রহস্যময় দুর্গ – ৪

চার

ফ্রেডি আর কিশোর সাইডওয়ক দিয়ে হাঁটছে, কেনসিংটন মার্কেটে গিজগিজ করছে মানুষ নানান ধরনের জিনিস কিনছে তারা। ফ্রেডি দুটো জ্যামাইকান হট বীফ প্যাটিস কিনেছেন, কিশোর ওটা খাওয়ার ফাঁকে মাংসের বাজারের এক সাইন-এর মর্মোদ্ধার করার চেষ্টা করল-গ্র্যাণ্ডে এস্পেশিয়াল কার্নে ডি পর্কো লেখা ওটায়।

‘বিগ স্পেশাল অন পর্ক চপ্‌স্‌, আমার ধারণা। ওটা কোন্ ভাষা?’ প্রশ্ন করল ও।

‘পর্তুগিজ। সারা দুনিয়ার মানুষের বাস এই টরণ্টোয়। আমি যেমন স্যান ফ্রান্সিসকো থেকে এসেছি।’

এক মিউজিক স্টোরের দরজায় চোখ গেল কিশোরের, গান- বাজনার শব্দে গমগম করছে দোকানটা এবং স্ট্র হ্যাট পরা এক কেরানী ধেই-ধেই করে নাচছে কাউন্টারের পেছনে। হাসিখুশি ছেলেটা হাতছানি দিয়ে কিশোরকে ডাকল নাচে যোগ দিতে, কিন্তু কিশোর লাজুক হেসে, মাথা নেড়ে তড়িঘড়ি পা বাড়াল।

ঘর্মাক্ত কলেবরে এক তরুণ এদিকেই আসছিল, বরফ দেয়া রেড স্ন্যাপার ভর্তি ঠেলাগাড়ি ঠেলে, পাশ কাটানোর সময় মাছগুলো যেন ওদের বিশাল, নিষ্প্রাণ চোখ মেলে একদৃষ্টে চেয়ে রইল কিশোরের উদ্দেশে।

‘মাছগুলোকে দেখে কাসা লোমার ওই কামার লোকটার কথা মনে পড়ে গেল, ওকে দেখলেই কেমন গা শিরশির করে। আস্তাবলে অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে, ফ্রেডি। আজ সন্ধেয় আমি ওখানে তদন্ত করতে যাব।’

‘একথা আগেও বলেছ। এবং আমি আবারও সাবধান করছি: ওসব করতে যেয়ো না।’

এক দোরগোড়ায় গা এলিয়ে শুয়ে থাকা এক দো-আঁশলা কুকুরের মাথায় হাত বুলোতে নুয়ে পড়ল কিশোর।

‘আপনি আমেরিকা থেকে এখানে এসেছেন কেন? বলিনি বোধহয় আমিও লস এঞ্জেলেসে থাকি। কানাডায় মামার কাছে বেড়াতে এসেছি।’

‘ও, তাই নাকি? আমাকে লোকাল এক টিভি স্টেশন স্পোর্টস্কাস্টিং জব অফার করে। বলতে ভাল লাগছে স্টেশনটার রেটিং এখন অনেক হাই। আমরা নাম্বার ওয়ান।’

‘কোন্ স্পোর্টস্?’

‘সব। সব খেলারই রিপোর্ট করি আমি। শহরের বেশিরভাগ পেশাদার খেলোয়াড়ই আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু

‘যেমন?’

‘জিম লেকার। এটা তো মাত্র একজনের নাম বললাম।’

‘জিম লেকার আপনার বন্ধু? বিশ্বাস হচ্ছে না!’

