ইতালির কবিতা: গোধূলি ও ভবিষ্যৎ

ইতালির কবিতা: গোধূলি ও ভবিষ্যৎ

এই শতাব্দীর শুরুতে, ফরাসি কবিতায় যেমন যৌথ সম্রাট ছিলেন দুই দিকপাল, ভালেরি এবং ক্লোদেল এবং পরে আপোলিনেয়ার এসে এবং সুররিয়ালিস্টদের বিদ্রোহ ফরাসি কবিতায় নতুন ধারা এনে দেয় সেইরকমই, ইতালির কবিতায় বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত স্তম্ভ ছিলেন তিনজন মহৎ কবি, কার্দুচ্চি, পাসকোলি এবং দানুৎসিয়ো— এঁদের প্রতিহত করে নবীন বিদ্রোহ শুরু হয় ইতালিতে। এই তিনজনকে বলা যায় রোমান্টিক যুগের শেষ অশ্বারোহী, দীপ্ত, বর্ণাঢ্য পরিচ্ছদে ভূষিত মানুষকে এঁরা মহামানব করতে চেয়েছিলেন— এঁদের প্রভাব ধ্বংস করার জন্য নবীনরা কবিতায় নিয়ে এলেন একরঙা সাধারণ মানুষের কথা— যে মানুষ লাঞ্ছিত ও বিধ্বস্ত, আত্মগোপনকারী—এই যন্ত্র ও যুদ্ধের যুগে যে মানুষ অতি সাধারণ এবং অসহায়। এই নবীন আন্দোলনের নাম ভবিষ্যৎবাদ– রোমান্টিকদের অতীতে-মুখ-ফেরানো স্বরূপের বিরুদ্ধে নবীনদের এই উত্তর। ইতালির কবিতার এই আন্দোলনের সঙ্গে সেই সময়ের ফরাসি কবিতার তেমন মিল নেই, কিন্তু ইংরেজি কবিতার সঙ্গে আছে। তুলনীয় সমসাময়িককালে টি এস এলিয়ট রচিত ফাঁপা মানুষ কিংবা প্রুফকের উক্তি, আমি যুবরাজ হ্যামলেট নই, আমি তা হতেও চাইনি! এই ভবিষ্যৎবাদের পরবর্তী আন্দোলনের নাম হারমেটিক বা বলা যায় নিরুদ্ধ কবিতার আন্দোলন— যে মতবাদ, একটি কবিতার মধ্যেই শেষ। যাই হোক, সে সম্পর্কে পরে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু ইতালির ভবিষ্যবাদ আন্দোলনের আগে, এই শতাব্দীর প্রথম দশকে আর একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু সার্থক আন্দোলন হয়েছিল, যার নাম দেওয়া হয়েছে গোধূলি কবিতা। স্বল্পস্থায়ী হলেও সে আন্দোলন উল্লেখযোগ্য।
রোমান্টিকদের প্রতিনিধি যদি দানুৎসিয়োকে ধরা যায়, তবে, সেই বিশাল পুরুষের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল দুটি রোগাপটকা বাচ্চা ছেলে। নিৎসের শিষ্য দানুৎসিয়ো তাঁর গল্পে, নাটকে এবং কবিতার মধ্যে দিয়ে প্রবলভাবে আশার জয়গান, বীরত্ব এবং রমণীসম্ভোগের কথা বলেছেন উজ্জ্বল ভাষায়, শব্দের ঝংকারে, ছন্দের চমৎকারিত্বে। তাঁর বিরুদ্ধে যারা দাঁড়াল, তারা যেন নিষ্প্রাণতার প্রতীক— ম্লান, অলংকারহীন ভাষা, সাধারণ শব্দাবলী-ভাঙা দুর্গ, পরিত্যক্ত বাগান, ঘরের জানলা, দীর্ঘশ্বাস, হতাশা তাদের কবিতার বিষয় প্রতি পদে জীবনের সমস্ত গৌরবকে অস্বীকার। গোধূলির কবিদের মধ্যে যে দু’জন প্রধান— সেই গুইদো গৎসানো আর সার্জও কোরাৎসিনি— দু’জনেই মারা গেছেন টি বি রোগে, অল্প বয়সে।
কোরাৎসিনি মারা গেছেন মাত্র একুশ বছরে— তবু সেই বালকই দানুৎসিয়ো প্রমুখ মহারথীদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ইতালির কবিতাকে নতুন পথে অনেকখানি অগ্রসর করে দিয়ে গেল। গৎসানোরও মৃত্যু হয়েছে মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে।
ক্রেপুসকোলারি বা গোধূলির কবিদের নব্যরীতির নিষ্প্রাণ, বর্ণহীন, নিরাশাময় ভাষা ও ভাবের ব্যাখ্যা খুব সহজেই করা যায়। পূর্ববর্তী প্রবল প্রভাবশালী লেখকদের বিরুদ্ধে নবীনরা যখন বিদ্রোহ করেন, তখন পূর্ববর্তীদের রচনায় যেসব উপাদান নেই, নবীনদের রচনায় অজ্ঞাতসারেই সেগুলি এসে যায়। ফলে, ভাষার অন্য একটি দিক খুলে যায়, উভয় দলের কাছ থেকে ভাষা ধনী হয়। রবীন্দ্রনাথের উচ্চ মহত্ত্ব এবং বিশ্বমানবতার বিরুদ্ধে যেমন জীবনানন্দের নির্জন আত্মকেন্দ্রিক মগ্নতা।
.
গুইদো গৎসানো

[গুইদো গৎসানোর জন্মসাল ১৮৮৩। ছেলেবেলা থেকেই যক্ষ্মারোগ। এই কবিতাটিতে দেখা যাচ্ছে পঁচিশ বছর বয়সেই যেন তার যৌবন শেষ হয়ে গেছে। বার্ধক্যের ভয়ে কবি ভীত। যদিও, সে বার্ধক্য আসার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু গুইদো বাঁচতে চেয়েছিলেন। যক্ষ্মা সারাবার জন্য কিটস এসেছিলেন ইতালিতে। আর ইতালির কবিরা যাবে কোথায়? গুইদো পৃথিবীর বহু দেশে আকুল হয়ে ঘুরেছেন রোগ সারাবার জন্য। তবু বাঁচতে পারেননি।]

সংলাপ

পঁচিশ বছর! বুড়ো হয়ে গেছি আমি
বুড়ো হয়ে গেছি! যৌবন গেছে শ্রেষ্ঠ ফসল লুকায়ে
পড়ে আছে শুধু শূন্যতা আর সংসার।

সময়ের পুঁথি দিয়েছে হারায়ে সেখানে আমার শেষ
কান্নার স্বর চাপা পড়ে আছে, ধূসর পাণ্ডুলিপি
হয়তো আমারে চেনাতে পারিত অতীতের সেই ছন্দ।

