মূর্তিমান আতঙ্ক – ১৫

পনেরো

‘উহ, জ-জমে গেলাম!’ তোতলাচ্ছি রীতিমত।

গলা অবধি বরফজল নিয়ে টাবে শুয়ে রয়েছি। গায়ের চামড়া লালচে আর কাঁটা-কাঁটা হয়ে উঠেছে। কিউব ভাসছে, ধাক্কা খাচ্ছে আমার চারপাশে।

প্রথমে শিহরন অনুভব করলাম। তারপর গভীর শিহরন।

‘এ-এটা নি-নিছক পাগলামি,’ গুঙিয়ে উঠলাম। দাঁতে দাঁত

বাড়ি খাচ্ছে খটাখট। ‘কা-কাজ হচ্ছে না।’

ওহ, এক মিনিট।

আরে, হচ্ছে তো!

কাঁপুনি, শিহরন আর দাঁতের খটাখটি হঠাৎই থেমে গেল। আমার পুরো দেহ অসাড় হয়ে গেছে বলে?

না। আমার অন্যরকম এক অনুভূতি হচ্ছে। টের পাচ্ছি আমার শরীরে পরিবর্তন আসছে।

গলে যাচ্ছি আমি! ভাবলাম। সহসাই দুর্বল অনুভব করলাম…নরম…একদম হালকা

আমি মিলিয়ে যাচ্ছি। গলে যাচ্ছি…পরিণত হচ্ছি পানিতে! না চামড়া, না হাড়-স্রেফ জল।

এবং এসময়ই আমার সমস্ত দুর্বলতা কেটে গেল। শক্তির ফোয়ারা বইছে যেন দেহজুড়ে। বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে আমার শরীরের ভেতর দিয়ে।

বাথটাবে রীতিমত উত্থান ঘটল আমার। ঢেউয়ের মতন। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের মত। সে এক আশ্চর্য অনুভূতি!

ওটা টিকল প্রায় দশ সেকেণ্ডের মত।

ক্রমেই উঁচু হচ্ছি আমি…আরও উঁচু…এবার ছলাৎ করে ফের পড়ে গেলাম। পরক্ষণে আমার দু’কাঁধের ওপর দিয়ে বয়ে গেল হিমশীতল পানি। কোমরের কাছে ঠোকর খাচ্ছে বরফের টুকরো।

আবারও ঠাণ্ডায় হি-হি করে কেঁপে উঠলাম। জমে যাওয়ার দশা! থরথর কাঁপুনি আর শিহরন শুরু হলো।

ঠক-ঠক করে এতটাই কাঁপছি, বাথটাবের দু’পাশ পর্যন্ত আঁকড়ে ধরতে কষ্ট হলো। নিজেকে টেনে বের করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার পাজোড়া জমে অবশ হয়ে গেছে।

‘আহ-আহ-আহ-আহ-আহ।’ দাঁতে দাঁত বাড়ি খাওয়ার ফাঁকে শব্দ বেরোচ্ছে আমার গলা দিয়ে। ‘আহ-আহ-আহ-আহ।’

শেষমেশ বেরোতে পারলাম টাব থেকে। দাঁড়ানোর সাধ্য নেই। মেঝেতে গড়িয়ে পড়লাম। চিতিয়ে পড়ে থেকে কাঁপছি থরথরিয়ে আর গোঙাচ্ছি। জমে যাওয়া হাতজোড়া পরস্পর চেপে ধরলাম। লাথি ছুঁড়লাম বাতাসে।

অসাড়। সব কিছু জমে অবশ হয়ে গেছে। শীতল যন্ত্রণা হুল ফোটাচ্ছে আমার হাতে-পায়ে।

কোনভাবে টাওয়েল র‍্যাক থেকে একটা বাথ টাওয়েল পাকড়ালাম। ওটা শরীরে জড়াতে রীতিমত বেগ পেতে হলো।

‘আ-আমার শ-শরীর আর কখনও গরম হবে না,’ বিড়বিড়িয়ে বললাম। ‘আর ক-কখনও গ-গরম হবে না!’

আরেকটা তোয়ালে পেঁচিয়ে নিলাম গায়ে। এবার টলমল পায়ে আধো হেঁটে আর আধো গুড়ি মেরে নিজের কামরায় গেলাম।

তিনটে শার্ট, দুটো সোয়েটার আর আমার সবচাইতে গরম সোয়েটপ্যান্টটা পরলাম। তারপর সোজা কম্বলের নিচে।

কিন্তু শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে যাওয়া হিমস্রোত ঠেকাতে পারছি না। শরীরটা এমনভাবে কাঁপছে যেন শক্তিশালী ভূমিকম্পের মধ্যে পড়েছি।

কোথায় ভুল করছি আমি জানতে হবে, সিদ্ধান্ত নিলাম। ক্ষমতাটা মাত্র দশ সেকেণ্ড টেকে কেন?

