মূর্তিমান আতঙ্ক – ২৫

পঁচিশ

‘আমি আপনাকে ভয় পাই না, উয!’

তৈলাক্ত আঠার হিসহিসানি ছাপিয়ে ফুসফুস ফাটিয়ে চিৎকার ছাড়লাম।

জ্বলন্ত আলকাতরার ঢেউ থেমে গেল। পিছিয়ে গেল সামান্য। ‘আমি দ্য উইয়ার্ড অভ উয পড়েছি!’ চেঁচালাম। ‘এবং এখন আমারও কিছু ক্ষমতা আছে!’

আঠাল তেলের ঢেউ পেছনে সরল। উয তার স্বাভাবিক আকার-আকৃতিতে ফিরে গেল।

ওর বুদ্বুদ ছড়ানো বিশাল বুকের ছাতি উঠছে-নামছে। চোখজোড়া বিস্ফারিত। কুৎসিত মুখটা হাঁ হয়ে রয়েছে, নীল জিভখানা এপাশ-ওপাশ নড়ছে।

‘ক্ষমতা?’ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল ও। ‘কী ধরনের ক্ষমতা আছে তোমার, পাঙ্ক? বাচ্চাদের মত চেঁচানোর ক্ষমতা?’

‘উয…আমার নতুন নাম হচ্ছে জলোচ্ছ্বাস!’ বললাম চিৎকার করে। কাল রাতে ভেবে রেখেছি নামটা।

চোখ সরু করে আমার উদ্দেশে চাইল ও। চিবানোর ভঙ্গিতে ওঠা-নামা করতেই টিক-টিক শব্দ করল ওর চোখা দাঁতের সারি।

‘আমি জল-জগতের রাজা!’ গর্জালাম।

যদিও আমার জলক্ষমতা মাত্র দশ সেকেণ্ড টিকেছিল, মনে- মনে বললাম। এবং আমার কোন ধারণা নেই আবারও দশ সেকেণ্ডের জন্য সেই ক্ষমতা আমি ফিরিয়ে আনতে পারব কিনা।

হয়তো এভাবে ওকে ধোঁকা দিতে পারব। চেষ্টা তো অন্তত করতে হবে!

উয বুকের কাছে ভাঁজ করল বাহুজোড়া। ফলে ভেজা, সপসপে এক শব্দ হলো।

শাণিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে ও। মুখে টু শব্দটি নেই।

‘হিমশীতল বাথটাবে আমি আমার ক্ষমতা আবিষ্কার করেছি।’ বললাম। ‘আপনিও হয়তো সেই চ্যাপ্টারটা পড়েছেন।’

এক চুল নড়ল না ও। এমনকী চোখের পাতাও ফেলল না।

‘তো…’ কথার খেই ধরলাম, ‘আমার এখন জলোচ্ছ্বাস ঘটানোর মত আশ্চর্য ক্ষমতা আর শক্তি আছে!’

উয মাথাটা পেছনে ঝাড়া মেরে অট্টহাসি হাসল। হাসি শেষে, হাতজোড়া কোমরে রাখল।

‘জলোচ্ছ্বাস, না?’ জলদগম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল। ‘ঢেউ সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা নেই, পাঙ্ক। জানো শুধু মিথ্যে কথার ঢেউ তুলতে!’

সগর্জনে আবারও হেসে উঠল উয। ওর শ্বাস-প্রশ্বাস জ্বলন্ত চুলোর তাপ বুলিয়ে গেল আমার শরীরে।

নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে আমি, হাতজোড়া দু’পাশে মুঠো পাকানো, চাইছি না ও দেখে ফেলুক আমার দু’পা কীভাবে থরথর করে কাঁপছে।

মাথা নামিয়ে কুৎসিত, দেঁতো হাসি হাসল ও আমার উদ্দেশে।

‘দেখি তোমার কত ক্ষমতা। কী পারো দেখাও আমাকে।’

ছাব্বিশ

মাথার মধ্যে চক্কর মারছে আমার। চারধারে চোখ বোলালাম।

বরফশীতল কোন বাথটাব নেই আশপাশে। এখন কী করা?

