রহস্যময় দুর্গ – ১

এক

‘আমরা ভয় পাচ্ছি উনি খুন হয়েছেন।’

বিজলী চমকে আলোকিত হলো খানসামার বিষণ্ন মুখের চেহারা।

‘ভেতরে আসুন, প্লিজ। মিস্টার ব্রাউন স্যর ডয়েলের অন্তর্ধানের বিষয়ে আপনাদেরকে সবই বলবেন।’

কাসা লোমার ভেতরে পা রেখে রোমাঞ্চ অনুভব করল কিশোর। টরন্টোর বুকের মাঝখানে এক দুর্গ এটা। ব্যাকপ্যাক নামিয়ে রেখে টিনা আর টিনার টম মামাকে অনুসরণ করে দুর্গের গ্রেট হল-এ প্রবেশ করল ও।

কিশোরের হায়দার মামার ঘনিষ্ঠ বন্ধু কানাডীয় পুলিস অফিসার জোসেফ টার্নার। তাঁর মেয়ে টিনা। কিশোর আর টিনা দু’জনে মিলে এর আগে জমিদারবাড়ি হত্যা-রহস্যের সমাধান করেছে। এবার অভিভাবকদের অনুমতি নিয়ে টম মামার সঙ্গে টরন্টোর কাসা লোমা দুর্গে বেড়াতে এসেছে ওরা।

ফায়ারপ্লেসে দাউদাউ আগুন জ্বলছে, দেয়ালে লটকানো বর্ম আর বর্শাগুলোর ওপর কমলা আভা ফেলেছে।

‘টরন্টোতে স্বাগতম, মিস্টার রবার্টস।’ টম মামার সঙ্গে করমর্দন করতে এগিয়ে এলেন সুদর্শন, কালোচুলো এক লোক। ‘আমি ফ্রেডি ব্রাউন, স্যর ডয়েলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।’

পরিচয় পর্ব সেরে, টম মামা হাতজোড়া গরম করতে গেলেন সুবিশাল ফায়ারপ্লেসটার কাছে।

‘ঘটনাটা খুবই দুঃখজনক। আমি স্যর ডয়েলকে খুব পছন্দ করতাম।’

অগ্নিশিখার দিকে চিন্তামগ্ন দৃষ্টিতে চাইলেন ফ্রেডি।

‘উনি মারা গেছেন কিনা এখনও জানি না আমরা।’

‘কী হয়েছিল?’

‘বলছি। তার আগে স্যর ডয়েলের প্রাইভেট সেক্রেটারির সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই।’

জানা হুইলচেয়ারে বসা এক যুবতী গ্রেট হল আড়াআড়ি পেরিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে এলেন।

‘আমি রেজিনা মিলার্ড, মিস্টার রবার্টস।’

‘প্লিজ, রেজিনা, টম বলে ডাকলে খুশি হব।’

মৃদু হাসলেন মহিলা।

‘ধন্যবাদ, তবে নতুন বাটলার জন হয়তো এতে আপত্তি তুলবে। কাসা লোমায় কদিন হলো এসেছে ও, এখনও সবার সাথে সহজ হতে পারেনি।’

গ্রেট হলের দূর কোনায় চকিতে চাইল কিশোর, খানসামা ওখানে এক অশুভ-দৃষ্টি ভাঁড়ের মূর্তির নিচে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। রেজিনার কথা কি শুনতে পেয়েছে লোকটা?

জনের উদ্দেশে হাতছানি দিলেন ফ্রেডি।

‘শেরি, প্লিজ, আর কিশোর আর টিনার জন্যে কোক।’

‘জি, স্যর।’

টম মামাকে পেছনে নিয়ে এক দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লেন ফ্রেডি।

এটা লাইব্রেরি। এখানে বসে শেরি খাওয়ার ফাঁকে আপনাকে স্যর ডয়েলের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে যতটুকু জানি বলি।’

একটু পরে, রুপোর এক ট্রে নিয়ে হাজির হলো জন, পানীয় সরবরাহ করল সবাইকে।

রেজিনা সতর্কতার সঙ্গে তাঁর পানীয়ে চুমুক দিয়ে মাথা ঝাঁকালেন।

‘যাক, আজকেরটা শেরিই। জন কাল ভুলে ব্র্যাণ্ডি সার্ভ করেছিল।’

কিশোর খানসামাকে কোকের জন্য ধন্যবাদ জানাল, এবং সুন্দরী মেইড ক্যাথরিনের পরিবেশন করা ছোট্ট এক স্যাণ্ডউইচ তুলে নিল। এবার ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগল স্যর ডয়েলের অন্তর্ধান-রহস্যের খুঁটিনাটি জানতে, টম মামাকে যেজন্য কাসা লোমায় আসতে হয়েছে। খবরটা পেয়েই রওনা দেন তিনি। তাঁর সঙ্গে টরন্টো আসার সুযোগ পেয়ে খুশি আর উত্তেজনার সীমা নেই কিশোর আর টিনার।

কিন্তু কেউ মুখ খোলার আগেই, ষাটের কাছাকাছি বয়সের এক লিকলিকে লোক লাইব্রেরিতে ঢুকে টম মামার উদ্দেশে এগিয়ে এল।

‘আপনার সাথে একান্তে একটু কথা বলতে পারি, মিস্টার রবার্টস?’

