গোপন সৈকতে – ১

এক

ফ্লোরিডার কি ওয়েস্টের উদ্দেশে ছুটে চলেছে রেন্টাল কারটা। জ্যাক নানা আর কিশোরের মাঝে সামনের সিটে চাপাচাপি করে বসে রয়েছে মুসা।

‘আমরা কি প্রায় পৌছে গেছি?’ প্রশ্ন করল ও।

‘এইমাত্র কি লার্গো ফেলে এলাম,’ জ্যাক নানা বললেন, ‘আরও ধরো ঘণ্টা দুয়েক লাগবে।’

‘আরও অনেকগুলো কি পেরোতে হবে আমাদের,’ পেছনের সিট থেকে বলল রবিন। ‘শুগারলোফ কি, ঈগল কি, বিগ পাইন কি…’ সু কির কোলের ওপর বিছানো ম্যাপটা দেখে বলে গেল ও। ‘খাইছে, ক্যাম্প কোরালে সময়মত পৌঁছে ডিনারটা ধরতে পারলেই হয়,’ বলল মুসা।

‘নামগুলো কী সুন্দর না?’ সু কি বলল। জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে দেখল সরু ফিতের মত মহাসড়কটিকে ছুঁয়েছে সাগরের আসমানী রঙের পানি। নীলচে-সবুজ আটলান্টিক মহাসাগর ওদের বাঁয়ে আর ডানে গাল্‌ফ্ অভ মেক্সিকো।

‘তোমার নামের মধ্যেও তো কি আছে,’ সু কিকে বলল ডন। শুনে হেসে ফেলল সবাই। ‘তুমি আসায় না খুব ভাল হয়েছে!’

‘আমারও ভাল লাগছে,’ বলল সু কি। ও সাত বছরের এক কোরিয়ান মেয়ে। জ্যাক নানার প্রতিবেশী রবিনসন দম্পতি দত্তক নিয়েছেন ওকে। তাঁদের অনুমতি নিয়েই সঙ্গে করে বেড়াতে আনা হয়েছে সু কিকে। তিন গোয়েন্দা আর ডনের সঙ্গে ভাল খাতির জমেছে মেয়েটির।

‘ক্যাম্প কোরালে আমরা অনেক দ্বীপ আর কি দেখব মনে হচ্ছে,’ বলল রবিন। ‘ওদের মোট চোদ্দটা নৌকা, আর আমরা রোজই নৌকায় চড়ে ঘুরতে পারব।’ ক্যাম্প-হ্যাণ্ডবুকের আদ্যোপান্ত পড়ে নিয়েছে নথি গবেষক রবিন।

‘আমিও পানিতে সময় কাটাব ইচ্ছেমত,’ খোশমেজাজে বললেন জ্যাক নানা। ‘ডেভিড মাছ ধরতে ভালবাসে। নীল মার্লিন আর স্যাপার ধরার ইচ্ছে আছে ওর সাথে। জ্যাক নানা ওদেরকে আগেই বলে রেখেছেন ওরা যখন ক্যাম্পে থাকবে তখন তিনি তাঁর বন্ধুর সঙ্গে আপার ম্যাটেকাম্ব কি-তে দেখা করতে যাবেন।

‘তারমানে আপনার সময়টাও খুব ভাল কাটবে, নানা,’ বলল মুসা।

মাথা ঝাঁকালেন জ্যাক নানা।

শেষ বিকেলে, ছোট, সবুজ এক সাইন চোখে পড়ল কিশোরের।

‘ওই যে,’ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল। ‘নানা, মোড় নিয়ে ক্যাম্প কোরালে ঢুকতে হবে।’ মহাসড়ক ছেড়ে সরু এক মেটে রাস্তায় পড়ল গাড়ি। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জঙ্গলের ম্যানগ্রোভ গাছপালা আর পাম গাছের সারি দু’পাশ থেকে ঘিরে রেখেছে পথটিকে। হঠাৎই আকাশে উড়ে উঠল একজোড়া সাদা হেরন, এবং ছোট্ট এক হরিণ আড়াআড়ি রাস্তা পেরিয়ে তীরবেগে ছুটে ঢুকে পড়ল বনের ভেতরে।

ক’মিনিট পরে, মহাসাগরের সুনীল জলরাশির কোল ঘেঁষে দাঁড়ানো এক সার সাদা স্টাকো বিল্ডিঙের কাছে পৌঁছল ওরা। বিশাল দুই পাম গাছ জুড়ে জেলে পল্লীর অনুকরণে ফ্রেমবন্দি এক সাইন লটকানো: ক্যাম্প কোরালে স্বাগতম। ওটার এক কোনা থেকে ঝুলছে জেলেদের জাল, এবং শব্দগুলো লেখা হয়েছে এক মোটা দড়ির কুণ্ডলী দিয়ে।

‘এসে পড়েছি!’ চিৎকার ছাড়ল ডন। জ্যাক নানা পার্কিং লটে ঢুকতেই, হাঁচড়ে পাঁচড়ে গাড়ি থেকে বেরোল ও। রবিন আর সু কিও দেরি করল না ওর পিছু নিতে।

