রহস্যময় দুর্গ – ৮

আট

দশাসই মানুষটি সজোরে হাঁকালেন।

ব্যাটে-বলে সংযোগ হতেই ফটাস করে জোরাল শব্দ উঠল। জিম লেকার ঝাঁপালেন বলটার উদ্দেশে, এবার বিদ্যুৎগতিতে ওটা ছুঁড়লেন ফার্স্ট বেস-এ।

‘ইউ আর আউট!’ আম্পায়ার গর্জালেন, বলের এক সেকেণ্ডের ভগ্নাংশ পরে ব্যাটার যখন বেস-এ পৌঁছলেন।

হাজারো মানুষের হর্ষধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল রাতটা, এবং আরেকটি ব্লু জ্যে বেসবল গেম শুরু হলো।

‘দেখলে?’ কিশোর চেঁচিয়ে উঠল। ‘ওটা আমার বন্ধু জিম।’ হা-হা করে হেসে উঠল টিনা।

‘বন্ধু, না? দু’দিন আগেও তো চিনতে না।

‘তাতে কী? আমার সাথে সবারই খুব তাড়াতাড়ি খাতির হয়ে যায়।’ কিশোর ঘাড় কাত করে কাছের কাঁচে ঘেরা ব্রডকাস্ট বুথের দিকে চাইল, ফ্রেডি ব্রাউন বসে রয়েছেন ওখানে। ফ্রেডি ভূয়সী প্রশংসা করছেন জিমের দক্ষতার; বুথটা যদিও সাউণ্ড-প্রুফ কিন্তু তাঁর উত্তেজিত হাব-ভাব বলে দিচ্ছে কেমন উচ্ছ্বসিত তারিফ করছেন তিনি খেলোয়াড়টির পারদর্শিতার।

এসময় এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে এল কাছের লেক অন্টারিও থেকে, ছুরির মতন বিধল কিশোরের জামা-কাপড় ভেদ করে। শিউরে উঠল ও, জনতার ভিড়ে এক লোককে দেখল- ধোঁয়া ওঠা এক কন্টেইনার বইছে।

‘হট ডগ,’ চেঁচাচ্ছে লোকটা। ‘আপনার পছন্দের জায়ান্ট রেড-হট পাবেন এখানে!’

‘তোমার খিদে পেয়েছে, টিনা?’

মাথা ঝাঁকাল ও।

‘আমি সল্টি প্রেটযেল খেতে যাচ্ছি। তোমার জন্যে হট ক্যাট আনব?’ ঠাট্টা করে বলল মেয়েটি।

‘সে আর বলতে!’

জনতাকে ব্রডকাস্ট এরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে সেই রেইলিংটায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল কিশোর, এবং স্টেডিয়ামের আলট্রা-গ্রীন কৃত্রিম টার্ফের দিকে ফের দৃষ্টি ফেরাল খেলা দেখার জন্য।

ব্লু জ্যে-এর পক্ষে প্রথম এলেন জিম। দুটো স্ট্রাইক পাস করতে দিলেন তিনি, তারপর বলটাকে বিদ্যুৎঝলকের মত বাঁদিকের মাঠে পাঠালেন এক ক্লিন সিঙ্গলের জন্য। দর্শকরা উল্লাসে ফেটে পড়তেই, খাবার নিয়ে ফিরল টিনা।

‘এত হৈচৈ কীসের? খেলা শেষ নাকি?’

‘উঁহু, জিম সুপারস্টার না?’

‘ওহ, জমে গেলাম।’ রেইলিঙের ওপর দিয়ে ঝুঁকে, টিনা এক লোককে আঙুল-ইশারায় দেখাল, গো, জ্যে, গো লেখা এক ক্যাপ তার মাথায়। ‘আমিও ওরকম একটা ক্যাপ কিনব। টরন্টোর __ন্ত এক স্যুভনিয়ার।’

পরের পিচটা সোজা উড়ে গিয়ে দর্শকদের কাতারে পড়ল। ভক্তদের মধ্যে রীতিমত কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। শেষমেশ যে মেয়েটি সগর্বে বলটা তুলে ধরে দেখাল তাকেও উষ্ণ করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানাল দর্শকরা 1