‘তাহলে এসো প্রমাণ করে দিই, নিজের চোখেই দেখবে।’ সরু রাস্তাটা পেরোলেন ফ্রেডি। ‘ডোরবেল বাজিয়ে দেখি জিম বাসায় আছে কিনা।’

অপেক্ষা করছে, কিশোর সন্দিহান টরণ্টো ব্লু জ্যে বেসবল টিমের খ্যাতনামা খেলোয়াড়টি সত্যিই দরজা খুলবেন কিনা।

চোয়াল ঝুলে পড়ল ওর, যখন খুললেন তিনি। পরিচয় করিয়ে দেয়ার পরও মুখে কথা জোগাল না কিশোরের। ওরা সিঁড়ি ভেঙে উঠে এল এক অ্যাপার্টমেন্টে, বাজারটি দেখা যায় যেখান থেকে।

‘শহরের সেরা ভিউ,’ বললেন জিম, ওদেরকে পেছনে নিয়ে ব্যালকনিতে চলে এলেন। ‘প্লাস দোরগোড়ায় তাজা ফলমূল আর তরি-তরকারী।’

কিশোর বুদ্ধিমানের মত কোন মন্তব্য করা যায় কিনা ভাবল, কিন্তু পারল শুধু মানুষটির দিকে অবাক নয়নে চেয়ে থাকতে। এঁকে টিভিতে কতবারই না দেখেছে! বাচ্চা কোলে ওঁর স্ত্রী এসে দাঁড়ালেন ব্যালকনিতে, তাঁর সঙ্গে কিশোরকে পরিচয় করানো হলো। লেকার দম্পতি ওদেরকে আপ্যায়ন করলে ধীরে-ধীরে সহজ হয়ে এল ও।

‘এটা খুব টেস্টি,’ বলে, মচমচে এক কর্ন-মিল ফ্রিটারে আরেক কামড় দিল কিশোর। ব্যালকনি থেকে চোখ নামিয়ে চাইল ব্যস্ত, কোলাহলমুখর বাজারটির দিকে।

হাতঘড়ি দেখলেন ফ্রেডি।

‘আমাকে শীঘ্রি টিভি স্টেশনে যেতে হবে। অ্যাই, কিশোর, তুমি আর টিনা আমার অতিথি হিসেবে কাল রাতের বেসবল গেমটা দেখবে নাকি?’

‘সে আর বলতে!’

‘তাহলে, লেকারদের অনুমতি নিয়ে, আমি বরং ফোন করে ওটা অ্যারেঞ্জ করে ফেলি।’

ফ্রেডি ব্যালকনি’ ত্যাগ করতেই, সাহস জড় করে জিম লেকারকে প্রশ্ন করল কিশোর, তারকা বেসবল খেলোয়াড় হিসেবে তাঁর অনুভূতি কী। মানুষটা খোশমেজাজে হেসে উঠে পেশাদার বেসবল জীবনের কিছু আগ্রহ জাগানিয়া গল্প শোনালেন।

‘পিচারের ওপর সবচেয়ে বেশি চাপ থাকে, সে সর্বক্ষণ থাকে সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে। সে যখন খারাপ খেলে, এবং এমনভাবে সব গুলিয়ে ফেলে যে আরেকজন পিচার দায়িত্ব নিতে বাধ্য হয়, তখন তাকে মন খারাপ করে লম্বা পথ হেঁটে শাওয়ারে যেতে হয়।’

‘এক মিনিট,’ আচমকা চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। ‘বুঝেছি!’

‘কী?’

‘রেজিনা ভুল শুনেছিলেন! স্যর ডয়েল ‘পিকচার্স’, মানে ছবি নয়, তিনি ‘পিচার্স’ বলেছিলেন!’

লেকার দম্পতি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছেন। কিশোর মুচকি হাসছে। এসময় ফ্রেডি ফিরলেন এবং কিশোর হড়বড় করে বলে ফেলল, ‘জানেন? আমি জানি হীরেগুলো কোথায় লুকানো আছে!’

সামান্য হাসলেন ফ্রেডি, তারপর চিন্তামগ্ন হয়ে পড়লেন।

‘আমার বিশ্বাস তুমি সত্যি কথাই বলছ।’ তাঁর কথা শুনে খুশি হলো কিশোর। ‘তো? কোথায় আছে ওগুলো?’