‘ঠিক যেমনটা কল্পনা করেছিলাম,’ বলল মুসা, ট্রাঙ্ক থেকে লটবহর বের করতে সাহায্য করার জন্য উল্টো ঘুরল। তীর বরাবর একদল ক্যাম্পার বৈঠা মেরে কায়াক চালাচ্ছে, এবং ওয়েটসুট পরা দুই কমবয়সী মেয়ে হেঁটে গেল। গগল্স্ আর ফ্লিপার দেখা গেল ওদের কাছে, এবং মেয়েদের একজন হাত নাড়ল ওদের উদ্দেশে।

‘ওরা অমন ড্রেস পরেছে কেন?’ কৌতূহলী ডন প্রশ্ন করল।

‘ওরা সম্ভবত স্নরকেলিং করতে যাচ্ছে,’ জ্যাক নানা বললেন। অথবা এমনকী হয়তো স্কুবা ডাইভিং। এই ক্যাম্পে দুটোই শেখানো হয়।’

‘শুধু তা-ই নয়। আমরা আরও অনেক কিছুই শেখাই,’ এক যুবতী বলল, হেঁটে এল ওদের দিকে। তার পরনে কাট-অফ শর্টস্ আর বুকে স্টাফ লেখা লাল টকটকে টি-শার্ট।

‘আমি এমা, অ্যাকটিভিটি ডিরেক্টর,’ জানাল, হাত বাড়াল জ্যাক নানার উদ্দেশে। ‘আপনি নিশ্চয়ই মিস্টার হিগিন্স?’

জ্যাক নানা করমর্দন করে সবার সঙ্গে এমার পরিচয় করালেন। হঠাৎই জোরাল ঘেউ-ঘেউ শব্দে চমকে ঘুরে দাঁড়াল এমা।

‘উপ্‌স্‌,’ বলল ও, হাত নামিয়ে এক বন্ধুভাবাপন্ন কোলি কুকুরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ‘জিমির সাথে পরিচয় করাতে ভুলে গেছি। ও ক্যাম্প মাসকট।’

‘আমাদের কিশোরভাইও কুকুর পোষে,’ বলল ডন। ‘ওর নাম বাঘা।’

তা এমা মৃদু হাসল ওর দিকে চেয়ে।

‘তাহলে তোমাকে আমি বিশেষ এক অ্যাসাইনমেন্ট দেব, ডন। রোজ ডিনারের পর তুমি জিমিকে ওর ডগি ট্রিট দেবে। কী, করবে কাজটা?’

‘সে আর বলতে!’

‘নানার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নাও, তোমাদেরকে কেবিনে পৌঁছে দেব।’ গাড়ির পাশ থেকে ডাফেল ব্যাগগুলোর একটা তুলে নিল সে।

‘ভাল থেকো, বাচ্চারা,’ বললেন জ্যাক নানা, একে-একে সবাইকে জড়িয়ে ধরলেন। ‘এনজয় করো, আগামী সপ্তাহে দেখা হবে।’

‘ভাল থাকবেন, নানা,’ বলল রবিন, খানিকটা বিষণ্ণ শোনাল ওর কণ্ঠস্বর।

‘খাইছে, আপনাকে খুব মিস করব!’ বলল মুসা।

জ্যাক নানা গাড়িতে উঠে ইঞ্জিন চালু করলেন। মেটে রাস্তাটির বাঁক ঘুরে নীল গাড়িটা দৃষ্টিসীমার আড়ালে না যাওয়া অবধি হাত নাড়ল ছেলে-মেয়েরা।

‘সবাই রেডি?’ প্রশ্ন করল এমা, ‘ছেলেদের কেবিন ডানে, আর মেয়েদেরগুলো সোজা নাক বরাবর।’ লম্বা, সাদা এক বাড়ির উদ্দেশে ওর পিছু নিয়ে হেঁটে চলল ছেলে-মেয়েরা। অবশেষে দরজায় টোকা দিল এমা। পরমুহূর্তে, সারবাঁধা সাদা বাঙ্ক বেড নিয়ে সাজানো মন-খুশি-করা এক কামরায় পা রাখল ওরা। হাতে বোনা এক গালিচা পাতা মেঝেতে এবং জানালায় উড়ছে মসলিনের ফিনফিনে পর্দা। ‘কেউ নেই এমুহূর্তে। সবাই খুব সম্ভব ক্লাসে কিংবা কোন অ্যাকটিভিটিতে আছে।’

‘ক্লাস?’ প্রশ্ন করল বিস্মিত ডন। ‘আমি তো ভেবেছিলাম এটা একটা ক্যাম্প।’

হেসে উঠল এমা।

‘মাঝে-মাঝে কোন কাজ করার আগে তা শিখে নিতে হয়। কিশোর আর ডনকে দুটো ফাঁকা বেডে ব্যাকপ্যাক আনলোড করতে সাহায্য করল। তারপর জানালার দিকে তর্জনী দেখাল। ‘বাইরে তাকিয়ে দেখো।’

