রহস্যময় দুর্গ – ১১

এগারো

মুহূর্তের জন্য নিশ্ছিদ্র নীরবতা নেমে এল।

এবার নদীর ওপরে এক শঙ্খচিল ডেকে উঠতেই, চাপা হাসলেন রেজিনা।

‘তোমরা চমকে গেছ, তাই না, বাছারা?’

‘কিন্তু…’

‘বিজয়ের এই অসাধারণ মুহূর্তটা সারাজীবন মনে থাকবে আমার।’

সহসাই বুঝে গেল কিশোর। ডক আর বনভূমির মাঝে পথের ওপর দীর্ঘ দুটো রেখা দেখেছে, ওকে যে কেবিনটিতে আটকে রাখা হয়েছিল সেটার কাছেও হুবহু একই রকমের দাগ ছিল। ওগুলো রেজিনার হুইলচেয়ারের ছাপ।

‘তো আপনিই ছিলেন ওই ভ্যানটার ড্রাইভার!’

মাথা ঝাঁকালেন রেজিনা, তখনও হেসে চলেছেন। এবার ফ্রেডির দিকে চাইলেন।

‘পার্টনার, ওকে বলুন কী হয়েছিল।’

মুচকি হাসি ফুটল ফ্রেডির ঠোঁটে

‘হীরেগুলো কোথায় লুকানো আছে বলতে চাওনি তুমি মনে পড়ে? আমি রেজিনাকে ফোন করি আর ও তোমাকে স্ট্রিটকার থেকে কিডন্যাপ করার লোক পাঠায়। আমরা তোমার থিয়োরিটা জানতে চেয়েছিলাম।’

‘তারমানে হীরেগুলো স্যর ডয়েলের শাওয়ারেই লুকানো ছিল?’

‘হ্যাঁ। তুমি ওটা বলে দিতেই, কেবিন থেকে ফোন করে রেজিনা এবং আমি কাসা লোমায় ছুটে যাই। ওখানে কেউ আমাকে সন্দেহ করে না, তাই সোজা স্যর ডয়েলের বাথরুমে গিয়ে দরজা লক করে দিই। ক’মিনিটের মধ্যেই, মেইন পাইপ অফ করতেই আমার হাতে ছোট্ট এক ধাতব টিউব ভর্তি হীরে চলে আসে।’

‘সেজন্যেই শাওয়ারটা কাজ করছিল না আমি যখন ঢুকি। পানি নিশ্চয়ই টিউবটাকে সরিয়ে দিয়েছিল, এবং ওটা মেইন পাইপটাকে আটকে দেয়।’

ফ্রেডি কথা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু রেজিনা থামিয়ে দিলেন তাঁকে।

‘আমি স্যর ডয়েলের ডেস্কে নকল হীরে লুকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিই। বুড়ো গর্দভটাই আমাকে ফস্ ড্রয়ারটা দেখিয়েছিল।’

‘উনি মোটেই বুড়ো গর্দভ নন।’ প্রতিবাদ করল টিনা। ‘উনি আপনাকে চাকরি দিয়েছেন, বিশ্বাস করেছেন। কিন্তু আপনি তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।’

রেজিনার গালজোড়া আপেলের মত টকটকে লাল হয়ে গেল।

‘চোপ! বেয়াদব মেয়ে কোথাকার!’

‘কেন চুপ করব? আপনি আস্ত একটা চোর, আপনার উচিত এখুনি হীরেগুলো তাঁকে ফিরিয়ে দেয়া।’

‘কিন্তু ওগুলো তো আমার কাছে নেই, সোনামণি, ফ্রেডির কাছেও না।’

‘কী?’

হেসে উঠলেন রেজিনা। ভারী মজার কথা বলেছেন যেন।

‘এবার মুখটা বন্ধ হবে দস্যি মেয়ের। আমি যেটা বলছিলাম, আসল হীরেগুলো নিরাপদে কাসা লোমা থেকে সরানোর পর, শোফার তোমার মামাকে ফোন করে স্যর ডয়েলের ডেস্কে খুঁজে দেখতে বলে। নকলগুলো আবিষ্কারের ফলে ফ্রেডি রত্নগুলো সীমান্ত পার করার প্রস্তুতি নেয়ার সময় পায়।’

‘কিন্তু আপনাদের কাছে তো হীরেগুলো নেই বলছেন।’

‘আমাদের কাছে নেই, কিন্তু তোমাদের কাছে তো আছে।’

‘মানে?’

হাসিতে ভেঙে পড়লেন রেজিনা।

‘আয়নায় যদি একবার নিজেদের মুখগুলো দেখতে!’

