গোপন সৈকতে – ৫

পাঁচ

পরদিন দুপুরে, এমা ছেলে-মেয়েদেরকে ওর প্রিয় সৈকতে মজাদার পিকনিক লাঞ্চের দাওয়াত দিল। সারা সকাল ডলফিনদের ব্যাপারে নানান কিছু শিখেছে ওরা।

‘রাঁধুনীকে বলেছি আমাদের জন্যে স্পেশাল লাঞ্চের ব্যবস্থা করতে,’ বলল এমা, ঢাউস এক কুলার দেখাল। ‘স্যাণ্ডউইচ, ফল আর ফ্রেশ লেমোনেড।’ মুসার দিকে চাইল। ‘সে সঙ্গে ঘরে বানানো ডজনখানেক ব্রাউনি,’ বলল, জানে ওর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠবে।

‘চলুন!’ বলল ডন, ডক ধরে দৌড় লাগাল।

‘ডলফিনদের সম্পর্কে সকালে কী-কী জানলে?’ আধ ঘণ্টা পরে জিজ্ঞেস করল এমা। বিচ টাওয়েল পেতে আরামসে বসে লাঞ্চ উপভোগ করছে সবাই।

‘আমাদের টিচার বলেছেন ওরা খুব বুদ্ধিমান,’ বলল ডন। ‘ওরা একে অন্যের সাথে বিশেষ শব্দ করে কথা বলে, আর খেলা করতে ভালবাসে।’ একটু থামল, স্যাণ্ডউইচ চিবোচ্ছে। ‘আর ওরা খেতেও খুব ভালবাসে। দিনে প্রায় বিশ পাউণ্ড মাছ খায়!’

হেসে উঠল কিশোর।

‘মুসার দোস্ত ওরা।’

‘ডলফিনদের সবসময়ই সুখী দেখায়,’ বলল সু কি। ‘দেখে মনে হয় হাসছে।’

‘তার কারণ ওদের মুখের কোনা দুটো ওপরদিকে উঠে যায়,’ বলল কিশোর। ‘ইন্সট্রাক্টর বলেছেন ওরাও মাঝেমধ্যে মানুষের মতই একঘেয়েমিতে ভোগে। তাই ওদেরকে ছোটখাট কোন পুলে কসরৎ দেখানোর জন্যে আটকে রাখা ঠিক নয়। ওরাও অন্যান্য ডলফিনের সাথে মহাসাগরে থাকতে চায়।’

লাঞ্চের পর এমা আর কিশোর পানির প্রান্তে হেঁটে গেল। এমা এক সিশেলে পায়ের পাতা ঘষে নিচের দিকে অবাক চোখে চাইল।

‘আরি, মনে হচ্ছে কেউ এখানে এসেছিল।’ তীর বরাবর বালির বুকে এক সার পদচিহ্ন।

সু কি সৈকত ধরে ছুটে এসে যোগ দিল ওদের সঙ্গে। ‘আমি পানিতে নেমে প্রবাল দেখি?’ জিজ্ঞেস করল।

‘দেখো,’ খোশমেজাজের সঙ্গে বলল এমা। ওকে যদিও উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে, এবং কিশোর উপলব্ধি করল নিজের দ্বীপে অন্য মানুষের পা পড়ায় মনে-মনে অসন্তুষ্ট ও।

কিশোর আর এমা সাগরতীর ধরে হাঁটছে, এসময় সু কির চিল চিৎকারে চমকে উল্টো ঘুরল দু’জনে।

‘কী হলো?’ চোখের ওপর হাতের ছাউনি বানিয়েছে কিশোর।

‘নেই!’ বলল সু কি, উঁকি দিচ্ছে পানিতে। ‘প্রবাল নেই!’

‘হায়, খোদা,’ বলে উঠে, অগভীর পানিতে হাঁটু গেড়ে বসল এমা। ‘মনে হচ্ছে হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে নিয়ে গেছে!

ডন, রবিন আর মুসা দৌড়ে এল। কোরাল বেডটা আসলেই ধ্বংস হয়ে গেছে। চমৎকার শাখাগুলো কেটে নেয়া হয়েছে, সাগরতলে রয়ে গেছে শুধু এবড়োখেবড়ো ভিত্তিমূলটা।

অশ্রুসজল চোখে ওদের দিকে চাইল এমা।

‘এখুনি ক্যাম্পে গিয়ে রিপোর্ট করতে হবে।’

‘চলুন,’ বলল রবিন। পিকনিকের জিনিসপত্র গোছগাছের কাজে হাত লাগাল ওরা। দ্রুত পাওয়ারবোটে ফিরে এল সবাই এবং এমা ইঞ্জিন চালু করল। পানি কেটে তরতর করে এগিয়ে চলেছে, ডন ছাড়া সবাই নীরব।

