গোপন সৈকতে – ৭

সাত

‘রিফে অপূর্ব সব প্রবাল দেখবে তোমরা,’ খানিক পরে বলল এমা। ওরা যখন এক গ্লাস-বটম নৌকোয় চাপল। নাস্তার পরে গাড়ি চেপে কি ওয়েস্টে যায় ওরা এবং এখন ফিউরি নামে সাদা, প্রকাণ্ড এক বোটের আপার ডেকে আসন নিয়েছে।

‘আমরা মাছ দেখব না?’ ডনের প্রশ্ন। বেশ কিছু ট্রপিকাল মাছ চিনে নিয়েছে ও ইতোমধ্যে এবং আরও জানতে চায়।

হাসল এমা।

‘দেখবে তো। ছয়শোর বেশি প্রজাতি। যে কোন মৎস্যপ্রেমীর জন্যেই সংখ্যাটা অনেক।’

নৌকো রওনা দিতেই, এমা জিজ্ঞেস করল ছেলে-মেয়েরা প্রবাল প্রাচীর সম্পর্কে কতটুকু জানে।

‘ওটা লম্বায় একশো মাইলের বেশি,’ বলল মুসা। ‘এবং ফ্লোরিডা কি-র সৈকতের কাছ ঘেঁষে গেছে।’

‘ঠিক,’ সায় জানাল এমা।

‘গ্রীনফিল্ডে প্রবাল প্রাচীর নেই কেন?’ ডনের জিজ্ঞাসা।

‘কারণ প্রাচীর তৈরি হয় প্রবাল পলিপ দিয়ে এবং টিকে থাকার জন্যে ওদের উষ্ণ পানি দরকার। সত্তর ডিগ্রির চাইতে কম গরম পানিতে রাখলে মরে যায়।’

ঘণ্টাখানেক বাদে, বিশাল এক কোরাল বেডের ওপর নোঙর ফেলল ওরা। তারপর সবাই নেমে এল নিচে অবজার্ভেশন ডেক- এ।

‘ও, এবার বুঝলাম এটার নাম গ্লাস-বটম বোট কেন!’ সরু ওয়কওয়েগুলোকে আলাদা করা কাঁচের প্যানেলগুলো ধরে ধেয়ে গেল ডন, মহাসাগরের তলদেশ দেখাচ্ছে ওগুলো।

‘খাইছে, মনে হচ্ছে মাছগুলোকে ছোঁয়া যাবে এতটাই কাছে, বলল মুসা, এক ঘন নীল প্যারট ফিশকে স্বচ্ছন্দে সাঁতরে যেতে দেখল।

‘এটাকে পেটুক মাছ মনে হচ্ছে,’ বলল ডন, হাঁটু গেড়ে বসল ভালভাবে দেখতে। প্রায় গোলাকার এক ইয়াবড় ট্যান ফিশ দেখাল তর্জনী দিয়ে।

‘ওটা সাউদার্ন পাফার,’ এমা বলল। ‘ও আসলে মোটা নয়, ডন। পেট ভর্তি পানি খেয়ে নিজেকে তিনগুণ ফুলিয়ে ফেলে। এভাবে বিপজ্জনক মাছেদের ভয় দেখিয়ে দূরে রাখে।’

রবিন অপরূপ সুন্দর কিছু এল্কহর্ন, স্ট্যাগহর্ন আর ব্রাঞ্চ কোরাল দেখে মোহিত হলো। এমা জানাল ওগুলো বছরে মাত্র দু’ কি তিন ইঞ্চি বাড়ে।

‘প্রবাল যে জ্যান্ত জিনিস ভাবতেই কেমন অবাক লাগে,’ বলল মুসা।

‘কিন্তু এটাই সত্যি। প্রবাল প্রাচীর পুরনো পলিপের কলোনির কঙ্কালের ওপর নিয়মিতই নতুন কলোনি জন্ম দিয়ে চলেছে। পলা শত-শত বছর বাঁচে। প্রবাল প্রাচীরটা হাজার-হাজার বছর আগের।’

এমা প্রবাল প্রাচীর নিয়ে কথা বলছে, কিশোরের মন চলে গেল দ্বীপের পলা চুরির ঘটনাটায়। কোস্ট গার্ড চোরটাকে ধরতে পারবে তো? ভাবছে ও। সন্দেহভাজনদের তালিকাটা মনে করে বিভ্রান্ত বোধ করল গোয়েন্দাপ্রধান। সমস্যাটাই তো সেখানে। সন্দেহজনক চরিত্র অনেকে, অথচ সত্যিকারের কোন সূত্র নেই। এবং সবচাইতে খারাপ ব্যাপার, প্রমাণ নেই!

.

