গোপন সৈকতে – ৩

তিন

পরদিন সকালে, নাস্তার সময় মুসা চুরির ঘটনাটা এমাকে জানাল। ছেলে-মেয়েরা যে সময়টায় ক্লাসরুম বিল্ডিঙে গিয়েছিল সেটা জেনে মুখের চেহারা গম্ভীর হয়ে গেল ওর।

‘কেউ একজন খুব দ্রুত কাজটা সেরেছে,’ বলল এমা। ‘আমি তার আধ ঘণ্টা আগেই বন্ধ করে দিয়েছিলাম।’ প্লেটটা একপাশে সরিয়ে দিল, খাবার স্পর্শ না করেই। ‘মনে হয় পাশের দরজাটা তালা দিতে ভুলে গিয়েছিলাম,’ বলে, অবিশ্বাসের সঙ্গে মাথা নাড়ল।

‘এত মনমরা কেন? স্ক্র্যাম্বল্‌ড্ এগটা নিশ্চয়ই অতটা বিস্বাদ নয়,’ ঠাট্টা করে বললেন নিল স্যাণ্ডার্স, ওর পাশের চেয়ারটায় বসলেন। তাঁর প্লেটভর্তি প্যানকেক, সঙ্গে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি।

‘কে যেন মুসাভাইয়ের শঙ্খটা অ্যাকুয়ারিয়াম থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে,’ বলল ডন। ‘কাল রাতে।’

‘তাই?’ হাসি মুছে গেল নিলের মুখ থেকে।

‘কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে,’ শান্তস্বরে বলল এমা। ‘আগে কখনওই এমন ঘটনা ঘটেনি।’

রবিন চোখ বুলিয়ে ভিড়ে ঠাসা ক্যাফেটেরিয়াটা দেখে নিল। বিশ্বাস করা কঠিন, চোর এমুহূর্তে সবার সঙ্গে এখানে বসে নাস্তা করছে সাধু বেশে!

এমা লক্ষ করল মুসা মুষড়ে পড়েছে।

‘আজ সকালে আমার সাথে আউটিঙে যাবে তোমরা? আরেকটা শাঁখ পাবে সে নিশ্চয়তা দিতে পারব না, তবে সুন্দর একটা জায়গা দেখাব তোমাদেরকে।’

মুসা আগ্রহী হলো।

‘খাইছে, কোথায় সেটা?’

‘ওটা আমার নিজের গোপন সৈকত,’ গলা খাদে নামিয়ে বলল এমা। ‘বিশেষ ওই জায়গাটার কথা কেউ জানে না।’

’আপনি কিনেছেন ওটা?’ সু কি জিজ্ঞেস করল।

‘কিনিনি,’ মৃদু হেসে বলল এমা। ‘তবে ওখানে যখন পাম গাছের নিচে একা বসে থাকি, মনে হয় সৈকতটা একান্তই আমার! ওটা আমার খুবই প্রিয় জায়গা।’

.

আধ ঘণ্টা পর। ছোট্ট এক পাওয়ারবোটে চড়ে পানি কেটে এগোচ্ছে ছেলে-মেয়েরা। এমা জলযানটিকে খুদে দ্বীপের উদ্দেশে চালনা করতেই উজ্জ্বল সূর্যালোকে চিকচিক করে উঠল সাগরের পানি।

‘আমরা দ্বীপে যাচ্ছি!’ চিৎকার ছাড়ল ডন।

‘কি-তে শত-শত দ্বীপ রয়েছে,’ জানাল এমা। ‘অনেকগুলোর এমনকী নামও নেই। ক’বছর আগে এই দ্বীপটা আবিষ্কার করি আমি। তারপর থেকে ওটা আমার প্রিয় জায়গা।’

দ্বীপে পৌঁছে, মোটর বন্ধ করল এমা এবং আঙুল দেখাল ম্যানগ্রোভ গাছের এক ঘন দঙ্গলের উদ্দেশে।