পঁচিশ বছর! মনে মনে আমি করেছি আলিঙ্গন
পৌরাণিকের যত বিস্ময় আমার আকাশ ম্লান,
একা বসে আমি দেখি সূর্যের ধীরভাবে ড়ুবে যাওয়া।

পঁচিশ বছর। তা হলে তিরিশও কেটে যাবে এই ভাবে
চুপিসারে, শুধু কটু অনুভূতি মরণের সাথে জোড়া
ভয়ের শিহর, তাও চলে যাবে, আবার আসিবে চল্লিশ।

কী ভয়ংকর— চল্লিশ, সে যে ভীরু পরাজয়, আর
ম্লান মানুষের বিরস বয়েস, তার পরে বুঝি বার্ধক্যের হানা
নকল দন্ত, কলপ মাখানো কেশরাজিভরা বৃদ্ধ বয়েস।
কভু পুরোপুরিভোগ না করার হে আমার যৌবন
আজ দেখি আমি তোমার স্বরূপ, সত্যমূর্তি
দেখি তব হাসি, প্রেমিকের শোভা, যে শোভা মোদের

শুধু বিদায়ের বিষাদের কাল নির্দেশ করে।
পঁচিশ বছর! যত দূরে আমি চলেছি অন্যপ্রান্তে
তত বলে যাই স্পষ্ট কণ্ঠে, হে আমার যৌবন

তোমার ও রূপ মধুর প্রেমের উপযোগী ছিল!

[এই কবিতাটির শুধু প্রথম অংশ আমি অনুবাদ করেছি, দ্বিতীয় অংশে আছে, এই যে যৌবন মধুর প্রেমের উপযোগী— এই যৌবন কবি নিজে কখনও ভোগ করতে পারেননি। যেন, তার হয়ে অন্য একজন কেউ ভোগ করেছে আজীবন। সম্পূর্ণ কবিতাটি পড়তে যদি কারুর ইচ্ছে হয়, তবে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত কনটেমপোরারি ইটালিয়ান পোয়েট্রি নামের দ্বি-ভাষা সংকলনটি দেখতে পারেন।
প্রথমত ইতালির কবিতা অনুবাদে আমি শুদ্ধ ক্রিয়াপদ ব্যবহার করেছি। ইতালির কবিতায় ওই রকম ব্যবহার করার উদ্দেশ্য, আমাদের বাংলার মতো ইতালিতেও এই শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত মুখের ভাষা আর লেখার ভাষার রীতি ছিল আলাদা। নবীন কবির দল। এই হাস্যকর পার্থক্য ভেঙে দেন— কিন্তু গোড়ার দিকে সেই পরিবর্তনটুকু বোঝাবার জন্যই একটি কবিতায় সাধুভাষা প্রয়োগ করে রাখলুম।]
.
দিনো কামপানা

[প্যান্টের পিছন-পকেটে একটা কবিতার বই, হুইটম্যানের লিভস অব গ্রাস— শুধু এই নিয়ে ইহুদি মায়ের ছেলে দিনো কামপানা কৈশোর বয়সেই বেরিয়ে পড়েছিলেন পৃথিবীতে, এই বিংশ শতাব্দী তখন সবে শুরু হয়েছে। কী খুঁজতে বেরিয়েছিলেন কে জানে, কিন্তু পেয়েছেন শুধু দারিদ্র্য, হতাশা আর মাথার অসুখ। কামপানা যেন ইতালীয় কবিতার র‍্যাঁবো- দেশ ছেড়ে ছন্নছাড়ার মতো ঘুরেছেন ইউরোপের সর্বত্র, দক্ষিণ আমেরিকায়। ছুরি কাঁচি শান দেওয়ার চাকরি থেকে শুরু করে, ইঞ্জিনের কয়লা ঠেলা, লিফ্ট-ম্যানের কাজ, জাহাজের ডেক পরিষ্কার করা ইত্যাদি বহু জীবিকাই গ্রহণ করেছেন। তাও সুস্থ শরীরে নয়, যৌবনেই পাগলামির লক্ষণ দেখা যায়, সব মিলিয়ে সাত-আটবার পাগলাগারদে বন্দি হয়েছেন ও বেরিয়েছেন, ইতালি ও সুইটসারল্যান্ডে দুবার জেলও খাটতে হয়েছে। লেখাপড়া শিখতে পারেননি, কিন্তু কামপানার কবিতায় বৈদগ্ধ্য অনুপস্থিত নয়।।
প্রথম মহাযুদ্ধ আরম্ভ হবার বছরে, এলোমেলো বিশ্রীভাবে ছাপা কামপানার একটি চটি কবিতার বই অরফিউসের গান ইতালির সাহিত্যে প্রবল আলোড়ন এনে দিল।
ওদিকে, ইতালির সাহিত্যে তখন চলছে প্রবীণদের বিরুদ্ধে নবীনদের বিদ্রোহ, ফিউচারইজম আন্দোলন, একদল তরুণ লেখক বিশ্ব সাহিত্যের তীর্থ প্যারিসে চলে গিয়ে সেখান থেকে বার করছে ইস্তাহার। ইতালির সাহিত্যকে তারা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ইয়োরোপীয় সাহিত্যের অঙ্গীভূত করে তুলছে। বিদ্রোহের প্রথম উচ্ছাসে বহু উদ্ভট ও চোখ ঠিকরোনো রীতিও দেখা দিচ্ছে। এদের মধ্যে প্রধান মেরিনেত্তি, নানারকম মুখের আওয়াজ দিয়ে শব্দ বানাবার চেষ্টা করছেন ও ছন্দ ভেঙে কবিতা সাজাবার কায়দায় কবিতায় নানারকম চাক্ষুষ পরিবর্তন আনছেন। যদিও এজরা পাউন্ড বলেছেন, ইতালিতে মেরিনেত্তি না থাকলে—ইংরেজিতে জয়েস, এলিয়ট ও আমি যে ধরনের পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছিলুম। তা সম্ভব হত না– কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেরিনেত্তির কবিখ্যাতি সময়কে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। ইতালির প্রথম দুই দশকের যে কাব্য-আন্দোলন, তার মধ্যে দিনো কামপানাই। সকলকে ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
কামপানার জন্ম ১৮৮৫-তে। ১৯৩২-এ মাত্র ৪৭ বছরে বয়েসে একটি উন্মাদ আশ্রমে তার মৃত্যু। শেষ পর্যন্ত তাঁর কবিতা রোমান্টিক রসেরই কবিতা।

