জার্মান কবিতা: দৃষ্টিবদল

জার্মান কবিতা: দৃষ্টিবদল

জুরিখে ত্ৰিস্তান জারা যখন ক্যাবারে ভলতেয়ার-এ নীবন সাহিত্যের হই-হল্লায় ডাডা আন্দোলন শুরু করেছিল, সেই কাছাকাছি সময়েই বার্লিনের নিউয়ের ক্লাবের সভ্যরা নিউপ্যাথেটিক ক্যাবারে-তে চিৎকার করে অন্য ধরনের কবিতা পাঠ করে নতুন এক্সপ্রেশানিস্ট সাহিত্য আন্দোলনের সূত্রপাত করতে চাইছিলেন। এঁদের বিদ্রোহ কৃত্রিম কবিত্ব এবং আদর্শের বাগাড়ম্বরের বিরুদ্ধে। ওদিকে ইতালির কবি মেরিনেত্তি শুরু করেছেন ফিউচারইজম, প্যারিস থেকে বেরিয়েছে তার ঘোষণাপত্র, ফরাসি ও ইংরেজ কবিরা তাতে আকৃষ্ট হচ্ছেন আস্তে আস্তে, সেই ঢেউ জার্মানিতেও এসে পৌঁছুল। প্রায় কাছাকাছি সময়ে, এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, কাছাকাছি ধরনের কিন্তু আলাদা নামের সাহিত্যরীতির উদ্ভব হয়। মূলভাবে বলতে গেলে, ফ্রান্সে সুররিয়ালিজম, ইংল্যান্ডে ইমেজিজম, ইতালিতে ফিউচারিজম ও জার্মানিতে এক্সপ্রেশানিজম।
জার্মানির এক্সপ্রেশানিজম আন্দোলন অবশ্য খুব সংঘবদ্ধভাবে হয়নি, অনেকটা অপর সাহিত্যগুলির নবীন রশ্মির প্রভাবে স্বতোৎসারিত হয়ে ওঠে। এক্সপ্রেশানিজম কথাটার প্রথম ব্যবহার হয় ফ্রান্সে, শিল্পকলার ক্ষেত্রে, বস্তুত ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের থেকে আলাদা হবার জন্যই এই নতুন রীতির উদ্ভব। বিমূর্ত শিল্পেরও শুরু এই সময় থেকে। অর্থাৎ যা চোখে দেখা যায় শিল্প সাহিত্যে তার প্রতিচিত্র বা ছায়া উপস্থিত করার বিরুদ্ধ মনোভাব জেগে ওঠে, চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার বদলে আন্তরিক উপলব্ধির সত্য প্রকাশ করতে চাইলেন এক্সপ্রেশানিস্টরা। বেনডেট্রো ক্রোচের নন্দনতত্ত্বে যেমন সৌন্দর্যের রূপের বদলে অনুভূতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ১৯১১ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যেই এক্সপ্রেশানিস্টদের প্রাথমিক বিকাশ, দৃষ্টিবদলের সঙ্গে সঙ্গে এঁরা কবিতায় নতুন ভাষা ও রূপ, বিষয়বস্তু নির্বাচনের স্বাধীনতা আনলেন, সবচেয়ে বিশেষত্ব এঁদের মধ্যে অনেকেরই উপমা বা চিত্রকল্প ব্যবহারের আমূল পরিবর্তনে। যেন, মতন ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে কবিত্বময় ছবির ব্যবহারের এঁরা সমূল উচ্ছেদ করলেন, ভাব ও চিত্র এক সঙ্গে মিলেমিশে গেল। ব্যাপারটা আরও স্পষ্টভাবে বোঝ যাবে, যদি মনে করা যায় যে ১৯১৪ সালেই ছাপা হয়েছিল, ফ্রানৎস কাফকার মেটামরফসিস নামের গল্পটি, যার নায়ক গ্রিগর সামসা জেগে উঠে দেখল সে সত্যিই একটা পোকা হয়ে গেছে, তার মনটা পোকার মতন হয়নি বা সে নিজেকে পোকা হিসেবে ভুল ভাবেনি। এখানে বিধেয় ও ভাবনা একরকম হয়ে গেল।
এক্সপ্রেশানিজমের প্রথম পর্ব খুব সংক্ষেপে শেষ হয়ে যায়, কারণ এর প্রধান উদ্যোক্তারা শীঘ্রই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, এবং প্রায় সকলেরই মৃত্যু হয় অল্প বয়সে। প্রথম মহাযুদ্ধ যে কত কবিকে খুন করেছে, তার আর ইয়ত্তা নেই। আলফ্রেড লিসটেনস্টাইনের মৃত্যু হয় পঁচিশ বছরে, যুদ্ধ আরম্ভ হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। গেয়র্গ ট্রাকল ও আর্নস্ট স্টেডলার দু’জনেই যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যান— ওই বছরেই। অগুস্ট স্ট্রাম— যাঁর নতুনত্বের কায়দা ছিল সবচেয়ে চোখ ধাঁধানো— তিনি যুদ্ধে নিহত হন পরের বছর। যুদ্ধ আরম্ভ হবার দু বছর আগেই, গেয়র্গ হেইম, যাকে বলা হত ধ্বংসের প্রবক্তা, তিনি এক জলে-ডোবা বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও মারা যান। জেবক ফন হোডিস, যাঁর কবিতাকে প্রথম এক্সপ্রেশানিস্ট কবিতা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তিনি ১৯১৪ সালেই পাগল হয়ে যান। এইভাবে এই তরুণ বিদ্রোহীরা হাউয়ের মতন অল্পকাল দপ করে জ্বলে উঠে অকস্মাৎ মিলিয়ে গেলেন। এঁদের নিজস্ব কবিতা কালোত্তীর্ণ হবার উপযোগী হতে সময় পেল না, কিন্তু মাতৃভাষার কবিতায় একটা বাঁক এনে দিয়ে গেল। এঁদের মধ্যে শুধু একজন, গেয়র্গ ট্রাকলকে আমি বেছে নিয়েছি।
এরপর আরম্ভ হয় এক্সপ্রেশানিজমের দ্বিতীয় পর্ব, অন্যান্য কবিদের আলোচনায় প্রাসঙ্গিকভাবে তার উল্লেখ করা হয়েছে।

স্টেফান গেয়র্গ

[হোল্ডারলিনের কবিতা বাংলায় জনপ্রিয় করেছেন বুদ্ধদেব বসু। হাইনে অনুবাদ করতে প্রলুব্ধ হয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ থেকে মুজতবা আলি পর্যন্ত। ১৯৫৬ সাল আন্দাজ হঠাৎ কলকাতায় খুব রিলকের কবিতা পড়ার হাওয়া ওঠে। প্রায় এঁদেরই সমান উল্লেখযোগ্য হয়েও স্টেফান গেয়র্গের কবিতা বাংলায় কখনও কী কারণে যেন খুব মনোযোগ পায়নি। পুর্বোল্লিখিত কবিদের মতো অমন বর্ণময় জীবন নয় তার, হোল্ডারলিনের মতো প্রভুপত্নীকে ভালোবেসে বদ্ধোন্মাদ হননি, হাইনের মতো নির্বাসিত জীবনে রহস্যময়ীর সেবা পাননি, রিলকের মতো দুর্গপ্রাকারে বসে দৈববাণীতে কবিতার লাইন পাননি, বরং হিটলারের সঙ্গে কাঁধ ঘেঁষাঘেঁষি করার ঝুঁকি নিয়েছিলেন। গেয়র্গের জন্ম ১৮৬৮-তে। কোনও সমালোচকের মতে, তিনি নাকি দশ বছর বয়েসের আগেই বুঝতে পেরেছিলেন যে নিজস্ব ভাষা সৃষ্টি করে তিনি আলাদা জগৎ তৈরি করবেন। ধনী পরিবারে জন্ম, শৈশব থেকেই পিতার কাছ থেকে সাহিত্যচর্চায় প্রশ্রয় পেয়েছেন। বহুদিন পর্যন্ত কবিতা লিখেছেন শুধু নিজেরই জন্য, বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবদের কাছেই শোনাতেন, বিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করার পর নিজেকে তিনি একজন মহাপুরুষ হিসেবে ভাবতে আরম্ভ করে জনসাধারণের মধ্যে তার উগ্র মতবাদ প্রচার শুরু করেন। বিংশ। শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে অভূদিত নাৎসিবাদ, নিৎসের মতো গেয়র্গের মতামতকেও ঈষৎ বিকৃত করে কাজে লাগাতে দেরি করেনি। প্রথমদিকে গেয়র্গ কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু এজরা পাউন্ডের মতো চূড়ান্ত পর্যন্ত যেতে হয়নি, হিটলার ক্ষমতায় আসার পর দলের প্রবক্তা এবং সভাকবি করার জন্য গেয়র্গকে আহ্বান করেন, সেই সময়েই তিনি নিঃশব্দে পালিয়ে যান সুইটসারল্যান্ড এবং অচিরেই মৃত্যু, ১৯৩৩-এ।
প্রভূত পাণ্ডিত্য এবং মনীষা সত্ত্বেও গেয়র্গের কবিতা ক্ষুন্ন হয়নি। জার্মান সাহিত্যে তার আসন চিরস্থায়ী। ফরাসি সিম্বলিস্টদের কাছে তার শিক্ষা, বোদলেয়ারের সমগ্র লে ফ্লর দু মাল অনুবাদ করেছেন, তঁাবোকে গুলি করার পর ভের্লেন যখন দুবছর জেল খেটে বেরিয়ে আসছেন, গেয়র্গ ছিলেন সেখানে। মোট সাতটি ভাষা তিনি অনুবাদ করেছেন।]


