ফরাসি কবিতা: সুররিয়ালিজমের উন্মেষ

ফরাসি কবিতা: সুররিয়ালিজমের উন্মেষ

ত্রিস্তান জারা নামে একজন তরুণ রুমানিয়ান, উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিলেন সুইটসারল্যান্ডে। জুরিখের ‘ক্যাবারে ভলতেয়ার’ নামে এক রেস্তোরাঁয় ত্ৰিস্তান নিজের বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে সাহিত্য-আন্দোলনের নামে প্রচুর হই-হুল্লোড় শুরু করে দিলেন। তখন প্রথম মহাযুদ্ধ সদ্য শেষ হয়েছে। মানুষের বিশ্বাস, নীতি, আশা, মমতাবোধ বিপন্ন ধ্বংসের কাছে। বস্তুত, প্রথম মহাযুদ্ধের আঘাত পৃথিবীর মানুষের কাছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের চেয়েও অনেক বেশি প্রচণ্ডভাবে লেগেছিল— কারণ, সেই প্রথম সভ্য পৃথিবীতে ব্যাপক মহাযুদ্ধ—তাও দীর্ঘদিন শান্তির পর, অকস্মাৎ। যুদ্ধের নিদারুণ নিষ্ঠুরতায় বহু, সাধারণ মানুষ এমনিতেই পাগল হয়েছিলসুতরাং কবি-শিল্পীদের মধ্যে খানিকটা পাগলামি দেখা দেবে— সেটা খুব অস্বাভাবিক নয়। ত্ৰিস্তান জারা তার পাগলামির আন্দোলনের নাম দিয়েছিলেন ডাডা (পরে ডাডাইজম নামে পরিচিত)— কথাটা ডিকশনারি থেকে হঠাৎ তুলে নেওয়া, চলতি অর্থ খেয়াল-খুশিতে যা ইচ্ছা করা, অর্থাৎ কথাটার কোনও মানে নেই সেইটাই ওঁরা চেয়েছিলেন, ত্রিস্তান চেয়েছিলেন তার আন্দোলনের কোনও উদ্দেশ্য থাকবে না, কোনও অর্থ না, কোনও কারণ না— সম্পূর্ণ নৈরাজ্য।
কিন্তু ত্ৰিস্তান ভেবেছিলেন, তার আন্দোলন একটা বিশাল বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা। খুব লম্বা লম্বা চিঠি লেখা তার স্বভাব ছিল, এস্তার চিঠি লিখতে লাগলেন জার্মানি, ফ্রান্স, আমেরিকার তরুণ লেখক-শিল্পীদের কাছে তাঁর বিপ্লবে যোগদান করার জন্য। শেষ পর্যন্ত জুরিখ শহর তার কাজের তুলনায় খুব ছোট জায়গা মনে হওয়ায়, সদলবলে চলে এলেন সভ্যতার মুকুটমণি প্যারিসে।
এই সময় প্যারিসে একজন ডাক্তারি ছাত্র, আঁদ্রে ব্রেতোঁ তার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে— লুই আরাগ, পিলিপ সুপো ইত্যাদি— একটি চটি পত্রিকা বার করতেন, নাম সাহিত্য। এই তরুণ দল ছিলেন কিছুটা বিক্ষুব্ধ, প্রতিষ্ঠিত লেখকদের প্রতি আস্থাহীন, অস্থির, ক্রুদ্ধ। পল ভালেরির মতো মহৎ কবিও তখন অ্যাকাডেমিতে সদস্যপদ পাবার। জন্য তদারকিতে ব্যস্ত, সুতরাং তরুণরা ওঁর প্রতি খানিকটা নিরাশ, পল ক্লোদেলের মতো বড় কবিও তখন সদ্য ক্যাথিলিক হয়ে চরম গোঁড়া হয়ে উঠেছে আঁদ্রে জিদ ক্লোদেল সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, উনি আগে ছিলেন সূক্ষ্ম পেরেক, এখন হয়েছে হাতুড়ি!) এবং আঁদ্রে জিদ–যাঁর রচনায় তরুণরা অনেক সময় আত্মপ্রতিকৃতি দেখতে পেয়েছে—তিনিও কিছুটা ঈষদুষ্ণ। একমাত্র যে বিশাল, দুর্দান্ত, বলগা-হীন, কুসুম-কোমল কবিকে (তখন প্রায় অপরিচিত) তরুণরা মনপ্রাণ সঁপে ছিল, সেই গিম আপোলিনেয়ার যুদ্ধ থেকে মাথায় গোলার আঘাত নিয়ে ফিরে, যুদ্ধ বন্ধ হবার ঠিক আগের দিন হাসপাতালে মারা গেলেন। আর, মার্শেল প্ৰস্ত যদিও সাহিত্য কাগজে লিখলেন না কিন্তু বারো পাতার চিঠি লিখে সমর্থন জানালেন।
সুতরাং ত্ৰিস্তান জারার হইহই দলের সঙ্গে প্যারিসের যুবারা একসঙ্গে মিলে গেলেন। শুরু হল ডাডাইজমের নামে অনেক উদ্ভট কাণ্ড, রাস্তাঘাটে গোলমাল, থিয়েটারে গিয়ে চেঁচামেচি, পথের উপর বসে পড়ে কবিতা লেখা—খবরের কাগজের দৃষ্টি আকর্ষণ করার যাবতীয় চেষ্টা। ত্ৰিস্তান জারার বিখ্যাত উক্তি, সব রকম নিয়মের অভাবও একটা নিয়ম এবং সেটাই শ্রেষ্ঠ নিয়ম— তরুণদের খুব মনে লেগেছিল।
কিন্তু ফরাসি দেশে রাজনৈতিক আন্দোলনেও বহুরকম পাগলামি প্রশ্রয় পেতে পারে কিন্তু সাহিত্য-আন্দোলনে সাহিত্য ছাড়া অন্য উপসর্গ বেশিদিন মনোযোগ পায় না। ত্রিস্তানের নৈরাজ্য অবিলম্বেই একঘেয়ে হয়ে গেল। তখন আঁদ্রে ব্রেতোঁ তাঁর দলবল নিয়ে সরে দাঁড়ালেন, শুরু করলেন নতুন শিল্প-আন্দোলন, ১৯২৪-এ প্রকাশিত হল প্রথম সুররিয়ালিজমের ইস্তাহার। এবং সুররিয়ালিজম এশতাব্দীতে এপর্যন্ত সবচেয়ে মূল্যবান শিল্পদর্শন।
সুররিয়ালিজম শব্দটা ব্রেতোঁ পেয়েছিলেন আপোলিনেয়ারের রচনায় কিন্তু এর বীজ ছিল আরও অনেক আগে হ্রাধোর লেখায় বা আরও আগে নার্ভাল, বালজাকের মধ্যে। পৃথিবীর সেই চরম বিস্ময়কর কবি, দুর্দান্ত বখাটে বালক হ্র্যাম্বো—আজ সুররিয়ালিজমের প্রধান পুরুষ, সিমবলিস্টদের প্রধান হিসেবে খ্যাত, এমনকী এজিসটেনশিয়ালিজমের প্রবক্তা হিসেবেও গণ্য, আবার ক্লোদেল ওঁর রচনা পড়েই ক্যাথলিক হবার প্রেরণা পেয়েছেন। (Rimbaud বাংলায় লেখা হয় র‍্যাঁবো। কিন্তু দেখেছি ফরাসিরা ও উচ্চারণ শুনে চিনতেই পারে না। ওরা যেভাবে উচ্চারণ করে সেটা বাংলায় লিখলে অনেকটা শোনায় হ্রাম্বাআমি বিদেশি উচ্চারণের ব্যাপারে খুঁতখুঁতে নই, জ্ঞানও খুবই কম, নিতান্ত নতুনত্বের লোভেই র‍্যাঁবোর বদলে হ্র্যাম্বো। লিখতে মাঝে মাঝে লোভ হয়।)
সুররিয়ালিজমের মূল বক্তব্য, কবিকে হতে হবে দ্রষ্টা, সে শুধু ভবিষ্যৎ দেখবে না–দেখবে নিজের অন্তঃকরণ, ছায়া, মগ্নচৈতন্য- হৃদয় খুঁড়ে জাগাবে বেদনা, স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, ললাটলিপির মতো যুক্তিহীনতা। এই সময় সিগমুণ্ড ফ্রয়েড এনে দিয়েছিলেন অবচেতনার ধারণা, ব্রেতোঁ নিজেও ছিলেন মনোবিজ্ঞানী— সেই থেকে আসে লুপ্ত স্মৃতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা, মাদক সেবনের পর পারম্পর্যহীন প্রতিফলনের লিখিত রূপ—অটোমেটিক রাইটিং বা কলম হাতে নিয়ে বসে থাকার সময় যাবতীয় বিদ্যুৎস্মৃতি ধরে রাখা। সব প্রয়াস সফল হয় না, কিন্তু বহু দুর্লভ কবিতা বা ছবি এর থেকে বেরিয়ে এসেছে। অবচেতনের উদ্ধার— এ ছাড়া স্বর্গ ও পৃথিবীকে মেলাবার আর কোনও উপায় নেই সাহিত্যে।
আমাদের ভারতবর্ষে সুররিয়ালিজমের প্রভাব যথাকালে আসেনি। অথচ এ তো ভারতবর্ষেরই। সুররিয়ালিজমের মূল খুঁজতে অনেক চলে গেছেন প্রাচীন গ্রিসে যেখানে ডেফির দেবতা সক্রেটিসকে বলেছিলেন, নিজেকে জানো। কিন্তু তারও বহু আগে আমরা শুনেছিলাম আত্মানং বিদ্ধি। ধ্যানের সাহায্যে অপরলোকে উত্থান, শরীর ছাড়িয়ে গিয়ে দৈববাণী শ্রবণ, বেদ যে কারণে অপৌরুষেয়, অ্যালকেমির সমান্তরাল তান্ত্রিক উপাসনা ইত্যাদি। কিন্তু সাহিত্যে আমরা এগুলো ভুলে গেছি অনেকদিন, সম্ভবত ইংরেজদের প্রভাবে। ইয়োরাপে যখন আত্মার পুনরাবিষ্কার হয়, আমরা তখনও তাকে গ্রহণ করতে পারিনি।
সুররিয়ালিজমের প্রভাব পড়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, ক্রমে বিভিন্ন মহাদেশে। দলগত আন্দোলন হিসেবে সুররিয়ালিজম বেশিদিন টেঁকেনি। ক্রমে এসে যোগ দিয়েছিলেন পল এলুয়ার, জাক প্রেভের, আন্টোনিন আর্তো, হ্রেনো শার প্রমুখ। শিল্পীদের মধ্যে মিরহো, মাক্স আনস্ট, চিরিকো, পিকাবিয়া, টালি, ম্যান রে, সালভাদর দালি প্রমুখ। প্রথম দল ভাঙতে শুরু করে, ব্রেতোঁ যখন রাশিয়ার দৃষ্টান্তে কমিউনিজম সমর্থন করলেন। পরে অবশ্য, ব্রেতের আশাভঙ্গ হয়েছিল এবং কমিউনিজমের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু তখন ভাঙা দল আর জোড়া লাগেনি। এ ছাড়া, কবিদের মধ্যে যা খুব স্বাভাবিক ছিল ক্ষমতার লড়াই ও ঈর্ষা— আঁরি মিশোর মতো বড় কবি যেমন ব্রেতোঁর নেতৃত্বে কখনও সুররিয়ালিস্ট আন্দোলনে যোগ দিতে চাননি, বরং প্রকাশ্যে নিন্দে করেছেন, কিন্তু উত্তরকাল জানে মিশো মনেপ্রাণে সুররিয়ালিস্ট। এ আন্দোলনে চরম আঘাত হানেন ১৯৪০-এ জাঁ পল সার্ত, তার অস্তিত্ববাদ দিয়ে নতুন করে জেগে ওঠার জন্য আমেরিকার নির্বাসন ছেড়ে আঁদ্রে ব্রেতোঁ আবার প্যারিসে এসে তার সিংহের কেশর নেড়ে ভাঙা দল জোড়ার চেষ্টা করলেন কিন্তু, ততদিনে দল ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে।
কিন্তু দল হিসেবে অস্তিত্ব না থাকলেও আদর্শ হিসেবে প্রবলভাবে আছে। সারা পৃথিবীর সচেতন লেখকদের মধ্যে এমন বোধহয় একজনও নেই— যিনি সুররিয়ালিজমকে পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারবেন। যোগাযোগহীন হলেও বাংলাদেশের জীবনানন্দ দাশ এই জাতের কবি। এরপর আর কোনও নতুন সাহিত্য-দর্শন পৃথিবীতে আসেনি। এমনকী ইংল্যান্ডের অ্যাংরি ইয়ংমেন এবং আমেরিকার বিট জেনারেশন— সেই সুররিয়ালিস্টদেরই বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গের পুনঃপ্রকাশ। সুররিয়ালিস্টদের মধ্যে কে কত বড় লেখক ছিলেন এ নিয়ে তর্ক উঠতে পারে কিন্তু এদের আদর্শ প্রভাবিত করেছে পৃথিবীর মহত্তম লেখকদের।
সুররিয়ালিস্টদের আর একটি বড় কীর্তি, গদ্যের কবল থেকে কবিতার উদ্ধার। গত শতাব্দী থেকে শুরু হয় গদ্যের প্রবল প্রচার, উপন্যাসের রবরবা— এবং উপন্যাসের প্রধান অবলম্বন হল যুক্তি এবং বাস্তবতাবোধ, প্রতিটি পরিচ্ছেদের সামঞ্জস্য, যার চরম প্রকাশ ডিটেকটিভ নভেলে— যেখানে প্রতিটি কথা এবং প্রত্যেক মানুষের চলাফেরার মধ্যেই একটা ছদ্ম কারণ দেখানোর চেষ্টা। এর সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলেই কবিতার সর্বনাশ। ব্রেতোঁ এইজন্য উপন্যাসকে বলতেন দাবা খেলা। কবিতার মুক্তি অলৌকিকে, রহস্যে, স্বপ্নের মতো আপাত যুক্তিহীনতায়। সুররিয়ালিস্টরা এই জন্য আক্রমণ করেছিলেন ধর্মকে (খ্রিস্টধর্ম)– নিৎসের ঈশ্বরের মৃত্যুও ঠাট্টা করে উড়িয়ে দিলেন— কারণ ঈশ্বরের মৃত্যু আনতে হলে ঈশ্বরের অস্তিত্বও মানতে হয়, নচেৎ যা ছিলই না তার মৃত্যু হয় কী করে। খ্রিস্টধর্মে অলৌকিক বা রহস্যের স্থান নেই, যেমন অডেন হোমেজ টু ক্লিয়ো কবিতায় লিখেছেন:
A Christian ought to write in prose
For poetry is Magic…..
সুররিয়ালিস্টের দল প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠা করলেন রহস্যের, স্বপ্নের, আলোছায়ার (যার প্রভাবে পাশ্চাত্যের বহু লেখক ঝুঁকেছেন হিন্দু ও বৌদ্ধ দর্শনে) এবং ফু দিয়ে উড়িয়ে দিলেন সাহিত্যের তথাকথিত বাস্তবকে— এবং শুধু কবিতায় নয়— এই রহস্যময়তা ছড়িয়ে গেল চিত্রশিল্পে, ফিল্মে, নাটকে— সুররিয়ালিস্টদের অন্যতম প্রধান আন্টোনিন আর্তো আজ পৃথিবীর আধুনিক নাট্যকারদের ব্রেখট, বেকেট আয়োনেস্কো, জেনে— এঁদের পূর্বপুরুষ হিসেবে স্বীকৃত। এই আক্রমণের হাতে অসহায় হয়ে গিয়ে ফরাসি গদ্যও অনেক যুক্তি ত্যাগ করে আশ্রয় নিল নিউ নভেল আন্দোলনে, এবং সারা পৃথিবীর আধুনিক উপন্যাসই আজকাল আর তথাকথিত বাস্তব বা যুক্তিপ্রধান নয়।
সুররিয়ালিজম আন্দোলন যে আমাদের দেশে যথাসময়ে আসেনি তাতে যে আমাদের সাহিত্যের কোনও ক্ষতি হয়েছে তা নয়। প্রত্যেক সাহিত্যেরই একটা নিজস্ব গতি আছে, বাংলা সাহিত্য সেই নিজস্ব মহিমায় অগ্রসর হয়েছে, এবং আন্দোলন না হয়েও ব্যক্তির আবিষ্কার চলেছে বাংলা গদ্য ও কবিতায়। সেদিক থেকে কলকাতা-প্যারিস-নিউ ইয়র্ক এক, দান্তে যেমন বলেছিলেন, পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুই অচেনা কবি মাঝে মাঝে মুখোমুখি কথা বলে।
.
গিয়ম আপোলিনেয়ার

[মা পোলিশ, বাবা ইতালিয়ান, উভয়ের বিবাহ হয়নি, আপোলিনেয়ার বাবাকে ভালো চিনতেন না। তিনি নিজের নাম নিজে ঠিক করেছিলেন। জন্ম ১৮৮০, শরীরে এক বিন্দু ফরাসি রক্ত নেই, উচ্চশিক্ষা পাননি, কিন্তু আপোলিনেয়ার খাঁটি ফরাসি কবিদের মধ্যে সর্বোচ্চ শ্রেণীতে। জীবনটা অনেক ব্যর্থ-প্রেমের মালা, বিশাল চেহারা ছিল, আমুদে হই-হুল্লোড়ে, নিজের উৎসাহে প্রথম মহাযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, মাথায় গোলার ঘা খেয়ে ফিরে আসেন, সে আঘাত সারেনি, বিয়ে করলেন তার ছ মাস পরেই যুদ্ধ থামার আগের দিন মৃত্যু। ওঁর শব বহে নিয়ে গিয়েছিলেন পিকাসো এবং অন্যান্য শিল্পী বন্ধুরা। নিজে ছিলেন বলিষ্ঠ শিল্প সমালোচক, কবি হিসেবে জীবিতকালে প্রায় অপরিচিত, এখন খ্যাতির শীর্ষে।]

ভালোবাসায় নিবেদিত জীবন

হায় রে আমার পরিত্যক্ত যৌবন
শুকনো ফুলের মালা
এখন অন্য ঋতুর আসার পালা
সন্দেহ আর জ্বালা

নানা ক্যানভাসে এ ছবি সাজানো
নকল রক্তধারা
একটি বৃক্ষে ফুলের মতন ফুটে আছে বহু তারা
নীচে কেউ নেই এক বিদূষক ছাড়া

শীতল রশ্মি পারিপার্শ্বিকে খেলে ঝরে যায়
তোমার চিবুকে ভাসে
গুলির শব্দ চিৎকার উঠে আসে
আঁধারে একটি আঁকা-মুখ একা হাসে।

এ ছবির ফ্রেমে বাতাসের কাচ ভাঙা
অচেনা হাওয়ার সুর
ভাবনা এবং ধ্বনির মধ্যে করে এসে ঘুরঘুর
স্মৃতি ও ভবিষ্যতের ভিতরে ঘুরে যায় বহু দূর

হায় রে আমার পরিত্যক্ত যৌবন
শুকনো ফুলের মালা
এখন অন্য ঋতুর আসার পালা
পরিতাপ আর যুক্তির বহু জ্বালা
.

