গোপন সৈকতে – ২

দুই

‘এখন এখানে ত্রিশজনের মত ক্যাম্পার আছে,’ ওরা ক্যাফেটেরিয়ার লাইন ধরে এগোতেই বলল এমা। মুসা ওর প্লেটে স্প্যাগেটি আর মাংসের বড়ার পাহাড় বানিয়ে এখন হাত বাড়াচ্ছে কি লাইম পাইয়ের এক টুকরোর দিকে। ‘বেশিরভাগই ছোটমানুষ, তবে কয়েকজন বড় গেস্টও আছেন।’

‘আমার মনে হয় বড়রাও আমাদের মত মহাসাগর সম্পর্কে জানতে চায়,’ চিন্তামগ্ন সু কি বলল।

‘ঠিক।’ এমা দাঁড়িয়ে পড়ে কামরাটা নিরীখ করল।.’জানালার পাশে বসা দাড়িওয়ালা লম্বা ভদ্রলোককে দেখতে পাচ্ছ? উনি নিল স্যাণ্ডার্স। মেরিন বায়োলজিস্ট। এর মানে হচ্ছে উনি মহাসমুদ্রে যেসব প্রাণী আর গাছপালা জন্মে সেগুলো নিয়ে গবেষণা করেন।’

‘ওঁর সঙ্গে কথা বলা যাবে?’ ডনের আগ্রহ ধরে না। ‘মাছ নিয়ে আমার অনেক প্রশ্ন আছে।’

‘নিশ্চয়ই,’ বলল এমা, টি-শার্ট আর শর্টস্ পরা, রোদে পোড়া ক্যাম্পারদের লম্বা-লম্বা টেবিল পেরিয়ে পথ করে নিল। সুস্বাদু ডিনার উপভোগ করছে তারা। ‘এসো।’

ক’মিনিট পরে, ছেলে-মেয়েরা নিল স্যাণ্ডার্স এবং রিনা আর ‘জো ইলিয়ট নামে এক দম্পতির সঙ্গে এক টেবিলে বসল। চার্টার সেইলিং কোম্পানি চালায় স্বামী-স্ত্রী। নিল স্যাণ্ডার্স অমারিক লোক, তবে ইলিয়ট দম্পতি তেমন মিশুক নয়। ওরা যেন একা থাকতে পারলেই বাঁচে।

এসময় এক লিকলিকে যুবতীকে টেবিলটার দিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল।

‘একজনের জায়গা হবে টেবিলে?’ প্রশ্ন করল। এত দ্রুত কথা বলছে যেন খানিকটা নার্ভাস।

‘অবশ্যই, ক্যাথি,’ বলল এমা। ‘আপনি আমাদের সাথে বসলে খুশিই হব আমরা।’ ছেলে-মেয়েদের দিকে চাইল। ‘ইনি ক্যাথি অ্যালেন। আণ্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফার।’

‘তাই?’ বলে উঠল রবিন। ‘খুব ইন্টারেস্টিং কাজ নিশ্চয়ই!’ গার্লিক ব্রেডে কামড় দিল।

শ্রাগ করল ক্যাথি অ্যালেন।

‘কখনও-কখনও। এক নেচার ম্যাগাজিনের জন্যে আর্টিক্ লিখব বলে এখানে এসেছি। প্রবালের গঠনবিন্যাস নিয়ে কিছু ছবি তুলব।’

‘আমাদের কি-গুলোতে প্রবালের দীর্ঘ বিস্তার রয়েছে জানো তো, ছেলে-মেয়েদেরকে ব্যাখ্যা দিল এমা। ‘প্রাচীরটা একশো আটাশ মাইল লম্বা। ডনের দিকে চাইল। ‘এ সপ্তাহে আমরা যখন গ্লাস-বটম বোট রাইডে যাব তখন এর খানিকটা দেখতে পাবে।’

‘কিশোরভাই, যেসব মাছের কথা পড়েছি সবগুলোকে কি দেখতে পাব?’ জিজ্ঞেস করল ও। জ্যাক নানা ওকে এক মাছের বই কিনে দিয়েছেন, ওখান থেকে রোজ রাতে খানিকটা করে পড়েছে ওরা।

‘অনেকগুলোকেই পাবে,’ জবাবে বলল কিশোর। ‘তোমার প্রিয় কোন্‌টা?’

