গোপন সৈকতে – ১০

দশ

‘রহস্যের সমাধান হলো শেষমেশ,’ ক’মিনিট পরে ফ্যাকাসে চেহারার, বালিরঙা চুলের অধিকারী এক লোক বললেন। সৈকতের কিনারায় দাঁড়িয়ে তিনি, দেখছেন আরেকজন অফিসার কীভাবে ক্যাথি অ্যালেনকে হাতকড়া পরিয়ে পুলিস প্যাট্রল বোটে তুলছেন।

‘আমি আপনাকে চিনি!’ চেঁচিয়ে উঠল ডন। ‘মিস্টার স্যাণ্ডার্সের সাথে কি ওয়েস্টে দেখেছি। উনি বলেছিলেন আপনি একজন জেলে।’

হেসে উঠলেন নিল।

‘ইনি অফিসার জেরার্ড, ডন। আমাকে তখন ডাহা মিথ্যে বলতে হয়েছিল। আসলে আমরা ইনভেস্টিগেটর।’

দু’জনই দু’জনই আণ্ডারকভার

‘আচ্ছা, এখন ওর কী হবে?’ প্রশ্ন করল কিশোর। ক্যাথির দিকে চকিতে চাইতেই সে-ও পাল্টা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাল।

‘এটা কঠিন কেস।’ অফিসার জেরার্ড কোস্ট গার্ডের পোশাকধারী একদল লোককে কটা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ব্যাগে সযত্নে চোরাই প্রবাল ভরতে দেখলেন। ‘প্রত্যক্ষদর্শী আছে, চোরাই মাল পেয়েছি, এবং যে যন্ত্রপাতিগুলো ও ব্যবহার করেছে সেগুলোও।’

‘শুনে মনে হচ্ছে হাতেনাতে ধরেছেন,’ বললেন নিল। মাথা ঝাঁকালেন অফিসার জেরার্ড।

‘হ্যাঁ। বোটে মাত্র আরেকবার মাল বোঝাই দিয়েছিল। মজার ব্যাপার, ও ইঞ্জিন চালু করতে পারেনি। ব্যাপারটা খুব কাজে এসেছে আমাদের।’

নিল হেসে উঠতেই তারটা তুলে দেখাল কিশোর।

‘এর কৃতিত্ব কিশোরের। ও ক্যাথির স্পার্ক প্লাগ খুলে নিয়েছিল। এই ছেলে-মেয়েগুলো না থাকলে ও এতক্ষণে বহু দূরে চলে যেত।’

এসময় রবিন আর সু কি এসে পৌঁছল, ওদের পেছন-পেছন এসেছে একদল কাউন্সেলর আর ক্যাম্পার।

‘ব্যাপার কী?’ প্রশ্ন করল রবিন, হাতকড়া পরা ক্যাথি অ্যালেনকে দেখে চমকে গেছে। ‘ও-ই চোর?’ বলল ফিসফিসিয়ে।

‘হ্যাঁ,’ ডন মহা উত্তেজিত। ‘প্রবাল চুরির সময় বমাল ধরা পড়েছে। ফেস মাস্ক খুলতেই আমরা চিনে ফেলি ওকে। তারপর জঙ্গলে পালিয়ে যাই! খুব ভয় পেয়েছি!’

রবিন ওকে জড়িয়ে ধরল।

‘এসব কী হচ্ছে বলো তো,’ বলল এমা, রবিনকে অনুসরণ করে এসেছে। দস্তুরমত হাঁফাচ্ছে। ‘শব্দ পেয়ে দ্বীপের ওমাথা থেকে ছুটতে-ছুটতে এলাম।’

মৃদু হাসলেন নিল।

‘মূল কথা হচ্ছে এই বাচ্চাগুলো রহস্যটার সুরাহা করেছে। ওরা না থাকলে, ক্যাথি শেষবারের মত চুরি করে চিরতরে পগার পার হত।

‘একটা কথা,’ বলল রবিন, চাইল নিলের দিকে। ‘আপনি তারমানে মেরিন বায়োলজিস্ট নন?’

হেসে উঠল মুসা।

‘উনি পুলিস অফিসার, তবে সে লম্বা কাহিনী।’

‘আমারও অনেক প্রশ্ন আছে,’ বলল এমা। ‘চলুন না, ক্যাম্প কোরালে গিয়ে সব শুনি?’