তুমি আলোর শিখার মতো পবিত্র ও ঋজু

তুমি আলোর শিখার মতো পবিত্র ও ঋজু
তুমি সকালের মতো এত কোমল উজ্জ্বল
তুমি মহৎ বৃক্ষের থেকে প্রস্ফুটিত শাখা
তুমি পাহাড়ি ঝরনার মতো গোপন সরল
রৌদ্রময় মাঠে মাঠে তুমি আছো আমার সন্নিধে
তুমিই আলোর মতো তুমি কুয়াশায়
সায়াহ্নের শীতে তুমি কেঁপে ওঠো আমার শরীরে

তুমি ঠান্ডা হাওয়া, তুমি উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস।
তুমি আমার বাসনা তুমি আমার ভাবনা
আমি প্রত্যেক নিশ্বাসে করি তোমাকে গ্রহণ
আমি প্রত্যেক চুমুকে করি তোমাকেই পান
আমি প্রত্যেক সুগন্ধে করি তোমার চুম্বন
তুমি মহৎ বৃক্ষের থেকে প্রস্ফুটিত শাখা
তুমি পাহাড়ি ঝরনার মতো গোপন সরল
তুমি আলোর শিখার মতো পবিত্র ও ঋজু
তুমি সকালের মতো এত কোমল উজ্জ্বল।


দ্বীপের প্রভু

মৎস্যজীবীদের গল্পে শোনা যায়, দক্ষিণ প্রদেশে
সুগন্ধ মশলা, তেল ভরা এক দারুচিনি দ্বীপে
যেখানে বালির মধ্যে ঝলসায় বহুমূল্য মণি
সেইখানে আছে এক পাখি, যার ডানা
মাটিতে ছড়ানো থাকে তবু ঠোঁট তুলে
বিশাল গাছের মাথা ছিঁড়ে আনতে পারে।
শামুকের রস মাখা যেন তার পালকের রং
যখন সে উড়ে যায় অল্প উঁচু, বিশাল শরীরে
মনে হয় যেন এক খণ্ড কালো মেঘ।
দিবাভাগে সে লুকোয় বনের ভিতরে
সন্ধেবেলা ফিরে আসে সমুদ্রের পাড়ে
ঝাঁঝি ও নুনের ঘ্রাণ ভরা সেই সমুদ্র বাতাসে
তার মিষ্টি শিস ওঠে, তীব্র হয়ে ভাসে—
শুশুকেরা গান ভালোবেসে আসে সৈকতের পাশে
সমুদ্রে সোনার পাখনা, স্বর্ণ উচ্ছলতা,
সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই সে ছিল এরকম
দৈবাৎ জাহাজ-ভাঙা মানুষেরা এক পলক দেখতে পেত তাকে
প্রথম যেদিন সাদা পাল তুলে মানব সভ্যতা
জাহাজের মুখ ফেরায় সেই দ্বীপে দৈবের নির্দেশে
সেই পাখি উড়ে গিয়ে বসল এক পাহাড় চূড়ায়
চেয়ে রইল নির্নিমেষে তার প্রিয় দ্বীপটির দিকে
বিষাদের চাপা স্বর তুলে মরে রইল সেখানেই।

[প্রথম কবিতাটি একটি প্রেমের কবিতা বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এই বিষয়ে লেখা কোনও বাংলা কবিতা এ পর্যন্ত আমাদের চোখে পড়েনি। ভালোবাসা এখানে শারীরিক আস্বাদের স্তরে এসেছে পর্যন্ত, কিন্তু কবিতাটি একটি ছেলেকে উদ্দেশ্য করে লেখা। অর্থাৎ এই ভালোবাসা অনেকটা গ্রিক আদর্শের। ম্যাক্সমিলিয়ান ক্রনবার্গার নামে একটি দেবপ্রতিম কিশোরকে তিনি ম্যাক্সিমিন নামে ডাকতেন এবং তাকে মনে করতেন প্রাচীন গ্রিসীয় আদর্শের প্রতিমূর্তি। ছেলেটি অকালে মারা যায়। গেয়র্গ এই কবিতাটি লেখেন, ম্যাক্সিমিন মারা যাবার কুড়ি বছর পরে। দ্বিতীয় কবিতায় শুশুকদের সংগীত প্রীতির প্রসঙ্গেও প্রাচীন গ্রিসের উপকথার উল্লেখ। কবি অরিওনকে জাহাজে দস্যুরা সর্বস্ব লুট করে যখন সমুদ্রে ফেলে দিতে যায়, তখন অরিওন শেষবারের মতো একটি গান গাইবার অনুমতি চেয়েছিলেন। তার মধুর গান শুনে হাজার হাজার শুশুক জাহাজের পাশে এসে ভিড় করে এবং অরিওন তখন নিজেই সমুদ্রে লাফিয়ে পড়েন। এবং শুশুকরা তাকে কাঁধে করে নির্বিঘ্নে পাড়ে পৌঁছে দেয়। গেয়র্গের অনেক কবিতাই সভ্যতা শুরু হবার আগের জগৎ নিয়ে।]
.
হুগো ফন হফমান্সথাল

[হফমান্সথালের জন্ম ভিয়েনায়, ১৮৭৪-এ। যদিও ভিক্টর যুগো সম্পর্কে গবেষণা করে ডক্টরেট হয়েছিলেন, কিন্তু নিজের সাহিত্য সাধনায় রোমান্টিসিজমকে অস্বীকার করেছেন। দু’জন কবিতাটি যখন লেখেন, তখন তার বয়েস ২৬, এবং জার্মান সাহিত্যে তাঁর আসন তখনই অবিসংবাদীভাবে স্বীকৃত, কিন্তু ক্রমশ তিনি কবিতা থেকে সরে গিয়ে মঞ্চ জগতে আশ্রয় নেন। জার্মান গীতিনাট্যের গৌরবময় ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হল তার নাম। সোফোক্লিস, মলিয়েরের ভাষান্তর ছাড়াও তিনি কয়েকটি কালোত্তীর্ণ ট্র্যাজেডি লিখেছেন নিজে—এবং সুরকার হিসেবে পেয়েছিলেন রিচার্ড স্ট্রাউসকে। এখন জার্মান সাহিত্যে তার সুনাম প্রধানত প্রাবন্ধিক ও নাট্যকার হিসেবে। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কবিরা হফমান্সথালের কবিতারই বেশি ভক্ত। ওঁর ছেলে হঠাৎ আত্মহত্যা করায়, ভগ্নহৃদয় হফমান্সথালের মৃত্যু ১৯২৯-এ।]

দু’জন

মেয়েটি এক হাতে নিয়েছে পাত্রখানি
মুখ ও চিবুক বাসনের মতো ডৌল
এমন সহজ, নির্ভয় তার লীলায়িত পথ চলা
হাতের পাত্র থেকে এক ফোঁটা উছলে পড়েনি মাটিতে
এমনই সহজ এবং কঠিন ছিল পুরুষের হাত
তরুণ অশ্বে আরূঢ় ছিলেন তিনি
এবং তখন অনায়াস ভঙ্গিতে
থামালেন সেই বেগচঞ্চল অশ্ব।
যা হোক, যখন মেয়েটির হাত থেকে
পাত্রটি নিতে হাত বাড়ালেন ঝুঁকে
দু’জনেরই কাছে সে কাজ বিষম কঠিন
দু’জনেই খুব কেঁপে উঠেছিল তখন
দু’জনের হাত ছোঁয়নি পরস্পর
গাঢ় লাল মদ গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।


বহির্জীবনের ব্যালাড

গভীর দু চোখ নিয়ে শিশু বড় হয়
কিছুই জানে না তারা, বড় হয়, ফের মরে যায়।
মানুষেরা চলে যায় যে-যার রাস্তায়।

তেতো ফল একদিন মিষ্টি হয়ে ওঠে
মরা পাখিদের মতো ঝরে যায় রাতে
কয়েকদিন পড়ে থাকে, ফের মরে যায়।

হাওয়া আছে সব সময়, তবু বার বার
কত কথা শুনি আমরা কত কথা বলি
শরীরের যন্ত্রপাতি সুখ আর দুঃখ ভোগ করে।
ঘাসের ভিতর দিয়ে রাস্তা হয়, গ্রাম ও শহর
এখানে ওখানে ভরা পুকুর ও গাছপালা, আলো
কিছু আছে বিশ্রী লোক, কিছু আছে মড়ার মতন।

কেন এরা বেড়ে ওঠে? কেন পরস্পর
দু’জন সমান হয় না? কেন এরা এত সংখ্যাহীন?
কেন একবার হাসি, তার পরই কান্না, শুকনো হাওয়া?