হাঁটার মত যথেষ্ট গা গরম হলেই, কমিক কনভেনশনে ফিরে যাব আমি। ওই ড্যারেল লোকটার সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাকে আমার খারাপ লাগেনি। উযের মত নয় সে। তার কাছ থেকে হয়তো জানতে পারব ভুলটা কোথায় হচ্ছে।

বালিশে ঠাণ্ডা মুখটা গুঁজলাম। কম্বলের তলায় নিজেকে গুটিয়ে শক্ত এক বল পাকালাম। কাঁপাকাঁপিটা যদি শুধু বন্ধ হত!

বেড টেবিলের ঘড়িটা এক নজর দেখে নিলাম। সাড়ে চারটা। অনেক সময় হাতে। কনভেনশন সেন্টারে উযের বইটা নিয়ে গিয়ে, ড্যারেলের সঙ্গে কথা বলে দেখি তার কোন পরামর্শ আছে কিনা; তারপর আবার যথাসময়েই বাসায় ফেরা যাবে।

ক’মিনিট পরে, অনেকটা স্বাভাবিক লাগতে লাগল। গায়ের চামড়া এখনও লালচে আর দাগে ভরা। তবে হাতে-পায়ে খানিকটা সাড় ফিরেছে। দুটো সোয়েটার আর দুটো শার্ট খুলে ফেললাম। জিন্স পরে নিলাম। পায়ে গলালাম স্নিকার্স।

বইটা থাবা মেরে তুলে নিয়ে তরতর করে নেমে এলাম নিচে। চাচীকে ডেন-এ পেলাম।

‘চাচী, আমাকে আবারও কমিক কনভেনশনে যেতে হচ্ছে, বললাম। ‘একটা কাজ আছে।’

পত্রিকা পড়ছিল, চোখ তুলে চাইল চাচী।

‘সরি, কিশোর। তুই গ্রাউণ্ডেড, মনে নেই?’

‘কিন্তু, চাচী,’ মিনতি করলাম। ‘ব্যাপারটা খুবই জরুরী। আজ বিকেলের জন্য আমাকে একটু ছাড় দাও না, প্লিজ।’

মাথা নাড়ল সে।

‘না। লণ্ডির কাজটা শেষ করেছিস?’

‘প্রায়,’ বললাম।

চাচীকে কি সত্যি কথাটা বলব? সুপারপাওয়ার হাসিলের জন্য যে আমার উপদেশ দরকার?

না। কেউ বিশ্বাস করবে না।

‘চাচী, কনভেনশন সেন্টারের এক লোক আমাকে উযের এই বইটার জন্যে তিনশো ডলার দিতে চায়।’ তুলে ধরে দেখালাম গ্রাফিক নভেলটা। সত্যি কথাটাই বলছি। শুধু এটা চেপে গেলাম ওটা বিক্রির কোন ইচ্ছে নেই আমার।

পত্রিকাটা কোলের ওপর নামাল চাচী

‘এত টাকা! লোকটার কোন বদ মতলব নেই তো?’

‘না,’ বললাম। ‘যাই?’

‘না,’ জবাব দিল চাচী। ‘মনে নেই, তোকে বলেছিলাম তোর চাচা আর আমি বাইরে যাব? তুই বাসায় ডনকে দেখে রাখবি।’

‘কিন্তু, চাচী—’

কপাল কুঁচকে আমার দিকে কটমটে দৃষ্টি হানল চাচী। বুঝে গেলাম যা বোঝার। এর অর্থ, চুপ কর, কিশোর, যদি নিজের ভাল চাস।

কাজেই মুখে কুলুপ আঁটলাম।

বেজার করে তুললাম চেহারাখানাকে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, বইটা বগলদাবা করে সিঁড়ি ভেঙে উঠে এলাম ওপরে।

খানিক পরে, ডনের দায়িত্ব আমার ওপর চাপিয়ে বিদায় নিল চাচা-চাচী গাড়িটা ড্রাইভ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে শুনতে পেলাম। রাস্তায় পৌঁছনোর আগে ছোট করে দু’বার হর্ন দিল চাচী। প্রায় সময়ই দেয়। কারণটা জানি না। এবার রওনা হলো চাচাকে নিয়ে।