ফ্রেডিও হাসলেন, তবে সামান্য।

‘রেজিনা, অনেক হয়েছে। সময় নষ্ট হচ্ছে।’

আচমকা রেজিনা পিস্তলটা তাক করলেন ফ্রেডির বুক বরাবর।

‘আমি বলেছিলাম কেউ নড়বে না। কথাটা আপনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, পার্টনার।

‘আপনি পাগল হলেন নাকি?’

‘না, স্রেফ লোভী।’ মুচকি হাসলেন রেজিনা। ‘ভেবে দেখলাম, ফ্রেডি, আধাআধি বখরায় পোষাবে না আমার। আমি চাইলেই যেখানে সব কটা হীরে পেতে পারি।’

‘শয়তান কোথাকার! দু’মুখো সাপ!’

রাগে কালো হয়ে গেছে ফ্রেডির মুখের চেহারা। রেজিনার উদ্দেশে পা বাড়াতেই ট্রিগারে চেপে বসল মহিলার আঙুল, এবং জায়গায় জমে গেলেন তিনি।

‘কথা ভুল বলেননি, পার্টনার। এখন শান্ত হোন, বেশি তিড়িং বিড়িং করলে কিন্তু বুক ঝাঁঝরা হয়ে যাবে।’ ঝটিতি নদী অভিমুখে চাইলেন মহিলা, দু’পাশে নায়াগ্রা রেন্টাল্স্ লেখা ছোট্ট এক মোটরবোট ডকের পাশে মৃদু ঝাঁকুনি খাচ্ছে। ‘যান, ভালয়-ভালয় ওটায় উঠে পড়ুনগে

‘কেন উঠব?’

‘কারণ আমি ওটা বিশেষভাবে আনিয়েছি, আপনাকে পালানোর সুযোগ করে দিতে। শীঘ্রি আপনি নদী পেরিয়ে কানাডায় যাচ্ছেন, ওখানে মাউন্টিদের হাত এড়াতে ঝটপট লুকিয়ে পড়নগে বিশাল কোন গাছের আড়ালে।’

‘আর বাচ্চাগুলো?’

‘ওরা আমার সাথে থাকবে জিম্মি হিসেবে।’

‘হীরেগুলো রেখে দিন, রেজিনা, কিন্তু ওদেরকে আমার সাথে যেতে দিন।’

‘অসম্ভব। বোটে উঠুন, যান।’

রেজিনা চাইলেন টিনার দিকে।

‘তোমার জ্যাকেট খোলো।’

‘ও, এই ব্যাপার!’ চেঁচিয়ে উঠল টিনা। ‘আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল।’

খলখল করে হাসলেন রেজিনা।

‘তুমি চালু মেয়ে, তবে অতটা বুদ্ধিমতী নও। জ্যাকেটটা দিয়ে দাও আমাকে!’

অনিচ্ছাসত্ত্বেও, সাটিনের চমৎকার জ্যাকেটটা খুলল টিনা এবং রেজিনাকে ব্লু জেয ক্রেস্ট ছিড়ে ফেলতে দেখল। শেষ পর্যন্ত আলাদা হলো ওটা। এবং ঝরঝর করে একগাদা ঝকঝকে হীরে ঝরে পড়ল রেজিনার কোলের ওপর।

‘কী সুন্দর!’ ফিসফিসিয়ে বললেন রেজিনা। হাত বোলালেন অমূল্য রত্নগুলোর ওপরে। ‘সব আমার!’

‘এবার আমার জ্যাকেটটা দেবেন?’

‘নিশ্চয়ই।’ হীরেগুলো পকেটে পুরে জ্যাকেটটা টিনার উদ্দেশে ছুঁড়লেন রেজিনা। ‘এবার তোমার পালা, কিশোর।’

কিশোরের ক্রেস্টের হীরেগুলোও নিরাপদে পকেটে পোরার পর, মোটরবোটের উদ্দেশে পিস্তল বাগালেন রেজিনা। ‘ফুটো বডি নিয়ে বেশিদূর যাবে না ওটা, পার্টনার, তাই আর দেরি না করে রওনা হয়ে যান। নইলে টার্গেট প্র্যাকটিস করতে বাধ্য হব আমি।’

‘ছুঁচো কোথাকার! আমাকে ছাড়া তুই একা এই অপারেশনটা সামলাতে পারতিস?’