তারপরও চেষ্টা করব, সিদ্ধান্ত নিলাম।

চোখ বুজে, মুখ কুঁচকে একাগ্র হওয়ার চেষ্টা করলাম।

‘উয, আপনি দেখতে চেয়েছেন যখন!’ চিৎকার ছাড়লাম, ‘তখন দেখুন জলোচ্ছ্বাসের কী বিপুল ক্ষমতা!’

‘সাধ্যমত চেষ্টা করো,’ জবাব দিল ও। ‘আমার সাথে লড়তে হলে সেরাটা দিতে হবে তোমার। কী, বুঝলে কিছু?’

বুঝিনি আবার! চোখের পাতা আরও সেঁটে বসল আমার। মন থেকে সব চিন্তা-ভাবনা দূর করতে চাইছি।

কল্পনায় মহাসাগর ফুটিয়ে তুললাম। গাঢ় নীল ঢেউ, মাইলকে মাইল শুধু নীলগোলা পানি, যদ্দূর দৃষ্টি চলে।

পানি…মাইলের পর মাইল স্রেফ পানি…

এবার ঢেউ, ক্রমেই উঁচু হচ্ছে। জলোচ্ছ্বাসের মত বড়-বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে। মাথায় সাদা ফেনার মুকুট নিয়ে।

সৈকতে ভাঙছে ঢেউয়ের পরে ঢেউ। সাগরতীরে ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ পাচ্ছি। একটার পর একটা ঢেউ আঘাত হানছে ছলাৎ- ছলাৎ করে।

হৃৎপিণ্ড এতটাই লাফাচ্ছে, ভয় হলো বুক ফেটে বেরিয়ে না যায়। জানি যে কোন মুহূর্তে উয গড়িয়ে যাবে আমার ওপর দিয়ে। চোখ বুজেই রেখেছি। নীল ঢেউয়ের ছবি ফোটাচ্ছি মনের পর্দায়…ওই উঁচু থেকে সশব্দে আছড়ে পড়ছে…ঠিক সাইক্লোনের মত…

‘ওহ।’ অন্যরকম অনুভূতি টের পেতেই সভয়ে শ্বাস চাপলাম।

সমস্ত মাংসপেশীতে খিল ধরে গেছে। চামড়া খসে পড়ছে গা থেকে।

চমকে উঠে, চোখ মেললাম। মাথা ঝিমঝিম করছে। এপাশ- ওপাশ দুলছে আমার দেহ। নিজের দিকে তাকালাম। হ্যাঁ, আমার শরীর রূপ পাল্টাচ্ছে…গলে যাচ্ছে… মিশে যাচ্ছে…

উযের মুখের চেহারায় আতঙ্কের অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে। বিস্ময় চাপতে পারেনি ও। বড়-বড় ভুড়ভুড়ি ছড়িয়ে, বিশাল এক কদম ফেলে পিছু হটল।

কাজ হচ্ছে! জানি আমি। জলক্ষমতা এখনও আমাকে ছেড়ে যায়নি। একবার পেলে হয়তো চিরদিনই থেকে যায় ক্ষমতাটা।

ও নিয়ে ভাবার সময় নেই। আমি এখন পানি। আমার শরীর এক ফেনিল ঢেউ।

নিজেকে টেনে তুললাম।

ভীত-সন্ত্রস্ত উযের সামনে উঁচু হয়ে উঠলাম।

‘দেখুন, উয!’ চেঁচিয়ে উঠলাম। ভেতরের গভীর কোনখান থেকে পানির মত গলগল করে উঠল আমার কণ্ঠস্বর। ‘দেখুন! তেলে আর জলে কখনও মেশে না!’