‘ইস, বলটা যদি স্যুভনিয়ার হিসেবে পেতাম!’ বলল কিশোর। ‘কিংবা এমনকী একটা ভাঙা ব্যাটও।’

ক’মুহূর্ত পরে, পিচার না বল ছুঁড়তেই জিম সেকেণ্ড বেসের উদ্দেশে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলেন। জনতা উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছে, গগনবিদারী চিৎকার দিচ্ছে, সেকেণ্ডের দিকে ছোঁড়া বলটা জিমকে ফাঁদে ফেলেছে ভেবে উৎকণ্ঠিত সবাই, কিন্তু গতির ঝড় তুলে জিম নিরাপদে ট্যাগের নিচে হড়কে পৌঁছে গেলেন। তিনি যখন ইউনিফর্ম থেকে ধুলো-ময়লা ঝেড়ে হাসছেন, তখনও হর্ষধ্বনি থামেনি।

‘অসাধারণ,’ বলল টিনা। ‘তোমার বন্ধু একেবারে চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে।’

‘দেখো, উনি ঠিক ফার্স্ট রান স্কোর করবেন।’

পরের পিচে ব্যাটার সপাটে এক ডবল অফ দ্য ওয়াল হাঁকালেন, এবং জিম হোম প্লেট অতিক্রম করে টরণ্টোকে এগিয়ে দিলেন।

মিলওয়াকি পিচার মহা ঝামেলায় পড়লেন, কিশোরের কষ্ট হলো মানুষটার জন্য, টিম ম্যানেজার যখন ভ্রূ কুঁচকে শ্লথপায়ে মাউণ্ডে হেঁটে গেলেন। সংক্ষিপ্ত কথাবার্তার পর, মনমরা পিচার বলটা ফিরিয়ে দিয়ে ডাগআউটের উদ্দেশে হাঁটা দিলেন।

‘উনি শাওয়ার নিতে যাচ্ছেন। কপাল ভাল হলে হয়তো কটা হীরে খুঁজে পেতে পারেন ওখানে!’ বলল কিশোর মজা করে।

স্টেডিয়ামের অতিকায় পর্দায়, পিচারকে ক্লান্ত পায়ে মাঠ পেরিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যাচ্ছে। এবার পর্দায় যেই ভেসে উঠল জাঙ্ক- -ফুডের বিজ্ঞাপন, কিশোরের মনে পড়ল রেজিনাকে দেয়া স্যর ডয়েলের সূত্রটার কথা-হীরেগুলো যেখানে তিনি লুকিয়ে রেখেছেন বলেছিলেন। সূত্রটা সম্ভবত ডেস্ক ড্রয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে না, এবং আবারও অস্বস্তি বোধ করল কিশোর।

‘হীরেগুলো নিয়ে আমি নার্ভাস বোধ করছি কেন?’

‘কারণ ব্যাপারটা পানির মত সোজা ছিল। একটা বেনামী ফোনকল, এবং হঠাৎ করেই রহস্যটার কিনারা হয়ে যাওয়া।’ স্টেডিয়ামের পেছনে জমাট বাঁধা শীতল অন্ধকারের উদ্দেশে চিন্তিত দৃষ্টিতে চাইল টিনা, এক টিভি স্টেশনের নিয়ন সাইন বিজ্ঞাপন ঝলসাচ্ছে যেখানে। ‘কেন জানি মনে হচ্ছে হীরেগুলো আবিষ্কারের পেছনে কোথাও কোন ঘাপলা আছে।’

নতুন মিলওয়াকি পিচার খুব দ্রুতই তাঁর দলকে বিপদমুক্ত করলেন, এবং টরন্টো তার ওয়ান-রান লিড ধরে রাখল খেলা যতই গড়াল। সেভেন্থ-ইনিং স্ট্রেচের সময় কিশোর আর টিনার সঙ্গে যোগ দিলেন ফ্রেডি।

‘বিনোকিউলার দিয়ে দেখতে চাও? আছে আমার কাছে।’

ধারাভাষ্যকারের দিকে চেয়ে মৃদু হাসল কিশোর।

‘জিমকে বলুন না, এখানে একটা ফাউল আপ করতে, আমরা তাহলে একটা স্যুভনিয়ার পেতাম।’

‘আমি জীবনে অনেক অসাধ্য সাধন করেছি, কিন্তু এটা বেশ কঠিন হবে, কিশোর। তবে চিন্তা কোরো না, তোমরা স্যুভনিয়ার নিয়েই এখান থেকে যাবে।’

‘ওয়াও! কী সেটা?’