‘সবার সামনেই বলুন, কোন সমস্যা নেই,’ বললেন টম মামা।

শুকনো চেহারার লোকটি নার্ভাস ভঙ্গিতে ঢোক গিলল, এবং আড়চোখে চাইল জনের দিকে।

‘আমার নাম গারফিল্ড, আমি স্যর ডয়েলের ব্যক্তিগত ভৃত্য-তাঁর ভ্যালেট। অনেক বছর যাবৎ তাঁর চাকরি করছি। আপনি কাসা লোমার দায়িত্ব নিচ্ছেন একথাটা কি ঠিক?’

টম মামা মাথা ঝাঁকালেন, এবং তাঁর চশমায় আলো প্রতিফলিত হলো।

‘স্যর ডয়েল আমার কাজিন। তাঁকে পাওয়া না গেলে আমিই হব এই দুর্গের মালিক।’

‘তাহলে, স্যর, আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি এখানে মারাত্মক সব ভুল কাজ চলছে! জন সহ নতুন ক’জন কাজের লোক এমনকী এটাও জানে না কী তাদের দায়িত্ব। কিন্তু আপনাকে আমার আস্তাবলের কথা জানানো দরকার। আমি…’

ঠিক সে মুহূর্তে, দপ করে নিভে গেল সব কটা বাতি। কামরায় শোনা গেল ভয়ার্ত চিৎকার, পরক্ষণে জনের দৃঢ় কণ্ঠস্বর সবাইকে আশ্বস্ত করল।

‘ঝড়ে মনে হয় পাওয়ার লাইনের ক্ষতি হয়েছে,’ বলল সে। ‘আমি কটা মোমবাতি নিয়ে আসছি।’

লাইব্রেরি জুড়ে শ্বাসরুদ্ধকর, নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। জন এত দেরি করছে কেন, ক’মিনিট পেরিয়ে যেতেই ভাবল কিশোর।

শেষমেশ জ্যান্ত হয়ে উঠল এক দিয়াশলাইয়ের কাঠি এবং আঁধার চিরে দিল কিছু মোমবাতির হলদেটে আলো, প্রকাশ পেল সমবেত মানুষগুলোর আবছায়া মুখের চেহারা।

‘তো, গারফিল্ড?’ টম মামা বললেন, ভ্যালেটের খোঁজে চারধারে চোখ বোলালেন। ‘কী যেন বলছিলেন আপনি?’

‘উনি এখানে নেই,’ জানাল টিনা।

‘কিন্তু গেল কোথায়?’ প্রশ্ন করল রূপসী মেইড ক্যাথরিন। তার মুখের চেহারায় নিখাদ বিস্ময়।

‘গারফিল্ডকে নিয়ে এখন আমাদের না ভাবলেও চলবে, ‘ বললেন ফ্রেডি। ‘আমি আপনাদেরকে স্যর ডয়েলের কথা বলতে যাচ্ছিলাম। আসুন আমার সাথে, উনি যে ঘর থেকে নিখোঁজ হয়েছেন আপনাদেরকে সেটা দেখাই।’ একটা মোমবাতি তুলে নিয়ে, সবার আগে এক লম্বা, অন্ধকার হলওয়েতে পা রাখলেন তিনি। ‘এটার নাম পিকক অ্যালি। এই যে, এটা স্যর ডয়েলের স্টাডির দরজা। উনি নিরুদ্দেশ হওয়ার পর থেকে এখানকার কোন কিছুতেই হাত দেয়া হয়নি।’

দরজা খুলে স্টাডিতে পা রাখলেন ফ্রেডি। এবার সভয়ে শ্বাস চাপলেন।

‘একী! এ কীভাবে সম্ভব!’

তাঁর কণ্ঠের আতঙ্ক চমকে দিল কিশোরকে। কাছিয়ে গিয়ে স্টাডির ভেতরে চোখ রাখল ও। মুখ থুবড়ে মেঝেতে পড়ে রয়েছে গারফিল্ড, মোমের ম্লান হলদেটে আলোয় বিকৃত দেখাচ্ছে তার মুখের চেহারা।