এবার আরও উঁচু। নিজেকে টেনে তুললাম আরও ওপরে।

কোটর থেকে চোখজোড়া ঠিকরে বেরিয়ে আসবে যেন সুপারভিলেনের। গর্জাতে লাগলাম আমি। শক্তিশালী জলোচ্ছ্বাসের শব্দ করছি।

উঁচিয়ে উঠলাম আরও।

আমার জল-দেহ বুদ্বুদের শব্দ করে, ফেনা তুলে সামনে ঝুঁকল। উযের ওপরে ভেঙে পড়বে যে কোন মুহূর্তে।

‘এখনই টের পাবেন -জলোচ্ছ্বাসের ক্ষমতা কাকে বলে!’ গর্জালাম।

এবং তারপর সব ভেস্তে গেল।

সাতাশ

ফট করে ফাটল কী যেন।

সাইডওয়কে আছাড় খেলাম আমি। সর্বাঙ্গে বয়ে গেল তীব্র ব্যথা।

চোখ নামিয়ে চাইলাম। আবারও নিজের রূপে ফিরে এসেছি। নিরেট। একদম স্বাভাবিক এখন আমি।

চিমটি কাটলাম চিবুকে। চামড়াই পানি নয়।

গোড়ালী অবধি ডুবিয়ে পানির এক গর্তে দাঁড়িয়ে আছি। এবারও মহাক্ষমতা মাত্র দশ সেকেণ্ড স্থায়ী হয়েছে। আমার ভুলটা কোথায় হচ্ছে?

উয তেলতেলে এক আঙুল বাড়িয়ে খোঁচা মারল আমার বুকে। শার্ট ভেদ করে গরম আঁচ লাগল।

‘বোকা কোথাকার,’ গর্জাল ও। ‘তোমার কি ধারণা এটা ছেলেখেলা?’

আবারও খোঁচাল আমাকে আঙুল দিয়ে। ‘হেরে গেছ তুমি, পাঙ্ক। ‘

এক পা পিছালাম। পানিতে ছপছপ শব্দ করল আমার জুতোজোড়া। বুকের মধ্যে জমাট বাঁধছে আতঙ্ক। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

‘আপনি-আপনি কি এখন আমাকে উযায়ন করবেন?’ শ্বাসের ফাঁকে বললাম কোনমতে।

ভেজা, তেল চটচটে চিবুকটা ডলল ও। ভাবছে গভীর মনোযোগে।

‘তোমাকে উযায়ন করাই উচিত,’ বলল শেষমেশ। ‘কিন্তু আমাকে যে সুপারপাওয়ারের নিয়ম মানতে হবে!’

‘মানে?’ চোখ তুলে চাইলাম সুপারভিলেনের দিকে, বোঝার চেষ্টা করছি।

‘সুপারপাওয়ারের কোড,’ বলল উয। ‘তোমার যেহেতু কিছু ক্ষমতা আছে, তাই তোমাকে আরেকটা সুযোগ দিতে হবে আমার।’

জোরে ঢোক গিললাম। ব্যাটা বলে কী?! ও কি আমাকে সত্যি-সত্যিই যেতে দেবে?

দীর্ঘশ্বাস পড়ল ওর।

‘এটাই আইন। যদিও তোমার ক্ষমতা মাত্র দশ সেকেণ্ড থাকে, তারপরও আমি কোড মেনে চলব। তাই তোমাকে আরেকটা সুযোগ দিচ্ছি…’

বুকে আবারও আঙুলের গুঁতো দিল আমার।

‘ফ্যাবুলাস ফ্লেম তোমার বইটা চুরি করেছে বলেছিলে না?’

‘ফ্যাবুলাস ফ্লেম?’ বলে উঠলাম। ‘মানে সেই অগ্নিমানব?’

মাথা ঝাঁকাল ও।

‘হুঁ, ও-ই ফ্যাবুলাস ফ্লেম। ওটা আসলে ড্যারেল,’ বলল উয। ‘মনে আছে নিশ্চয়ই? কমিক কনভেনশনে আমার কর্মচারী ছিল যে লোকটা।’

চোয়াল ঝুলে পড়ল আমার।

‘ড্যারেলই সেই অগ্নিমানব?’

‘হ্যাঁ। ওকে দেখতে সাধারণ মানুষের মত দেখায়। কিন্তু আসলে তা নয়, ও একটা মিউট্যান্ট।’

এবার পিলে চমকানো ক্রুদ্ধ হুঙ্কার ছাড়ল উয। তালুতে ঘুষি মারল সজোরে। ফলে, চারদিকে ছিটকে পড়ল তৈলাক্ত আঠার দলা।

‘এবারই শেষ, ও আর আমার জিনিস চুরির সুযোগ পাবে না!’ থমথমে গলায় বলল।

‘বুঝলাম…না,’ বললাম। ‘ও না আপনার চাকরি করে?’

