মূর্তিমান আতঙ্ক – ২০

বিশ

লোকটা রাস্তা ধরে ছুটছে, মানুষজন আর্তনাদ ছেড়ে আঙুল- ইশারায় দেখাচ্ছে তাকে।

ডন আর আমি নিথর দাঁড়িয়ে রইলাম। চরম আতঙ্কিত। আমার গায়ের চামড়ায় আর কাপড়ে এখনও আগুনের উত্তাপের স্পর্শ। ডন এবার ওর দানবের মুখোশটা খুলে ফেলল। কাঁপছে রীতিমত। ভয়ার্ত দৃষ্টি ওর চোখে। চেপে ধরল আমার হাত।

‘লোকটা কে ছিল?’ ক্ষীণ কণ্ঠে প্রশ্ন করল।

মাথা নাড়লাম।

‘জানি না,’ বললাম।

‘ও-ও তোমার বইটা নিয়ে গেছে,’ কোনমতে আওড়াল ডন। ‘লোকটা অগ্নিমানব ছিল, কিশোরভাই। আগুন জ্বলছিল ওর সারা গায়ে।’

‘হুম,’ মৃদুকণ্ঠে বললাম। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ‘চলো, বাসায় যাই।’

.

চাচা-চাচী ফিরে আসার দশ মিনিট আগেই বাসায় পৌঁছলাম আমরা।

ডনকে শপথ করালাম ও যাতে বড়দেরকে কিছু না বলে। নীরবে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিল ও।

‘আঙ্কল-আণ্টি এমনিতেও আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না,’ বলল। ‘অগ্নিমানবের কথা বলছি আরকী।’

ঠিকই বলেছে ও। এমনকী আমিই বিশ্বাস করেছি কিনা নিজেও জানি না।

তবে এটা সত্যি, চাচা-চাচীকে খুব বলতে ইচ্ছে করছে উয, অগ্নিমানব এবং কীভাবে আমার বইটা ছিনতাই করা হয়েছে সে সব কথা। কিন্তু ডনের কথাই ঠিক। তারা বিশ্বাস করবে না। বরং আরও বিপদে পড়ব আমি।

চাচা-চাচী হেঁটে বাসায় ঢুকল, সদাইপাতির বড়-বড় ব্যাগ নিয়ে। চাচী প্রথমেই যেটা জানতে চাইল, ‘কোন সমস্যা হয়নি তো? সময়টা কীভাবে কাটালি তোরা?’

‘না, সমস্যা হয়নি,’ জানালাম।

‘কী করলি দু’জনে?’ চাচা শুধাল।

‘এই নানান কিছু,’ বললাম।

ডিনারে বসে, ডন আর আমি দু’জনেই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলাম। কাজটা মোটেও সহজ হলো না।

এবং সে রাতে ঘুমোতেও কষ্ট হলো আমার।

বারবার কল্পনায় ভেসে উঠল উয কীভাবে উঁচু হয়ে আমার ওপর গরম তেল ঢালার পাঁয়তারা করছিল। কানে বাজছে শুধু ওর সেই গর্জন: ‘বলো, ছেলে, শেষ কোন কথা আছে?’

এবং তারপর সেই আগুনে-মানব। অগ্নিশিখা ভেদ করে স্থিরদৃষ্টিতে যেভাবে চেয়ে ছিল আমার আর ডনের উদ্দেশে! তারপর বইটা ছিনিয়ে নিয়ে, কোন কথা না বলে ওভাবে তার ছুটে পালানো।

বইটা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? কেনই বা এত দামি?

উযের আদিকথা সবাই-ই তো জানে। বইটার প্রথমাংশের কোন গুরুত্ব কারও কাছে নেই।

তারমানে পেছনের ওই অধ্যায়গুলোই টানছে ওদেরকে। যে পরিচ্ছেদগুলোতে তোমার ভেতরের সুপারপাওয়ার আবিষ্কারের কথা লেখা রয়েছে।

কিন্তু ওগুলো তো কোন কাজের নয়। মাত্র দশ সেকেণ্ড টেকে।

তাহলে লোকে বইটা হাতে পাওয়ার জন্য এত মরিয়া কেন?

প্রশ্নটা মাথায় নিয়ে শেষমেশ ঘুমিয়ে পড়লাম আমি।

ছটফট করলাম ঘুমের মধ্যে এবং ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্ন দেখলাম।

স্বপ্নটার শুরু এভাবে: আমার বেডরুমের জানালা। ওটা পুরোটা খোলা। বাতাসে পতপত করে উড়ছে পর্দাগুলো। দেয়ালে বাড়ি খেয়ে শব্দ করছে।

শোঁ-শোঁ বাতাস বইছে। মনে হচ্ছে কোন পশু কাঁদছে বুঝি।

ঘুমের মধ্যে, আতঙ্ক অনুভব করলাম আমি। জানালাটা খোলা কেন? আমি তো ওটা বন্ধ করে ঘুমাই।

চট…চট…চট…

দেয়ালে সজোরে বাড়ি খাচ্ছে পর্দাগুলো। এবার, ঘুমের মধ্যেই, ধীরে-ধীরে আকার পাল্টাতে লাগল ওগুলোর। হাত-পা গজাল। পর্দাগুলো হয়ে গেল ভূত, রক্ত হিম করা গর্জন ছাড়ছে।