লাঞ্চ সেরে, দলটা চলল মেল ফিশার জাদুঘরে, বিখ্যাত স্প্যানিশ জাহাজ অ্যাটোচা-র ধ্বংসস্তূপ থেকে পাওয়া রত্নরাজি দেখতে। এক খাঁটি সোনার বার স্পর্শ করে সে কী রোমাঞ্চ ডনের! রুবি আর হীরেখচিত অসাধারণ সুন্দর এক বেল্ট দেখে রীতিমত মুগ্ধ হলো রবিন।

‘ভগ্নস্তূপ থেকে পান্না উদ্ধারের জন্যে যে আমরা ডলফিনদের ট্রেনিং দিয়েছিলাম জানো তোমরা?’ জাদুঘরের এক গাইড প্রশ্ন করল।

‘পান্না? ডলফিনদেরকে পান্না টানবে কেন?’ বিস্মিত মুসা প্রশ্ন করল।

‘কারণ আমরা ওদের পছন্দের খাবারটা দিয়েছিলাম যে-ম্যাক্রল মাছ!‘

.

সেদিন রাতে, ডন নিজের গুপ্তধনটার কথা ভাবল-ডকে পাওয়া সেই তোবড়ানো মুদ্রাটা। গলার চেইনে সোনার কয়েন পরা মেল ফিশারের এক ছবি দেখেছে ও। ডনও অমন একটা ছবি তুলতে চায়।

‘কিশোরভাই, কাল আমার কয়েনটায় একটা ফুটো করে দেবে?’

‘দেব, ডন। ওর গায়ে চাদর টেনে দিল কিশোর। কিছুক্ষণ পর দু’জনই ঘুমিয়ে পড়ল।

মাঝরাতের দিকে হঠাৎই ঘুম ভাঙল ডনের। ক্ষীণ এক খসখস শব্দ কানে আসছে, তবে কোত্থেকে তা ঠিক ধরতে পারছে না। চোখ খুলতে ভয় পাচ্ছে ও।

‘কিশোরভাই, তুমি কি শব্দ করছ?’ ফিসফিস করে বলল। জবাব নেই। কান পাতল, আড়ষ্ট শরীরে কাঁটা দিচ্ছে। ও কি বিছানা থেকে হাঁচড়ে পাঁচড়ে নেমে কিশোরভাইকে জাগাবে? আরও মিনিট দুয়েক অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নিল।

ও এখন পুরোপুরি সজাগ, শব্দটা কাল্পনিক নয় মোটেই, বুঝে গেছে।

ওর নাইট টেবিলের ল্যাম্পশেডে ঘষা খাচ্ছে কী যেন। কিছু একটা ড্রেসারের ওপরে রাখা ব্রাশ আর চিরুনি দুটোকে নাড়াচ্ছে। ওর বিছানায় কোন কিছু ধাক্কা খেল।

‘কিশোরভাই?’ মৃদুকণ্ঠে ডাকল ডন, গলা কাঁপছে।

ঠিক এমনিসময় দরজাটা ককিয়ে খুলে গেল। নিস্পন্দ শুয়ে রইল ডন, কান খাড়া। তবে কেবিনটা এখন নিঃশব্দ।

ডন আর দেরি করল না। তড়াক করে বিছানা থেকে নেমে কামরার ওপ্রান্তে ছুটে গেল বাতির সুইচ জ্বালতে।

‘কী হলো?’ এক ঝটকায় বিছানায় উঠে বসেছে কিশোর, চোখ কচলাচ্ছে।

কেবিনটা ভেসে যাচ্ছে আলোর বন্যায়, ডন দরজার দিকে আঙুল তাক করল। খোলা!

‘কেউ এসেছিল এখানে,’ ভয়ে-ভয়ে বলল ও। ‘আমাদের কেবিনে।’

‘ঠিক বলছ?’

‘একদম।’ বিছানায় এক লাফে উঠে, বুকে হাঁটুজোড়া ঠেকিয়ে বসে রইল ভীত-সন্ত্রস্ত ডন। বিপদ কেটে গেছে, কিন্তু ওর বুকের ধুকপুকুনি যায়নি।

কিশোর গিয়ে পাইন কাঠের নিরেট দরজাটা পরখ করল। ‘বাতাসে হয়তো খুলে গেছে,’ দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বলল। ‘কিন্তু দরজাটা তো অনেক ভারী।’

‘শুধু তো দরজা খোলেনি!’ আপত্তি জানাল ডন। ‘সারা ঘরময় ঘুরেও বেড়াচ্ছিল। আমি শুনেছি!’ ভয়ার্ত দৃষ্টিতে কামরাটার চারপাশে চোখ বোলাল। ‘হয়তো…ভূত এসেছিল।’ গলা খাদে নেমে গেছে ওর।

খোলা দরজার ওপাশে উঁকি দিয়ে শব্দ করে হেসে উঠল কিশোর।

‘এই যে, তোমার ভূত।’ তীরবেগে কামরায় ঢুকল জিমি, খুশিয়াল ডাক ছাড়ছে।

‘জিমি?’ ডনের কণ্ঠে সন্দেহ। ‘আমি জিমির শব্দ শুনেছি?’

