মূর্তিমান আতঙ্ক – ৫

পাঁচ

চিলার হাউসটা দেখতে অনেকটা ছোটখাট বাড়ির মতন। যম্বি প্লাজার পেছনদিকে এক সার দোকানের শেষ প্রান্তে ওটা। হাস্যকর সব স্যুভনিয়ার নিয়ে সামনে এক আলোকিত জানালা রয়েছে দোকানটির।

প্রবেশপথের ওপরে এক সাইনে লেখা: শপ টিল ইউ ড্রপ (রিয়েলি!)। দরজার সামনে পেতে রাখা স্বাগত ম্যাটটিতে লেখা: গো অ্যাওয়ে। অর্থাৎ, দূর হও।

‘ডনের জন্যে এখানে হয়তো ভাল কিছু পাওয়া যেতে পারে, বললাম। দরজাটা টেনে খুললাম। ‘লিখে তো রেখেছে কেনাকাটা করতে-করতে মাটিতে পড়ে যাওয়ার দশা হবে।’

দোকানটির মাঝ বরাবর বিস্তার পেয়েছে লম্বা এক আইল। ওটার দু’পাশেই, অদ্ভুতুড়ে মজার সব জিনিসপত্রে ঠাসা উঁচু-উঁচু তাক আর কাঁচের কেস। ছাদ থেকে ঝুলছে মড়ার মাথা। মেঝেতে স্তূপ করে রাখা স্টাফ করা দানো।

প্রথম কাউন্টারটি থেকে ছোট্ট এক বাক্স তুলে নিলাম আমি।

‘ডনের হয়তো পছন্দ হবে এটা,’ বললাম।

রবিন ওটা নিল আমার হাত থেকে।

‘ধ্যাত! ও সাবান পছন্দ করবে কেন?’

এবার লেবেলটা পড়ল: মাংসখোর সাবান।

‘খাইছে, এটা গায়ে মাখলে মাংস খেয়ে ফেলে,’ বলল মুসা। তিনজনই হেসে উঠলাম। সাবানের পাশে এক আইটেম দেখাল রবিন। কবজি থেকে কাটা মানুষের এক হাত।

‘একদম আসল মনে হচ্ছে,’ বলল। ‘নিশ্চয়ই রবারের তৈরি।’

হাত বাড়াতেই—আঙুলগুলো ওর কবজি আঁকড়ে ধরল।

রবিন বিস্ময়ে অস্ফুট আর্তনাদ ছাড়ল।

‘বাঁচাও!’

ওটার আঙুলগুলো টেনে খুলে, হাতটা এক ঝটকায় ছুটিয়ে আনলাম।

‘এটা নিশ্চয়ই ইলেকট্রনিক কিংবা অমন কিছু,’ বললাম। ‘কিন্তু স্পর্শটা একদম আসল চামড়ার মত। থুহ্।’

‘ডন মনে হয় এটা পছন্দ করবে,’ বললাম। তুলে ধরে দেখালাম ওদেরকে। বাড়তি নাক একটা। ‘দেখেছ? নকল নাক। পেছনটা আঠাল। এটা কপালে লাগিয়ে বন্ধুদেরকে ও ভয় দেখাতে পারবে।’

‘খাইছে, দারুণ,’ বলল মুসা।

‘নাকটা পছন্দ হয়েছে?’ এক কণ্ঠস্বর প্রশ্ন করল। ‘ওটার তিনটে সাইয আছে।’

ঘুরে চাইতেই সামনের কাউন্টারে এক বৃদ্ধকে দেখলাম। মাথা জোড়া টাক। লালমুখো মানুষটির খাড়া, লম্বা নাকের ডগায় ছোট, চারকোনা চশমা।

কোঁচকানো শার্টের সঙ্গে মানানসই সেকেলে বাদামি সুট আর ভেস্ট পরেছে। আমার পাঠ্যবইয়ে দেখা বেন ফ্র্যাঙ্কলিনের হাতে আঁকা ছবির কথা মনে পড়ল বুড়োকে দেখে।

দু’হাতের আঙুলগুলো বুকের কাছে পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে টলমল পায়ে আমাদের উদ্দেশে হেঁটে এল লোকটা।

‘আমি জন চিলার,’ বলল। ‘চিলার হাউসে স্বাগতম।’ হাসতেই মুখের একপাশে ঝিকিয়ে উঠল এক সোনায় বাঁধানো দাঁত।

‘বাড়তি নাক খুব জনপ্রিয়,’ জানাল চিলার। ‘আর এখানে নতুন একটা জিনিস আছে, এ সপ্তাহে এসেছে।’ ছোট্ট এক বাক্স তুলে ধরল: নিজে করো ডেন্টিস্ট কিট।

‘দাঁতে এই স্টিকারগুলো লাগাতে পারো,’ ব্যাখ্যা করল লোকটা। ‘দেখে মনে হবে নোংরা বাদামি ছোপ আর গর্ত আছে তোমাদের দাঁতে।

হেসে উঠল রবিন

‘বাহ, দারুণ তো!’

চিলার আরও কী যেন বলল। কিন্তু আমি শুনিনি। সাঙ্ঘাতিক আকর্ষণীয় একটা জিনিস চোখে পড়েছে তখন আমার। তাক থেকে নামালাম ওটাকে। পাতা ওল্টানোর সময় বুকের ভেতরে ঢিব-ঢিব করতে লাগল।

এক গ্রাফিক নভেল। উযকে নিয়ে লেখা। আমার প্রিয় কমিক ভিলেন। এই গ্রাফিক নভেলটা আগে কখনও দেখিনি!

‘বিশ্বাস হচ্ছে না!’ চেঁচিয়ে উঠলাম। প্রচ্ছদটা মেলে ধরলাম রবিনের চোখের সামনে। ‘দেখো! আমার এটা নেই!’

শিরোনামটা জোরে-জোরে পড়ল ও।

‘দ্য উইয়ার্ড অভ উয।’

‘কিশোর—তুমি এটাও পড়েছ নিশ্চয়ই,’ নামটা শুনে বলল মুসা। ‘উযকে নিয়ে লেখা প্রতিটা কমিক আর গ্রাফিক নভেলই তো পড়া তোমার। তুমি তো বিশাল ভক্ত ওর!’