এইসব ছেলেখেলা— আমাদের কাছে আর কতটুকু দামি
আমরা কজন তবু রয়েছি অসাধারণ, অনন্ত একাকী
চিরকাল ভ্রাম্যমাণ, কখনও খুঁজিনি কোনও শেষ।

এত সব বিচিত্রকে লক্ষ করা কেন প্রয়োজন?
যা হোক, সেই তো সব কিছু বলে, যে বলে সায়াহ্ন
এই এক শব্দ থেকে ভেসে ওঠে গভীর কাতর স্বর, দুঃখ নিরবধি
শূন্য মৌচাক থেকে যেরকম প্রবাহিত মধু।

[হফমান্সথালের দু’জন কবিতাটি বর্তমান লেখকের খুব প্রিয়, শুদ্ধ কবিতার রূপাঙ্কিত এই রচনা, অথচ বাংলায় এই কবিতাটির যথাযথ অনুবাদ প্রায় অসম্ভব। কারণ, বাংলা সর্বনামে নারী-পুরুষ বোঝা যায় না। সে বা তার ছাড়া কবিতাটিতে অন্য কোনও বর্ণনা নেই, অথচ বাংলায় মেয়েটি বা পুরুষ লিখিতে বাধ্য হলুম। মেয়েটি ইত্যাদি লেখার বিপদ এই যে, এতে বয়েস বোঝা যায়। বালিকা, কিশোরী, যুবতী, রমণী বা নারী— সবই বয়েসবাচক, যেমন ছেলেটা, লোকটা, লোকটি, পুরুষ ইত্যাদি। অথচ সে—বা তার-এর কোনও বয়েস নেই। যথাযথ শব্দের অভাবে বাংলা কবিতা এখনও অতিকথন দোষে দুষ্ট। প্রথম লাইনেই মেয়েটি ব্যবহার করতে না হলে, এই অনুবাদের আকার নিশ্চয়ই বদলে যেত।
যেমন, দ্বিতীয় লাইনে, মেয়েটি যে সুরার পাত্রটি ধরে আছে, তার হাতলের সঙ্গে মেয়েটির মুখ ও চিবুকের রেখার তুলনা করা হয়েছে। আমি বরং উপমাটি নষ্ট করে দিয়েছি, তবু হাতল ব্যবহার করিনি। একটি মেয়ের (সুন্দরী, বলাই বাহুল্য) মুখের সঙ্গে তুলনা দিতে, এই রকম কবিতায় হাতলের মতো শব্দ ব্যবহার করতে মন চায় না। চেয়ারের হাতল আছে, লরি স্টার্ট দেবার জন্য যে বিকট লোহার ডাণ্ডাটা ঘোরাতে হয়, সেটার নাম হাতল, অফিসে যাবার সময় ট্রামবাসের যে দুর্লভ অংশটুকু ধরে ঝুলে থাকা যায়, তার নামও হাতল, আর চায়ের কাপটি পাতলা ঠোঁটের কাছে তুলে আনার জন্য কোনও নবীনা নারী চম্পক অঙ্গুলিতে কাঁপের যে-অংশটা ধরে থাকে, তার নামও হাতল? সত্যি, কী গরিব আমরা। কত অল্পে কাজ চালাচ্ছি।
হাত থেকে মদ চলকে পড়ে যাবার মানে হল, দু’জনের মিল হবে না। হফমান্সথালের কবিতার প্রতিটি শব্দ গুরুত্বপূর্ণ। মেয়েটির চঞ্চলতা, সহজ ভাব ও পুরুষটির দৃঢ় আত্মবিশ্বাস, তবু দু’জনে যখন মিলিত হয়, তখন কেঁপে উঠেছিল। মদ পড়ে যাওয়া রক্তের প্রতীক। অর্থাৎ মিলন। এই শতাব্দীর শুরুতেই প্রথম দেখা দিল মিলনের মধ্যে সব সময় কিছুটা উৎকণ্ঠা, কিছুটা দূরত্ব ও অস্বস্তি।
দ্বিতীয় কবিতার শেষ দিকে আমরা, এই শতাব্দী-পরিবর্তনের কবিরা। সায়াহ্ন কথাটির অর্থ— না অর্থ নয়, ভাব— কবিতা। সায়াহ্নর কথা বলা মানে এখানে কবিতা লেখা। জীবনের সব কিছুই অর্থহীন হয়ে যায়, যদি তা কবিতার মধ্য দিয়ে বলা না যায়।]
.
রাইনের মারিয়া রিলকে

[রিলকের জন্ম চেকোশ্লোভাকিয়ায়, ১৮৭৫ সালে। কৈশোর কেটেছে সামরিক বিদ্যালয়ে। যৌবনে তিনি নিজের কবিতা ছাপিয়ে প্রাহা শহরের পথে পথে বিক্রি করার চেষ্টা করেছিলেন পর্যন্ত। পরে তাঁর জীবন একেবারে বদলে যায়। একাধিক রূপবতী ও ধনবতী মহিলা তার ভক্ত হয়েছিলেন ও তার জন্য প্রচুর সুযোগের সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। একবার তার জন্য একটি সম্পূর্ণ দুর্গ-ভবন ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, কথিত আছে যার চূড়ায় বসে রিলকে দৈবী প্রেরণার প্রতীক্ষা করে ছিলেন। নিৎসের প্রেমিকা ও ফ্রয়েডের বান্ধবী লু আনড্রিয়াস সালোমির সঙ্গে তিনি রাশিয়ায় ভ্রমণ করেন ১৮৯৯ সালে, সেখানে টলস্টয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরের বছর ক্লারা ওয়েস্টহপ নামী ভাস্করকে বিয়ে করার পর প্যারিসে কিছুদিন রোদার কাছে ছিলেন। এর পর অনুরাগী-অনুরাগিণীদের আতিথ্যে বহু দেশ ভ্রমণ করেন। যুদ্ধের সময় তাকে জোর করে ডাকা হয়েছিল, তাতে তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। শেষ পর্যন্ত বহু সাহিত্যিকের স্বাক্ষরিত আবেদনের ফলে তিনি মুক্তি পান। ১৯২৬ সালে সুইটসারল্যান্ডে লিউকোমিয়া রোগে রিলকের মৃত্যু।
এক শতাব্দীর মধ্যে জার্মান ভাষায় সবচেয়ে বড় কবি এবং পৃথিবী ধ্বংস হবার আগের দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন রিলকে। বাংলার প্রধান কবিরা রিলকের অনেক কবিতা অনুবাদ করেছেন, বুদ্ধদেব বসু, সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ মিত্র, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত প্রমুখদের অনুবাদ বিশেষ পরিচিত। রিলকের কবিতার ভাষান্তরণ অতীব শক্ত, কোনও কোনও সমালোচক হয়তো রোদার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সংযোগের কথা মনে রেখেই তাকে বলেছেন, শব্দ-ভাস্কর। শুনেছি বহু শিক্ষিত জার্মানের পক্ষেও ড়ুইনো এলেজির বহু সাধারণ বাক্যের অসাধারণ প্রয়োগ বুঝতে পারা যথেষ্ট শক্ত। প্রথম জীবনে সরল রচনা দিয়ে শুরু করে ক্রমশ কঠিন দুর্বোধ্য শিখরে আরোহণ করেছেন রিলকে। এখানে রিলকের দুটি অপেক্ষাকৃত সরল কবিতা, যা বাংলায় আগে অনুদিত হয়নি, দেওয়া হল।
রিলকে মূল ফরাসিতেও অনেক কবিতা লিখেছেন। টি এস এলিয়টও তার কাব্য সংগ্রহের শেষ সংস্করণে কয়েকটি নিজস্ব ফরাসি কবিতা অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। মাতৃভাষায় ছাড়া কবিতা লেখা যায় না— এলিয়ট ও রিলকের ফরাসি রচনা এই ধারণার বিরুদ্ধে যায়। কিন্তু এলিয়টের মূল ফরাসি রচনা ফরাসি দেশে বিশেষ গ্রাহ্য হয়নি। আর রিলকের ফরাসি কবিতা সম্পর্কে ফরাসিরা বলেন, তাঁর রচনায় কিছু মিষ্টি ভুল আছে।]

পাথরের সেতু

পাথরের সেতুর উপরে ওই যে অন্ধ মানুষটি আছে দাঁড়িয়ে
নামহীন বহু পরিধির সীমা-পাথরের মতন ধূসর
হয়তো ও-ই সে উপাদান, সেই অনন্ত কালের একমাত্র
যাকে ঘিরে বহু দূরে অনাদি নক্ষত্র কাল ঘূর্ণমান,
ও সেই ভিখারি, এখনও সপ্তর্ষিদলে কেন্দ্রবিন্দু
ওর চার পাশ থেকে ঝরে পড়া সকল স্রোতের ধারা চরম উজ্জ্বল।

ও-ই সে অনড় ন্যায় দেবপ্রিয় একমাত্র সৃষ্টি
বসে আছে নানান জটিল ধাঁধা রাজপথের কেন্দ্রে
এখানেই মৃত্তিকার জগতের ম্লান প্রবেশের দ্বারপথে
কৃত্রিম মনুষ্য ভিড়ে অন্ধ বসে আছে এখানেই।


মৃতদেহ প্রক্ষালন

[একটি ফ্ল্যাট বাড়ির অগোছালো ঘরে একজন মানুষ মরে পড়ে আছে। তার সেখানে কোনও আত্মীয় বন্ধু নেই। দু’জন স্ত্রীলোককে ডাকা হয়েছে তার মৃতদেহ ধুইয়ে মুছিয়ে দিতে।]
তারা লোকটিকে কিছু চিনেছিল, কিন্তু যে সময়ে
রান্নাঘর থেকে এল কুপি, জ্বলতে লাগল থিরথিরিয়ে
অন্ধকার হাওয়া চলাচলে— সেই অজানা মানুষ
হয়ে এল সম্পূর্ণ অচেনা। তারা তার কণ্ঠনালি ধুয়ে দিল,
এবং যেহেতু তারা কিছুই জানত না তার জীবনের গল্প
নিজেরাই বানিয়ে নিল অন্য জীবন
ধোয়া মোছা ঠিক চলেছে, একজন কেশে উঠল একবার
একজন এক সময় ভারী ভিজে ভিনিগার স্পঞ্জ
রাখল সেই মুখে। অর্থাৎ সেই সময়ে একটু বিরতি
দ্বিতীয় নারীর জন্য। শক্ত রুক্ষ ব্রাশ থেকে জল
ঝরছে টিপটিপ করে; মৃতের ভয়ংকর হাত
মুচড়ে থেকে যেন সেই মুহূর্তের সমগ্র গৃহকে
জানাতে চেয়েছে, আর তার কোনও তৃষ্ণা নেই।

