রহস্যময় দুর্গ – ১২

বারো

ছোট্ট বিমানটা কাত হতেই, পেটের ভেতর মুচড়ে উঠল কিশোরের।

ক’মুহূর্ত কাত হয়ে উড়ল বিমানটা, একটা ডানা নিচের খরস্রোতা নীল রঙের নদী বরাবর তাক করা। এবার আচমকা পাল্টি খেয়ে স্রেফ উল্টে গেল ওটা।

‘আর দেখা সম্ভব নয়,’ দু’হাতে মুখ ঢেকে গুঙিয়ে উঠল টিনা।

বিমানটা সোজা হলো এবার, তারপর সংকীর্ণ এক ক্যানিয়নে সাঁ করে ঢুকে পড়ে, ফেনিল সাদা পানির ওপর ভাসতে লাগল।

‘উতরাইগুলো,’ বলে উঠলেন স্যর ডয়েল। ‘ঠিক যেমনটা তোমাদেরকে কথা দিয়েছিলাম।’

হেসে উঠলেন টম মামা।

‘তোমাদের র‍্যাপিড দেখার শখ মিটে গেছে নিশ্চয়ই?’

‘হ্যাঁ,’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।

এখন পানির ওপরে নিচু হয়ে উড়ছে বিমানটা, পরমুহূর্তে এক লোকের ইয়াবড় এক ছবি ভেসে উঠতেই পাল্টে গেল দৃশ্যপট। ভদ্রলোক প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে জীবন যাপনের কথা বলতেই, কপাল মুছে সিটে হেলান দিয়ে বসল কিশোর; ইতোমধ্যেই যথেষ্ট রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা হয়েছে ওর-আর দরকার নেই।

দ্য ওয়ার্ল্ড অভ নেচার ছবিটি শেষ হলো এবং জ্বলে উঠল বাতিগুলো। মুচকি হাসলেন স্যর ডয়েল।

‘কী, কেমন লাগল?’

‘দারুণ, এটা কি সত্যিই পৃথিবীর সবচাইতে বড় পর্দাগুলোর একটা?’ শুধাল কিশোর

‘তা-ই তো বলে ওরা। আমি সবসময় এই অন্টারিও প্লেস-এ শো দেখি, তবে বলতে দ্বিধা নেই, লণ্ডনে সিনেমা দেখার মজাই আলাদা।’

‘ব্রিটেন কেমন, স্যর ডয়েল?’ টিনা জিজ্ঞেস করল।

‘অসাধারণ। তোমাদেরকে কোন একসময় বেড়াতে নিয়ে যাব। ওখানেও নিশ্চয়ই সমাধানের জন্যে কোন না কোন রহস্য পেয়ে যাবে তোমরা।’

ক’মিনিট পরে, দলটা থিয়েটার ছেড়ে বেরিয়ে এসে অন্টারিও প্লেসে ঘুরে বেড়াতে লাগল। স্যর ডয়েল হীরে উদ্ধারের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে তাঁর দুর্গে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। জিম লেকার ও তাঁর স্ত্রীও যোগ দিয়েছেন পার্টিতে।

‘কারও খিদে পেয়েছে?’ প্রশ্ন করলেন স্যর ডয়েল, সবাইকে পেছনে নিয়ে এক চাইনিজ টেক-আউট স্ট্যাণ্ডের উদ্দেশে চললেন।

একটু পরে, একগাদা চপ সুয়ে আর এগ রোল নিয়ে কটা বেঞ্চি খুঁজে নিল ওরা। এখানে বসে লেগুনের মোহনীয় দৃশ্য দেখতে পাবে, সঙ্গে ভাসমান ব্যাণ্ডের শো, পেডাল বোট আর অন্যান্য জলযান তো রয়েছেই।

‘অসম্ভব,’ ওর ফরচুন কুকির মেসেজটা পড়ে বলে উঠল টিনা। ‘এগুলো কেউ বিশ্বাস করে?’

‘কী লিখেছে?’

‘শীঘ্রি সুদর্শন এক অচেনা তরুণকে দেখে নাকি আমার মাথা বিগড়ে যাবে।’

মৃদু হাসলেন টম মামা।

‘টিনা ঠাণ্ডা মাথার শান্ত-শিষ্ট মেয়ে। ওর মাথা বিগড়ালে আমি খুশিই হব।’

চপস্টিল্স্ দিয়ে এক সুইট-অ্যাণ্ড-সাওয়ার স্পেয়াররিব তুললেন জন, কিন্তু কাঠি থেকে হড়কে পড়ে লাল সস মেখে গেল তাঁর সাদা শার্টে।

‘আমার পরের আণ্ডারকভার অ্যাসাইনমেন্টটার আগেই ভালভাবে চপস্টিকসের ব্যবহার শিখতে হবে দেখছি।’ শী

‘কী সেটা?’ কিশোরের ব্যগ্র প্রশ্ন।

স্মিত হাসলেন জন।

‘গোপনীয় ব্যাপার, তবে এটুকু বলতে পারি ওখানে আমি আর খানসামা সাজছি না।’

‘কাসা লোমার আসল খানসামার কী হয়েছিল বলবেন?’

