রহস্যময় দুর্গ – ৭

সাত

দীর্ঘ কটি মুহূর্ত কিশোর কেবল একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল।

‘কিন্তু…কীভাবে…?’

‘খুব সহজেই।’ টম মামা ডেস্কের ওপরে পাজোড়া তুলে দিয়ে, খোশমেজাজে এক পুরানো পালকের কলম নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। ‘কীভাবে পেলাম এগুলো জানতে চাও?’

‘অবশ্যই!’

‘আমরা স্রেফ গোপন ড্রয়ারটা খুলেছি।’ মৃদু হাসলেন তিনি। ‘তবে তার আগে অবশ্য ছোট একটা সাহায্য পেয়েছি।’

‘কী সাহায্য?’

‘আজ সকালে একজন ফোন করেছিল। নিজের নাম বলেনি, কিন্তু হীরেগুলো কোথায় পাব ঠিক-ঠিক বর্ণনা দেয়। ফ্রেডি ব্রাউন এখানে কফি খাচ্ছিল, আমরা দু’জন, সে সঙ্গে টিনা আর জন স্টাডিতে ছুটে আসি…আর বাকিটুকু তো তুমি জানই।

‘হায় রে! বনে-বাদাড়ে এত ছোটাছুটি করে, লেকের ঠাণ্ডা পানিতে নাকানিচুবানি খেয়ে আমার লাভটা হলো কী! আপনারা তো আগেই আসল কাজ সেরে ফেলেছেন!’

‘সরি, কিশোর, তোমার জন্যে আমাদের অপেক্ষা করা উচিত ছিল।’

কিশোর হাসার চেষ্টা করল।

‘যাকগে, হীরেগুলো তো পাওয়া গেল, আমি এতেই খুশি। স্যর ডয়েলও যদি এখানে থাকতেন কতই না ভাল হত!’

‘হ্যাঁ, তাঁর রহস্যময় দুর্গ তাঁকে বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিতে পারতাম।’ হাতঘড়ি দেখলেন টম মামা। ‘যাই, বিকেলের চায়ের আয়োজন করিগে। বাবুর্চি ভুলে যেতে পারে, খানসামা যেহেতু নেই কে মনে করাবে?’

তিনি চলে গেলে মুচকি হাসল টিনা।

‘আজ সকালে আমরা কিচেনে ছিলাম। স্টোভটা এতই বড়, আস্ত একটা ষাঁড় রোস্ট করা যাবে।’

‘সত্যি?’

‘তোমার গলা শুনে মনে হচ্ছে মন খারাপ।’

‘হুঁ।’ মখমলের বাক্সটার ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে ঝকঝকে রত্নগুলো নাড়ল কিশোর। ‘এগুলো নিরাপদ জায়গায় রাখা উচিত।’

‘আজ রাতের জন্যে টম মামা ডেস্কেই লুকিয়ে রাখবে এগুলো। কাল ব্যাঙ্কের সেফটি-ডিপোজিট বক্সে রাখা হবে।’

‘এখানে থাকলে চুরি হবে না তো?’

‘না। বাদবাকি কাজের লোকেরাও শীঘ্রি চলে যাবে, কাজেই চুরি করার মত কেউ তো থাকছেই না।’

টিনাকে মখমলের বাক্সটা রেখে দিয়ে, গুপ্ত প্যানেলটা বন্ধ করতে দেখল কিশোর।

‘এখনও অনেক প্রশ্নের জবাব মেলেনি, টিনা। যেমন, স্যর ডয়েল রেজিনাকে যে সূত্রটা দিয়েছিলেন তার সাথে ডেস্ক ড্রয়ারের কোন মিল নেই, যদিও তিনি হয়তো নিছক মজা করেই কথাগুলো বলেছিলেন।’ কিশোর মর্মর পাথরের ফায়ারপ্লেসটার কাছে হেঁটে গেল। ‘তাছাড়া কামার ব্যাটার বলা অদ্ভুত কথাটাও কানে বাজছে, আড়ি পেতে যেটা শুনেছিলাম আমি। আমাকে যখন কেবিনটায় বন্দি করে রেখেছিল আরকী।’

‘কী সেটা?’