চট…চট…চট…

ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসলাম বিছানায়। ঘামে জবজবে সারা শরীর। গায়ের সঙ্গে ঘামে ভেজা পাজামা সেঁটে রয়েছে।

আমার কামরা এখন জ্বলন্ত চুল্লী। শ্বাস বন্ধ হওয়ার দশা।

চকিতে দেখলাম বেডরুমের জানালা গলে চুইয়ে ঢুকছে ম্লান আলো। আঁতকে উঠলাম ওটা খোলা দেখে। ঠিক স্বপ্নে যেমনটা দেখেছিলাম।

ঠিক এমনিসময় টপ করে কপালে এক ফোঁটা তরল পড়ল। তপ্ত তেলের মত।

কাঁপা-কাঁপা হাতে, বেড টেবিল ল্যাম্পটা জ্বাললাম।

এবং চোখ তুলে চাইলাম উযের দিকে। ওর কালো চোখজোড়া ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে আমার উদ্দেশে। মুঠো তুলল ও। আমার কপালে আরেক ফোঁটা আগুন-গরম তেল ফেলল।

ছ্যাঁকা খেয়ে হাত চেপে ধরলাম ওখানটায়।

‘প্লিজ-’ আওড়ালাম।

‘বইটা,’ হুঙ্কার ছাড়ল ও। ‘দিয়ে দাও।’

ওর গা থেকে বিশ্রী গন্ধ আর প্রচণ্ড তাপ গড়িয়ে এল ঢেউয়ের মতন…

শ্বাস নিতে পারছি না। নড়ারও সাধ্য নেই।

ও আমার বাসায় ঢুকেছে! আমার ঘরে! তৈলাক্ত মুঠো উঁচিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার বিছানার ওপরে।

‘আমি–আমি—’ কথা বলতে যুঝছি রীতিমত 1

‘বইটা দাও, ছেলে,’ ঘাউ করে উঠল ও। ‘আমি এখানে ঠাট্টা-তামাশা করতে আসিনি। কী, বুঝলে কিছু?’

‘কিন্তু-’

একটা বাহু ঝাড়ুর মত বুলিয়ে আমার বিছানার চাদরে তেল ফেলল ও। ছ্যাত করে এক শব্দ হলো। পরমুহূর্তে, ধোঁয়া উঠে চিরে আলাদা হয়ে গেল চাদরটা।

‘তোমারও একই দশা হতে পারে, পাঙ্ক,’ চাপা গর্জন ছাড়ল উয। ‘মানুষের চামড়া পোড়ার শব্দ শুনেছ কখনও? অভিজ্ঞতাটা কিন্তু সুখের নয়।’

‘কিন্তু আমার কাছে তো নেই বইটা!’ অবশেষে কোনমতে উগরে দিতে পারলাম কথাগুলো।

ওর পুরো মাথা জুড়ে এখন বুদ্বুদ উঠছে। কাঁধের তৈলাক্ত মাংসপেশী কিলবিল করছে। নীল জিভটা চাবুকের মত এপাশ- ওপাশ আছড়ে পড়ছে।

‘এটা ছেলেখেলা নয়, কিশোর,’ রুক্ষ স্বরে বলল। ‘মিথ্যে কথা বোলো না।’

‘ওটা-ওটা চুরি হয়ে গেছে!’ তুতলে বললাম। বিছানায় বসে রয়েছি জবুথুবু হয়ে।

‘মিথ্যুক!’ গমগম করে উঠল উযের কণ্ঠস্বর। বিছানায় আড়াআড়ি ছড়িয়ে দিল গরম তেল। পরক্ষণে, শোঁ-শোঁ শব্দে আবারও ধোঁয়া উঠল পোড়া চাদরটা থেকে।

‘আমি সত্যি কথাই বলছি!’ চিৎকার করে বললাম।

আরেকটু ঝুঁকল ও। আমার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এল তীব্র কটু গন্ধে।

‘বইটা দিয়ে দাও, কিশোর। তোমাকে উযায়ন করতে বাধ্য কোরো না। এত সুন্দর একটা ঘরকে তছনছ করার কী দরকার?’

‘বইটা ছিনতাই হয়েছে,’ বোঝানোর চেষ্টায় বললাম। ‘সত্যি বলছি। আজ বিকেলে একজন ওটা কেড়ে নিয়ে গেছে।’

ওর গায়ের চামড়ায় জোর বুদ্বুদ উঠল। ভেজা, তেল চকচকে মুখে কালো চোখজোড়া গর্তে ঢুকে গেছে।

ধীরে-ধীরে মাথা নাড়ল উয।

‘ওহ্, কিশোর,’ কোমল গলায় বলল। ‘ওহ, কিশোর। ওহ, কিশোর। তোমার কপালে খারাবি আছে।’

একুশ

‘চাচা! চাচী! বাঁচাও!’

গলা থেকে আমার কর্কশ আর্তনাদ বেরোল।

মনে হলো চিৎকারটা শুনে চমকে গেল উয। কালো চোখজোড়া বিস্ফারিত এখন ওর। টলমল পায়ে এক কদম পিছাল।

‘চাচা! চাচী!’ আর্তচিৎকার ছাড়লাম। ‘জলদি এসো!’