‘এখনই বলতে চাইছি না, বাই চান্স যদি ভুল হয় আমার? এখন চলুন কাসা লোমায় যাই, ওখানে গিয়ে আমার থিয়োরি পরীক্ষা করব।’

‘একটু ধৈর্য ধরো, লেকারদের বাসায় বেড়াতে এসে তো হুট করে চলে যেতে পারি না।’

অগত্যা হতাশাটুকু গিলে নিতে বাধ্য হলো কিশোর, ওদিকে ফ্রেডি বসে পড়ে আরেক কাপ কফি নিলেন, তারপর হতভম্ব দম্পতিটিকে ব্যাখ্যা করলেন কিশোর কেন এত উত্তেজিত। এবার তিনজন মিলে প্রাণপণ চেষ্টা করলেন কিশোরের পেট থেকে গুমর বের করতে, কিন্তু ও স্রেফ মাথা নেড়ে হেসে গেল।

‘আমার ধারণা যদি ভুল হয়? সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে না?’

একটু পরে, হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালেন ফ্রেডি।

‘বোঝাই যাচ্ছে কিশোর মুখ খুলবে না, আমি বরং যাই। আরেকটা ফোন কল করেই বিদায় নেব।’

ফ্রেডি যতক্ষণ না ফিরলেন, কিশোর লেকারদের বাচ্চাটাকে কোলে দোল খাইয়ে নিজের উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা করল। বাচ্চাটা খুব মজা পাচ্ছে, হাসছে খিলখিলিয়ে। শেষমেশ, ফ্রেডি আর ও বিদায় নিয়ে বাজার ভেদ করে হনহন করে পা চালাল। বেকারি আর সুস্বাদু মশলাদার খাবার বিক্রেতাদের দোকান থেকে আসা মন মাতানো ঘ্রাণকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে দুর্গে ফিরতে রীতিমত মরিয়া কিশোর।

‘শোনো, কিশোর,’ ফ্রেডি বললেন। ‘আইস হকি প্লেয়ার জন্টি রোডসের সঙ্গে আমার এক অন-এয়ার ইন্টারভিউ আছে, আমি ইতিমধ্যেই দেরি করে ফেলেছি। তুমি বরং স্ট্রিটকার নিয়ে কাসা লোমায় চলে যাও।’

‘ঠিক আছে, ফ্রেডি, এবং ধন্যবাদ আপনাকে, বাজারটা দেখে আর লেকারদের সাথে আলাপ করে খুব ভাল লাগল। টিনা আজ সায়েন্স সেন্টারে বেড়াতে গিয়ে মস্ত ভুল করেছে।’

বেশ কয়েকটা স্ট্রিটকার পাশ কাটাল ওদের, এবং রাস্তার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ক্রমেই উদ্বিগ্ন আর অধৈর্য হয়ে উঠতে লাগলেন ফ্রেডি।

‘যাক, এল শেষ পর্যন্ত। ওকে, কিশোর, পরের স্ট্রিটকারটা তোমার। প্রিন্স এডওয়ার্ড ড্রাইভের কাছে নেমে কারও কাছ থেকে কাসা লোমার রাস্তা জেনে নিয়ো।’ কিশোর নিরাপদে উঠেছে কিনা নিশ্চিত হয়ে, হাত নাড়লেন ফ্রেডি। ‘আশা করি হীরেগুলো তুমি খুঁজে পাবে। আমার জন্যেও দু’একটা রেখো কিন্তু!’

