গোপন সৈকতে – ৮

আট

সেদিন লাঞ্চে, ক্যাফেটেরিয়ার লাইন বরাবর এগনোর সময় ছেলে- মেয়েদের নাগাল ধরল জো ইলিয়ট।

‘কী খবর, ডন?’ খোশমেজাজের সঙ্গে জানতে চাইল। ‘কি ওয়েস্টে ভাল লাগল?’

‘আমরা এক ভাঙা জাহাজ থেকে উদ্ধার করা কিছু গুপ্তধন দেখেছি, আর আমি এক সত্যিকারের সোনার বার ছুঁয়েছি,’ ডন বলল তাকে। সামনে সাজানো কোন্ খাবারটা নেবে ভাবছে। হট ডগ, নাকি গ্রিড্ চিয স্যাণ্ডউইচ?

কিশোর আবারও ভেবে পেল না লোকটা এত ঘেঁষতে চাইছে কেন ওদের সঙ্গে। এবং অন্য এক ব্যাপার রীতিমত সন্দিগ্ধ করে তুলেছে গোয়েন্দাপ্রধানকে। জো সারসের মত গলা বাড়িয়ে ডনের গলার দিকে তাকানোর চেষ্টা করছে। কেন?

মুহূর্তখানেক পরে, রহস্যটার জবাব মিলল।

‘তোমার গলার কয়েনটা সুন্দর, ডন। ডকে কি এটাই খুঁজে পেয়েছিলে?’

মাথা ঝাঁকাল ডন, বড় এক পাত্র আম আর পেঁপে নিল নিজের জন্য।

‘একটু দেখতে পারি?’ বলল জো। ‘কয়েন আমাকে সবসময়ই টানে।’

‘নিশ্চয়ই,’ অন্যমনস্ক কণ্ঠে বলল ডন। কয়েনটা গলা থেকে দূরে ধরল জো যাতে দেখতে পায়। ‘কিশোরভাই এটায় ফুটো করে দিয়েছে। নকশাটা কী সুন্দর দেখেছেন? ওপরের কটা অক্ষর এখনও পড়া যায়- ‘

মুদ্রাটা পরখের সময় চোখজোড়া সরু হলো জো-র, এবার সরে গেল। মহাবিরক্ত।

‘হ্যাঁ, কয়েনটা দারুণ, বাছা।’ কর্কশ শোনাল ওর কণ্ঠস্বর। ‘ভাল থেকো।’ র‍্যাকে শূন্য ট্রেটা রেখে তড়িঘড়ি ক্যাফেটেরিয়া ছাড়ল।

রবিনকে কনুইয়ের আলতো গুঁতো দিল মুসা।

‘ব্যাপারটা কী?’

‘জানি না।’ রবিন চাইল ডনের উদ্দেশে, ও তখন এক গ্লাস দুধের দিকে হাত বাড়িয়েছে। এটা ভেবে খুশি হলো ও, বাচ্চা ছেলেটা অন্তত জো-র রুক্ষ ব্যবহারে মন খারাপ করেনি।

‘খাইছে, জো ইলিয়টের ব্যবহার কেমন অদ্ভুত না?’ মুসার প্রশ্ন।

মাথা ঝাঁকাল রবিন।

‘খুবই অদ্ভুত। এই সে বন্ধুর মত আচরণ করছে তো পরের মিনিটেই এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন আমাদের পছন্দই করে না।’

লাঞ্চ খাচ্ছে ওরা। ডন জানাল ও উইণ্ড-সার্ফিং সিমুলেটর অনুশীলন করতে চায়।

‘ও অনেক উন্নতি করেছে,’ ওদেরকে জানাল কিশোর। ‘এমা বলেছে শীঘ্রি পানিতে নামতে পারবে।’

‘অগভীর পানিতে,’ বলল এমা, ওর পাশে এক চেয়ারে বসে পড়ল। ‘লাইফ প্রিজার্ভার সহ।’

রবিন মাথা ওপর-নিচ করল। ক্যাম্প কোরালে সবার আগে নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেয়া হয়।

‘কোস্ট গার্ড কিছু জানিয়েছে?’ এমাকে জিজ্ঞেস করল ও।

‘না, ওরা এখন পর্যন্ত কোন লিড পায়নি,’ পরিতাপের সঙ্গে বলল এমা। ‘মিস্টার সোবার্সকে বলেছি আমরা সবাই চোখ-কান খোলা রাখব, এছাড়া তো আমাদের আর কিছু করারও নেই।’ একটু বিরতি নিয়ে ভিড়ে ঠাসা ক্যাফেটেরিয়ায় চোখ বোলাল। ‘যদি না চোর আবার চুরি করে।’

‘চোরটা কি আবার আসবে?’ ডনের চোখ রসগোল্লা। ক্যাম্প থেকে বিদায় নেয়ার আগেই প্রবাল চোরকে ধরতে চায় ও। চোর পাকড়াও হয়েছে শুনলে জ্যাক নানা কী খুশিটাই না হবেন!

‘আমি শিয়োর আসবে,’ গোমড়া মুখে বলল এমা। ‘নৌকা ভর্তি প্রবালের জন্যে কী পরিমাণ টাকা পাচ্ছে মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না। কালই একটা রিপোর্ট দেখছিলাম। বাজি ধরে বলতে পারি চোর লোভ সামলাতে পারবে না, আবার হানা দেবে।’

‘ক্যাম্পেরই কেউ কাজটা করছে, তাই না?’ সু কি জিজ্ঞেস করল। একটু আগেই এমাকে কামরাটা জরিপ করতে দেখেছে ও।

সায় জানাল এমা।

‘দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি।’ পনিটেইল করা এক লাজুক চেহারার তরুণীকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকল ও। ‘এক্সকিউজ মি,’ বলে, চেয়ারটা পেছনে ঠেলে দিল। ‘মেয়েটা নতুন ক্যাম্পার, এখানে নিজেকে ঠিক মানাতে পারছে না। বাড়ির জন্যে ওর মন খারাপ।’

.