খোলা হাতটা দিয়ে আমার গাল চেপে ধরল উয।

‘চুপ করো, পাঙ্ক, বইটা দিয়ে দাও। ওটা দিলেই চলে যাব।’

‘চাচা! চাচী! জলদি!’ তারস্বরে চেঁচালাম।

হৃৎপিণ্ডের ধুপ-ধুপ শব্দ ছাপিয়ে কানে এল ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ। হল ধরে সবেগে ছুটে আসছে।

শব্দটা উযও শুনেছে। আমাকে অবাক করে দিয়ে, পাঁই করে ঘুরে গেল ও।

‘কাজটা ঠিক করলে না,’ গর্জাল, ‘কী, বুঝলে কিছু?’

হেলেদুলে খোলা জানালাটার কাছে পৌঁছল ও। জানালার কাঠামো চেপে ধরে বিশাল দেহটা টেনে তুলল তাকে।

‘আমি আবার আসব,’ গর্জন ছাড়ল। এবার জানালা ছেড়ে লাফিয়ে পড়ল বাইরে। মিশে গেল রাতের আঁধারে।

বিছানায় তখনও জড়সড় হয়ে বসে রয়েছি আমি, কাঁপছি থরথর করে। নাকে লেগে রয়েছে আলকাতরার দুর্গন্ধ। উযের দেহ থেকে আসা জঘন্য ভেজা উত্তাপটুকু এখনও অবধি অনুভব করছি আমি।

এসময় দরজা হাট হয়ে খুলে গেল। চাচা-চাচী ধেয়ে এসে ঘরে ঢুকল, বাথরোব জড়াচ্ছে গায়ে। ছানাবড়া চোখে তীব্র আতঙ্ক।

‘কিশোর? কী হয়েছে?’

‘কিশোর? কী ব্যাপার?’

এবার মেঝেতে নামল তাদের দৃষ্টি। দু’জনেই বিস্ময় আর বিভ্রান্তির অস্ফুট শব্দ করে উঠল।

আমি তাদের দৃষ্টি অনুসরণ করলাম। আমার বেডরুমের সাদা গালিচায় প্রকাণ্ড, কালো, তেলতেলে পায়ের ছাপ।

‘কী এগুলো?’ চাচা চেঁচিয়ে উঠল। ‘কার পায়ের ছাপ?’

চাচী এবার বিছানার চাদরে পোড়া দাগ দেখতে পেল। পুড়ে ছিঁড়েখুঁড়ে গেছে কাপড়টা।

‘কিশোর—এসব কী? কী করেছিস তুই? পাগল হয়ে গেছিস নাকি?’

‘এটা…আমার সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট,’ বললাম। ‘তবে কাজ হচ্ছে না।’

‘কী ধরনের সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট?’ চেঁচিয়ে উঠল চাচী। ‘নিজের ঘরটাকে ধ্বংস করার গবেষণা?’

‘সরি। সকালে সব পরিষ্কার করে ফেলব। কথা দিলাম।’

‘শুধু পরিষ্কার করলেই হবে না,’ বলল চাচা। কালো পদচিহ্নগুলোর দিকে চেয়ে মাথা নাড়ল। ‘সকালে এই সায়েন্স এক্সপেরিমেন্টের একটা আগাগোড়া ব্যাখ্যা চাই আমি।’

‘এটা বাড়তি ক্রেডিটের জন্যে,’ বললাম। এতেই সাধারণত কাজ হয়। তবে এবার যে হবে না তাও জানি।

শব্দ করে হাই তুলল, চাচী।

চালা’ঘুমোতে গেলাম। সকালে কথা হবে এ ব্যাপারে, ঠিক আছে?’

‘আচ্ছা,’ বললাম।

চাচা দীর্ঘ দু’মুহূর্ত মাপল আমাকে। তারপর চাচীকে অনুগমন করে কামরা ছাড়ল।

আমার প্রদীপের আলোয় জ্বলজ্বল করছে তৈলাক্ত, কালো পদচিহ্নগুলো।

এ ব্যাপারে কাউকে আমার জানানো দরকার। এটা নিজের মধ্যে চেপে রাখা সম্ভব না।

চাচা-চাচীকে বলা যাবে না। তারা বুঝবে না। আর ডনকে বলেও লাভ নেই। ও বেশি ছোট। হয়তো হেসেই উড়িয়ে দেবে।

‘মুসা আর রবিন।’ বিড়বিড় করে নাম দুটো উচ্চারণ করলাম। ‘হ্যাঁ।’

চকিতে বেড টেবিল ক্লকটা দেখে নিলাম। রাত দুটো।

এত রাতে ওদের কাউকেই ফোন করা যাবে না।

ওদের বাবা-মারা স্রেফ খুন করে ফেলবে আমাদেরকে!

