রহস্যময় দুর্গ – ৯

নয়

ঢেউয়ের দোলায় দুলতে-দুলতে ছোট্ট নৌকোটা হর্সশু ফল্স্ অভিমুখে চলেছে।

অনেক ওপর থেকে, সবেগে আছড়ে পড়ছে পান্না-সবুজ পানি, দেখে মনে হচ্ছে যেন ধোঁয়াটে সাদা স্প্রে ছড়াচ্ছে কেউ।

‘কী অপূর্ব!’ জলপ্রপাতের গর্জন ছাপিয়ে চেঁচাতে বাধ্য হলো কিশোর।

মুখে সুচের মত জলকণার খোঁচা খেতেই হেসে উঠল টিনা।

‘আমি ডুবে যাচ্ছি!’

রেইন-স্পিকারে মোড়া কিশোর আর টিনা ফ্রেডির সঙ্গে মেইড অভ দ্য মিস্ট-এর বো-তে দাঁড়িয়ে, ফেনিল সবুজাভ পানির বিরুদ্ধে রীতিমত যুঝছে নৌকোটা। সাদা স্প্রে ছাড়া এখন আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না কিশোর, চোখে-মুখে জলকণার দংশনে অন্ধ হওয়ার দশা ওর। ভয় হলো ক্যাপ্টেন হয়তো অনেক বেশি কাছে নিয়ে গেছেন ওদেরকে এবং জলপ্রপাতটি সরোষে ভেঙে টুকরো-টুকরো করে দেবে ওদের ছোট্ট নৌকোটাকে। বহু বছর ধরেই পর্যটকরা জলপ্রপাতের বুকের গভীরে ঢুকছে এসব দুঃসাহসী ছোট-ছোট নৌকোয় চেপে।

ক্যাপ্টেন বোটটিকে রিভার্সে দিলেন এবং মেইড অভ দ্য মিস্ট ধীরেসুস্থে, আলগোছে বেরিয়ে এল পানির স্প্রে থেকে। জিভ দিয়ে ঠোঁট থেকে জলবিন্দু চেটে হেসে ফেলল কিশোর।

ফ্রেডি তাঁর স্পিকারের হুডটা ফেলে দিয়ে, ঢেউ খেলানো বাদামি চুল ঝেড়ে পানি ফেললেন। এবার জলপ্রপাতের শীর্ষ স্থানটি লক্ষ্য করে আঙুল তাক করলেন, উঁচু এক পাহাড় থেকে একদল লোক মেইড অভ দ্য মিস্ট-কে দেখছে।

‘ওটার নাম টেব্‌ল্ রক হাউস। ওখান থেকে, এলিভেটরে করে টুরিস্টদেরকে পাথরের গভীরে সুড়ঙ্গগুলোতে নিয়ে যায়, জলপ্রপাতের পেছনে খোলা জায়গায় গিয়ে মিশেছে ওগুলো। চলো, যাই।’

‘কোন বিপদ-আপদ হবে না তো?’ টিনার প্রশ্ন।

‘হবে না আশা করি!’ জবাব দিলেন ফ্রেডি।

বোটটা চরকির মতন ঘুরে, ডকের উদ্দেশে রওনা হলো। বিপুল জলরাশির পতনের ফলে তৈরি হওয়া বায়ুতরঙ্গে গাল-দের সাঁ করে নেমে আসতে আর উড়ে উঠতে দেখল কিশোর। গিরিসঙ্কটের সবুজ পানির ওপরে মিহি কুয়াশার আস্তরণ, এবং বাতাসে আশ্চর্যরকমের সতেজ ঘ্রাণ।

‘কী দুর্দান্ত অনুভূতি! আমার জীবনের সেরা দিন আজ!’ মন্তব্য করল টিনা।

মুচকি হাসলেন ফ্রেডি।

‘এখনও অনেক কিছুই দেখার বাকি।’

ডক করার পর, রেইন-স্পিকারগুলো ফিরিয়ে দিয়ে, ফ্রেডি আর টিনা ভেজা চুল আঁচড়াতে কোম্পানির জোগান দেয়া আয়নার সামনে দাঁড়াল। কিশোর স্রেফ চুলে আঙুল চালাল, তারপর ব্লু জ্যে ক্যাপটা মাথায় চাপিয়ে টিম-জ্যাকেটটা টেনেটুনে ঠিকঠাক করে নিল, অভিযানের’ পরবর্তী পর্বের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ও।