তারা চলে যেতেই, লাফাতে-লাফাতে আমার ঘরে এসে ঢুকল ডন।

‘কিশোরভাই, কী করতে চাও?’ জিজ্ঞেস করল। ‘খেলবে?’ স্থির চোখে চেয়ে রইলাম ওর দিকে। এবার দৃষ্টি দিলাম উযের বইটার প্রতি।

এবং সহসাই বুঝে গেলাম কী করতে চাই আমি।

জানি কী করতে হবে আমাকে।

ষোলো

‘জুতো পরো,’ বললাম। ‘আমরা কমিক কনভেনশনে যাচ্ছি।’

চোয়াল ঝুলে পড়ল ওর।

‘কী?’

‘তুমি চেয়েছিলে না?’ বললাম ওকে। ‘এ-ই সুযোগ।’

দাঁত বেরিয়ে পড়ল ডনের।

‘কী মজা!’ নিজের কামরার দিকে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল। ‘কিন্তু আণ্টি বলেছে—’

‘চাচীকে বোলো না,’ বললাম। ‘এটা গোপন রাখতে হবে। পারবে না?’

বুকের ওপর আড়াআড়ি দু’আঙুল রাখল ডন

‘পারব না আবার!’ দুটো করে ধাপ ভেঙে উঠতে লাগল সিঁড়ি ভেঙে।

ও ভুলে বলে ফেলতে পারে এমন আশঙ্কা আছে। তারপরও কী আর করা, কোন গতি যখন নেই আমার।

আমার মিশন পরিষ্কার। বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই যথাশীঘ্রি পৌঁছতে হবে কনভেনশন সেন্টারে। বইটা দেখাতে হবে ড্যারেলকে। দেখি সে কী বলে। এবং চাচা-চাচী বাসায় ফেরার আগেই ফিরে আসতে হবে ডনকে নিয়ে।

সাঙ্ঘাতিক আঁটসাঁট, ব্যস্ত কর্মসূচী। তবে কাজটা সারা সম্ভব।

জ্যাকেট পরলাম। এবার বইটা বগলদাবা করলাম।

না ‘ডন,’ ওপরতলার উদ্দেশে চেঁচালাম। ‘তুমি কোথায়? এত দেরি কীসের?’

‘আমার এক পাটী জুতো পাচ্ছি না,’ চেঁচিয়ে বলল ও।

গুঙিয়ে উঠলাম। ওকে এখানে রেখে গেলেই ভাল হত, ভাবলাম।

কিন্তু তা তো সম্ভব নয়, চাচী আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে। ডনকে একা রেখে গেলে যদি কোন অঘটন ঘটে, তখন?

ওর কামরায় দৌড়ে গেলাম। বালিশে দুমাদুম কিল মারছে ও। জুতো খুঁজে না পেয়ে জেদ চেপে গেছে।

ওর স্পিকারের অপর পাটীটা বিছানার তলায় খুঁজে পেতে মাত্র দু’সেকেণ্ড লাগল আমার। এবার ওকে ওর জ্যাকেট ছুঁড়ে দিয়ে, নিচে নামিয়ে, সদর দরজা দিয়ে ঠেলে বের করলাম।

জোর হাওয়া দিচ্ছে, ঠাণ্ডা বিকেল। বৃষ্টি থামলেও আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা।

‘দৌড়াও,’ বললাম। ‘অনেক দেরি হয়ে গেছে।’

পরের কোনার বাস স্টপে ছুটে গেলাম আমরা। কোন বাসের ছায়াও দেখলাম না। বইটা বগলদাবা করে পায়চারী করতে লাগলাম।

ডন প্রাচীন এক গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।

সময় বয়ে চলেছে। অবশেষে কোনা ঘুরে এদিকেই আসতে দেখলাম বাসটাকে। ক’মূহূর্ত পরে, বাসে উঠে পেছনদিকে বসলাম আমরা।

ধুলোটে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম দু’জনে। মেঘপুঞ্জের আড়ালে ডুবতে বসেছে সূর্য। সময়মত পৌঁছতে পারব না, মনে মনে বললাম। বাস যদি না রকেটের গতিতে ছোটে।

কিন্তু বাসটার গতি বড়ই ধীর। প্রতিটা স্টপে থামছে লোক তুলতে। শহরের দিকে কাছিয়ে যেতেই, সামনে দুর্ঘটনা ঘটেছে দেখতে পেলাম।

লাল বাতি ঝলসাতে দেখছি। নট নড়ন চড়ন নট কিচ্ছু অবস্থা আমাদের।

ডন হাত রাখল আমার কাঁধে।

‘কিশোরভাই, বইটা আমার কাছে দাও,’ বলল।

‘কেন?’