বন্ধন

চোখের জলে তৈরি করা রজ্জু
সারা ইওরোপ জুড়ে ঘন্টা বাজে
শতাব্দীরা ফাঁসিতে ঝুলছে

আমরা মাত্র দু’জন কি তিনজন মানুষ
সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত
এসো আমরা হাত ধরে থাকি

ভয়ংকর বৃষ্টি চিরে যায় ধোঁয়া
দড়ি
পাকানো দড়ি
সমুদ্রের নীচে টেলিগ্রাফের তার
ব্যাবেলের স্তম্ভগুলি বদলে হয় সেতু

মাকড়সা–মোহান্ত
এক সূত্রে সমস্ত প্রেমিকরা বাঁধা
আরও সব সূক্ষ্ম বন্ধন
আলোর সাদা রেখা
সুতো ও সমতা

হে অনুভব হে প্রিয় অনুভব
স্মৃতির শত্রু
বাসনার শত্রু
অনুতাপের শত্রু
অশ্রুর শত্রু
আমার সমস্ত প্রিয় জিনিসের শত্রুরা
আমি শুধু তোমাদেরই গৌরব দিতে লিখে যাই

[আপোলিনেয়ার কবিতায় সাধারণত কমা, ফুলস্টপ ব্যবহার করতেন না। প্রথম কবিতার মূল নাম লাতিনে, Vitam Impendere Amori, তার দ্বিতীয় গান, অনুদিত হল, পরপর লাইনে মিল ছিল, অনুবাদের সময় আমার হাতে অন্যরকম মিল এসে গেছে। এ কবিতা লেখার সময় কবির বয়স সবে তিরিশ পেরিয়েছে, মারি লরাঁসাঁ নামে শিল্পীর সঙ্গে ব্যর্থ প্রেমের পর, সেইজন্যই এ কবিতায় ওইরকম ছবির উল্লেখ। আপোলিনেয়ারও আলফ্রেড দে মুসের মতো এক নারী থেকে অন্য নারীতে ভালোবাসার পর্যটনে বিশ্বাস করতেন। দ্বিতীয় কবিতার নাম Liens, অমিল মুক্ত-ছন্দে লেখা, শেষ স্তবকের প্রথম লাইনটি আমি অনুবাদে ইচ্ছে করেই একেবারে স্তবকের শেষে বসিয়েছি।]
.
আন্টোনিন আর্তো

[আর্তোর কবিতা আজকাল অনেক সংকলনে থাকে না, কারণ আর্তো তার প্রতিভা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বহু ধারায়, কবিতা, নাটক, নাটকে অভিনয়, পরিচালনা, ফিল্ম, চিত্রনাট্য লেখা, সমালোচনা; বিশেষত অভিনয়। এ ছাড়া জীবনের অনেকগুলি মূল্যবান বছর কেটেছে পাগলা গারদে। কিন্তু আর্তোর প্রভাব এখন পৃথিবীর অনেক কবির রচনায়, বিশেষত আমেরিকায় খুব প্রবল। এ ছাড়া আধুনিক নাটকে তার চিন্তা বিশেষ সম্মানিত।
জন্ম ১৮৯৬, ভালো ছাত্র ছিলেন, কবিতা লেখা শুরু ১৪ বছর বয়সে, এর চার বছর পরেই মেলানকলিয়া রোগ, দু বছর কাটে মেন্টাল হোমে, সেই থেকেই ধারাবাহিক অসুস্থতার শুরু।
সুররিয়ালিস্ট দলের এক সময় তিনি ছিলেন সবচেয়ে জীবন্ত, দুর্দান্ত, তীব্র বেপরোয়া সদস্য। এক সংখ্যা সুররিয়ালিজম বিপ্লবের তিনিই সম্পাদক ছিলেন, কিন্তু শীঘ্রই বিচ্ছেদ হয়ে যায়, যখন ওঁরা সাম্যবাদ সমর্থন করেন। আর্তো মনে করনে, এই নোংরা বাস্তব পৃথিবী নিয়ে মাথা ঘামানোই অশুচি, রাজনৈতিক ক্ষমতা বুর্জোয়া কিংবা সর্বহারাদের হাতে থাকল—এতে তার কিছু যায় আসে না। এই বিচ্ছেদ এত উগ্র যে, পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটলে দেখা যায়, আঁদ্রে ব্রেতোঁর দল ইস্তাহার ছাপিয়ে একান্তে ওঁর নাম কেটে দেন, এবং আর্তো ওঁদের বললেন ভণ্ড ও জোচ্চোর, তার ব্যক্তিগত সুররিয়ালিজমের ধারণাই সৎ এবং খাঁটি, নতুন ম্যাজিক।
বহু নাটকে অভিনয় করেছেন, নিজের শরীরে বহু মাদক পরীক্ষা করেছেন, সব সময় তার মনে হত নিজের ভাবনার উপযোগী শব্দ পাচ্ছেন না, কে যেন তার শব্দগুলি চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে, এই থেকে মাথার যন্ত্রণা শুরু হত। কারুর সঙ্গে ঠিক মানিয়ে চলতে পারতেন না, নিজের মতামত এমন দৃঢ়। বিষম আকর্ষণ ছিল প্রাচ্য দর্শনে। শেষবার শুভানুধ্যায়ী এবং বন্ধুবান্ধবরা প্রায় জোর করেই পাগলা গারদে ভরে দেন, খুব আপত্তি ছিল, আর্তো ভেবেছিলেন এসব ষড়যন্ত্র, সেখান থেকে পেনসিলে রক্ত ঝরানো চিঠি লিখেছেন, যার প্রতিটি অনুবাদযোগ্য। সেখান থেকে ছাড়া পাবার দুবছর পর ১৯৪৮-এ দুঃখিত মৃত্যু। Antonin Artaud-এ প্রথম নামের উচ্চারণ আমি শ্রুতিনির্ভর করে লিখেছি। এ নাম সম্ভবত ফরাসিদের হয় না, গ্রিক; কারণ আতোর বাবা ফরাসি হলেও মা গ্রিক বংশের রমণী।]

একটি কবিতা

আমার সঙ্গে আছেন ঈশ্বর-কুকুর, আর তাঁর
ত্রিশূলের মতো জিভ বিদ্ধ করে আছে
যা তাকে সব সময় চুলকুনি দিয়েছে
পৃথিবীর দুই ভাঁজ গম্বুজের আস্তর।

এবং এখানে এক জলের ত্রিভুজ
ছারপোকার গতি নিয়ে হাঁটে
কিন্তু নীচে, ছারপোকাও বদলে যায় জ্বলন্ত কয়লায়
আর জল ছুরির মতন বিদ্ধ করে।

কুৎসিত বিশ্বের দুই স্তনের গভীরে
ঈশ্বর-কুক্কুরী লুকিয়েছে
পৃথিবীর বুক আর বরফের জল
পচন ধরায় সেই শূন্যগর্ভ জিভে।

আর এক কুমারীর এক হাতে হাতুড়ি
আসছেন পৃথিবীর গুহাগুলি ধ্বংস করে দিতে
সেখানে মাথার খুলি তারকা-কুকুরের
বোধ করে বীভৎস সমতার জেগে ওঠা।

[ইচ্ছে করেই ছন্দ-মিল দিয়ে সুখপাঠ্য করা হল না অনুবাদটি। কারণ আপাত-অর্থহীনতা ও রুক্ষ কর্কশতা কবিতাটির সৌন্দর্য। যদিও মূল কবিতায় মিল আছে। দ্বিতীয় লাইনে বর্শা জাতীয় অস্ত্র ছিল, কিন্তু আমি পৃথিবী বিদ্ধ করার ইমেজের জন্য ত্রিশূল ব্যবহার করেছি। ঈশ্বর কুকুরঅর্থে হয়তো ইজিপসীয় দেবতা আনুবিশ, সমাধিভবনের রক্ষক, তাঁর জিভ–চিন্তার গমনপথ, ত্রিভুজ সংসার, শরীর ও আত্মা, ছারপোকার মতো রক্তশোষক—যে শুধু একরকম সৌন্দর্য দেখাতে পারে। ছুরি জিভ ইত্যাদি পুরুষত্ব-প্রতীক শব্দের সঙ্গে দ্বন্দ্ব লাগাবার জন্য কয়েকটি নারীত্ব-প্রতীক শব্দ আছে। পুরো কবিতাটিই এক হিসেবে চিন্তা ও লিখিত শব্দের দ্বন্দ্বের কথা। কবি আর্তো অর্ধেক ঈশ্বর ও অর্ধেক জানোয়ার— এই পৃথিবীর ধ্বংসস্তুপে একা বসে দেখছেন স্থূল, অকিঞ্চিৎকর বাস্তবের জেগে ওঠা।]
.
পল ভালেরি

[যদিও আপোলিনেয়ার দিয়ে এই পর্যায়ের অনুবাদ শুরু কিন্তু ক্লোদেল ও ভালেরিকে অন্তর্ভুক্ত না করলে ফরাসি কবিতার কোনও আলোচনাই হয় না। ভালেরি এই শতাব্দীর গভীরতম কবি। তার নিজের নির্বাচিত কবিতাগুচ্ছ যদিও একটি ছোট সংকলনে এঁটে যায়, কিন্তু পৃথিবীর কবিতায় তার স্থান চিরকালের। জন্ম ১৮৭১এ, মুগ্ধ হয়েছিলেন এডগার এলান পোর কবিতায় (তার নিজের রচনা যদিও সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের)। মালার্মের বাড়ি সন্ধেবেলার সাহিত্য-আড্ডায় যেতেন যুবক ভালেরি, তারপর কী কারণে যেন বহুদিন কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন, ফিরে এলেন বহু বছর পর, এবং তখন থেকে প্রতিটি কবিতা অসাধারণ। কবিতার ইতিহাসে এমন ত্যাগ করে আবার বহু পরে সার্থকতর হয়ে ফিরে আসার উদাহরণ আর দ্বিতীয় নেই। অঙ্ক ও বিজ্ঞানচর্চায় ছিল তার আত্মার আনন্দ। ছিলেন সমালোচক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষক আকাডেমির সদস্য, প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা তিনিই করেছিলেন। মৃত্যু ১৯৪৫।
ভালেরির নাম যতটা পরিচিত, তাঁর কবিতা তত পঠিত নয় ফরাসি না-জানা মানুষের। অনুবাদের সম্পূর্ণ বাইরে তার কবিতা। ইংরেজিতেও সার্থক অনুবাদ নেই। বাংলাতেও অনুবাদ খুব কম। সমুদ্রের পাশে কবর নামে তার অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ও কঠিন কবিতা, যেটির অর্থান্তর নিয়ে সময় কাটানো বহু গবেষক ও বিশেষ পাঠকদের ব্যসন, একটি অতি-ব্যক্তিগত কবিতা, সেটি অত্যন্ত নিষ্ঠা ও পরিশ্রমে অনুবাদ করেছেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ভালেরি বিশ্বাস করতেন, কবিতা লেখা কোনও সৃষ্টি বা প্রেরণার ব্যাপার নয়, অঙ্কের মতো নির্মাণ ও নির্বাচন। বলা বাহুল্য, তার কবিতা বহু জায়গায় তার এই মতের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, এসে গেছে কবিত্বের আবেগ ও মর্মস্পর্শিতা। আমরা এখানে একটি কবিতার অনুবাদ করছি শুধু এইটুকুই দেখাবার জন্য যে, ভালেরির কবিতার কীভাবে তন্নতন্ন অর্থ করতে চান সমালোচকেরা। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, ভালেরির শ্রেষ্ঠ কবিতা, লা যন্ পার্ক অর্থাৎ তরুণী ভাগ্য, ৫১২ লাইনের একটি বিস্ময়কর রচনা, যেটি নিঃসন্দেহে এ শতাব্দীতে ফরাসি ভাষার সবচেয়ে দুর্বোধ্য এবং সফলতম কবিতা, এ পর্যন্ত বাংলায় পূর্ণ অনূদিত হয়নি। অবশ্যই কারুর এ চেষ্টা করা উচিত। মূলত সংগীত প্রধান বাংলা কবিতায় ক্রমশই অতি সারল্যের যে প্রবণতা এখন দেখা যায়, যার ফলে অধিকাংশ কবিতাই যে অর্থহীন আবেগ ফলাফল হিসেবে প্রতীয়মান হয়, এর পরিপূরক হিসেবে কিছু দৃঢ়বদ্ধ, কঠিন, চেতনাপ্রধান কবিতার আদর্শও উপস্থিত থাকা উচিত, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যার শেষ চেষ্টা করেছেন। ভালেরির পাশে আদর্শ বা প্রতিপক্ষ হিসেবে ছিলেন বলেই আপোলিনেয়ারের সংগীতময় কবিতা অত সার্থক হতে পেরেছে। আমাদের বাংলা কবিতার আদর্শ, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে, সংগীতময়তা, ফলে অতি সারল্য ক্রমশ আসা স্বাভাবিক।]

নিদ্রিতা

কী গোপনতার হৃদয়ে পোড়ায় আমার তরুণী সখা
ফুলের গন্ধ নেয় কি আত্মা মধুর মুখোশ পরে?
কোন নিষ্ফল পুষ্টিতে তার অশিল্প উষ্ণতা
ঘুমন্ত এই রমণীর দ্যুতি আপনি সৃষ্টি করে?

নিশ্বাস, চুপ, স্বপ্ন এবং অভেদ্য নীরবতা
হে শান্তি, তুমি অশ্রুর চেয়ে প্রবল প্রবল, তুমিই জয়ী
যখন বিশাল ঢেউ আর সেই ঘুমের গভীর পূর্ণ
অমন একটি শত্রুর বুকে আঁটে শলা-ষড়যন্ত্র।

হে নিদ্রাবতী, স্বর্ণশস্য ছায়া ও সমর্পণের
তোমার হিংস্র বিশ্রাম সাজে ওরকম উপহরে
হরিণী, অলস শরীর ছড়ানো আঙ্গুরথোকার পাশে

যদিও তোমার আত্মা এখন সুদূরে, ব্যস্ত নরকে
তোমার অঙ্গ, পবিত্রতম তলপেট, ঢাকা একটি তরল হাতে
জেগে আছে; জাগে তোমার অঙ্গ, আমার দু চোখ খোলা।

[ঘুমন্ত নারী বহু কবিতা ও ছবির বিষয়। ভালেরির এই চতুর্দশপদী নিছক বর্ণনামূলক নয়, আবার কোনও রূপকও না। এটি প্রেমের কবিতা নয়, প্রেমের কবিতা ভালেরি প্রায় কখনও লেখেনইনি বলা যায়। আসলে একটি যুবতী সত্যিকারের নিদ্রিতা কিন্তু তার শরীর জেগে আছে। এই নারীর শরীর ও আত্মাকে পৃথক করে, শরীর যা দ্রষ্টার চোখে সুন্দর ও রমণীয়, আর আত্মা যখন বিশ্লিষ্ট তখন রক্তমাংসের মিলনে উন্মুখ, কিছুটা অসৎ সেই ইচ্ছা— এই বৈপরীত্যের খেলায় জীবন ও মৃত্যু এসে যায়। শেষ পর্যন্ত কবির চোখে এই বাস্তব নারীর দেহ নগ্ন, একটি, নরম হাত ঊরুদেশ ঢেকে আছে, তার আত্মা অন্যত্র, সুতরাং কুবাসনায়, কিন্তু তার ঘুমন্ত অঙ্গ দেখতে পাচ্ছে ভাবী উপভোক্তাকে অর্থাৎ কবিকে।
অবশ্য অন্যরকম অর্থও করা যায়। ভালেরির নিজস্ব নির্দেশ আমরা অগ্রাহ্য করতেও পারি। পূর্বের উল্লেখ করা, লা যন্ পার্ক কবিতা সম্পর্কে ভালেরি বলেছিলেন, পাঠকরা ইচ্ছে করলে এটাকে শারীরতত্ত্ব সম্পর্কে বক্তৃতা হিসেবেও গ্রহণ করতে পারেন। আর এই কবিতাটি, ভালেরির মতে, নিছক কবিতার আঙ্গিক ও শব্দ নির্বাচনের পরীক্ষা।
এখন এ কবিতার অনুবাদ অসম্ভব? বস্তুত, মূল কবিতার এই অনুবাদের দুরবস্থা দেখে আমারই কষ্ট হচ্ছে। সংস্কৃতের মতো লঘু, গুরু, প্লতস্বরের ব্যবহারের বিশিষ্টতায় ভালেরি অসীম উদ্যমী। পণ্ডিতরা বলেন মূল কবিতায় ma, amie, ame ইত্যাদি শব্দের অক্ষরের দীর্ঘ উচ্চারণ শায়িতা নারীর বিস্তৃত দেহের আভাস এনেছে। s-এর ঘন ঘন ব্যবহারে ঘুমন্তের নরম নিশ্বাস। আঙুরগুচ্ছের পাশে শুয়ে থাকা হরিণীর চিত্রে ভোগআশ্লেষ থেকে সৌন্দর্যের অনুভূতি এসেছে I-এর ব্যবহারে। সবচেয়ে মজার, শেষ লাইনে জেগে থাকার কথা দুবার কেন লিখেছেন? কারণ, জেগে থাকা অর্থাৎ veille-এ শব্দের v অক্ষরের যে গঠন, এই অক্ষরটি যেরকম দেখতে, এর মধ্যের ত্রিকোণ শূন্যতা নগ্ন শরীরের ত্রিকোণের কথা মনে পড়ায়। ইংরিজি অনুবাদেও এ অনুভাব আসতে পারে না, কারণ awake আর বাংলায় জাগা। জ দেখলে এরকম সুন্দর ছবি মনে পড়া অসম্ভব, জ-কে দেখতেই কীরকম জ্যাঠামশাইয়ের মতো!]
.
পল ক্লোদেল

(ক্লোদেলের লেখা কবিতাধর্মী নাটকগুলি পৃথিবীর যেকোনও ভাষায় শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারে। কবি হিসাবেও তিনি অত্যন্ত বড়, ক্ষমতাবান, বিশুদ্ধ কবিতার বাহক, কিন্তু সব সময় শ্রদ্ধেয় নন। ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণের পর তিনি হয়ে উঠেছিলেন উগ্র ধার্মিক, ধর্ম তাকে বিনয় শেখায়নি, শেখায়নি পরধর্মসহিষ্ণুতা। যদিও তিনি বলতেন, ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণের প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন র‍্যাঁবোর কবিতা পড়ে—সেই দুর্দান্ত, বিবেকহীন, ঈশ্বরহীন, বিদ্রোহী বালক কবি র‍্যাঁবো।।
জন্ম ১৮৬৮, দীর্ঘজীবনের অধিকারী হয়েছিলেন, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী হিসেবে বহুদিন কাটিয়েছেন চিন দেশ ও দূরপ্রাচ্যের দেশগুলিতে, এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে কিছুদিন ছিলেন চিনে ফরাসি দেশের রাজ-প্রতিনিধি, সেই সময়কার উপলব্ধিপ্রসূত তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ আমার জানা প্রাচ্যদেশ। মূলত ধর্মবিশ্বাসের জন্যই, ভারতবর্ষ সম্পর্কে শ্রদ্ধার বদলে অশ্রদ্ধেয় উক্তিই তার বেশি। ৮৭ বছর বেঁচে বিশাল চেহারায় তিনি ফরাসি সাহিত্যের বুক জুড়ে ছিলেন, মৃত্যু ১৯৫৫। এ শতাব্দীর ইওরোপের অধিকাংশ কবিই খ্রিস্টধর্মকে অবহেলা ও ঈশ্বরকে খুন করেছেন, আর পৃথিবীর সব দেশের কবিরা সৃষ্টি করেছেন প্রত্যেকের আলাদা ব্যক্তিগত ঈশ্বর, সেখানে পল ক্লোদেলের প্রচলিত ধর্মের গোঁড়ামি এবং ঈশ্বরের প্রতি সরল ও দ্বিধাহীন বন্দনাই বৈশিষ্ট্য। সত্যিকারের মহৎ কবিত্বের অধিকারী হিসেবে তিনি শ্রদ্ধা ও সম্মান পেয়েছেন প্রভৃত, কিন্তু সকলের ভালোবাসা পাননি।]