ট্র্যাকে এপাশ-ওপাশ দুলছে, কিশোর স্ট্রিটকারটার পেছনদিকে হেঁটে চলে এল। মাত্র অল্প ক’জন যাত্রী উঠেছে এটায়; কিশোর তাদেরকে এক পলকে দেখে নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে চাইল। এক স্কুলের পাকা খেলার মাঠে কটা বাচ্চা বেসবল খেলছে।

পরের স্টপে ইয়াবড় রেইনকোট আর ফ্লপি হ্যাট পরা দু’জন লোক অপেক্ষা করছিল। প্রথমজন সামনের দিকের এক আসনে ধপ করে বসে পড়ল আর দ্বিতীয়জন ক্রাচে ভর দিয়ে কষ্টেসৃষ্টে স্ট্রিটকারে চাপল।

ড্রাইভার সাহায্যের হাত বাড়ালেও, লোকটা মাথা নেড়ে ধীর পায়ে আইল ধরে পেছনে হেঁটে গেল। লোকটা একইসঙ্গে রেইনকোট আর র‍্যাপ-অ্যারাউণ্ড সানগ্লাস ব্যবহার করছে দেখে মুচকি হাসল কিশোর; যে কোন আবহাওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি রেখেছে সে।

কিশোর জানালার কাছ ঘেঁষে সরে বসল, কেননা লোকটা ধপাস করে ওর পাশে বসেছে। লোকটা অন্য কোন খালি সিট বাছল না কেন ভাবল কিশোর, এবার জানালা দিয়ে চেয়ে ঠেলাগাড়িতে টকটকে লাল ক্যাণ্ডি আপেল আর গরম কাজুবাদামের প্রদর্শনী দেখল। হীরেগুলো আবিষ্কারের পুরস্কার হিসেবে একটা ক্যাণ্ডি আপেল হতে পারে সেরা উপহার; মনে-মনে চাইল · স্ট্রিটকারটা গতি দ্বিগুণ করবে।

‘পকেটমার! পকেটমার!’

হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠেছে কিশোরের পাশের লোকটা। স্ট্রিটকার থেমে দাঁড়ালে, অন্য যাত্রীরা ঘুরে চাইল। লোকটা ক্রাচে ভর দিয়ে রীতিমত যুঝে উঠে দাঁড়াল এবং অভিযোগের আঙুল তুলল কিশোরের প্রতি।

‘এই ছেলেটা আমার ওয়ালেট চুরি করেছে!’

‘কী?’ নিজের কানজোড়াকে বিশ্বাস করতে পারছে না কিশোর। ‘পাগল নাকি আপনি?’

‘ওটা তোমার পকেটে!’

কিশোর চোখ নামিয়ে চেয়ে এক জীর্ণ চামড়ার ওয়ালেট দেখল ওর পকেটে। তাজ্জব বনে গেল ও।

‘আরি, এটা কীভাবে…?’

‘চোর কোথাকার! প্রতিবন্ধীদের পকেট মারিস! তোকে হাজতে পোরা দরকার।

শেষ স্টপটিতে যে লোকটি উঠেছিল সে দ্রুতপায়ে এদিকে এগিয়ে এল; সামনাসামনি তার রেইনকোট আর হ্যাট নিজের পরিচয় গোপন করতে পারল না কিশোরের কাছ থেকে।

‘আরি! আপনি-’

‘চুপ থাকো,’ কঠোর কণ্ঠে বলল লোকটা, কিশোরের গলা ছাপিয়ে। ‘আমি পুলিস অফিসার, বাছা, এবং তোমাকে গ্রেপ্তার করা হলো।’

‘কী বলছেন এসব ‘

কিন্তু এবারও কিশোরের কণ্ঠস্বর চাপা পড়ল, লোকটা যখন চালককে হেঁকে বলল পেছনের দরজা খুলে দিতে। এবার ওকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে ঠেলে নিয়ে গেল কালো কাঁচে ঢাকা এক ভ্যানের উদ্দেশে। এক গলির ভেতর পার্ক করা ছিল ওটা। কিশোর মরিয়ার মতন চারপাশে চাইল সাহায্যের আশায়, কিন্তু গলিটা একদম সুনসান। হঠাৎই টের পেল ওকে ভ্যানটার মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলা হলো। এবার সগর্জনে মেইন স্ট্রিটের যানবাহনের ভিড়ে মিশে গেল ওটা।