‘ওটা হাতে নিতে ইচ্ছে করছে,’ জানাল ও।

‘নাও,’ ওর কোলের ওপর রাখলাম বইটা।

গ্রাফিক নভেলটা খুলল না ও। স্রেফ ধরে রইল।

শেষমেশ বাস আবারও নড়ে উঠল। পুলিসের ঝলসানো আলোর পাশ দিয়ে গুড়ি মেরে এগিয়ে চললাম আমরা। তবে দুর্ঘটনাটা কীসের দেখতে পেলাম না।

মিনিট দশেক পরে, শহরের মাঝখানে ‘পৌঁছলাম আমরা। ডনকে নিয়ে নামলাম বাস থেকে। সত্যিই অনেক দেরি করে ফেলেছি। মেঘরাশির ফাঁকে ম্লান, সাদা চাঁদ উঠেছে।

সাইডওয়কগুলোতে মানুষের ভিড়। এদিকেই আসছে। এর মানে জানি আমি। কনভেনশন সেন্টার থেকে বেরিয়েছে তারা। কারণ কমিক কনভেনশন শেষ হয়ে গেছে।

বন্ধ।

দীর্ঘশ্বাস পড়ল আমার।

‘কিশোরভাই, দেখো, দেখো!’ চেঁচিয়ে উঠল ডন।

ওয়্যারউলফ উয়োম্যানের কস্টিউম পরেছে দুটি মেয়ে, তাদের উদ্দেশে তর্জনী দেখাল।

‘দারুণ না?’

আমি এতটাই হতাশ, কথা বলার মনমানসিকতা নেই।

দ্য মিউট্যান্ট ক্রোকোডাইল রেঞ্জার্স-এর ঢাউস এক পোস্টার আগ্রহ নিয়ে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল ডন।

‘দুর্দান্ত!’ প্রশংসা ঝরাল।

আমাদের মধ্যে একজন অন্তত খুশি হয়েছে এখানে এসে।

লোকজন আমাদের পাশ দিয়ে হনহনিয়ে চলে যাচ্ছে, কমিক্‌স্ আর পোস্টার নিয়ে।

প্রতিটা মুখ পরখ করছি। হয়তো এদের মধ্যে ড্যারেলকে দেখতে পাব। তাকে হয়তো বেরনোর সময় ধরতে পারব।

কটা ছেলে-মেয়ে আমাদের পাশ কাটাল, গলা ফাটিয়ে ড. উইয়ার্ড-ফেস অ্যান্থেম গাইছে তারা। একজনের হাতে এক ড. উইয়ার্ড-ফেস বল্‌ হেড পুতুল দেখা গেল। ওটাকে ওপরে-নিচে ঝাঁকাচ্ছে ও।

আমরা কনভেনশন সেন্টারের প্রবেশদ্বারের কাছে পৌঁছে গেছি প্রায়। ড্যারেলের দেখা নেই। কাঁচের সদর দরজাগুলো লাগাচ্ছে গার্ডরা।

দালানটার পাশ বরাবর হাঁটছি আমি। আকাশ এখন মেঘে- মেঘে আরও কালো হয়ে উঠেছে।

না তো। আকাশ তো নয়। ওটা একটা ছায়া। গভীর এক ছায়া আমার ওপর দিয়ে এমনভাবে গড়িয়ে গেল যেন মাথার ওপর দিয়ে মেঘখণ্ড ভেসে গেল।

এবং পরমুহূর্তে, উযের কস্টিউমধারী সেই লোকটি আমার পথ আগলে দাঁড়াল।

আঁতকে উঠলাম রীতিমত। পিছিয়ে গিয়ে কংক্রিটের ঠাণ্ডা দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালাম।

লোকটা চেপে এল আমার উদ্দেশে। এবং আবারও তার গা থেকে আলকাতরার কটু গন্ধ পেলাম। গালজোড়া যেন তার বুদ্বুদের মত ফুলে-ফুলে উঠছে। মুখটা যখন খুলল, এপাশ-ওপাশ ছিটকে গেল নীল জিভখানা।

অতিকায়, ভেজা এক হাত বাড়াল ও।

‘বইটা, ছেলে,’ গর্জাল। বুকের গভীর থেকে উঠে এল কণ্ঠস্বর ওর। ‘দিয়ে দাও। এখুনি।’

জোরে ঢোক গিললাম। জান উড়ে গেছে।

দেয়ালে কোণঠাসা করে ফেলেছে ও আমাকে। নড়তে পারছি না।

আচমকা ঝুঁকে পড়ে আমার মাথার সামান্য ওপরে একটা হাত ভাসিয়ে রাখল লোকটা। মুঠো চাপছে-মাথায় টপ করে পড়ল কী যেন আমার।

‘ওফ!’ চিৎকার ছাড়লাম ছ্যাকা খেয়ে!