আধ ঘণ্টা পরে, ক্যাম্পের ডকের পাশে পিকনিক টেবিলগুলো জুড়ে বসল সবাই। অন্যান্য অফিসাররা দ্বীপ ত্যাগ করলেও, নিল রয়ে গেছেন কেসটা নিয়ে কথা বলতে। এমা কয়েকটা টিকি ল্যাম্প জ্বালল এবং ক্যাম্পার আর কাউন্সেলররা নানান প্রশ্ন করে তাদের কৌতূহল মেটাল।

‘ক্যাথি কি সত্যি-সত্যি আণ্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফার ছিল?’ সু কি জানতে চাইল।

‘হ্যাঁ, সত্যিকারের ফটোগ্রাফার। বেশ কিছু বড়-বড় ম্যাগাজিনে ওর ছবি ছাপাও হয়েছে।’ বিরতি নিলেন নিল। ‘ইদানীং মনে হয় ওর ধারণা হয়েছিল প্রবাল চুরি করলে অনেক বেশি টাকা কামাতে পারবে।’

‘খাইছে, সেই ছবিটা! ওটা আমার মাথার ভেতর শুধু ঘুরছিল!’ বলে উঠল মুসা। সবাই চাইল ওর উদ্দেশে। ‘ক্যাথি সূর্যাস্তের অপূর্ব এক ছবি তোলে এবং ওটা ডার্করুমে ঝোলানো ছিল শুকানোর জন্যে।

‘হ্যাঁ, ছবিটা নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলে তুমি,’ বলল নথি। ‘তবে কারণটা বুঝিনি।’

‘আমিও তো বুঝিনি-বুঝলাম এইমাত্র।’ এমার দিকে চাইল মুসা। ‘পাথরের অবস্থান আর সূর্য অস্ত যাওয়ার দৃশ্যটা খুব চেনা- চেনা লাগছিল। ওটা আমি আগেও দেখেছি-আপনার দ্বীপ থেকে!’

‘তো আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেখানে না গেলে ও ছবি ক্যাথির তুলতে পারার কথা নয়,’ ধীর গলায় বলল রবিন। ‘বড় কোরাল বেডটা সম্ভবত সেদিনই আবিষ্কার করে ও এবং ভেঙে- ভেঙে চুরির সিদ্ধান্ত নেয়।’

‘আমরা কোস্ট গার্ডকে আগেই জানিয়েছিলাম,’ বলল গোয়েন্দাপ্রধান। ‘তারা সতর্ক থাকলে আর চুরি হত না।’

‘হয়তো গাফিলতি ছিল ওদের,’ বললেন নিল। ‘তার জবাবদিহি তাদেরকেই করতে হবে।’

‘আবার প্রবাল জন্মাতে কয়েকশো বছর লেগে যাবে,’ ব্যথিত কণ্ঠে বলল এমা।

‘মন খারাপ করবেন না, এমা,’ বলল মুসা। ‘ও তো অন্তত আর ক্ষতি করতে পারবে না।’

‘আপনারা ওকে প্রথম কখন সন্দেহ করেন?’ জনতার পেছন থেকে এক পুরুষকণ্ঠ বলে উঠল।

কিশোর চাইতেই জো ইলিয়টকে হাত তুলতে দেখল।

‘গোড়া থেকেই,’ জানালেন নিল। ‘তবে আমি আরও অনেককেই সন্দেহ করেছি। যেমন আপনাদের স্বামী-স্ত্রীকে।’

নার্ভাস হাসল রিনা ইলিয়ট।

‘আমাদেরকে?’

‘হ্যাঁ। আপনারা চার্টার বিজনেস করেন অথচ সেইলিঙের কিছুই জানেন না।’

‘ঠিক!’ বলে উঠল সু কি। ‘আমার ম্যাক্রামির টুকরোটা যখন দেখাই আপনি এমনকী স্কয়্যার নটও চিনতে পারেননি।’

‘এবং আপনি শার্টের ভেতর একটা মাছ ঢোকান!’ বলল ডন। ‘আমরা যে রাতে নমুনা সংগ্রহ করতে যাই।

‘আমি কী ঢুকিয়েছি বললে? ওহ, এবার বুঝেছি।’ হেসে উঠল জো। ‘ওটা মাছ নয়। ভেবেছিলাম পানিতে একটা বিরল কয়েন পড়ে রয়েছে, তাই ওটা তুলে শার্টের তলায় গুঁজি। কেউ দেখে ফেলেছে জানতাম না।’

‘আপনি দুষ্প্রাপ্য কয়েনের ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড?’ বলল কিশোর। ‘তারমানে সে রাতে আপনিই আমাদের কেবিনে গোপনে ঢুকেছিলেন!’