আমার হাতজোড়া সত্যি-সত্যিই কাঁপছে। ও ঠিকই বলেছে-আমি উযের মন্ত্রমুগ্ধ পাঠক। উযের প্রতিটা বই পড়েছি। কখনও সখনও ওকে নিয়ে নিজেও কাহিনী ফাঁদি।

এবং হ্যাঁ, স্বীকারও করছি। মাঝেমধ্যে আয়নার সামনে দাঁড়াই আমি মুখের চেহারায় বিদ্রূপের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে, এবং বারবার উচ্চারণ করি উযের সবচেয়ে বিখ্যাত উক্তিটি: ‘কী, বুঝলে কিছু?’

‘কী, বুঝলে কিছু?’

‘কী, বুঝলে কিছু?’

চাইলেই কঠিন গলায় শব্দগুলো বলতে পারি আমি

‘তুমি শিয়োর এটা তোমার নেই?’ প্রশ্ন করল রবিন। এবার চিলারের দিকে চাইল। ‘কিশোরের কালেকশন দেখলে বুঝতেন। পুরো এক দেয়াল জুড়ে ডাঁই করে রাখা!’

আমার হাত থেকে বইটা নিল চিলার। চারকোনা কাঁচ ভেদ করে প্রচ্ছদটা দেখছে।

‘এই এডিশনটা খুবই দুষ্প্রাপ্য,’ বলল। ‘শুরুর গল্পটা আছে এতে। মানে উযের আরম্ভটা কীভাবে হয়।’

প্রচ্ছদটায় আঙুল ঠুকল ও।

‘আর পেছনে, স্পেশাল বোনাস সেকশন রয়েছে। ওখানে বলা আছে কীভাবে ধাপে-ধাপে সুপারহিরো হওয়া যায়।’

হেসে উঠে চোখ ঘোরালাম আমি।

‘হুম। আমি তারপর উযের সাথে লড়ব!’

মুসা আমাকে আলতো ঠেলা দিল।

‘খাইছে, তুমি তো সুপারহিরো হতেই চাও, আমরা জানি না বুঝি?’

‘কিন্তু কোন কমিক বই থেকে ওটা ঘটবে না,’ বললাম। ‘তারপরও বইটা আমি কিনব। কালেকশনে রাখার জন্যে। আর একটা বাড়তি নাক নেব ডনের জন্যে।’

‘বেশ তো, বলল চিলার। ‘এসো।’

আমাদেরকে পেছনে নিয়ে সামনের কাউন্টারের কাছে চলে গেল। এক ড্রয়ার থেকে সাপ্লাই টেনে বের করল। এবার নাকটা আর বইটা সযত্নে মুড়ে দিল ধূসর এক মোড়কে।

জিন্সের পকেটে হাত ভরলাম টাকার জন্য।

‘মোট কত দাম হলো?’ প্রশ্ন করলাম। ‘উত্তেজনার চোটে দাম দেখতে ভুলে গেছি।’

চিলার ইশারায় আমাকে টাকা রেখে দিতে বলল।

‘টাকা এখন দিতে হবে না,’ বলল। হাসতেই ঝিক করে উঠল সোনার দাঁতটা। ‘পরেরবার দিলেই হবে।’

পরেরবার? মানে?

প্যাকেটটি গাঢ় লাল রিবনে বাঁধল সে। এবার ড্রয়ার থেকে কী যেন একটা বের করে গুঁজে দিল রিবনের নিচে।

একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম আমি। ছোট্ট এক দেহ। খুদে এক হরর, হররল্যাণ্ডে যারা কাজ করে হুবহু তাদের মত।

প্যাকেটটা আমার হাতে দেয়ার সময় চওড়া হলো জন চিলারের হাসি।

‘নাও, ধরো,’ বলল। ‘বাসায় ছোট্ট এক হরর নিয়ে যাও!’

ছয়

গাড়ি করে বাড়ি ফেরার পথে, পেছনের সিটে নীরবে বসে রইলাম আমরা তিন বন্ধু। আমি মুখ ডুবিয়ে রেখেছি উয কমিক বইটিতে। দু’পাশ থেকে রবিন আর মুসা আমার কাঁধের ওপর দিয়ে পড়ছে।

‘অ্যাই, দেখ, দেখ, গাছগুলো কেমন অদ্ভুত,’ প্যাসেঞ্জার সিট থেকে বলে উঠল চাচী। ‘এরকম গাছ আগে কখনও দেখেছিস?’

বই থেকে চোখ তুললাম না আমরা তিনজন।

‘দুর্দান্ত,’ বললাম।

‘গাছগুলো?’ চাচীর প্রশ্ন।

‘না। উয,’ বিড়বিড় করে বললাম। ‘এমন অসাধারণ ভিলেন আর জন্মায়নি। তেল দিয়ে তৈরি ওর পুরো শরীর। কী বুঝলে?’

‘খাইছে…ও নিঃসন্দেহে তেলতেলে, নোংরা আর গা ঘিনঘিনে একটা জীব,’ বলল মুসা।

‘তোরা এত সুন্দর-সুন্দর সিনারি কিন্তু মিস করছিস,’ বলল চাচী।

‘বুঝি না,’ বলল রবিন। ‘ও তো আস্ত একটা তেলের ডিপো। ওকে তোমার এত পছন্দ কেন?’

‘ওটাই তো কারণ,’ বললাম।

‘বাঁয়ে ঘোড়ার খামার,’ বলল চাচা, গাড়ির গতি কমাল। ‘পাহাড়টার দিকে তাকা। ঘোড়াগুলো নিশ্চয়ই খুব ভালভাবে ট্রেনিং পেয়েছে। ওগুলো রেস করে কিনা কে জানে।’

রবিন বইটা আমার কাছ থেকে নিতে চাইল। কিন্তু আমি আঁকড়ে ধরে রইলাম।

‘আমার পড়া শেষ হয়নি,’ বললাম। ‘তাছাড়া তোমার তো উয পছন্দ নয়।’

রবিন ঠোঁট ওল্টাল।

‘আর তো কিছু করার নেই। ভুল করে আইপডটা প্যাক করে ফেলেছি।’

‘এত সুন্দর সিনারি দেখছ না কেন?’ চাচী বাতলে দিল। ‘কীভাবে সুপারহিরো হবে সে নিয়ে যে বোনাস সেকশনটা আছে ওটা দেখেছ?’ রবিনকে প্রশ্ন করলাম।

‘না। দেখব কখন, তুমি তো বইটা দখল করে রেখেছ!’