‘হ্যাঁ। ব্যাটার জন্যে মায়া হয় বলে সবসময় কাছে-কাছে রাখি,’ জানাল উয। ‘জানই তো, ও আমার মত এত বিখ্যাত নয়। ওর নিজের কমিক কিংবা অমন কিছু নেই। কিন্তু মাঝেমধ্যে ও হিংসের চোটে আমার ক্ষতি করে বসে। রাগ লাগে!’ দাঁত কিড়মিড় করে বলল।

মাথা নাড়ল সুপারভিলেন।

‘কিন্তু মনিবের জিনিস চুরি-চামারি করাটা বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি। ওর প্রতি ঘৃণা জন্মে গেছে আমার! সত্যি বলছি।’

‘তাহলে ওকে ছাঁটাই করছেন না কেন?’ প্রশ্ন করলাম।

ভ্রূ কুঁচকে ফেলল উয।

‘ওর ব্যাপারে আমার সাবধান থাকতে হবে। ও তো অগ্নিমানব, তাই না? ও মওকা পেলে আমাকে পুড়িয়ে ফেলতে পারে। আগুন যে তেলকে জ্বালিয়ে দিতে পারে হতভাগাটা তা ভালই জানে। তাই সাবধানে করতে হবে যা করার।’

‘তা আমার কী করতে হবে?’ জিজ্ঞেস করলাম।

উয ঝুঁকে এল আমার উদ্দেশে।

‘ওর আগুন নেভাতে হবে,’ বলল।

আটাশ

সভয়ে ঢোক গিললাম। শ্বাস ফিরে পেতে ক’মুহূৰ্ত লাগল।

‘বলেন কী! আমি? আমি ওর আগুন নেভাব?’

‘কাজটা আমি পারব না,’ বলল উয। ‘তবে তুমি পারবে। তুমি পানি দিয়ে ওর আগুন নিভিয়ে বইটা আমাকে এনে দেবে।’

গভীর মনোযোগে লক্ষ্য করলাম উযকে। ও সিরিয়াস।

উয আমাকে বাঁচার একটা সুযোগ দিচ্ছে। আমাকে ওর হয়ে ধ্বংস করতে হবে অগ্নিমানবকে।

কোন সমস্যা নেই-ঠিক না?

তাহলে আমার বুক দুরুদুরু করছে কেন? গা কাঁপছে কেন? ‘পানি ঢেলে ওর আগুন নিভিয়ে বইটা নিয়ে এসো,’ আবারও বলল উয। ‘পানির মত সোজা। জলক্ষমতা যার আছে তার কাছে এটা নস্যি। বইটা এনে দাও, বাছা, তাহলে আমি সুপারপাওয়ার কোড মেনে চলব। তোমাকে ছেড়ে দেব।’

‘কিন্তু…ও তো আমাকে পুড়িয়ে রোস্ট করে ফেলবে,’ ভাঙা গলায় বললাম। ‘আমি কি পারব-’

কালো চোখজোড়া সরু হলো উযের। মুখের চেহারা শক্ত হয়ে উঠল। ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে এখন ওকে। আবারও বুদ্বুদ ছড়াচ্ছে শরীর থেকে।

তপ্ত বাতাসের গরম ভাপ ছড়িয়ে, উঁচু হয়ে উঠল ও। আমাকে আঁধারে ঢেকে ফেলল ওর ছায়া। এবার আমার ওপর ঝুঁকে পড়ল ও…চামড়ায় ছ্যাকা না লাগা অবধি কাছিয়ে এল।

এবার নেমে আসতে লাগল, নিজেকে ছড়িয়ে দিচ্ছে আমার ওপরে।

‘আচ্ছা, আচ্ছা!’ প্রাণভয়ে চিৎকার ছাড়লাম। আত্মা খাঁচাছাড়া। ‘এনে দেব। কিন্তু ওকে পাব কোথায়?’