এবং সে প্রমাণও করেছে। যেন অপ্রস্তুত হয়ে সেই দু’জন নারী
সংক্ষিপ্ত কাশি দিয়ে আরও দ্রুত মোছা শুরু করে,
তারা কাজ করে যায়, দেয়ালের রঙিন কাগজে
দু’জনের বক্র ছায়া কুঁকড়ে ওঠে, কখনও গড়ায়

যেন পাশবদ্ধ, সেই দেওয়ালের চতুর্দিকে নিঃশব্দ নকশায়
যতক্ষণ চলে সেই দু’জনের সব ধোয়া মোছা
পর্দাহীন জানালার কাছে এক থেমে থাকা রাত্রি
অত্যন্ত নির্দয়। সেই নামহীন দেহ
শুয়ে থাকে নগ্ন পরিচ্ছন্ন, নিয়মের সৃষ্টি হয়।

[ঈশ্বর গরিবদের কেন বেশি ভালোবাসেন? ঈশ্বরের গল্পে রিলকে বলেছিলেন, ঈশ্বর যখন প্রথম মানুষ সৃষ্টি করলেন, তখন সেই প্রথম মানুষ আদম, বেঁচে ওঠার অতি ব্যস্ততায় নিজেই ঈশ্বরের হাত থেকে লাফিয়ে নেমে যায়। ঈশ্বর যখন এক মুহূর্ত পরে তাকে খোঁজার জন্য তাকালেন (ঈশ্বরের এক মুহূর্ত অর্থাৎ এক কল্পান্ত) দেখলেন সারা পৃথিবী গিসগিস করছে মানুষে, কিন্তু সবাই, পোশাক-পরিচ্ছদে ঢেকে আছে, সুতরাং তিনি ঠিক কীভাবে মানুষকে সৃষ্টি করেছিলেন, তা আর দেখতে পেলেন না। সুতরাং তিনি স্থির করলেন, তিনি এমন একটি দরিদ্র মানুষকে সৃষ্টি করবেন, যে কিছুতেই জামাকাপড় পরে নগ্নতা ঢাকতে পারবে না। ঈশ্বর নিজের আসল সৃষ্টিকে স্বচক্ষে দেখতে পাবেন সব সময়।… রিলকের গুরু। রোদাও বলতেন, নগ্নতাই পৃথিবীর মূল সৌন্দর্য। প্যারিসের প দু ক্যারুজেল নামে পাথরের সেতুর ওপর বসে থাকা অন্ধ ভিখিরিই এ জন্য প্রথম কবিতাটিতে প্রধান পুরুষ।
দ্বিতীয় কবিতায়, মৃতদেহ ধোয়া মোছা যেন রাজসিংহাসনে আরোহণের অনুষ্ঠানের মতোই ঠিক বিপরীত। বহুমূল্য পোশাক ও মুকুট পরানোর বদলে এখানে সব কিছু খুলে ফেলা জীবন ছেড়ে মৃত্যুর সিংহাসনে অধিষ্ঠানের জন্য। মুখের ওপর ভিজে স্পঞ্জ রাখা, ক্রুশবিদ্ধ যিশুর প্রতীক। রিলকের কবিতায় অন্যত্র সেই বর্ণনা আছে। যিশুর মুখের সামনে মদ-ভেজানো স্পঞ্জ তুলে ধরেছিল নিষ্ঠুর রক্ষীরা। এখানে শবদেহ বুঝিয়ে দিচ্ছে, তার আর তৃষ্ণা নেই। কবিতাটি কথ্য গদ্য ভঙ্গিতে লেখা, চাপা ছন্দ আছে, দ্বিধার মুহূর্তে সামান্য বিচ্যুতি।]
.
রূডলফ আলেকসান্ডার শ্রয়েডর

[জার্মান সাহিত্যের জন্ম ধর্মগীতি ও সন্তদের জীবন গাথায়। খ্রিস্টধর্ম প্রচার ও প্রতিষ্ঠা পরেই ইউরোপের অধিকাংশ দেশে আধুনিক ভাষাগুলির জন্ম হয়। কয়েকটি দেশের যেসব ভাষাকে বলা হয় রোমান্স ল্যাঙ্গয়েজ, অর্থাৎ ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, প্রভাসাল, ইতালিয়ান, পর্তুগিজ ইত্যাদি, অর্থাৎ যাদের জননী ল্যাটিন, সেসব দেশের ভাষাগুলির জন্ম হতে একটু দেরি হয়েছে। কারণ, উন্নত-ভাষা ল্যাটিন ছিল শিক্ষিত উচ্চ শ্রেণীর ভাষা এবং সেই ভাষাই হয়েছে প্রথম দিকে খ্রিস্টধর্মের বাহন। কিন্তু ল্যাটিন যাদের কাছে সম্পূর্ণ অজানা, তাদের মধ্যে ধর্ম প্রচারের জন্য গির্জার প্রচারকরা স্থানীয় ভাষার উন্নতি সাধনে ব্রতী হন। বাংলা দেশেও শ্রীরামপুরের পাদরিদের বাংলা গদ্যের চর্চার কারণ যেমন একই।
যে টিউটনিক জাতির বাসভূমি ছিল ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীর জার্মানি, তাদের মধ্যে ইংরেজ ও আইরিশ ধর্মপ্রচারকরা এসে প্রচারের সুবিধের জন্য স্থানীয় ভাষাকে সুষম করতে সাহায্য করেন সেই সমস্ত ধর্মগীতি থেকেই জার্মান সাহিত্য ধীরে ধীরে রূপ নেয়। বাংলা কবিতারও জন্ম বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারের কারণে, কিন্তু নিছক ধর্ম ও দেবদেবীদের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে রক্তমাংসের মানুষকে সাহিত্যে উপজীব্য করতে বাঙালি লেখকদের বড় দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়, চৈতন্যদেবের কালও ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু কোর্টলি লাভ এবং শিভালরির অভ্যুত্থান হলে, এবং ততদিনে জেগে-ওঠা ফরাসি সাহিত্যের প্রভাবে, দ্বাদশ শতাব্দীতেই জার্মানিতে বিশুদ্ধ প্রেমগীতি লেখা শুরু হল। ত্ৰিস্তান এবং সোনালি ইসল্টের অবৈধ মধুর প্রেমের গাথার প্রথম সার্থক রূপ দেখা যায় (যদিও অসমাপ্ত) এয়োদশ। শতাব্দীর একেবারে শুরুর জার্মানিতে, গটফ্রিড ফন স্ট্রাসবুর্গের রচনায়।
তবু ধর্মগীতি রচনার স্রোত চিরকাল অক্ষুন্ন আছে। শ্রেষ্ঠ জার্মান গীতিকাব্যের অধিকাংশ ধর্মসংগীত। সেই কারণে আমরা এবার বিংশ শতাব্দীর একজন বিশুদ্ধ ধর্মসংগীতের কবিকে বেছে নিয়েছি। শ্রয়েডর ধর্মে প্রোটেস্টান্ট। কবি হিসেবে তিনি খুব বড় নন এবং জার্মান সাহিত্যের ইতিহাসে তার স্থান হয়তো তেমন উজ্জ্বলভাবে নির্দেশিত হবে না, কিন্তু ধর্মীয় সাহিত্যে তাঁর যুগপৎ বৈদগ্ধ্য ও সরলতা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। তাঁর রচনার ধারা খুঁজলে সপ্তদশ শতাব্দীর পল গেরহার্ড কিংবা আরও আগে প্রোটেস্টান্ট মতবাদের মূল প্রচারক মার্টিন লুথারের নাম করা যায়। যে সরল এবং প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী প্রতিবাদ ছিল লুথারের চরিত্র (গির্জার দরজায় পেরেক ঠুকে নিজের ইস্তাহার লটকে দিয়ে আসা কিংবা মঠ-পরিত্যক্তা নানকে বিয়ে করে গির্জার অনুশাসন অমান্য করা), পরবর্তী যুগের। প্রোটেস্টান্টদের তা চিরকাল প্রেরণা দিয়েছে। লুথার অনুদিত বাইবেল (তার জীবদ্দশাতেই ৩৭৭ সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম দৃঢ় জার্মান গদ্যের নিদর্শন এবং তার রচিত কবিতাবলী ও গান (ঈশ্বর আমাদের এক দুর্ভেদ্য দুর্গ) পরবর্তী দীর্ঘকাল প্রভাব বিস্তার করেছে এবং শ্রয়েডরের রচনাতেও তার চিহ্ন পাওয়া যায়।
জার্মান সাহিত্যের আর একটি বিশেষত্ব, প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার প্রতি আকর্ষণ। খ্রিস্টধর্ম প্রচারের পর ঈশ্বর হয়ে যান এক ও নিরাকার, গ্রিসের হাস্যমুখর-কলহপরায়ণ চমৎকার দেবদেবীরা ধূলিসাৎ হয়ে যান। কিন্তু গেয়র্গের কবিতার আলোচনায় আমরা দেখেছি, গ্রিক দেবদেবীদের সমাজকেই তিনি আদর্শ মানব সমাজ মনে করতেন, হোন্ডারলিনও এরকম বিশ্বাসী এবং আরও অনেকে। শ্রয়েডরও কিছুটা এই ধারার কবি।
শ্রয়েডর-এর জন্ম ১৮৭৮ সালে। বিদগ্ধ ও সাত্ত্বিক জীবন। বহু ভাষায় পণ্ডিত; গ্রিক, ফরাসি ও ইংরেজি ক্লাসিকসের অনুবাদক। তাঁর সরল ও মধুর ধর্মগানগুলি রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি ও নৈবেদ্য পর্যায়ের কবিতাগুলির কথা মনে পড়ায়; প্রোটেস্টান্টদের বিশ্বাসের সঙ্গে কিছুটা উপনিষদের ধারণারও মিল আছে। শ্রয়েডর-এর কাব্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব পড়েছে কি না বা পড়া সম্ভব ছিল কি না, আমার জানা নেই।]