‘বুঝলাম না এত সুন্দর জিনিস কেউ নষ্ট করবে কেন?’ বলল ও।

‘টাকার জন্যে,’ শান্তকণ্ঠে বলল এমা, মৃদু ঢেউ ভাঙছে, তার মাঝ দিয়ে দক্ষ হাতে চালিয়ে নিচ্ছে বোটটা। ‘প্রবালের অনেক দাম, এবং আজকাল তেমন একটা পাওয়াও যায় না।’

‘কিন্তু বিশেষ এই কোরাল বেডটার কথা কেউ জানবে কীভাবে?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর। ‘আপনি তো একাই এই দ্বীপে আসেন অনেক বছর ধরে, আর এটাকে সবসময়ই নির্জন দেখেছেন।’

‘এতদিন তো তা-ই ভাবতাম,’ স্বীকার করল এমা। ‘কোস্ট গার্ডকে জানাতে হবে।’

‘কোস্ট গার্ড?’ ডনের চোখ ছানাবড়া।

‘প্রবাল চুরি গুরুতর অপরাধ,’ এমা বলল ওকে। ‘ক্যাম্পে ফিরেই কর্তৃপক্ষকে ফোন করব। আশা করছি তারা এখুনি তদন্ত শুরু করবে।’

এক ঘণ্টা পরে, ছেলে-মেয়েদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন মি. সোবার্স, স্থানীয় কোস্ট গার্ড স্টেশনের এক হাসিখুশি কর্মকর্তা।

‘আমাকে কোরাল বেডটার কথা বলো তো,’ বললেন তিনি। ‘এমার জবানবন্দি নিয়েছি, তবে তোমাদের চোখে হয়তো বাড়তি কিছু ধরা পড়েছে।’

‘ওটা অনেক বড় বেড আর অপূর্ব সুন্দর,’ আরম্ভ করল রবিন। ‘ওখানে রোজ কোরাল আর ফিঙ্গার কোরাল আছে, এমা আমাদেরকে দেখিয়েছেন……’

‘এক মিনিট!’ বলে উঠল মুসা। ‘আপনাকে আমরা ছবি দেখাতে পারব!’ এমার দিকে ফিরল ও। ‘আপনিই তো আমাকে আণ্ডারওয়াটার ক্যামেরা চালানো শিখিয়েছিলেন।’

‘হ্যাঁ,’ বলল এমা, মনে হলো স্বস্তি বোধ করছে। ‘এখন আমরা বেডের একটা নিখুঁত রেকর্ড পাব।’

‘আপনার ক্যামেরাটা কোথায়?’ শুধালেন মি. সোবার্স।

‘আমার কেবিনে,’ বলল এমা। ‘আনতে হবে।’

‘আপনারা কি কেউ ছবির কথা বললেন?’ প্রশ্ন করল ক্যাথি অ্যালেন। এতটাই নিঃশব্দে লজে ঢুকেছে কেউ খেয়ালই করেনি। ‘আমি হয়তো সাহায্য করতে পারব। আমি যেহেতু আণ্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফার।’

‘দরকার নেই,’ বলল এমা। মি. সোবার্সের দিকে চেয়ে বুঝতে চাইল তিনি ক্যাথির কাছ থেকে কোন তথ্য পেতে আগ্রহী কিনা। কিন্তু সামান্য মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক। আপাতদৃষ্টিতে তিনি এই কেস নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনায় রাজি নন।

ক্যাথি অ্যালেন দু’মুহূর্তের অস্বস্তিকর অপেক্ষার পর হড়বড় করে বলল, ‘আমি বরং যাই। আমার অনেক কাজ পড়ে আছে।’

সে উল্টো ঘুরতেই তার পায়ের ডিমে লাল-লাল আঁচড়ের দাগ দেখল ডন।

‘আপনার পায়ে কী হয়েছে?’ শুধাল।

ফটোগ্রাফার থতমত খেয়ে দৃষ্টি নামাল।

‘ও কিছু নয়, বলে, লালচে দাগগুলো স্পর্শ করল। ‘আমি জয়েসের সাথে খেলছিলাম, ও বোধহয় খেলার ফাঁকে খামচে দিয়েছে।’ কামরা থেকে তড়িঘড়ি বেরিয়ে যাওয়ার আগে ক্ষীণ হাসল।

‘জয়েস?’ মুসার কণ্ঠে বিস্ময়। কমলারঙা বিশাল বিড়ালটার সঙ্গে ক্যাম্পে পৌঁছেই দেখা হয়েছে ওর। ‘ও তো খুবই শান্ত-শিষ্ট বিড়াল। কাউকে আঁচড়ানোর প্রশ্নই ওঠে না।’