জেনোয়ার নারী

তুমি এনে দিলে সমুদ্র থেকে একমুঠো পানা
তোমার অলকে, রৌদ্র তাম্র শরীরে তোমার
প্রবাসী বাতাস নানা দেশ ঘুরে এনেছে বাসনা
আমার জন্য।
আহা, কী দেবীর মতো সরলতা তোমার তন্বী শরীরের রূপে
ভালোবাসা নয়, নয় যন্ত্রণা, মায়াবি অতীন্দ্রিয়
ছায়া যেন এক অমোঘতা, ফেরে
তোমার শান্ত, ধ্রুব আত্মায়
ভেঙে মিশে যায় আনন্দে, যায় শান্ত অলৌকিক,
যেন তাকে ফের মরুর উষ্ণ ঝড়ে নিয়ে যাবে
দূরে অনন্ত শূন্য আকাশে।
তোমার মুঠোয় এই যে বিশ্ব কত ছোট, কত পলকা
.
উমবার্তো সাবা

[উমবার্তো সাবা এ শতাব্দীর ইতালীয় কবিতায় একক ব্যতিক্রম। জন্মেছেন মূল ইতালি থেকে অনেক দূরে, অ্যাড্রিয়াটিক সমুদ্রের ত্রিয়েস্ত দ্বীপে। ত্রিয়েস্ত ইতালি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল বহুদিন, প্রথম মহাযুদ্ধের ফলাফল হিসেবে এই দ্বীপ ইতালির সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে যুক্ত হয়। তখন সাবার বয়েস ৩৫। অর্থাৎ পুর্ণযৌবন পর্যন্ত তিনি ইতালির ভাষায় কবি হয়েও সে দেশের নাগরিক ছিলেন না।
কিন্তু উমবার্তো সাবা এ শতাব্দীর প্রধান তিনজন আধুনিক ইতালীয় কবির অন্যতম। উনগারেত্তি এবং মনতালের সঙ্গে তাঁর নামও সমান শ্রদ্ধেয় এবং ইতালির কবিতায় তার প্রভাব অপরিমিত।
মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে ছিলেন বলে, তিনি সমসাময়িক কাব্য আন্দোলনের খোঁজ পাননি। প্রত্যেক যুগেই কবিদের শব্দ ব্যবহারে এক ধরনের প্রবণতা দেখা যায়। শব্দ নির্বাচনে এক প্রকার রুচি এক যুগের কবিদের সময় চিহ্নিত করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলায় আমরা জন্মদাতাকে বাবা বলে ডাকি, কিন্তু শুদ্ধ পিতা শব্দটি এখনও অপাক্তেয় হয়ে যায়নি, অথবা মুখে বলি, বাড়িটা ভেঙে গেছে, লেখাতে ভগ্নস্তূপ এখনও অচল নয়। কিন্তু, বাঁশির বদলে, কোনও অর্বাচীন কবিও হংসীর সঙ্গে মেলাবার দারুণ লোভ সত্ত্বেও বংশী ব্যবহার করবেন না! কী সেই অলিখিত আইন— যাতে ভাঙার বদলে ভগ্নও চলে, কিন্তু বাঁশির বদলে বংশী চলে না— তা ব্যাখ্যা করা যায় না। সময় অনুযায়ী এইরকম রুচি গড়ে ওঠে— সব কবিরাই তা টের পেয়ে যান।
মূল ভূখণ্ড থেকে দুরে সাবা এই ধরনের আধুনিক শব্দ ব্যবহারের রুচি টের পাননি। সুতরাং তিনি নিজস্ব শব্দ ব্যবহারের একটি রীতি প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং প্রধানত অনুসরণ করেছেন ক্লাসিক ধারা। সরলতা এবং প্রভূত কবিত্ববোধ তার কবিতাকে বিশিষ্ট এবং স্বতন্ত্র করেছে।
১৮৮৩ সালে জন্ম, প্রায় সারা জীবনই দূরে কাটিয়ে, উমবার্তো সাবার মৃত্যু ১৯৫৩-তে।]

নারী

যখন ছিলে ছোট্ট খুকুমণি
পারতে হুল ফোটাতে
কাটার ধার বুনো ফুলের মতো।

তোমার ওই ছোট্ট পা দু’খানি
ছিল কেমন বন্য, তুমি অস্ত্র হয়ে লাথি ছুড়তে—
তোমায় ধরা শক্ত ছিল, বিষম শক্ত।
আজও তেমন ছোট্ট আছে।

অথচ সুন্দরী।
সময় আর দুঃখ দুই সুতোয় জট বাঁধা
তোমার আমার দুই হৃদয় আজ হয়েছে এক
এখন তোমার ভ্রমর কালো চুলের মধ্যে আমার হাত
এখন আর ভয় করি না তোমার ওই ছোট্ট সাদা
খরগোসের মতন দুই ধারালো কান!


সবুজ ফসল, ফল

সবুজ ফসল, ফল, রূপসী রানির মতো ঋতুর
বর্ণনা।
বেতের ঝুড়ির মধ্যে ঝলসে ওঠে মিষ্টি স্বাদ
দাঁত লোভী করে।
এক জোড়া তামাটে পা, নগ্ন হাঁটু— আসে, অহংকারী
বালকের ফের দৌড়ে চলে যায়।
অন্ধকার
নেমে আসে সামান্য দোকানটিতে, গাঢ় হয়—
দ্রুত বুড়ো হয়ে যাওয়া মায়ের মুখের মতো।
সেই ছেলেটা
বাইরে রোদ্দুরে ছুটে যায়, লঘু পায়ে হাল্কা ছায়া
সঙ্গে সঙ্গে ফেরে।

[মূল কাব্যধারা কিছুটা বিচ্ছিন্ন থেকে সাবা যে প্রাচীনপন্থী হয়ে থাকেননি, কারণ, তাঁর অধিকাংশ রচনাই আত্মজীবনীমূলক। নিছক আকাশ, সমুদ্র ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদের স্তুতি বা মানুষের মহানুভবতার জয়গান না করে তিনি নিজের জীবনের ছোটখাটো সুখ-দুঃখের কথা লিখেছেন। গোধুলির কবিদের মতো ভাষা ব্যবহারে লাঞ্ছিত এবং পরাজিত ভঙ্গি না থাকলেও, তিনি দূরে থেকে এবং না জেনে, মানসিকতায় সমসাময়িক গোধূলি কবিতা আন্দোলনের কাছাকাছি ছিলেন এবং কবিত্বশক্তিতে ওঁদের চেয়ে অনেক বড়।]
.
জুসেপ্পে উনগারেত্তি