‘ধৈর্য ধরো।’

বিনোকিউলারে চোখ রেখে টিনা কম্বল মুড়ি দেয়া লোকজনকে দেখল, অনেকের গায়ে মোটা কাপড়ের কোটও রয়েছে।

‘এই, কিশোর,’ শেষমেশ বলল ও। ‘জন নামের খানসামাটাকে নিচে দেখতে পাচ্ছি।’

ফ্রেডি বিনোকিউলারে হাত রাখলেন।

‘কই, দেখি!’

টিনার চিহ্নিত লোকটিকে সতর্ক দৃষ্টিতে জরিপ করলেন ফ্রেডি। এবার মুচকি হাসলেন।

‘তুমি ভুল দেখেছ, টিনা। এর নাকের গড়ন আলাদা।’

‘কিন্তু চিবুকের কাটাকুটি?’

‘ভোঁতা রেযর ব্লেড দিয়ে দাড়ি কাটে এ-ও। এজন্যেই তো আমি টিভিতে ইলেকট্রিক শেভারের বিজ্ঞাপন করি।’

বিনোকিউলারে আবারও চোখ রাখল টিনা।

‘ওটা জন-ই। একটু আগে দেখেছি, বারবার এদিকে চাইছে। ঘটনাটা কী?’

হেসে উঠলেন ফ্রেডি।

‘ঘটনা আর কিছু নয়, সবই তোমার কল্পনা।’

ফ্রেডি বুথে ফিরলেন এবং কিশোর বিনোকিউলার দিয়ে দেখার চেষ্টা করল, কিন্তু দেখতে পেল শুধু লোকটার পিঠ, এমুহূর্তে হনহন করে এক এক্সিটের দিকে চলেছে।

‘জন এখানে কী করছে? পেশাদার বেসবলে ওর আগ্রহ নেই এমনটাই তো বলেছিল,’ বলল কিশোর।

এসময় সগর্জনে উঠে দাঁড়াল জনতা। এক ব্লু জেয স্লাগার সজোরে হাঁকিয়েছেন, বল উঠে গেছে অনেক ওপরে, কালো আকাশের পটভূমিতে ঝিকোচ্ছে। রাতের আঁধার চিরে বৃত্তাকার আলোর ছটা তৈরি করে, সোজা দেয়ালের ওপারে গিয়ে পড়ল হোমরানের জন্য।

‘অবিশ্বাস্য!’ বিজয়ধ্বনি দিল কিশোর। তুমুল করতালি দিচ্ছে। ‘একেই বলে হিট!’

ব্লু জেয সদস্যরা ডাগআউট থেকে বেরিয়ে এলেন নতুন নায়ককে অভিনন্দন জানাতে, এবং দর্শকরা টানা ক’মিনিট ধরে হাততালি দিয়ে গেল। এবার তারা উদ্বিগ্নচিত্তে ফের যার-যার আসনে বসে পড়ল, মনে শঙ্কা মিলওয়াকি টিম যদি এরপর খেলায় ফিরে আসে!

খেলা যখন শেষ হলো, কিশোরের খুশি ধরে না। ব্লু জেয ২- ০-তে জিতেছে। বেড়াতে আসার উদ্দেশ্যে হায়দার মামার কাছ থেকে পাওয়া পকেট খরচার বাদবাকি টাকা-পয়সা গোনার পর, নিজের আর টিনার জন্য হট ডগ কিনবে ঠিক করল কিশোর।

ওরা খাচ্ছে, এসময় ফ্রেডি মিলিত হলেন ওদের সঙ্গে।

‘তোমরা ব্লু জে-দের সাথে দেখা করতে চাও? আমি এখুনি ওদের সাক্ষাৎকার নিতে যাচ্ছি।’

‘অবশ্যই!’