আবারও হাত মুঠো পাকাল লোকটা। আমার চুলে আরেক ফোঁটা তপ্ত তেল পড়ল। পুড়ে গেল মাথার খুলি। টের পাচ্ছি কানের দিকে চুইয়ে পড়ছে ওটা।

আর্তনাদ ছাড়লাম আবারও।

‘থামুন!’ তীক্ষ্ণ, চড়া স্বর ফুটল গলায়। মগজ ঘুরপাক খাচ্ছে।

লোকটা কীভাবে করছে এটা? ও কি নিছক কস্টিউম পরা সাধারণ কেউ?

নাকি ও আসল উয? সত্যিকারের ভিলেন?

আমার মুখের সামনে তেলমাখা মুঠোটা নাচাল আবারও সে।

‘বইটা দিয়ে দাও, ছেলে। এটা খেলা না।’

‘আচ্ছা, আচ্ছা,’ বললাম। গলা ভেঙে গেল। ‘দেব, কিন্তু ড্যারেল কথা দিয়েছিল আমাকে ওটার জন্যে তিনশো ডলার দেবে।’

মাথা নাড়ল ও।

‘ড্যারেল মত পাল্টেছে,’ ঘাউ করে উঠল। ‘কী, বুঝলে কিছু?’

‘কিন্তু-কিন্তু-’ মুখে কথা জোগাচ্ছে না আমার। ‘তাহলে কি আপনি দেবেন টাকাটা?’

‘না, তুমি ওটা এমনিতেই দিচ্ছ আমাকে। তোমার মগজে আরেকটু তেল দিলেই বোধহয় কথাটা বুঝতে সহজ হবে!’

আমার মাথার ওপরে মুঠো তুলল ও। সজোরে চাপল ওটা।

খুলিতে গরম ছ্যাকা খেয়ে আবারও আর্তচিৎকার ছাড়লাম।

‘না, প্লিজ—’ দু’হাতে মাথা ঢাকার চেষ্টা করলাম। ‘আপনি জিতেছেন। বইটা আপনাকে দিয়ে দেব।’

মুঠো নামাল ও। ঝুঁকল আমার উদ্দেশে, ওর কালো চোখজোড়া জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে আমার দু’চোখে। মুখের বাইরে সাপের মতন দুলছে ওর নীলচে জিভটা।

‘আমার ছোট ভাইয়ের কাছে আছে ওটা,’ বললাম। ‘ডন, বইটা দিয়ে দাও।’

পাঁই করে ঘুরে দাঁড়ালাম।

‘ডন? অ্যাই-ডন?’

হায়, হায়!

কোথায় ও?

সতেরো

‘ডন! অ্যাই-ডন!’

প্রাণপণে চেঁচাচ্ছি।

‘ডন! কোথায় তুমি? এখানে এসো! ডন?’

বিশালদেহী উযের পাশ দিয়ে ঝুঁকলাম। ওর পেছনে ডনের ছায়াও নেই।

চরকির মতন ঘুরে তারস্বরে চেঁচাতে লাগলাম ডনের নাম ধরে। গলা বসে গেল রীতিমত

‘ধোঁকা দেয়ার চেষ্টাটা ভালই ছিল, ছেলে,’ কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠল উয। ‘স্বীকার করলেই পারো তোমার কোন ছোট ভাই নেই।’

‘কিন্তু-আছে তো!’ কোনমতে আওড়ালাম।

হিমদৃষ্টি নামিয়ে আমার দিকে চাইল ও।

‘বইটা কই?’ গমগমে কণ্ঠে বলল। ‘বাসায়? বাড়িতে রেখে এসেছ? গিয়ে নিয়ে আসতে চাও?’