‘ওখানে পৌঁছতে খানিকটা হাঁটতে হবে কিন্তু।’ ক্যাম্প কোরালের চিহ্ন সহ বড়-বড় বিচ টাওয়েল দিল ও সবাইকে। ‘এগুলো কোমরে পেঁচিয়ে নাও। ঝোপ-ঝাড় খুব ঘন এখানে, ঘষা লেগে ছড়ে যেতে পারে।’

ক’মিনিট পরে, সরু, আঁকাবাঁকা এক পথ দিয়ে, নির্জন, মনোরম এক সৈকতে পৌঁছল ওরা। সবাই তোয়ালে খুলে নরম, সাদা বালির ওপর বসল।

‘আপনি নিশ্চিত আর কেউ জানে না এটার কথা?’ প্রশ্ন করল মুসা।

‘আমি যদ্দূর জানি এটা একান্তই আমার,’ এমা বলল ওকে।

‘কর্মচারীদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব পছন্দের জায়গা আছে। সবাই কখনও-কখনও একা থাকতে চায় কিনা।’

‘আমার মনে হয় অন্য কেউ একজন আপনার দ্বীপটা খুঁজে পেয়েছে,’ কিশোর বলল এমাকে। হাত বাড়িয়ে বালির ভেতর থেকে এক চকচকে জিনিস বের করল।

‘বাটালি?’ রবিন সবিস্ময়ে বলল। ‘অদ্ভুত তো। সৈকতে লোকে বাটালি আনবে কেন?’

মাথা নাড়ল এমা।

‘আমি তো কল্পনাও করতে পারছি না।’ ঝকঝকে হলুদ হাতলটা দেখল। ‘এটা ক্যাম্প কোরালের নয়। আমাদের সব যন্ত্রপাতিতে দুটো ‘C’ স্ট্যাম্প করা হয়।’

‘এমা, আমরা সাঁতার কাটতে পারি?’ ডনের প্রশ্ন। ফ্লোরিডার গনগনে রোদে গরম লাগছে ওর।

‘অবশ্যই, পানিতে হাঁটাও যায়। এখানে চমৎকার এক কোরাল বেড রয়েছে। তোমরা চাইলে ছবি তুলতে পারো।’ ডাফেল ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে ছোট্ট এক ক্যামেরা আর কটা গগল্স্ বের করল এমা। ‘কে ছবি তুলবে?’

‘আমি,’ বলে, এক লাফে দাঁড়িয়ে পড়ল মুসা। ‘এটা কি আণ্ডারওয়াটার ক্যামেরা?’

‘হ্যাঁ, তোমাকে দেখিয়ে দেব কীভাবে ছবি তোলে। খুব সোজা,’ এমা বলল ওকে।

ছপ-ছপ করে উষ্ণ পানি ভেঙে সাগরে নামল ওরা, এবং এমা ওদেরকে এক ফালি রঙচঙে প্রবালের কাছে নিয়ে গেল।

‘আমি ভাবতাম শুধু মহাসাগরের গভীরেই প্রবাল মেলে,’ বলল কিশোর।

মাথা ঝাঁকাল এমা।

‘ব্যারিয়ার রিফের কথা আলাদা। আমরা কাল যাব ওখানে। কিন্তু এ ধরনের প্রবাল শ্যালো বে কোরাল-হাঁটু পানিতেই পাওয়া যায়।’ মুসাকে ক্যামেরাটা দিল এবং অল্প কথায় বোঝাল কীভাবে ব্যবহার করে।

‘ডন, কোন কিছু ছুঁয়ো না কিন্তু,’ বলল রবিন। ফুটখানেক দূরে একখণ্ড প্রবালের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে ডন।

এমা প্রত্যেককে গগল্‌স্‌ দিল।

‘পানিতে মুখ না রাখলে কিন্তু রঙগুলো ভালভাবে দেখতে পাবে না। এই দেখো। তোমার পায়ের ঠিক পাশেই ওটা গল্ফ বল প্রবাল। আর ওই যে, ডানদিকে ফিঙ্গার কোরালের দারুণ একটা চাং।’

‘খাইছে, আজব কাণ্ড,’ বলল মুসা, চমকিত। পানি থেকে মাথা তুলল ও, ক্যামেরাটা তখনও শক্ত করে আঁকড়ে রয়েছে। ‘প্রবালের ছবি নিতে যেতেই সরে গেল ওটা!’