স্টেডিয়ামের অনেক গভীর থেকে, সরগরম ব্লু জ্যে ড্রেসিং রুমের কথা-বার্তা আর প্রাণখোলা হাসির শব্দ আসছে। আলাদা এক কামরায়, ক’জন খেলোয়াড়ের সঙ্গে ফ্রেডির সাক্ষাৎকার পর্বের জন্য ক্যামেরা বসানো হয়েছে।

সবার শেষে সাক্ষাৎকার দিলেন জিম লেকার, এবং তারপর কিশোর সগর্বে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিল টিনার সঙ্গে। ফ্রেডি এবার জিমকে বড়সড়

বড়সড় এক কার্টন দিলেন। বেসবল খেলোয়াড়টিকে ফিসফিস করে কী সব বললেন, ফলে কিশোর আর টিনার উদ্দেশে চেয়ে মুচকি হাসলেন তিনি।

‘টিনা আর কিশোর,’ বললেন জিম, কণ্ঠে ভারিক্কী ভাব, ‘তোমরা আজ স্যর ডয়েলকে উদ্ধার করেছ, তাই না?’

‘বলতে পারেন,’ জবাব দিল টিনা। ‘আমরা তাঁকে স্রেফ জায়গামত খুঁজেছি আরকী।’

‘তোমাদের এই কৃতিত্বের জন্যে আমি তোমাদের দু’জনকে একটা স্যুভনিয়ার উপহার দিতে চাই।’

‘ধন্যবাদ!’

কিশোর আর টিনা জিমের দিকে চেয়ে হাসল, তারপর ধন্যবাদ জানাল ফ্রেডিকে, তিনি হাত নাড়লেন।

‘এটা তোমাদের প্রাপ্য, বাছারা।’

জিম কার্টনটা খুলতেই পুরু ক্রেস্ট সহ টরণ্টো ব্লু জ্যে লেখা দুটো সাটিনের টিম-জ্যাকেট দেখা গেল, এবং ক্রেস্ট সহ দুটি বেসবল ক্যাপ। কিশোর আর টিনা তো মহাখুশি, তখুনি পরে ফেলল ওগুলো।

‘খুব মানিয়েছে তোমাদেরকে,’ বললেন ফ্রেডি। ‘দাঁড়াও, জিমের সাথে তোমাদের একটা ছবি তুলি।’

ক্যামেরা ঝলসাল, এবার জিম বিদায় নিলেন। কিশোর আর টিনার দিকে চেয়ে স্মিত হাসলেন ফ্রেডি।

‘নায়াগ্রা ফলসে যাবে? আমি এক রিটায়ার্ড টেনিস প্রো-র ইন্টারভিউ নিতে ওখানে যাচ্ছি। তোমাদের মামা অনুমতি দিলে তোমরা আমার সাথে যেতে পারো।’

‘দেবে, দেবে!’ বলে উঠল টিনা।

‘তাহলে চলো, গাড়িতে করে দুর্গে চলে যাই। তোমরা যার- যার টুথব্রাশ নিয়ে নাও, আজ রাতেই রওনা হব আমরা। তাহলে ভোরে নায়াগ্রা ফল্স্ দেখার সুযোগ পাবে।’

টম মামা অনুমতি দিলেন, তবে কিছু একটা নিয়ে হতাশ তিনি। স্যর ডয়েলের অপেক্ষায় তাঁকে ফায়ারপ্লেসের সামনে বসিয়ে রেখে বেরিয়ে পড়ল ওরা। স্যর ডয়েল হাসপাতালে থাকতে রাজি নন, আশা করা হচ্ছে ছাড়া পেয়ে পৌঁছে যাবেন যে কোন মুহূর্তে।

‘আচ্ছা, ব্যাপারটা কী বলো তো,’ বলল কিশোর। ফ্রেডির স্পোর্টস্ কারের দিকে হাঁটছে টিনাকে নিয়ে। ‘দুর্গটা হাতছাড়া হয়ে গেল বলে কি টম মামার মন খারাপ?’

মাথা নাড়ল টিনা।

‘না, নিশ্চয়ই অন্য কোন কারণ আছে।’

‘হীরেগুলো? আমি কিন্তু এখনও বলব অত সহজে ওগুলো খুঁজে পাওয়ার কথা নয়। এর পেছনে অবশ্যই কোন রহস্য আছে।’