‘কার-ওয়াশ মাছ,’ ঝটপট জানাল ডন।

‘কার-ওয়াশ মাছ?’ হেসে উঠল এমা। ‘এমন মাছের নাম তো কস্মিনকালেও শুনিনি, যদিও এখানেই সারাজীবন কাটিয়েছি।’

‘বানালাম আরকী,’ বলল ডন। ‘এটা আমাকে গাড়ি পরিষ্কারের কথা মনে করিয়ে দেয়। মাছগুলো সব সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে, আর সুন্দর এই নীল মাছটা ওদের শরীর থেকে ছোট-ছোট পোকা সাফ করে।’

নিল স্যাণ্ডার্সের দিকে চাইল ও। ‘আসল নামটা কী যেন? ভুলে গেছি।’

কেমন অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন ভদ্রলোক।

‘ওটা…নিশ্চয়ই…’ চিবুক চুলকালেন, এবং অসহায় দৃষ্টিতে এমার উদ্দেশে তাকালেন। ‘নামটা মনে পড়ছে না।’

‘তুমি মনে হয় ব্লু অ্যাঞ্জেল ফিশের কথা বলছ,’ ধীরে-ধীরে বলল এমা। কিশোর লক্ষ করল মহিলা খানিকটা অবাক হয়েছে। নিল স্যাণ্ডার্স মেরিন বায়োলজিস্ট, তাঁর তো জানার কথা। তিনি ব্লু অ্যাঞ্জেল ফিশ চেনেন না?

‘আর আমি সিশেল কালেক্ট করতে চাই,’ জানাল ডন। ‘গাদা- গাদা।’

‘খাইছে, আমিও,’ বলল মুসা। ‘গোলাপী আর সাদাগুলো আমার বেশি ভাল লাগে। কানের কাছে ধরা যায়।’

‘ওহ, ওগুলো তো শাঁখ,’ ক্যাথি অ্যালেন বলল। ‘ভুলেও ছুঁয়ো না। ওগুলোকে সরালেই আটশো ডলার জরিমানা।’ বিরক্ত শোনাল তার কণ্ঠস্বর।

‘একটা সিশেল তুললে আটশো ডলার জরিমানা?’ প্রশ্ন করল কিশোর। সন্দিহান ও।

‘উনি ঠিকই বলেছেন,’ এমা বলল। ‘ক্যাম্প কোরালের চারপাশে আমরা পোস্টার লাগিয়েছি সবাইকে সাবধান করার জন্যে। ক্যাম্প থেকে কোন শাঁখ নেয়া নিষেধ।’ কণ্ঠ গম্ভীর ওর। ‘এবং প্রবাল স্পর্শ করাও বারণ, কারণ তোমার হাতের ব্যাকটেরিয়া ওটাকে মেরে ফেলতে পারে।’

‘কিন্তু আমার হাত তো পরিষ্কার!’ বলে উঠল ডন। দু’হাত তুলে দেখাল, মুখে গর্বের হাসি।

‘তা ঠিক, ডন, তবে প্রবাল জন্মাতে হাজার-হাজার বছর লেগে যায়। মানুষের হাতের সামান্য ছোঁয়ায় প্রবালের পুরো স্ট্যাণ্ড ধ্বংস হয়ে যেতে পারে,’ দৃঢ়কণ্ঠে বলল এমা।

.

ডিনারের পর ছেলে-মেয়েরা বেদিং সুট পরে জো, রিনা এবং আরও কয়েকজন ক্যাম্পারের সঙ্গে পানির কিনারায় মিলিত হলো।

তীরে এক নৌকো বাঁধা, এবং এমা সবার হাতে-হাতে প্লাস্টিকের পাত্র বিলি করল।

‘আমরা কি মাছ ধরতে যাব?’ সু কি জানতে চাইল।

‘বলতে পারো। প্রত্যেকে নমুনা কালেক্ট করবে অ্যাকুয়ারিয়ামে রাখার জন্যে। পাত্রে সাগরের পানি ভরে চটপট নৌকায় উঠে পড়ো। রওনা দিয়ে তারপর বাকিটা বলব,’ বলল এমা।

‘কিন্তু আমার তো অ্যাকুয়ারিয়ামই নেই,’ আপত্তি জানাল ডন।

‘আছে তো।’ দাঁত বের করে হাসল এমা। ‘ওশেন স্টাডিয রুমে তোমার নামে একটা অ্যাকুয়ারিয়াম রাখা আছে। আজ সকালেও তো দেখলাম। তোমাদের সবার একটা করে।’

‘আমার নিজের অ্যাকুয়ারিয়াম!’ ডন মহা উত্তেজিত। ‘কী আছে ওটার ভেতর?’