এমা চোখ রাখল স্বচ্ছ নীল পানিতে।

‘ওহ, ওটা রোজ কোরাল, মুসা। বালিতে ঢাকা পড়লেই একটুখানি পানি ছেটায়। এভাবেই নিজেকে একপাশে সরিয়ে নেয়।’

আরও আধ ঘণ্টাখানেক পানিতে হেঁটে বেড়াল ওরা, সাবধান রইল যাতে প্রবালগুলোর কোন ক্ষতি না হয়। মুসা অনেক ছবি তুলল, আর অদ্ভুতদর্শন এক মাছ পাশ কাটাতেই উত্তেজিত হয়ে উঠল ডন।

‘আরি! ওটা কী?’ পানিতে স্বচ্ছ এক চাকতিকে ঝাঁকি খেতে দেখে বলে উঠল ও।

‘জেলিফিশ,’ জানাল এমা।

‘ওটা আসলেই মাছ? ভেতরে সবুজ কী যেন,’ বলল রবিন ‘গাছের মত।’

‘ওটা গাছই। কিছু-কিছু জেলিফিশ সাথে করে নিজের খাবার বয়ে বেড়ায়, ব্যাখ্যা করল এমা।

‘আমরা যেমন ব্যাকপ্যাকে গ্র্যানোলা বার নিয়ে ঘুরি,’ বলল ডন।

‘ঠিক।’

মুখরোচক লাঞ্চের পর, এমা ওদেরকে নিয়ে ক্যাম্পে ফিরল। তারপর অন্যান্য ক্যাম্পারদের সঙ্গে ভ্যানে উঠল কি ওয়েস্ট যাত্রার উদ্দেশ্যে।

প্রাচীন ভিক্টোরিয়ান আদলের বাড়িগুলো মন কাড়ল রবিনের, ওগুলোর উইণ্ডো বক্স থেকে ট্রপিকাল গাছপালা বেরিয়ে এসেছে বাইরে। দৃষ্টিনন্দন পাম আর বট-অশ্বত্থ গাছ রাস্তায় সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে, বাতাস ম-ম করছে ফুলের সৌরভে।

সারকে সার দোকান নিয়ে ম্যালোরি স্কয়্যারের এক রাস্তা অভিমুখে চলেছে ভ্যান। এক হকার তরতাজা নারকেল কেটে বিক্রি করছে একদল বাচ্চার কাছে, ওরা ঠোঁটের কাছে তুলে ধরেছে রুক্ষ বাদামি খোল। নারকেলের মিষ্টি পানি পান করছে মহানন্দে।

এমা ভ্যান পার্ক করার পর, টুরিস্টে গিজগিজ করা এক ওপেন এয়ার মার্কেটে ঢুকল সবাই। দুপুরের সূর্যের প্রখর তাপে চলার গতি ধীর হয়ে গেছে ওদের। মুসা পামের পাতা দিয়ে এক লোককে ঝুড়ি বানাতে দেখল। সু কি সুদৃশ্য এক ব্রেসলেট কিনল স্যুভনিয়ার হিসেবে। ডন ঝিনুকের এক সংগ্রহ থেকে বেছে নিল চকের মত সাদা এক স্যাণ্ড ডলার।

টাকা মিটিয়েই চমকে চোখ তুলে চাইল ডন।

‘ওই যে, নিল স্যাণ্ডার্স।’ দেখা গেল দীর্ঘকায় শ্মশ্রুমণ্ডিত ভদ্রলোক আরেক লোকের সঙ্গে গভীর আলোচনায় মগ্ন। ‘আমি ওঁকে আমার স্যাণ্ড ডলারটা দেখাতে চাই।’