সারমর্ম

কবির মনে আছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ, এবং কবি তাঁকে
কৃতজ্ঞতা জানাবার বন্দনায় কণ্ঠ তোলে। কারণ, তুমিই আমাকে
মূর্তিপূজা থেকে মুক্ত করেছ। বাস্তবের পবিত্রতা ও ঐশ্বর্য কার্যকারিতার
চমকপ্রদ দৃশ্য দেখায়; সবই প্রয়োজনীয়। কবি চায়, তাকে
ভৃত্যদের মধ্যে স্থান দেওয়া হোক। কারণ, তুমি আমাকে
মৃত্যু থেকে মুক্ত করেছ। নিষ্প্রাণ ও ঘাতক দর্শনের বীভৎসতা ও
অভিশাপময়তা (থেকে মুক্ত করেছ)। কবিত্বের দায়িত্ব সর্বভূতে
ঈশ্বর সন্ধান এবং তাদের প্রকাশ, যেন সবকিছুই ভালোবাসায়
মিশে যায়। বিরতি। সৃষ্টিজনিত ক্লান্তি। দৈব ইচ্ছা ও দৈব সমতার
কাছে অপাপ ও সরল আত্মসমর্পণ। পুণ্য আমার ঈশ্বর,
যিনি আমাকে আমার আমি থেকে মুক্ত করেছেন, এবং তুমি—
তুমিই স্বয়ংসম্পূর্ণ— আমার বাহুতে এই সদ্যোজাত শিশুর বেশে এসেছ।
ঈশ্বরকে বুকে করে, কবি প্রতিশ্রুত ভূমিতে প্রবেশ করে।


মিশ্রণ

এবং আবার আমি ফিরে এলাম উদাসীন তরল সমুদ্রে
আমার মৃত্যুর পর আমাকে আর যন্ত্রণা সইতে হবে না।
পিতা ও মাতার মধ্যে কবরে যখন শুয়ে থাকব, আমাকে
আর যন্ত্রণা সইতে হবে না।
এই অতিরিক্ত ভালোবাসাময় হৃদয় আর বিদ্ধ হবে না বিদ্রূপে।
শরীরের দীক্ষা আমার মিশে যাবে পৃথিবীর অভ্যন্তরে, কিন্তু আত্মা
তীব্রতম কান্নার মতো বিশ্রাম নেবে আব্রাহামের বুকে।
এখন সবকিছুই মেশা, বৃথাই আমি ভারী এক চক্ষে খুঁজি আমার
চারপাশের সেই চেনা দেশ, আমার পদক্ষেপের নীচে নিশ্চিত পথ
এবং সেই নিষ্ঠুর মুখ।
আকাশ কুয়াশা ছাড়া কিছুই না, শূন্যতা শুধু জল
দেখো, সবই এখন মিশ্রিত, তবু আমি চারপাশে খুঁজি রেখা ও আঙ্গিক।
দিগন্তের জন্যও কিছু নেই, শুধু গাঢ় অন্ধকার রঙের অবশেষ
সব দ্রব্য মিলিত হয়েছে এক জলে, যে জল আমি অনুভব করি
আমার চিবুকে গড়ানো অশ্রুর ধারায়
এর স্বর ঘুমের মতন, যখন নিশ্বাস নেয় আমাদের ভিতরের বধিরতম আশায়
এখন সন্ধান বৃথা, নিজের বাহিরে আমি কিছুই দেখি না।
না আমার সেই দেশ, না আমার অতিপ্রিয় সেই মুখচ্ছবি।

[ক্লোদেলের অধিকাংশ কবিতাই গদ্যছন্দে, এবং এই গদ্যে আশ্চর্য ধ্বনিমাধুর্যের ব্যবহার। প্রথম রচনাটি সম্পূর্ণ কবিতা নয়। ম্যাগনিফিকাত নামক দীর্ঘ কবিতার মুখবন্ধ। ম্যাগনিফিকাত শব্দটি ধর্মীয়, বাইবেলে লুক লিখিত অংশে কুমারী মেরির গান, যেখানে তিনি ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন তার সৌভাগ্যের জন্য। ক্লোদেলের কবিতাটিও অনুরূপ বিষয়ে। এখানে তিনি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন—১৯০৭ সালে চিন দেশে তার নিজের মেয়ে মেরির জন্ম উপলক্ষে। এই খণ্ড কবিতাটির শেষে সদ্যোজাত শিশুর প্রসঙ্গ এসেছে ওই কারণেই। এই সঙ্গে কবি ধন্যবাদ জানাচ্ছেন ঈশ্বরকে, তার নিজের ধর্মান্তরের জন্য, যে খ্রিস্ট সমগ্র মানবজাতিকে উদ্ধার করার জন্য জন্মেছিলেন, তিনি কবিকেও উদ্ধার করেছেন। দ্বিতীয় কবিতাটি, আমার জানা প্রাচ্যদেশ গ্রন্থের শেষ রচনা ১৯০০-১৯০৫, এই সময়ে ক্লোদেলের ধর্মবিশ্বাস খানিকটা টলে উঠেছিল, একটা অবৈধ প্রেমের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিলেন—যার ফলে তার ধর্ম, সম্মান, এমনকী চাকরি নিয়েও খানিকটা টানাটানি পড়ে। তিনি নিজেই পরে এই সময়কার বর্ণনা দিয়েছেন তার শ্রেষ্ঠ রচনা পারতেজ দ্য মিডি নাটকে। মূল কবিতার প্রতিটি শব্দই প্রায় কান্না-ভরা। সাময়িকভাবে চিন দেশ ছেড়ে যাওয়া ও ব্যর্থ প্রেম, এ দুটি বিষয় মনে রাখলে কবিতাটি বুঝতে অসুবিধে হয় না।]
.
সাঁ-ঝঁ প্যার্স

[ব্রেতোঁ তার সুররিয়ালিস্টদের নামের তালিকায় যদিও বলেছেন, সাঁঝ প্যার্স দূর থেকে সুররিয়ালিস্ট কিন্তু প্যার্স-কে সুররিয়ালিস্ট বলা বড়ই কষ্টকল্পনা। তাঁর জগৎ সম্পূর্ণ পৃথক। জন্ম তার ফরাসি দেশ থেকে এক দুরতর দ্বীপে, অভিজাত পরিবারে, ১৮৮৭। আসল নাম আলেক্সি লেজে। ফরাসি ভাষার এরকম একজন সার্থকতম কবি, দীর্ঘ সময়ই কেটেছে ফরাসি দেশের বাইরে। ১৯৪০-এর আগে প্রকাশিত হয়েছিল মাত্র দুটি চটি বই, বন্ধুবান্ধব ও কিছু ঘনিষ্ঠ পাঠকের বাইরে, তার নাম ছিল অপরিচিত। ১৯১৪-তে কুটনৈতিক দপ্তরে চাকরি নিয়ে ক্লোটেলের মতো বহুদিন কাটান চিন ও প্রাচ্যের অন্যান্য দেশে। তারপর ফরাসি সরকারের বৈদেশিক দপ্তরে স্থায়ী সেক্রেটারি হয়েছিলেন। নাৎসীবাদের প্রবল বিদ্বেষী প্যার্স, ১৯৪০-এ জার্মানির ফরাসি দেশ অধিকার ও ক্রীড়নক ভিসি-সরকার গঠনে অত্যাচারের ভয়ে ও কিছু সংখ্যক দেশবাসীর বিশ্বাসঘাতকতার গ্লানিতে ভগ্নহৃদয়ে দেশ ত্যাগ করে চলে এলেন আমেরিকার ওয়াশিংটনে। সেই যে গেলেন, আর ফিরলেন না। ওভিদের সময় থেকে। শুরু হয়েছে যে নির্বাসিত লেখকের দল, প্যার্সও তাদের একজন। এরপর নিউইয়র্ক থেকে, তার পর পর কবিতার বইগুলি দ্বি-ভাষা সংস্করণে প্রকাশিত হতে থাকে, তাকে পৌঁছে দেয় খ্যাতির উচ্চ শিখরে। ১৯৬০-এ নোবেল প্রাইজ। আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটনের চাপা, গুমোট বিশ্রী আবহাওয়ার মধ্যে রইলেন তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসনে। প্যার্সের দৃঢ়শৈলী গদ্য র‍্যাঁবো, মালার্মে, ক্লোদেলের ধারার সার্থকতার পরিণতি। ঈশ্বর, দৈবশক্তি, প্রকৃতি, পবিত্র কুমারীর প্রতি স্তোত্র, বন্দনা, সামগানের যে রীতি উজ্জীবিত করেছিলেন ক্লোদেল, প্যার্সও সেই রীতি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু প্যার্সের প্রকৃতির মধ্যে কোথাও ঈশ্বর বা দৈবশক্তির উল্লেখ নেই, তার চোখে দেখা জগতের তিনিই স্রষ্টা, প্রকৃতির উদ্ভাসন তার বর্ণনায় পৃথক সৃষ্টি হয়ে উঠেছে। তার গ্রন্থগুলির নামও এইরকম সহজ, বৃষ্টি (১৯৪৩), তুষার (১৯৪৪), বায়ু (১৯৪৬) ইত্যাদি।
সুররিয়ালিস্টদের বিপরীত, চলিত শব্দ বা মুখের ভাষা তাঁর কবিতায় প্রায় নেই। তার কবিতা ক্বচিৎ ব্যক্তিগত।]

প্রশস্তি—২

আমার মায়ের দাসীরা, দীর্ঘ, মসৃণ রমণী…এবং আমাদের
উপকথাময় চক্ষুপল্লব…হে
উজ্জ্বলতা! হে করুণা!
প্রত্যেক বস্তুকে আহ্বান করে আমি উচ্চারণ করি সে মহৎ,
প্রত্যেক জন্তুকে বলি সুন্দর এবং দয়াময়।
হে আমার দীর্ঘতম
সর্বভুক ফুলগুলি, রক্তিম পাপড়িদলে আমার সুন্দরতম
সবুজ পতঙ্গদের গ্রাস করতে উৎসুক! বাগানে ফুলের গুচ্ছে
পারিবারিক সমাধির গন্ধ! কনিষ্ঠা, বোনটির মৃত্যু হয়েছে
তিন ঘরের আয়নাগুলির মধ্যে
গন্ধ সমেত তার মেহগনি শবাধার আমার সঙ্গে ছিল।
পাথর ছুড়ে টুনটুনি পাখিদের মারা উচিত নয়…
তবু পৃথিবীর গুড়ি মেরে বসে আমাদের খেলার মধ্যে, দাসীর
মতন, যদিও দাসীর অধিকার আছে, পরিবারের সকলে অন্তঃ-
পুরে রইলে, চেয়ারে বসার।


বৃষ্টি-৮

…বর্ষণের বটবৃক্ষ নগরে ছড়ায় তার বিচারের সভা। স্বর্গের
হাওয়ার প্রতি এই সেই ভ্রাম্যমাণ এরকম
আমাদের মধ্যে বসবাসে আগমন! …তুমি অস্বীকার করো না;
যারা অকস্মাৎ শূন্য হয়ে আসে আমাদের জন্য……
যাঁরা জানতে উৎসুক বৃষ্টি পৃথিবীতে এসে শোভাযাত্রা করে
গেলে কি ঘটনা হয়, তারা এসে বাস করুন আমার বাড়ির
ছাদে, চিহ্ন, সংকেতের মধ্যে। অরক্ষিত শপথ! অনলস
বপন মানুষের সৃষ্ট পথের উপরে
ধোঁয়া!
আসুক বিদ্যুৎ, হাঃ! কে আমাদের ত্যাগ করে!…..নগরের
দ্বারে দ্বারে আমরা ফের নীত হব
এপ্রিলের নীচে দীর্ঘকায় বৃষ্টি হেঁটে যায়, চাবুকের নীচে
দীর্ঘকায় বৃষ্টি ছোটে, যেন নিজ পৃষ্ঠে বেত্রাঘাত অনুষ্ঠান।

[প্রথম কবিতার দাসী, সম্ভবত হিন্দু রমণী। আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস চালান গত শতাব্দীতে বন্ধ হয়ে গেলেও এশিয়া থেকে গোপনে দাস-দাসী রপ্তানি অব্যাহত ছিল। প্যার্সের পৈতৃক দ্বীপভবনে এইরকম কয়েকজন দাস-দাসী ছিল; কোনও কোনও ভাষ্যকার এ কবিতায় যে দাসীর উল্লেখ, তাকে হিন্দুই বলেছেন। ভারতীয়দের লৌহবর্ণ শরীর ফরাসিদের চোখে বড় প্রিয়, কতোর কবিতায় এর চমৎকার উল্লেখ আছে। এ কবিতার দাসী পৃথিবীর উপমেয়। প্যার্সের কবিতা সম্পর্কে একটি খুব সুন্দর তুলনা আছে। নিজের কবিতায় ব্যক্তিগতভাবে তিনি বিষমভাবে অনুপস্থিত। এ যেন কোনও মন্দিরের পুরোহিত দেবতাকে পূজা করছেন, পাশেই নানা সুন্দর, মহার্ঘ দ্রব্য পূজার অর্ঘ্য হিসেবে সাজানো। পুরোহিত সবই উৎসর্গ করছেন দেবতাকে, নিজেকে কিছুই না। প্যার্সও তার কবিতার ও প্রকৃতির সমস্ত সুন্দর উপাদান উৎসর্গ করছেন মানুষকে বা অদেখা পাঠককে। নিজের জন্য কিছু রাখলেন না। বৃষ্টি কবিতার তুমি সেই পাঠক।
বৃষ্টি—৮ একটি দীর্ঘ কবিতার অংশ। প্যার্স একবার কৌতুক করে নিজের কবিতা সম্পর্কে বলেছিলেন, আমার সমস্ত কবিতা আসলে একটি মাত্র দীর্ঘ বাক্য, বিরতিহীন এবং চিরকালের জন্য দুর্বোধ্য। সেই হিসাবে তার যেকোনও কবিতাই অংশ কবিতা। এই কবিতা বৃষ্টির বর্ণনা, ঠিক আবার বৃষ্টিও না বোধহয়। যুদ্ধের সময়ে নির্বাসিত কবির হতাশা ও তিক্ততা, পরিপার্শ্বের মানুষ তাকে ভুল বুঝছে, কবি দুর থেকে দেখছেন ইওরোপের ধ্বংস ও পরিবর্তন, এখানে বৃষ্টির অন্য ভূমিকা আছে। কয়েকটি শব্দের আলোচনা করলেই তা বোঝা যাবে।
বটবৃক্ষ আমার রূপান্তর নয়, মূল কবিতায় ব্যবহৃত। যে বটগাছ নানান শিকড় ছড়ায়। বিচারের সভা কথাটি বিভ্রান্তি ঘটাতে পারে। মূল শব্দের ব্যবহার পরিমিত অর্থে। assise, ইংরেজি assizes— ইংল্যান্ডের ছোট ছোট শহরে নানান অপরাধের মধ্যযুগীয় বিচার অনুষ্ঠান। কদাচার ও পাপে পূর্ণ পৃথিবীর উপর শেষ বিচারের ঘোষণার ইঙ্গিত আছে এখানে।
শেষ লাইনের বেত্রাঘাত অনুষ্ঠানের মূল শব্দ Flagellants-এর তুলনীয় শব্দ বাংলায় নেই। অর্ডার অব ফ্লাজেলান্টস মধ্যযুগের একরকম ধর্মীয় আচার। আত্মশুদ্ধির জন্য সাধক নিজের পিঠে নিজেই বেত মারতেন, অথবা হোক ভাড়া করতেন নিজের পিঠে চাবুক খাবার জন্য।]
.
ব্লেইজ স্যাঁদরার

[আপোলিনেয়ার থেকে যে আধুনিকতার শুরু ফরাসি সাহিত্যে, তার থেকে বিচ্ছিন্ন কিন্তু সমসাময়িক আর তিনজন প্রবল শক্তিমান কবি ছিলেন। ভালেরি, ক্লোদেল এবং পেগি। শেষোক্তজন, অর্থাৎ শার্ল পেগির কবিতা আর আমরা এখানে অনুবাদ করলুম না। কারণ, পেগির কাব্যমূল্য এখনকার চোখে কিছুটা নিষ্প্রভ, তিনিও ছিলেন ক্লোদেলের মতো ক্যাথলিক, এবং মূলত ফরাসি দেশাত্মবোধের জনপ্রিয় কবি, সুতরাং এখন আমাদের কাছে উপভোগের আকর্ষণ কম।
আপোলিনেয়ারের বন্ধুবান্ধব, সমসাময়িক কবি এবং যাদের মধ্যে সুররিয়ালিজমের অঙ্কুর প্রথম উঁকি মারে, তাদের মধ্য থেকে আমি ব্লেইজ স্যাঁদরারকে বেছে নিলাম। এই দলের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কবি আলফ্রেড জারি, মাক্স জাকব এবং লেয়ঁ-পল ফার্গ। জারির কবিতার চেয়ে নাটক বেশি সার্থক, বিশেষত তার উবু রাজা এই শতাব্দীর সত্যিকারের প্রথম উদ্ভট, আজগুবি, বিদ্রূপঝকঝকে নাটক যা পরবর্তীকালের আধুনিক নাট্যকারদের প্রভূত প্রভাবিত করেছে। যদিও নাটকটি এই শতাব্দী শুরু হবার কিছু আগে লেখা। রবীন্দ্রনাথের হিং টিং ছটের হবুচন্দ্র রাজার সঙ্গে উবু রাজার খুব মিল আছে। মাক্স জাকব এবং লেয়ঁ-পল ফার্গের কবিতায় যে দানা ছিল তারই সবিস্তার রূপবান প্রকাশ আছে আপোলিনেয়ারের কবিতায়, ফলে পরবর্তী যুগে ওঁরা কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে। এখন ওঁরা টিকে আছেন সংকলন-গ্রন্থে। বাংলায় মাক্স জাবের কবিতার অনুবাদ করেছেন কবিতা সিংহ ও উৎপলকুমার বসু। ব্লেইজ স্যাঁদরার বাংলায় কিছুটা অপরিচিত কিন্তু ফরাসি কবিতার ইতিহাসে ওঁর অবদান মূল্যবান।
জন্ম ১৮৮৭, প্যারিসে, খাঁটি ফরাসি নন। বহু দেশ ঘুরেছেন, বহুরকম কাজ করেছেন, এমনকী মণি-মুক্তোর সেলসম্যানগিরি পর্যন্ত। ভ্রমণ কবিতাগুলোই তার শ্রেষ্ঠ। প্রথম মহাযুদ্ধে ডান হাতটা কাটা যায়, বাঁ হাত দিয়ে টাইপ করে করে লিখতেন। বহু অনুবাদের কাজ করেছেন। নিগ্রোদের শিল্প ও সংস্কৃতি সম্পর্কে খুব ঝোঁক ছিল। মৃত্যু ১৯৬১-তে।]

সূর্যাস্ত

সকলেরই মুখে সূর্যাস্তের কথা
পৃথিবীর এ অঞ্চলে সব পর্যটকরাই সূর্যাস্ত বিষয়ে
কথা বলতে একমত
এমন অসংখ্য বই আছে, যাতে শুধু সূর্যাস্তেরই বর্ণনা
গ্রীষ্মমণ্ডলের সূর্যাস্ত
হ্যাঁ, সত্যিই, ভারী চমৎকার
কিন্তু আমি বেশি ভালোবাসি সূর্যোদয়
ভোর
আমি একটি প্রত্যুষও হারাই না
আমি ডেকের উপর দাঁড়িয়ে থাকি
নগ্ন
আমি একা সূর্যোদয়ের বন্দনা করি
কিন্তু আমি সূর্যোদয়ের বর্ণনা করিতে চাই না
আমি আমার ভোরগুলি নিজের জন্যই রেখে দেব।

জ্যোৎস্না

নাচি আমরা ট্যাঙ্গো নাচি জাহাজে
চাঁদ এঁকেছে চাঁদের বৃত্ত জলে
আর আকাশে বৃত্ত আঁকে মাস্তুল
আঙুল তুলে দেখায় দূরে তারার দঙ্গল