‘স্টাডিতে বোতামের বদলে ছিটকিনি থাকার ব্যাপারে কী যেন একটা কথা। ভেবেছিলাম ও এই স্টাডির কথাই বলছে, স্যর ডয়েল যেহেতু এখান থেকেই নিখোঁজ হন।’

‘বুঝলাম না,’ সব শুনে মন্তব্য করল টিনা।

সারা রাত বনে-জঙ্গলে, খোলা জায়গায় কাটিয়ে শরীরে এখনও শীত-শীত ভাব, কিশোর ঠিক করল স্নান করবে। টিনাকে স্টাডিতে বসিয়ে রেখে, স্যর ডয়েলের প্রাইভেট সুইটে বিলাসবহুল শাওয়ারে গা ভেজাতে গেল ও। আর টিনা নিজের হাতে স্টাডি- ছিটকিনি-বোতাম লেখা এক টুকরো কাগজ নিরীখ করতে লাগল গভীর মনোযোগে।

কিশোর আনন্দচিত্তে আবিষ্কার করল, এবার আর বেয়াড়া আচরণ করছে না শাওয়ারটা, সরু সুচের মতন গরম পানির ধারা রেইল থেকে হিসহিস শব্দে ঝরতে লাগল, কিশোর যতক্ষণ না দুর্গের বয়লার প্রায় ফুরিয়ে ফেলল। আলস্যির সঙ্গে গা মুছল ও। শাওয়ারে হীরে লুকিয়ে রাখার ব্যাপারটায় ওর ধারণা ভুল প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও, মূল্যবান রত্নগুলো নিরাপদে আছে জেনে রীতিমত খুশি কিশোর।

স্টাডিতে ফিরে ও দেখল, ডেস্কে দু’পা তুলে দিয়ে, হাসিমুখে বসে টিনা।

‘বুঝলে, আমার একটা বড়সড় মেডেল পাওনা,’ বলল টিনা। ‘কেন? কী কারণে?’

‘স্যর ডয়েলের বেডরুমে ক্যাথরিন একটা গোপন প্যানেল খুলেছিল। আরেকবার বলবে প্রথম থেকে?’

‘হুঁ, ও স্রেফ ম্যান্টেলের নিচের এক বোতাম চাপে, আর প্যানেলটা ঝট করে খুলে যায়।’

‘বোঝনি? বেডরুমে বোতাম, স্টাডিতে…’

‘ছিটকিনি!’

‘এই দেখো,’ দামি গালিচাটা পেরিয়ে ফায়ারপ্লেসের ওপরে কাঠের ম্যান্টেলটার উদ্দেশে হাত বাড়াল টিনা।

নিঃশব্দে দেয়ালের এক মেহগনি প্যানেল খুলে গেল হাট হয়ে।

‘আরি!’ কিশোর কাছিয়ে যেতেই দেখল আঁধারে এক সার সিঁড়ির ধাপ নেমে গেছে। ‘সাবাস, টিনা।’

‘ধন্যবাদ,’ বলে, মুচকি হাসল টিনা।

‘এগুলো কোথায় গেছে?’

‘কে জানে। চলো, নেমে দেখি।’

আলগোছে প্রথম ধাপটায় পা রাখল কিশোর। ওটা ককিয়ে উঠল।

‘এসো, একসাথে ট্রাই করি,’ বলল টিনা।

টিনাকে সঙ্গে নিয়ে আঁধারে প্রবেশ করল কিশোর। কাঠের সরু সিঁড়িটা পাক খেয়ে নেমে গেছে নিচে, এবং শীঘ্রিই স্টাডির আলোটা পড়ে রইল পেছনে। বাতাসে কেমন ছাতাপড়া গন্ধ। সে সঙ্গে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা।

‘কংক্রিট,’ ফিসফিস করে বলল টিনা। ‘মনে হয় আমরা কোন সুড়ঙ্গে ঢুকেছি।’

‘কোথাও নিশ্চয়ই কোন আলো থাকবে।’ হাত বাড়াতেই শীতল সিমেন্টের স্পর্শ পেল কিশোর। হাত বোলাল দেয়াল বরাবর, কিন্তু কোন বাতির সুইচ পেল না।

‘ফিরতে চাও?’ টিনা ফিসফিসিয়ে বলল।

‘প্রশ্নই ওঠে না, সুড়ঙ্গটা কোথায় গেছে দেখতে চাই।’

আঁধারে আবছা সাদা ছাপের মতন দেখাচ্ছে টিনার মুখের চেহারা। সুড়ঙ্গ ধরে এগিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল ও।

‘আস্তে,’ বলল কিশোর। ‘আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।’

‘দেয়ালে হাত রাখো, গাইডের কাজ করবে।’

‘সামনে যদি কোন খোলা গর্ত থাকে? অ্যালিগেটরে ঠাসা।’

‘তোমার কী, আগে তো আমাকে খাবে!’