[যদিও বাবা-মা ইতালিয়ান, কিন্তু উনগারেত্তি জন্মেছিলেন মিশরে, এবং লেখাপড়া শিখেছেন প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভালেরি, জিদ, আপোলিনেয়ার প্রভৃতি সাহিত্যের বিখ্যাত মহীপালের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল, ফরাসি সাহিত্যের আবহাওয়ায় তার মানস গড়ে ওঠে। কিন্তু ইতালিয়ান সাহিত্যে এক সময় তার নিন্দে ও প্রশংসার প্রবল ঝড় ওঠে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে ইতালিতে তিনিই ছিলেন একক খ্যাতি-অখ্যাতির কেন্দ্র।
জন্ম ১৮৮৮, প্যারিসে লেখাপড়া শেষ করে ইতালিতে এলেন ১৯১৪ সালে। তখন যুদ্ধ। যুদ্ধে যোগ দিয়ে তিনি লড়াই করলেন ইত্যালি ও ফ্রান্সে। ট্রেঞ্চের মধ্যে বসে বসে কবিতা লিখতেন, তার বন্ধু আপোলিনেয়ারও অন্য দিকের ট্রেঞ্চে বসে তার বিখ্যাত কবিতাগুলি লিখছেন, সেই সময়।
যুদ্ধ থেকে ফিরে কবিতার বই ছাপলেন। সাংবাদিক বৃত্তি নিয়ে ঘুরলেন সমগ্র ইয়োরোপ, তারপর ইতালীয় ভাষার অধ্যাপক হিসেবে ব্রাজিল গিয়েছিলেন। দ্বিতীয় যুদ্ধ বাধার সময় তাকে জোর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয় ব্রাজিল থেকে। এখন রোমে অধ্যাপনা করছেন।
ইতালির কবিতায় হারমেটিক কবিতার যে আন্দোলন শুরু হয়, কিছু ফরাসি কবিও এই অভিধায় ভূষিত হচ্ছেন— উনগারেত্তিকে তার পুরোধা বলা যায়। হারমেটিক আন্দোলন সম্পর্কে সামান্য আলোচনা করা যেতে পারে। হারমেটিক কবিতার আধুনিক অর্থের নিকটতম অনুবাদ হতে পারে— বন্ধ কবিতা। এই কবিতার মুখ্য উদ্দেশ্য, যেকোনও পথ চলতি পাঠক যে হুট করে একবার চোখ বুলিয়ে এই কবিতার রস পাবেন, তার উপায় নেই। অরসিকের কাছে এ কবিতার পথ বন্ধ। এর রস আস্বাদ করতে হলে পাঠককে প্রস্তুত হয়ে নিতে হবে, প্রতিটি শব্দ, ধ্বনি, লাইন সাজানো ছোট বড় লাইন, লাইনের মাঝখানে ফাঁক— এই সবই অর্থময় হতে পারে। এ ছাড়া উপমার নিরাভরণত্ব। যেমন উদারহণ দেওয়া হয়েছে, আমার হৃদয়ের মতো একটি পাখি— এই উপমার আরও সরল রূপ, হৃদয়-পাখি— হারমেটিক কবিরা আরও সরল করে বলবেন, শুধু পাখি পাখি মানেই কোনও কবিতায় হৃদয়— সেটা বুঝে নিতে হবে। প্রতীকের সঙ্গে উপমার ঠিক কোথায় তফাত, তা অবশ্য বোঝা যায় না।
শব্দ ব্যবহার সম্পর্কে উনাগারেত্তির ভিন্ন মত আছে। তার মতে, শব্দের কোনও আলাদা মেজাজ থাকতে পারে না। কোনও শব্দই ইচ্ছে মতো করুণ বা মধুর বা ক্রুদ্ধ হতে পারে না। সব শব্দই ব্যবহার করতে হবে আদি, ঐতিহাসিক (আমাদের ক্ষেত্রে ধাতুগত) অর্থে। বাংলায় উদাহরণ দেওয়া যায়: একটি বিধবা যুবতীর কায়ক্লেশে দিন কাটছে এই কথার। প্রচলিত অর্থ, কষ্টেসৃষ্টে কোনওরকমে দিন কাটছে আর কি। কিন্তু কায়ক্লেশের আদি অর্থ মেনে বুঝতে হবে, বিধবাটির শারীরিক কষ্টও এখানে উল্লেখিত। কিংবা, প্রতিমা শব্দটির সাধারণ অর্থ খড়-মাটি রঙের মূর্তি কিন্তু যদি মনে রাখা যায় প্রতিমা আসলে সাদৃশ্য অর্থে প্রতিম শব্দের স্ত্রীরূপ, তবে বৃষ্টির প্রতিমা বা ঝড়ের প্রতিমা ও বিসদৃশ হয় না।]

রহস্য-বিরক্তি

স্তব্ধতা যখন অভঙ্গ জাগে
সতেজ শরীরের প্রতি আমার যাত্রা
আমার দিকে তার বাড়ানো হাত রক্তাভ
আমার সামান্য অগ্রসরে সেই হাত পিছিয়ে যায়।

সুতরাং এখানে এই ব্যর্থ অনুসন্ধানে আমি পরাভূত।
সকাল যখন তরঙ্গময় সে এগিয়ে আসে।
সে হেসে ওঠে, আমার চোখের সামনে অন্তর্হিত হয়ে যায়।

স্বকৃত উন্মত্ততা, বিরক্তি
প্রভূত নও, কখনও প্রভূত মত্ত এবং মিষ্টি নও তুমি

স্মৃতি কেন তোমার সঙ্গে সমান হাঁটে না?

তোমার দান কি একখণ্ড মেঘ?
এ শুধু ফিসফিস এই স্মৃতির বসতি
ভরায় বৃক্ষের শাখা দুরান্ত সংগীতে

স্মৃতি সঞ্চরমাণ ছবি,
বিষন্ন বিদ্রূপময়
রক্তের আঁধার…

ছায়াচ্ছন্ন লাজুক ঝরনার মতো

অলিভ কুঞ্জের প্রাচীন ছায়া
তুমি ফিরে আসো আমায় ঘুমপাড়ানি গান শোনাতে
তবুও গোপনে প্রত্যুষে
গোপনে আমি কি তোমার ওষ্ঠাধর প্রত্যাশা করতে পারি..
আর কোনওদিন আমি জানব না!


একটি গ্রামের ভগ্নস্তূপ

এই গৃহগুলির
কিছুই অবশিষ্ট থাকে না
শুধু কয়েকটি
দেয়ালের ভগ্নাংশ

কত মানুষ
যারা ছিল আমার আপন
কেউ নেই
এমন কী দেয়ালও না।

কিন্তু আমার হৃদয়ে
একটি ক্রুশচিহ্নও হারায়নি

আমার হৃদয়
এক রকম অত্যাচারিত গ্রাম

[হারমেটিক কবিতার যে-আলোচনা উপরে করা হয়েছে, অনুবাদ কবিতায় তা প্রকাশ করা অসম্ভব। আমরা ইতালির ভাষা জানি না, মূলের প্রতিটি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পাওয়া দুরূহ, তা ছাড়া সেভাবে অনুবাদ করাও যায় না। তবে, আমি লাইনের গতি ঠিক করেছি, এবং ইচ্ছে করেই কোনও বাংলা ছন্দের পোশাক পরাইনি। ফলে, পড়তে হয়তো কিছুটা কর্কশ লাগবে।
দ্বিতীয় কবিতাটি অস্ট্রিয়ার সান মারটিনো শহরের ভগ্নস্তূপ দেখে লেখা।]
.
উজিনো মনতালে