রেলিং ধরে ঝুঁকে রয়েছে নবীনা এক আর্জেন্টিন-বালা
ফরাসি উপকূলের আলো মালার দিকে তাকিয়ে এখন
স্বপ্ন দেখে প্যারিসের
অল্প চেনা প্যারিস তার অনুতাপের প্যারিস
জাহাজ থেকে ঘুরছে আলো দুরঙা আলো, আলো এবং গ্রহণ
মনে পড়ায় বড় রাস্তায় হোটেল ঘরের জানলা থেকে দেখা
ওরা সবাই ফিরে আসবে শপথ করেছিল
ঐ যুবতী স্বপ্ন দেখছে আবার দ্রুত ফিরে আসবে প্যারিসে
থেকে যাবে
আমার টাইপ রাইটারের শব্দ ওঠে শব্দ ওকে স্বপ্ন শেষ করতে
দেয় না
আমার এই চমৎকার টাইপ রাইটার প্রতি লাইনের শেষে কেমন
টুং শব্দে বেজে ওঠে
আর কেমন দ্রুত ছোটে যেমন ঠিক জ্যাজ সংগীত
আমার এই চমৎকার টাইপ রাইটার আমায় কোনও স্বপ্ন
দেখতে সুযোগ দেয় না।
না ওদিকের বন্দরের না বিপরীত জাহাজ মুখের
অনুসরণে বাধ্য করে শেষ অবধি এক চিন্তার
আমার চিন্তা

[অধিকাংশ পথিকৃৎকেই শেষ পর্যন্ত যে দুর্ভাগ্য সইতে হয়, স্যাঁদরারকেও তা সইতে হয়েছে। অর্থাৎ তার কবিতায় যা কিছু নতুন এবং মৌলিক, যেমন কবিতায় গদ্যধর্ম, যতিচিহ্নহীন চেতনাপ্রবাহ, ফটোগ্রাফের মতো বর্ণনা (সেটা ছিল চলচ্চিত্রের আদি যুগ, সুতরাং কবিতা চলচ্চিত্রকে বা চলচ্চিত্র কবিতাকে খুব অভিভূত করেছিল)— এই সমস্ত রীতি পরবর্তী বহু কবি এবং অনেক বেশি শক্তিমান কবিরা আরও এমন সার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন যে, প্রথম ব্যবহারকের কথা আর আমাদের মনে থাকে না বা পড়তে ক্লান্তিকর লাগে। কিন্তু এদের থেকেই শুরু হয়েছিল এই নতুন ধারা, কবিতাকে অতিশয় ব্যক্তিগত করে তোলা, বর্ণিত বিষয়ের মধ্যে কবি নিজে সব সময় উপস্থিত, বা কোনও দৃশ্যের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে তাৎক্ষণিক মানসিক প্রতিফলন, পারম্পর্যহীন হলেও সঙ্গে সঙ্গে লিখে রাখা। এসব আমাদের বাংলা কবিতাতেও এত ব্যবহৃত হয়েছে যে, এখন আর এরকমের কবিতা নতুন মনে হবার সুযোগ নেই, তা ছাড়া স্যাঁদরারের কবিত্ব খুব বেশি কালোত্তীর্ণ হবার মতো গর্ভবতী নয়। সুতরাং, এ কবিতা পড়ার সময় ৪০/৪৫ বছর আগের ইতিহাস মনে রাখা দরকার।
অনুবাদের আরেকটি অসুবিধে এবার বোধ করলুম। আমরা মুখের কথায়, লেখায় অনেক ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি, কিন্তু কবিতা অনুবাদের সময় প্রতিটি শব্দই বাংলা করার দিকে আমাদের ঝোঁক। কিন্তু অনেক শব্দের যে বাংলাই নেই। (যেমন অনেক বাংলা শব্দের ইংরেজি হয় না।) দ্বিতীয় কবিতার মূল শেষ লাইন, মনিদে-এর বাংলা আমার চিন্তা একেবারে ভালো শোনায় না। আইডিয়া শব্দের বাংলা কি? ভাবনা বা চিন্তা ঠিক নয়, এ দুটোর মধ্যে যেন একটু দুঃ মেশানো আছে। আবার ভাবও চলে না— ওটা যেন বেশি গদগদ। আমার একটা আইডিয়া মনে এসেছে— এর বদলে আমার মনে একটা ভাব এসেছে একেবারে অসম্ভব। আইডিয়ার এক কথায় বাংলা, অভিধানে দেখলুম, চিচ্ছবি। কিন্তু এ শব্দটা চলবে কি? নাঃ!]
.
পিয়ের রেভার্দি

[১৯৫০-এর পর ফরাসি দেশের তরুণ লেখকরা যখন নিউ নভেল আন্দোলন শুরু করে, তখন কবিতাতেও তারা প্রতিষ্ঠিত প্রবীণ কবিদেরও উপস্থিত করে নিজস্ব বিচারালয়ে। কাকে কাকে রাখা হবে দলনেতা হিসেবে, কে কে গণ্য হবেন সার্থক পূর্বসূরী হিসেবে, কোন কোন কবির ওপর পড়বে বিস্মৃতি ও ঔদাসীন্যের খাঘাত, কার রচনায় তরুণদের সত্যিকারের আনন্দ। অধিকাংশ প্রবীণ সুররিয়ালিস্ট কবি তখন প্রাক্তন গুরু হিসেবে গণ্য, আবার ঈষৎ বিস্মৃত কয়েকজন কবির নামও প্রবলভাবে ফিরে এল নবীন লেখকদের কাছে। এই সময় আবার উচ্চকিত হয়ে উঠল পিয়ের রেভার্দির নাম, তরুণরা তাঁর কবিতার সঙ্গে বিশেষ আত্মীয়তা বোধ করল, অথচ রেভার্দি তখন নির্জন মঠে স্বেচ্ছানির্বাসনে।
পিয়ের রেভার্দির জন্ম ১৮৮৯-এ দক্ষিণ ফ্রান্সের এক সাধারণ পরিবারে। একুশ বছর বয়সে প্যারিসে এলেন খবরের কাগজে প্রুফ রিডারের চাকরি নিয়ে। এই সময় প্যারিসে আলফ্রেড জারি, মাক্স জাকব, আপোলিনেয়ার এবং কিউবিস্ট শিল্পীরা সাহিত্য, শিল্প, থিয়েটার নিয়ে প্রবল উন্মাদনায় মেতে আছেন। রেভার্দি সহজেই আবিষ্কার করলেন ওঁদের স্বজাতি হিসেবে। তিনি ওঁদের দলে মিশে গেলেন। কিন্তু কয়েক বছর পরই আরম্ভ হল প্রথম মহাযুদ্ধ। আপোলিনেয়ারের সঙ্গে তিনিও যুদ্ধে যোগ দিলেন। দু’জনেই ফিরে এলেন ১৯১৭ সালে, আপোলিনেয়ার মাথায় গোলার আঘাত নিয়ে, রেভার্দি স্বাস্ত্যের কারণে। ওই বছরেই বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করলেন বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা নর-সুদ অর্থাৎ উত্তর দক্ষিণ। এই পত্রিকা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করে ডাডাইস্ট ও সুররিয়ালিস্টদের। আপোলিনেয়ারের হঠাৎ মৃত্যু হওয়ায় রেভার্দি, জাকব, স্যাঁদরার এঁরাই হলেন সুররিয়ালিস্টদের প্রধান অবলম্বন, প্রতিষ্ঠিত সমর্থক।
কিন্তু হঠাৎ চরিত্র বদলে গেল রেভার্দির। বিপ্লবীর ভূমিকা ছেড়ে অকস্মাৎ ১৯২৬-এ তিনি ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করলেন, অন্তরীণ হলেন এক খ্রিস্টান মঠে, সেখানেই নির্জন হয়ে রইলেন বাকি জীবন। দীর্ঘ জীবন, ১৯৬০-এ মৃত্যুর আগে আর একবারও বিচলিত হননি।]

ভগ্নহৃদয়

আ-আজ সব চলেছে শেষের দিকে।
দেয়ালে ছড়ায় ঢিমে-লয় সংগীত
মুখে এক হাত
অপর হাতের ছোঁয়ার উলটো পিঠটুকু নেই
জানলা গলিয়ে পালায় নগ্ন প্রেম
মনোরম ছবি
একটি রমণী পরেছে ছিন্ন সেমিজ
বেশ তো ভঙ্গি এ মহৎ কামনার
কেঁদে কেঁদে সেই রমণীটি যায় আকাশের দিকে
যে আকাশ তাকে ডাকে
জল ও কঠিন বৃক্ষের দল
বেহালার সুর ছাড়া প্রণয়ের নিরাশা
যাই হোক তবু ফঁদ পাতা আছে গোপন
চৌরাস্তায় ভারী অর্গ্যান একটি গ্রীষ্ম সন্ধ্যা
তোমার বিষাদ করেছে অর্থময়
হালকা দুঃখ
কিছুই থাকে না
বন্ধুরা সব মৃত
স্ত্রীলোকেরা তবু নিজের গরজে তাদের দেখতে যায়
তুমি এসেছ এ খেলায় একটি অশুভ চিহ্ন নিয়ে
কি তোমার সাধ ভদ্র মানুষ অথবা দস্যু হওয়া
কোনও কিছু নয়
আমরা চামড়া লুকিয়ে রেখেছি পোশাকের নীচে ভাঁজে
স্রোত বয়ে যায় যে স্রোত বয়েই যাবে
আমার হাসিও মিশিয়েছি তার সঙ্গে
ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে তোমার যুক্তির দিকে দেখি
পৃথিবী কি খুশি হাসছে পৃথিবী তোমারও হাস্য
এক রাত্তিরে আমি হারালাম আমার বয়েস শৈশব নাম

[যদিও সুররিয়ালিস্ট দলের সমর্থক ছিলেন, মেতে উঠেছিলেন নতুন রীতির আন্দোলনে, কিন্তু রেভার্দির কবিতার চরিত্র অন্যরকম, তার সমসাময়িকদের সুরের সঙ্গে মেলে না। সুররিয়ালিস্টদের মতে, এই বাস্তব জীবনটাই আসলে বাজে, কোনও মানে হয় না, অবান্তর, বরং স্বপ্নের জীবন ও মগ্ন চৈতন্যই সত্য, অতি বাস্তব। সুতরাং শিল্প সৃষ্টির উদ্দেশ্য এ জীবন-যাপন বদলে দেওয়া। রেভার্দি নিজের কবিতায় এ মত মানেননি, বরং বিপরীত। তার মতে, কবিতার কাজ হল, যে জীবন তাকে দেওয়া হয়েছে তাতেই চূড়ান্তভাবে বেঁচে থাকা, স্বপ্ন ও বাস্তব যে সূক্ষ্ম সীমায় এসে মিশেছে সেখানে দাড়ানো, অপসৃয়মাণ মুহূর্তগুলিকে ধরে রাখা, যেখানে বাস্তব কখনও কখনও হয়ে ওঠে পরম সত্য। এই নির্দিষ্ট বাস্তব জীবনকে চূড়ান্তভাবে বাঁচার ধারণাই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরের কবিদের নতুন করে প্রেরণা দিয়েছে। রেভার্দি তাঁর কবিতায় কখনও কখনও কমা ফুলস্টপ দিতেন, কখনও দিতেন না। ভগ্নহৃদয় কবিতাটিতে নেই। অনুবাদ করার সময় আমি যোগ করে দেব কিনা ভাবনায় পড়েছিলাম। তার ইমেজগুলো টুকরো টুকরো, লাইনগুলি যোগাযোগহীন। কবিতায় আমরা যেরকম মানে খুঁজতে চাই, সেরকম অর্থ প্রতি লাইনে নেই। কিন্তু সমগ্র কবিতা উজ্জ্বল অর্থময়। যেন, একটি নামহীন মানুষ, একটি উদ্বিগ্ন আত্মা এই টুকরো ছবিগুলোর মধ্য দিয়ে দেখছে পৃথিবীকে। মাঝে মাঝে এক একটা লাইন হঠাৎ উচ্চাকাঙ্ক্ষী মনে হয়, যেন কবি কোনও বিরাট রহস্য উন্মোচন করতে চলেছেন। কিন্তু সে রহস্য আর ধরা পড়ে না, কবির চোখ আটকে দেয় এক অদৃশ্য পরদা, আবার কবিকে ছোট ঘোট দৃশ্যের মধ্যে খুঁজতে হয়। রেভার্দির সমগ্র কবিতায় বিধৃত হয়েছে মানুষের ভাগ্যের দুঃখ। এইরকম তাৎক্ষণিক অনুভূতির ছোট ছোট ছবিতে গেঁথে ভোলা কবিতার নাম রেভার্দি দিয়েছিলেন, পোয়েজি ব্রুত— অর্থাৎ কর্কশ কবিতা।
এই কবিতায় আমি আর তুমি হয়তো একই ব্যক্তি। শার্ল পেগির কবিতায় যেমন ঈশ্বর এসে পেগির ভাষায় কথা বলতেন, তেমনি রেভার্দিও অনেক সময় নিজেকেই নিজের ভাষায় শাসন করেছেন।]
.
জাঁ ককতো

[প্যারিসের যতগুলি সৌধ, স্তম্ভ, মিনার, শিল্পকীর্তি আছে, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ককতো-ও ছিলেন যেন তার অন্যতম। প্যারিস শহরের বিশেষ দ্রষ্টব্য ফরাসি নাগরিক বিদগ্ধ পুরুষদের প্রতিমূর্তি। প্যারিসের অদূরে ধনাঢ্য পরিবারে জন্ম, ১৮৮৯। চরম শৌখিন এবং পরম বেপরোয়া জীবনযাপন করেছেন প্যারিসেই। বদলেয়ার এবং আপোলিনেয়ার যেমন অসংখ্য রচনায় প্রিয়তম প্যারিসকে বারবার সৃষ্টি করেছেন, সেইরকম ককতোও প্যারিসেরই লেখক। যদিও, ককতোর রচনা বড় বিক্ষিপ্ত, অপরিপূর্ণ।
বহু মুখে ছড়িয়েছিলেন ককতো নিজের প্রতিভা। উপন্যাস লিখেছেন, লিখেছেন নাটক, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, চিত্রনাট্য। ফরাসি দেশের অধিকাংশ বড় কবিই বড় সজাগ অহংকারী, কবিতা ব্যতীত শিল্পের অন্যান্য শাখায় সহসা কার্যকারীভাবে প্রবেশ করতে চান না। ককতো করেছিলেন, বহু জটিল শাখায়, ফলে ওঁর কবিতার ক্ষতি হয়েছে নিশ্চিত। ফিলম তোলার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়েছিলেন, নাটক প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছেন নিজে, এমনকী অভিনয় পর্যন্ত। নাটকই শেষ পর্যন্ত তার শ্রেষ্ঠ বাহন ছিল, বহু পরীক্ষা করেছেন, পুরাণ মহাকাব্যের পুনরুত্থান, মধ্যযুগীয় প্রেম কাহিনীর আধুনিক রূপ, মাত্র একটি চরিত্রের নাটক— ইত্যাদি। অর্ধশতাব্দীর প্রত্যেকটি শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনের পক্ষে-বিপক্ষে ভয়ংকরভাবে যুক্ত ছিলেন। কিউবিজম, ডাডাইজম, সুররিয়ালিজম— সব কটি পরপর পেরিয়ে এসেছেন— প্রখ্যাত বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত ছিলেন পিকাসো। ক্ষীণ, স্পর্শকাতর স্বাস্থ্য, তবু শরীরে গাঁজা, আফিং ও অন্যান্য মাদক সেবনের পরীক্ষা করেছেন। যৌবনে বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল প্রতিভাবান, অকাল মৃত লেখক রাদিগের সঙ্গে ককতো পুরুষ-প্রেমের উপরেও বিশেষ জোর দিতেন।
১৯৬৪ সালের গোড়ার দিকে, তার মৃত্যু প্যারিস শহরে যেন ইন্দ্ৰপাত ঘটিয়েছিল। রূপকথার মতো সেই মৃত্যু। ককতোর আন্তরিক বান্ধবী ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত গায়িকা এদিথ পিয়াফ— সেই এদিথ পিয়াফ— যাঁর জন্ম পথের ভিখারিণী হিসেবে, ক্রমে ভবঘুরে, চোর, খুনে ও বারবনিতাদের জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে শেষ পর্যন্ত যিনি উঠেছিলেন সমাজের শীর্ষে। ককতো আর পিয়া পরস্পরের গুণমুগ্ধ। দু’জনেই অসুস্থ বারবার কক্ততা ভৃত্যকে পাঠাচ্ছেন এদিথ কেমন আছে জেনে আসতে। একই দিনে, প্রায় এক সঙ্গেই দু’জনের মৃত্যু।]

দুপুর

নাবিক, এখন দারু দেবদূত, ডানার আঘাতে
আফ্রোদিতির অস্ট্রিচ পাখি, হীরকের হার,
শান্ত সাগর থেকে নিয়ে আসে তোমার জন্য তটের প্রান্তে
বিশ্বাসী ঢেউ, মুক্তাখচিত টমটমে জোড়া ক্লান্ত অশ্ব।

ভগ্ন জাহাজ, টিনের কৌটো, নোঙর, বরগা, মাস্তুল, আর
জেলিমাছ, নীচে জলের ভিতরে রাজধানী, তার বড় রাস্তার
জানালার থেকে তাকানো দৃষ্টি পরে সমুদ্র
ফিরে যায় ফের, নিজের মুখের লালা শুষে নিয়ে—।
আমি খুলে ফেলি পোশাক ও টুপি নেই মুহূর্তে
বালির উপরে উলঙ্গ দেহে চিত হয়ে শুই
বন্য রৌদ্রে শরীর পুড়িয়ে প্রতীক্ষা করি, বেরুবে কখন
আমাদের এই চামড়ার নীচে লুকিয়ে যে আছে, সেই ভারতীয়।


আনাড়ি পরীরা

আনাড়ি পরীরা তোমাদেরই অনুকরণ করেছে, হে পারাবত।
তোমরা মেরির বন্দনা গাও। ওরা সান্ত্রীর মঞ্চে
পাহারা দিচ্ছে ফরাসি রাজ্য। হায়! তবুও তো আমরা নিরাশ করেছি ওদের।
সারা রাত জেগে আকাশ তুলেছে রাশি রাশি জুই
শেষ ফুলটিও তোলা হলে, ওরা খোলে জানালার ঝিল্লি।
এসেছে শরৎ, পরী ঝরানোর দিন এল আজ
দুধের ভাণ্ড থেকে গড়ানোর মতো পরীদের এই ঝরে যাওয়া।

সোনালি বৃক্ষ অপেরায় বহু কমলালেবুর ফসল ফলেছে
শীর্ষদেশের কমলার প্রতি জনসাধারণ বড় উৎসুক
কারণ নীচের কমলার স্বাদ, ওদের সবারই মুখে বিস্বাদ।

দশ লাইনের এই কবিতাটি খুব সুন্দর নাকি কুৎসিত?
কুৎসিতও নয় সুন্দরও নয়, অন্যরকম গুণ আছে ওর।