‘হ্যাঁ। পুলিসের অনুরোধে ছুটিতে যায় ও, আর আমি তার বদলে কাজে ঢুকি স্যর ডয়েলের অন্তর্ধানের তদন্ত করতে। যদ্দূর জানি, শীঘ্রি কাসা লোমায় ফিরবে সে, সাথে বেচারা গারফিল্ড সহ অন্য কাজের লোকেরাও। আশা করি চাকরিটা ফিরে পাবে ও।’

টম মামা চাইলেন জনের দিকে।

‘আমি এখনও জানি না কেন আপনি ওদিন হঠাৎ করে কাজ ছাড়লেন, আমাকে বিপদে ফেলে ওভাবে চলে গেলেন।’ … জন আবারও চপস্টিকস্ কায়দা করার চেষ্টা করলেন এবং আরও খানিকটা সস চলকে পড়ল তাঁর শার্টে 1

‘স্যর ডয়েলের ডেস্কে খুঁজে পাওয়া হীরেগুলো আপনি আমাকে দেখিয়েছিলেন মনে পড়ে? আপনি পিঠ ফেরাতেই, আমি ওগুলোর হার্ডনেস পরখ করে বুঝে ফেলি একদম নকল মাল। এর মানে দুর্গ থেকে আগেই আসল হীরে সরানো হয়েছিল।’

‘কিন্তু আপনি চাকরি ছাড়লেন কেন?’

‘আমার প্রধান সন্দেহভাজন ফ্রেডি ব্রাউনকে ধোঁকা দিতে। বুঝতেই পারছেন, নকল হীরের কথা আপনাকে বলা সম্ভব ছিল না, কারণ ফ্রেডি জেনে গেলে গা ঢাকা দিত। পুলিস চেয়েছে ফ্রেডি যেন ভাবে তার পরিকল্পনা সফল হয়েছে, আমরা যাতে সীমান্ত পেরনোর সময় হীরে সহ ওকে হাতেনাতে পাকড়াতে পারি।’

‘কিন্তু খবরটা তো কাগজে এসে যায়।’

মাথা ঝাঁকালেন জন।

‘কিন্তু আমরা যে ফ্রেডি ব্রাউনকে অনুসরণ করছি ওটা জানাজানি হয়নি, দু’জন আমেরিকানের কথাই শুধু লিখেছে পেপারে।’

লাল হয়ে গেল কিশোর।

‘তারপর তো আমি নায়াগ্রা ফলসের সুড়ঙ্গে আপনাকে দেখি।’

হো-হো করে হেসে উঠলেন জন।

‘আমি সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আমেরিকান পুলিসের সাথে যোগ দিতে ধেয়ে যাওয়ার আগেই, তোমাদের মোটরবোট জলপ্রপাতের দিকে এগোতে থাকে। কল্পনা করো তখন কী ভয়ঙ্কর অনুভূতি হয়েছে আমার!’

‘যাক, সব কিছু ভালয় ভালয় শেষ হয়েছে।’

‘সব ভাল যার শেষ ভাল,’ বলল টিনা।

এসময় হাঁসের একটা ঝাঁক হড়কে পানিতে নামল। কিশোর ওগুলোর উদ্দেশে খানিকটা চাউমিন ছুঁড়ল। এবার ওরা দলবেঁধে ওয়াটারফ্লাইডের উদ্দেশে হাঁটা ধরল, আনন্দমুখর বাচ্চারা ওখানে লম্বা-লম্বা প্লাস্টিকের শুটে চেপে সড়সড় করে নেমে এসে ঝাঁপাচ্ছে পুলের পানিতে।

‘কাসা লোমা দুর্গে,’ বললেন জন, ‘ফ্রেডি দুই বদমাশকে শোফার আর কামারের কাজ দেয়।’

‘জানেন, আমার না আগেই বোঝা উচিত ছিল ফ্রেডি আর রেজিনা যে ওদের গোপন বস।’ বলল কিশোর।

‘কেন?’