‘ধুর, ব্যাটা, গেলি?! পুরো প্ল্যানটাই তো আমার, তুই শুধু হুকুম তামিল করে গেছিস। যা ভাগ! আমার আঙুল কিন্তু চুলকাচ্ছে।’

ক্রুদ্ধ ফ্রেডি বিড়বিড় করে কীসব আওড়ে, স্টার্টারে হাত দিলেন এবং ইঞ্জিনটা গুড়-গুড় করে জ্যান্ত হয়ে উঠল। রেজিনার নির্দেশে, বোটটার মুরিং লাইনগুলো খুলতে গেল কিশোর।

‘সরি, বাচ্চারা,’ শান্তস্বরে বললেন ফ্রেডি। ‘তোমাদেরকে ঠকানোর ইচ্ছে ছিল না আমার, কিন্তু এছাড়া আর কীভাবে ‘হীরেগুলো পাচার করতাম বলো!’

‘রেজিনার হাত থেকে যদি বাঁচতাম,’ বলল চিন্তিত টিনা। ‘মহিলা গুলি করে বসতে পারে যখন-তখন।’

‘আমাকে নিশ্চিত গুলি করবে পাখি মারার মত, কিন্তু দুটো ছোট-ছোট ছেলে-মেয়েকে করবে না।’ রেজিনাকে এক পলক দেখে নিয়ে, গলার স্বর আরেক পর্দা নামালেন ফ্রেডি। ‘কিশোর, বন্ধু আমার, তোমার ক্যাপটা দেবে? পানিতে সানস্ট্রোক হতে পারে ভয় পাচ্ছি আমি।’

‘কিন্তু আপনি তো পনেরো মিনিটেই ওপারে চলে যাবেন।’

‘তা ঠিক। কিন্তু ক্যাপটা থাকলে একটা ভাল ছদ্মবেশ নিতে পারতাম আরকী।’

পেছন থেকে ককিয়ে উঠল রেজিনার হুইলচেয়ার, গড়িয়ে কাছে চলে এলেন মহিলা।

‘এত গুজুর-গুজুর, ফুসুর ফুসুর কীসের? পিছিয়ে এসো, কিশোর, আমি ওই হতভাগাকে গুলি করব।’

আতঙ্কিত দেখাল ফ্রেডিকে, তিনি গিয়ারে দিলেন বোটটাকে। কিশোরের সঙ্গে কথা শুরু করতে যাবেন, পিস্তলের হ্যামারের ‘টিক’ শব্দ পেয়ে চটজলদি গতি তুললেন। ডক ছেড়ে তীরবেগে ছুটে যেতেই বোটটা থেকে ফেনা আর পানির ফোয়ারা উঠল।

হেসে ফেললেন রেজিনা।

‘আপদ বিদেয় হয়েছে,’ গলা চড়িয়ে বলে, কিশোর আর টিনার উদ্দেশে হাতছানি দিলেন। ‘আমার আগে-আগে হেঁটে সোজা জঙ্গলে ঢোকো। চমৎকার এক রাইড নেব আমরা।’

কিশোর হাঁটা ধরতেই, মোটরবোটের গতি কমার শব্দ পেল। চকিতে কাঁধের ওপর দিয়ে চাইতেই দেখল গুলির সীমানার বাইরে থেমে পড়েছেন ফ্রেডি, এবং চেয়ে রয়েছেন ওদের গমনপথের উদ্দেশে। ওদের অপেক্ষায় রয়েছেন, রেজিনাকে যদি শুধু খসাতে পারে ওরা।

রেজিনার মনোযোগ অন্যদিকে সরাতে কথা শুরু করল কিশোর।

‘ওই শোফারটাই কি ভান করেছিল আমি ওর ওয়ালেট চুরি করেছি?’

‘হ্যাঁ। তারপর তুমি পালিয়ে গেলে কেবিনে যায়, তোমাকে খুঁজতে সাহায্য করার জন্যে।’

‘আপনি ভ্যানে স্কি মাস্ক পরেছিলেন কেন?’

‘যাতে চেনা না যায়।’

রেজিনার উদ্দেশে চাইল কিশোর; চেয়ারের চাকা ঘোরানোর সময় তাঁর কোলে নিরীহ ভঙ্গিতে পড়ে রইল পিস্তলটা।

‘আপনি এই জঙ্গলের ভেতরে গাড়ি রেখেছেন কেন?’

‘ফ্রেডির সাথে যখন এলে তখন যেন আমার ভ্যানটা তোমরা দেখতে না পাও। বাপ রে, তুমি জেরাও করতে পার, বাপু!’