[ককতোর কবিতায় প্রাচীন কাব্যের গন্ধ ও বর্ণের সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে আধুনিকতা। কবিতার বহিরঙ্গ সজ্জায় অস্বাভাবিক দক্ষতা দেখিয়েছেন তিনি, কখনও কখনও নিখুঁত গঠনের কবিতায় যুক্ত হয়েছে তার ডাডাইস্টদের ধরনে বিদ্রূপময় দৃষ্টিভঙ্গি। এসব সত্ত্বেও অনেক সময় তার লেখা সম্পর্কে মনে হয় সার্থকভাবে রচিত অপ্রধান কবিতা। কবিতা সম্পর্কে ককতোর বিখ্যাত উক্তি: শ্রেষ্ঠতম রচনাও বর্ণমালার বিশৃঙ্খলতা ছাড়া, আর বেশি কিছু না। প্রথম কবিতাটি ইমপ্রেশানিস্টদের ধরনের রচনা। মাঝির কথা বলেই পরমুহূর্তে সে হয়ে গেল কাঠের তৈরি দেবদূত— দেবদূত ও পরী কক্ততার অতি প্রিয় বিষয় সেই দেবদূত ডানার আলোড়নে নিয়ে এল আফ্রেদিতিকে। রোমানদের যেমন ভিনাস, গ্রিকদের সেই প্রেমের দেবী আফ্রেদিতি— সমুদ্রের ফেনা থেকে যার জন্ম— যদিও ককতোর সমুদ্রে, ঢেউ একটু পরেই হয়ে গেল মুখে ফেনা মাখা টমটম বা জুড়িগাড়ির ঘোড়া। সমুদ্র থেকে যেমন উঠে এলেন আফ্রেদিতি— সেইরকমই প্রখর সূর্যের আলোর নীচে কবির চামড়া থেকে বেরিয়ে আসে এক গাঢ় রঙের ভারতীয়।]
.
পল এলুয়ার

[বলা যায়, ১৯২০ সাল থেকেই একরকম, পশ্চিমের সাহিত্য থেকে নারীর নির্বাসন হয়ে গেছে। নারীর বন্দনা, স্তুতি, সজ্জা—এতকাল ছিল যেকোনও সাহিত্য সৃষ্টির প্রাণ, যেদিন থেকে লেখকরা মুখ ফিরিয়ে নিলেন, নারী ক্রমশ অবহেলিতা, অনাদৃতা হতে হতে অস্তিত্বহীন হবার উপক্রম। মালার্মে বা ভালেরি কোনও মেয়েকে ভালোবাসা নিয়ে প্রেমের কবিতা লেখা প্রায় হাস্যকর মনে করতেন। ফ্রানৎস কাফকা, টমাস মান— সাত্র, কামু হেনরি মিলার, নরমান মেইলার—এঁদের রচনায় কোনও নায়িকা নেই বললেই চলে। নারী চরিত্র আছে নানা প্রয়োজনে, কিন্তু নারী নেই! হায় শ্বেতাঙ্গিনী!
পল এলুয়ার তার অপর দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু—ব্রেতোঁ ও আরাগঁর সঙ্গে মিলে প্রায় যুদ্ধে নেমেছিলেন নারীর লুপ্ত মহিমা পুনরুদ্ধারের জন্য। সুররিয়ালিস্টদের আদি ও প্রবল সমর্থক এলুয়ার বললেন, নারীই রহস্যের সিন্ধু। পৃথিবীর সব রহস্যেরই উন্মোচনের চেষ্টা করা যায় নারীর শরীরে ও ভালোবাসায়। এলুয়ার রমণীর বন্দনা করেছেন নির্লজ্জ, দ্বিধাহীন, সরল, আত্মার স্পষ্ট ভাষায়। পোর্কের সময় থেকে শুরু হয়েছে যে প্রেয়সী বন্দনা, এলুয়ার যেন সেই ধারারই আধুনিক পূজারি। এবং তার সার্থক সঙ্গী লুই আরাগ।
পল এলুয়ারের জন্ম ১৮৯৫,(কোনও কোনও বইতে দেখছি ১৮৯৭, আমার পক্ষে ঠিক করা সম্ভব নয়। তাঁর নামটিও যে ছদ্মনাম, এ তথ্যও সুপরিচিত নয়। ইউজিন গ্রাঁদেল নামের লোকটি যে কেন স্বনাম ত্যাগ করে সারা জীবন পল এলুয়ার নামেই লিখেছেন জানতে পারিনি।) ব্যক্তিগত জীবনে তিনি নানান ঘটনার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকতে চাইতেন। নির্জন ঘরে নিজের মুখোমুখি হওয়া নয়, এলুয়ার চেয়েছেন পৃথিবীর মানুষের মধ্যে নিজেকে খুঁজতে। কৈশোরে ফুসফুসের অসুখ হয়, তারপর প্রথম মহাযুদ্ধে আক্রান্ত হন বিষাক্ত গ্যাসে। তবু বেঁচে উঠে, নিজের মধ্যে বোধ করলেন একটা পরম ছটফটানি, নির্দিষ্ট নিয়মহীনতা। সেই টানে যোগ দিলেন ডাডাইস্টদের আন্দোলনে, কিছুদিন পর সুররিয়ালিস্টদের দলে, প্রবলভাবে মেতে উঠলেন, তারপর আবার একদিন বিকেলবেলা প্রিয় বন্ধু পিকাসোর কাঁধে হাত দিয়ে গিয়ে দু’জনেই নাম লিখিয়ে এলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। আবার, নাৎসিরা যখন ফরাসি দেশ অধিকার করে, তখন গোপন মুক্তিযুদ্ধে লড়াই। করেছেন সৈনিক হয়ে। মৃত্যু ১৯৫২]

প্রেয়সী

সে আছে দাঁড়িয়ে আমার চোখের পাতায়
তার চুল এসে মিশেছে আমার চুলে
আমার হাতের মতো অঙ্গের গড়ন হয়েছে তার
আমার চোখের মতো তার রং দেখেছি চক্ষু খুলে
তাকে আমি গ্রাস করেছি নিজের ছায়ায়
বিশাল আকাশে যেমন হেলানো পাহাড়।
তার দুই চোখ খোলা সারা দিন রাত
আমায় কিছুতে দেয় না কখনও ঘুমোতে
খাঁটি দিবালোকে স্বপ্ন দেখে সে, স্বপ্নের সংঘাত
এমনকী ওই সূর্যকে দেয় উবিয়ে, যেমন কর্পূর
স্বপ্ন দিয়ে সে হাসায়, কাঁদায়, হাসায়, কথার স্রোতে
টেনে নিয়ে যায়, কিছুই বলার নাই থাক
আমি কথার নেশায় ভরপুর।


ঈষৎ বিকৃত

বিদায় বিষাদ
স্বাগত বিষাদ
তুমি আঁকা আছ দেয়ালের কড়িকাঠে
তুমি আঁকা আছ আমার ভালোবাসার চোখে
তুমি নও সম্পূর্ণ দুঃখ
কেননা দরিদ্রতম ওষ্ঠও তোমাকে
ফিরিয়ে দেয়
একটুকরো হাসিতে

স্বাগত বিষাদ
রমণীয় শরীরের ভালোবাসা
ভালোবাসার তেজ
তার মনোহরণ জেগে ওঠে
অশরীরী দানবের মতো
ব্যর্থকাম মস্তিষ্ক
বিষাদ সুন্দর মুখ

[১৯৪২-এ ফরাসি দেশের মুক্তিযুদ্ধে হাতে বন্দুক নিয়ে অসম সাহসীর মতো যখন লড়াই করেছে এলুয়ার, দেখেছেন নিজের দেশের অসংখ্য মানুষের অবর্ণনীয় দুর্দশা, তখনও তিনি প্রেমের কবিতায় বিশ্বাস হারাননি। তখনও তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি মেয়েকে ভালোবাসাই সব ভালোবাসার প্রথম সোপান, সেই ভালোবাসা থেকেই জন্ম হয় স্বাধীনতা ও পৃথিবীর সমস্ত মানুষের প্রতি ভালোবাসার/ ভালোবাসা হচ্ছে সেই প্রবল আকর্ষণ যা দুটি নারী-পুরুষকে কাছে আনে, সর্বাঙ্গের রক্ত-মাংসের স্পর্শে জন্ম হয় সত্যিকারের পরিচয়, ‘আমি’ তখন বদলে ‘তুমি’ হয়ে যায়। ‘তোমাকে ভালোবেসেই আমি পৃথিবীর মানুষের কাছে ফিরে এলাম’।
এলুয়ার যখন মেয়েদের বর্ণনা করেছেন, তাদের চুল, ওষ্ঠ, গ্রীবা, স্তন, জঙঘা সব কিছুর মধ্যেই একটা আশ্চর্য নম্র কমনীয়তা আছে। কোনও অঙ্গই তার বর্ণনায় পৃথক নয়, নারীর একটি হাতও সম্পূর্ণ নারী। রুহিতনের বিবি নামে তাঁর বিখ্যাত কবিতার এক জায়গায় আছে, ভালোবাসাকে ভালোবেসে– অর্থাৎ সেন্ট অগাস্টিন যেমন বলেছিলেন, প্রেমের প্রেমে পড়া একটি মেয়েকে ভালোবাসার পর ভালোবাসাতেই চক্ষু আচ্ছন্ন হয়, বদলে যায় এই জগৎ— আমার আর বিশ্বচরাচরের মধ্যের সব ব্যবধান তুচ্ছ হয়ে যায়, সহপাঠিনী বালিকা হয় পৃথিবীর যেকোনও বা সমস্ত নারী।]
.
লুই আরাগঁ

[প্রেমিকাকে নিয়ে কবিরা ঢের কবিতা লিখেছেন ও লিখবেন। কিন্তু প্রেমিকার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেলে তারপর আর তাকে নিয়ে কবিতা লেখার রেওয়াজ নেই বিশেষ। নিজের স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে প্রেমের কবিতা লেখার ফ্যাশন কোনও দেশেই নেই। দু-একজন কেউ লিখলেও, নাম না দিয়ে কিছুটা অস্পষ্ট বর্ণনায় এমন ভাব করা হয়, যেন কোনও অচিন-প্রিয়া, ইত্যাদি। রাধাকৃষ্ণ বা ত্রিস্তান-ইসোল্টের কাল থেকেই প্রেমের কবিতার নায়িকা পরস্ত্রী বা অনুঢ়া।
কিন্তু আরাগঁ লিখেছেন, প্রবল ও নির্লজ্জভাবে। তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থের নাম এর চোখ। এলসা ত্রিয়োলেট নামের রাশিয়ান নারীকে বিয়ে করার পর বহু কবিতায় উল্লেখ করেছেন।
জন্ম ১৮৯৭।। আরাগঁর জীবনের ঘটনাগুলি অনেকটা তার বন্ধু এলুয়ারের মতোই। দু’জনেই প্রথম মহাযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। আরাগঁ বীরত্বের জন্য পদক পান। তারপর ডাডাইজম আন্দোলনের স্বেচ্ছাচারে যোগদান। পরে সুররিয়ালিজম। আরও পরে কমিউনিজম। আবার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সৈনিক হিসেবে যুদ্ধ। এই সময়ে প্রকাশিত পরপর দুটি কাব্যগ্রন্থ ভগ্নহৃদয় ও এলসার চোখ–এতে যুদ্ধ ও দেশাত্মবোধের সরল কবিতাগুলি তাকে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দেয়।
গদ্য-লেখক হিসেবেও আরাগ-র সুনাম আছে। তাঁর তিনখানি উপন্যাস ফরাসি ভাষায় কবিত্বময়তায় বিশিষ্ট। কিন্তু কবি হিসেবে তার স্থান কোথায়—এ নিয়ে এখন বিপুল মতভেদ দেখা গিয়েছে। তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের মতে, তিনি এ যুগের একজন মহাকবি; অন্যদের মতে তিনি একটি বিপুল ব্যর্থতা। রাজনীতি-নিরপেক্ষ সমালোচকদের মধ্যেও এরকম মতভেদ। কারণ, আরাগঁ চান জনতার কাছে তার রচনার সম্পূর্ণ আবেদন পৌঁছে দিতে, এবং তিনি বেছে নিয়েছেন কবিতার প্রথাসিদ্ধ রীতি ও সরল, মর্মস্পর্শী বিষয়। তার ছন্দ ও শব্দ ব্যবহার ক্রমশ হয়ে উঠছে প্রত্যক্ষভাবে অনাধুনিক কবিতার মতো, অর্থাৎ চলিত ভাষায় আমরা যাকে পদ্য বলে থাকি। নিম্নেদ্ধৃত কবিতার অনুবাদেও আমরা আমাদের। সচরাচর অব্যবহার্য কয়েকটি পুরনো শব্দ ব্যবহার করে সেই পুরনো ভাবটি আনার চেষ্টা করেছি।
যুদ্ধের সময় লেখা আরাগঁর দ্বিতীয় রিচার্ড চল্লিশ কবিতাটিই সবচেয়ে বিখ্যাত। এই কবিতাটি একসময়ে লোকের মুখে মুখে ফিরেছে। এবং এখনও যুদ্ধের উপরে লেখা সার্থক কবিতা হিসেবে এর কৃতিত্ব সমসাময়িকতা ছাড়িয়ে আছে।]

লিলি ও গোলাপ

কুসুমের মাস রূপান্তরের মাস
মে মেঘহীন জুনের পৃষ্ঠে ছুরি
ভুলব না আমি লিলির গুচ্ছ গোলাপের নিশ্বাস
বসন্তে আরও লুকানো যে মঞ্জরী

ভুলব না আমি কখনও করুণ মায়ায় দৃশ্যমান
জনতার স্রোত চিৎকার রোদ্দুরে
ভালোবাসা-মোড়া সাঁজোয়া বাহিনী বেলজিয়ামের দান
বাতাস ও পথ কাঁপে মাছিদের ভনভনানির সুরে

বিবাদের আগে দ্রুত হঠকারী জয় অধিকার পায়
সুন্দরীদের লাল চুম্বন রক্তপাতের অগ্রিম
মৃত্যুর কাছে যারা যাবে তারা দাঁড়িয়ে বারান্দায়
ফুলের মালায় ভরে গেছে বুক জনতার হিমসিম

ভুলব না আমি ফ্রান্সে সেই প্রিয় উদ্যানগুলি
ওরা যেন বহু প্রাচীন কালের ভোরে প্রার্থনা গান
নৈঃশব্দের ধাঁধা সন্ধ্যার যাতনা কেমনে ভুলি
ছিল আমাদের যাত্রার পথে গোলাপ যে অফুরান…..

……থেমে গেছে সব শত্রু এখন ছায়ায় নিয়েছে বাস
প্রিয় প্যারিসের পতন শব্দ শত্রুর মুখে শোনা
ভুলব না আমি লিলির গুচ্ছ গোলাপের নিশ্বাস
এবং আমার দুই ভালোবাসা হারিয়েছি ভুলব না।

প্রথম দিনের লিলির স্তবক ফ্লান্ডার্সের ফুল
মৃত্যু যে রঙ গণ্ডে মেশায় ফুলে সেই জাগরণী
আর তুমি হায় কোমল গোলাপ অপসরণের ভুল
আঁজুর গোলাপ তোমার বর্ণ দূর কামানের ধ্বনি

[এই কবিতার কয়েকটি উল্লেখ স্পষ্টভাবে বুঝতে হলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দুটি মাসের ইতিহাসে ফিরে যেতে হয়। ১৯৪০-এর মে-জুন। আরাগঁ তখন সৈন্যবাহিনীতে। মে মাসে ফরাসি বাহিনীর মধ্যে জয়ের ছদ্ম আশা জন্মেছিল। মে মাসের স্নিগ্ধ সূর্যালোকে সাদা লিলি ফুল সেই ভুল আশার প্রতীক। ফরাসি বাহিনী চলেছে আলরিয়ার খালের দিকে প্রতি-আক্রমণে, বেলজিয়ামের অকৃপণ সাহায্য, সেই উপলক্ষে নাগরিকদের উৎসব। যুদ্ধের ট্যাঙ্কগুলো ভালোবাসায় মোড়া– অর্থাৎ, পশ্চিম দেশের যেমন রীতি— যুদ্ধে যাবার সময় সুন্দরী তরুণীরা দলে দলে ছুটে এসে গাড়ির ওপর উঠে সৈনিকদের আলিঙ্গন-চুম্বন দেয়। সৈনিকদের গালে সেই লালচে লিপস্টিকের দাগ— যেন তাদের আসন্ন মৃত্যু-পরোয়ানা। গোলাপ ভয়ংকর জুন মাসের ফুল— যে জুন মাসে আশাভঙ্গ এবং পশ্চাদপসরণ। ১৪ জুন। প্যারিসের পতন। পরাজিত সৈন্যদের ফিরে আসার পথে আর কোনও অভ্যর্থনা নেই, উৎকট স্তব্ধতা, শুধু পথের পাশে পাশে লাল গোলাপের ঝাড়। দুই ভালোবাসাকে হারানো– অর্থাৎ প্রিয় প্যারিস ও প্রিয়তমা এলসা।
প্যারিসের বাগানগুলির সঙ্গে প্রার্থনা গানের তুলনা—একটু দূরাম্বয়ী মনে হতে পারে, মূল কবিতায় আছে missel, অর্থাৎ ইংরেজি missal— আগেকার রোমান ক্যাথলিক গির্জায় রক্ষিত প্রার্থনা সংগ্রহ-পুস্তক। প্রার্থনা-পুস্তকের সঙ্গে বাগানের তুলনা এই হিসেবে হতে পারে, যে রঙিন ফুলের চৌখুপ্লি করা বাগানের সঙ্গে নানা বর্ণে চিত্রিত প্রার্থনা-পুস্তকের দৃশ্যত সাদৃশ্য। তেমনি আঁজুর গোলাপ, মূল কবিতায় আঁজু শব্দটি ছিল লাইনের শেষে। আঁজু অঞ্চলের গোলাপ এমন কিছু বিখ্যাত নয়— তবু কেন আঁজুর উল্লেখ আগে ক্লান্ডার্সের ফুল বলার তবু মানে হয়, কারণ সৈন্যবাহিনী এগিয়েছিল ফ্লাভার্স দিয়ে কিন্তু আঁজু? ওটা মনে হয় এসেছে মিলের খাতিরে— কবিদের এরকম স্বভাব আছেই।
মূল কবিতা থেকে আট লাইন আমি বাদ দিয়েছি। মূল কবিতায় আছে লাইলাক ফুল, কিন্তু বাংলায় লিলি নামটা পরিচিত। মে মাসে লিলি ফুল ফোটার কথা তো আমরা ছেলেবেলা থেকেই পড়েছি।]
.
আঁরি মিশো

[সাম্প্রতিক ফরাসি কবিতায় দুই সৃষ্টিশীল প্রধান কবি মিশো এবং বনফোয়া। আঁরি মিশো এখন বয়সে প্রবীন কিন্তু এই অভিমানী, আত্মভুক, পাগলাটে পুরুষটি ফরাসি কবিতার একটি বিশেষ দিকের প্রতিনিধি।
মানুষের মনের ভিতরের হিংস্র, ভয়ংকর জগৎ থেকে দানবগুলিকে বারবার টেনে এনেছেন, কিন্তু মুক্তি বা রূপান্তরে বিশ্বাস করেননি মিশো। এই কবি নৈরাশ্যবাদী অর্থাৎ অন্তৰ্জীবনের অজ্ঞানকে আবিষ্কার ও মনুষ্যত্বের রূপান্তর নয়, তাঁর কবিতা কবিতার মধ্যেই শেষ। কবিতা লিখে মানুষের উন্নতি করতে তিনি আসেননি, বরং নিজের সঙ্গে এক প্রচণ্ড যুদ্ধ, যে যুদ্ধে জয়-পরাজয় কিছুই নেই, জীবন এইরকমই— তীব্র, নির্বাচিত ভাষায় আঁরি মিশো লিখে চলেছেন। বোদলেয়ারের পর থেকে ফরাসি কবিতায় মেটাফিজিকাল দিক যে ক্রমশ কমে আসছে, মিশোই তার চরম উদাহরণ। তাঁর লেখায় প্রতীকের ব্যবহার খোঁজা নিরর্থক। কবিতা জীবনযাপনের প্রতিটি মুহূর্তের মতো, প্রত্যেকটি কবিতারই আলাদা অস্তিত্ব আছে, মানুষ বা মুহূর্তের মতোই তার জন্ম-মৃত্যু।
মিশো-কে প্রথম অভ্যর্থনা জানান আঁদ্রে জিদ। মিশো সম্পর্কে তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন। মিশোর জন্ম ১৮৯৯, আসলে জাতে বেলজিয়ান। ব্রাসেলসে ডাক্তারি পড়তে পড়তে হঠাৎ পড়া ছেড়ে দিয়ে নাবিকের চাকরি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন সমুদ্রে। সেই সময়ে ঘুরেছিলেন উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বন্দরে। ফিরে এসে প্রথম লেখা শুরু করলেন। পঁচিশ বছর বয়সে প্যারিসে এসে আস্তানা নিলেন। সেইসময় সুররিয়ালিস্ট আন্দোলন প্রবল, মিশো ওই পালকেরই পাখি, কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে যোগ দেননি ঈর্ষাবশত, ব্রেতোঁর একনায়কত্বের জন্য। আবার ভ্রমণ এশিয়া মহাদেশ। ফিরে এসে প্রবল কবিতা ও ছবি আঁকা নিয়মিত। রুগ্ন শরীর, কিন্তু গত এক দশক গাঁজা, মেস্কালিন, হাসিস, আফিম ইত্যাদি মাদকদ্রব্য ব্যবহার করে পরীক্ষা করছেন। পরীক্ষা, নেশা নয়।
এশিয়া মহাদেশ ভ্রমণের পর একটি বই লিখেছিলেন, এশিয়ার এক বর্বর। সে বইয়ের কোনও কোনও মন্তব্যে এ দেশের অনেক গোঁড়া লোক খুশি হন না, কিন্তু বইটি ভারী মজার।]