মুসা একপাশে পর্দা সরিয়ে বাইরে চাইল। ছোট এক ছেলে ঝলমলে নীল পানির ওপরে উইণ্ড-সার্ফিং করছে। বোর্ডের ওপর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ভারসাম্য ঠিক রাখছে ও, সেইলগুলো স্বচ্ছন্দে নিয়ন্ত্রণ করছে।

‘খাইছে, খুব মজার ব্যাপার মনে হচ্ছে। আমরা সার্ফিং করব না?’ বলল মুসা।

‘হ্যাঁ, তবে তার আগে শিখতে হবে নিরাপদে কীভাবে কাজটা করতে হয়,’ এমা জানাল। ‘সেজন্যেই ক্লাসে যাওয়ার কথা বলেছি। ডাঙায় প্র্যাকটিস করতে হবে আগে।’

‘ডাঙায়?’ নাক কোঁচকাল ডন। ‘ওভাবে তো বেশি দূর যাওয়া যাবে না।’

‘তা ঠিক। তবে পড়ে গেলে, বালির ওপর পড়বে।’ ডনের মাথার চুল এলোমেলো করে দিল এমা। ‘আমাদের বিশেষ এক উইণ্ড-সার্ফিং সিমুলেটর আছে, ডন, তাতে তোমার মনে হবে বুঝি পানিতেই আছ। প্র্যাকটিস করার জন্যে দারুণ কাজের জিনিসটা।’

‘ঝুঁকিমুক্ত,’ বলল কিশোর।

‘একদম।’ দরজার উদ্দেশে পা বাড়াল এমা। ‘যাই, ওদেরকে কেবিনে পৌঁছে দিই।’

ক’মিনিট পরে, রবিন, মুসা আর সু কি কিশোরদের মত হুবহু একইরকমের নিখুঁত আরেকটি কেবিনে মালপত্র খালাস করল। সু কি একা থাকতে পারবে না বলে মুসা আর রবিনের সঙ্গেই রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে ওকে।

একটু পরে, রবিন পা আড়াআড়ি ভাঁজ করে বিছানায় বসল, মোটাসোটা এক বুকলেট পড়ছে মন দিয়ে।

‘এই অ্যাকটিভিটি লিস্টটা দেখেছ? সব ধরনের ক্লাসই হয় এখানে-মেরিন সায়েন্স, স্কুবা ডাইভিং, স্নরকেলিং, ক্যানুইং…’

‘খাইছে, এটা দারুণ ইন্টারেস্টিং হবে মনে হচ্ছে,’ বলল মুসা। ওর কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি দিল। ‘আমরা এক আণ্ডারওয়াটার শিপরেকের সাইটে ভিজিট করতে পারি। ডুবে যাওয়া ভাঙা জাহাজটা থেকে হয়তো কোন গুপ্তধন মিলতে পারে।’

‘ওটা তো যারা স্কুবা ডাইভিং জানে তাদের জন্যে,’ বলল নথি। ‘আমাদেরকে সম্ভবত স্নরকেলিং দিয়ে শুরু করতে হবে।’ আরও কিছু বলতে যাবে, এসময় দরজায় জোরে-জোরে টোকার শব্দ হলো।

‘এটা দেখেছ!’ ডন হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল, অ্যাকটিভিটি বুকলেটটা নাড়াচ্ছে। ‘কিশোরভাই আর আমি এরমধ্যেই কোন্‌টা নেব ঠিক করে ফেলেছি,’ জানাল ও। ‘কিশোরভাই আণ্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফি, আর আমি ইকি…ইকি… কী এটা?’ পাশে দাঁড়ানো কিশোরের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চাইল।

‘ইকথিয়োলজি,’ বলে দিল কিশোর।

‘মৎস্যবিজ্ঞান,’ বিড়বিড় করে বলল রবিন।

‘হ্যাঁ,’ বলে, ওর বিছানায় লাফ দিয়ে বসে পড়ল ডন। ‘আমি হাঙরদের সম্পর্কে জানতে চাই।’ বইটার পাতা উল্টাচ্ছে পরম আগ্রহে। ‘এখানে যা-যা আছে সবই দুর্দান্ত। আমরা প্রবাল প্রাচীরের ওপর সাঁতরাতে পারি, ডলফিন আর তিমিদের ব্যাপারে জানতে পারি…’ এবার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বলল, ‘কিন্তু কোটা দিয়ে আরম্ভ করব বুঝতে পারছি না।’

‘আমি বলে দেব,’ বলল এমা। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে অ্যাকটিভিটি ডিরেক্টর, হাতঘড়ি দেখছে। ‘আর তিন মিনিট পরেই, ডিনারের বেল বাজবে। তোমাদেরকে ডাইনিং হল-এ নিয়ে যাব আমি।’

‘ডিনার?’ মুসার উৎসাহ ধরে না। দরজার দিকে তড়িঘড়ি পা বাড়াল।

এমার মুখের চেহারায় বিস্ময়ের অভিব্যক্তি ফুটতে দেখে শব্দ করে হাসল কিশোর আর রবিন।

‘আসলে খাওয়াটাই মুসার সবচাইতে প্রিয় অ্যাকটিভিটি, ব্যাখ্যা করল রবিন।