[ইতালির কবিতায় জীবিত প্রধান ত্রয়ীর মধ্যে মনতালে অন্যতম। আগে উনগারেত্তি প্রসঙ্গে আমরা যে হারমেটিক কবিতার উল্লেখ করেছি, মনতালে সেই ধারার অপর স্তম্ভ। উনগারেত্তির সঙ্গে মনতালের মূল প্রভেদ, সমালোচকদের মতে এই যে, উনগারেত্তির কবিতায় দুঃখের সুর আছে, কিন্তু সেই দুঃখবোধ খ্রিস্টান-সুলভ—অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত উত্তরণ আছে। কিন্তু মনতালের দুঃখবোধ আরও বিধুর, কিছুটা তিক্ত, শেষ পর্যন্ত মুক্তিহীন। মনতালে জানেন, মানুষ শেষ পর্যন্ত বড় নির্জন, এই পৃথিবীটা অর্থহীন, গাছপালা প্রভৃতি শেষ পর্যন্ত বস্তুজগৎ ছাড়া আর কিছুই না। (ছেলেবেলায় তিনি প্রকৃতির সামনে বসে দৈববাণীর প্রতীক্ষায় থেকে নিরাশ হয়েছিলেন।) আধুনিক কবির দ্বিধা এবং হতাশার ছাপ তার কবিতায়, পরবর্তীকালে প্রচারিত এজিসটেনশিয়ালিজমের আভাস পাওয়া যায়। যদিও উনগারেত্তি বড় হয়েছিলেন ফরাসি সাহিত্যের আবহাওয়ায়, এবং মনতালের শিক্ষা ইংরেজি আধুনিক সাহিত্য থেকে। ইতালিতে তাকে টি এস এলিয়েটের ধারার কবি বলা যায়।
মনতালে-র জন্ম ১৮৯৬-তে, জেনোয়ায়। প্রথম মহাযুদ্ধে গোলন্দাজ হয়ে লড়াই করেছেন। এখন মিলান শহরে একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক।]

দুপুর কাটানো

দুপুর কাটানো, ম্লান, মগ্নতা
ঝলসানো, ভাঙা দেয়ালের পাশে বাগানে,
কান পেতে শোনা, ঝোপের কাটার ভিতরে
পাখির কিচির, সাপের চলার খসখস।

মাটির ফাটলে অথবা মাধবীলতায়
লাল পিঁপড়ের আনাগোনা চেয়ে দেখা
কখনও ছড়ায়, কখনও বা সারি বাঁধে
ছোট্ট ঢিবির উপরে ব্যস্ত পিঁপড়ে।

পাতার আড়াল থেকে দুরে চেয়ে দেখা
রেখায় রেখায় সমুদ্র উত্তাল
বাতাসে তখন কর্কশ ভাবে কাঁপে
তৃণহীন টিলা থেকে ঝিঁঝিদের ধ্বনি।

প্রখর রৌদ্রে কিছু দূর হেঁটে যাওয়া
অনুভবে শুধু বিষণ্ন বিস্ময়
এ জীবন আর জীবনের যত শ্রম
পাশে হেঁটে যাওয়া– এই দেয়ালের মতো
যে-দেয়ালে ভাঙা বোতলের কাচ বসানো।


বান মাছ

বান মাছ, লাস্যময়ী
হিম সমুদ্রের, বালটিক উপসাগর ছেড়ে
এসেছ আমাদের সাগরে,
আমাদের মোহানায়, নদীর ভিতরে
নদীর প্রবাহ থেকে ক্রমশ গভীরে, প্রবল বন্যায়
ভেসে, নদীর প্রতিটি শাখা-উপশাখায়
শিরা-উপশিরায়, সরু হয়ে–
আরও ভিতরে, পাথরের অভ্যন্তরে ঢুকে
কাদার ভিতর থেকে ফুঁড়ে বেরিয়ে–
তারপর একদিন
চেস্টনাট গাছ থেকে আলোর রেখা এসে ঝলসায়
নিবদ্ধ পুকুরে
পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনায়—
বান মাছ, আলো, চাবুক,
মর্ত্যে ভালোবাসার তীর
যাকে শুধু আমাদের নদীর খাত অথবা
পিরেনিস পর্বতের শুকনো ঝরনায় পথ
ফিরিয়ে দেয় প্রজনন স্বর্গে;
সবুজ আত্মা আবার জীবন খোঁজে
যেখানে শুধু জ্বলন্ত বৃষ্টিহীনতা আর
নির্জনতার ক্ষয়,
স্ফুলিঙ্গ বলে ওঠে
সেই তো সব আরম্ভ, যেখানে সব
জমে যায় কাঠকয়লায়, নিহিত কাষ্ঠে;
তোমার চোখের পাতায় সাজানো
সংক্ষিপ্ত রামধনু
তুমি উজ্জ্বল হও, অচঞ্চল থাকো
মানুষের সন্তানদের মধ্যে, যারা
মগ্ন থাকে তোমার জীবনদায়িনী কর্দমে;
তুমি কি মানোনা
সে তোমারই সহোদরা?

[মনতালের প্রথম যৌবন এবং পরিণত জীবনের দুটি কবিতা এখানে উদ্ধৃত হল। প্রথমটি তার উনিশ বছর বয়সের রচনা। বান মাছ ইতালীয় ভাষার একটি অত্যন্ত বিখ্যাত কবিতা। সামুদ্রিক বান মাছ হাজার হাজার মাইল পার হয়ে যায়। হয়তো তারা মাটি খুঁড়েও যেতে পারে— যেমন ভাবে তারা পুকুরে-ডোবায় আসে—এই কল্পনায় মনতালে বলছেন, বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো হাজার বান মাছ বালটিক থেকে আড্রিয়াটিক উপসাগরে চলে যাচ্ছে ইতালির পর্বতমালা পেরিয়ে, শেষ পর্যন্ত অঙ্গারে পরিণত হয়ে মেয়েদের চোখের মণিতে রামধনু হয়ে থাকছে। কবিতাটির শেষ অংশের তুমি অবশ্যই কোনও নারী। দান্তের স্বর্গনিষিক্ত ভালোবাসা মনতালের কবিতায় পাতালচারী বান মাছের রূপ নিয়েছে।]
.
সালভাতোর কোয়াসিমোদো