ওদের সামনে, সরু রাস্তাটার ওপরে নুয়ে পড়েছে লম্বা এক ডাল। পেরনোর সময় ডালটা আঁকড়াল কিশোর, ওটা যখন টান- টান হলো ধনুকের ছিলার মতন, ছেড়ে দিল। সোজা রেজিনার উদ্দেশে আছড়ে পড়ল গাছের ডালটা।

‘দৌড়াও, টিনা,’ গর্জাল কিশোর।

ঝোপ-ঝাড় মাড়িয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল কিশোর, মনেপ্রাণে কামনা করছে রেজিনা গুলি করবেন না। গাছপালার আড়াল ছেড়ে টিনাকে নিয়ে সবেগে ডক অভিমুখে দৌড়ল কিশোর, মরিয়ার মত হাত নাড়ছে ফ্রেডির উদ্দেশে।

পরমুহূর্তে, মোটরবোটটা সগর্জনে পানি চিরে লাফাল ওদের দিকে।

‘জলদি,’ চেঁচাল কিশোর। বুক ধড়ফড় করছে ওর, আশঙ্কা হচ্ছে এই বুঝি গুলি এল।

ডকের দিকে কাছিয়ে এসে, ইঞ্জিন ধীর করে চিৎকার ছাড়লেন ফ্রেডি। মোটরবোটটাকে থামানোর সময় নেই; ওদেরকে লাফাতে হবে, এবং মোক্ষম মুহূর্তটির জন্য শরীরের প্রতিটি মাংসপেশীকে তৈরি রাখল কিশোর।

‘এইবার,’ চেঁচিয়ে উঠল টিনা।

একসঙ্গে বাতাসে শরীর ভাসিয়ে নির্বিঘ্নে বোটের ওপর লাফিয়ে পড়ল দু’জনে। নিমেষের জন্য প্রবল বাতাসে বিভ্রান্ত বোধ করল কিশোর, এবার বোটটা ডক থেকে সাঁ করে ছুটে যেতেই টলে উঠল

‘পেরেছি,’ বাতাসে হুঙ্কার ছাড়লেন ফ্রেডি। ‘জয় আমারই হলো!’

ওদেরকে উদ্ধার করার জন্য ফ্রেডিকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে পাত্তা পেল না কিশোর। ফ্রেডির দৃষ্টি তখন পেছনে তীরের কাছে, এবার হা-হা করে হাসতে লাগলেন তিনি।

‘পুলিস এসে গেছে! একদম ঠিক সময়ে!’

হতচকিত কিশোর পার্কে সাইরেনের গোঙানী শুনল। স্টিয়ারিঙে রেজিনাকে নিয়ে ভ্যানটা জঙ্গলের ভেতর থেকে রীতিমত কামানের গোলার মতন ছুটে বেরোল। এবার, তীক্ষ্ণ ধাতব শব্দ তুলে, ডানদিকে কেতরে ধুলোর মেঘের মধ্যে থেমে পড়ল। পুলিসের একাধিক গাড়ি ওটাকে ঘিরে ফেলতেই, দু’হাত তুলে আত্মসমর্পণ করলেন রেজিনা।

‘ইয়াহু!’ ফ্রেডি আনন্দে আটখানা। বত্রিশ পাটী দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। ‘আহা, কী অসাধারণ একখান দৃশ্য! বেইমান বেটি এবার বুঝুক মজা!’

‘কিন্তু ঘটনাটা কী?’

একান-ওকান হাসি ফ্রেডির মুখে।

‘শুরু থেকেই, রেজিনাকে বোকা বানাব ঠিক করে রেখেছিলাম। জানতাম বনের ভেতর ওর ভ্যানটা লুকানো থাকবে। পালাতে যাতে না পারে সেজন্যে আগেই ওর চাকার হাওয়া ছেড়ে দিই, তারপর কানাডার মাউণ্টিদের ফোন করে জানিয়ে দিই ওরা যে হীরেচোরকে খুঁজছে সে আমেরিকায় আছে, রিভারসাইড পার্কে।’

বিরতি নিলেন ফ্রেডি, চাপা হাসলেন।

‘জানতাম কানাডিয়ান মাউণ্টিদের কাছ থেকে আমেরিকান এফবিআই-এর কাছে খবরটা পৌঁছতে সময় লাগবে, তারপর না স্থানীয় পুলিস তথ্যটা জানবে। ওরা পার্কে পৌঁছনোর আগেই তোমাদের দু’জনের কাছ থেকে হীরেগুলো বাগিয়ে নেয়ার প্ল্যান করি আমি, তারপর রেজিনাকে গ্রেপ্তার করিয়ে সোজা পগার পার।’

পার্কে পুলিসের গাড়িগুলোতে ঝলসানো রঙিন আলো ঘুরপাক খেতে দেখল কিশোর।

‘হ্যাঁ, রেজিনা তো ধরা পড়েছেনই। কিন্তু আপনার কপাল তো খুলল না।’

‘মানে?’