‘ওখানে বলছে নিজের ভেতরে সুপারহিরো খুঁজে পাওয়া খুব সহজ ব্যাপার।’

হেসে উঠল মুসা।

‘খাইছে, তারমানে তুমি মত পাল্টেছ? এখন ভাবছ এই কমিক বইটা তোমাকে সত্যি-সত্যি সুপারহিরো বানিয়ে দেবে?’

‘না…ঠিক তা নয়,’ বললাম।

‘গ্রাফিক নভেলগুলোর পেছনে ওটা দেয় কেন জান?’ বলল রবিন। ‘পাতাগুলো ভরার জন্যে। কাহিনী শেষ। তাই পেছনে আজেবাজে জিনিস দিয়ে ভরিয়ে রাখে। তোমাকে সুপারহিরো বানিয়ে দেবে ভাবার কোন কারণ নেই।’

‘ঠিকই বলেছ,’ বললাম। ‘একদম ঠিক।

‘এবার আমার পালা,’ বলল রবিন। আমার হাত থেকে আবারও ছিনিয়ে নিতে চাইল বইটা-এবং টানাটানির ফলে গাড়ির সিটে টুক করে খসে পড়ল কী যেন।

জিনিসটা কুড়িয়ে নিল রবিন।

‘আরি, একটা বুকমার্ক।’ খুঁটিয়ে দেখল ওটা। ‘অদ্ভুত তো।’

‘কেন? অদ্ভুত কেন?’ প্রশ্ন করলাম। ‘কী লেখা?’

‘পড়তে পারছি না,’ জানাল ও। ‘খুবই ছোট টাইপ।

‘দেখি,’ বলল মুসা। হাতে নিয়ে পড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। ‘তাই তো!’

আমি বুকমার্কটা কেড়ে নিয়ে গুঁজে দিলাম বইটার ভেতরে।

‘পরে দেখব,’ বললাম। ‘বইটা সুপার!’

‘তোরা সামনে তাকিয়ে দেখ-এক পাল কালো ভেড়া!’ এসময়ে চাচা বলে উঠল।

.

রবিন আর মুসাকে যার-যার বাসায় নামালাম আমরা। তারপর আমাদের ড্রাইভওয়েতে ঢুকতেই, ডন দৌড়ে এল আমাদেরকে স্বাগত জানাতে। বলাই বাহুল্য ওর প্রথম কথাটাই হলো, ‘কিশোরভাই, তুমি আমার জন্যে কী এনেছ?’

চাচা-চাচীকে সুটকেসগুলো বইতে সাহায্য করলাম আমি। এবার ডনকে ওর বাড়তি নাকটা দিলাম। জিনিসটা ও নিজের মুখে না লাগিয়ে সাঁটাল লিভিং রুমের দেয়ালে-ওর ধারণা ওটাকে ওখানে অপূর্ব দেখাবে!

বাকি দিনটুকু গেল চাচীকে আনপ্যাক করার কাজে সাহায্য করে আর আমার কামরাটা গোছগাছ করতে। লম্বা জার্নির ধকলে সবাই ক্লান্ত ছিলাম আমরা এবং তাই সকাল-সকাল শুতে গেলাম।

উয আর সুপারপাওয়ারের কথা বারবার আসছে আমার ভাবনায়…সুপারপাওয়ার…

হাই তুললাম, এতটাই ক্লান্ত যে পড়তে পারব না। কিন্তু কাল নিজের সুপারপাওয়ার খুঁজে বের করতেই হবে আমাকে।

.

পরদিন শনিবার। বিকেলে, ওপরতলায় নিজের ঘরে ছিলাম আমি। বিছানায় উযের বইটা খোলা। পেছনের পাতাগুলো উল্টাচ্ছি।

নিজের সুপ্ত সুপারহিরোকে খোঁজো

ওটাই লেখা রয়েছে। আমি জানি পুরো ব্যাপারটাই ফালতু। অর্থহীন। ভুয়া।

কোন সন্দেহ নেই এতে।

কিন্তু তারপরও চেষ্টা করতে চাই। চেষ্টা করতেই হবে আমাকে।

উপুড় হয়ে শুয়ে আছি বিছানায়, নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেই প্রথম পাতাটা উল্টে পড়তে লাগলাম…

অনেক ক্ষমতার মধ্য থেকে তোমাকে ওটা বেছে নিতে হবে। চেষ্টা করে দেখতে হবে। গবেষণা করতে হবে। জন্মগত ক্ষমতা ব্যবহার করতে চাইলে ওটা খুঁজে নিতে হবে নিজেকেই!

শক্তির সন্ধান যখন পাবে, নিজেই জানবে। তোমার ক্ষমতা তোমার মধ্যেই থাকবে। ওটা হয়ে যাবে তুমি-এবং তুমি হয়ে যাবে ওটা! মিলেমিশে একাকার।

বাহ, দারুণ তো। কিশোর, তুমি পারবে! নিজেকে বললাম। এগিয়ে যাও, বন্ধু। চেষ্টা করে দেখো!