ডনকে মেরিন বায়োলজিস্টের উদ্দেশে ছুটে যেতে দেখল এমা।

‘আজব ব্যাপার তো,’ বলল ও।

‘কী?’ রবিন একগাদা খুদে পিতলের আংটি দেখছিল, প্রশ্ন করল ওকে।

‘নিল স্যাণ্ডার্সকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমাদের সাথে কি ওয়েস্টে আসবেন কিনা, কিন্তু উনি বললেন ক্যাম্পে নাকি তাঁর অনেক কাজ,’ শ্রাগ করে বলল। ‘পরে মনে হয় মত পাল্টেছেন।’

‘আমার স্যাণ্ড ডলারটা নিল স্যাণ্ডার্সের পছন্দ হয়েছে!’ বলল ডন, এক দৌড়ে ফিরেছে দলের কাছে। ‘আর উনি কী বললেন জানো-ওঁর বন্ধু নাকি সত্যিকারের জেলে!’

কিশোর এক ঝলক দেখে নিল স্যাণ্ডার্সের বন্ধুটিকে, ফ্যাকাসে, বালিরঙা চুলের অধিকারী লোকটির বয়স ত্রিশের কোঠায়। লোক দু’জন হঠাৎই ঝট করে পিঠ ফিরিয়ে ডকের দিকে হাঁটা দিল।

‘দেখে তো মোটেও জেলে মনে হলো না লোকটাকে,’ বলল কিশোর। ‘কীরকম ফ্যাকাসে! কখনও রোদে গেছে বলে তো মনে হয় না।’

‘এখানকার সবাই রোদে পোড়া তামাটে,’ বলল রবিন। শ্রাগ করল। ‘লোকটা হয়তো ফিশিং বোটের ক্যাপ্টেন, অন্যরা যখন মাছ ধরে সে হয়তো ভেতরে বসে থাকে।

‘কে জানে,’ বলল এমা সন্দেহের সুরে।

‘এখন কোথায় যাব আমরা?’ প্রশ্ন করল মুসা। এক খেজুর গাছের নিচে বসে কোলের ওপর কি ওয়েস্টের ম্যাপখানা বিছিয়েছে। ‘আমরা কি ওয়েস্ট অ্যাকুয়ারিয়ামে যেতে পারি, কিংবা মেল ফিশারের জাদুঘরে।’

‘কী ধরনের জাদুঘর ওটা?’ ওর কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ডন!

‘ওখানে পানির তলায় খুঁজে পাওয়া সব ধরনের গুপ্তধন রয়েছে,’ জানাল এমা। ‘মেল ফিশার অ্যাটোচা জাহাজটা আবিষ্কার ওটা কয়েকশো বছর আগে ডুবেছিল। সোনার বার, পান্না আর নানা ধরনের রত্ন পাওয়া গেছে ওটায়।’

‘তবে অ্যাকুয়ারিয়ামটাও ইন্টারেস্টিং,’ মুসা বলল। ‘ওখানে অনেক জাতের মাছ আছে, ডন। শুনেছি ওরা নাকি বান মাছ ছুঁয়ে দেখতেও দেয়।’

‘ওয়াও!’ চেঁচিয়ে উঠল ডন। দ্বিধায় পড়ে গেছে ও রীতিমত। মাছ নাকি গুপ্তধন-বাছবে কীভাবে? এমার দিকে চাইল। ‘দুটোতেই যাওয়া যায় না?’ জিজ্ঞেস করল। ‘আমরা নয় এখন অ্যাকুয়ারিয়ামে যাই আর আরেকদিন আসব জাদুঘর দেখতে।’

‘সমস্যা নেই, স্মিত হেসে বলল এমা। ‘ভাল তো, তুমি কোনটাই মিস করতে চাও না।’

ডন খুশিতে লাফ দিলে হেসে ফেলল রবিন। ওর প্রাণশক্তির তুলনা নেই!