সারাদিন রোদে ঘোরাঘুরি করে সবাই আজ আগেভাগেই কেবিনে ফিরল। মাঝরাতের দিকে আচমকা ঘুম ভাঙল রবিনের। বাইরে থেকে আজব এক শব্দ আসছে, বিছানায় উঠে বসে কান পাতল ও। ভট-ভট। ভট-ভট।

‘কে যেন বোট চালু করেছে,’ মৃদুস্বরে বলল। রাতের বেলা বোট ব্যবহার করা নিষেধ, জানে ও।

ঝটপট মুসা আর সু কির ঘুম ভাঙাল।

‘আওয়াজটা শুনেছ?’ বলে, খোলা জানালার উদ্দেশে আঙুল তাক করল। শব্দটা ক্ষীণ হয়ে এলেও চেনা যাচ্ছে এখনও।

‘বোট,’ ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল সু কি।

‘শব্দটা অদ্ভুত,’ বলল মুসা। ‘মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছে একটা বিট স্কিপ করছে।’

‘এত রাতে কেউ পানিতে নামবে কেন?’ বলে, শর্টস পরল নথি।

‘কী করছ?’ পাশের ল্যাম্পটা জ্বালল মুসা।

‘এখানে বসে থাকলে তো চলবে না,’ রবিন অধৈর্য কণ্ঠে বলল। ‘ওটা প্রবাল চোরও হতে পারে। হয়তো এখন প্রবাল চুরি করছে।’

‘খাইছে, ঠিকই তো,’ বলল মুসা, বিছানা থেকে ত্বরিত নেমে পড়ল। চটপট জিন্স পরে নিয়ে হাত বাড়াল ফ্ল্যাশলাইটের দিকে। ‘রেডি হও, সু কি। আমাদের তদন্ত করতে হবে!’

‘কিশোরভাই আর ডনকে ডাকব না?’ সু কি বলল।

‘পরে,’ জানাল রবিন।

‘আমি রেডি।’ সু কি এরমধ্যেই খাকি শর্টস্ আর টি-শার্ট পরে নিয়েছে।

কিশোর আর ডনকে জাগাল ওরা, তারপর ব্যস্তসমস্ত হয়ে ডক অভিমুখে চলল। বাতাসে আশ্চর্য সুন্দর সুবাস, পূর্ণিমার চাঁদের রুপোলী আলোয় থই-থই করছে চারপাশ। উষ্ণতা সত্ত্বেও সামান্য শিউরে উঠল রবিন।

‘মনে হয় দেরি করে ফেলেছি,’ ডকে পৌঁছে বলল মুসা। ওরা নিঃসাড়ে দাঁড়িয়ে আঁধারে দৃষ্টি মেলে দিল। কাছে-পিঠেই কোথাও একটা পাখি ডেকে উঠল মৃদুস্বরে, এছাড়া সব স্থির। নৌকোটার কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না এবং মিলিয়ে গেছে ইঞ্জিনের শব্দও।

‘লোকটা কি আঁধারে ঘাপটি মেরে বসে আছে মোটর বন্ধ করে?’ কিশোর বলল। ‘আমাদেরকে হয়তো দেখতে পাচ্ছে অপেক্ষা করছে কখন আমরা ঘরে ফিরি।’

রবিন যথাসাধ্য তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাইল। কোথাও কোন নড়াচড়া নেই, জনমানুষের কোন চিহ্ন নেই।

‘না,’ বলল হতাশ কণ্ঠে। ‘ওখানে কেউ নেই। ও…চলে গেছে।

‘ইস, আরেকটু আগে যদি আসা যেত!’ বলল মুসা।

‘আশপাশে খুঁজলে হয়তো কোন সূত্র পেতে পারি,’ বাতলে দিল নথি।

‘এখানে এখন খোঁজাখুঁজি করবে?’ ডনের গলায় সন্দেহ। ‘কিছু পেয়েও যেতে পারি আমরা। ডক ধরে হাঁটি এসো, বলল রবিন।

নৌকোর সারির পাশ দিয়ে হাঁটছে, সবাই ওরা চিন্তামগ্ন। ‘ওই দেখো!’ হঠাৎই বলে উঠল সু কি। এক ফাঁকা বার্থ দেখাল।

‘ছয় নম্বর।’ রবিন উত্তেজনায় সু কির বাহু চেপে ধরল। ‘ছোট, সাদা পাওয়ারবোটটা সবসময় ওখানেই থাকে।’

‘তারমানে কেউ একজন নিয়েছে ওটা,’ বলল মুসা। ‘পারমিশন পেয়েছে কিনা কে জানে,’ বলল রবিন। ‘মনে হয় না,’ বলল কিশোর। ‘শুধুমাত্র কাউন্সেলরদের কাছেই বোটের চাবি থাকে এবং তারা রাতে বেরোয় না। ‘

‘যাকগে, অন্তত একটা জরুরী বিষয় তো জানা গেল আজ রাতে,’ বলল রবিন, কেবিনের দিকে যখন ফিরছে ওরা। ‘কেউ একজন বোট নিয়ে সাগরে গেছে, এবং কোনটা নিয়েছে তাও আমরা জানি। কাল এমাকে বলব, তারপর কী করব ঠিক করা যাবে।’