‘তাই তো।’ কিশোর ঝুঁকে রোমশ কোলিটার গায়ে হাত বোলাতেই এক লাফে সোজা বিছানায় উঠে পড়ল কুকুরটা। ‘ওর হয়তো একা-একা লাগছিল, তাই কারও সঙ্গ চাইছিল।

ডন আশ্বস্ত হতে পারল না।

‘কিন্তু ও দরজা খুলল কীভাবে? আর আমার বিছানার নিচেই বা কী করছিল?’

ডনকে হাঁচড়ে পাঁচড়ে বিছানার তলায় ঢুকে কুকির টিনটা বের করতে দেখল কিশোর।

টিনের মুখটা আধখোলা, তবে ওর মুদ্রাটা নিরাপদ রয়েছে। ‘ও একটা টিনের বাক্সের আশপাশে ছোঁক ছোঁক করবে কেন?’

শ্রাগ করল কিশোর।

‘কে জানে। হয়তো ভেবেছে ভেতরে এখনও কুকি আছে।’ জিমি লাফিয়ে নেমে শুঁকতে লাগল টিনটা। ‘দেখলে? ও হয়তো ওটায় খাবারের গন্ধ পেয়েছে।’

‘তুমি যখন বলছ তখন হয়তো তা-ই,’ বলে, বিছানায় উঠল ডন।

কিশোর জিমিকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিল।

‘এবার ঘুমানো যাক,’ বলে, নিজের বিছানায় ফিরল।

‘ঠিক আছে, তবে আমি কিন্তু বাতি জ্বেলে রাখব,’ মিহি সুরে বলল ডন।

.

পরদিন সকালে, নাস্তার পর ক্র্যাফট রুমে গেল কিশোর। ডনের মুদ্রাটায় ড্রিল দিয়ে একটা ফুটো করবে।

‘কেমন?’ কাজটা সেরে কিশোর তুলে ধরে দেখাল ওটা। সু কি ডনকে এক টুকরো পাট দিয়েছে দড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে। ডন কয়েনটা গলায় ঝোলাল।

‘আমাকে এখন সত্যিকারের ট্রেজার হান্টারের মত দেখাচ্ছে,’ গর্বভরে বলল।

ওদিকে, রবিন, মুসা আর সু কি ডার্করুমে বসে রয়েছে, আর এমা সাদা-কালো ফটো ডেভেলপ করছে। কামরার এমাথা-ওমাথা অবধি এক লম্বা লাইন চলে গেছে, ওটা দেখাল আঙুল দিয়ে।

‘তোমরা চাইলে আমার অ্যাডভান্সড্ স্টুডেন্টদের কাজ দেখতে পারো। ওখানে বেশ কিছু অসাধারণ আণ্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফি রয়েছে।

‘ওহ, এটা দেখেছ?’ বলল সু কি, সূর্য অস্তাচলে যাচ্ছে এমন এক অপূর্ব ছবি দেখাল। ‘কী সুন্দর!’

‘ওটা পেশাদার ফটোগ্রাফারের তোলা,’ জানাল এমা। ‘ক্যাথি অ্যালেন তুলেছে।

মুসা ছবিটার কাছে গিয়ে ক’মুহূর্ত খুঁটিয়ে দেখল।

‘কী ব্যাপার, মুসা?’ প্রশ্ন করল রবিন, মুসার চেহারার গম্ভীর অভিব্যক্তি দৃষ্টি এড়ায়নি ওর। ‘তোমার ভাল লাগেনি?’

‘হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে ভাল ছবিটা,’ বলল মুসা। ‘তবে…’

‘তবে কী?’ প্রশ্ন করল সু কি।

শ্রাগ করল মুসা।

‘জানি না। ছবিটা খুব পরিচিত লাগছে।’

‘হয়তো পোস্টকার্ডে দেখেছ,’ মজা করে বলল রবিন। ‘সূর্যাস্ত, সাগর, পাম গাছ। কি ওয়েস্টের যেদিকেই তাকাও একই দৃশ্য।’

মাথা নাড়ল মুসা।

‘না, এটা অন্য কিছু। ও জিনিস নয়।’ সবাই লাঞ্চ খেতে গেল, কিন্তু মুসা শেষবারের মত ছবিটা দেখার লোভ সামলাতে পারল না। খাইছে, ছবিটা ওকে এত জ্বালাচ্ছে কেন? ও আগে কোথায় দেখেছে এটা? মনে না পড়া অবধি প্রশ্নটা খোঁচাবে ওকে। মাথা ঘামাতে হবে।

রবিন ফিরে এল ওকে ডার্করুম থেকে নিয়ে যেতে।

‘দেরি করলে ক্যাফেটেরিয়ার লাইনে আমরা কিন্তু সবার শেষে পড়ব। আর আজ ওরা পিত্যা বানাচ্ছে। শেষ হয়ে যাবে তো!’

আর বলতে হলো না মুসাকে। দ্রুত পা বাড়াল দরজার দিকে।

রবিন ছবিটা এক ঝলক দেখে নিয়ে শ্রাগ করল। বুঝছে না মুসা এটা নিয়ে এত ভাবিত কেন।

একটু পরে, দু’বন্ধু রওনা হলো।