র স্বরূপ
যুগপৎ সাধু ও ঠক, অহংকারী, ঋদ্ধিমান, কভু কাপুরুষ
অবিরাম স্মৃতিক্ষয়ে ক্ষীণজীবী, দুর্গন্ধ দূষিত জলাশয়ে
দপ করে জ্বলে ওঠা আলেয়ার মতো ঠিক ওদের হৃদয়।

কোটিতে কয়েকটি মাত্র এই আত্মা, এক দেশে এক শতাব্দীতে।
বাকি সব ভাণমূর্তি, জনপ্রিয়, দুমূল্য কাগজে ঢালে কালি
অথবা খানিকটা দূর পৌঁছে গিয়ে দুরারোগ্য বেরিবেরি রোগে
পা দুখানা ভারী করে স্থির হয়, নতুবা নিজেরই গলা কাটে
ওদের লেখার মধ্যে সস ঝোল-টানার শব্দ শোনা যায়।

বন্ধু
দুজনেই একমত হলে– রক্তে তীক্ষ্ণ হুল ফোটে
যেন কোনো ভয়ংকর খাদের কিনারে এসে
প্রতিযোগিতায় হাঁটা হয়;
কেউ কারো বিপদে, শোকে, অনটনে হৃদয় পোড়াবে
এর নামও সৌহার্দ্য বা সখ্য ঠিক নয়,
মানুষের জন্য এ তো মানুষের সামান্য পদবি!
অস্তিত্বে উত্তাপ দিও, কিন্তু কারও আত্মা ছুঁয়ে
উচ্ছিষ্ট করো না।

আত্মঘাতী
সমস্ত দরজা খোলা, এ পৃথিবী মুক্ত অবারিত
বার বার ঝাপটা মারে নীল শূন্য, স্বপ্নের দেবতা
স্থানু বৃক্ষদল যেন আশীর্বাদ-ভঙ্গিতে ধ্বনিত
রাত্রি আনে গাঢ় শস্য, শুদ্ধ নীরবতা।
এ পৃথিবী যেন বড় বেশি আছে, অপর্যাপ্ত,
বড় ক্লান্তিকর—
এই কথা ভেবে কেউ, আত্মাকে মুষ্টিতে ধরে
হতে চায় নিজের ঈশ্বর।

রাজনৈতিক
ওদের সবার জন্য একটি পৃথক ভূমি খুঁজে দিতে হবে
বাচাল বুডোর দল ছেলেখেলা নিয়ে মত্ত
থাকবে সেইখানে।
সব অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আণবিক, অতি দানবিক
ক্রেমলিন-লন্ডন-রোম-পিকিং-প্যারিস-সাদাবাড়ি
ওই যে অদ্ভুত মুখ, উত্তেজিত ক্ষীণমুষ্টি চোখ সারি সারি
ওরা নিজেদের জন্য তিন হাত মাটি খুঁড়ে নিক।

হীনম্মন্য
বুকের পাঁজর খুলে দয়িতাকে দিলে
এ পৃথিবী বলবে, লোকটা কী নির্বোধ দেখ—
মানুষের হাড় পাঁজরা ভেদ করে হানো দীপ্ত ছুরি
এ পৃথিবী বলবে, লোকটা কী নির্বোধ দেখ!

রূপসী
কোথায় তোমার রূপ, গ্রীবায় বা চক্ষের মণিতে
অথবা স্তন-কোরকে, উম্মুক্ত জঙ্ঘায়, ঠিক জানি না।
কে আছে হেন পুরুষ, এক শরীরের রূপ দেখে নিতে পারে
নিতান্ত এক-জীবনে, মর-চক্ষে?
কেউ পারে না জানি।

অসতী দর্পিতা হলে রূপ আসে, স্ফুরিত অধরে
ঝলসায় মিথ্যে প্রেম, মোহিনী ভ্রূভঙ্গে
লোভ রতি প্রবঞ্চনা নরকের আহ্বান ফোটালে
রমণীরা কিছুক্ষণ আকর্ষণযোগ্য হতে পারে।

পাপী
বাতাসে বিষন্ন চোখ, মুখ ভাসে হিম নীলিমায়
কেন প্রাকৃতিক দুঃখে মূঢ় আর্তনাদ?
মন্দিরে ঘণ্টা বাজাও। অস্থিতে মজ্জায়
কেন এত আবর্জনা? পূর্ণিমার চাঁদ
ছুঁয়ে ছুঁয়ে ফিরে আসে চামচিকে, তোমারও বিষাদ
যেন প্রতিমার মতো লাবণ্যের গোপন সজ্জায়
সাজায় বিশুদ্ধ শোক, এ জীবন ধারণের গূঢ় অপরাধ,
রক্তে অন্তর্গত পাপ, যেন প্রতি মুহূর্তকে স্বাগত জানায়।

সম্পাদক
ধীমান ও পরিশ্রমী, চোখে হয়তো গোল চশমা আঁটা
মুখে মাকড়সার জাল, ক্ষীণদেহ, অভিব্যক্তিহীন ওষ্ঠে বড় সদালাপী
সকলেরই প্রীতি কিংবা স্নেহ কিংবা শ্রদ্ধার আস্পদ।

কেউ ঘন ঘন এসে বন্ধুত্ব ও প্রণয় জানাবে
কেউ নববর্ষে কিংবা বিজয়ায় পদধূলি শিরে নিয়ে যাবে
অথবা, ‘আমার বিয়ে’, ‘ছেলেটার মুখে ভাত’, ‘জন্মদিনে’, ‘সাহিত্যসভায়’
‘আপনি না হাজির থাকলে কিছুতেই সম্পন্ন হবে না।‘

ঈষৎ প্রবীণ দল বলবেন, শোনো হে অমুক,
এ রচনা লেখামাত্র তোমাকেই পড়াতে এলাম
তুমি ছাড়া কে বা বুঝবে সাহিত্যের গূঢ় সমাচার,
একমাত্র, লেখার পর, তোমাকেই পড়িয়ে তৃপ্তি পাই।

মৃত্যুর দ্বিতীয় মাসে অনেকেই কিন্তু তার নাম ভুলে যাবে।