কাঁপা হাতে সেল ফোনটা তুললাম। টিক করে কিবোর্ড ওপেন করে টেক্সট করলাম রবিনকে। একের পর এক টেক্সট টাইপ করে গেলাম।

সব কিছু জানালাম ওকে, সেই স্বপ্ন দেখা থেকে নিয়ে শুরু করে। লিখলাম খোলা জানালাটার কথা…তেলমাখা পায়ের ছাপ…উয আগেরবার কীভাবে আমাকে উযায়ন করতে চেয়েছিল…বইটা কীভাবে চুরি যায়।

উড়ছে আমার বুড়ো আঙুল দুটো। টাইপ করেই চলেছি, গল্পটা কাউকে বলতে পেরে ভাল লাগছে। এমন কাউকে বলছি যাদেরকে আমি বিশ্বাস করি। আমি জানি মুসা আর রবিন আমাকে অবিশ্বাস করবে না। এবং কাউকে ওরা এসব কথা বলতেও যাবে না।

টেক্সট পাঠালাম রবিনকে। এবার ওগুলো ফরোয়ার্ড করে দিলাম মুসাকেও। খাটের কিনারায় বসে, চেয়ে রইলাম ফোনটার দিকে।

সাড়া নেই। পাব আশা করাও ঠিক নয়। এখন মধ্যরাত। ওরা নিশ্চয়ই গভীর ঘুমে।

‘সকালে ফোন অন করলেই পাবে,’ নিজেকে বললাম।

আবারও কম্বলের নিচে ঢুকলাম। ঘুমোতে চাই।

কিন্তু ঘুমোব কীভাবে? বিশালদেহী বদমাশটা জোর করে আমার কামরায় হানা দিয়েছে। এবং আমি জানি আবারও ফিরে আসবে।

‘ও আমাকে ধ্বংস করার আগেই ওকে আমার শেষ করে দিতে হবে!

কথাগুলো আমার ঠোঁট থেকে বেরোল। নিজের কানেই ওগুলো কমিক বইয়ের কোন চরিত্রের সংলাপের মত শোনাল।

কমিক বই…

চিন্তার ঢেউ উঠল মাথার মধ্যে। আমার পড়া উযের সব কটা বইয়ের ছবি ফুটিয়ে তুললাম কল্পনায়। এবং সহসাই…উপলব্ধি করলাম কীভাবে ওকে ধ্বংস করতে পারি।

‘ওহ!’

জানালায় আঁচড়ানোর শব্দে অস্ফুট আর্তনাদ ছাড়লাম।

ওটা বন্ধ করতে ভুলে গেছি। হাঁ-হাঁ করছে জানালাটা।

উয! উয ফিরে এসেছে ইতোমধ্যেই!

ঝট করে সিধে হয়ে বসে ভয়ার্ত চোখে চেয়ে রইলাম।

চোখ ধাঁধানো হলদে আলোর উদ্দেশে তাকিয়ে রয়েছি স্থিরদৃষ্টিতে।

এবার বিস্ময় আর আতঙ্কের মিশ্র এক আর্তনাদ বেরোল আমার গলা চিরে।

বাইশ

জানালা ভরিয়ে তুলেছে অগ্নিমানব তার তীব্র আলো ছড়িয়ে।

ওর মাথা আর দেহ থেকে আগুনের উজ্জ্বল ফুলকি ছিটকে পড়ছে। জানালা দিয়ে গড়িয়ে পড়ল, আমার বেডরুমের মেঝেতে-জ্বলন্ত এক অগ্নিগোলকের মত।

‘না!’ চেঁচিয়ে উঠলাম। তড়াক করে লাফিয়ে নামলাম বিছানা থেকে।

গালিচায় তেল ফেলে রেখে গেছে উয। এই লোকটা কি বড়সড় কোন আগুন ধরানোর মতলবে আছে?

দরজার দিকে ঝেড়ে দৌড় দিলাম। কিন্তু কম্বলে পা বেধে মুখ থুবড়ে পড়লাম অগ্নিমানবের সামনে।

লোকটার কালো পোশাক থেকে ফট-ফট শব্দে নিক্ষিপ্ত হলো অগ্নিশিখা। দু’বাহু শূন্যে তুলল ও, এবং আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছিটকে উঠল ওপরদিকে, ছাদ ছুঁই-ছুঁই করছে।

সবুজ চোখ মেলে কড়া দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইল অগ্নিমানব। গাঢ় লাল-হলদে পর্দার আড়ালে ঢাকা পড়েছে ওর মুখের বাকি অংশ।

‘কোথায় ওটা?’ দাবানলের মত আমার উদ্দেশে ধেয়ে এল ওর কণ্ঠ।

চোখ পিটপিট করছি। কোন জবাব খুঁজে পেলাম না।

‘কোথায় ওটা?’ পুনরাবৃত্তি করল লোকটা। ‘কোথায় লুকিয়েছ?’

‘মানে?’

কম্বল থেকে পাজোড়া ছাড়িয়ে নিলাম। টলতে টলতে পিছিয়ে গিয়ে বিছানার সঙ্গে সেঁটে দাঁড়ালাম।

ওর শরীর থেকে বেরনো অগ্নিশিখার কারণে বুনো ছায়ারা লাফাচ্ছে, নাচছে। স্ফুলিঙ্গগুলো আমার ডেস্ক, ড্রেসারে পড়ে নিভে যাচ্ছে।

‘আ-আপনি তো আগেই কেড়ে নিয়ে গেছেন ওটা!’ শেষমেশ স্বর ফুটল গলায়। ‘আর কী চান? ওটা তো এখন আপনার কাছেই!’

‘নাআআআ!’ ওর চারপাশে আগুনের ফোয়ারা ছুটল। ‘কোথায় লুকিয়ে রেখেছ ওটা?’