‘ফোর্ট ইয়র্কে আমি রেজিনার হুইলচেয়ারের চাকার দাগ দেখেছি, তারপর ওই একই ছাপ দেখি আমাকে যে কেবিনটায় বন্দি করেছিল তার ড্রাইভওয়েতে। গাঁয়ের রাস্তার ফোন বুথটায় আরেকটা সূত্র পাই আমি, ভ্যানের ড্রাইভার যখন আমাকে দেখেও ধাওয়া দিল না। দেবে কী করে, ড্রাইভারটা তো ছিল রেজিনা, পা নেই যে।’

‘কিন্তু ফ্রেডির ব্যাপারটা?’

‘প্রথমটায় বুঝিনি স্ট্রিটকারে ওরা আমাকে ধরল কেন,’ ব্যাখ্যা করল কিশোর। ‘তারপর ওই কামারটা জানতে চাইল হীরে কোথায় লুকানো আছে। ও ব্যাপারে আমার অনুমানের কথা কে বলতে পারে ওকে? মাত্র তিনজন মানুষ জানত আমার একটা থিয়োরি আছে।’

মিসেস লেকার স্মিত হাসলেন।

‘আমার স্বামী আর আমি হলাম তাদের দু’জন।’

মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

‘এবং তৃতীয়জন হলো ফ্রেডি।’

‘কিন্তু আমরা আমেরিকান, ফ্রেডি আর রেজিনার মতই। আমরা অপরাধী নই বুঝলে কীভাবে?’

‘দুটো বড় কারণ আছে, মিসেস লেকার। প্রথম কারণ, আমাকে স্ট্রিটকারে তোলার ব্যবস্থা তোলার ব্যবস্থা করেছিল ফ্রেডি। কিডন্যাপিঙের জন্যে মুখে তুলে দিয়েছিল শয়তানদের।’

‘আর দ্বিতীয় কারণ?’

‘স্টাডি থেকে গারফিল্ড উধাও হওয়ার পর, ফ্রেডি বলেছিল পুলিসকে জানাবে। কিন্তু পুলিস আর আসেনি-ফ্রেডি চায়নি তারা দুর্গে এসে ছোঁক ছোঁক করুক।’

মাথা ঝাঁকালেন জন।

‘ফ্রেডি আর রেজিনা ভেবেছিল ওরা সব দিক সামলাতে পেরেছে, কিন্তু চোরের সাত দিন আর গৃহস্থের এক দিন।’

‘আহা, বেচারা ফ্রেডি, বলল টিনা। ‘এত সাধের দামি-দামি ড্রেস ছেড়ে কিনা জেলের মার্কা মারা ডোরাকাটা কাপড় পরতে হবে।’

এমনিসময়, বাচ্চাদের দূরাগত জোরাল চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ কানে এল ওদের। ওয়াটার ওয়স্ এরিয়া আর ফোম সোয়াম্পে উদ্দাম যুদ্ধ দেখতে থামল ওরা। এবার দূর থেকে আরও জোরে হই-হল্লার আওয়াজ পেল।

‘এত শব্দ কীসের?’ টিনা জিজ্ঞেস করল।

ভ্রূ কোঁচকালেন স্যর ডয়েল।

‘মঞ্চ থেকে আসছে, ওখানে ওপেন-এয়ার শো করে ওরা, কিন্তু ঘটনা কী বুঝলাম না। টরণ্টো সিম্ফনিকে ওখানে যখন দেখি তখন তো কাউকে এমন ষাঁড়ের মতন চেঁচাতে শুনিনি।’

‘চলুন, দেখে আসি!’ প্রস্তাব করল টিনা।

শোরগোল লক্ষ্য করে ব্যস্তসমস্ত হয়ে এগোল সবাই, দেখল মঞ্চ ঘিরে পুলিস কর্মকর্তারা রীতিমত গলদঘর্ম, হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হাজারো কিশোরী-তরুণীকে তরুণ এক গায়কের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে। ‘

‘এলাহী কারবার,’ বলল টিনা। ‘এটা রক কনসার্ট। মেয়েগুলোর কাণ্ড দেখুন, একটা মেধাহীন মাকাল ফলের জন্যে কেমন পাগলামি করছে!’

‘নতুন গায়ক মনে হচ্ছে, বলল কিশোর। ‘আগে তো এর নাম শুনিনি।’

‘নামটা জানলে কীভাবে?’

‘সাইনে লেখা আছে। রনি অ্যাডাম্‌স্।’

‘ক্বী?! রনি অ্যাডাম্স! ঠিক বলছ তো? ঠাট্টা করছ না তো?’

‘না। নিজেই পড়ো না সাইনটা।’

গা কেঁপে উঠল টিনার।

‘এটা সত্যিই রনি অ্যাডাম্‌স্‌! কেউ আমাকে আগে বলেনি কেন?’