[বিক্ষুব্ধ কোয়াসিমোদো চেয়েছিলেন মানুষের পুননির্মাণ। মানুষকে বদলে দিতে। সমালোচকরা ঈষৎ বাঁকা সুরে বলেছেন, কোয়াসিমোদো অতখানি বড় কাজের যোগ্য নন।
অর্থাৎ প্রশ্ন ওঠে, কবি কি শুধুই নতুন সৃষ্টি করে যাবেন? না, এই সৃষ্টি করা জগৎ ও সমাজ, পরিপার্শ্ব এর নানান বৈষম্য দূর করার জন্যও ব্যর্থ হবেন, তার মানে, সমসাময়িককালের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়বেন? কোয়াসিমমাদের জীবনে এই দুরকম চিন্তাধারার দুটি স্পষ্ট ভাগ দেখা যায়। প্রথম লেখা শুরু করেছিলেন আত্মমগ্ন কবি হিসেবে, হারমেটিক ধারার অন্যতম, যখন ধারণা ছিল কবিতাতেই কবিতার শেষ, সে সময়-নিরপেক্ষ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনী যখন ইতালির উত্তরাঞ্চল দখল করে নেয়, তখন নিজের গোপন কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে বিরক্ত এবং ক্রুদ্ধ কবি নেমে এলেন অনেকটা জনতার কাছাকাছি, কবিতা লিখে মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব বোধ করেছিলেন। কোয়াসিমমাদের এই সামান্য রূপান্তরে পুরনো অনুরাগীরা হতাশ হয়, আবার অন্য একদল নতুন কবির জন্ম হল বলে অভিনন্দন জানায়। ১৯৫৯-র নোবেল প্রাইজ তাঁকে ইতালির সবচেয়ে বিখ্যাত কবি হিসেবে পরিচয় জানায় পৃথিবীর কাছে।
কোয়াসিমোদোর জন্ম ১৯০১ সালে, সিসিলি দ্বীপের সিরাকিউসে। শৈশব সুখে কাটেনি, মায়ের প্রতি চিঠিতে তার চিহ্ন আছে। ধারাবাহিকভাবে লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি। যৌবনে সিভিল এনজিনিয়ার্স বিউবোর কর্মী হিসেবে সারা ইতালি ঘুরেছেন। এখন মিলান শহরের স্থায়ী নাগরিক। সমসাময়িক অন্যান্য বিখ্যাতদের মতো কোয়াসিমোদো ইংরাজি বা ফরাসি সাহিত্য থেকে প্রেরণা গ্রহণ করেননি। তাঁর যাবতীয় শিক্ষা স্বদেশের ঐতিহ্যে। প্রতিবেশী গ্রিসের কিছু প্রাচীন কবিতারও তিনি অনুবাদ করেছেন।]

প্রায় গান

সূর্যমুখী ঢলে পড়ে পশ্চিমে, দিন
নিজের ভগ্নপ্প চোখে অস্ত যায়,
গ্রীষ্মের বাতাস ভারী হয়ে আসে, নুইয়ে দেয়
গাছের পাতা, কারখানার ধোঁয়া ওঠে।
মেঘের শুকনো আনাগোনা, বিদ্যুতের সিরসিরানির সঙ্গে
অন্তরীক্ষের শেষ খেলা দূরে
সরে যায়। আবার বহু বছরের ভালোবাসা
খালের দুপাশে ভিড় করা গাছের মধ্যে এসে
আমরা একটু থমকে দাঁড়াই।
তবু আজ আমাদের দিন, তবু সেই
সূর্য তার ছুটি নিয়ে যায়
স্নেহময় রশ্মির গ্রন্থিগুলি গুটিয়ে।
আমার স্মৃতি নেই, আমি আর কিছু মনে করতে চাই না;
মৃত্যু থেকে জেগে ওঠে স্মৃতি,
যেমন জীবন অন্তহীন। প্রতিটি দিনই
আমাদের। একটি দিন এর মধ্যে থেমে থাকবে চিরকাল।
তখন তুমি আমার পাশে, হয়তো সেদিন বড় দেরি হয়ে যাবে।
এখানে খালের কিনারায় বসে, আমাদের পা
দুলছে শিশুদের মতো খেলাচ্ছলে,
এসসা আমরা জল দেখি, গাছের শাখাপ্রশাখায়
সবুজের গাঢ় হয়ে আসা দেখি।
নিঃশব্দে যে-লোকটা পিছন থেকে গুঁড়ি মেরে আসছে
ওর হাতে কোনও ছুরি লুকোনো নেই
ও তো শুধু একটা মাধবীলতা।


মায়ের কাছে চিঠি

…আমি উত্তরাঞ্চলে আছি, দুঃখ নেই। নিজের সঙ্গে
শান্তিতে নেই আমি। কিন্তু আমি কারুর কাছে
ক্ষমা প্রত্যাশা করি না, অনেকের কাছেই আমি
চোখের জলে ঋণী, যেমন মানুষের প্রতি মানুষ।
আমি জানি, তুমি ভালো নেই, তুমি বেঁচে আছ
যেমন সব কবিদের মায়েরা থাকে, দরিদ্র,
প্রবাসী ছেলের জন্য খাঁটি ভালোবাসা বুকে নিয়ে। আজ
আমি তোমাকে চিঠি লিখছি। —তুমি বলবে, তবু এতদিনে
ছেলেটা দুটো কথা লিখে জানাল, সেই ছেলেটা যে
একদিন রাত্তিরে পালিয়ে গিয়েছিল একটা ছোট সাইজের কোট পরে,
পকেটে কয়েক লাইন কবিতা। পয়সা ছিল না, এমন চঞ্চল
যে একদিন কেউ হয়তো ওকে মেরেই ফেলবে!
..মা, আমার মনে পড়ে…

[কোয়াসিমোদো-র অপেক্ষাকৃত সুবোধ্য কবিতা এখানে অনুদিত হল। নোবেল প্রাইজ পাবার পর তার কিছু কবিতা আমাদের দেশে অনুবাদ করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সুন্দর অনুবাদ করেছেন জগন্নাথ চক্রবর্তী ও সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত।
তার অধিকাংশ কবিতায় তুমি থাকে, সেই তুমির কোনও নির্দিষ্ট নাম নেই। কোনও নারী বা পুরুষ বা যুদ্ধে নিহত কোনও আত্মা বা কবিরই অন্য স্বরূপ, কখনও স্পষ্ট বোঝা যায় না। যখন কোনও নারী বলে মনেও হয়, তখনও কোনও নির্দিষ্ট নারী নয়, মনে হয় যেন সমগ্র মহিলা সমাজের প্রতিনিধি যেকোনও একজন।]
.
পিয়ের পাওলো পাসোলিনি