‘নোনা পানি ছাড়া আর কিছু নেই আপাতত। তবে আমি নিশ্চিত আজ রাতে তোমরা অনেক ইন্টারেস্টিং মাছ জোগাড় করে ফেলবে।’

সন্দেহের ছায়া ফুটল মুসার মুখের চেহারায়।

চাক’আমরা যদি ভুল মাছ তুলি?’ প্রশ্ন করল। ‘ওরা একটা যদি আরেকটাকে মেরে ফেলে?’

‘চিন্তা নেই। আমি তো আছি দেখার জন্যে।’ এমা ক্যাম্পারদের নৌকোয় উঠতে সাহায্য করল। এবার নোঙর খুলে এক যুবককে ইশারা করল ইঞ্জিন চালু করতে।

স্ফটিকস্বচ্ছ পানির ওপর দিয়ে তরতর করে এগোল ওরা, এমা যতক্ষণ না ইঞ্জিন বন্ধ করতে বলল।

‘থামো। এখানকার পানি অগভীর,’ বলে, এক লাফে নেমে পড়ল হাঁটু পানিতে। ‘তোমরা এখান থেকে সুন্দর-সুন্দর স্পঞ্জ কালেক্ট করতে পারো, শৈবাল আর সি ফ্যানেরও অভাব নেই।

‘খাইছে, এখানে এটা কী?’ বলে, পানিতে উঁকি দিল মুসা।

‘ওটা সি আর্চিন। নিতে পারো। তোমার পাত্রে ভালই এঁটে যাবে ওটা,’ এমা আশ্বস্ত করল ওকে।

সবার স্পঞ্জ আর সামুদ্রিক ঘাস সংগ্রহ করা হলে, পন্টুন নৌকোটিতে উঠে আরেকটি অগভীর অংশের দিকে চলল ওরা।

‘ওহ, পেয়েছি!’ নৌকো থামতেই বলে উঠল সু কি। সারবাঁধা ম্যানগ্রোভ নিয়ে সৈকত, ওটার কিনারার কাছাকাছি পৌঁছেছে ওরা। ‘তারা মাছ!’

লাফিয়ে পানিতে নামল ও মাছটা সংগ্রহ করতে।

‘আমি একটা হর্সশু কাঁকড়া পেয়েছি,’ বলল কিশোর, হাত ডোবাল পানিতে।

ডন যেই না জাল দিয়ে এক রেইনবো প্যারট ফিশ ধরেছে, অমনি দেখতে পেল বালুময় সাগরের তলদেশ থেকে কিছু একটা তুলে নিল জো ইলিয়ট। জিনিসটা চার্টার ক্যাপ্টেন শার্টের নিচে গুঁজলে অবাক হয়ে গেল ও। লোকটা কি মাছ গুঁজেছে কাপড়ের তলায়? নোনা পানির পাত্রে রাখল না কেন ওটাকে?

ডন কিছু বলতে যাবে, তার আগেই মুসা জানাল ও এক জ্যান্ত শাঁখ খুঁজে পেয়েছে, এবং এমার অনুমতি নিয়ে সযত্নে পাত্রে তুলে রাখল ওটা।

‘ওগুলো নেয়া না বারণ আমাদের?’ রিনা ইলিয়ট প্রতিবাদ জানাল।

‘অ্যাকুয়ারিয়ামে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সব কটা নমুনাই সাগরে ফিরিয়ে দেয়া হয়,’ এমা আশ্বাস দিল ওকে। ‘শাঁখটা কখনওই ক্যাম্প কোরালের বাইরে যাবে না। যেখান থেকে এসেছে ঠিক সেখানেই ফিরে যাবে।’

সূর্য পাটে বসার পর, দলটা ফিরে চলল ক্যাম্প কোরাল অভিমুখে। এমা সবাইকে ট্যাঙ্ক বসাতে সাহায্য করল।

‘এখন খানিকক্ষণের বিরতি,’ বলল সে। ‘তবে বেশি দেরি করবেন না। কাল কিন্তু অনেক আয়োজন আছে।’

‘তোমার অ্যাকুয়ারিয়ামটা খুব সুন্দর, মুসাভাই,’ ক’মিনিট পরে বলল সু কি। মুসা এইমাত্র ওর পাঁচ গ্যালনী ট্যাঙ্কের পেছনদিকের দেয়ালে এক সি ফ্যান সাজিয়েছে। একগাদা লাল শৈবাল আর সামুদ্রিক ঘাসের ওপরে শোভা পাচ্ছে ওর শঙ্খটা।

‘ধন্যবাদ। এমা বলেছে এটা শৈবাল খায়, কাজেই খিদে পেলেই বেরিয়ে আসার কথা।’

‘এমা বলেছে শঙ্খ দেখতে কেমন?’ কিশোর প্রশ্ন করল ওকে। ‘বড়সড় এক বাদামি জিভের মতন!’