একজন শান্ত মানুষ

বিছানা থেকে হাত বাড়িয়ে দেয়াল ছুঁতে না পেরে প্লুম অবাক হয়ে গেল। সে ভাবল, হুঁ, পিঁপড়েতে খেয়ে গেছে….এবং সে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। একটু পরেই ওর স্ত্রী ওকে জড়িয়ে ধরে ঝকানি দিতে দিতে বলল, কুঁড়ের যম, একটু চোখ মেলে দ্যাখো, তুমি যখন ঘুমিয়ে কাদা, তখন ওরা আমাদের বাড়িটা চুরি করে নিয়ে গেছে। এবং সত্যিই ওদের চারপাশে সীমাহীন আকাশ ছড়ানো। বাঃ, হয়ে যখন গেছেই… সে ভাবল। তারও একটু পরে সে একটা শব্দ শুনতে পেল। একটা ট্রেন প্রচণ্ড গতিতে ওদের দিকে ছুটে আসছে। যে-রকম জোরে ওটা আসছে, তা দেখে মনে হয় সে ভাবল, আমরা পালাবার আগেই… এবং সে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। তারপর শীত তার ঘুম ভাঙাল। ওর সমস্ত শরীর রক্তে ভেজা। ওর স্ত্রীর টুকরো টুকরো দেহ পাশে পড়ে আছে। সে ভাবল, রক্ত-টক্ত থাকলে অনেক বিশ্রী ব্যাপার পর্যন্ত গড়ায়; ট্রেনটা যদি সত্যিই না আসত, আমি খুবই খুশি হতাম। কিন্তু যখন কাণ্ডটা ঘটেই গেছে…
সে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
—তা হলে, বিচারক বললেন, তুমি এর কী কারণ দেখাতে পারো যে, তোমার স্ত্রী যখন অমন ভয়ংকরভাবে নিজেকে টুকরো টুকরো করল— লোকেরা ওর লাশ আটটা টুকরোয় ভাগ করা দেখেছে এবং তুমি পাশে শুয়ে থেকে ওকে এ কাজে বাধা দেবার কোনও চেষ্টাই করোনি, এমনকী তুমি কিছু লক্ষই করোনি। এটাই আসল রহস্য। পুরো কেসটা এর ওপরই নির্ভর করছে।
এই মামলায় আমি ওকে কোনও সাহায্যই করতে পারব না, প্লুম ভাবল, এবং সে আবার ঘুমের মধ্যে ফিরে গেল।
ফাঁসি হবে কাল সকালে। আসামি তোমার কিছু বলার আছে? —মাপ করবেন, আমি কেসটা গোড়া থেকে কিছুই শুনিনি। সে বলল। এবং আবার ঘুমিয়ে পড়ল।


আগামীকাল এখনও নয়…

ঘোরো, ঘোরো, দ্বিমুণ্ড ভাগ্য,
আমাদের ব্যান্ডেজমোড়া শরীরের গ্রহগুলি থেকে ছিটকে ওঠা
গভীর গতি, ঘোরো।

দেরির জন্য সূর্য,
আবলুশ ঘুম,
আমার স্বর্ণফলের বুক।

দু’হাত ছড়িয়ে
আমরা আলিঙ্গন করি ঝড়,
আমরা আলিঙ্গন করি আয়তন,

আমরা আলিঙ্গন করি বন্যা, আকাশ, ব্রহ্মাণ্ড,
আমাদের সঙ্গে যা-কিছু আজ আমরা আলিঙ্গন করেছি,
ফাঁসি কাঠের উপরে রতি-ক্রীড়ায়।

[অনুবাদের সীমাবদ্ধতা, অনুবাদকের অক্ষমতা ইত্যাদি প্রশ্নে এখানে আঁরি মিশোর দুটি প্রায় অপ্রধান কবিতাই অনুদিত হল। তাঁর বিখ্যাত কবিতাগুলির মধ্যে আমার রাজা— যে কবিতায় কবি নিজস্ব মধ্যরাত্রে জেগে উঠে নিজের রাজার সঙ্গে লড়াই করছেন কিংবা দুর্ঘটনার পর প্রভৃতি কবিতা অনুবাদেই মিশোর সত্যিকারের পরিচয় বোঝা যেত।
ফ্রানৎস কাফকা এই শতাব্দীতে যে ধরনের গদ্যলেখক, কবিতায় আঁরি মিশোও অনেকটা তাই। কাফকার চরিত্র জোসেফ কের মতে, বা আলবিয়ার কামুর মেরশো-র মতো, প্লুম নামের চরিত্রটিও মিশোর বহু কবিতায় ঘুরে ঘুরে এসেছে।
প্লুম হচ্ছে আধুনিক মানুষের প্রতিভূ– যে এই নিষ্ঠুর এবং দুর্বোধ্য জগতের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে। মিশো কখনও কখনও এই লোকটিকে প্রচণ্ড বিদ্রূপও করেছেন, ওকে ক্লাউন বানিয়েছেন।]
.

ফ্রাঁসিস পঁঝ

[ফ্রাঁসিস পঁঝকে মনে হয় ফরাসি কবিতার…ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন, একক। বোদলেয়ার থেকে শুরু হয়েছে যে হৃদয়-খোঁড়া, অজ্ঞাত প্রদেশের উদ্ভাসন, পঁঝ সে পথে যাননি। তার কবিতার মূল বিষয় মানুষ নয়, বস্তু। কাঠ, লোহা, জল, সিগারেট দেশলাই, শামুক, বরফ, ঝিনুক এইগুলিই তার চোখের কেন্দ্র, বস্তুর চরিত্র অনুযায়ীই তিনি মানুষের সম্পর্কের কথা ভেবেছেন। পাসকালের স্বধর্মী পঁঝ বহির্জগতে ধ্যানমগ্ন, প্রতিদিনের দেখা জড়পদার্থের মধ্যেই তাঁর কবিত্বের আবিষ্কার। এইসব বস্তুকে তিনি জীবনের চরিত্র দিয়েছেন, কিন্তু নিজের জীবনের সঙ্গে মেলাননি, সেই হিসেবে পঁঝ প্রতীকধর্মী নন।
পঁঝের এই নির্লিপ্তভাবে গল্প বলার ভঙ্গিতে কবিতা, তার পরবর্তীদের মধ্যেও অনুকারী বা অনুসারী সৃষ্টি করেনি, কবিতার চরিত্রে ফরাসি কবিতায় তিনি বিশেষ উল্লেখযোগ্য অনন্য, কিন্তু ১৯৫০-এর পর কিছু আধুনিক ঔপন্যাসিক, এল্যাঁ রব গ্রিয়ে বা মিশেল বুতর—এঁদের রচনায় পঁঝের প্রভাব স্পষ্ট।
জন্ম ১৮৯৯। বাবা ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক, তার কাছে এবং প্যারিসের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করে সাংবাদিকতা এবং পুস্তক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছিলেন। সুররিয়ালিস্টদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, কিন্তু অপ্রত্যক্ষ। ঘটনাহীন জীবন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় গুপ্ত প্রতিরোধ আন্দোলনে সাংবাদিকদের সংগঠন করেছিলেন। ১৯৫২ সাল থেকে প্যারিসের আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজে অধ্যাপনা করছেন।]

তিনটি দোকান

বড় রাস্তার কাছে, যেখানে রোজ খুব ভোরে আমি বসে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকি, তিনটি পাশাপাশি দোকান। একটি সোনারুপোর, একটি কয়লা আর কাঠের, আরেকটি মাংসের দোকান তিনটির দিকে পরপর তাকিয়ে আমি লক্ষ করি স্বভাবের বিভিন্নতা, আমার চোখে ধাতু, মূল্যবান পাথর, কয়লা ও জ্বালানি কাঠ এবং মাংসের টুকরো।
ধাতুগুলি সম্পর্কে বেশিক্ষণ ভাবার দরকার নেই— ওরা কাদা-মাটির ওপর, মানুষের ভয়ংকর বা নিরূপিত প্রচেষ্টার ফল— অথবা প্রাকৃতিক আলোড়ন— যার কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। মূল্যবান পাথরগুলি সম্পর্কেও তাই, ওদের দুর্লভতাই আমাদের কিছু নির্বাচিত শব্দের বর্ণনা দিতে বাধ্য করে প্রকৃতির সম্পর্কেও যেরকম শুদ্ধ বর্ণনা।
মাংসের ব্যাপারে, দেখা মাত্রেই আমি কেঁপে উঠি, এক ধরনের আতঙ্ক অথবা সহানুভূতি আমাকে আলাদা হতে বাধ্য করে। তা ছাড়া, সদ্য ছাড়ানো মাংস—একটা সূক্ষ্ম কুয়াশা বা ধোঁয়ার আস্তরণ আড়াল করে রাখে— আক্ষরিক অর্থে খাঁটি সংস্কারাদি যারা প্রকাশ করতে চান তাদের চোখ থেকেও। ওর কেঁপে ওঠা স্বভাবের দিকে এক মুহূর্তের জন্যও আমার মনোযোগ গেলে আমার যা বলার বলতে পারব।
কিন্তু কাঠ ও কয়লা সম্পর্কে চিন্তা সত্যিকারের আনন্দের উৎস- সরল, নিশ্চিন্ত এবং শান্ত আনন্দ— যা আমি খুশি মনে ভাগ করে নিতে চাই। এর বর্ণনা দিতে আমার পাতার পর পাতা লাগা উচিত, এখানে আমার মাত্র আধ পাতা সীমা, সুতরাং আপনাদের চিন্তার জন্য আমি সূত্রাকারে এই বিষয়ের আভাস দিচ্ছি:
১) ভেকটরে অধিকৃত সময় সর্বদাই নিজের প্রতিশোধ নেয় মৃত্যুতে।
২) ধূসর— কারণ ধূসরই হচ্ছে অঙ্গার হবার পথে সবুজ ও কালোর মধ্যবর্তী পথ, কাঠের ভাগ্যে আরও— যদিও সামান্যতম আছে একটি রোমাঞ্চকর গল্প, অর্থাৎ একটি ভুল, হঠকারিতা, এবং সমস্ত সম্ভব ভুল বোঝাবুঝি।


দেশলাই

আগুন দেশলাই কাঠিকে শরীর দেয়
একটি জীবন্ত শরীর, তার ভঙ্গি
তার পদোন্নতি, একটি সংক্ষিপ্ত গল্প
উৎস থেকে জ্বলে ওঠে গ্যাস
তাকে দেয় ডানা ও পোশাক, এমনকী শরীর;
একটি গতিময় আকার
এবং সঞ্চরমাণ। খুব দ্রুত।

একমাত্র তার মাথাটাই শুধু কঠিন বাস্তবের সংঘর্ষে
শিখায় জ্বলতে পারে,
খেলার মাঠে স্টার্টারের পিস্তলের মতো তখন এর শব্দ।

কিন্তু যে মুহূর্তে ধরা হল
শিখা
সরল রেখায়, দ্রুত— জাহাজের পাল
ঝুলে পড়ার মতো
কাঠের রূপালী বর্ণে উঠে আসে,
এবং তাকে ছোঁয়া মাত্রই
পুরোহিতের মতো কালো করে
রেখে যায়।

[বস্তুকে মানবজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখেন বলেই পঁঝের কবিতা আবেগময় নয়, বরং যুক্তিগ্রাহ্য এবং কঠিন। তাঁর শব্দ ব্যবহারও খুব নির্বাচিত এবং বৈজ্ঞানিক পরিভাষাময়। এ ধরনের দুরূহ কবিতা, বাংলায় বোঝাবার জন্য আমরা অবশ্য সরল ভাষাই ব্যবহার করেছি। প্রথম কবিতায়, ভেকটর শব্দটির আমি বাংলা পরিভাষা পাইনি। জ্বালানি কাঠের আশু রূপান্তর বোঝাতে এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ভেকটর অঙ্কের শব্দ, বাংলা অঙ্কের পত্রিকা অঙ্ক-ভাবনার প্রথম সংখ্যায় ভেকটরের এই সংজ্ঞা পেলাম: ভেকটর গণিত শাস্ত্রমতে নিছক পরিমাণ, এই ভেকটরের মানগুণ্য (magnitude) এবং দিক অভিমুখ নির্ণীত থাকে। সাধারণত, ভেকটরের ব্যাপার হিসাবে বেগ এবং জোর ধরা হয়।]
.
জাক প্রেভের

[বিংশ শতাব্দীর ফরাসি কবিদের মধ্যে জাক প্রেভের নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। জনপ্রিয়তার জন্য যা যা দরকার, সহজবোধ্যতা, শব্দের চমক ও খেলা, লঘু সুর, চেনাশুনো বিষয় নিয়ে ঠাট্টা ইয়ারকি, জাক প্রেভের এর সবকটাতেই খুব সিদ্ধহস্ত। কবি হিসেবে যথেষ্ট নিম্নমানের, কিন্তু তাঁর কবিতার বই হু-হু করে বিক্রি হয়, প্যারিসের নাইট ক্লাবে প্রেভেরের গান, রেকর্ড, রেডিয়ো ফিমেও ঘন ঘন তার রচনার ব্যবহার। কিন্তু কবি হিসেবেও প্রেভেরকে সম্পূর্ণ অবহেলা করা যায় না। তার ছন্দ ও শব্দের ব্যবহার বহু প্রতিষ্ঠিত কবির কাছেও ঈর্ষণীয়। প্রেভের যদিও নিজের কবিতা সম্পর্কে বলেন, তিনি মজা করার জন্য নিজেকে খুশি করার জন্যই কবিতা লেখেন, কিন্তু তার সূক্ষ্ম বিদ্রূপবোধ এবং খেলো ও কথ্য শব্দের মধ্যে কবিত্বের বিকাশ সমালোচকরাও স্বীকার করেছেন। যেকোনও সংকলনে তার স্থান নিশ্চিত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশেও প্রেভের কিছুটা পরিচিত। বিষ্ণু দে ও অরুণ মিত্র প্রেভেরের অনুবাদ করেছেন। একটি দীর্ঘ কবিতার অনুবাদ আছে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর।
প্রেভেরের জন্ম ১৯০০ সালে। যথারীতি, সমবয়েসিদের মতো উনিও সুররিয়ালিজম, কমিউনিজমের স্তর পেরিয়ে এসেছেন পর পর। সিনেমার গল্প লিখেছেন কয়েকটি, তা ছাড়াও সাময়িকপত্রে ছোটগল্প ও রেকর্ডের জন্য গান লেখেন। প্রেভেরের রচনা অনেকটা স্বভাবকবিদের মতো স্বতঃস্ফূর্ত—এবং প্রতিদিনের দেখা চরিত্র—অর্থাৎ পুরুত, অধ্যাপক, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ— যাদের হাতে সাধারণ নিরীহ মানুষ নিয়ত অত্যাচারিত হচ্ছে— প্রেভেরের বিদ্রোহ তাদের বিরুদ্ধে। এবং তার বিদ্রূপের ধরন নানা অসংগতির মধ্যে চরিত্রগুলোকে জট পাকিয়ে উলটোপালটা এলোমেলো করে দেওয়া।]

তোমার জন্য হে আমার প্রেম

পাখির বাজারে গিয়েছি আমি
পাখি কিনেছি
তোমার জন্য
হে আমার প্রেম
ফুলের বাজারে গিয়েছি আমি
ফুল কিনেছি
তোমার জন্য
হে আমার প্রেম
লোহার বাজারে গিয়েছি আমি
শিকল কিনেছি
কঠিন শিকল
তোমারই জন্য
হে আমার প্রেম
তারপর ক্রীতদাস-দাসীদের বাজারে গিয়েছি
এবং খুঁজেছি
তোমাকে পাইনি
হে আমার প্রেম।


শোভাযাত্রা

সোনায় মোড়া একটি বৃদ্ধের সঙ্গে একটি দুঃখিত ঘড়ি
রানি পরিশ্রম করছেন এক ইংরেজের সঙ্গে
আর মাছ-ধরা শান্তির জাহাজের সঙ্গে সমুদ্রের অভিভাবক
ব্যঙ্গনাট্যের বীরপুরুষ, তার সঙ্গে মৃত্যুর বোকা হাঁস
কফির সাপের সঙ্গে এক চশমা পরা কারখানা
দড়ির খেলার শিকারির সঙ্গে এক বহুমুন্ডের নর্তকী
ফেনার সৈন্যাধ্যক্ষের সঙ্গে এক অবসরপ্রাপ্ত তামাকের পাইপ
কালো পোশাকে সজ্জিত এক পিছন নোংরা শিশুর সঙ্গে একটি
নিকারবোকার পরা ভদ্রলোক
ফাঁসিকাঠের গান লেখকের সঙ্গে একটি গায়ক পাখি
বিবেক সংগ্রাহকের সঙ্গে এক সিগারেট-টুকরোর পরিচালক—
বাংলাদেশের একটি কচি সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে একটা ধর্মীয় মঠের বাঘ
পোর্সিলিনের এক অধ্যাপকের সঙ্গে একজন দর্শন-মেরামতকারী
রাউন্ড টেবিলের একজন ইন্সপেকটরের সঙ্গে প্যারিস গ্যাস
কোম্পানির বীরবৃন্দ
সেন্ট হেলেনের একজন হসের সঙ্গে টোমাটোর রস দিয়ে রান্না
করা একটি নেপোলিয়ান
নিম্নাঙ্গের এক সদস্যের সঙ্গে ফরাসি আকাদেমির পিল
একটি বিশাল ঘোড়ার সঙ্গে সার্কাসের একটি বড় বিশপ
কাঠের ক্রশধারী একজন টিকিট কালেক্টারের সঙ্গে বাসের একজন ধর্মগান গায়ক
এক ভয়ংকর শল্যচিকিৎসকের সঙ্গে একটি দাঁতের শিশুডাক্তার
আর ঝিনুকদের সেনাপতির সঙ্গে জেসুইট সাঁড়াশি।