সাত

তোমার সুপ্ত সুপারপাওয়ারের কি ওড়ার ক্ষমতা আছে? জানতে হলে, তোমাকে একাগ্রতা আনতে হবে…তোমার চিন্তা-ভাবনা আর মাংসপেশীগুলোকে এক করো। উড়তে পারাটা পাখিদের জন্য আশীর্বাদ। শুরুতে, তোমাকে পাখিদের কাছ থেকে কিছু জিনিস ধার নিতে হবে। দুটো তরতাজা পালক লাগবে, জ্যান্ত পাখির দেহ থেকে পেতে হবে ওগুলো, উষ্ণতার স্পর্শ যাতে লেগে রয়েছে এখনও…

দুটো পাখির পালক।

‘সমস্যা নেই,’ আপনমনে আওড়ালাম।

বেশিরভাগ মানুষের বেগ পেতে হবে টাটকা, গরম পাখির পালক খুঁজে পেতে। কিন্তু আমার নয়। তারমানে আমার কপালে আকাশে ওড়া নাচছে।

বিছানায় বইটা খোলা রেখে দিলাম। এবার স্পিকার্স পরে হল-এ বেরিয়ে এলাম।

ডনের কামরাটা আমারটার উল্টোদিকে। ওকে দেখলাম বাড়তি নাকটা ওর ল্যাপটপের স্ক্রিনে সাঁটছে।

‘কিশোরভাই, কোথায় যাচ্ছ?’ চেঁচিয়ে বলল।

‘এই তো, এক মিনিটের জন্যে একটু বাইরে যাচ্ছি,‘ জানালাম।

‘আমার সাথে টেদারবল খেলবে?’ প্রশ্ন করল ডন। ‘রাশেদ আঙ্কেল দড়িটা ঠিক করেছেন।’

‘আমি ব্যস্ত,’ বললাম।

‘আচ্ছা, তাহলে পরে,’ বলল ও।

ভাল ছেলে। সমঝদার।

পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গুমট, মেঘলা দিন, কালো মেঘরাশি নিচু হয়ে ঝুলছে গাছের ওপরে। মনে হচ্ছে পরে হয়তো বৃষ্টি হতে পারে।

আমাদের প্রতিবেশী, মিস্টার রোডসের গ্যারেজের পেছনে কবুতরের খাঁচা রয়েছে। তিনি কয়েক ডজন কবুতর পালেন। ওদের ডাক শুনতে পাচ্ছি।

ভদ্রলোক আশপাশে আছেন কিনা আগে দেখে নিলাম। তাঁর বাসার পেছনটা কেমন অন্ধকার। ড্রাইভওয়েতে গাড়িটা নেই।

মি. রোড্‌স্ আমাকে দেখতে পারেন না। ভদ্রলোকের ধারণা তাঁর টমেটো বাগানের ওপর দিয়ে আমার বন্ধু-বান্ধবদের দৌড়োদৌড়ির জন্য আমিই দায়ী। কথা সত্যি, আমরা ওখানে আমাদের ফ্রিসবি-টা খুঁজছিলাম। কিন্তু আমরা আসলে ঠিক তাঁর বাগানটা মাড়াইনি।

যাই হোক, আমাকে তাঁর কবুতরের পালক খসাতে দেখলে নিশ্চয়ই খুশি হবেন না তিনি। ধরা পড়লে কী বলব তাঁকে? কেন এসেছি এখানে ব্যাখ্যা দেব কীভাবে?

আমাদের দুই উঠনের মাঝখানে, নিচু ঝোপ-ঝাড়গুলোর আড়ালে গা ঢাকা দিলাম। এবং যথাসম্ভব দ্রুত ছুটে পৌঁছে গেলাম পায়রার খাঁচাগুলোর কাছে। গ্যারেজে ঠেস দিয়ে উঁচু গাদা করে রাখা ওগুলো। তার দিয়ে ঘেরা ছটা কাঠের খাঁচা গুনলাম, প্রতিটায় দশ-বারোটা করে কবুতর।

পাখিগুলোর কাছে ছুটে যেতেই, ওরা ত্রাহি ডাক ছেড়ে ডানা ঝাপটাতে লাগল এবং একটা আরেকটাকে দাঁড় থেকে ফেলে দিল।

‘শশশ, শান্ত হ, বাছারা,’ ফিসফিস করে বললাম।

গ্যারেজের চারপাশে চোখ বুলিয়ে বাড়িটার দিকে চাইলাম। মি. রোডসের পেছনের জানালায় কি একটা বাতি জ্বলে উঠল?

বুকের ভেতরে ধড়াস করে উঠল। গলা শুকিয়ে খসখসে হয়ে গেল হঠাৎ করেই।

নির্বোধ পায়রাগুলো বাকবাকুম করে জ্বালিয়ে মারল! সে কী প্রচণ্ড ডানা ঝাপটানি! দুটো তো রীতিমত লড়াই-ই বাধিয়ে দিল, পরস্পরের চোখে ঠোকর মারার অপচেষ্টা করছে।

মাঝের খাঁচাটায় আঙুল গলাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তারের মধ্যকার ফাঁক খুবই সামান্য। দুটো পালক খসানোর কোন উপায়ই নেই, এমনকী কোন কবুতর যদি আমার খাতিরে সঙ সেজে বসে থাকে তবুও।

খাঁচার দরজার ছিটকিনির উদ্দেশে হাত বাড়ালাম। ওরে সর্বনাশ, সঙ্গে-সঙ্গে কবুতরগুলো আরও চড়া সুরে কোরাসে বাকবাকুম শুরু করে দিল।

‘শশশ, ওরে, একটু চুপ কর, সোনারা!’

গ্যারেজের দেয়ালের কোনা দিয়ে উঁকি মারলাম আবারও। হ্যাঁ। কিচেনে বাতি জ্বলছে কোন সন্দেহ নেই। আর ওটা মি. রোস্ না, জানালা দিয়ে শ্যেনদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছেন এদিকে?

যা করার চটপট করে ফেলতে হবে। ছিটকিনি নামানোর সময় সে কী কাঁপুনি আমার হাতে! খাঁচার দরজাটা টেনে খুললাম।

‘অ্যাই!’

কবুতরগুলো ডানা ঝাপ্টে, পতপত করে উড়ে এল খোলামুখের কাছে। আমার হাত ঠেলা-ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পালাবার পাঁয়তারা আরকী।

‘অ্যাই, কে রে?’ বাসা থেকে গর্জন ভেসে এল মি. রোডসের। ‘ওখানে কে?’