‘আ-আ-আমি, তোতলাচ্ছি রীতিমত। ‘বুঝতে পারছি না! কী বলছেন আপনি? বইটা তো আপনার কাছে!’

দ্রুত সচল হয়ে, আমার কামরাটাকে চক্কর কাটতে লাগল অগ্নিমানব। ওর আগুনে-হাতজোড়া ডেস্ক থেকে এক ঝটকায় ফেলে দিল সব কাগজপত্র। ড্রেসারের ড্রয়ারগুলো টেনে-টেনে খুলছে।

ওয়ালপেপারে আগুন লেগে পোড়া, কালো দাগ ফুটল। কার্পেটে ফট-ফট শব্দে ফাটছে ধোঁয়াটে গনগনে আগুন।

‘কোথায় ওটাআআআআ?’ হিসিয়ে উঠল লোকটা।

‘আপনি-আপনি আমার ঘরে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছেন!’ চিৎকার ছাড়লাম।

‘ওটা না দিলে সব পুড়িয়ে ছাই, করে দেব!’ গর্জাল অগ্নিমানব। এক হাত ওঠাল পর্দা লক্ষ্য করে। ‘দেখো কীভাবে পোড়ে।’

‘না, প্লিজ-’

পায়ে-পায়ে সরে গেলাম ক্লজিটের কাছে। হঠাৎই মনে পড়ল কিছু একটার কথা। পেছনদিকে ক্লজিটের মেঝেতে রয়েছে ওটা।

সময়মত যদি শুধু পৌছতে পারি ওখানে…

‘আ-আমি আনছি ওটা,’ অতিকষ্টে আওড়ালাম।

ও কী চায় কোন ধারণা নেই আমার। উযের বইটা তো ওর কাছেই। ওকে আর কী দিতে পারি আমি?

কিন্তু ওকে আমার দেরি করাতে হবে। ক্লজিটের কাছে পৌঁছতে হবে। ওটাই একমাত্র সুযোগ আমার।

ও পর্দার কাছ থেকে সরে গেল আমাকে নজরবন্দি রাখতে। ওর দু’হাতের অগ্নিশিখা এখন অনেকটাই স্তিমিত।

‘আনছি,’ আবারও বললাম। ‘ওটা এখানে আছে।

ক্লজিটের দরজা টেনে খুলে পা রাখলাম ভেতরে। ঝুলন্ত কাপড়চোপড়ের নিচে মাথা নোয়াতে হলো আমাকে।

কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। ক্লজিটের ভেতরে কালিগোলা অন্ধকার।

ঝুঁকে পড়ে মেঝের জিনিসপত্রগুলো ঘাঁটছি। অন্ধের মত হাতড়ে-হাতড়ে, জুতো আর স্পিকারগুলো সরালাম সামনে থেকে।

‘কোথায় ওটা?’ অগ্নিমানব হাঁকল। ওর প্রতিটা শব্দের সঙ্গে হিসিয়ে উঠছে অগ্নিশিখা।

‘পেয়েছি!’ গলা ছেড়ে বললাম।

ধাতব, ছোট্ট অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রটা আঁকড়ে ধরে তুলে নিলাম ক্লজিটের মেঝে থেকে। চাচা প্রতি কামরায় একটা করে ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখে। তবে কখনওই ভাবিনি ওটা ব্যবহার করতে হতে পারে।

আঁধারে, ক্যানিস্টারটা ঘোরালাম। খুঁজে পেলাম ট্রিগারটা। হাতে স্থির করলাম ওটাকে। ছোঁড়ার জন্য তৈরি। ওকে ধ্বংস করতে প্রস্তুত।

‘পেয়েছি!’ চেঁচালাম আবারও।

‘জলদি!’ গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল ও।

ক্লজিট ছেড়ে বেরিয়ে এসে, দোল খাইয়ে আগুন নেভানোর যন্ত্রটা নিয়ে এলাম আমার সামনে। নল্‌টা তাক করলাম ওর বুক বরাবর।

এবার ট্রিগার চাপলাম।

কিছুই ঘটল না।

তেইশ

সগর্জনে লাফিয়ে পিছাল ও, ঝলসে উঠল অগ্নিশিখা।

ক্যানিস্টারটা ঝাঁকালাম। এতটাই জোরে, আরেকটু হলেই পড়ে যেত হাত থেকে।

এবার এক লাফে সামনে এগোলাম। ঝাঁপালাম-এবং সর্বশক্তিতে চেপে দিলাম ট্রিগারটা।

তীব্র বেগে সাদা ফোয়ারা বেরিয়ে, অগ্নিমানবের মুখ থেকে ছিটকানো অগ্নিস্ফুলিঙ্গে আঘাত করল।

‘অ্যাই!’ চমকিত আর্তচিৎকার ছাড়ল সে।

ট্রিগার দাবিয়ে রাখলাম। ওপরে-নিচে বোলালাম স্প্রে, ওর মুখ থেকে বুক অবধি।

ওর ছড়ানো অগ্নিশিখা নিভু-নিভু হয়ে এলেও একেবারে মরে যায়নি।

বাহুজোড়া ঝট করে সামনে বাড়াল অগ্নিমানব। পায়ে-পায়ে পিছিয়ে যাচ্ছে জানালার উদ্দেশে।