দুটি গান


আমি তো চাইনি তোমার চোখের বালি
ও চোখের ওই বিচারসভায় আমি কে?
সানন্দে আজ ছেড়েছি আমার ঐশ্বর্যের ডালি
যা ছিল তোমার তাই তো দিয়েছি রেখে!
অপর লোকের যত্নে লুকোনো রত্নের সিন্দুকে
আবর্জনার স্তূপ জমে আছে খালি।

হে পথিক, তুমি থেমো না এখানে একা
এই বীভৎস ছবিতে
এই কুৎসিত ভয়ংকরকে দেখা।
পারে বুক ভেঙে খান খান করে দিতে।
ফেরাও নয়ন, মূর্থের পদচিহ্ন অনুসরণ
তোমার জন্য নয়
ওরা শুধু বলে আবহমানের সৃষ্টির অনুখন
উৎকণ্ঠা ও ভয়।

তবু হায় আজও নিজেই পারিনে আমি
উৎকণ্ঠায় যা দেখেছি ওই মুখে
পথিকের মুখে অপমান-লাজ, নিয়েছি নিমেষে চিনে
ওই অপমান আমারই, লজ্জা রয়েছে আমার বুকে।


যদিও তোমার রয়েছে একটি শরীর
অস্থি মাংসে গড়া
যদিও তোমার পরীক্ষা নয় কঠিন
হৃদয় কঠিন করো!
যে-হৃদয় তুমি পেয়েছ সে যদি কখনো
ব্যথা পায়, চায় বাসনায় ঘুরে মরা,
সময়ের দাবি: প্রস্তর হোক মন
প্রস্তরই ভিত, প্রস্তর দৃঢ়তর।
.
গটফ্রিড বেন

[কবিতা কী, এর উত্তরে জীবনানন্দ দাশ খুব সংক্ষেপে বলেছিলেন, কবিতা অনেক রকম। একথা বলার সময় তার চোখ ছিল সম্ভবত সমগ্র পৃথিবীর কবিতার দিকে, কারণ, বাংলা দেশে এখনও কবিতা অনেক রকম নয়। লিরিকের প্রতিই এখনও বাংলা দেশের ঝোঁক বেশি, একটু সুরেলা, কিছুটা নরম সৌরভময় পাপড়িমেলা না হলে বাংলা কবিতা এখনও যথেষ্ট গ্রাহ্য হয় না।
কবিতা যে অর্থে অনেক রকম, তার মধ্যে কিছু কিছু চাক্ষুষ রূপান্তরও পড়ে। কোনও রকম ছেদচিহ্ন ব্যবহার না করা, কখনও বড়-টাইপ, তারা-ফুটকি এগুলোও বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক। কিংবা অ্যাপোলিনেয়ার বা পাউন্ড যা করেছিলেন, বৃষ্টিধারার মতো বা চ্যাপটা বা সরুভাবে স্তবক সাজানোকিংবা কামিংস যেমন ছিলেন ক্যাপিটাল লেটারের জাতশত্রু—এগুলিও কবিতারই অঙ্গ। নাটক-সংগীত বা চিত্রকলার অনুগ্রাহকদের বিপরীত, কবিতার পাঠক কখনও চোখের সামনে থাকে না বলেই কবি পরিপূর্ণ আত্মপ্রকাশের জন্য যথেষ্ট স্বাধীনতা নিতে পারেন। কিন্তু বাংলা দেশে এখনও সামান্য এলোমেলোমিকে পাগলামি বলে গণ্য করা হয়। সেদিক থেকে, গটফ্রিড বেনের কবিতায় ক্রিয়ার অনুপস্থিতি বা বাক্য সাজানোর নিয়ম অগ্রাহ্য করা খুবই দুর্বোধ্য ঠেকবে। এই সুত্রে গটফ্রিড বেন। ছিলেন নিহিলিস্ট।
বহিরঙ্গ ছাড়াও, অন্যান্য দেশের সাহিত্যের নানা আন্দোলন এই পৃথিবীর দিকে চেয়ে-দেখার ভঙ্গি বার বার বার বদলে দিয়েছে। এ শতাব্দীর শুরুতে ফরাসি দেশে যখন সুররিয়ালিস্ট আন্দোলন শুরু হয়েছে, জার্মানিতে তখনকার নতুন আন্দোলনের নাম এক্সপ্রেশানিজম। পরবর্তীকালে সুররিয়ালিজম এবং এক্সপ্রেশানিজম দুটোই এসে মিশে যায় বা ধ্বংস হয় একজিসটেনশিয়ালিজমে।
এক্সপ্রেশানিজম সম্পর্কে খুব সংক্ষেপে বলা যায়, এই মতবাদীদের বিশ্বাস ছিল, এই বিশ্বের যেকোনও বস্তুর আন্তরিক সত্যটুকুই প্রকাশ করা উচিত। তার রূপের বর্ণনা বা শুধু নাম উল্লেখ করা অর্থহীন। এবং এই আন্তরিক সত্যটি প্রত্যেক লেখকের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে আসে। এই বিশ্বাসের কেন্দ্র হয় এই সভ্যতা, যা বাইরে থেকে দেখতে চকচকে এবং সহস্র পুষ্পে সজ্জিত মনে হয়, কিন্তু সেটা আসলে ভেতরে পচা। সুতরাং সভ্যতা এই। নামটা অর্থহীন। গটফ্রিড বেন বলেছেন, এই বিশৃঙ্খল জগতের কিছুই চিরস্থায়ী নয়, একমাত্র শিল্প ছাড়া।]

নষ্ট অহমিকা
(অংশ)

নষ্ট অহমিকা, স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে বিপর্যস্ত,
আয়নের শিকার, গামা রশ্মির মেষশিশু
কণিকা ও প্রান্তর, অন্তরের দুঃস্বপ্ন-প্রাণী
তোমার নামের ধূসর পাথরে।
তোমার জন্য দিন কাটে রাত্রিহীন, ভোরহীন
বৎসর তুষারহীন এবং ফল
ধরে আছে অনন্ত শাসানিময় গোপন
পৃথিবী যেন শূন্য যাত্রা।
কোথায় শেষ তোমার, কোথায় ফেলবে তাঁবু
কোথায় তোমার শূন্য স্তরে প্রসারিত লাভ, ক্ষতি
পশুদের নিয়ে এক খেলা, অনেকগুলি শাশ্বত
তুমি তাদের বাধা পেরিয়ে যাও।
পশুর চাহনি, তারাগুলি ষাঁড়ের অস্ত্র
জঙ্গলের মধ্যে মৃত্যু অস্তিত্ব ও সৃষ্টির কারণ
মানুষ, জাতি সংঘর্ষ, ক্যাটালনিয়ার
প্রান্তর, পশুর গলা দিয়ে নেমে যায়।

পৃথিবী চিন্তায় খণ্ড খণ্ড। স্থান ও কাল
এবং আর যা কিছু এই মানবসমাজকে
বুনেছে ও ওজন করেছে, সবই শাশ্বতের নিত্য ক্রিয়া।
পুরাণকাহিনী মিথুক।
কোথায় যাবে? কোথা থেকে? না রাত্রি, না সকাল
না ইভো, না মৃতের জন্য প্রার্থনা
তুমি শুধু চাও একটা ধারকরা স্লোগান,
কিন্তু কার কাছ থেকে ধার করা?

আ, যখন তারা সবাই নত হয়ে প্রণাম করেছে এক কেন্দ্রে
যখন চিন্তাশীলরাও শুধু চিন্তা করেছেন ঈশ্বরকে
যখন তারা ছড়িয়ে গেছেন মেষপালক ও মেষের দিকে
প্রত্যেকবার শেষ ভোজনের সুরাপাত্র থেকে রক্ত তাদের শুদ্ধ করেছে।

এবং প্রত্যেকেই এক ক্ষতস্থান থেকে প্রবাহিত
প্রত্যেকেই একটা রুটি ভেঙে টুকরো মুখে দিয়েছে
হে দূরের বাধ্য হিসেবে পরিপূর্ণ সময়
তুমি একবার নষ্ট অহমিকাও গ্রাস করেছিলে।..