[ভিড়ের রেস্তোরাঁর মধ্যে হঠাৎ টেবিলে লাফ দিয়ে উঠে পাসোলিনি চিৎকার করে বললেন, অনর্থক মানুষ, তোমরা অনর্থক সময় নষ্ট করছ। শোনো আমার কবিতা, এই কবিতাই তোমাদের বেঁচে থাকতে শেখাবে!— পাসসালিনি এইরকম স্বভাবের কবি। ইতালির তরুণ কবিদের মধ্যে পাসসালিনি-ই সবচেয়ে প্রবল এবং দুর্দান্ত, এবং সবচেয়ে বিতর্কমূলক। এক দিকে তাঁর প্রবল জনপ্রিয়তা, অপর দিকে একদল তাঁকে কবি বলেই মানতে চান না। কিন্তু এ পর্যন্ত তার ছটি কবিতা সংগ্রহ বেরিয়েছে। এখন অবশ্য আর তিনি বয়সে ঠিক তরুণ নন।
পাসোলিনির জন্ম ১৯২২-এ। কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন, পরে বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দেন। তার ধারণা, লেখকদের শুধু লেখা ছাড়া অন্য কোনও জীবিকা থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু, বলাই বাহুল্য, পৃথিবীর যেকোনও দেশেই কোনও তরুণ লেখক, বিশেষত কবি, শুধুমাত্র সাহিত্য রচনা করেই গ্রাসাচ্ছাদন সংগ্রহ করতে পারেন না। ফলে পাসোলিনিকে ফিলমের স্ক্রিপ্ট লিখতে হয়, কখনও কখনও নিজে অভিনয়ও করেছেন। ইদানীং পাসোলিনি চলচ্চিত্র পরিচালনাতেই মুখ্যত আত্মনিয়োগ করেছেন। ইতালির আধুনিক চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে তিনি উল্লেখযোগ্য অন্যতম। তার তোলা যিশুর জীবনী একটি বিতর্কমূলক ছায়াছবি। রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীতে তিনি ভারতবর্ষে এসেছিলেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সারা পৃথিবীতে শিল্পে নিওরিয়েলিজম নামে যে ধারা এসেছে, ইতালিতে যা সবচেয়ে প্রবল, কবিতাতেও তার প্রভাব দেখা যায়। পাসোলিনির কবিতার বিষয় ইতালির সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা। বর্ণনার ভঙ্গি কখনও অতিবাস্তব, অনেকে তাঁর কবিতাকে নিওরিয়েলিস্টিক আখ্যা দিয়েছেন।]
.
আপেন্নিন

ক্যাসিনো থেকে সেই ছেলেটাকে তার বাপ মা
বিক্রি করে দিয়েছে আনিয়েনের গর্জমান সৈকতে এক
খুনির কাছে, একটি বেশ্যা ওকে মানুষ করে—
ঔপনিবেশিক রাত্রির মধ্যে যখন কিয়ামপিনোর চোখ
ধুয়ে যাওয়া তারায় অন্ধ, বোজানো চোখের পাতার নীচে
উকুনে হাসিতে ছেলেটা গুনগুন করে সম্রাটদের এরোপ্লেনের
শব্দের সঙ্গে গান গায়, আর পথে পথে
কামের প্রহরীদের পদশব্দ,
ময়লা প্রস্রাবখানার আশেপাশে অপেক্ষা করে
সানপাওলো থেকে সান গিয়োভান্নি পর্যন্ত
রোমের চরম উত্তপ্ত পাড়ায়— শুনতে পাওয়া যায়
রাত্রির অবসন্ন প্রহর বেজে উঠছে
উনিশ শো একান্ন-তে গির্জা থেকে গোয়ালঘর
পর্যন্ত নৈঃশব্দ্যেও ফাটল ধরে।
ইলারিয়ার বন্ধ চোখের পাতায় কাঁপে
ইতালির রাত্রির দূষিত আস্তরণ… অল্প
হাওয়ায় নরম, আলোয় শান্ত…
যুবকদের চিৎকার,
তপ্ত, কটু, ভয়ংকর, উষ্ণ কম্বলের
গন্ধ, এখন ভিজে… দক্ষিণ অঞ্চলের বুড়োদের
কণ্ঠে চালাকি… সমস্বর গান
সপ্তাহান্তের দুটি পুকুরে পুকুরে, গ্রামে।
পাপের প্রদেশ থেকে, শস্তা নোংরা শুঁড়িখানার
সাদা আলোর হৃদয় পর্যন্ত
শহরের উপকণ্ঠে
মাংস এবং দারিদ্র শান্ত সহাবস্থান পেয়েছে,

হাওয়ার শব্দ… তারপর। ইলেরিয়ার
ভারী চোখের পাতায় ঘুম ছাড়া
আর কিছুই নেই। এই মেয়েটির মৃত্যুর রূপ
দিয়েছে সকাল, পূর্বকল্পিত, মার্বেল পাথর
হয়ে যাবে। ইতালির আর কিছুই নেই অবশিষ্ট
শুধু তার মার্বেল মৃত্যু ছাড়া, তার ঊষর
বাধাপ্রাপ্ত যৌবন…

তার চোখের পাতার নীচে, ঘুমের মধ্যে
পৃথিবী সশরীরী, চাঁদের আলোর
রূপালী অন্ধকারে একটি কুমারী রথ
পাথরের ধস হয়ে নামছে আপেন্নিন থেকে
খাড়া পাহাড় বেয়ে সোজা নেমে যাচ্ছে উপকূলের
দিকে— যেখানে টিরোনিয়ান এবং আড্রিয়াটিকের
ফেনা মুক্তাখচিত।

ঝোপঝাড়ের মধ্যে একখণ্ড নগ্ন ঘাস জমিতে
একটি সবুজ বৃত্তে, সোরাকটের সবুজ উপত্যকার
চামড়া ও ধাতুর গোল আবরণে ঘুমিয়ে আছে
কালচে জ্যাবজেবে একপাল ভেড়া, আর রাখালের
সমস্ত প্রত্যঙ্গ জমাট বেঁধে আছে

চুন পাথরের ওপরে

[আপেন্নিন নামের একটি বিশাল কবিতার একটি অংশের মুক্ত অনুবাদ এখানে দেওয়া হল। আপেন্নিন সমগ্র ইতালিব্যাপী দীর্ঘ পর্বতমালার নাম। উত্তর দিকে এই পর্বতমালা আল্পসের সঙ্গে মিশেছে। আড্রিয়াটিক সমুদ্রের কাছে এর শিখরের উচ্চতা সাড়ে ন হাজার ফুট, সেইটাই সর্বোচ্চ। ভিসুভিয়াস সমেত আর কয়েকটি আগ্নেয়গিরি আছে এরই মধ্যে। রোম নগরীর চারপাশ ঘিরে আছে আপেনিন এই পার্বত্য অঞ্চলের ছোট ছোট গ্রামের উল্লেখ আছে এই কবিতায়।]
.
মাৰ্ঘেরিটা গুইদাচ্চি

