রহস্যময় দুর্গ – ৫

পাঁচ

অন্ধের মত কিছুক্ষণ হেঁটে চলল কিশোর।

আরেকটা পাহাড় বাইল ও, লোকালয়ের চিহ্ন দেখতে পাবে ভেবেছিল, কিন্তু খুঁজে পেল শুধুই নিখাদ অন্ধকার। একবার মনে হলো যানবাহনের শব্দ শুনেছে, কিন্তু ভুল।

ঠাণ্ডায় আর ভয়ে কাঁপছে, অবশেষে এক গাছের নিচে বসে পড়ল কিশোর, শীতের কবল থেকে বাঁচতে জবুথুবু হলো। ভোর না হওয়া অবধি উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটাহাঁটি করে লাভ নেই।

দীর্ঘ রাতটি জুড়ে এক লকলকে অগ্নিশিখার আরামদায়ক ফায়ারপ্লেসের স্বপ্ন দেখল কিশোর, এবং আরও দেখল এক বিলাসবহুল হট বাথে গা ভেজাচ্ছে ও, আশপাশে ওর দ্যুতি ছড়াচ্ছে অগুনতি হীরে। একটু পরপরই চটকা ভাঙল কিশোরের, শরীর আড়ষ্ট, আবারও ফিরে গেল স্বপ্নরাজ্যে।

.

সকালের আগেই পাখির কলকাকলী শুনতে পেল কিশোর। ভোরের ফিকে আলোয় মরা এক গাছের গুঁড়িতে সাদা ছত্রাক ঝুলে থাকতে দেখল ও, এবার চোখে পড়ল মাথার ওপরে এক গাছের পাতাহীন শাখা-প্রশাখা।

শেষমেশ সূর্য উঠল, এবং ও পাতা ঝরা গাছগাছালি ঘেরা এক বনভূমি আবিষ্কার করল-কুয়াশামাখা। সটান সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে, হাত-পায়ের খিল ছাড়াল কিশোর। ও যদি ঘন, ধূসর কুয়াশার আড়ালে ম্লান আলো ছড়ানো সূর্যটাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যায়, তবে চক্রাকারে ঘোরার হাত থেকে বাঁচবে এবং একসময় সাহায্যও খুঁজে নিতে পারবে।

কিশোর উতরাই বেয়ে নামতে শুরু করতেই পায়ের নিচে মট- মট করে ডাল-পালা ভাঙতে লাগল। আচমকা থমকে দাঁড়াল ও। ওটা গাড়ির শব্দ না? না, নিছকই নগ্ন ডাল-পালা ভেদ করে বাতাস বয়ে চলার হুশ-হুশ আওয়াজ।

পাহাড়ের গোড়ার কাছে, এক মেটে রাস্তায় নেমে এল কিশোর। নখরে কিছু একটা বাধিয়ে ডোবা থেকে এক বাজপাখি উড়ে উঠল; অদৃশ্য হওয়ার আগে ধূসর হিম আকাশের বিপরীতে আবছা দেহরেখা ধরা পড়ল ওটার।

‘বাহ,’ কিশোর ফিসফিস করে বলল। ‘কী অপূর্ব একটা দৃশ্য!’

বাজপাখিটাকে সৌভাগ্যের প্রতীক ধরে নিয়ে, ওটার গমনপথ অনুসরণ করে হাঁটতে লাগল ও। বনভূমির বাদামি, ধূসর গাছপালা, ঝোপ-ঝাড় রীতিমত মুড়ে রেখেছে রাস্তাটিকে; মাসটা যদিও এপ্রিল, কিন্তু প্রচণ্ড ঠাণ্ডার কারণে কোন গাছেই এখনও মুকুল ধরেনি।

মাংসপেশীর খিল আর খিদের কারণে পেটের ভেতরে ব্যথা সত্ত্বেও, খুশিয়াল মনে রাস্তাটি ধরে এক পাহাড়ের চড়াই বাইতে লাগল কিশোর। কাছেপিঠে নিশ্চয়ই মানুষজনের বসবাস আছে, এবং শীঘ্রিই ও নিরাপদ আশ্রয় আর খাবার পাবে।

পাহাড়চূড়ায় উঠতেই কাঠপুতুল হয়ে গেল কিশোর। সামনেই রাস্তার ওপরে, গত সন্ধেয় ওকে যে ভ্যানটিতে তুলে অপহরণ করে আনা হয়েছে সেটি পার্ক করা!

ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে, ভ্যানটা জরিপ করল কিশোর। এক ফোন বুথের কাছে দাঁড়ানো ওটা, বুথের ভেতরে সেই কামার লোকটাকে দেখল ও, হাত নেড়ে নেড়ে ফোনে কথা বলছে। কামার এবার রিসিভারটা ঝুলিয়ে রেখে, ভ্যানের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোকের সঙ্গে কথা বলতে গেল। কিশোর চমকে উঠল লোকটিকে চিনতে পেরে, কাসা লোমার সেই শোফার।

দু’জনের পরনেই লাল চেক কাটা উলের কোট। পরস্পরের প্রতি সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকানোর সময় নাক দিয়ে ধোঁয়ার মত নিঃশ্বাস বেরোচ্ছে ওদের। এবার আলাদা হয়ে গেল ওরা, শোফার গেল কাছের জঙ্গলে এবং কামার ঢুকল রাস্তার ওপারের গাছগাছালির সারির ভেতরে।

লোক দুটো দৃষ্টিসীমার আড়াল হতেই, কিশোর শশব্যস্তে ফোন বুথের উদ্দেশে পা চালাল পুলিসকে ফোন করার জন্য। এতটাই শীতার্ত আর ক্লান্ত ও, এখুনি সাহায্য দরকার, এবং কিশোর নিশ্চিত বনভূমিতে তল্লাশী চালাতে সময় নেবে দুই অপহরণকারী।

ভ্যানটির পেছনদিকে চকিতে চাইল কিশোর, তারপর হাত বাড়াল ফোনের দিকে। হাত এতটাই কাঁপছে ওর, ধরে রাখতে কষ্টই হচ্ছে যন্ত্রটা।

‘প্লিজ, সাড়া দিন,’ ফিসফিস করে বলল, দূরের কোন অফিসে যখন ফোন বাজতে শুনল। ‘প্লিজ!’

অপেক্ষা করছে, আবারও ভ্যানটা এক পলক দেখে নিল কিশোর। ভেতরে কেউ একজন আছে, চালকের আসনে-রিয়ার- ভিউ মিররে একজোড়া চোখকে প্রতিফলিত হতে দেখল ও। স্কি মাস্কে ঢাকা মানুষটার মুখ শুধুমাত্র চোখ দুটি দেখা যাচ্ছে। রাস্তার সামনে-পেছনে নজরদারি করছে ও দুটো, লক্ষ রাখছে সব কিছুর ওপরে।

অনন্তকাল পরে যেন রিং বাজা থামল এবং এক কণ্ঠস্বর জবাব দিল।

‘পুলিস।’

‘উম। স্কি মাস্ক পরা মানুষটির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল কিশোর। চোখজোড়া পরিচিত ওর। কিন্তু কোথায় দেখেছে? ‘হ্যালো, পুলিস?’ ফিসফিসিয়ে বলল।

‘কথা বলুন, লাইন ক্লিয়ার নয়। ঠিকমত শোনা যাচ্ছে না।’

‘আমি সাহায্য চাই,’ ফিসফিস করে বলল কিশোর, এবার খানিকটা জোরে।

‘প্লিজ, আবার কল করুন। আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না।’

‘শুনুন-’

লাইনটা ডেড হয়ে যেতেই, মুখোশধারীর চোখজোড়া দেখে ফেলল কিশোরকে। মুহূর্তের জন্য মানুষটা হতবিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল, এবার বিকট শব্দে বেজে উঠল ভ্যানের হর্ন। কানে তালা লাগানো আওয়াজটি ভেঙে চুরমার করে দিল সকালের অটুট নীরবতা, পরমুহূর্তে বুথ থেকে পড়িমরি বেরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিল কিশোর।

শীঘ্রি বনভূমির কাছে পৌছে গেল ও থমকাল ক্ষণিকের জন্য। হর্নটা বেজেই চলেছে, তারমানে চালক ওকে ধাওয়া না করে সঙ্গী-সাথীদেরকে সঙ্কেত দিচ্ছে। সুবিধাটুকু কাজে লাগাল কিশোর, গাছগাছালির গভীর জটলায় গা ঢাকা দিল।

অবশেষে হর্নের শব্দটা থামল। পাহাড় থেকে বেরিয়ে থাকা এক পাথুরে অংশে পা রাখল কিশোর এবং গভীর এক নদীর দিকে চোখ নামিয়ে চাইল, বসন্তের বানের পানিতে ফুলেফেঁপে উঠেছে ওটা। গুড়ি মেরে এক পাথরের আড়াল নিয়ে, মরিয়ার মত চিন্তা- ভাবনা করার চেষ্টা চালাল ও। নিজেকে কীভাবে বাঁচাবে?