[জন্ম ১৮৮৬ সাল। ডাক্তারি পাশ করার পর বেন সৈন্যদলে যোগ দিয়েছিলেন, প্রথম মহাযুদ্ধে ছিলেন সামরিক চিকিৎসক দলে, কিন্তু পরবর্তী কালে ডাক্তারি করার চেয়ে সাহিত্যিকদের দলে আড্ডা মারাই ছিল তার প্রধান কাজ। ১৯১২ সালে প্রকাশিত তার লাশকাটা ঘর নামের প্যামফ্লেট খুব চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। এই সময়েই তাঁর আত্মজীবনীমূলক কিছু কিছু গদ্য রচনা এক্সপ্রেশানিস্ট সাহিত্যের রূপ স্পষ্ট করে তোলে, এগুলির মধ্যেই তিনি আধুনিক পৃথিবীর বহুখণ্ডিত মানুষকে উপস্থিত করেন।
এক সময় তিনি নাৎসিদের রাজনৈতিক মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, কিছুটা যুক্তও হয়েছিলেন। কিন্তু পরে সংস্কৃতির জগতে নাৎসিদের উৎপাত তার পছন্দ হয়নি। তিনি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেন, নাৎসিরা তাঁর সমস্ত রচনা বাজেয়াপ্ত করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ও তাকে ডাক্তার হিসেবে যোগ দিতে হয়েছিল। যুদ্ধ থেমে গেলে, মিত্রপক্ষও আবার তাঁর রচনা জার্মানিতে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে কিন্তু তরুণ জার্মান লেখকদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে, ১৯৪৯ সালে সুইটসারল্যান্ড থেকে তাঁর রচনা আবার প্রকাশিত হলে তার প্রতি শাসকবর্গের বিরূপ মনোভাব ক্রমশ কমতে থাকে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরই, গটফ্রিড বেনের খ্যাতি জার্মানি ছাড়িয়ে সারা ইউরোপে ছড়ায় এবং ইউরোপের একজন প্রধান লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। মৃত্যু ১৯৫৬, পশ্চিম জার্মানিতে।]
.
গেয়র্গ ট্রাকল

[প্রায় বালক বয়েসে, অথবা সদ্য যৌবনেই মৃত্যু, কিন্তু কবি হিসেবে অমর হয়েছেন, এরকম দু-একজন কবি প্রায় প্রত্যেক ভাষাতেই। কিটসের কথা মনে পড়লেই চোখে ভাসে তাঁর রোগশয্যায় শুয়ে থাকা শরীর, মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে তার দুঃখিত মৃত্যু শেলিরও তো মৃত্যু হয়েছিল মাত্র ৩০ বছর বয়সে। কত মানুষ কত দীর্ঘ দিন ব্যর্থ বেঁচে থেকে পৃথিবীকে শুধু ভারী করে রাখে, আর ওই দুটি ছোকরা পৃথিবীকে কত ধনী করে দিয়ে গেল। ফরাসি ভাষায় এরকম উদাহরণ বেশি
র‍্যাঁবোর কথা উল্লেখ করে লাভ নেই, কারণ শুধু ফরাসি ভাষায় নয়, সারা পৃথিবীতেই দেব-দানবের সমাহারে সৃষ্টি এরকম এক বালকের অলৌকিক কীর্তির আর দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। কিন্তু এ প্রসঙ্গে লাফর্গের কথা খুব মনে পড়ে। মাত্র সাতাশ বছরে মৃত্যু, কিন্তু লাফর্গের নাম ফরাসি ভাষায় চিরকালীন হয়ে গেছে, এবং নিজের চেয়েও অনেক বেশি প্রতিভাবান কবিদের (পাউন্ড, এলিয়ট, হার্ট ক্রেন) প্রভাবিত করেছে ওই তিক্ত, হতাশ, করুণাপ্রার্থী যুবা। ইতালিতেও আমরা দেখেছি, গুইদো গৎসানো রোগের হাত থেকে বাঁচার জন্য সারা পৃথিবী ঘুরেও বাঁচতে পারেননি, তেত্রিশ বছরে মৃত্যু।
জার্মানিতে এরকম গেয়র্গ ট্রাকল। ভয় ও বীতস্পৃহার মধ্যে মাত্র সাতাশ বছরে মৃত্যু। প্রথম মহাযুদ্ধে কর্পোরাল হিসেবে লড়াই করেছে একজন অস্ট্রিয়ান, অ্যাডলফ হিটলার, আর, আরেকজন অস্ট্রিয়ান গেয়র্গ ট্রাকল অ্যাম্বুলেন্স বাহিনীতে শুশ্রুষা করেছেন। কিন্তু মানুষকে বাঁচাবার কাজ ট্রাকল বেশিদিন করতে পারেননি, কারণ তার নিজেরই বাঁচার কোনও ইচ্ছে ছিল না। জন্ম ১৮৮৭, ছেলেবেলা থেকেই নানারকম মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এই পৃথিবীটা ছিল তার কাছে ভয়ের বস্তু সেই ভয় তাকে সব সময় তাড়া করে ফিরত। কবিতা লেখা ছাড়া তাঁর জীবনের আর কোনও অবলম্বন ছিল না। গ্রোডেকের যুদ্ধের পর রক্তাক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখে তার মন স্তম্ভিত হয়ে যায়, তা ছাড়া, ট্রাকল তখন মেডিকেল কোরের লেফটেনান্ট, তার অধীনে ৯০ জন গুরুতর আহত সৈনিক, তাদের বাঁচাবার কোনও উপায়ই তার হাতে নেই— এই পরিবেশে তার মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। তাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হল তখন, সেখানেই তিনি আত্মহত্যা করলেন, সেদিন ৩ নভেম্বর, ১৯১৪।
এক্সপ্রেশানিস্ট লেখকদের মধ্যে ট্রাকলের স্থান অত্যন্ত উঁচুতে। জার্মান কবিতার তিনি একদিকে মোড় ঘুরিয়েছেন এবং সাম্প্রতিক লেখকদের ওপর তার প্রভাব প্রবল। জীবনে অত হতাশা ও অসহায়তা থাকলেও ট্রাকলের কবিতাবলী ভারী মধুর, এবং বেঁচে থাকার উপযোগী একটা মিষ্টি আশার ইঙ্গিত আছে।]

একটি শীতের সন্ধ্যা

শার্সির গায়ে ঝুরুবুরু ঝরে তুষার
গির্জায় বাজে করুণ দীর্ঘ ধ্বনি
খানার টেবিলের চামচ পিরিচ সাজানো
সজ্জিত গৃহ, মনোরম তাপ, শান্ত।

বহু পথ ঘুরে কারা যেন ফিরে আসে
আঁধার পথের পাশে দরজায় থামে
দরজার পাশে দয়ালু বৃক্ষ, থোকা থোকা সোনাঝুরি
জননী ধরার সুশীতল রস টানে।

দরজা পেরিয়ে মৃদু পায়ে এল পথিক
গভীর দুঃখে অঙ্গনটুকু নিথর।
টেবিলে সাজানো সতেজ খাদ্য টলটলে লাল মদ
নিখুঁত আভায় উজ্জ্বল হয়ে আছে।


পাশ্চাত্য সংগীত

হে আত্মার নৈশ ডানার আন্দোলন;
রাখাল, আমরা একদা গিয়েছিলাম আঁধার অরণ্যে
লাল হরিণ, সবুজ ফুল এবং ধ্বনিময় বসন্ত আমাদের মান্য করেছিল
হে প্রাচীন ঝিল্লিস্বর
মন্দিরের বেদিতে গড়ানো রক্ত ফুল হয়ে ফুটে আছে
পুকুরের সবুজ নিস্তব্ধতার ওপরে ভাসে একটি পাখির কান্না
হে ধর্মযুদ্ধ, মাংসময় শরীরের উজ্জ্বল যন্ত্রণা
সন্ধ্যার বাগানে ঝরে পড়া রক্তিম ফল
একদিন এখানে ধার্মিক শিষ্যবৃন্দ ভ্রমণ করেছিল
আজ সৈন্যদল এখানে আহত শরীর নিয়ে জেগে উঠে তারার স্বপ্ন দেখে
হে রাত্রির কোমল শস্যস্তবক!

হে তুমি সোনালি শরৎ ও শান্তির কাল
আমরা শান্ত সন্ন্যাসীরা একদিন তোমার মধ্যে বসে
আঙুর পেষণ করেছি
আর আমাদের ঘিরে পাহাড় ও অরণ্য উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।
হে তোমার শিকারদেশ ও দুর্গ; সন্ধ্যার নিস্তব্ধতা
নিজের নিরালা ঘরে মানুষ চেয়েছে সুবিচার
নিঃশব্দ প্রার্থনায় দ্বন্দ্ব করেছে ঈশ্বরের জীবিত মাথার জন্য।

হে ধ্বংসের তিক্ত সময়,
এখন আমরা কালো জলের মধ্যে একটি পাথর কঠিন
মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
তবু উজ্জ্বল প্রেমিকেরা তুলে ধরে তাদের রূপালী ঢাকনা—
মিলিত এক শরীর।
গোলাপের মতো নরম বালিশ থেকে ভেসে আসে ফুলের সুরভি
আর ঘুম ভাঙার পর মধুর গান।
.
বেল্ট ব্রেহখট

বেচারি বি.বি.