মেঝে থেকে চোখ তুলে চাইতেই বুকে কাঁপ ধরে গেল কিশোরের। ওর ওপরে অশুভ ভঙ্গিতে ঝুঁকে রয়েছে কাসা লোমার আস্তাবলের সেই হিংস্র কামারটা।

‘কোন নড়াচড়া নয়, কোন কথা নয়,’ বলে, লোকটা চালকের উদ্দেশে ঘুরে দাঁড়াল। ‘আস্তে চালাও। স্পিড লিমিট ভাঙার জন্যে থামানো হোক চাই না, বিশেষ করে পুলিসের ভান ধরার পর!’

ভ্যানটার গতি কমে এল। ভয় তাড়াতে চালকের ওপর মনোযোগ দিতে চাইল কিশোর, মেঝে থেকে তাকে দেখতে পাচ্ছে না ও। কে ওটা? ওরা ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, এবং কেনই বা ওকে অপহরণ করা হলো?

প্রশ্নগুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, কিশোর আতঙ্কিত হয়ে উঠল। চোখ বুজল ও, টিনা আর কাসা লোমার অন্যদের কথা ভাবতে চেষ্টা করল; ও না ফিরলে ওরা নিশ্চয়ই পুলিসকে জানাবে।

সময় বয়ে চলেছে এবং গড়িয়ে চলেছে ভ্যানটা। চোখের পাতা ভারী হয়ে এল কিশোরের, এবং একসময় ইচ্ছের বিরুদ্ধে অস্বস্তিকর ঘুমে তলিয়ে গেল ও।

.

কাঁধে কামারের ঝাঁকুনি খেয়ে ঘুম ভাঙল কিশোরের।

‘এসো।’

ভ্যানের খোলা দরজা দিয়ে শীতল বাতাস ঢুকছে। অন্ধকারময় রাতে টলমল পায়ে বেরিয়ে এল কিশোর এবং ওকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো এক দালানের দরজার উদ্দেশে। এক হলওয়ে ধরে হাঁটিয়ে ওকে ঠেলে ঢোকানো হলো কালিগোলা অন্ধকারে ঢাকা এক কামরায়।

দরজা লেগে গেল পেছনে, তালায় খুট করে চাবি মারা হলো। বদ্ধ কামরাটিতে চুইয়ে ঢুকছে আলো, আবছাভাবে কটা চেয়ার আর এক সোফা চোখে পড়ল; ঘরের এক কোনায় একটা ফায়ারপ্লেস দেখল কিশোর।

দরজার ওপাশে, হলওয়ে থেকে নিচু কণ্ঠস্বর কানে আসছে। কাছিয়ে গেল কিশোর, এবং কামারের কথা শুনে পেটের মাংসপেশী আড়ষ্ট হয়ে গেল ওর, ‘আমি ছোঁড়ার পেট থেকে কথা আদায় করব। ও বাপ-বাপ করে সব বলে দেবে। দু’সেকেণ্ডের মামলা, তার কমও লাগতে পারে।’

দ্বিতীয় আরেকটি কণ্ঠস্বর জবাব দিল, এটা সম্ভবত ভ্যানচালক। কিশোর কান পাতল, কিন্তু কণ্ঠটি এতটাই অনুচ্চ যে স্রেফ বিড়বিড়ানির মত শোনাল।

‘এখনই না,’ বলল কামার। ‘আগে টিভিতে খেলাটা দেখে নিই।’

অপর কণ্ঠটি বিড়বিড় করে কীসব বলল।

‘ওকে আমার ভাল লাগে,’ বলল কামার। ‘ওর নিজস্ব একটা স্টাইল আছে, কী সুন্দর একটা ঘড়ি পরে! কাজটা হয়ে গেলে যখন টাকাটা পাব, আমিও অমন একটা ঘড়ি কিনব।’

আবার বিড়বিড়ানি।

‘ওকে, তো আমি তোমাদের দু’জনের জন্যেই কাজ করছি! হ্যাঁ, এটা ঠিক তুমিই প্রথম আবিষ্কার কর স্টাডিতে বাটনের জায়গায় ছিটকিনি রয়েছে, কিন্তু তারপরও তোমাকে বর্স মানতে পারছি না।’

এবার টিভি চালু হওয়ার শব্দ এবং পরিচিত কণ্ঠটি শুনতেই ধড়াস করে উঠল কিশোরের হৃৎপিণ্ড: ফ্রেডি ব্রাউন।

.