একটু পরে, এলিভেটরে চেপে গিরিসঙ্কটের মাথায় উঠে এল ওরা, ফ্রেডি তাঁর স্পোর্টস কারটা রেখেছিলেন ওখানে।

‘ওই যে, রেইনবো ব্রিজ,’ বলে, আঙুল নির্দেশ করলেন। ‘ওটা দিয়ে জলপ্রপাতের আমেরিকান অংশে যাওয়া যায়।’

‘তারমানে গিরিসঙ্কটের ওপাশেই আমেরিকা?’ কিশোরের প্রশ্ন।

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালেন ফ্রেডি।

‘আমরা সেতুটা পেরিয়ে আমেরিকান ভিউপয়েন্ট থেকে ফল্স্টাকে দেখব, তবে তার আগে সুড়ঙ্গগুলো দেখে নিই, চলো।’

‘ওখান থেকে বেঁচে ফিরলেই হয়,’ ঠাট্টা করে বলল কিশোর।

.

একটু পরে, ওরা টে রক হাউসের উদ্দেশে হাঁটছে, এসময় টিনা হঠাৎই এক নিউজপেপার বক্সের দিকে তর্জনী দেখাল।

‘অ্যাই, কিশোর, হেডলাইনটা দেখো!’

স্যর ডয়েলের ছবির নিচে, বিশাল কালো শিরোনামে লেখা হীরা পাচার রোধে সীমান্তে সতর্কতা। বক্সে একটা কয়েন ঢুকিয়ে, একটা কাগজ রীতিমত ছিনিয়ে নিয়ে আর্টিকল্টায় দ্রুত চোখ বোলাল টিনা।

‘এবার সব ব্যাখ্যা পাওয়া গেল!’

‘কী লিখেছে, টিনা?

খবরের কাগজটা থেকে মুখ তুলল টিনা, চোখজোড়া উত্তেজনায় চকচক করছে ওর।

‘আমরা কাসা লোমায় যে হীরেগুলো পেয়েছিলাম ওগুলো নকল ছিল! কোয়ার্ট থেকে বানানো সস্তা ইমিটেশন। পুলিসের ধারণা আসল হীরেগুলো চুরি গেছে দুর্গ থেকে।

‘সীমান্তে সতর্কতা কেন?’ ফ্রেডির প্রশ্ন।

‘পুলিসের প্রাথমিক ধারণা দু’জন আমেরিকান এই চুরির হোতা, এবং তারা সম্ভবত আমেরিকার দিকে চলেছে হীরেগুলো নিয়ে। সীমান্তের চেকপয়েন্টগুলোতে পর্যটকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, এবং কাউকে-কাউকে সার্চও করছে।’

‘খাসা স্টোরি করেছে তো!’ আর্টিকলটা পড়ার সময় ফ্রেডিকে ঈর্ষান্বিত দেখাল। ‘মাঝেমধ্যে মনে হয় স্পোর্টসে না থেকে যদি টিভি নিউজে থাকতাম! তাহলে এমন অনেক চাঞ্চল্যকর খবর __ আনতে পারতাম। নেটওয়র্ক টিভির একজন উপস্থাপক হতে পারতাম আমিও।’

লেখাটা পড়তে লাগল কিশোর।

‘ভাগ্যিস স্যর ডয়েল কাল রাতে বাসায় ফিরেছিলেন, নইলে সত্যটা অজানাই থাকত।’

টিনা মাথা ঝাঁকাল।

‘পড়ে যাও, কিশোর। স্যর ডয়েল বাসায় ফেরার অনেক আগেই পুলিস জানত হীরেগুলো যে নকল।’

‘কীভাবে?’

জবাবটা কারও জানা নেই। কিশোর খেলার পাতায় চলে গেল, আশা করেছিল জিম লেকারের সঙ্গে ওদের যে ছবিটা ফ্রেডি তুলেছিলেন সেটা দেখবে, কিন্তু একমাত্র ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে জিম উড়ন্ত মানবের মত এক দর্শনীয় ক্যাচ লুফছেন। ছবিটার নিচে ক্যাপশন লিখেছে: জিম লেকার-আমেরিকার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়!