আমার হাতের পাশ দিয়ে সাঁত করে শরীর গলিয়ে খাঁচা ছেড়ে আরেকটু হলেই পালাচ্ছিল একটা কবুতর। কবজি দিয়ে চেপে ধরে রাখলাম দরজাটা। পাখিগুলো ডাক ছেড়ে ঝাঁপাল আমার উদ্দেশে।

লেজের কটা পালক খপ করে আঁকড়ে ধরলাম। লক্ষ্যভ্রষ্ট। আবার পাকড়ালাম।

হ্যাঁ! আঙুলের ফাঁকে তিনটে পালক গুঁজে রয়েছে, বাড়তি একখানা জুটেছে ভাগ্যে।

শক্ত করে চেপে ধরলাম অমূল্য পালকগুলো, প্রার্থনা করছি যেন খসে পড়ে না যায়। এবার সাবধানে, খাঁচা থেকে হাত বের করলাম। মুক্ত হাতটি দিয়ে, খাঁচার দরজা লাগিয়ে ছিটকিনি মারলাম।

পালক তিনটে হাতের তালুতে নিয়ে ওগুলোকে নিরাপদ রাখার জন্য মুঠো পাকালাম। এবার দে দৌড়, টলমল পায়ে ছুটছি।

ঝোপ-ঝাড়ের লম্বা সারিটার কাছে যেই না পৌঁছেছি, অমনি দড়াম করে খুলে গেল মি. রোডসের বাসার পেছনের দরজা। তাঁকে বেরোতে দেখলাম, ধূসর বাথরোবটার বেল্ট বাঁধছেন।

‘কে রে? কে ওখানে?’ বাজখাঁই গলায় চিৎকার ছাড়লেন।

পড়বি তো পড় মালীর ঘাড়ে, প্রমাদ গণলাম।

কবুতরগুলো তাঁর সাড়া পেয়ে তারস্বরে চেঁচিয়ে-মেচিয়ে জবাব দিল।

ঝোপের পেছনে লুকিয়ে, তাঁকে কবুতরের খাঁচাগুলোর কাছে গটগট করে হেঁটে যেতে দেখলাম। ভদ্রলোক গ্যারেজের আড়ালে উধাও হতেই, পাঁই-পাঁই ছুটলাম। তীরবেগে বাসায় ঢুকে সশব্দে দরজাটা পেছনে লাগালাম।

চাচা কিচেন টেবিলে বসে ছিল, ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছে। মুখ তুলে তাকাল এবং একদৃষ্টে চেয়ে রইল আমার মুঠো পাকানো হাতের দিকে।

‘কিশোর, তোর হাতে কী রে?’

‘উম…স্কুলের সায়েন্স এক্সপেরিমেন্টের জিনিস,’ বললাম কোনমতে।

ডাহা মিথ্যে তো বলিনি। এটা তো বিজ্ঞান গবেষণারই অংশ, তাই না?

পালকগুলো শক্ত করে মুঠোয় ধরে রইলাম, গরম রাখছি। এবার দুদ্দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে উঠে এলাম আমার ঘরে।

হল-এর ওপ্রান্তে নিজের ঘরে ছিল ডন। বন্দুকের গুলির শব্দ আর কামানের গোলার বিস্ফোরণ শুনতে পাচ্ছি। ওয়র ভিডিও গেমস দারুণ ভালবাসে ও।

পালকগুলো বিছানায় নিয়ে এসে সযত্নে বালিশের ওপর রাখলাম। গভীর শ্বাস টানলাম। বুকের ধড়ফড়ানি থামেনি এখনও।

এবার বইটা তুলে নিয়ে নির্দেশগুলো আরেকটু পড়লাম…

দুটো তরতাজা, উষ্ণ পাখির পালক আর এক প্যাকেট ইস্ট লাগবে…

কিচেনে গেলাম। চাচা গভীর মনোযোগে পর্দায় দৃষ্টি ধরে রেখেছে। ভ্রূজোড়া কোঁচকানো।

‘আমাদের বাসায় কি ইস্ট আছে, চাচা?’ জিজ্ঞেস করলাম। ‘সায়েন্স এক্সপেরিমেন্টটার জন্যে দরকার।’

চোখ তুলল না চাচা। স্রেফ চুলোর ওপরে ক্যাবিনেটটা দেখিয়ে দিল আঙুল-ইশারায়।

হাতড়ে হাতড়ে শেষমেশ ক’প্যাকেট ইস্টের গুঁড়ো ভরা এক বাক্স খুঁজে পেলাম। আমার কামরায় ওটা বয়ে নিয়ে উঠে এসে ফের মন দিলাম বইটায়…

পালকগুলো তোমাকে উড়তে সাহায্য করবে। ইস্ট তোমাকে উঁচুতে উঠিয়ে নেবে। দু’পকেটে দুটো পালক রাখো। এবার ইস্ট ঢালো তোমার মাথায়। নিজের ক্ষমতাকে এক করো। তোমার ওড়ার সক্ষমতা থাকলে, নিমেষে তুমি শূন্যে ভেসে উঠবে।

সতর্কতা: তোমার সুপ্ত ক্ষমতা যদি উড়তে পারা হয়, তবেই কেবল ছাদ কিংবা কোন উঁচু জানালা থেকে লাফ দেবে, তার আগে নয়।

জানি পুরো ব্যাপারটাই আজগুবী। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি কবুতরের পালক জোগাড় করেছি। এখন চেষ্টা আমাকে করতেই হবে।

জিন্সের দু’পকেটে দুটো পালক গুঁজলাম। এবার বাক্সটা খুলে ক’প্যাকেট ইস্ট বের করে মাথায় ঢাললাম। খানিকটা গুঁড়ো পড়ল আমার টি-শার্টের কাঁধের ওপর। পড়কগে, ঝাড়লাম না।

আমার কম্পিউটারের সামনে থেকে ডেস্ক চেয়ারটা টেনে বের করে কামরার মাঝখানে হিঁচড়ে নিয়ে এলাম। এবার উঠলাম ওটার ওপর। সাবধানে…খুব সাবধানে, মাথা থেকে ইস্ট যাতে আর ঝরে না পড়ে।

এবার চোখ বুজে একাগ্র হওয়ার চেষ্টা।

জানি স্রেফ পাগলামি ছাড়া কিছু নয় এটা। কিন্তু আমি উত্তেজনা বোধ করছি। বুক ভরে শ্বাস টেনে ধরে রাখলাম।

যদি কাজ হয় এতে? যদি সত্যিই আমি সুপারহিরোর মত উড়তে পারি?