ঊনত্রিশ

ফ্যাবুলাস ফ্লেম, ওরফে অগ্নিমানব কোন চুল্লী কিংবা অতিকায় আভনের ভেতরে থাকে না। ডেয়ারি ফ্রিয থেকে ছ’ব্লক দূরে সাধারণ এক বাসাবাড়িতে তার বসবাস। গ্যারেজের সামনে, ড্রাইভওয়েতে ছোট, নীলরঙা এক গাড়ি দেখলাম। ফ্রন্ট ওয়কের কাছে কাত হয়ে পড়ে রয়েছে এক লিফ ব্লোয়ার।

উয আর আমি সন্তর্পণে ড্রাইভওয়ে ধরে এগোলাম এবং বাসাটার পাশ ঘুরে পথ করে নিলাম।

‘সাধারণ মানুষের মত জীবন যাপন করে মানুষকে বোকা বানায় ও,’ মৃদুস্বরে বলল উয। ‘এমনকী ওর প্রতিবেশীরাও জানে না ও যে ফ্যাবুলাস ফ্লেম। তারা ওকে ড্যারেল নামেই চেনে।’

বুক ঢিব-ঢিব করছে আমার। পেছনের উঠনের উদ্দেশে পা চালানোর সময় মাথায় জট পাকিয়ে গেল। কোনভাবে কি এই বিপদ থেকে রক্ষা পাব?

‘আমাদের একটা পাকাপোক্ত পরিকল্পনা চাই,’ বিড়বিড়িয়ে বলল উয।

‘উম…আচ্ছা…’ গলা খাঁকরালাম। ‘ওকে শুধু বলি বইটা ছিনতাইয়ের সময় ওকে আমি চিনে ফেলেছি,’ বাতলে দিলাম। ওকে বলব আমি ওর মহাভক্ত। আমি…উম…ওর অটোগ্রাফ চাইব।’

‘গুড। ওর কাছে যাবে। তারপর পানি ঢালবে।’ বলল উয। ‘ওর আগুন নিভিয়ে দেবে। আর আমি বইটা হাতিয়ে নেব।’

আমার জলক্ষমতা কি কাজ করবে? ভাবলাম। আগে হয়তো আমি তেমন জোরাল চেষ্টা করিনি। আসলেই এটা হয়তো আমার সুপারপাওয়ার।

ক’মুহূর্তের মধ্যেই, জানা যাবে।

ব্যাকইয়ার্ডে আমার পিঠে জোরে ধাক্কা দিল উয।

‘কাজ শুরু করো, পাঙ্ক।’

ড্যারেলকে দেখলাম। বারান্দায় এক লাউঞ্জারে শুয়ে রয়েছে। ও কি দেখেছে আমাকে? না।

বাড়িটার আবছায়ায় সাঁত করে ঢুকে পড়লাম।

ড্যারেল চিত হয়ে শোয়া। ওর জ্বলন্ত বুকের ওপরে একটা স্টেক ভাজছে! স্টেকটা শোঁ-শোঁ শব্দ করছে আর অগ্নিস্ফুলিঙ্গ লাফিয়ে-লাফিয়ে উঠছে

সহসাই উঠে বসল। দেখে ফেলেছে আমাকে!

‘কিশোর-তুমি এখানে কী করছ?’ স্টেকটা ওর কোলের ওপর পড়ল। গনগনে অগ্নিশিখা তখনও নাচছে ওর খোলা বুকে।

ওর দিকে আঙুল দেখালাম। ভান করলাম অবাক হয়েছি। ‘আমি জানতাম!’ চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘আপনিই ফ্যাবুলাস ফ্লেম-ঠিক না!’

খুশিতে দাঁত বেরিয়ে পড়ল ওর। ‘অস্বীকার করব না।’ লাউঞ্জ চেয়ারের পাশে রাখা ছোট্ট এক টেবিল, ওটার ওপরে এক প্লেটে তুলে রাখল স্টেকটা।

এবার এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এল আমার উদ্দেশে। ‘তুমি এখানে কেন এসেছ, কিশোর? বইটা নিতে নয় নিশ্চয়ই? কারণ ওটা আর ফেরত পাচ্ছ না তুমি।’

‘আ…আমার ওই বই নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই,’ বললাম। ‘আমি আপনার অনেক বড় ভক্ত! তাই আপনাকে দেখতে এলাম!’