যার-যার ট্যাঙ্ক ঠিকঠাক করার পর, পাত্র থেকে সাগরের লবণাক্ত পানি ঢালল ওরা এবং স্টোররুমে সুন্দর করে স্তূপ করে রাখল পাত্রগুলো। ছেলে-মেয়েরা এবার ক্লাসরুম বিল্ডিং ছেড়ে বেরিয়ে এসে, বাইরের টাটকা রাতের বাতাসে বুক ভরে দম নিল। আজ পূর্ণিমা, ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে পাম গাছের সারির মাঝ দিয়ে। ক্যাম্পের ক’জন স্টাফ সৈকতে আগুন জ্বালছে, এবং একজন গিটারের তারে ঝঙ্কার তুলেছে।

‘যাবে ওখানে?’ কিশোর জানতে চাইল।

ডন বড়সড় হাই তুলল আর মুসা চাইল বন্ধুর দিকে

‘ঘরে যাওয়াই ভাল। ডন তো মনে হচ্ছে যে কোন সময় ঘুমে ঢলে পড়বে।’

‘না!’ প্রতিবাদ জানাল ডন। বিছানায় গিয়ে এক মুহূর্তের মজাও মাটি করতে নারাজ ও। আবারও হাই এলে মুখে হাত চাপা দিল।

‘বুঝেছি, ঘরে চলো,’ বলল কিশোর, ডনকে কেবিনের দিকে নিয়ে চলল।

এক ঘণ্টা পরে, বিছানায় শুয়ে ডন নানান কথা ভাবছে। নৌকো ভ্রমণ, মাছ ধরা, বিশেষ করে ও প্যারট ফিশটাকে নিয়ে মহাগর্বিত। আচমকাই ভ্রূ কোঁচকাল ও। কিশোরভাইকে তো বলা হয়নি জো ইলিয়টকে শার্টের তলায় একটা মাছ গুঁজতে দেখেছে! এমন আজব কাণ্ড ও কখনও দেখেনি। ওটা আসলে হয়তো মাছ নয়…কিন্তু কী তাহলে? নিজের প্রশ্নের জবাব পাওয়ার আগেই, ঘুমে তলিয়ে গেল ডন।

ওদিকে, নিজেদের কেবিনে মুসা বিছানায় উঠে বসে ফিসফিস করে বলল, ‘সু কি, জেগে আছ?’

‘হ্যাঁ,’ পাশের বেড থেকে হেসে বলল সু কি। ‘কেন?’

‘খাইছে, এইমাত্র একটা কথা মনে পড়ল। আমার অ্যাকুয়ারিয়ামের ফিল্টারটা কি অন করেছিলাম?’

‘করেছিলে তো,’ ঘুমজড়ানো গলায় বলল রবিন। ‘হুশ করে একটা শব্দ হলো মনে নেই?’

‘না, নেই। শিয়োর হতে পারছি না। ফিল্টার অন না থাকলে পানিতে ঠিকমত অক্সিজেন থাকবে না।’ ঠোঁট কামড়াল ও। যে করব বুঝতে পারছি না।’

‘চলো, গিয়ে দেখে আসি,’ বলল রবিন। ‘নইলে দুশ্চিন্তায় সারা রাত ঘুম হবে না।’

‘আমিও যাব,’ বলল সু কি। আঙরাখার দিকে হাত বাড়াল।

একটু পরে, ঘোরানো পথ ধরে ক্লাসরুম বিল্ডিঙের দিকে চলল তিনজনে। সব কটা বাতি নেভানো, তবে পার্শ্বদরজাটা ভেজানো দেখে হাঁফ ছাড়ল মুসা। বাতির সুইচটা খুঁজে পেতেই, ওটা জ্বেলে হন্তদন্ত হয়ে সোজা অ্যাকুয়ারিয়ামটার কাছে চলে গেল।

‘বলেছিলাম না সব ঠিকই আছে,’ গলা চড়িয়ে বলল রবিন ওর উদ্দেশে। ‘পানিতে বুদ্বুদ দেখছি এখান থেকেই।’

‘খাইছে, সব ঠিক নেই,’ কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল মুসা।

‘কেন, কী হয়েছে?’ প্রশ্ন করল রবিন, সু কিকে নিয়ে হনহন করে বন্ধুর পাশে চলে এল। মুসা নিঃশব্দে তর্জনী দেখাল ওর ট্যাঙ্কের উদ্দেশে।

‘হায়-হায়!’ বলে উঠল সু কি। ‘শঙ্খটা নেই!