‘এমনকী জিমিও খুব ভাল। ও-ও আঁচড়াবে না,’ বলল ডন। মি. সোবার্সের জন্যে ক্যামেরা আনার সময় জো ইলিয়টের

মুখোমুখি পড়ে গেল মুসা।

‘ছবি তুলবে?’ প্রশ্ন করল লোকটা।

মাথা ওপর-নিচ করল মুসা।

‘ডেভেলপের জন্যে একটা রোল রেডি আমার।’

‘কীসের ছবি তুলেছ?’ চুপচাপ লোকটা হঠাৎই বেশি কথা বলছে, মুসা ভেবে পেল না তার এত কৌতূহল কীসের। কেমন অস্বাভাবিক ঠেকছে।

‘কিছু ট্রপিকাল মাছ, কিছু সুন্দর সি গ্রাস…’ মুসার কেন জানি মনে হলো চোরাই প্রবাল কিংবা চলমান তদন্তের কথা লোকটাকে না জানানোই ভাল।

‘ওহ, ব্যস, এই? … আচ্ছা, চলি, পরে দেখা হবে!’ কথাগুলো বলেই সোজা হাঁটা ধরল লোকটা।

কী বোঝাতে চাইল জো ইলিয়ট? ভাবছে মুসা। ও কী বলবে আশা করেছিল লোকটা?

মি. সোবার্সের হাতে ফিল্মটা তুলে দেয়ার পর, মুসা আর এমা ধীরেসুস্থে সৈকতে ফিরল উইণ্ড-সার্ফিং চর্চার জন্য। অন্যরা সিদ্ধান্ত নিল বিকেলটা জাহাজের ভগ্নস্তূপ বিষয়ে শিখবে।

‘আপনার খুব খারাপ লাগছে, তাই না, কোরাল বেডটার জন্যে?’ প্রশ্ন করল মুসা।

‘হ্যাঁ,’ স্বীকার করল এমা। ‘ওটা আমার কাছে বিশেষ কিছু।’

উইণ্ড-সার্ফার ঠিকঠাক করতে ঝুঁকল সে। ‘আরও প্রবাল চুরির আগেই যেন চোরটা ধরা পড়ে। প্রবাল জন্মাতে হাজার-হাজার বছর লেগে যায় এবং জিনিসটার কখনওই বিকল্প হয় না।

ছোট্ট বোর্ডটায় মুসার পাজোড়া ঠিকভাবে রাখতে সহযোগিতা করল ও, এবং দেখিয়ে দিল কীভাবে পালগুলো নাড়তে হয়।

‘কী শিখিয়েছিলাম মনে আছে তো?’

‘আশা করি।’ মুসা ভারসাম্য ধরে রেখে পালগুলো এমনভাবে টানল, ও যেন মহাসাগরে রয়েছে। কিন্তু ওর মনটা পড়ে আছে অন্যখানে। জো ইলিয়ট লোকটা এই বন্ধুভাবাপন্ন তো এই আবার আড়ষ্ট। কেন? ক্যাথি অ্যালেনের পায়ে অতগুলো আঁচড়ের দাগ এবং সে সরাসরি বিড়ালটার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিল। কিন্তু বিড়ালটার আচরণ বন্ধুসুলভ এবং কখনওই কাউকে আঁচড়ায়নি। ওদিকে নিল স্যাণ্ডার্স মেরিন বায়োলজির অ-আ-ক-খ কিছুই জানেন না। খাইছে, ক্যাম্প কোরালে রহস্যজনক সব চরিত্র এসে জুটেছে!

‘মুসা, পালগুলো আরও শক্ত করে ধরো। ঢিলে হয়ে যাচ্ছে তো!’ বলল এমা।

‘সরি,’ বিড়বিড় করে বলে, আঁকড়ে ধরল মুসা।

‘এই তো,’ এবার সন্তুষ্ট হলো এমা। ‘শীঘ্রিই ঢেউয়ের ওপর সার্ফিং করতে পারবে তুমি।’

‘ধন্যবাদ।’ কাউন্সেলরের উদ্দেশে মৃদু হাসল মুসা, মাথায় ভাবনা খেলা করছে তখনও। অন্যগুলো তো ছোটখাট, কিন্তু সবচাইতে বড় রহস্যটা হচ্ছে প্রবাল চুরি করছে কে? ডিনারের পর বসতে হবে কিশোর, রবিনকে নিয়ে, সঙ্গে ডন আর সু কিও থাকবে। ওরা সবাই মিলে চোরটাকে পাকড়ে হয়তো রহস্যটার সমাধান করতে পারবে।