[দ্বিতীয় কবিতাটিতে শোভাযাত্রার নানান ধরনের মানুষের চবিত্রের অসংগতি প্রেভের বর্ণনা করেছেন বিপরীতার্থক শব্দ সমাবেশে। বর্ণিত চরিত্রগুলি দেখেই কাদের ওপর প্রেভেরের রাগ—স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়। বিশেষণগুলি দ্রুত উলটে দিয়ে যে কৌতুকের সমাবেশ করেছেন—তার স্বাদ কোনও ভাষাতেই অনুবাদে পুরোপুরি পাওয়া সম্ভব নয়। যেমন, চতুর্থ লাইনে আমি যে বোকা হাঁস বসিয়েছি— ওটার মূল শব্দ, Dindon, যার অর্থ টার্কি অর্থাৎ মুরগি জাতীয় সুখাদ্য পাখি। কিন্তু, ওর আর একটাও মানে হয়, বোকাসোকা লোক। ইংরেজিতেও যেমন গুজ শব্দের অন্য মানে আছে- হি ইজ এ থরো গুজ! কিন্তু বাংলায় মুরগি-হাঁসের বোকামি প্রসিদ্ধ নয়। আবার পঞ্চম লাইনের চশমা পরা কারখানা কিছুই প্রায় বোঝায় না কারখানার মূল শব্দ Moulin, যার অর্থ মিল বা কারখানা- যেমন আটা-ময়দার কারখানা, কফি গুঁড়োবার কারখানা। প্যারিসের বিখ্যাত নাইটক্লাব মূল্যাঁ রুঝ— তার ওই নামের কারণ, ওই লাল বাড়িটাকে দেখতেই একটা উইন্ড মিলের মতন। কিন্তু, মূল্যাঁ কথাটার আর একটা মানে আছে ফরাসিতে, মুল্যাঁ আপারোল মানে হচ্ছে বকবকানি মেয়ে। তা হলে চশমাটা কী সুন্দর মানিয়ে যাচ্ছে!
বাহুল্যভয়ে আর দৃষ্টান্ত বাড়াচ্ছি না। কিন্তু এ ধরনের কবিতা বাংলায় লেখা হয় না বলেই, কিছুটা হয়তো স্বাদ পাওয়া যাবে ভেবে এ কবিতা অনুবাদে উদ্ধার করেছি।]
.
রেনে শার

[সুররিয়ালিস্ট আন্দোলনে যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন, রেনে শার তাঁদের মধ্যে কনিষ্ঠতম। জন্ম ১৯০৭; যখন বাইশ বছর বয়েস, তখন থেকেই প্রবলভাবেই মেতে উঠেছিলেন ওই সাহিত্য-আন্দোলনে, যুক্ত ছিলেন ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত, তারপর এসে গেল যুদ্ধ। সুররিয়ালিস্ট দলের যে অংশ সাম্যবাদ গ্রহণ করে, তিনি তাদের সমর্থন করেননি, কিন্তু যুদ্ধের সময় সাহিত্য-আন্দোলনের চেয়েও বড় কাজে আত্মনিয়োগ করলেন, দেশরক্ষায়। শার-এর খ্যাতির অনেকখানি অংশই যুদ্ধের সময় প্রতিরোধ আন্দোলনে তাঁর অসমসাহসিকতার জন্য, জীবনপণ করে তিনি দেশরক্ষায় নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন, তিনি একজন জাতীয় বীর হিসেবে স্বীকৃত। এবং অনেকটা এই কারণেই, খাঁটি কবি হিসেবে শার-এর স্থান অত্যন্ত উঁচুতে। এই উক্তির মধ্যে বৈপরীত্যের সুর থাকলেও শার নিজের শরীর এবং জীবন পর্যন্ত দান করতে প্রস্তুত ছিলেন দেশরক্ষায়, কিন্তু কবিতার পবিত্রতা ও শুদ্ধতার প্রতি তার নিষ্ঠা ছিল অবিচল। কবিতাকে কখনও উদ্দেশ্যমূলক করেননি। অর্থাৎ আরাগঁ প্রভৃতির মতো যুদ্ধের সময়েও চিৎকারময় কবিতা লেখেননি। শার-এর সংক্ষিপ্ত, ঘন কবিতাগুলি চিরায়তের নির্যাস, সেই জন্যই দুরূহ, যেকোনও ঘটনা বা চরিত্রই তার কবিতার উপজীব্য নয়। সুররিয়ালিস্টদের অপর দুর্দান্ত প্রবক্তা আন্টোনিন আর্তোর যেমন মত ছিল, কবির সঙ্গে এই বাস্তব জীবনের কোনও সম্পর্কই নেই, তার দেশকাল-সমাজ কোনও কিছুর সঙ্গেই যোগ নেই—শার একথা মানতেন না, তাঁর মতে জীবনে ও বেঁচে থাকায় কবি তার দেশ ও সমাজের সঙ্গে জড়িত, দায়িত্বশীল, কিন্তু কবিতা তার ব্যক্তিগত আরাধনা, নিজস্ব মন্ত্রোচ্চারণ। কামুর মতে শার এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফরাসি কবি।
শার এখন বছরের কিছুদিন প্যারিসে, কিছুদিন জন্মস্থান লিল-সুর-সরনামের দ্বীপে থাকেন। মিরো, ব্রাক প্রভৃতি শিল্পীদের সম্বন্ধেও লিখেছেন।]

ওরিওল পাখি

ওরিওল পাখি ছুঁয়েছে ঊষার রাজধানী
তার সংগীত তলোয়ার, এসে বন্ধ করেছে দুঃখ শয্যা
সব কিছু আজ চিরজীবনের শেষ। (৩ ডিসেম্বর ১৯৩৯)


বিরুদ্ধতা

তোমার শূকরদের মান্য করো, যাদের অস্তিত্ব আছে। আমি আত্মসমর্পণ করি
আমার দেবতাদের কাছে, যার অস্তিত্ব নেই।
আমরা নির্দয় মানুষ থেকে যাই।


তুমি ছেড়ে গিয়ে ভালোই করেছ, আর্তুর র‍্যাঁবো
তুমি ছেড়ে গিয়ে ভালোই করেছ, আর্তুর র‍্যাঁবো। বন্ধু ও শত্রুদের প্রতি সমানভাবে তোমার আঠারো বছরের অবহেলা, প্যারিসের কবিদের ন্যাকামির প্রতি, আর সেই বন্ধ্যা ঝিঝির একঘেয়ে সুর— তোমার গ্রাম্য ও পাগলাটে পরিবার—তুমি ভালো করেছ তাদের উদার বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে, তাদের অহংকারী গিলোটিনের খাঁড়ার নীচে পেতে। তুমি বেশ করেছ, ছেড়ে চলে গেছ অলসদের রাস্তা, লিরিক-প্রস্রাবকারীদের সরাইখানা— পশুর নরকস্থানের জন্য, প্রতারকদের ব্যবসা এবং সরল মানুষের অভ্যর্থনা।
শরীর ও আত্মার সেই দুর্বোধ্য উত্থান, লক্ষ্যস্থানে আঘাত করার সময় ফেটে যায় যে কামানের গোলা, হ্যা, নিশ্চিন্ত, তাই তো মানুষের জীবন! শৈশব থেকে উঠে এসে আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের অনির্দিষ্টকাল হত্যা করতে পারি না। কী হয়, যদি ক্বচিৎ জেগে ওঠা আগ্নেয়গিরি থেকে লাভা বেরিয়ে ছড়িয়ে যায় বিশ্বের বিশাল শূন্যতায়, আনে সেই গুণাবলী যারা নিজের ক্ষতস্থানের গান করবে।
তুমি ছেড়ে চলে গিয়ে ভালো করেছ, আর্তুর র‍্যাঁবো। আমাদের কাছে তোমার প্রমাণ করার দরকার নেই, আমরা অল্প কয়েকজন বিশ্বাসী, যে তোমার পক্ষেও সুখ সম্ভব ছিল।

[মালার্মের পর, শার-এর কবিতাই ফরাসিতে সবচেয়ে কঠিনবোধ্য, অধিকাংশ কবিতারই স্পষ্ট, সরল, নির্গলিতার্থ করা সম্ভব নয়, নানারকম ব্যাখ্যা নিয়েও অনেক সমালোচকের মধ্যে মতভেদ আছে। কবিতায় দুর্বোধ্যতার যাঁরা বিরুদ্ধে, তাঁদের কাছে আগেই স্বীকার করা হয়তো যায় যে, শার-এর কোনও কবিতারই সম্পূর্ণ অর্থ নেই। অর্থাৎ, তিনি তাঁর আবেগ বা বিশেষ অনুভূতি কবিতায় সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করেন না, মাত্র যাত্রারম্ভটুকু যাতে পাঠকের আত্মা ক্রমশ সেই আরম্ভটুকু অবলম্বন করে, নিজস্ব বিভিন্ন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় মগ্ন হতে পারে। তাঁর কোনও বর্ণনাই ছবি নয়, সুরের মতো। বলা বাহুল্য, এই সুরের স্পর্শ একমাত্র পাওয়া যেতে পারে কবির নিজ নির্বাচিত মূল ভাষায় অনুবাদে শুধু প্রকরণের আভাস তাও কম নয়, আমাদের পক্ষ অন্যরকম, নতুন।
ওরিওল কবিতার মর্মের সূত্র পাওয়া যাবে, রচনার তারিখে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রথম দিক। ইউরেপের কালো আকাশ পেরিয়ে এল একটি পাখি। ওরিওল কথাটার মানে সোনালি পাখি, হলদে আর কালোয় মেশানো যে পাখি প্রায় সর্বত্র দেখা যায় তার নাম, আমাদের দেশে যে হলুদে পাখিগুলো গৃহস্থের থোকা হোক বলে ডাকে— অনেকটা সেইরকম।
র‍্যাঁবোর উদ্দেশে কবিতাটি নিশ্চিত অপেক্ষাকৃত সরল। বিশ্ববিজয়ী কবি র‍্যাঁবো মাত্র ১৯ বছর বয়সে (মতান্তর আছে) কবিতা লেখা শেষ করে, জীবনের যে বাকি আঠারো বছর সাহিত্য ও সাহিত্যিক বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কচ্ছেদ করে আফ্রিকার ভয়ংকর জঙ্গলে আদিবাসীদের মধ্যে চোরাই বন্দুকের ব্যবসা করে কাটিয়েছেন, শার র‍্যাঁবোর জীবনের সেই দ্বিতীয় অংশকেই সমর্থন করছেন। এই সমর্থনের কারণ বোঝা যায়। প্রত্যেক কবিই চায়, এক হিসেবে কবিতা লেখার হাত থেকে মুক্তি পেতে।]
.
রেনে গি কাদু

[রেনে কাদুকে আজকাল অনেকেই ভুলতে শুরু করেছেন। জীবনে অসফল এই কবি, ব্যর্থ, ভগ্নহৃদয় রাজধানী থেকে দূরেই কাটিয়েছেন সারা জীবন। সারা জীবন শব্দটা শুনলেই খুব দীর্ঘ মনে হয়, কিন্তু রেনে কাদু-র জীবন মাত্র একত্রিশ বছরের, জন্ম ১৯২০, মৃত্যু ১৯৫১। জন্মেছিলেন ব্রিটানিতে, বাবা স্কুল মাস্টার, সাধারণ পরিবার। আমরা আগে দেখেছি, অন্যান্য ফরাসি কবিরা প্রায় সকলেই নানা দেশ ঘুরেছেন, বহু অভিজ্ঞতা, বহু নাটকীয় ঘটনা জীবনে। রেনে কাদু-র জীবন একরঙা। ভ্রমণের সুযোগ হয়নি, বাকালরিয়া— অর্থাৎ বি. এ. পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন বলে, বড় চাকরি পাননি কখনও, প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন।
কবিতার বিষয়বস্তু যাই হোক, আজকাল দেখা যায়, সারা পৃথিবীতেই কবিরা নগরবাসী, অথবা রাজধানী-নিবাসী। হপকিন্সের উদাহরণ নিতান্তই ব্যতিক্রম। বাংলা কবিতার কেন্দ্র যেমন কলকাতা শহর। খ্যাতি প্রতিষ্ঠা কিংবা বার্ধক্যে ধর্ম-আশ্রয় কিংবা পল্লীনিবাসে নির্জন বিশ্রামসুখ কখনও কবিদের প্রিয় হলেও যৌবনে রাজধানী বা বড় শহরের পরিবেশ, যেখান থেকে নানান পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে, নতুন বই, নানান কবিদের আড্ডাস্থল— সব কবিদেরই আকর্ষণ। কবিতার ভাষা বা রীতি প্রায় দুমাসে-ছমাসে বদলে যায় বলে, একমাত্র রাজনীতিতেই তার সংস্পর্শে থেকে কবিরা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অর্জনের পথ প্রস্তুত করার চেষ্টা করেন।
আধুনিক কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও বিশিষ্ট হয়েও, রেনে কাদু প্যারিসে এসেছেন মাত্র একবার। জীবন কাটিয়েছেন কর্মস্থল গ্রামাঞ্চলেই। সেই ছায়াময়, শান্ত পরিবেশ তার কবিতায় নতুন সুর ও সরলতা এনে দিয়েছে। তাঁর জন্মস্থান ব্রিটানি বড় স্নিগ্ধ, মনোরম ভূমি। ব্রিটানির সৌন্দর্য ভুবনবিদিত। অনেকেরই নিশ্চয়ই মনে আছে, ফ্রান্স থেকে বহু দূরে তাহিতি দ্বীপে থেকে পল গগ্যাঁ যে শেষ ছবিটি আঁকার চেষ্টা করেছিলেন, তার নাম ব্রিটানির তুষার।]

কবির ঘর

যে দৈবাৎ ঢুকে পড়ে কবির নিজস্ব ঘরে, সে জানে না
এ ঘরের প্রতিটি আসবাব তাকে জাদু করতে পারে
চেয়ার আলমারির কাঠে সব কটি গ্রন্থি ধরে রাখে
যত বিহঙ্গের গান অরণ্যের বুকে আছে, তারও বেশি।
হঠাৎ টেবিল ল্যাম্প মেয়েদের মতো তার গ্রীবার ভঙ্গিমা
মসৃণ দেয়াল থেকে উকি দিতে পারে কোনও পড়ন্ত সন্ধ্যায়
চকিতে সে দেবে ডাক নানা বর্ণ নানা জাতি মৌমাছির ঝাঁক।
ফুটন্ত ফুলের গুচ্ছে তাজা পাঊরুটির গন্ধ সে পারে জাগাতে।
কেননা, এই যে এত নির্জনতা এই ঘরে, তার এত শক্তি
একটি বিস্তৃত হাত অন্যমনে সামান্য আদর করে যদি
এই মূক, অন্ধকার, শান্ত, হিম প্রত্যেকটি বিশাল আসবাবে
জেগে ওঠে— ভোরের আলোয় অমলিন সরল বৃক্ষের চঞ্চলতা।


হেলেনের প্রতি প্রেমের কবিতা

যেমন নদীর শুরু হয়
আপন গতিকে ভালোবেসে
নিজেকে একদম তুমি দ্যাখো
আমার দু হাতে নগ্ন দেহে।

আমি আর কিছুই ভাবিনি
চেয়েছি পাতায় ঢেকে দিতে
তোমার ও শরীরের শীত
আমার দু’হাত বৃক্ষ পাতা

শরীরের প্রাণোচ্ছল জল
তার চেয়ে কত বেশি আর
আছে ভালোবাসার আমার,
নারীর শরীর এক পলক
আমার আঙুলে দোল খায়।

এমন কী সাধ্য ছিল বলো
শুধু একবার চেয়ে দেখা
তোমার ও মর্মর শরীর
সেই চেয়ে দেখা এক পলক
নিতান্তই পাবার বাসনা?

কুমারী, উত্তর দাও তুমি
যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার
আমার হৃদয় মৃদু ঝোঁকে
চাপ দেয় তোমার হৃদয়ে

যদি দেখি কখনও তোমার
রূপান্তরে কোনও অস্থিরতা
তবে সেই অস্থিরতা এই
তোমাকে প্রেমের আগে আমি
তোমার প্রেমকে ভালোবাসি।

[[হেলেন-কে ফরাসিরা উচ্চারণ করে এলেন। বা, ফরাসিদের নাচটিয়ে বলা যায়, এসেনকে ইংরেজরা উচ্চারণ করে হেলেন। যাই হোক, এলেনের বদলে হেলেন-ই সেই ট্রয়ের আমল থেকে পরিচিত। হেলেন একটি সত্যিকার মেয়ের নাম, রেনে কাদুর সঙ্গে মেয়েটির দেখা হয় ১৯৪৩-এ, মৃত্যুর আগে বাকি কয়েক বছরে লেখা হেলেনের প্রতি প্রেমের কবিতাবলীই কাদুর শ্রেষ্ঠ রচনা, এবং এগুলি ফরাসি কবিতায় একটি অন্যরকম সরল ধারার সূচনা হিসেবে স্বীকৃত।]
.
ইভ বনফোয়া

[আমাদের দেশে কবিতার যেমন কোনও ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি, কবিতা বা কবিদের নিয়ে কোনও নিষ্ঠাপূর্ণ আলোচনা আজও শুরু হল না। একটি দেশের কবিতা একটি খরস্রোতা নদীর মতো, এক-একজন বড় কবি এক-একটি গঞ্জ বা বন্দর। মূল কবিতার স্রোত থেকে কোনও কবিকেই সম্পূর্ণ আলাদা করে ছিনিয়ে এনে আলোচনা করা যায় না। আমাদের কোনও জীবিত বাঙালি কবি সম্পর্কে যদি বলা হয়, তিনি মুকুন্দরাম বা বিহারীলাল চক্রবর্তীর ধারার কবি, তবে সেই কবি নিজে তো বটেই, সমালোচকরাও আঁতকে উঠলে। অথচ এরকমভাবে যোগাযোগ টেনে নবীন কবির কোথায় বিশেষত্ব না দেখালে কবিতার আলোচনা সম্পূর্ণ হতে পারে না। বরং, সাম্প্রতিক সমালোচকদের মতে, সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা দেশের সঙ্গে যোগাযোগহীন, বিদেশ-নির্ভর, কৃত্রিম। কিন্তু, সহজ বুদ্ধিতেই বোঝা যায়, এ ব্যাপার অসম্ভব। কবিতার এক হিসেবে স্বদেশ-বিদেশ নেই। আবার, অন্যদিকে কবি যে ভাষায় লিখছেন, সেই ভাষার পূর্বাপর স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যেকোনও কবির পক্ষে অবাস্তবভাবেই অসম্ভব, শারীরিক অসামর্থ্যের মতোই। শুধু চিন্তাধারা নয়, ভাষা ব্যবহারও কবিতা।
এ প্রসঙ্গে মনে এল, কারণ, বনফোয়া, যাকে দ্বিতীয় যুদ্ধোত্তর ফরাসি দেশের সবচেয়ে শক্তিমান কবি বলা হয়, সমালোচকরা তাঁর কবি-চরিত্রের সূত্র পেয়েছেন ভালেরির কবিতায়, এমনকী বহু যুগ পিছিয়ে যোড়শ শতাব্দীর কবি মরিস সেভ-এর রচনায়। পূর্বে আলোচিত কবিদের মধ্যে কতোর সঙ্গে যেমন সমালোচকরা দেখেছেন মালহার্ব বা সারের মিল, দেনো-র সঙ্গে নেভালের, এমনকী আপোলিনেয়ার— যিনি নবীন কবিদের রাজা, তারও সঙ্গে পনেরো শতকের ডাকাতকবি ফ্রাঁসোয়া ভিয়োর (অথবা ভিলো, দুরকমই উচ্চারণ হয় শুনেছি) কবিতার মিল! মিল ঠিক নয়, দূর-সম্পর্কের উত্তরাধিকার।
বনফোয়ার জন্ম ১৯২৩-এ। গণিত এবং দর্শন অধ্যয়ন করেছেন। মধ্যযুগীয় শিল্প-স্থাপত্য-ভাস্কর্যে উৎসাহী। ফরাসিতে শেক্সপিয়র অনুবাদ করেছেন। এখন অধ্যাপনা করেন এবং শিল্প ও কবিতা বিষয়ে প্রবন্ধ লেখেন।]

সত্য নাম

দুর্গ, একদা যা ছিলে তুমি, তোমাকে ডেকেছি মরুভূমি
এই কণ্ঠস্বর আমি নাম রাখি রাত্রি এই মুখ অনাগত;
এবং যখন তুমি ঝরে যাও বন্ধ্যা মৃত্তিকায়
যে বিদ্যুন্মালাখানি তোমাকে এনেছে এই দেশে, সে নাম শূন্যতা।

মৃত্যু, এক তোমার অতীতপ্রিয় দেশ, আমি আসি
শুধুই অনন্তকাল তোমার আঁধারময় পথে।
আমি ধ্বংস করি স্মৃতি, তোমার বাসনা, দেহরূপ
আমি তো তোমার শত্রু, ক্রমশই অতীব নির্দয়।

তোমার নতুন নাম যুদ্ধ রাখি, নিজ হাতে তুলে
তোমার শরীরে দেব যুদ্ধের সমস্ত নিষ্ঠুরতা, অধিকার
করে নেব এই হাতে, তোমার মুখের রেখা, ছিন্নভিন্ন, ম্লান
আমার হৃদয়ে এই দেশ-ঝড়ের আভায় আলোকিত।


সারা রাত

সারাটা রাত ধরে পশুটা ঘোরে ঘরে,
এ পথ কী রকম, ফুরোতে রাজি নয়?
সারা রাত ধরে হরিণ খোঁজে তির,
কারা সে অনাগত, ফিরতে চায় আজ?
সারাটা রাত ধরে ছুরিটা ক্ষত খোঁড়ে,
এ কোন জ্বালা যার পাবার কিছু নেই?
সারাটা রাত ধরে রক্তমাখা দেহে পশুটা গুমরোয়
ঘরের আলোটুকু অস্বীকার করে,
এ কোন মৃত্যু যে কিছুই সারাবে না?