মিনিটখানেক বাদেই, মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল ওর। বেরিয়ে থাকা পাথুরে অংশটির সবচাইতে বড় পাথরটির গায়ে কাঁধ ঠেকিয়ে, ধাক্কা দিয়ে-দিয়ে আলগা করে ফেলল ওটাকে। এবার অপেক্ষায় রইল গাছপালা ভেদ করে যতক্ষণ অবধি ছুটন্ত পদশব্দ না শুনল।

সর্বশক্তিতে প্রকাণ্ড পাথরটিকে ঠেলা দিল কিশোর। মুহূর্তের দ্বিধার পর, পাথুরে প্রান্তভাগ দিয়ে গড়িয়ে নেমে গেল ওটা, নিচের কালো পানির ঘূর্ণিপাক অভিমুখে ছুটছে। পাথরটা গড়িয়ে পড়ছে, মুখ চেপে ধরে অস্ফুট আর্তনাদ ছাড়ল কিশোর।

‘না!’

ছলাৎ করে প্রচণ্ড শব্দ উঠল পেল্লায় পাথরটা পানিতে পড়তেই। কিশোর হাঁচড়ে পাঁচড়ে বিশাল এক গাছের পেছনে আশ্রয় নিয়ে, ধপ করে বসে পড়ল।

‘ছেলেটা মনে হয় পানিতে পড়েছে!’ কিশোর কামার লোকটার গলা শুনল গাছগাছালির আড়াল থেকে।

‘ভাল তো,’ চেঁচাল শোফারটা। ‘চলো ওকে পানি থেকে তুলি।’

ক্রুদ্ধ এক কাঠবিড়ালের ডাক শুনে বোঝা গেল লোক দুটো এদিকেই আসছে। শ্বাস চেপে বসে রইল কিশোর।

‘পানিটা দেখো,’ চেঁচিয়ে উঠল কামার। ‘বাঁচার কোন সুযোগ নেই। এমনকী ওর লাশটাও দেখতে পাচ্ছি না।’

‘চলো, ফেরা যাক।’

ওরা ত্বরিত বিদায় হলো, কিন্তু ভ্যানটার চলে যাওয়ার শব্দ যতক্ষণ না পেল ঘাপটি মেরে বসে রইল কিশোর। সম্ভাবনা আছে লোক দুটো হয়তো চালাকিটা ধরতে পেরেছে এবং একজন রয়ে গেছে বনভূমির ওপর নজর রাখতে।

শেষমেশ খিদে আর ঠাণ্ডার জ্বালায় অতিষ্ঠ কিশোর নিজেকে টেনে তুলতে বাধ্য হলো। সাবধানে রাস্তাটায় ফিরল ও, যতক্ষণ অবধি ফোন বুথটা চোখে না পড়ল। লোক দুটোর কোন চিহ্ন নেই। তড়িঘড়ি ফোন বুথের কাছে চলে এল কিশোর, পুলিসে যোগাযোগ করতে বেপরোয়া। কিন্তু ফোনটা ডেড হয়ে রয়েছে।

‘ওরা লাইন কেটে দিয়েছে! এখন?’

অকেজো যন্ত্রটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল কিশোর, মুষড়ে পড়ছে ক্রমেই। কী করবে এখন ও? বুথের গায়ে শরীর ছেড়ে দিয়ে ধূসর কুয়াশা আর ন্যাড়া গাছপালার উদ্দেশে চেয়ে রইল স্থিরদৃষ্টিতে।

লোক দুটো যে কোন সময় ফিরতে পারে। ওকে পথ চলতে হবে, কিন্তু গায়ে জোর পাচ্ছে না; চেষ্টা করে লাভ নেই। এবার সবিস্ময়ে দেখল, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে হেলেদুলে রাস্তা পেরোচ্ছে এক শজারু। ওটার তীক্ষ্ণ কাঁটাগুলোর দিকে তাকাল কিশোর, ওটার মজাদার, গড়ানো চলনভঙ্গি দেখে হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে। মনে হচ্ছে ক্ষীণদৃষ্টি কোন ভদ্রলোক বুঝি মিলিয়নেয়ারদের ক্লাবের উদ্দেশে চলেছেন।