আমি বের্টল্ট ব্রেহখট, এসেছি কালো জঙ্গল-দেশ থেকে
আমার মা আমাকে যখন শহরে আনেন, তখন আমি ছিলুম
তার পেটের মধ্যে। এবং সেই জঙ্গলের সিরসিরানি
আমার শরীরে থাকবে— যতদিন না আমি অদৃশ্য হয়ে যাই।

এই পিচ বাঁধানো শহরে আমি বেশ মানিয়ে গেছি। প্রথম
থেকেই মুমূর্ষর প্রতিটি মন্ত্রে আমি সজ্জিত: খবরের
কাগজ, তামাক এবং মদ। সন্দেহপ্রবণ আর অলস
থেকে শেষ পর্যন্ত তৃপ্ত।

আমি মানুষের প্রতি অসাময়িক, ওদের শিষ্টতা অনুযায়ী
আমি মাথায় টুপি পরে থাকি। আমি বলি: এরা সব
অবিকল এক একটি গন্ধমূষিক! আবার আমি বলি: তাতে
কিছু যায় আসে না, আমি নিজেও তাই।

কোনো কোনো সকালে আমি আমার খালি দোলনা
চেয়ারে কয়েকটি মেয়েকে এনে বসাই এবং খুশি চোখে তাকিয়ে
থাকি তাদের দিকে। আমি ওদের বলি: আমি হচ্ছি সেই
ধরনের মানুষ, যাদের কক্ষনো বিশ্বাস করা যায় না।

সন্ধের দিকে আমি কিছু লোক জড়ো করি। পরস্পরকে আমরা
ডাকি, জেন্টলম্যান। ওরা আমার টেবিলের ওপর পা তুলে
দিয়ে বলে, শিগগিরই আমাদের সুদিন আসছে হে! আমি
আর জিজ্ঞেস করি না: কবে?

শেষ রাত্রির দিকে, ধূসর ঊষার পাইন গাছরা সময় হিসি করে,
আর গাছের উকুন অর্থাৎ পাখিরা শুরু করে চেঁচামেচি।
সেই সময়টায় শহরে আমি শেষ গ্লাসে চুমুক দিয়ে,
চুবরাটের টুকরোটা ছুড়ে ফেলে ঘুমোতে যাই, উদ্বিগ্ন।

আমরা অর্বাচীনের দল এমন সব বাড়িতে থাকি, যেগুলো
ধ্বংসের অতীত বলা যায়। (এইভাবেই ম্যানহাটান দ্বীপের
বিশাল কুঠরি বাড়িগুলো তৈরি করেছি আমরা—আটলান্টিকের
মধ্যে দিয়ে কথা বলা তারাগুলোও।)

এইসব শহরগুলোর মধ্যে শেষ পর্যন্ত শুধু তাই টিকে
থাকবে—যা শহরের মধ্যে দিয়ে ঘুরে যায়, হাওয়া! এই বাড়ি
ভোজনবিলাসীদের খুশি করে খালি হয়ে যায়। আমরা জানি
আমরা শুধু সূচনা, জানি আমাদের পর যারা আসবে—
উল্লেখযোগ্য কিছুই না।
সামনের ভূমিকম্পে আমি আশা করছি, আমার চুরোটটা
নিবে গিয়ে তেতো হতে দেবো না।
আমি, বেল্ট ব্রেহ, যখন আমি মায়ের পেটে ছিলুম
সেই বহুদিন আগে কালো জঙ্গল-দেশ থেকে এই
পিচবাঁধানো শহরে পরিত্যক্ত হয়েছি।


নিমজ্জিতা মেয়েটি

জলে ড়ুবে গেল, ভেসে গেল খরস্রোতে
পেরিয়ে ঝরনা, ঢেউ উত্তাল নদীতে
আকাশে সূর্য উজ্জ্বল নীলমণি
যেন তিনি চান ওই মৃতদেহ জুড়োতে।

শরীরে জড়াল শ্যাওলা, সাগর-পানা
ক্রমশই ভারী হয়ে এল সেই শরীর
দু পায়ের ফাঁকে ভেসে যায় কত মাছ
শেষ যাত্রায় প্রাণী ও ঝাঝির বাধা বার বার জড়ায়।

সন্ধ্যা আকাশ ধোঁয়ার মতন কালো
রাত্রে তারার আলো হয়ে এল অনড়
তবুও বিকেলে ছিল স্বচ্ছতা, নীলিমার নীল দিন
আরও কিছু ভোর এবং সন্ধ্যা এখনও রয়েছে সামনে।

যখন পাচন শুরু হল তার ম্লান দেহটিতে জলে
খুব ধীরে ধীরে ঈশ্বর তাকে অনায়াসে ভুলে গেলেন।
প্রথমে মুখটি, তার পর হাত, সব শেষে তার চুল
এখন সে শুধু পচা গলা মাস, নদীতে অন্য পচা মাংসের মতন।

[নাট্যকার ও মঞ্চ প্রযোজক হিসেবে ব্ৰেহটের প্রভূত খ্যাতি তার চমৎকার লিরিকগুলিকে কিছুটা চাপা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু তাঁর কবিতার নিপুণ সারল্য অননুকরণীয়। কখনও কখনও তিনি চিনে কবিতার ভঙ্গি গ্রহণ করেছেন এবং তার মতে তার শব্দ ব্যবহার বাইবেলগন্ধী— যদিও কোনও কোনও সমালোচক তাঁর কাব্য-সংগ্রহকে বলেছেন, শয়তানের প্রার্থনা পুস্তক। এর কারণ, ব্রেহ সমাজের নিচু শ্রেণীর নরক-সমান পরিবেশের বঞ্চিত, অপমানিত মানুষের কথা গভীর সহানুভূতির সঙ্গে হাসতে হাসতে বলতে পেরেছেন।
প্রথম কবিতাটিতেই তার জীবনী জানা যায়। এ ছাড়া, উল্লেখযোগ্য তথ্য এই, জন্ম ১৮৯৮, রাজনৈতিক মতবাদের জন্য একাধিকবার নির্বাসন। তিনি সাম্যবাদে বিশ্বাসী এবং জার্মানি বিভাগের পর শেষ পর্যন্ত আশ্রয় গ্রহণ করেন পূর্ব জার্মানিতে। নাট্যকার হিসেবে তার সম্মান পৃথিবীব্যাপী এবং সম্ভবত তিনিই একমাত্র কমিউনিস্ট লেখক। যাঁর নাটকের ধারাবাহিক অভিনয় হয় আমেরিকায়। মৃত্যু ১৯৫৬।]
.
ইনগেবর্গ বাখমান

[এই শতাব্দীর শুরুতেই নিঃসঙ্গতা নামক নির্মম ব্যাধিটি প্রবলভাবে আক্রমণ করে কবি ও শিল্পীদের। অধিকাংশ রচনাতেই ফুটে ওঠে সমাজের প্রতি কবির অনাস্থা, মানুষের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা বোধ। সমস্ত শিল্পই ক্রমশ হয়ে ওঠে অতি ব্যক্তিগত, শিল্পীর একক নিঃসঙ্গতার অভিব্যক্তি। কিন্তু ১৯২০-র পর জার্মানির একদল লেখক (ব্রেহ প্রমুখ) চেয়েছিলেন সমাজের সঙ্গে কবির নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করতে, ঘঘাষণা করেছিলেন মানুষের সম-ভ্রাতৃত্ব। কিন্তু কয়েক বছর পর হিটলারের উত্থান এই শুভ বিশ্বাসকে তছনছ করে দেয়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর, জার্মানিতে আবার এক নবীন সাহিত্যিক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে, যাদের বলা হয় ৪৭-এর দল। এই দলের লেখকরাও বিদ্রোহী নন, শান্ত, চাপা-আচ্ছন্ন, সংগীতময় রচনা এঁদের বৈশিষ্ট্য। এঁদের মধ্য থেকে আমরা একমাত্র শ্রীমতী ইনগেবর্গ বাখমানকে বেছে নিলাম।
শ্রীমতী বাখমান জাতে অস্ট্রিয়ান, জন্ম ১৯২৬। দর্শনশাস্ত্রে ডক্টরেট। দুটি কবিতার বই এবং একটি ছোট গল্পের বই বেরিয়েছে। এই রূপসী বিদুষী তরুণী, অল্প বয়সেই যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছেন, ইংরেজি অনুবাদকরাও বলেছেন, অনুবাদে তাঁর কবিতার রস খুবই নষ্ট হয়।
জার্মান কবিতা সম্পর্কে উৎসাহী পাঠকরা বিশদ পরিচয়ের জন্য পাওলিক-হাকার-মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত জার্মান শ্রেষ্ঠ কবিতা নামের বাংলা অনুবাদের বইটি দেখতে পারেন।]

দুপুর

গ্রীষ্ম ঋতুতে যখন লেবু গাছগুলি
নিঃশব্দে ভরে যায় ফুলে
শহরের বহু দূর থেকে দিনের বেলার চাঁদ
পাঠিয়ে দেয় আলোর ম্লান ছায়া:
দুপুর হয়ে এল,
এখন ঝরনার জলে কাঁপে সূর্যের আলো

এখন প্রাচীন ভগ্ন্যুপের নীচ থেকে বেরিয়ে এসে
ফিনিক্স পাখি মেলে দেয় তার বিক্ষুব্ধ ডানা,
পাথর ছুড়ে ছুড়ে ক্ষতবিক্ষত হাত
এখন জাগ্রত ফসলে ড়ুবে যায়।

যেখানে জার্মান আকাশ পৃথিবীকে কালো করে দেয়
সেখানে এক মুণ্ডহীন দেবদূত খুঁজছে একটি কবর
মানুষের ঘৃণার জন্য
আর তোমার জন্য সে রেখে যায় একটি হৃদয়ের চাবি।