কবিতার শিল্প

রাত্রি থেকে বাইরে আসে রেণুমাখা চোখ
হাত দুটি শুষ্ক, অচঞ্চল
জ্বর নির্বাপিত, হৃদয়কে বলা হল
শুধুই হৃদয় হতে। শিরা-ধমনীতে ছিল একটি দানব
গর্জনের সঙ্গে পালিয়েছে।
মুখের ভিতরে ছিল একটি হতাশাময়, রক্তমাখা স্বর
অবগাহনের পর হয়েছে উদ্ধার।

[প্রথমেই স্বীকার করি, বনফোয়ার সৌন্দর্যনামে যে কবিতাটি আমার সবচেয়ে প্রিয়, সেটি অনুবাদের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। আশা করি, অন্য কেউ করবেন। বনফোয়া শুদ্ধ রসের কবি, ধ্যানময়। তাঁর রচনাশৈলী কঠিন, শব্দ অতিশয় নির্বাচিত। মৃত্যু এবং রাত্রি—এই দুটি বিষয় তার অধিকাংশ কবিতায় ছায়া ফেলে আছে। যদিও তার কবিতা নৈরাশ্যের নয়। মৃত্যুর উপস্থিতিতে যে জীবন আলোকিত, বনফোয়া সেই জীবনের স্তোত্রপাঠক। এখানে মৃত্যু বলতে সামগ্রিক মৃত্যু হয়তো, ক্ষীণভাবে পরমাণু বোমার কথাও উল্লেখ করা যায়। একথা তো আমরা সবাই জানি যে আমেরিকানরা জাপানের হিরোশিমায় বোমা ফেলেছে, কিন্তু তার প্রভাব ও দুশ্চিন্তা সবচেয়ে বেশি ভোগ করেছেন ফরাসি লেখকরা— পিয়ের ইমানুয়েল নামে অপর একজন আধুনিক ফরাসি কবি বলেছেন, আমরা সবাই হিরোশিমার শিশু।
সারা রাত কবিতাটিকে যেমন অধিকার করে আছে রাত্রি সেই রকম, পশু, হরিণের ব্যাকুল ডাক, ছুরিসবই মৃত্যুর প্রতীক, কিন্তু এই রাত্রি ও মৃত্যু কিছুই রূপান্তরিত করতে পারে না, কবি মোটেই বিচলিত না হয়ে তার নিজস্ব নির্লিপ্ত সৌন্দর্য ভোগ করছেন। বনফোয়ার কোনও কবিতাই বিচ্ছিন্ন নয়, বোদলেয়ারের অশিব পুষ্প বা প্যার্সের কবিতাবলীর মতোই, তার প্রায় সব কবিতাই ধারাবাহিক অনুভূতি।]
.
পিলিপ জাকোতে

[এবার আমরা এসে পড়েছি ফরাসি কবিতার সমসাময়িক কবিদের মধ্যে। পাঠক লক্ষ করুন, সমসাময়িক বাঙালি কবিদের সঙ্গে এঁদের কতখানি মিল বা প্রভেদ। পিলিপ জাকোতের জন্ম ১৯২৫-এ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মণীন্দ্র রায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অরুণকুমার সরকার, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নরেশ গুহ প্রমুখদের কাছাকাছি বয়সের ফরাসি কবি বনফোয়া, জাকোতে, আঁদ্রে দু বুশে, রেনে কাদু, জাক দুপা প্রভৃতি। ওঁদের কিছু কিছু কবিতা আলোচনা করলে, বাংলা কবিতা বিষয়ে আমাদের কিছুটা হীনমন্যতা কেটে যাবে।
প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসুদের কল্লোলের বিপ্লবের সময়েই এই দুর্নাম ওঠে যে, আধুনিক বাংলা কবিতার বিষয় বিদেশিদের কাছ থেকে ধার করা। রবীন্দ্রনাথকেও এই দুর্নাম সইতে হয়েছিল কিছুটা। সমালোচকদের এ মনোভাবকে নিশ্চিত হীনমন্যতা বলব। বাংলা কবিতা পৃথিবীর যেকোনও ভাষার কবিতার তুলনায় পশ্চাৎপদ নয়, বরং মনে হয় অগ্রবর্তী, বিদেশের কাছ থেকে গ্রহণ করার কিছু থাকলেও অনুকরণ করার কোনওই প্রয়োজন নেই। বরং, বাংলা কবিতার সুপ্রচার হলে, বিদেশি কবিরাও আমাদের থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করত। কিছু কিছু যে এখন করছে, তা-ও ঠিক।
এখন দেখতে পাচ্ছি, কবিরা অনেক সাধারণ মানুষ হয়ে এসেছেন। এতদিন পর্যন্ত কবিদের একটা মঞ্চ দরকার হত, সাধারণ মানুষের থেকে অনেক উঁচুতে দাঁড়িয়ে তাকে কথা বলতে হত। এমন রটনা ছিল যে, কবি একজন দুর্লভ-জন্মা, সে প্রবক্তা, মুক্তিদাতা। বিচারক যেমন আদালতের বাইরে একজন সাধারণ মানুষ, অন্য সকলেরই মতো চেহারা, এমনকী আসামির মতোই কিন্তু বিচারের সময় কেন যেন তাকে সাধারণ থাকলে চলে না, তাকে বসতে হয় উচ্চাসনে, মাথায় পরে নিতে হয় সাদা পরচুলা— তেমনি কবির উপরেও অসাধারণত্বের পোশাক চাপানো ছিল— এই শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত। এখন লম্বা চুল, কাঁধে-চাদরের রূপ খুলে ফেলে কবি মিশে গেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে, বা লুকিয়েছে। তার ব্যবহৃত শব্দ আর পাঁচজনের মুখে ভাষা, তার বিষয় তার নিজের জীবন। জাকোতেও এই আধুনিক জগতের কবি। তাঁর ব্যবহৃত ছবি কোনও বৃহতের বা অলৌকিকের আভাস আনে না, নিজের জীবনকেই উদ্ভাসিত করে।
জাকোতের জন্ম সুইটসারল্যান্ডে। লুসান বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনো করার পর, এখন সমালোচকের কাজ করেন। হোমার এবং জার্মানির ঔপন্যাসিক মুজিলের অনুবাদ করেছেন।]

আমাদের এ জীবনে যেহেতু এসেছি আমি

আমাদের এ জীবনে যেহেতু এসেছি আমি এক আগন্তুক
শুধুই তোমার সঙ্গে কথা বলি অজানা ভাষায়,
কেননা তুমিই বুঝি হতে পারো একমাত্র আমার স্বদেশ,
আমার বসন্ত, টুকরো খড়কুটোর বাসা, বৃষ্টিপাত বৃক্ষশাখে

সকালের আলো ভেঙে কেঁপেছে আমার এই জলের মৌচাক
জায়মান রাত্রির-মাধুর্য…(যদিও জেনেছি আমি এই তো সময়
সুখময় দেহগুলি আলিঙ্গন করে তাকে প্রেমের আশ্লেষে,
তৃপ্তির শীৎকার ওঠে— কোনও একটি কৃশাঙ্গ তরুণী

বিরলে রোদন করে শীতের উঠোনে। আর তুমি? তুমি নেই?
এ শহরে, তুমি তো যাও না হেঁটে রাত্রির সম্মুখে দেখা দিতে;
এই তো সময়, যখন নির্জন আমি, অদুষ্কর শব্দের বন্ধনে

একটি বাস্তব মুখ মনে আনি…) হে সুপক্ক ফল,
সোনালি পথের উৎস, আইভি উদ্যান— আমি শুধু তোমাকেই
ডাকি, তোমাকেই বলি, হে আমার অনাগত, নিজস্ব পৃথিবী…


অভ্যন্তর

এই সেই জায়গা, আমি চেষ্টা করছি জীবন কাটাতে
এই আমার ঘর, আমি ভালোবাসার ভান করি
এই টেবিল, যাবতীয় জড়বস্তু;— একটি জানালা
প্রতিটি আঁধার থেকে ঠেলে আনে সবুজ সীমানা।
হৃৎস্পন্দনের মতো কোকিলের ডাক ওঠে ঘন আইভি-ঝোপে
ভোরের প্রথম আলো হঠাৎ ঝাপিয়ে পড়ে
পলাতক ছায়ার উপরে।
এই তো আমার ঘর, আমি এখানেই থাকব, খুব চমৎকার
ভাবে মেনে নিতে রাজি আছি, দিনভরা বহু প্রতিশ্রুতি।
কিন্তু এই মাকড়শাটা বিছানার পায়ের ওপাশে
(এসেছে বাগান থেকে, মনে হয়) অবিরাম বুনে যাচ্ছে জাল—
বহু চেষ্টা করে আমি ঠিকমতো পিষে ফেলতে পারিনি ওটাকে,
এই জাল ঘিরে ফেলে, ঢাকে, স্বচ্ছ আমার অস্তিত্ব।

[জাকোতে যেহেতু সমসাময়িক কবি, সুতরাং তার কিছু নিন্দে শুরু করা যাক! এই কবির এখনও সনেট লেখার দুর্বলতা আছে। অথচ, পৃথিবীর প্রায় সমস্ত আধুনিক কবিই এখন সনেট লেখা অত্যন্ত কঁচা কাজ বলে মনে করেন, কারণ, কবিতাটি লেখার আগেই বা লিখতে লিখতে কবিকে যদি আঙ্গিক সম্বন্ধে সব সময় সজাগ থাকতে হয়, বা কবিতাটি ঠিক কলাইনে গিয়ে শেষ হবে মনে রাখতে হয় তবে সেটা কবির নিশ্চিত পরাজয়। এই কৃত্রিমতা কবিরা আজকাল পরিহার করেছেন। জাকোতের এই দ্বিতীয় কবিতার শেষেও মাকড়শার জালের উল্লেখ খুব দুর্বল। জীবনের জটিলতা-ফটিলতা বোঝাতে মাকড়শার জালের ছবি আঁকা খুবই পুরনো হয়ে গেছে। সিনেমায় বা স্টেজে মাকড়শার জাল দেখানো এখনও খুব আধুনিকতা কিন্তু বাংলা দেশের যেকোনও সদ্য শুরু করা আধুনিক কবিও জানেন, ও জিনিস বহুব্যবহৃত, এখন পরিত্যাজ্য।
জাকোতের বিশেষত্ব, তাঁর কবিতায় সব সময় একটা অনুসন্ধান আছে— শব্দের মধ্য দিয়ে তিনি বারবার কবিতার একটা মূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন, এবং সে মূর্তি কখনওই সম্পূর্ণ হয় না। প্রথম কবিতায়, কবি একজন পরবাসী, তিনি নিজের প্রেয়সীকে খুঁজছেন, সেই সঙ্গে স্বদেশ, কারণ, বাসভূমি না পেলে প্রেয়সীকেও পাওয়া যাবে না। বারবার প্রেয়সী এবং স্বদেশের ছবি মিলে যাচ্ছে, কবির সন্দেহ, তার ভাষা হয়তো তার অনুসন্ধান ব্যক্ত করতে পারছে না।]

দু’জন নিগ্রো কবি

[ফরাসি দেশের বাইরে আগেকার ফরাসি উপনিবেশগুলিতে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে যে কয়েকজন ফরাসি ভাষায় কবিতা লিখেছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দু’জন, এমে সেজার এবং লেওপোন্ড সেদার সেঙ্ঘর। এঁদের মধ্যে, এমে সেজারের কবিত্ব বহুজনস্বীকৃত, তিনি সুররিয়ালিস্ট কবিদের অন্যতম, এবং উল্লেখযোগ্য ফরাসি কবিদের সম্পর্কে আলোচনায় তার নাম প্রায়ই দেখা যায়; যদিও আশ্চর্যের বিষয়, বহু কবিতা সংকলনে তিনি অবহেলিত। সেঙ্ঘরের কবিত্ববোধ খুব সুক্ষ্ম না হলেও, তিনিও যথেষ্ট বিখ্যাত এবং আফ্রিকার একটি নবীন রাষ্ট্রের তিনি রাষ্ট্রপতি এখন।
এককালের ভারতীয়দের কাছে বিলেতের মতো, ফরাসি উপনিবেশের প্রতিভাশালী তরুণরাও প্যারিসে লেখাপড়া শিখতে যেতেন। বর্ণ-বৈষম্যের বিষ এঁরাও সহ্য করেছেন। একটি ফলের ব্যবসায়ী ভাল ভাল মর্তমান কলার বিজ্ঞাপন দিয়ে প্যারিসের দেয়ালে দেয়ালে প্রায়ই পোস্টার লাগান। সেই পোস্টারের ছবিতে আছে, একটি নিগ্রো আহ্লাদের সঙ্গে কলা খাচ্ছে। কালো কুচকুচে চেহারার নিগ্রো হলদে রঙের পুরুষ্ট কলা মুখে দিয়ে আছে— ছবিটা হাস্য উদ্রেক করে। দুঃখিত সেঙ্ঘর যুবক বয়সে প্যারিসের পথে পথে ঘোরার সময় লিখেছিলেন, আমার ইচ্ছে করে প্যারিসের দেয়াল থেকে ওই হাসিমাখা মুখগুলো উপড়ে নিতে!
আমরা দু’জনের কবিতা অনুবাদ না করে, এমে সেজারকে লেখা সেঘরের একটি কবিতা তুলে দিলাম। খাঁটি কবিতার আস্বাদ এতে হয়তো পাওয়া যাবে না কিন্তু একজন সমসাময়িক কবির প্রতি অপর কবির এমন আন্তরিক আহ্বান ও শ্রদ্ধার চিহ্ন দুর্লভ। কবিতাটি খানিকটা অভিমানেরও। কবিতার সুউচ্চ স্বর্গ থেকে তিনি সেজারকে দেশের মাটিতে নেমে আসতে বলছেন।]

লেওপোল্ড সেঙ্ঘর
এমে সেজারকে চিঠি

প্রিয় ভ্রাতা এবং বন্ধুর প্রতি আমার সংক্ষিপ্ত এবং সহোদরপম শুভেচ্ছা
বোকা কালো মানুষের দল এবং দুর দুরান্ত পরিভ্রমণকারীরা তোমার প্রতি
মশলা সুগন্ধ এবং দক্ষিণের নদী ও দ্বীপের শব্দে ভরা
সমৃদ্ধ ভাষায় প্রশস্তি জানিয়েছে।
তোমার প্রশস্ত কপাল এবং তোমার সূক্ষ্ম ওষ্ঠের ফুলের প্রতি ওদের স্তুতি
তোমার শিষ্যদের জন্য শ্রদ্ধা এক মৌচাক স্তব্ধতা,
ময়ুরের বর্ণময় পাখা
চাঁদ ওঠার আগে পর্যন্ত যে তুমি ওদের উৎসাহকে তৃষ্ণাময়
এবং অতৃপ্ত রেখে দাও
সে কি তোমার রূপকথার ফলের মিষ্টি গন্ধ না দুপুরে
মাঠে হলকর্ষণের আলো?
সাপাডিলার ছালপরা নারীরা তোমার আত্মার সেরালিও-তে
বসতি করে।

তোমার জীবন্ত জ্বলন্ত অঙ্গারে আমি সময় ছাড়িয়ে মুগ্ধ
ছাইমাখা চোখের পাতা ছাড়িয়ে– তোমার সংগীতের প্রতি
আমাদের অতীত বছরের হাত ও শ্রদ্ধা বাড়িয়েছি
তুমি কি ভুলে গেছ তোমার মহত্ত্ব, তোমার কথা ছিল
পিতৃপুরুষ, রাজকুমারের দল ও ঈশ্বরের গান করা
ফুল নয়, কুয়াশা নয়।
আমাদের আত্মায় তুমি এনে দেবে তোমার বাগানের সাদা ফুল
ফুল শুধু খাদ্য, ফসলের বৎসরেই ফুটেছে
তোমার নিশ্বাস সুগন্ধ করে নিতে তুমি তার একটি
পাপড়িও চুরি করবে না
অতীত ঘটনার কুণ্ড থেকে আমি তোমার মুখ স্পর্শ করি
তরুণ প্রণয়কে সতেজ করার জন্য আমি বসন্তকে ডাকি
তুমি রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছ, একটি ছোট পাহাড়ে বাহুর ভর
তোমার শয্যার চাপে ভূমি ঈষৎ দুঃখিত।
জলে ডোবা জমিতে দুঃখিত ঢাকের বাজনা তোমার গান গায়
তোমার কবিতা রাত্রি এবং দূর সমুদ্রের নিশ্বাস।
তুমি সংগীত ও ছন্দের নিখাদে আকাশ থেকে একটি তারা ছিঁড়ে আনবে
হতভাগ্য দরিদ্রেরা সারা বছরের উপার্জন দেবে তোমার পায়ে
তোমার নগ্ন পায়ের কাছে মেয়েরা ডালি দেবে তাদের রজন হৃৎপিণ্ড
দেখাবে পরাজিত আত্মার নাচ।

হে বন্ধু, তোমাকে ফিরতে হবে
আমি তোমার প্রতীক্ষায় থাকব– কেইসড্রাটি গাছের নীচে
জলপোতের অধিপতির কাছে আমি এই গোপন কথা বলেছি।
অনেক প্রতিশ্রুতি নিয়ে তুমি ফিরে আসবে। সূর্য ড়ুবে গেলে
ম্লান রাত্রি যখন ভর করে বাড়ির ছাদে
খেলোয়াড়েরা যখন বরের বেশে যৌবন দেখায়।
সেই কি তোমার ফিরে আসার চিহ্ন?

[সাপাডিলা এক ধরনের চিরহরিৎ বৃক্ষ, হলদে-ছাই-রঙা ফল হয়। সেরালিও (Seraglio), তুর্কি সেরাই শব্দের সঙ্গে মিল আছে কিছুটা, বন্ধ ঘর যেখানে কোনও মুসলমান তার স্ত্রী বা রক্ষিতাকে আতে রাখেন। ছোট হারেম বলা যায়। কেইসড্রাট কী ধরনের গাছ আমি জানি না। আফ্রিকার কয়েকটি প্রবাদ বা উপকথারও উল্লেখ আছে সেগুলো আমার জানা নেই।]