আরেকটা চেষ্টা করবে ও। রাস্তা ধরে হাঁটা দিল কিশোর, মনে হলো পাজোড়া যেন বরফের চাঁই, হাতের অসাড় আঙুলগুলোয় ফুঁ দিয়ে গরম করার চেষ্টা করল। ছোট্ট এক পাখি পাইন গাছ থেকে সাঁ করে নেমে এসে, কিশোরের মাথা ঘিরে উড়ল এক পাক, নিজের বাসাটাকে রক্ষা করছে। ক্লান্ত পায়ে, কষ্টে-সৃষ্টে হেঁটে চলল ও।

একটু পরেই, এক হ্রদ দেখল কিশোর। দূরে, পাড় বরাবর, বিশাল এক কেবিনের পাথুরে চিমনি দিয়ে পাক খেয়ে ধোঁয়া উঠছে।

‘মানুষ! শেষ পর্যন্ত সত্যিকারের মানুষ! বাঁচলাম!’

ঠিক সে মুহূর্তে, ওর মনোবল ভেঙে দেয়ার শেষ চেষ্টাতেই যেন বৃষ্টি শুরু হলো। রাস্তা ছেড়ে, তীররেখা অনুসরণ করে দূরের কেবিনটার উদ্দেশে চলেছে, বড়-বড় ফোঁটায় মুখে বৃষ্টির পানি পড়তে লাগল কিশোরের।

‘আল্লাহ, ওটা যেন মরীচিকা না হয়,’ কাতর মিনতি করল কিশোর। ‘দোহাই লাগে, যেখানে আছিস থাক্।’

কূলরেখা বরাবর বুনো ঘাস খুঁটছে এক ঝাঁক খুদে পাখি। পাড় থেকে উড়াল দিল এক ব্লু হেরন, মোহনীয় ভঙ্গিতে উড়ছে নিস্তরঙ্গ হ্রদটার ওপরে, বৃষ্টির ফোঁটা যেখানে শত-শত নিখুঁত বৃত্ত তৈরি করছে।

কেবিনটার কাছে পৌঁছে, কিশোর দেখল বনভূমি থেকে ফিতের মত পেঁচানো এক রাস্তা বেরিয়ে এসে, গাড়ির গ্যারেজের সঙ্গে মিলেছে, শেওলায় ছেয়ে রয়েছে যেটির ছাদ। গ্যারেজটির দুটি দরজাই বন্ধ। শীতের ঝড়ে খসে পড়া মরা ডাল-পালা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে রাস্তা জুড়ে। মনে হচ্ছে বিরান কোন প্রান্তর বুঝি এটা, কিন্তু গ্যারেজ থেকে কেবিনের দিকে চলে যাওয়া টায়ারের টাটকা দাগ আর স্পষ্ট পায়ের ছাপগুলো প্রমাণ দিচ্ছে কেবিনটা নিয়মিত ব্যবহার করা হয়। ভেজা মাটিতে, পদচিহ্নের পাশে দুটি দীর্ঘ, সরু ছাপ।

কেবিনের পার্শ্বদরজায় থাবড়া মারল কিশোর, সাহায্যের জন্য চেঁচাল। সাড়া না পেয়ে, দরজায় ধাক্কা দিল আবারও, সাড়হীন হাতটা টাটাচ্ছে যন্ত্রণায়।

‘কে?’ ভেতর থেকে এক কণ্ঠস্বর গর্জে উঠল

গলার স্বরটা শুনে রোমাঞ্চিত কিশোর উপলব্ধি করল কোত্থেকে যেন বাড়তি শক্তি এসে গেছে ওর মধ্যে।

‘আমাকে বাঁচান,’ চেঁচাল ও।

‘এখুনি আসছি।’

দরজা থেকে দু’পা পিছু হটল কিশোর, ঠাণ্ডা হাতজোড়ায় ফুঁ দিচ্ছে। শরীরের রক্ত চলাচল ঠিক রাখার জন্য, ঘুরে কেবিনের সামনের অংশে চলে এল ও।

একটা জানালা বিধ্বস্ত।

কিশোর ভাঙাচোরা কাঁচের দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করল, বিশ্বাস করতে পারছে না নিজের চোখকে। এবার ক্যাঁচকোঁচ শব্দে কেবিনের দরজা খোলার শব্দ পেল, ঘুরে চাইতেই বুকের ভেতর ধড়াস করে উঠল হৃৎপিণ্ড-সেই কামার লোকটা!