হাসলেন টম মামা।

‘তুই না বললি ও একটা মেধাহীন মাকাল ফল?’

‘দেখো, মামা, ওকে নিয়ে এমন বাজে কথা আর বলবে না! ওর চেয়ে নিখুঁত কোন প্রাণী পৃথিবীতে আর জন্মায়নি, বুঝলে? ইস, ও এখানে আমি ভাবতেই পারছি না!’ এবার এক দৌড়ে উন্মত্ত ভক্তদের ভিড়ে মিশে গেল টিনা।

না হেসে পারলেন না স্যর ডয়েল।

‘ফরচুন কুকিটা তো দেখছি ঠিকই বলেছিল। অচেনা এক সুদর্শন তরুণ টিনার মাথাটা খেয়েছে, তবে আমি শিয়োর টিকে যাবে ও। মানে, ওই হেঁড়ে গলার চেঁচানি শোনার পরও ওর কানের পর্দা অক্ষত থাকবে আশা করি!’

‘বুঝলেন,’ বললেন জন, ‘ওই কামার ব্যাটা আস্তাবলে আপনাকে রনি অ্যাডামসের গান শোনালে আর দেখতে হত না! আমি নিশ্চিত আপনি গড়গড়িয়ে হীরেগুলো কোথায় রেখেছেন সব বলে দিতেন।’

স্মিত হাসলেন স্যর ডয়েল।

‘তা যা বলেছেন। সব মানুষেরই তো সহ্যের একটা সীমা থাকে।’

তাঁকে চিন্তামগ্ন দৃষ্টিতে দেখলেন ক্যাথরিন।

‘আমি আপনার সাহসের প্রশংসা করি, স্যর ডয়েল। আপনি খুব ভালভাবে ওই বদমাশগুলোকে সামলেছেন।’

‘মাই ডিয়ার, একই সমান প্রশংসা তো আপনারও প্রাপ্য। এখন অন্যদেরকে বলতে পারি পুরো ঘটনাটায় আপনার গোপন ভূমিকার কথা?’

ক্যাথরিন মাথা ঝাঁকালেন, এবার অপ্রতিভ দৃষ্টিতে চাইলেন টম মামার দিকে।

‘ক্ষমা চাই, কাসা লোমার কাজের লোক হিসেবে আপনার কাছে মিথ্যে পরিচয় দেয়ার জন্য। আমাকে জোরালভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল কারও কাছে নিজের পরিচয় ফাঁস করা যাবে না, এমনকী আপনার কাছেও না।’

‘তারমানে আপনি কাজের লোক নন? ‘

মাথা নাড়লেন ক্যাথরিন।

‘আমিও একজন মাউন্টি, এবং জনের মত আমিও দুর্গে আণ্ডারকভার ইনভেস্টিগেটর হিসেবে দায়িত্বে ছিলাম।’

মুহূর্তের নীরবতা, এবার টম মামা বিস্ময় আর আনন্দের মিশ্র হাসি হেসে উঠলেন।

‘আমাকে একদম বুদ্ধু বানিয়েছেন আপনি! ভীষণ অবাক হয়েছিলাম আপনি যখন বিদায়টুকুও না নিয়ে কাসা লোমা ছেড়ে চলে গেলেন।’

‘আমারও খুব খারাপ লেগেছিল, কিন্তু কী করব বলুন, আপনাকে কারণটা জানানোর কোন উপায় ছিল না। যাদের পেছনে লেগেছি তাদেরকে কোনমতেই সত্যিটা জানতে দেয়া যেত না যে।’

‘তারা কারা ছিল?’

‘কামার আর শোফার। জেনে খুশি হবেন আজ সকালে গ্রেপ্তার করা হয়েছে দুটোকেই।’

ক্যাথরিনের উদ্দেশে উষ্ণ হাসলেন টম মামা।

‘আপনি সত্যিই অসাধারণ এক মহিলা! আজ রাতে আমার সাথে ডিনার করবেন?’

‘খুশি মনে।

সন্তুষ্ট দেখাল টম মামাকে, চোখ টিপলেন তিনি কিশোরের দিকে চেয়ে।

‘আমরা উইনিপেগে ফেরার পর, আমাদের সাথে কী-কী ঘটেছে কেউই বিশ্বাস করবে না। বিশেষ করে কেউ যদি জেনে ফেলে সবশেষে আমি এক সুন্দরী মাউন্টির সাথে ডেটিং করেছি!’

হেসে ফেলল কিশোর।

‘চিন্তা করবেন না, মামা, কেউ জানবে না। আপনার গোপন কথা গোপনই থাকবে।’

***