আমাকে আপাদমস্তক খুঁটিয়ে পরখ করল ও। ওর মাথার ওপর থেকে ছিটকে পড়ল আগুনের ফুলকি।

‘আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না আমি ফ্যাবুলাস ফ্লেমের সাথে কথা বলছি!’ গলায় উৎসাহ ফুটিয়ে তুলে চিৎকার করে বললাম।

অভিনয়টা ভালই পারি আমি। ব্যাটা টোপ গিলেছে মনে হচ্ছে।

‘আপনি আমার ঘরে গিয়েছিলেন কত বড় সৌভাগ্য আমার!’ হড়বড় করে বললাম।

হাসিটা আরও চওড়া হলো অগ্নিমানবের। ওর বাহুজোড়া আর বুক থেকে ছিটকে পড়ছে শিখা।

‘যা খুঁজছিলাম তা নিয়ে এসেছ তো?’

‘হ্যাঁ,’ মিথ্যে বললাম। ‘এনেছি। কিন্তু তার আগে-আমাকে একটা অটোগ্রাফ দেবেন? যদি সম্ভব হয় আরকী! অটোগ্রাফ পেলে আমি বর্তে যাব!’

জ্বলন্ত এক হাত নাড়ল ও।

‘এসো, বসো।’ লাউঞ্জ চেয়ারে উঠে স্টেকটা আবারও বুকের ওপর রাখল। ‘কেমন স্টেক পছন্দ তোমার, কিশোর? মিডিয়াম রেয়ার?’

‘উম…আমার…’

অগ্নিশিখা লাফাচ্ছে ওর বুকের ওপর। ওগুলো উঁচিয়ে উঠতেই, আড়ালে ঢাকা পড়ল ওর মুখ।

এই সুযোগ।

চোখ বুজলাম। মনোযোগ ঢালছি…একাগ্র হচ্ছি। আবারও কল্পনা করলাম বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ছে নীল ঢেউ। জলোচ্ছ্বাসের মত উঁচু হয়ে…সগর্জনে…ভাঙছে ঢেউ।

এবং ক’মুহূর্ত পরে, টের পেলাম পরিবর্তন হচ্ছে আমার। গলে যাচ্ছে দেহ, অনুভব করছি। মনটা তলিয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ, শীতল পানিতে।

হ্যাঁ!

আবারও আমি জলোচ্ছ্বাস হয়েছি! আমার শরীর মিলিয়ে গেছে। সেখানে এখন দ্রুত বয়ে-চলা, গর্জনশীল পানির উঁচু ঢেউ।

ঝট করে ঘুরলাম। এবং অগ্নিমানবের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম।

প্রচণ্ড শক্তিশালী এক সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের মত লাউঞ্জ চেয়ারটা ভাসিয়ে দিলাম। পানির খরস্রোত বয়ে গেল ওটার ওপর দিয়ে।

বারান্দার পাথরগুলোর ওপরেও আছড়ে পড়েছি। ক্রমেই উঁচু হচ্ছি।

দশ সেকেণ্ড কেটে গেছে। আবার আমি ফিরে এসেছি নিজের রূপে। নিরেট, জলজ্যান্ত কিশোর। পানির ডোবায় হাঁটু গেড়ে বসা।

আর অগ্নিমানব?

বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে সে। অগ্নিঝরা হাতজোড়া কোমরে রেখে। বুকের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে আগুনের ফুলকি। স্টেকটা মাটিতে পড়ে রয়েছে, লাউঞ্জ চেয়ারটির পাশে।

‘বেশি তাড়াহুড়ো করে ফেলেছ, কিশোর,’

‘নরম গলায় বলল। ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে আমার দিকে। ‘চেষ্টাটা ভালই ছিল। তবে তুমি হেরে গেছ, বাছা।’

মাথা নোয়াল ও। এবার ষাঁড়ের মত সগর্জনে ধেয়ে এল আমার উদ্দেশে, বাহুজোড়া বাড়ানো, আগুন ধরিয়ে দেবে আমার সারা গায়ে।