ফোঁস-ফোঁস করে শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে আমার, বুক ধড়ফড় করছে, সামনে এগোলাম। ওর মুখ লক্ষ্য করে ধরে রাখলাম সাদা স্প্রে।

অনাহূত অতিথির চোখে ক্রোধের চাউনি ফুটে উঠতে দেখলাম। এক হাত তুলে চোখজোড়া ঢাকল।

এসময় খক-খক শব্দ তুলল ক্যানিস্টারটা। নিষ্কম্প হাতে স্প্রে ধরে রাখতে রীতিমত বেগ পেতে হলো আমাকে।

আগুন এত সহজে নেভার নয়। স্প্রের কবল থেকে বাঁচতেই যেন এঁকেবেঁকে, নেচেকুঁদে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে শিখাগুলো।

যন্ত্রটা ক্রমেই হালকা হয়ে এল। আমি জানি প্রায় খালি এখন ওটা।

সহসা, আমার দিকে পিঠ ফেরাল ও। এক লাফে চড়ে বসল জানালার তাকে-পরমুহূর্তে, সোজা লাফিয়ে পড়ল বাইরে। অন্ধকার রাতে উড়ে গেল অগ্নিমানব। আঁধারের বিপরীতে ঝলমলে এক অগ্নিগোলকের মত।

দীর্ঘ, কম্পিত শ্বাস ফেললাম।

কাঁপছি ঠকঠকিয়ে। ফায়ার এক্সটিংগুইশারটা হাত থেকে খসে পড়ে কার্পেটে লাফাল বার দুয়েক।

নুয়ে পড়ে হাঁটুজোড়া চেপে ধরলাম। শ্বাস ফিরে পেতে যুঝছি রীতিমত।

এবার বিছানায় পিঠ দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লাম। এখন আর ঘুমানো সম্ভব নয়। ঠায় বসে রইলাম ওখানে সকাল পর্যন্ত, খোলা জানালার দিকে নির্নিমেষে চেয়ে…ভাবছি…আর ভাবছি…

.

পরদিন সকালে, চাচা-চাচী সকাল-সকাল বেরিয়ে গেল। আলোচনাটা হলো না আমাদের। আল্লাহ বাঁচিয়েছেন!

সকালটা ঠাণ্ডা আর মেঘলা। রাতে বৃষ্টি হওয়ায় সাইডওয়কে পানি জমেছে। তৈরি হয়েছে গভীর বেশ কটা ডোবা।

হেঁটে স্কুলে যাওয়ার সময়, বার-বার চকিতে পিছু ফিরে চাইলাম। ভয় হচ্ছে এই বুঝি কোন গাছের আড়াল থেকে উদয় হয়ে উয কিংবা অগ্নিমানব তেড়ে আসবে আমাকে ধরতে।

ছায়া-আবছায়ার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছি। কাছেই কোথাও এক কুকুর ডেকে উঠলে চমকে গেলাম! আরেকটু হলেই পড়তে যাচ্ছিলাম পানির এক ডোবায়।

স্কুলে যখন পৌঁছলাম তখন কাঁপুনি সারা দেহে।

রবিনকে খুঁজে পেলাম ওর লকারের সামনে। কথা বলছিল ক্লাসের কটা ছেলে-মেয়ের সঙ্গে, তাই অপেক্ষা করতে হলো আমাকে।

ঘণ্টি বাজল। ক্লাসে ঢোকার পালা। অনুসরণ করলাম রবিনকে।

‘রবিন, আমার টেক্সট মেসেজগুলো পেয়েছ?’

মাথা ঝাঁকাল ও। এবার উল্টো ঘুরে মাপল আমাকে।

‘ওগুলোর সত্যিই কি কোন অর্থ আছে?’

ইতোমধ্যে মুসাও যোগ দিয়েছে আমাদের সঙ্গে।

মেসেজগুলো পেয়েছে ও-ও।

‘অবশ্যই!’ চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘কী বলছ তুমি? আমার কথা বিশ্বাস হয়নি তোমার?’

ভ্রূ কোঁচকাল রবিন।

‘ওটা তোমার বানানো গল্প নয় তো? আমাদের ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রজেক্টের জন্যে?’

‘না, দৃঢ়কণ্ঠে বললাম। ‘আমি তোমাদেরকে রাত দুটোর সময় গল্প পাঠাতে যাব কেন?’

‘খাইছে, আমাদের সাথে মজা করনি বলছ?’ বলল মুসা। হেসে ফেলল।

আমার হাসি পাচ্ছে না। ‘যা লিখেছি সব সত্যি,’ বললাম। ‘কাল রাতে-’

এসময় দরজায় আমাদের সাথে মিলিত হলেন মিসেস হার্পার।

‘গুড মর্নিং, তিনজনকেই। আবার তর্ক করছ? যার-যার সিটে যাও, ওকে?’