মনোযোগ ঢেলে দিলাম…মনকে শান্ত করলাম…

চোখ মেললাম।

‘এইবার!’ জোরে চিৎকার ছাড়লাম।

হাঁটুজোড়া ভাঁজ করলাম-এবং চেয়ার ছেড়ে লাফ দিলাম। বাতাসে। হ্যাঁ! হ্যাঁ!

মেঝেতে পতনের অপেক্ষা করলাম। কিন্তু না-ভাসছি আমি…বাতাসে ভাসছি।

দু’বাহু উঁচিয়ে আরেকটু ভেসে উঠলাম। মেঝে থেকে অন্তত তিন-চার ফিট ওপরে এখন আমি!

কী অদ্ভুত! অবিশ্বাস্য! কিন্তু কাজ তো হচ্ছে।

হাতজোড়া আরও উঁচালাম এবং অনুভব করলাম উড়ে উঠছি আরও ওপরে। বাতাসে হালকা পালকের মতন ভাসছি। আমার দেহ সাঁ করে উড়ে গেল ওপরে-যতক্ষণ না হাতজোড়া ছাদ স্পর্শ করল।

এবার… ‘ওহ্, নাআআআআ!’

ঝপ করে নিচে পড়তেই দীর্ঘ এক গোঙানি বেরিয়ে এল আমার গলা চিরে।

সজোরে মুখ থুবড়ে পড়েছি। ফুসফুস থেকে বাতাস বেরিয়ে গেল হুশ করে। দম বন্ধ এক শব্দ বেরোল মুখ দিয়ে। শ্বাস নিতে পারছি না। সারা দেহ জুড়ে ওঠা-নামা করল যন্ত্রণার ঢেউ।

‘গেছি রে, ওহ…..বাঁচাও,’ শ্বাসের ফাঁকে বললাম। ‘বাঁচাও। শরীরের সব কটা হাড় ভেঙে গেছে!’

আট

ধীরেসুস্থে মাথা তুললাম। গভীর, কাঁপা-কাঁপা শ্বাস টানলাম।

চিবুকটা ভেজা-ভেজা লাগল। দু’আঙুলে মুছতেই গাঢ় লাল রক্ত দেখলাম। জিভে রক্তের স্বাদ পাচ্ছি।

গুঙিয়ে উঠলাম, উঠে বসার চেষ্টা করলাম। মাথাটা কেমন দপ-দপ করছে। বাহু আর পাজোড়া পরখ করলাম।

কপাল ভাল, কিছু ভাঙেনি।

চোখ তুলে চাইলাম-এবং দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম ডনকে। বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে গেছে চোখজোড়া ওর।

‘আঙ্কেল! আণ্টি!’ গলা ফাটিয়ে চেঁচাল ও। ‘কিশোরভাইয়ের নাক থেকে রক্ত পড়ছে!’

একটু পরে, চাচা-চাচী দুপদাপ করে কামরায় ঢুকলে লাফিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল ডন।

‘কী হয়েছে?’ চাচা চিৎকার করে উঠল। ঝুঁকে পড়ল আমাকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে।

চাচী টিস্যু চেপে-চেপে ধরছে আমার নাকে।

‘কী করছিলি তুই, বাপ? কিশোর? ব্যথা পেয়েছিস? মেঝেতে পড়ে ছিলি কেন?’

‘আমি…মানে…’ শব্দগুলো আটকে গেল গলার ভেতরে।

‘কিশোরভাই চেয়ার থেকে পড়ে গেছে,’ তাদেরকে জানাল ডন। ‘ও চেয়ারে দাঁড়িয়ে ছিল, কীভাবে যেন পড়ে গেছে। আর পড়েছে মুখ থুবড়ে।

ঠায় দাঁড়িয়ে চোখ পিটপিট করছি, মাথা ঘুরছে। ডন আমাকে উড়তে দেখেনি। শুধু পড়তে দেখেছে।

চাচা তখনও আমার বাহু চেপে ধরে রয়েছে।

‘তুই কি চেয়ার থেকে ইচ্ছে করে লাফ দিয়েছিস?’ জবাব চাইল। ‘তুই কি নিজেকে আবার সুপারহিরো ভাবছিস নাকি, কিশোর? সারাক্ষণ তো খালি কমিক বই আর কমিক বই…’

‘না, না, তা ভাবব কেন,’ বললাম জোর গলায়। টিস্যুটা নাকে চেপে ধরলাম। রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছে। ‘আমি…আমি তো তোমাকে বলেছি সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট করছিলাম। এক্সট্রা ক্রেডিটের জন্যে।’

আমি বাড়তি ক্রেডিটের জন্য খাটলে চাচা-চাচী মহাখুশি হয়।

‘আরে, তোর চুলে এগুলো কী?’ চাচীর প্রশ্ন। আমার মাথায় হাত দিয়ে নাড়া দিতেই ইস্টের মিহি গুঁড়ো ঝরে পড়ল।

‘মনে হয় খুশকি হয়েছে,’ মিনমিন করে বললাম।

মাথা নাড়ল চাচা।

‘নব্বই পার্সেন্ট দুর্ঘটনা কিন্তু বাসায় ঘটে,’ বলল। ‘কথাটা মনে রাখিস, কিশোর।’

চাচা নিরাপত্তার ব্যাপারে সাঙ্ঘাতিক খুঁতখুঁতে!

চাচা-চাচী আরও ক’মিনিট জেরা করল আমাকে। কথা আদায় করল আমি বিপজ্জনক কোন বিজ্ঞান গবেষণা করব না। এবার দু’জনে ফিরে গেল নিচে।

ডন আমার খাটের কিনারায় বসে রয়েছে। ওর মুখের চেহারায় উদ্বেগের ছাপ।

‘টেদারবল খেলবে, কিশোরভাই?’

‘পরে খেলব, ডন। এখন আমাকে একটু একা থাকতে দাও।‘

সুবোধ বালকের মত ঘর ছাড়ল ও।

ওর পেছনে দরজাটা লাগালাম। এখনও কাঁপুনি টের পাচ্ছি শরীরে। কিন্তু সে সঙ্গে পুরোমাত্রায় উত্তেজনাও।

কাজ হয়েছিল! ভাবলাম। সত্যিই আমি উড়েছিলাম!