শুভ সন্ধে, ফ্রেডি বললেন। বেসবলের জন্যে আজ আদর্শ রাত। তাঁর ভরাট কণ্ঠস্বর কথা বলে চলেছে, বেসবল গেমটির খুঁটিনাটি বর্ণনা করছে, হঠাৎই একাকীত্ব জেঁকে বসল কিশোরের মনে। ও কি আর কখনও প্রিয়জনদের মুখ দেখতে পাবে?

ইস, যদি পালাতে পারত এখান থেকে!

দুর্দান্ত! চেঁচিয়ে উঠলেন ফ্রেডি। অসাধারণ এক ক্যাচ লুফেছেন জিম লেকার!

লেকারদের ব্যালকনিতে এই তো ক’ঘণ্টা আগেই কী সুন্দর সময় কাটিয়েছে, স্মৃতিটা মনে পড়তেই পালাতে মরিয়া হয়ে উঠল কিশোর। বেসবল ব্রডকাস্টের সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে ওকে।

সাবধানে, কামরাটা নিরীখ করল ও। ঘরে একটাই মাত্র দরজা, যেটিতে তালা মারা এবং জানালাটাও বন্ধ। ফাঁদে পড়েছে ও।

নাকি পড়েনি? কোনার কাঠের ছোট চেয়ারটার দিকে চাইল কিশোর, এবং উল্টেপাল্টে ভেবে দেখল সম্ভাবনাগুলো। এবার ঝটপট চলে এল চেয়ারটার কাছে, ওটা তুলে নিয়ে জানালার দিকে এগোল।

সর্বশক্তিতে চেয়ারটা জানালার ওপর আছড়াল কিশোর। ভয়ঙ্কর ঝনঝন শব্দে কাঁচ ভাঙল, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল কাঁচের ফোয়ারা। ভাঙা কাঁচের টুকরো-টাকরা চেয়ারের পায়া দিয়ে খসিয়ে কিশোর মাটিতে লাফিয়ে পড়তেই হলওয়ে থেকে উচ্চকিত চিৎকার শুনল।

ঘরের ভেতরে বাতি জ্বলে উঠল এবং কিশোর ধরা পড়ল ওটার আলোয়। আঁধারে অন্ধের মতন ছুট দিল ও, আরেকটু হলেই ধাক্কা খেত এক গাছের সঙ্গে, এবার টলতে-টলতে ঢুকে পড়ল ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে।

‘ফিরে এসো!’ কামার লোকটা গর্জন ছাড়ল।

ঝোপের ভেতর দিয়ে পথ করে নিয়ে এক পাহাড়ের পাথুরে পার্শ্বদেশে পৌছল কিশোর। টলমল পায়ে হেঁটে চলেছে, মাঝেমধ্যে মুহূর্তের বিরতি নিচ্ছে ওকে অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা বুঝতে। মাথার ওপরে শীতল আলো বিলাচ্ছে নক্ষত্ররাজি, এছাড়া আঁধার একদম ঘিরে রেখেছে ওকে। ব্যাঙের তীক্ষ্ণ ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই, এবং কিশোর উপলব্ধি করল নিরাপদেই পালাতে পেরেছে।

পলকের জন্য ভাবনাটা ওকে রোমাঞ্চিত করল, কিন্তু পরক্ষণে মুখে ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা লাগতেই চারপাশে চাইল ও। মুক্তি পেলেও এই অনন্ত, শূন্য আঁধারে কোথায়ই বা যাবে ও?