‘পুলিস রেজিনার কাছ থেকে হীরেগুলো উদ্ধার করবে। আপনি খামোকাই কাদা ঘেঁটে মরলেন, কিছুই পেলেন না।’

খুশির হাসি হাসলেন ফ্রেডি।

‘তোমার ধারণা আমি আহাম্মক? ভুলে যেয়ো না, আমি রেজিনাকে কখনওই বিশ্বাস করিনি।’

‘বুঝলাম না।’

‘ভেবে দেখো, বাছারা। ঝুটো হীরে একবার ব্যবহার করা গেলে দু’বার নয় কেন? আর জ্যাকেট ছাড়া তোমাদের আর কোথায় ক্রেস্ট আছে বলো তো?’

খুশিয়াল হাসিতে ফেটে পড়লেন ফ্রেডি। এবার ওদের দু’জনের মাথা থেকে ক্যাপ দুটো ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে, নাড়তে লাগলেন খোশমেজাজে।

‘ঠিক ধরেছি! রেজিনা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে ‘পারে ভেবে, আমি ওকে বলেছিলাম তোমাদের জ্যাকেটের ক্রেস্টে হীরে থাকবে। ওগুলোতে নকল হীরে ভরে, আসলগুলো রাখি তোমাদের ক্যাপের ক্রেস্টে। আইডিয়াটা কেমন ছিল, দুর্দান্ত না?’

মাথা ঝাঁকাল টিনা।

‘ভাগ্যও আপনার সাথে ছিল, ফ্রেডি।’

‘কোন সন্দেহ নেই। আমরা এরমধ্যেই অর্ধেক নদী পেরিয়ে এসেছি। ডাঙায় পৌঁছেই সটকে পড়ব আমি। মাউন্টিরা কখনওই আমাকে খুঁজে পাবে না। আমি মহাধনী হয়ে যাব!’

কিশোরের মনে হলো ঠকানো হয়েছে ওদেরকে, পছন্দের আর আস্থাভাজন মানুষটির দিকে অসন্তুষ্ট দৃষ্টিতে চাইল ও।

‘আমরা যখন রেজিনার সাথে তাঁর ভ্যানের দিকে যাচ্ছিলাম, ভেবেছিলাম আপনি আমাদেরকে বাঁচানোর জন্যে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু আপনি আসলে শুধু আমাদের ক্যাপের হীরেগুলো চাইছিলেন।’

একথা শুনে চিরাচরিত মধুর হাসি উপহার দিলেন ফ্রেডি।

‘মন খারাপ কোরো না, কিশোর। তুমি সবসময়ই আমার প্রিয় বন্ধু থাকবে, টিনাও।

খোঁত করে উঠল টিনা।

‘আপনার প্রতিটা কথাই ভুয়া। আপনি আপনার বন্ধু স্যর ডয়েলের হীরে চুরি করে তাঁকে আস্তাবলে মরার জন্যে ফেলে রেখেছিলেন।’

‘ওই বুড়ো হাবড়াটার মরাই উচিত! থাইল্যাণ্ডের রাজার চেয়েও ব্যাটা বেশি টাকার মালিক, তারপরও হীরেগুলো দখল করে রেখেছে। কেন, ওগুলো গরীব মানুষদেরকে বিলিয়ে দেয়া যেত না?’

‘যারা আপনার মত গরীব?’ ব্যঙ্গ করে বলল টিনা।

‘হ্যাঁ, তাই তো! আমি একজন ছাপোষা মানুষ, জীবন- জীবিকার জন্যে খেটে মরছি, আর ওদিকে হতচ্ছাড়া স্যর ডয়েল দুর্গে বসে মজাসে ক্যাভিয়ার সাঁটাচ্ছে। ব্যাপারটা অসহ্য লাগত আমার কাছে, তাই তার বন্ধুর ভান ধরি লুকানো হীরেগুলোর খোঁজ পেতে। ব্যাটার অন্তরের মধ্যে ঢুকে পড়ি।’

‘অন্যরা লোভী, আপনি নন?’ টিনার প্রশ্ন।

‘অনেক বাখোয়াজ হয়েছে, মেয়ে। ট্যারা-ট্যারা কথা বলে নিজেকে খুব স্মার্ট প্রমাণ করতে চাও, তাই না?’