হ্যাঁ, ব্যাপারটা দশ সেকেণ্ডের মত স্থায়ী হয়। আসলেই আমি উড়ে কামরার ছাদে উঠে গিয়েছিলাম।

আরও বেশিক্ষণ ভেসে থাকতে পারলাম না কেন?

কারণটা আমি জানি। ওড়াউড়ি আমার গোপন সুপারপাওয়ার নয়।

বইতে লিখেছে, নিজের ভেতরে শক্তি খুঁজে পেলে ঠিকই টের পাব আমি। এবং ক্ষমতাটা আমাকে ছেড়ে যাবে না।

ভেতরে লুকানো শক্তির সন্ধান না পাওয়া অবধি চেষ্টা করে যেতে হবে আমাকে।

বইটা তুলে নিয়ে পাতা উল্টাতে লাগলাম।

তোমার গোপন মহাশক্তি খুঁজে বের করতে হলে…

হ্যাঁ! মহাশক্তি! কেন জানি মন বলছে এটাই হয়তো আমার গোপন ক্ষমতা। বিছানায় বসে কোলের ওপর বইটা রাখলাম এবং পড়তে লাগলাম নির্দেশগুলো।

শারীরিক শক্তি যদি তোমার বিশেষ ক্ষমতা হয়, তবে সহজেই তার খোঁজ পাবে। দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন জিনিসের সঙ্গে নিজেকে যাচাই করতে হবে তোমাকে। স্বচ্ছ প্লাস্টিক কিচেন র‍্যাপের চাইতে কঠিন কোন কিছু নেই। ওটা টানলে লম্বা হবে, কিন্তু ছিঁড়বে না।

স্বচ্ছ প্লাস্টিক র‍্যাপ দিয়ে বুক থেকে শুরু করে শরীরের নিচের অংশ মুড়ে ফেলো। প্লাস্টিক র‍্যাপের এক গুটি তৈরি করো। কিন্তু বাহুজোড়া মুক্ত থাকবে। এবার একাগ্রচিত্ত হও…একাগ্র। নিজেই ক্ষমতা আবিষ্কার করতে পারবে।

বেশ। সহজই তো শোনাচ্ছে। চাচা-চাচীও নিশ্চয়ই আপত্তি করবে না। চেয়ার থেকে তো আর লাফিয়ে পড়ছি না!

নিচে, ডেন–এ গান-বাজনার শব্দ হচ্ছে। চাচা-চাচী রয়েছে ওখানে, পড়ছে। পা টিপে-টিপে কিচেনে ঢুকে প্লাস্টিক র‍্যাপের একটি রোল তুলে নিলাম কিচেন প্যান্ট্রি থেকে।

ওটা নিজের কামরায় নিয়ে এসে আনরোল করার সময় উত্তেজনা ক্রমেই বাড়তে লাগল আমার, প্রথমে পাজোড়া মুড়ে নিলাম স্বচ্ছ প্লাস্টিকে। দু’পা পুরু স্তরে মোড়ার পর, কবজি মুড়তে লাগলাম।

কাজটা যত সহজ মনে হয়েছিল আসলে ততটা নয়। বুকের কাছে ওটাকে তুলতেই, রোলটা আমার হাত থেকে পড়ে যাওয়ার দশা হলো। এবার পড়েই গেল ওটা এবং আঠাল প্লাস্টিক সেঁটে গেল রোলে।

শেষমেশ টেনে খুলতে পারলাম ওটা। বুক মুড়ে ফেললাম, তারপর নামতে লাগলাম নিচের দিকে। দীর্ঘক্ষণ লাগল। একটা রোলে কয়েক মাইল প্লাস্টিক র‍্যাপ থাকে জানতাম না!

অবশেষে, কাজটা সারা গেল। প্লাস্টিকে মোড়া মমি এখন আমি। খালি বাক্সটা পড়ে গেল মেঝেতে। হাঁটার সাধ্য নেই আমার। নড়ারও।

টের পাচ্ছি কপাল আর গাল বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। ভয়ানক গরম লাগছে আমার! হাঁসফাঁস করছি রীতিমত।

‘কাজ হলেই হয়,’ আওড়ালাম বিড়বিড় করে। ‘আমার ওপর যদি মহাশক্তি ভর না করে, তাহলে আর এখান থেকে মুক্তি নেই!

চোখ মুদে একাগ্র হলাম। ফুলে ওঠা মাংসপেশী কল্পনা করলাম-এক ভারোত্তোলক ভীষণ ওজনদার কিছু তুলেছে মাথার ওপরে।

একাগ্র হও…একাগ্র…

আচমকা, কিছু একটা অনুভব করলাম। ককিয়ে উঠল প্লাস্টিকের মোড়ক। টান-টান হতেই শব্দ করে উঠছে। পায়ের কাছে মোড়ক ছিঁড়ে যাচ্ছে টের পাচ্ছি।

এবার ফটাস করে বুকের কাছটায় ছিঁড়ল মোড়ক। কোন কিছু ছেঁড়ার আরেকটা জোরাল শব্দ পেতেই নিচের দিকে চাইলাম। আমার টি-শার্টটা ফেটে গেছে।

স্ফীত হয়ে উঠেছে আমার দু’বাহুর মাংসপেশী। ফুলে উঠেছে বেলুনের মতন। টি-শার্টটা পুরোপুরি ছিঁড়ে আলগা হয়ে গেছে। প্যান্ট ছিঁড়ছে এখন।

ইনক্রেডিব্লু হাল্কের মত অনুভূতি হচ্ছে আমার।

আমার গোটা দেহ বেড়ে চলেছে…ফুলে উঠছে…প্লাস্টিকের মোড়কের গুটিতে টান পড়ছে-যতক্ষণ অবধি না প্লাস্টিক ছিঁড়ে খসে পড়ল।

বুকের ছাতি ফুলেফেঁপে উঠেছে, কুটি-কুটি হয়ে গেল আমার টি-শার্ট। পাজোড়া ভারী ঠেকছে…চওড়া…কোমর স্ফীত হতেই ফট করে ছিঁড়ে গেল জিন্স-এবার শতচ্ছিন্ন হয়ে গেল ওটা।

কতক্ষণ চলবে এমন? বাড়তে-বাড়তে আমি কি এই বাড়িটার সমান হয়ে যাব নাকি? এটা যদি আর না থামে?