[মেয়েদের চোখে দেখা এই পৃথিবী হয়তো সত্যিই অন্যরকম। কিন্তু সাহিত্যে মেয়েদের চোখে দেখা পৃথিবীর সেরকম কোনও উল্লেখযোগ্য ছবি পাওয়া যায়নি। বাংলায় আমরা যাকে বলি দৃষ্টিভঙ্গি— সেই দৃষ্টিভঙ্গিতেও মেয়েদের সঙ্গে পুরুষদের বহু ক্ষেত্রে ঢের তফাত দেখা যায়। কিন্তু পৃথিবীর মহিলা সাহিত্যিকদের মধ্যে তাদেরই আমরা খুব উল্লেখযোগ্য বলি, যাঁদের রচনা অতিমাত্রায় পুরুষালি। পুরুষদের সমকক্ষ হবার বদলে মেয়েদের আলাদা কোনও সাহিত্যরীতি নেই। মেয়েদের কৈশোর থেকে যৌবনে রূপান্তরের সংকটকাল, সন্তানের প্রতি স্নেহ, স্বামীর জন্য ত্যাগ স্বীকার, মুখবুজে সংসারের সমস্ত যাতনা সহ্য করা ইত্যাদি বিষয়গুলি পুরুষদের রচনাতেই মহভাবে ফুটেছে। কে জানে এগুলো সবই অতখানি সত্যি কিনা।
যদিও আমরা চোখেই দেখতে পাচ্ছি। যেমন, সন্তানের প্রতি জননীর স্নেহ, হাত দুখানাকে ডানার মতো করে ছেলে-মেয়েদের সব বিপদ থেকে মায়ের আগলে রাখার চেষ্টা, পৃথিবীতে প্রতিদিন চোখে দেখা যায়। কিন্তু চোখে দেখার বাইরেও আরও কিছু অন্ধকার পরিসরে যেতে ছাড়ে না সাহিত্য। জননীর কতখানি আত্মত্যাগ, কিছুই কি আত্মবিপর্যয় নেই? সন্তান যেমন নয়নের মণি, তেমনি সন্তানই জনক-জননীকে প্রতিদিন মৃত্যুর কথা স্মরণ করায়। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে ওঠা থেকেই বাপ-মা বুঝতে পারেন তাঁরা কতখানি বার্ধক্য ও মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে পুরুষের লেখা কবিতা আছে, কিন্তু পুরুষরা তো স্বার্থপর নামেই বিদিত। মাৰ্ঘেরিটা গুইদাচ্চির এ কবিতায় একই সঙ্গে সন্তানের প্রতি স্নেহ এবং নিজের স্বার্থপর ভয়ের কথা আছে।
এই কবিতাটি পুরো বুঝতে হলে জানা দরকার শ্রীমতী মাৰ্ঘেরিটা সুগৃহিণী এবং তিন সন্তানের জননী। তার তৃতীয় সন্তান, মেয়ের জন্মের পর এ কবিতা লেখা। তার এখন বয়েস ৪৫, শিক্ষয়িত্রী। জন্ম ফ্লোরেন্সে ১৯২১-এ, ইংরেজি সাহিত্যে বি এ পাশ করার পর। ঔপন্যাসিক লুসা প্রিমাকে বিয়ে করেছেন। সাম্প্রতিক ইতালির কবিদের মধ্যে তিনি বিশিষ্ট এবং এই হিসেবে তিনি নতুন ধরনের কবি যে তার রচনা স্পষ্ট ও নির্ভীক এবং একটি নারী হিসেবে তার চোখে দেখা জগৎই তিনি দেখাবার চেষ্টা করেন।]


অংশ কবিতা

বহুবার নভেম্বর ফিরে ফিরে আসে
আমার জীবনে, আজ যার শুরু হল
সে নয় জঘন্যতম; শান্ত একটি দিন
কিছুটা অস্বস্তিময়। আজ আমি ঝুঁকে আছি
একটি দোলনার কাছে, আমার কনিষ্ঠতম
মেয়েটি ঘুমোয়, তার গভীর রহস্যময় ঘুম, যেন আজও
অতিথি এখানে, এই পৃথিবীর নাগরিক নয়, এখনও অচেনা
আমার স্তনের মধ্যে দুধ ভরে ওঠার সুমিষ্ট ঘ্রাণ আমি
টের পাই, কী এক নরম অনুভব
স্নায়ুর প্রতিটি তন্ত্রে, শরীরের সীমানা ছাড়ায়।
আজ এই ক্লান্ত রক্ত গোপন ঝরনার দিকে ফিরে
পুনরায় পুণ্য হল, রক্তের অপাপ রূপান্তর
শিশুর অপাপ ওষ্ঠে তৃষ্ণা হরণের যোগ্য হয়।
আমার শরীর এক অলৌকিক যন্ত্র, এ-ই শুধু
জীবনের জন্ম দিতে পারে। স্তন দুটি
যেন রূপকথার পাহাড়, এই প্রাচুর্যের নদী
বহে যায় স্বর্ণ যুগে, আর এই অবোধ শিশুর
স্মৃতির গভীরতম নদীগর্ভ সৃষ্টি হয়ে যায়, এ স্মৃতির কাছে জানি
সে আবার ফিরে আসবে একদিন স্বপ্নে কিংবা গাঢ় বেদনায়…
ওর জন্য এই ছবি স্পষ্ট, আর আমি,
আমি উপলক্ষ আজ, সময় নিষ্ঠুর ক্রুর হাতে
আমাকে বিবর্ণ করা আরম্ভ করেছে। হয়তো এই
শেষবার, আমি মাতা, এক শিশুর ধরিত্রী, কেননা আমার
দারুণ বৎসরগুলি শুষ্ক করে টেনে নিচ্ছে রস
শরীরের বিশেষ প্রত্যঙ্গ থেকে। জানি আজও আমি
একটি জীবন্ত বৃক্ষ, হাওয়ায় ঝিলমিল করে পাতা
শরীরে এখনও আছে জন্মবীজ, কিন্তু জানি ঊষর সময়
অদূরে দাঁড়িয়ে আছে, গ্রাস করে নেবেই আমাকে।
কী চমৎকার এই ক্ষণিক বিরতি, আমি আজ
নিজেই নিজের কাছে হেমন্তের দিন;
সামান্য আশঙ্কা আর ভয় তাকে ঢেকে আছে।
দীর্ঘ রাজপথ হয়ে আমার অতীত
পিছনে বিস্তীর্ণ, শুধু ভবিষ্যৎ চোখ তুলে এইটুকু জানি
আমার অতীত যত দীর্ঘ ছিল, ভবিষ্যৎ তার
কিছু ছোট হবে।

[সন্তদের দিন নামের একটি দীর্ঘ কবিতার অংশ এখানে অনুদিত হল। যৌবন ও বার্ধক্যের মধ্যবর্তী সাময়িক বিরতিকে তিনি শরৎকাল বলেছেন, যেহেতু ওর পরেই শীত। কিন্তু আমি অটামের অনুবাদ হেমন্ত করেছি, এইরকম অর্থে হেমন্তের উল্লেখ জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।]