‘আপনি যেহেতু নন,’ বলল কিশোর, ‘আমার বিশ্বাস জন আণ্ডারকভার মাউণ্টি।’

‘হ্যাঁ! সুড়ঙ্গে ধরা খেয়ে ওর কী চেহারা হয়েছিল জীবনেও ভুলব না, আর সেই ফাঁকে আমি হাওয়া! দেখেছই তো, প্রমাণ ছিল না বলে মাউন্টিরা আমাকে অ্যারেস্ট কিংবা সার্চ করতে পারেনি, তাই জনের দায়িত্ব ছিল আমি বর্ডার ক্রস করার চেষ্টা না করা অবধি আমাকে ফলো করা, তারপর হীরেগুলোর জন্যে কাস্টম্স অফিসারদেরকে দিয়ে আইনী প্রক্রিয়ায় তল্লাশী করানো।’

‘কিন্তু তাঁরা তো ওগুলো পেতেন না,’ বলল কিশোর।

‘তাও ঠিক। আমি তো চালু লোক, বুদ্ধি খাটিয়ে তোমাদেরকে দিয়ে হীরেগুলো পাচার করিয়েছি। আর তোমরা তো দেখলেই কী ঘটল। কাস্টম্‌স্ অফিসাররা আমাকে ভালভাবে সার্চ করলেও তোমরা ছোট মানুষ বলে ছেড়ে দিয়েছে।’

এসময় হঠাৎই কেশে উঠল মোটরটা। ওটার দিকে চকিতে চেয়ে, সূর্যের উদ্দেশে মুখ ফেরানোর সময় খুশিতে শিস দিয়ে উঠলেন ফ্রেডি।

‘আহা! ফ্লোরিডায় গিয়ে গায়ে রোদ মাখতে কী ভালই না লাগবে আমার!’

মোটরটা খক-খক শব্দ করল আবারও, তারপর থেমে গেল একদম। ফিউয়েল ট্যাঙ্কটার দিকে চাইলেন ফ্রেডি।

‘ওটা খালি! ওই বেইমান মেয়েলোকটা মনে হয় বেশিরভাগ তেল শুষে নিয়েছে।’

মুচকি হাসল টিনা।

‘উনি বোধহয় আপনাকে বিশ্বাস করতে পারেননি, ফ্রেডি।’

‘বাঁকা-বাঁকা কথা রেখে বৈঠা ধরো! আমরা ভেসে যাচ্ছি।’

ফ্রেডির কণ্ঠের জরুরী তাগিদ অবাক করল কিশোরকে। এবার যে শব্দটা শুনল তাতে ভয়ে জমে গেল।

পাঁই করে ঘুরে, ভাটি অভিমুখে চাইল কিশোর।

‘আমরা উতরাইগুলোর দিকে চলেছি!’

একটা দাঁড় আঁকড়ে ধরে মরিয়ার মতন বাইতে লাগল টিনা।

‘ওগুলোর পেছনে কী দেখো!’ আর্তনাদ ছাড়ল।

দূরে নদীটা যেখানে আচমকাই শেষ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, সেখানে সূর্যকিরণ পড়ে জলরাশির এক মেঘ রঙধনুর রূপ নিয়েছে। ভয়ঙ্কর সেই জায়গাটি নির্দেশ করছে ওটা, নদী যেখানে জলপ্রপাতের ওপর দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বহু নিচে পাথরখণ্ডগুলোর ওপরে।

একটা বৈঠা ছিনিয়ে নিয়ে, বোটটাকে নিরাপদ জায়গায় সরাতে টিনাকে সাহায্য করতে চাইল কিশোর। কিন্তু স্রোত এমনই ভয়ানক শক্তিশালী, বোটটাকে অবিরাম টেনে নিয়ে চলেছে উতরাইগুলোর গুম-গুম শব্দ লক্ষ্য করে।

‘লাভ নেই,’ গর্জালেন ফ্রেডি। ‘বৈঠা ফেলে শক্ত করে নৌকা ধরে বসে থাকো!’

ঠিক সামনেই মাথা তুলে রয়েছে অতিকায় এক পাথর। চোখজোড়া বুজে ফেলল কিশোর, এবার অনুভব করল ফুঁসে-ওঠা পানি বোটটাকে ছুঁড়ে দিল পাথরটা থেকে দূরে। শীতল জলবিন্দু তীক্ষ্ণ কামড় বসাল ওর চোখে-মুখে, নিজের অজান্তেই আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল গলা দিয়ে।

উতরাইগুলোর বজ্রধ্বনি গিলে নিল ওর চিৎকারটাকে। বড়- বড়, এবড়োখেবড়ো পাথরগুলোকে ঘিরে সাদা পানি আঘাত হানছে-অসহায়ের মত দেখল কিশোর। বিশাল এক পাথরের পাশ কাটাল নৌকা, এবার ঘূর্ণিপাকের মধ্যে চরকির মতন ঘুরল এক পাক, তারপর পাঁই করে মোচড় খেয়ে নিমেষে আবারও ফিরে এল গর্জনশীল খরস্রোতের মধ্যে।

আচমকাই ঢলগুলো শেষ হয়ে গেল। কিশোরের নৌকো আঁকড়ে ধরা হাত শিথিল হলো, কিন্তু স্বস্তিটুকু উবে গেল নিমেষে। চোখ-মুখ থেকে জলকণা মুছতেই দেখল ক’মুহূর্তের মধ্যেই নির্দয় পানি ওদেরকে বয়ে নিয়ে যাবে জলপ্রপাতের কিনারায়।

‘ওই গুঁড়িটা,’ চেঁচালেন ফ্রেডি। ‘আমরা হিট করলেই ওটা চেপে ধরবে!’