হায়-হায়, বাড়ার এই গতি যদি না থামে, তখন?

নয়

ক’মুহূর্ত পরে, হুশ করে এক শব্দ শুনলাম। বেলুন থেকে বাতাস বেরিয়ে যাওয়ার মত।

কামরাটা ঘুরপাক খাচ্ছে আমার চারপাশে। মাথা ঘুরছে। ছাদটা কাত হলো আমার মাথার ওপরে।

এক কি দু’মুহূর্ত, তারপর পুরো কামরাটা যেন ছিটকে বেরিয়ে গেল। এবার মেঝে উঠে এল আমার সাথে মিলিত হতে। আবারও স্বাভাবিক আকার ফিরে পেলাম আমি।

‘ওহহ।’ দাঁড়িয়ে থেকে শিউরে উঠলাম, সারা শরীর কাঁপছে। বাহু আর পায়ের সব কটা মাংসপেশী থরথর করছে। চামড়ায় টান টের পাচ্ছি। সর্বাঙ্গে চুলকানি, কাঁটা-কাঁটা অনুভূতি আর কাঁপুনি।

কাজ হয়েছিল! ভাবলাম। কী আশ্চর্য! কাজ হয়েছিল।

কিন্তু আবারও…মাত্র দশ সেকেণ্ডের জন্য।

নড়লাম না। একটা ঘোরের মধ্যে আছি মনে হলো।

কিছুক্ষণ পরে উপলব্ধি করলাম পরনের জামা-কাপড় শরীর থেকে ফেটে বেরিয়ে গেছে। সম্পূর্ণ নগ্ন দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি!

এবার হল-এ ডনের চেঁচামেচির শব্দ পেলাম: ‘আণ্টি! আঙ্কেল! শীঘ্রি আসুন! কিশোরভাইয়ের ঘরে কী যেন হচ্ছে!’

তারা উঠে আসার আগেই কিছু করে ফেলতে হবে আমাকে। টলতে-টলতে ক্লজিটের কাছে গেলাম। শতচ্ছিন্ন জিন্স খসালাম।

সিঁড়ি ভেঙে দুদ্দাড় করে উঠে আসছে চাচা-চাচী, পায়ের শব্দ পেলাম।

‘জলদি!’ ডন চিৎকার ছাড়ল তাদের উদ্দেশে। ‘কিশোরভাইয়ের মনে হয় কোন বিপদ হয়েছে!’

খুদে বিচ্ছু।

সময় নেই। একদমই সময় নেই।

মেঝেতে স্তূপ করে রাখা ময়লা কাপড় থেকে ছোঁ মেরে একটা পাজামা তুলে নিলাম।

‘কিশোরভাই উদ্ভট কোন কিছু করছে!’ বলল ডন। বেডরুমের দরজা খুলে যাচ্ছে।

হাঁচড়ে পাঁচড়ে পাজামাটা পরে নিলাম, হাঁফাচ্ছি, বুক ধড়ফড় করছে।

ছেঁড়া জিন্স আর টি-শার্ট এক লাথিতে চালান করলাম খাটের নিচে, পরমুহূর্তে ধেয়ে এসে ঘরে ঢুকল চাচী। চারপাশে চকিতে চোখ বুলিয়ে নিল

একটু পরে, কামরায় পা রাখল চাচা, মুখের চেহারা কঠিন।

‘এবার কী?’ জবাব দাবি করল।

চাচী ভ্রূ কুঁচকে দেখছে আমাকে।

‘এই, তুই দিনের বেলায় পাজামা পরেছিস কেন রে? শরীর খারাপ লাগছে?’

‘ন-না, তুতলে বললাম। ‘পাজামায় স্বচ্ছন্দ বোধ করি আমি।’ খোঁড়া যুক্তি। কিন্তু এমুহূর্তে এর বেশি আর কিছু মাথায় এল না।

দু’জনেই কঠোর দৃষ্টিতে চেয়ে রইল আমার উদ্দেশে। তাদের পেছনে, দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ডন, দু’বাহু বুকের কাছে ভাঁজ করে রেখেছে। মুখের চেহারায় উদ্বেগ।

‘কিশোরভাই এখানে কী যেন করছিল। আমি আওয়াজ পেয়েছি।’

চাচী চাইল বিছানায় পড়ে থাকা উযের বইটার দিকে।

‘এখনও ওই কমিক বইটা পড়ছিস তুই? বাইরে গিয়ে তাজা হাওয়া খেয়ে আয় যা।’

‘আ…আমি একটু ব্যস্ত আছি, চাচী,’ বললাম। ‘পরে যাব, কেমন?’

‘ও আমার সাথে খেলতে চায় না,’ ডন বলল।

সবাইকে বিদায় করতে আরেকটু সময় লাগল। গায়ের কাঁপুনি এখনও থামেনি আমার। চামড়ায় এখনও টান-টান ভাব আর চুলকানি রয়ে গেছে।

স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম বিছানায় পড়ে থাকা উযের বইটার দিকে। আরেকটা সুপারপাওয়ার কি চেষ্টা করে দেখব?

দুটো চেষ্টা করেছি এবং সেগুলো আমার জন্য নয়। বারেবার তিনবার হয়তো…

এবার এক বিষণ্ণ চিন্তা ঘাই মারল মাথায়: কোনটাই যদি কাজ না করে? আমি যদি কোন সুপারপাওয়ারই না পাই?

এমন যদি হয় আমি অতি সাধারণ এক ছেলে, মোটেই বিশেষ কেউ নই?

আমাকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বইটা তুলে নিলাম।

এবার কোন ক্ষমতাটা বাছাই করব আমি? পানির ক্ষমতা হলে কেমন হয়? আমি সাঁতরাতে ভালবাসি। ভাল ডাইভও দিতে পারি। ওটা নিশ্চয়ই পানির ক্ষমতাই হবে। হ্যাঁ! হ্যাঁ!

আমি জানি, এবার কাজ হবেই!