‘আমরা তর্ক করছি না,’ বলল রবিন। ‘স্রেফ কথা বলছি।’ আমাদের বসার জায়গা আলাদা। রবিন আর মুসা সামনের সারিতে, আর আমি পেছনদিকে বসি।

‘তোমাদের সাথে কথা আছে,’ বললাম। ‘ছুটির পর দেখা কোরো।’

‘কোথায়?’ রবিনের প্রশ্ন।

‘ডেয়ারি ফ্রিয়ের পেছনের গলিতে।’ প্রায়ই ওখানে মিলিত হই আমরা।

‘খাইছে, তোমার সাথে টাকা আছে তো?’ জিজ্ঞেস করল মুসা। ‘কোন খাওয়াতে হবে কিন্তু।’

‘আমার জীবনের ওপর এত বড় ঝুঁকি!’ বললাম। ‘আমি এখন এসব আইসক্রিম-ফাইসক্রিম নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না।‘

‘আমি ঘামাচ্ছি!’ বলল মুসা, নিজের ডেস্কের দিকে চলল। রবিন অনুসরণ করল ওকে।

.

ডেয়ারি ফ্রিযের পেছনের গলিটায় সারি-সারি ট্র্যাশ ক্যান, বাতিল কার্টন আর অন্যান্য আবর্জনা উপচে পড়ছে। কর্মচারীরা তাদের গাড়ি রাখে ওখানে। পেছনের ছোট জানালাটা দিয়ে দোকানের সাদা অ্যাপ্রন পরা কর্মীদের দেখতে পাচ্ছি।

গলির উল্টোদিকে কে যেন মরচে ধরা এক পুরানো বেঞ্চি ফেলে গেছে। ছুটির পর বন্ধুদের জন্য ওখানে বসেই অপেক্ষায় রয়েছি আমি।

জায়গাটা গোপন আলোচনার জন্য আদর্শ। কেউ আসে না এদিকটায়। আইসক্রিম কোন কিনে বেঞ্চিটায় বসে-বসে খাওয়া যায়। আর জঞ্জালের গন্ধটাও মোটেই তেমন বাজে নয়।

চকোলেট স্প্রিঙ্কল দেয়া চকোলেট কোন কিনে বেঞ্চিতে ফিরে এলাম। আশা করছি যে কোন মুহূর্তে দেখা দেবে মুসা আর রবিন। কিন্তু এরমধ্যেই কোনটা খেয়ে শেষ করে এখন আঙুল চাটছি আমি-ওদের ছায়াও দেখলাম না।

ব্যাপারটা কী? ভাবলাম। ওদেরকে তো বললাম ব্যাপারটা ভীষণ গুরুতর। কোথায় ওরা?

সেল ফোনে সময় দেখলাম। প্রায় চারটে বাজে। স্কুল ছুটি হয়েছে পঁয়তাল্লিশ মিনিট হতে চলল।

দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ওরা আসবে না।

দোকানের পাশের একটুকরো ফাঁকা ঘেসো জমিতে দুটো রবিন মাটি ঠোকরাচ্ছে। অগত্যা উঠে দাঁড়ালাম। চলে যাব।

বাড়িটার পাশ ঘুরে রাস্তার দিকে চললাম। কিন্তু মুখে গরম বাতাসের ঝাপটা লাগতেই থমকে দাঁড়ালাম। টলে উঠে পিছু হটলাম। তীব্র, কটু গন্ধটা চিনতে পেরেছি। চামড়ায় হুল ফুটিয়ে পুড়িয়ে দিল যেন।

উয গদাইলশকরী চালে গলিটায় ঢুকল, আমার পথ আগলে দাঁড়িয়েছে।

‘কী চান আপনি?!’ আর্তচিৎকার ছাড়লাম। কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ আর চড়া শোনাল।

ভ্রূ কুঁচকে রাখায় তৈলাক্ত মুখটা আরও ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। বিশালদেহী উয মোটেই বন্ধুভাবাপন্ন নয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

অনেকগুলো কালো আবের মত গজিয়েছে ওর কপালে, চোখের ওপরে এবং মুখের দু’পাশে। বারবার মুঠো পাকাচ্ছে আর খুলছে ও।

‘আমাকে যেতে দিন!’ চেঁচিয়ে বললাম। ‘আমি ৯১১-তে কল করব! সত্যি বলছি!’

পকেট থেকে ফোনটা বের করে সামনে ধরলাম।

হাত নাড়ল ও-এবং এক চাপড়ে ডেয়ারি ফ্রিযের পেছনের দেয়ালে আছড়ে ফেলল ওটা। ভেঙে দু’টুকরো হয়ে রাস্তায় পড়ে গেল ফোনটা।

‘কী চান আপনি? ছেড়ে দিন আমাকে!’ আর্তস্বর ফুটল আমার গলায়। ‘আপনার ওই ফালতু বইটা আমার কাছে নেই!’

ডেয়ারি ফ্রিযের পেছনের জানালার দিকে চোখ সরু করে চাইলাম। মনে আশা, কোন কর্মচারী হয়তো আমার চেঁচামেচি শুনে বেরিয়ে আসবে সাহায্য করতে।

কিন্তু না। একটি মেয়ে আইসক্রিম স্কুপ করছে আর আরেকজন ক্যাশ রেজিস্টারে টোকা দিচ্ছে। ওরা ফিরেও চাইল না।

উয আমার গায়ের ওপর হামলে পড়ল প্রায়। তেলমাখা এক হাত বাড়িয়ে দু’গালে আড়াআড়ি ঘষে দিল।

‘ওহ!’ ককিয়ে উঠলাম রীতিমত। ‘পুড়ে গেল!’