‘না-না,’ তোতলাচ্ছি। ‘আমার ছোট ভাইয়ের কাছে আছে ওটা। ও এসেছে আমার সাথে। সত্যি বলছি।’

মুখের দু’পাশে হাত দিয়ে চোঙা বানিয়ে, ডনের নাম ধরে অবিরাম চিৎকার করলাম আরও কিছুক্ষণ।

ওর চিহ্নমাত্র নেই।

কনভেনশন সেন্টার এখন ফাঁকা। ভবনটার সামনে অল্প ক’জন মানুষ শুধু ছোট-ছোট দলে ভাগ হয়ে দাঁড়িয়ে।

উয ঝুঁকে এল আমার ওপরে।

‘ছোট-ভাই কৌশলে কাজ হবে না,’ গর্জন ছাড়ল। ‘কী, বুঝলে কিছু?’

‘হ-হ্যাঁ, বুঝেছি,’ কোনমতে বললাম। ‘কিন্তু ডন-’

আমার বুকে ঠেলা দিয়ে দেয়ালে চেপে ধরল ভিলেনটা T

‘বইটা আমার সত্যিই চাই,’ খেঁকাল। আমার জ্যাকেটের সামনের দিকে কালো, আঠাল কিছু একটা মুছল। ‘তোমাকে দেখে তো বুদ্ধিমান ছেলে বলেই মনে হয়।’

‘ধন্যবাদ,’ আওড়ালাম।

‘খারাপ লাগছে তোমাকে আমার উযায়ন করতে হবে!’ গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল।

‘উযায়ন করবেন আমাকে?’ সভয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম।

চাচা আমি এর মানে জানি। ওর কমিক বইয়ের প্রায় পাতায়- পাতায় মানুষকে উযায়ন করে ও। দারুণ লাগে আমার। আমার ধারণা ছিল ব্যাপারটা নিছকই মজার।

ভাবতেও পারিনি আমার জীবনে কখনও ঘটতে পারে এমনটা।

‘আপনি সত্যিকারের উয-তাই না?’ চিৎকার করে বললাম। ‘আপনি আসল উয। জলজ্যান্ত!’

‘এত প্রশ্ন কোরো না, কিশোর,’ বলল ও। ‘জবাবটা শুনতে তোমার ভাল লাগবে না।’

‘কিন্তু আমি শুনতে চাই,’ দৃঢ়কণ্ঠে বললাম। ‘আমি—’

‘সময় নিচ্ছ তুমি,’ বলল ও। ‘ভয় পেয়েছ। কাঁপছ থরথর করে। তুমি জান তোমাকে এখুনি উযায়ন করা হবে।

বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ড এতটাই ধড়াস ধড়াস করছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে দস্তুরমত। ডনকে শেষবারের জন্য মরিয়ার মত খুঁজলাম।

ওর ছায়াও দেখলাম না।

উযায়নের মানে কী জানা আছে আমার। এর অর্থ ও প্রথমে আমার সারা শরীরে তপ্ত তেল মাখাবে। তারপর লাফিয়ে পড়বে আমার ওপরে। ওর শরীরের নিচে পিষবে আমাকে-গরম তেলের

বিশাল এক ঢেউয়ের তলায় কবর দেবে।

কাঁপছি রীতিমত, চোখ তুলে চাইলাম ওর দিকে।

‘দোহাই লাগে—’

হঠাৎই ওর গোটা দেহ বুদ্বুদ ছড়াতে শুরু করল। কাঁপছে ও। আবছা, কম্পমান এক ছায়ার মত দেখাচ্ছে এখন ওকে।

ক্রমেই উঁচু হচ্ছে ও…আরও উঁচু…এবং এবার নিজেকে কাছিয়ে আনল।

মুখে গরম ভাপ টের পাচ্ছি। চামড়া পুড়তে আরম্ভ করেছে। ওর ছায়া বয়ে গেল আমার ওপর দিয়ে। নিমেষে পুরো জগৎটা রাতের চেয়েও আঁধার হয়ে উঠল।

আমার মাথার ওপরে দু’মুঠো তুলেছে উয, ফুটন্ত তেল আমার শরীরে চুইয়ে ফেলতে তৈরি।

‘বলো, ছেলে,’ গমগম করে উঠল ও। ‘শেষ কোন কথা আছে?’

আঠারো

চোখ বুজে ফেললাম। সমস্ত মাংসপেশী আড়ষ্ট। এমনভাবে দাঁতে দাঁত পিষছি, চোয়াল ব্যথা করতে লাগল।

প্রচণ্ড তাপ অনুভব করছি। আলকাতরার গন্ধে প্রাণ ওষ্ঠাগত ওর তৈলাক্ত ত্বকে বুদ্বুদ ওঠার শব্দ পাচ্ছি।

‘বিদায়, ছেলে।’ বাজের মত কড়কড় করে উঠল উযের কণ্ঠস্বর।

এবার আরেকটা গলা কানে এল। এক ছেলের কণ্ঠ :

‘আপনার একটা অটোগ্রাফ দেবেন?’