সামনে বিরাট দুই পাথরের মাঝখানে এক গাছের গুঁড়ি গুঁজে রয়েছে। নৌকোটা গুঁড়িতে আঘাত করতেই কোনভাবে একটা ডাল আঁকড়াতে পারল কিশোর। নৌকো থেকে নিজেকে টেনে বের করে নিল ও-ওটা প্রপাতের ওপর দিয়ে পড়ে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে।

হতভম্বের মত কিশোর একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল বোটটা যেখানে উধাও হয়েছে। এবার গুঁড়িটা বেয়ে ওপরে উঠতেই স্বস্তিতে হৃৎপিণ্ড ধড়াস করে উঠল টিনা আর ফ্রেডিকে দেখে।

‘বেঁচে গেছি আমরা,’ জলপ্রপাতের কানে তালা লাগানো গর্জন ছাপিয়ে চিৎকার করে বলল কিশোর। ‘আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না!’

‘বেঁচে গেছি?’ পাল্টা চেঁচালেন ফ্রেডি। ‘এটাকে বাঁচা বলে?’

গুঁড়িটা ঘিরে পাক খাচ্ছে খরপানি। কিশোর ওর অবস্থান পাল্টাতেই কেঁপে উঠল গুঁড়িটা; তিনজন মানুষের ভার চেপেছে, যে কোন মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে ওটা

আতঙ্কিত কিশোর তীরের দিকে চাইল। টেব্‌ রক হাউসে, মানুষ জড় হয়ে দেখছে ওদেরকে, আঙুল দেখাচ্ছে। এই তো খানিক আগেই, নিরাপদে ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল কিশোর, জলপ্রপাতের ওপর দিয়ে যারা গেছে ঠাট্টা-তামাশা করছিল তাদেরকে নিয়ে।

এসময় গুঁড়ি বরাবর একটা কম্পন বয়ে গেল, এবং নদীটা এমনভাবে ফুলেফেঁপে উঠল যেন পাথর থেকে ওটাকে আলগা করেই ছাড়বে। তীরে দাঁড়ানো জনতার উদ্দেশে মরিয়ার মতন চাইল কিশোর, কামনা করছে তারা কোনভাবে সাহায্য করবে।

টিনা চেঁচিয়ে উঠল এবং শব্দটা লক্ষ্য করে ঝট করে ঘুরে গেল কিশোরের মাথা, ভয় পেল টিনা পড়ে গেছে বুঝি। কিন্তু তার বদলে দেখল মেয়েটা আকাশের দিকে তর্জনী দেখাচ্ছে।

‘দেখো!’

এক দানব রেসকিউ হেলিকপ্টার দেখল কিশোর। বিশাল যন্ত্রটা আকাশ থেকে ধীরে-ধীরে নেমে আসতেই, আনন্দে আর স্বস্তিতে চিৎকার ছাড়ল ও।

‘দেখলেন?’ ফ্রেডির উদ্দেশে চিৎকার ছাড়ল। ‘আমরা নিরাপদ। বেঁচে গেলাম এযাত্রা।’

আতঙ্কে ফ্যাকাসে দেখাল লোকটির মুখের চেহারা। ব্লেডের ঘূর্ণিতে বাতাসের ঝড় উঠতেই থরথর করে কেঁপে উঠল গুঁড়িটা। ফ্রেডির আঙুলগুলো শক্ত করে চেপে ধরল ওটাকে। হেলিকপ্টারের পেটের এক হ্যাচ খুলে গেল এবং নেমে এল এক রেসকিউ বাস্কেট। ফ্রেডি বাস্কেটটাকে তাঁর পাশে ঝুলতে দেখলেন, এবার গুঁড়িটাকে আরও জোরে আঁকড়ে ধরলেন।

‘জলদি, ফ্রেডি,’ গর্জাল টিনা। ‘আর দেরি করবেন না!’