দু’জনেই চুপ হয়ে গেল। শুধু দ্বিধাগ্রস্ত পায়ের আওয়াজ আর নার্ভাস শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। কালিগোলা, হিম বাতাস ভেদ করে সন্তর্পণে, সাবধানী পায়ে এগিয়ে চলেছে কিশোর আর টিনা।

‘এভাবে কি আজীবন হাঁটব নাকি আমরা?’ খানিক পরে ফিসফিসে স্বরে বলল কিশোর।

‘সুড়ঙ্গটা নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও গিয়ে তো শেষ হয়েছে।’

‘আর দু’মিনিট, তারপর কিন্তু ফিরে যাব আমরা।’

‘আচ্ছা।’

কিশোরের কল্পনায় পানি ভরা গর্ত আর রোমশ মাকড়সাদের ছবি ভেসে উঠল, আঁধারে ওত পেতে রয়েছে। গুপ্ত প্যানেলটা গোপন থাকলেই ভাল হত কিনা ভাবছে, এমনিসময় হিসিয়ে উঠল টিনা।

‘সিঁড়ি,’ বলল ফিসফিস করে। ‘ওপরদিকে যাচ্ছে।’

পায়ের তলায় ককাচ্ছে কাঠের সিঁড়ি। সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে দেয়াল হাতড়াল টিনা। হঠাৎই টিক করে এক শব্দ এবং ম্লান এক আলো চুইয়ে বেরোল সরু এক ফাটল গলে।

‘আমরা আস্তাবলে!’

‘তুমি শিয়োর?’

টিনা দেয়ালের এক প্যানেল ঠেলে খুলতেই ফাটলটা চওড়া হলো। ঘোড়ার স্টলগুলোর দিকে চলে যাওয়া সংকীর্ণ প্যাসেজটি দেখতে পেল কিশোর।

‘আচ্ছা! তারমানে এভাবেই ওরা স্টাডি থেকে স্যর ডয়েল আর গারফিল্ডকে বের করে আনে।’

মাথা ঝাঁকাল টিনা।

‘অপকর্মটা মনে হয় কামার ব্যাটার। স্যর ডয়েলের মাথায় বাড়ি মেরে অজ্ঞান করে সুড়ঙ্গ দিয়ে টেনে আস্তাবলে নিয়ে এসেছে। গারফিল্ডের বেলাতেও তাই।’

‘কিন্তু তারপর?’

‘শোনো!’ টিনার কণ্ঠে জরুরী তাগিদ।

আস্তাবলের কোথাও থেকে চাপা ধুপ-ধাপ শব্দ আসছে। আওয়াজটা অনুসরণ করে প্যাসেজ ধরে টিনার পিছু-পিছু চলেছে, আড়ষ্ট বোধ করল কিশোর। ওই কামার লোকটা আচমকা হাতুড়ি নিয়ে উদয় হবে নাকি? টিনাকে রক্ষা করতে হবে তো!

এক কোনা ঘুরতেই, নিজেদেরকে ঘোড়াদের স্টলে খুঁজে পেল ওরা। শব্দটা এখন আরও জোরাল।

‘শেষের স্টলটা থেকে আসছে আওয়াজটা,’ বলল টিনা।

দ্রুত পায়ে টালির মেঝে পেরিয়ে স্টলটির তালা বন্ধ দরজাটার কাছে চলে এল দু’জনে। কামারের একজোড়া চিমটা খুঁজে নিয়ে, জোর খাটিয়ে তালাটা ভাঙল কিশোর।

টিনা দরজাটায় ধাক্কা দিতেই, ধাতবের গোঙানী তুলে খুলে গেল ওটা এবং ছোট্ট এক খাট দেখতে পেল ওরা।