হকচকিয়ে গেছে জো।

‘ঠিকই ধরেছ। আমরা আসলে ট্রেজার হান্টার, সেইলর নই। ডনের কথা শুনে মনে হয়েছিল ও বোধহয় একটা স্প্যানিশ স্বর্ণমুদ্রা খুঁজে পেয়েছে। বুঝিনি ওটা মূল্যহীন।’ একটু থামল। ‘এখানে দামি জিনিস একটাই পেয়েছি, সেটা হচ্ছে শঙ্খের খোলসটা কিন্তু ওটা ফাটা ছিল।

‘খাইছে, তারমানে, আপনিই আমার শাঁখের খোলটা নিয়েছিলেন?’ জবাব চাইল মুসা।

জোকে অপ্রস্তুত দেখাল, মুখ ফস্কে বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে টের পেয়েছে।

‘আমার এক ইনভেস্টরকে ওটা দেখাতে চেয়েছিলাম। জিনিসটার দাম জানতাম না তো।’

‘কী করেছেন ওটা নিয়ে?’ এমা জবাব চাইল।

‘ক্লাসরুমের এক ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রেখেছি,’ জো উদ্ধতস্বরে বলল। ‘একসময় না একসময় আপনারা ঠিকই খুঁজে পাবেন ওটা, এই ভেবে।’

মুহূর্তের জন্য নীরব রইল সবাই, এবার মুখ খুলল রবিন।

‘আমরা এমনকী আপনাকেও সন্দেহ করেছি, নিল। একরাতে কে যেন গোপনে একটা পাওয়ারবোট নিয়ে সাগরে যায় এবং আমরা সিটের ওপর এনএস লেখা এক সোনালী সিগারেট লাইটার খুঁজে পাই।’

‘আমি এর ব্যাখ্যা দিতে পারব,’ বললেন নিল। ‘এনএস হচ্ছে ‘নর্থ স্টার’। ওরা প্রবালের বড় হোলসেলার। ক্যাথি সম্ভবত ওদের সাথেই কাজ করছিল।

মুসা নিচু হয়ে জয়েসের গায়ে হাত বুলিয়ে দিল। বিড়ালটা এতক্ষণ ওর পায়ে গা ঘষছিল।

‘এখন আমরা জানি জয়েস ক্যাথিকে আঁচড়ায়নি।’ নিলের মুখের চেহারায় অবাক দৃষ্টি ফুটতে দেখল। ‘এমার দ্বীপের ম্যানগ্রোভ গাছপালার খোঁচায় ওর দু’পা ছড়ে গিয়েছিল, অথচ ও জয়েস বেচারীর ওপর দোষ চাপায়।’

‘কারও কেবিনে চুরি করে ঢোকা ক্যাম্প রুলের পরিপন্থী,’ এমা কঠোর গলায় জো ইলিয়টকে বলল। ‘আপনাকে আমরা এখানে আর কখনও স্বাগত জানাব না।’

‘আমি দুঃখিত,’ মৃদুস্বরে বলল জো। স্ত্রীর দিকে চাইল এবং দু’জনেই ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা দিল কেবিন অভিমুখে। কাঁধ নুয়ে পড়েছে ওদের।

‘খাইছে, ওরা আসলে মাঝেমধ্যে আমাদের সাথে বন্ধুর মত আচরণ করত আমরা ডুবে থাকা কোন গুপ্তধনের খোঁজ জানি কিনা জানার জন্যে,’ বলল মুসা।

হাই চাপল ডন।

‘বিশ্বাসই হচ্ছে না রহস্যটার কিনারা হয়েছে,’ ঘুমজড়িত গলায় বলল।

‘এবং একদম সময়মত,’ বলল মুসা। হাতঘড়ি দেখল। ‘জ্যাক নানা আর ক’ঘণ্টা পরেই চলে আসবেন আমাদেরকে নিতে।’