শব্দটা দূরাগত শোনাল, দেয়ালের ওপাশ থেকে এসেছে যেন।

‘প্লিজ?’ কণ্ঠস্বরটি বলল। ‘আমাকে এটায় একটা অটোগ্রাফ দিন না!’

এবার আরেকটি কণ্ঠ। এক মেয়ে বলছে: ‘আমরা আপনার সাথে ছবি তুলি?’

চোখ মেললাম। এখনও আঁধার দেখছি। উযের বুদ্বুদ ওঠা চামড়া থেকে বেরনো তাপে আমার মুখ পুড়ে যাওয়ার জোগাড়।

‘আমি আপনার খুব বড় একজন ভক্ত,’ বলল ছেলেটি।

‘আমাকেও আপনার অটোগ্রাফ দিন না,’ আরেকটি ছেলে মিষ্টি করে বলল।

উল্টো ঘুরল উয।

টের পেলাম বাতাস সহসাই শীতল হয়ে উঠল। বারকয়েক চোখ পিটপিট করলাম, দৃষ্টির স্বচ্ছতা ফিরে পাওয়ার জন্য।

উয বোঁ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ভক্তদের মুখোমুখি হতে। পাঁচ- ছটা ছেলে-মেয়ে জটলা পাকিয়েছে, অটোগ্রাফ বই ঝাঁকাচ্ছে ওর উদ্দেশে। এক মেয়ে উযের ছবি তোলার জন্য মোবাইল উঁচু করল।

ছেলে-মেয়েগুলো ওকে ঘিরে ধরা না অবধি অপেক্ষা করলাম আমি। এবার গভীর দম নিলাম-এবং দেয়ালের কাছ থেকে সরে এলাম।

পাজোড়া কাঁপছে, দুর্বল লাগছে। মাথা ঘুরছে বনবন করে। ভয় হলো ফুটপাতে মুখ থুবড়ে পড়ে না যাই।

কোনমতে, ভারসাম্য ধরে রাখলাম নিজের। এবার মাথা নুইয়ে ঝেড়ে দৌড় দিলাম।

‘অ্যাই!’ এসময় উযের গর্জন কানে এল।

কিন্তু থামাথামির ধার ধারলাম না। প্রতি কদমে পায়ে আরেকটু জোর পাচ্ছি। অসুস্থ করে তোলা কটু গন্ধটা দূর হতেই পরিষ্কার হতে লাগল মাথা।

কোনা ঘুরে ছুটে চলেছি। পেভমেন্টে ধুপ-ধাপ শব্দ তুলছে আমার স্নিকার্স। ছোটার সময় হাতজোড়া প্রবলবেগে দুলছে।

একদল টিন এজারকে দেখলাম আমার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রয়েছে।

‘অ্যাই! ওর চুল দেখেছিস?’ একজন গর্জাল।

ঘন কালো তেলে চুল মাখামাখি, আমাকে ওভাবে দৌড়তে দেখে যে কেউই পাগল ভাববে। কিন্তু গতি কমালাম না আমি একটুও। –

এক ছেলে আমার কোমর চেপে ধরে ট্যাক্‌ না করা অবধি থামলাম না।

সাইডওয়কে ছিটকে পড়লাম দু’জনেই। কনুইয়ে তীব্র ব্যথা পেয়ে আর্তচিৎকার ছাড়লাম, সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল যন্ত্রণা।

গড়িয়ে গেলাম। হাঁচড়ে পাঁচড়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসলাম। এবং একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম ছেলেটার দিকে। কুৎসিত এক বেগুনী মুখোশ পরে রয়েছে ও, ফলে চিনলাম না।

‘কে তুমি?’ চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘কী চাও?’

উনিশ

মুখোশের চোখের ফুটো দিয়ে ছেলেটা চেয়ে রয়েছে আমার দিকে।

‘কিশোরভাই, আমি!’ চিৎকার করে বলল।

‘ডন?’

মাথা ঝাঁকাল ও। এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে টেনে তুলল।

‘কোথায় ছিলে তুমি?’ জবাব চাইলাম।

‘এই মুখোশটা কিনতে গেছিলাম,’ জানাল ও। ‘আমি সুপারভিলেন হতে চাই।’

‘তোমার জন্যে আরেকটু হলেই আমি মহাবিপদে পড়তে যাচ্ছিলাম,’ বললাম। ‘আমাকে উযায়ন করা হচ্ছিল!’