হাতঘড়ি দেখলেন ফ্রেডি

‘এসো।’

টেব্‌ল্ রক হাউসের প্রবেশপথের বাইরে দাঁড়াল ওরা, গিরিসঙ্কটটা এক নজর দেখার জন্য। ও-ই নিচে, সাদা ফেনার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে মেইড অভ দ্য মিস্ট; সবুজরঙা কী বিপুল জলপ্রবাহ আছড়ে পড়ছে নিচে দেখে শিহরন অনুভব করল কিশোর।

‘কেউ যদি জলপ্রপাত থেকে নিচে পড়ে যায় তাহলে কী হবে? স্রেফ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে!’ বলল ও।

সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকালেন ফ্রেডি।

‘অনেক মানুষ মারা পড়েছে এখানে। তবে কয়েকজন বেঁচেও গেছে।’

‘বলেন কী?!’

জলপ্রপাতে পড়ার আগে পরপর কয়েকটি উতরাই ভেদ করে বয়ে চলা চওড়া, খরস্রোতা নদীটির দিকে আঙুল-ইশারা করলেন ফ্রেডি।

‘১৯০১ সালে, ওকের এক পিপেয় চেপে এক বিধবা টিচার নদী পাড়ি দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন তাৎক্ষণিক নাম-যশ কামাবেন, বেঁচে যাওয়া প্রথম মানুষ হিসেবে।

‘উনি কি বেঁচেছিলেন?’ টিনা জানতে চাইল।

‘হ্যাঁ, কিন্তু টাকা অল্প যেটুকু কামান তা ওই পিপের পাশে দাঁড়িয়ে তোলা, অটোগ্রাফসহ ছবি বেচে। মহিলার মৃত্যু হয় চরম আর্থিক দুর্দশার মধ্যে। এর পরে তাঁর দেখাদেখি আরেকজন পিপেয় চেপে নিরাপদে পাড়ি জমায়, তবে পরে বেচারা মারা যায় কমলার খোসায় পা পিছলে পড়ে।’

গর্জনশীল জলপ্রবাহের দিকে সবিস্ময়ে চেয়ে রইল কিশোর, বিশ্বাস করতে পারছে না অতীতে এখানে এত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটেছে।

‘স্কুলে মিস্টার অস্টিন বলেছিলেন একটা বাচ্চা নাকি এখান থেকে বেঁচে ফিরেছিল!’ বলল টিনা।

মাথা ঝাঁকালেন ফ্রেডি।

‘সাত বছরের এক বাচ্চা একবার নদীতে নৌকা দুর্ঘটনায় পড়ে। লাইফ জ্যাকেট ওকে ভাসিয়ে রাখে সব কটা উতরাইয়ে, এবং বাচ্চাটা এতটাই হালকা ছিল যে সোজা জলপ্রপাতের ওপর থেকে পড়ে যায়। পাথরগুলোর ওপাশে পড়ে ও, আর ওকে তুলে নেয় মেইড অভ দ্য মিস্ট। অল্প দু’এক জায়গায় কেটে-ছড়ে গেলেও অলৌকিকভাবে একদম অক্ষতই ছিল বাচ্চাটা।’

জলপ্রপাতের ঠোঁটের কাছে, অতিকায় দুই পাথরের মাঝে আটকে থাকা এক গাছের গুঁড়ির দিকে চাইল টিনা, এবার চোখ রাখল ফেনায়িত সাদা ঢলগুলোর উদ্দেশে।

‘এরকম বিপজ্জনক নদীতে বোটিং করার কথা ভাবা যায়?! স্রেফ পাগলামি না?’ বলল ও।

শব্দ করে হাসলেন ফ্রেডি।

‘একদম। যদিও আমি স্পোর্টস্ ভালবাসি, কিন্তু নায়াগ্রার উতরাই দিয়ে নৌকাভ্রমণের কথা ভাবতেও পারি না। আমার অত থ্রিলের দরকার নেই, বাবা!’

‘থ্রিলের কথা যখন উঠলই, ওই সুড়ঙ্গগুলো ট্রাই করলে হয় না?’ প্রস্তাব করল কিশোর।

‘এসো!’

টেব্‌ল্ রক হাউসের ভেতরে, এক চেঞ্জিং-রুমের দিকে যেতে বলা হলো ওদেরকে। সায়েন্স ফিকশন মুভির দৃশ্য থেকে যেন তুলে আনা হয়েছে কামরাটিকে। হলদে পোশাক পরা অ্যাটেনডেন্টরা সুড়ঙ্গে ঢোকার উপযোগী করে তৈরি করছে টুরিস্টদেরকে। পায়ের জুতো খুলে পরানো হচ্ছে বিশাল গামবুট আর প্রত্যেককে মুড়ে দিচ্ছে কালো রবারের রেইন-স্পিকার আর হুড দিয়ে। ফ্রেডির পরামর্শে, কিশোর আর টিনা ওদের ব্লু জ্যে ক্যাপ আর টিম-জ্যাকেটের ওপরেই গায়ে চড়াল ওগুলো।