খাটে শুয়ে রয়েছেন স্বয়ং স্যর রবার্ট আর্থার ডয়েল।

দেয়ালে লাথি মারতে মারতে মুখের চেহারা লাল টকটকে হয়ে উঠেছে তাঁর, মুখের বাঁধন ভেদ করে কথা বলার চেষ্টা করতেই চোখজোড়া ঠিকরে বেরিয়ে আসার জোগাড় হলো ভদ্রলোকের।

‘মমমমমফ!’ বললেন, বেঁধে রাখা হাতজোড়া দিয়ে ইশারা করলেন।

‘চিন্তা করবেন না,’ তাঁকে আশ্বস্ত করল কিশোর। ‘এখুনি খুলে দিচ্ছি।’

কিশোর গিঁটগুলো খোলার জন্য ঝুঁকতেই, অবিরাম উদ্বিগ্ন শব্দ করে চললেন স্যর ডয়েল। টিনা মুখের বাঁধন খুলতেই, কথাগুলো বিস্ফোরিত হলো তাঁর মুখ থেকে।

‘আমার হীরেগুলো! ওগুলো নিরাপদে আছে তো?’

‘আছে।’ মৃদু হাসল টিনা। ‘এবং এখন আপনিও নিরাপদ।’

‘রত্নগুলো…তুমি জেনে বলছ তো?’

‘আমরা একটু আগেও দেখছিলাম ওগুলো। আপনি একটু শান্ত হোন, স্যর ডয়েল। কিশোর বাঁধনগুলো খুলে ফেলেছে প্রায়।’

‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ আমার হীরেগুলো চুরি হয়নি। ওই শয়তানগুলো সব চেষ্টাই করেছে আমি যাতে হীরে রাখার গোপন জায়গাটা দেখিয়ে দিই, কিন্তু পারেনি!’

‘খুব ভাল,’ বলল টিনা। নিজেদের পরিচয় দিল, টম মামার কথাও বলল।

কিশোর শেষ গিঁটটা খুলে দিতেই, খাটে উঠে বসলেন স্যর ডয়েল। টাক মাথার অল্প দু’এক গাছি পাকা চুলে হাত বুলিয়ে সমান করে, স্মিত হাসলেন।

‘আমাকে উদ্ধার করায় তোমাদেরকে অনেক ধন্যবাদ। দেয়ালে লাথির পর লাথি মেরেছি, কিন্তু কারও কানে পৌঁছয়নি।’ সটান সিধে হয়ে দাঁড়াতে যেতেই, গুঙিয়ে উঠে আবারও বসে পড়লেন তিনি।

‘আপনি দুর্বল হয়ে পড়েছেন,’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল টিনা। ‘আমরা বরং লোক নিয়ে আসি।’

‘না, না, আমি ঠিক আছি।’ টলমল পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে আবারও ধপাস করে বসে পড়লেন স্যর ডয়েল। ‘তুমি ঠিকই বলেছ। কারও সাহায্য ছাড়া আমি দাঁড়াতেই পারব না।’

দরজার কাছে গেল কিশোর।

‘আপনি এখানেই থাকুন। আমি টম মামাকে অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে বলছি।’ আস্তাবল ভেদ করে শশব্যস্তে চলেছে, জালিয়াতিটা ভেবে দেখল ও এবং সহসাই উপলব্ধি করল কামার লোকটা সবসময় কেন ঠাণ্ডা হর্সশু পেটায়। এর কারণ মুক্তিলাভের জন্য স্যর ডয়েলের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রাণপণ চেষ্টা যাতে আস্তাবলে আসা কারও কানে না যায়।

এবার দ্বিতীয় ধাঁধাটারও জবাব মিলে গেল। কিশোরের মনে পড়ল শোফারটার খাবারের ট্রে হাতে উদয় হওয়ার কথা। ও নিশ্চয়ই স্যর ডয়েলের জন্য সুড়ঙ্গ দিয়ে ওটা বয়ে এনেছিল, সেজন্যই পরনের জামা-কাপড় শুকনো ছিল লোকটার।

খাপে খাপে বসে যাচ্ছে সব কিছু, কিন্তু তারপরও খুশি হতে পারল না কিশোর। টের পেল ও, রহস্য আর বিপদটার সমাধান হতে এখনও ঢের দেরি।