ফ্রেডির চোখে নগ্ন আতঙ্ক দেখল কিশোর। যে কোন মুহূর্তে গুঁড়িটা ছুটে যাবে; কিশোর জানে দেরি করা যাবে না, ওকে শীঘ্রি বাস্কেটে উঠতে হবে। প্রতিটি মুহূর্ত এখন মহামূল্যবান। পিচ্ছিল গুঁড়ি বরাবর সাবধানে এগিয়ে, বাস্কেটটির কাছে পৌঁছল ও এবং ক’মুহূর্তের মধ্যেই পাক খেয়ে উঠে গেল হেলিকপ্টারের নিরাপদ আশ্রয়ে, সঙ্গে-সঙ্গে ওকে মুড়ে দেয়া হলো পুরু কম্বলে।

কিন্তু বিপদ এখনও কাটেনি, ঝুড়িটাকে আবারও গুঁড়ির কাছে নামতে দেখে শিউরে উঠল কিশোর।

‘শিগির, টিনা,’ ফিসফিস করে বলল, মেয়েটিকে ঝুড়ির দিকে বুকে হেঁটে এগোতে দেখে।

ওটার কাছে পৌঁছে, ফ্রেডির উদ্দেশে কিছু বলার জন্য থামল টিনা। লোকটি মাথা ঝাঁকালে, ঝুড়িতে উঠে পড়ল ও; হেলিকপ্টারের উইশ্ আঁটসাঁট হলো এবং শীঘ্রি এক ক্রু মেম্বার টিনাকেও কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে দিলেন।

চোখ থেকে পানি মুছে, সহায়তাকারী মহিলার দিকে চাইল ও।

ফ্রেডি গুঁড়ি ছাড়তে ভয় পাচ্ছেন,’ হেলিকপ্টারের গর্জন ছাপিয়ে গলা চড়াল টিনা।

‘আমি দেখছি।’ মহিলা ঝটপট কিছু যন্ত্রপাতি জড় করলেন। ‘ফ্রেডি ব্রাউনকে খুব সাহসী আর শক্তিশালী লোক ভাবতাম, কিন্তু

এখন দেখছি বিপদে পড়ায় তার আসল চেহারা বেরিয়ে পড়েছে!’

‘ওটা যে ফ্রেডি ব্রাউন জানলেন কীভাবে?’

‘ওহ, তাকে তো টিভিতে অনেক দেখেছি।’

মহিলাকে ঝুড়িতে করে নামানো হলে, উইশ্ অপারেটরের দিকে চাইল কিশোর

‘আপনারা এত সহজে এখানে এলেন কীভাবে?’

‘রেসকিউ চপারটার বেস এই নায়াগ্রা ফলসেই। মানুষজন প্রায়ই বিপদে পড়ে কিনা।’

হ্যাচ ভেদ করে চাইল কিশোর। মহিলা নির্ভীক ভঙ্গিতে গুঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ফ্রেডির শরীরে হার্নেস বাঁধছেন। এবার উইশ্ অপারেটরকে সঙ্কেত দিলেন, এবং যন্ত্রটা কুঁই-কুঁই করে উঠল।

হার্নেস রোপ এঁটে বসতেই, মহিলা ফ্রেডিকে ডাল ছাড়তে বাধ্য করলেন এবং গুঁড়ি ছেড়ে উঠতে শুরু করলেন লোকটি। বিশাল এক গুবরেপোকার মত ধীরেসুস্থে ঘুরছেন, ফ্রেডি ব্রাউনকে হেলিকপ্টারে তুলে ডেক-এ নামানো হলো। তাঁর হার্নেস খুলে দিলে, টলতে-টলতে এক সিটে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ে স্বস্তির শ্বাস ফেললেন বাঁধনমুক্ত ফ্রেডি।

‘আমি পেরেছি, বাছারা,’ বলে, বিজয়ীর ভঙ্গিতে একটা হাত তুলে দেখালেন। বেসবল ক্যাপ দুটো এখনও আঁকড়ে ধরে রয়েছেন। ‘এত কিছুর পরও হীরেগুলো হাতছাড়া করিনি!’

‘তাতে কী হলো?’ বলল কিশোর। ‘আপনি তো জেলে যাবেন, আর হীরেগুলো যাবে স্যর ডয়েলের কাছে।’

‘হুঁ,’ বিন্দুমাত্র দমলেন না ফ্রেডি। ‘কিন্তু রত্নগুলো ফিরে পেয়ে স্যর ডয়েল নিশ্চয়ই আমাকে বড়সড় কোন পুরস্কার দেবেন!

জলপ্রপাত থেকে হেলিকপ্টারটি সরে আসতেই, কম্বলের ভেতরে আরও গুটিসুটি মেরে দাঁত বের করে হাসল টিনা।

‘ফ্রেডি, বারোটা নাচুনে ভালুকের চাইতেও আপনি মানুষকে অনেক বেশি মজা দিতে পারেন। আপনি চিজ বটে একখান!’