‘তোমাদের ওই কাপড়গুলো মহামূল্যবান,’ বললেন ফ্রেডি, স্মিত হাসলেন।

টলতে-টলতে এলিভেটরের উদ্দেশে চলল কিশোর, গামবুটের ভেতরে বারবার হড়কাচ্ছে পাজোড়া। রবারের তেলতেলে হুডের নিচে ঢাকা পড়েছে ওর মাথা। হাসিমুখে লক্ষ করল, টুরিস্টদের বড়সড় এক দল বিদেশী ভাষায় মহানন্দে কিচিরমিচির করছে আর নিজেদের কালো গিয়ার পরা ছবি তুলছে।

এবার সবাই এলিভেটরে গাদাগাদি করে চাপল নিচে নামার জন্য। উত্তেজিত আলাপচারিতা চলল, যতক্ষণ না এলিভেটরের দরজা কোন আগাম সতর্কতা ছাড়াই খুলে গেল। এবার পর্যটকরা জলপ্রপাতের কানে তালা লাগানো আওয়াজে একদম চুপ হয়ে গেল।

সরু সুড়ঙ্গটি বজ্রপাতের শব্দ করে ভরিয়ে তুলল পানি। এক পর্যটকের ছোট এক বাচ্চা কান্না জুড়ে দিল। দলটা এলিভেটর থেকে টলমল পায়ে বেরিয়ে আসার সময় ওর বাবা কোলে তুলে নিলেন ছেলেকে।

‘এদিকে,’ চেঁচালেন ফ্রেডি, সুড়ঙ্গ বরাবর আঙুল দেখালেন। কিশোর মাথা ঝাঁকিয়ে মৃদু হাসল, তবে হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুততর হয়েছে ওর। পানির প্রচণ্ড শব্দে তালা লেগেছে কানে, ভাবল জীবনের দুর্দান্ত এক অভিজ্ঞতা হতে চলেছে এটা। অবশ্য নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা নেই। ঝুঁকি থাকলে নিশ্চয়ই ভ্রমণপিপাসুদের এখানে আসতে দিত না কর্তৃপক্ষ। আহা, মুসা আর রবিনও যদি এখন থাকত ওর সঙ্গে! দীর্ঘশ্বাস পড়ল কিশোরের।

‘দারুণ না?’ পরমুহূর্তে, টিনার উদ্দেশে চেঁচাল ও।

নার্ভাস হাসল টিনা।

‘ফ্রেড়ি নিশ্চয়ই জানেন কী করছেন! আমি এখান থেকে পড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেও পারি না।’

‘চিন্তা কোরো না, কিছু হবে না!’

দীর্ঘ সুড়ঙ্গটিতে কমলা, সাদা আর লাল বাতির সারি। অন্যান্য পর্যটকদের ভুতুড়ে অবয়ব দেখামাত্রই আবারও এক সায়েন্স ফিকশন ছায়াছবির দৃশ্যের কথা মনে পড়ল কিশোরের।

একই ধরনের কালো স্পিকারের ভেতরে লুকানো সবাই, কেউ যদি এখানে খুনও করে চেনা যাবে না তাকে।

এক কোনা ঘুরতেই, সহসা পানি দেখতে পেল ও।

সাদা, নিরেট এক চাদরের মতন নিচে পড়ছে বিপুল জলপ্রবাহ, পাথরের ওপর সগর্জনে আছড়ে পড়ে, জলকণার মেঘ হয়ে উঠে এসে ধোঁয়ার মত ঢুকছে সুড়ঙ্গমুখ দিয়ে। মন্ত্রমুগ্ধের মত একদৃষ্টে চেয়ে রইল কিশোর।

শেষমেশ, পিছিয়ে গেল ও, আরেকটা সুড়ঙ্গ দিয়ে অন্য এক খোলা মুখের কাছে চলে এল। এখানে পর্যটকদের সংখ্যা আরও বেশি, নিজের পালা এলে কাঠের পলকা পাটাতনটার দিকে এগোবে বলে অপেক্ষা করছে, দেখল ওটায় সতর্কবাণী লেখা-বিপজ্জনক: সাবধান!

ঠিক সে মুহূর্তে, পাটাতনের ওপর দাঁড়ানো লোকটা ঘাড় কাত করে এদিকে চাইল। ওটা কাসা লোমার খানসামা জন।