একমুঠো দুঃখ মিলিয়ে যায় পাহাড়ের ওপারে।
সাত বছর পর
তোমার পুরনো চিন্তা তোমার জন্য ওখানে অপেক্ষায় আছে,
সেই দরজার সামনে ঝর্নায়
খুব গভীর ভাবে সেদিকে তাকিয়ো না, না, তাকিয়ো না
অশ্রু তোমার চক্ষু ড়ুবিয়ে দেবে।

সাত বছর পর
যে বাড়িতে মৃতেরা শুয়ে আছে
সেখানে গত কালের হত্যাকারীরা তুলে ধরেছে
তাদের সোনালি পানপাত্র
তুমি চোখ নামিয়ে নাও, চোখ ফেরাও
এখন পুরো দুপুর।
ছাইয়ের মধ্যে
কুঁকড়ে উঠছে লোহা, কাটাঝোপ ছাড়িয়ে
উড়ছে পতাকা, আদি কালের স্বপ্নের পাথরগুলি
শিকলে রূপান্তরিত ঈগলকে ধরে আছে।
আলোয় অন্ধ হয়ে যাওয়া আশা শুধু শিউরে ওঠে।

তার শিকল খুলে দাও, শিখর থেকে নামিয়ে
আনো তাকে, তোমার দু’হাতে ঢাকো তার চোখ
যেন ছায়া তাকে ঝলসে দেয়।
যেখানে এক জার্মান আকাশ পৃথিবীকে কালো করে
সেখানে মেঘ খোঁজে শব্দ,
বোমার গর্তগুলি ভরিয়ে দেয় স্তব্ধতায়
গ্রীষ্মের আগে সেই শব্দ শুনতে পায় সামান্য বৃষ্টি ধারায়।

সারাদেশ জুড়ে ঘুরে বেড়ায় সেই অব্যক্ত অনুভব
শুধু ফিসফিস করে শোনা যায়:
এখন দুপুর ॥

[ফিনিক্স মিশরের একটি পৌরাণিক পাখি। এই সুন্দর উজ্জ্বল পাখিটি ৫০০ বছর বাঁচার পর নিজেই ইচ্ছে করে আগুনে ঝাপিয়ে পড়ে, আবার সেই ছাই থেকে হয় পুনর্জন্ম। ফিনিক্স পাখি অমরত্বের প্রতীক। পাহাড় চূড়ায় যে বন্দি ঈগলের উল্লেখ আছে সেই ঈগল পাখিও সাধারণভাবে যেকোনও জাতির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখানে পরাভূত জার্মান জাত। কবিতাটিতে জার্মানির দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তী বিষাদ স্পষ্ট। পৃথিবীতে যখন সভ্যতার দ্বিপ্রহর, তখন জার্মানিতে ছায়ার জন্য ভয়।]
.
আনড্রিয়াস ওকোপেঙ্কো

[বাংলা দেশের কবিতায় দশক ভাগ করার একটি অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর রীতি প্রবর্তিত হয়েছে। তৃতীয় দশক, চতুর্থ দশক, পঞ্চম দশক এই অনুযায়ী কবিদের নিতান্ত জন্মসাল বা কবিতার লেখার কাল দিয়ে শ্রেণী ভাগ করার রীতি আর কোথাও চোখে পড়ে না। কোনও পত্রিকা বা কোনও শক্তিশালী দলকে কেন্দ্র করে কবিতায় স্মৃতির পুনরুদ্ধার বা নতুন ধ্যান ও রীতির উদ্ভব হয়, কবিতার ইতিহাস তৈরি হয় সেরকমভাবে। বাংলা দেশে কবিদের ইতিহাস লেখা হয়েছে, কবিতার ইতিহাস নিয়ে এখনও আলোচনা শুরুই হয়নি। আমাদের যেমন রবীন্দ্রনাথ, জার্মান কবিতায় এ শতাব্দীতে তেমন বলা যায় রিলকে, কিন্তু আমি অন্তত সাতটি জার্মান কবিতা বিষয়ক গ্রন্থ খুঁজে দেখেছি, কোথাও রিলকে-পূর্ববর্তী কিংবা রিলকে-পরবর্তী কবি— এ ধরনের কোনও আলোচনা চোখে পড়েনি।
এক্সপ্রেশানিজমই এ শতাব্দীতে এ পর্যন্ত জার্মানিতে মুখ্য কাব্যচিন্তা। যদিও আরম্ভের কালে ও পরবর্তী চিন্তায় অনেক পার্থক্য। জার্মান কবিতা পর্যায় শেষ করার আগে আমরা একজন তরুণ লেখখকে বেছে নিয়েছি যাঁর কাব্য এক্সপ্রেশানিস্টদেরই রূপান্তর এবং বলা যায় এক্সপ্রেশানিজমের দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈশিষ্ট্যসূচক, তিনি নিজস্ব পদ্ধতিতেও কবিতার শরীর ভাঙাচোরার চেষ্টা করছেন। কবিতার এরকম গঠন বাঙালি পাঠকদের কাছে হয়তো নতুন ও চিত্তাকর্ষক মনে হবে।
আনড্রিয়াস ওকোপেঙ্কো জাতে চেকোশ্লোভাক, এখন অস্ট্রিয়ার নাগরিক। পেশায় রাসায়নিক, কিন্তু উগ্রপন্থী আধুনিক কবিদের অন্যতম। তাঁর বয়স এখন ৩৬, এই কবিতাটি ২৯ বছর বয়সে লেখা।]

সবুজ সুর

…সবুজ সুর নীল নারী
ছুটির দিন সাদা।
আমি সবুজ মাঠের মধ্যে তরুণ গ্রামের
আমার গোলা হলুদ রং নারী সমেত শস্য সমেত
আমার নারী হলুদ রং গোলা সমেত শস্য সমেত
আমি সবুজ শস্য দেশে তরুণ গ্রামের

সূর্য এখন বাজার পথে ঘুরে চলেছেন
আমার নারী বাজার পথে হেঁটে চলেছে
আমার সবুজ শস্য নারী আমার সবুজ মাঠের নারী
আমার সবুজ তরুণী গ্রাম তরুণী এখন বাজার পথে হেঁটে চলেছে


বাজার ঘর ভরতি এখন চালকুমড়োয়
চালকুমড়োগুলোই এখন বাজার ঘরের সাদা ধুলো
দুপুরবেলার বাজার ঘরের সাদা ধুলো সাদা ধুলো
বাড়ির পথে মেয়ের দিকে বাগান পথে

আমি সবুজ বিকেলবেলা নারীর মধ্যে বাগান
এখন আমি এখন সবুজ হচ্ছি নারীর মধ্যে বাগান এখন
একটি ঘর ঠান্ডা একটি নীল রঙের ডোরা কাপড়
দুপুর কলসি নীল গেলাস একটি জল

আমিই সেই ঠান্ডা ঘর আমি এখন ঠান্ডা ঘরে
আমি এখন যেখানে শেষে মেয়েটি আমি মেয়ের সঙ্গে
মেয়েটি আর জল ও পাখি পান করেছি কিছুটা জল
কলসি এই ঘর ভিতরে আছি দু’জনে

একটা পিঁপড়ে পেরিয়ে গেল ল্যাটিন গ্রামার
জানলা দিয়ে উড়ে এল গাছের পাতা
এক ফোঁটা জল গড়িয়ে গেল আমার মুখে
একটি ধীর ছোট্ট ঘড়ি সৃষ্টি করে অ্যালুমিনিয়াম বিকেলবেলা

আমি চকচক রূপে রৌদ্রে অ্যালুমিনিয়াম
ফুলের টবের মাটির নীচে কবর দিলুম আমার ঘড়ি
আমার নারী অরণ্যের ভিতরে ছোটা ঝিঁঝি পোকা না
আমার নারী গ্রীষ্মভূষায় জানলা ঘেঁষে শুয়ে রয়েছে

জানলার ঝিলমিলির ওপর, ছোট চেয়ার হালকা টেবিল তার ওপরে
ছায়ার ওপর রৌদ্র স্মৃতি আজ বিকেলের ওপরে বাগান
আমি এখন বুঝতে পারি ছোট ছেলেটা কেন যে যায় তাস খেলায়
আমি এখন বুঝতে পারি ছোট মেয়েটা রাখে আখুল সবুজ পাতায়…

আমিই সব ছুটির দিন আমি সবুজ
আমি সবুজ মাঠের ওপর ধানের মধ্যে
আমিই নীল সেই নারীর ঘরের মধ্যে
বিকেলবেলা, আমি নারীর ভিতরে নীল।

[কবিতাটি থেকে তিনটি স্তবক অনুবাদে বাদ দিয়েছি। পুরো কবিতাটির একেবারে শেষ লাইনে মাত্র একটি কমা ও শেষে দাড়ি আছে—এ ছাড়া আর কোথাও কোনও ছেদচিহ্ন নেই। সুতরাং কোনও বিশেষ্যের সঙ্গে কোনও বিশেষণের কী সম্পর্ক— সে দায়িত্ব সম্পূর্ণ পাঠকের। সবুজ রংটিকে কোথাও কোথাও ক্রিয়া হিসেবেও ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, আমি সবুজ বিকেলবেলা— এখানে অর্থ, বিকেলবেলাটা সবুজ, না আমিই সবুজ, না আমি বিকেলকে সবুজ করছি এর মীমাংসা পাঠক নিজের সঙ্গে তর্কাতর্কি করে ঠিক করে নেবেন। আমার বুঝতে অসুবিধে হয়নি।]