হেসে উঠল ডন। ও কেন এত মজা পাচ্ছে জানি না। আমার তো জান যাচ্ছিল প্রায়!

‘এত হাসির কিছু নেই!’ চেঁচিয়ে উঠলাম। ওকে ঠেলে সরাতে যাব, নিজেই নাচতে-নাচতে সরে গেল।

সাইডওয়কে উযের বইটা পড়ে রয়েছে দেখলাম। আমাকে পাকড়াবার সময় নিশ্চয়ই ডন হাত থেকে ফেলে দিয়েছে ওটা।

রীতিমত ছোঁ মেরে তুলে নিলাম বইটা। চারধারে নজর বোলালাম। উযের ছায়ামাত্র চোখে পড়ল না। ও কি এখনও অটোগ্রাফ সই করছে?

‘আ-আমাদেরকে এখান থেকে এখুনি চলে যেতে হবে,’ তুতলে বললাম।

বইটাকে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে বাস স্টপ অভিমুখে দৌড় দিলাম। কাঁধের ওপর দিয়ে চাইলাম। ডন এখনও দাঁড়িয়ে ওখানে, রবারের মুখোশটা নাড়াচাড়া করছে।

‘জলদি!’ চেঁচালাম, হাতছানি দিলাম থেমে দাঁড়িয়ে। ‘ব্যাপারটা সিরিয়াস।’

‘গররর।’ গর্জন ছেড়ে বাঘের মত আমার উদ্দেশে বাতাসে থাবা চালাল ডন।

‘চলে এসো-দৌড়াও!’ বললাম ওকে।

এক চুল নড়ল না ও।

‘আরেকটু পরে বাসায় গেলে কী হয়, কিশোরভাই? এত তাড়াহুড়ো কীসের?’

ওকে বোঝানোর সময় নেই। দৌড়ে ফিরে গিয়ে ওর হাত চেপে ধরলাম। এবার হ্যাঁচকা টান দিলাম।

‘চলো।’

প্রায় আধ ব্লক ছুটলাম আমরা। তারপর জমে গেলাম এক লোককে আমাদের দিকে দৌড়ে আসতে দেখে।

লোকটার গায়ে আগুন লেগেছে!

তার শরীর থেকে কমলারঙা আগুনের ফুলকি ছিটকে-ছিটকে পড়ছে। কালো প্যান্ট আর কালো টার্টলনেক সোয়েটার মানুষটির পরনে। লোকটার কাপড়চোপড়, মাথা, পা তুমুলভাবে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছিটাচ্ছে।

কিন্তু ভয়ের কোন লক্ষণ নেই তার মধ্যে। দুলকিচালে অবিরাম ছুটে আসছে আমাদের উদ্দেশে।

লোকটার কাপড় পুড়ছে না উপলব্ধি করে সবিস্ময়ে শ্বাস চাপলাম। তার গোটা দেহ আগুনের ফুলকি ছড়াচ্ছে-কিন্তু এক বিন্দু পুড়ছে না সে!

টলে উঠে পিছিয়ে গেলাম। ওর পথ থেকে সরে যেতে চাইলাম।

‘আপনি ঠিক আছেন তো?’ চিৎকার ছাড়লাম। ‘কোন সাহায্য লাগবে?’

লোকটার শরীর থেকে অগ্নিশিখা ছিটকে সাইডওয়কে পড়ে নিভে যাচ্ছে। নিয়মিত ছন্দে ছুটে আসছে আমাদের দিকে, টু শব্দটিও করল না সে।

ডন আর আমি দু’জনেই রাস্তায় লাফিয়ে পড়লাম, লোকটাকে এড়াতে।

কিন্তু আমরা এতটাই আতঙ্কিত আর বিস্মিত বোধ করছি, দ্রুত সরতে পারিনি। অগ্নিস্ফুলিঙ্গ উড়িয়ে ধেয়ে এল ও আমাদের উদ্দেশে।

‘কী চান আপনি?’ আর্তনাদ করে উঠলাম আমি।

থাবা মারল লোকটা।

‘ওহ!’ আগুনের তাপ টের পেলাম।

জ্বলন্ত হাতে বইটা চেপে ধরল লোকটা। এবার আমার হাত থেকে কেড়ে নিল ওটা এক টানে। চরকির মত ঘুরল-শরীরময় নাচুনে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ফট-ফট শব্দ তুলে দৌড়ে ফিরে চলল যে পথে এসেছিল।