‘তোমাদেরকে অনেক ধন্যবাদ, ছেলে-মেয়েরা,’ বললেন নিল। ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে প্রত্যেকের সঙ্গে হাত মেলালেন। ‘তোমরা না থাকলে, ক্যাথি হয়তো অন্য কোথাও, অন্য কোন কোরাল বেডে তার দুষ্কর্ম চালাত। ওকে ধরতে ধরতে হয়তো কয়েক মাস, এমনকী কয়েক বছর লেগে যেত।’

‘যাক, চোর শেষমেশ ধরা তো পড়েছে,’ বলল কিশোর। চাইল ডনের দিকে। ওর গায়ে হেলান দিয়ে রয়েছে, ঘুমে চোখ বুজে আসছে ছেলেটার। ‘এখন ঘরে যাওয়ার পালা। ডন ঘুমিয়ে পড়ছে এখানে বসেই।’

‘না, আমি জেগে আছি,’ ঘুমকাতুরে গলায় প্রতিবাদ জানাল ডন। কিশোর যখন কোলে তুলে নিল, ও তখন তলিয়ে গেছে ঘুমের রাজ্যে।

‘গুড নাইট,’ কোমলকণ্ঠে বলল এমা। ‘সকালে তোমরা যাওয়ার আগে দেখা হবে। একসাথে নাস্তা করব আমরা।’

.

পরদিন। রোদ ঝলমলে সকালে হাজির হলেন জ্যাক নানা। একে- একে সবাইকে আলিঙ্গন করলেন। ক্যাম্পের প্রবেশদ্বারের পাশে মালপত্র নিয়ে অপেক্ষা করছিল ওরা।

‘অনেক মজা হয়েছে, নানা,’ বলল রবিন। ‘আমরা পানিতে অনেক সময় কাটিয়েছি।’

‘কিন্তু ডন কোথায়?’ জ্যাক নানা চারধারে চোখ বুলিয়ে প্রশ্ন করলেন। ‘ওকে দেখছি না যে!’

‘এখানেই আছে,’ রহস্য করে বলল মুসা। ‘সৈকতে গেছে। আপনাকে একটা জিনিস দেখাতে চায়। আসুন, আপনাকে নিয়ে যাই।’ জ্যাক নানার হাত ধরল।

‘চলো,’ খোশমেজাজে বললেন জ্যাক নানা। ওদেরকে বেশ ক’দিন পর দেখে মহাখুশি হয়েছেন।

‘আপনার ট্রিপটা কেমন হলো, নানা?’ বলল কিশোর।

‘খুব ভাল। বেশ অনেকদিন পর ছুটি কাটালাম। খানিকটা সেইলিং করেছি আর-’ সাগরতীরে পৌঁছতেই কথা বন্ধ হয়ে গেল তাঁর। ‘আরি! ওটা ডন নাকি?’

‘হ্যাঁ, ডনই তো!’ গর্বের সঙ্গে বলল রবিন।

ছোট্ট এক অবয়বকে উজ্জ্বল লাল রঙের এক উইণ্ড-সার্ফারে চেপে তরতরিয়ে পানি কেটে ছুটতে দেখছে সবাই।

শ্বাসের নিচে শিস দিল কিশোর।

‘ভাল রপ্ত করেছে পিচ্চিটা,’ তারিফ করে বলল। ‘তাই না, নানা?’

‘নিঃসন্দেহে,’ বললেন জ্যাক নানা। ডন তীরের উদ্দেশে এঁকেবেঁকে এগোলে হাত নাড়লেন ওর দিকে। ‘তা ও যখন উইণ্ড- সার্ফিং শিখছে আমার অন্য নাতি-নাতনীরা তখন কী করেছে? বিশেষ কিছু ঘটেছে নাকি এখানে?’

মুসা আর রবিন চোখাচোখি করে সশব্দে হেসে উঠল।

‘ঘটেছে, নানা। আমরা আরেকটা রহস্যের সমাধান করেছি!’ বলল রবিন।

‘তাই নাকি? বল-বল!’ ডনকে বেলাভূমি মাড়িয়ে তাঁর দিকে ছুটে আসতে দেখে বললেন জ্যাক নানা

‘অনেক সময় লাগবে, নানা,’ বলল সু কি। ‘সে লম্বা গল্প।’ জ্যাক নানা ডনকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিলেন।

‘অসুবিধে নেই,’ বলে, গাড়ির দিকে চললেন। ‘মায়ামি এয়ারপোর্ট লম্বা সফর। তবে আমি জানি, তোমাদের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শুনতে-শুনতে সময়টা স্রেফ উড়ে যাবে!’

***