হাত তুললাম। মুখে মেখে রয়েছে ঘন চটচটে তেলের দাগ। হাতটা জোরে ঝাড়া মেরে ঠাণ্ডা করতে চাইলাম। প্রচণ্ড গরমে হাত জ্বলে যাচ্ছে!

ডেয়ারি ফ্রিযের পেছনের দেয়ালে পিঠ ঠেকা না অবধি টলতে টলতে পিছিয়ে গেলাম। এবার ঝটিতি ঘুরে দাঁড়ালাম। রাস্তায় পৌঁছতে পারব এক ছুটে?

‘ও চেষ্টা কোরো না,’ গর্জন ছাড়ল উয। ‘ওটা দিয়ে দিচ্ছ না কেন? তুমি তো জানই আমি কেন এসেছি।’

চব্বিশ

‘আ-আপনি কী চান?’ সভয়ে বললাম। ‘কেন এসেছেন জানি না আমি। আপনাকে তো আগেই বলেছি-

উয ঝুঁকল আমার ওপরে। নাকের এক ফুটোয় এক আঙুল রাখল-এবং অপর ফুটোটা দিয়ে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নিমেষে গরম, আঠাল তেল বেরিয়ে এসে ছ্যাঁকা দিল আমার ঘাড়ের পেছনে।

‘এহ!’ চরম ঘৃণার সঙ্গে বলে উঠে শরীর মোচড়ালাম। ইঁটের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আমার।

পালানোর পথ নেই।

বুক ধড়ফড় করছে। ঘাড়ের পেছনটা যন্ত্রণায় টাটাচ্ছে।

‘আ-আমার ওপর আর নাক ঝাড়বেন না, প্লিজ! আমি-আমি তো বলেছি আপনাকে,’ কোনমতে বললাম। ‘আগেই বলেছি, বইটা ছিনতাই হয়েছে। সারা শরীর থেকে আগুন বেরোয় এমন এক লোক কেড়ে নিয়ে গেছে ওটা।’

সটান সিধে হয়ে দাঁড়াল উয। মনে হলো বিস্মিত হয়েছে। গভীর মনোযোগে ভাবছে আমার কথাগুলো।

এবার আবারও ঝুঁকে এল আমার ওপরে। ওর কালো চোখজোড়া আমার ওপর স্থির।

‘বিশ্বাস করি না,’ গর্জে উঠল। ‘কী, বুঝলে কিছু?’

‘আ-আমি সত্যি বলছি। মিথ্যে বলতে যাব কেন?’

তেলতেলে একটা হাত বাড়াল ও।

‘দিয়ে দাও, ছেলে, এখুনি। যা খুঁজছি আমি দিয়ে দাও ভালয়- ভালয়-যদি বাঁচতে চাও।’

‘কী বলছেন আপনি?’ গলা থেকে ফ্যাসফেঁসে স্বর বেরোল।

আরেকটু ঝুঁকল ও। আলকাতরার কড়া গন্ধে শ্বাস চাপলাম। ওর শরীরের উত্তাপে আমার মুখ বেয়ে দরদর করে ঘাম গড়াচ্ছে।

‘ন্যাকা সাজছ?’ গমগম করে উঠল উয। ‘সরি, ছেলে। আমার আর কোন উপায় রাখছ না তুমি। কী, বুঝলে কিছু?’

হাজার মাইল বেগে ঝড় চলছে মনের মধ্যে। কী করব ভেবে পাচ্ছি না। আলকাতরার তীব্র, কটু গন্ধ… প্রচণ্ড তাপ…ওর চোখের শীতল দৃষ্টি…

‘সরি, ছেলে। ওর মুখের চামড়া বুদ্বুদ ছড়িয়ে হিসহিস শব্দ করছে। তৈলাক্ত কালো আব কিলবিল করছে ওর হাত, ঘাড় আর বুকে। ‘আর সাধু সেজে লাভ নেই।’

ও কী করতে চলেছে দেখতে পাচ্ছি। গরম তেলের ছ্যাঁকা আর নয়। ওগুলো ছেলেমানুষী কাজ-কারবার ওর জন্য।

কমিক বইতে এসবই আমার দেখা। দশ ফিট লম্বা হয়ে উঠবে উয, তারপর ছলাৎ করে আমার ওপর আছড়ে পড়বে তেলের ঢেউয়ের মতন।

মাথা নোয়াতে চাইলাম। সরে যেতে চাইছি গোপ্তা খেয়ে।

কিন্তু ও আমাকে ফাঁদে ফেলেছে।

আমি চাপা পড়ব ওটার নিচে!

ডুবে মরব গরম তেলের তলায়!

এগুলোই কি আমার শেষ ভাবনা?

তখনও শোঁ-শোঁ শব্দে বুদ্বুদ ছড়াচ্ছে, উয আমার মাথার ওপরে উঁচু হয়ে উঠল।

চোখ বুজলাম। শ্বাস চেপে রেখেছি। আর ক’মুহূর্তের মধ্যেই আমার ওপরে আছড়ে পড়বে উয।

আমি শেষ। আর কোন আশা নেই বাঁচার।

যদি না আমার মহাপরিকল্পনা কাজ করে। সারা রাত ধরে যেটার কথা ভেবেছি…

ও আমাকে ধ্বংস করার আগেই ওকে আমার বিনাশ করতে হবে।

হ্যাঁ, এখনই সে চেষ্টা করার মোক্ষম সময়।