২৫শে মার্চ – ৮

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, টিচার্স কোয়ার্টার
২৫শে মার্চ, ১৯৭১
সময় : রাত ১০টা ১৫ মিনিট

“তো, এই হলো ব্যাপার,” বলে মনিরুজ্জামান কবির আর আবুর দিকে তাকাল। দুজনেই গম্ভীর হয়ে শুনছে। সদা বাচাল টাইপের আবুও চুপ। আর কবির সবসময়ই গম্ভীর টাইপের, কথা কম বলে।

“স্যার, আমার একটা কথা আছে,” কবির বলল। “আসলে আমার প্রশ্ন আছে, একটা না দুইটা। প্রথম প্রশ্ন, আপনার কি মনে হয় হাফিজ স্যার আসলেই সুইসাইড করেছেন? করলে কারণা কী? আর দ্বিতীয় প্রশ্ন, হাফিজ স্যার যদি এরকম একটা কিছুর পেছনেই লেগে থাকেন এবং সেটা শুধুমাত্র আপনার সাথেই শেয়ার করে থাকেন তবে অন্য কেউ বিশেষ করে পাকিস্তান সরকারের কেউ এই ব্যাপারে জানল কীভাবে?”

“তোর প্রশ্নগুলো ঠিক আছে,” মনিরুজ্জামান আনমনেই বলে উঠল। “তোর প্রথম প্রশ্নটার উত্তর আমার এখনও জানা নেই। আর আমার মনে হয় এই প্রশ্নটার উত্তর জানতে পারলে আমরা দ্বিতীয়টার উত্তরও জানতে পারব। তবে এই ব্যাপারটা আসলেই খুব অস্বাভাবিক। সরকারের লোকজন এই ব্যাপারে জানবে কীভাবে? হাফিজ তো অনেকটা একা একাই থাকত ওর কাছে থেকে ব্যাপারটা ছড়ানোর কথা না। আর আমি জানার পর তেমন কেউই জানতে পারেনি। তোরা হয়তো কিছুটা জানতি কিন্তু…”

“স্যার, আপনি এখন কী করতে চাচ্ছেন?” আবু অনেকক্ষণ পরে প্রশ্ন করল।

মনিরুজ্জামান বড় করে একবার দম নিল। সে ইতোমধ্যেই সম্ভাব্য কর্মপন্থা ঠিক করে ফেলেছে। “বাইরের পরিস্থিতি কী রে কবির?” এই ছেলেটাকেই সে বেশি বিশ্বাস করে এবং নির্ভরযোগ্য মনে করে। অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছেলে, অন্যদিকে আবু ভালো ছেল কিন্তু ওর গভীরতা কম। এই দুজনই তার নিজের ছাত্র এবং এই দুজনকেই সে নিজে গড়ে তুলছে।

“স্যার, পরিস্থিতি একদম ভালো না। কী হবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এতদিন তাও একটা আশার আলো দেখা গিয়েছিল কিন্তু এখন যে আসলে কী হবে কেউই তা বলতে পারে না। বিশেষ করে আজ ইয়াহিয়া খান হঠাৎ করে মিটিং বাতিল করে চলে যাওয়াতে এখন,” বলে কবির একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। “গুজব ছড়িয়ে পড়েছে গত কয়েকদিনে চট্টগ্রাম বন্দর সহ নানা দিক দিয়ে যেভাবে সৈন্য ঢুকেছে আমার মনে হচ্ছে একটা যুদ্ধ আসন্ন। এখন দেখা যাক আমাদের নেতারা কী করেন।”

সবাই তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে, মনিরুজ্জামান মনে মনে ভাবল। তবে যাই ঘটুক না কেন এখন তাদেরকে বেরোতে হবে। তাকে এই রহস্যের তল খুঁজে বের করতে হবে। আর সেটা করতে হলে তাকে সেখানে যেতে হবে, যেখানে এর শুরু হয়েছিল। “চল আমরা বেরোব।”

“স্যার, আমরা এখন যাব কোথায়?” আবু জানতে চাইল।

“হাফিজের বাসায়। কী ঘটেছিল, এর উত্তর আমার ধারণা একমাত্র ওখানেই পাওয়া সম্ভব।”

তারা সবাই মিলে বাইরে বেরিয়ে এসে মনিরুজ্জামানের ওপেল রেকর্ডে উঠল। গাড়ি চালিয়ে রওনা দিল পল্টনের দিকে। রাস্তাঘাট একদম শুনসান। চারপাশে কীসের যেন অশুভ চাপ। মনিরুজ্জামান গাড়ি চালাতে চালাতে পরিস্থিতির চাপটা পরিষ্কার অনুভব করতে পারছে। আসলেই কিছু একটা হতে যাচ্ছে। টিএসসি পার হতে হতে সে দেখল টিএসসি’র কাছেই অন্ধকার এক কোণে তিনটা মিলিটারি ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে কি সত্যিই যুদ্ধ আসন্ন? সে মনে মনে ভাবল।

.

মনিরুজ্জামানের ওপেল রেকর্ডটা টিচার্স কোয়ার্টারের গেট দিয়ে বাইরে আসতেই ফুলার রোডের অন্ধকার কোণে একটা জিপ থেকে একজর ওয়ারলেসে কথা বলে উঠল, “টার্গেট ইজ অন দা মুভ, টার্গেট ইজ অন দা মুভ।”

অন্যপাশে নীরবতা। এটা একটা হট লাইন। অন্যপাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ সরাসরি বসে আছে। ফিল্ড এজেন্ট একবার ভাবল আরেকবার বলবে কি না। কারণ অপর প্রান্তে যে মানুষটা বসে আছে সে অত্যন্ত গরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। সে আবারও বলার জন্য মুখ খুলতেই অপর প্রান্ত থেকে ভারি গলায় একজন বলে উঠল, “ফলো দা টার্গেট, কিপ অ্যান আই ওন দেম অ্যান্ড ডোন্ট লুজ দেম। আই রিপিট ডোন্ট লুজ দেম।”

ওয়ারলেসের অপর প্রান্তে কর্নেল হাবিব মাউথপিসটা নামিয়ে রাখতে রাখতে ভাবল, খেলা শুরু হয়ে গেছে। এটা হলো মাইন্ড গেম। যে যত ঠান্ডা মাথায় খেলতে পারবে সে-ই জয়ী হবে। তবে এখন পর্যন্ত সে এগিয়ে আছে। তার সাপোর্ট আছে। সে সব জানে এবং সবচেয়ে বড় শক্তি, তার টার্গেট তার ব্যাপারে এখনও পুরোপুরি অজ্ঞ। তার টার্গেট পরিবারকে সরিয়ে দিয়েছে এবং এখন সে বেরিয়েছে তার মানে সে এখন ওই উদ্দেশ্যেই বেরিয়েছে।

কর্নেল হাবিবের পরিকল্পনা খুব পরিষ্কার। হাফিজ মারা গিয়ে তাকে বিপাকে ফেলে দিয়েছে, এখন তার একমাত্র ভরসা এই মনিরুজ্জামান। সে তাকে জিনিসটা খুঁজে বার করতে দেবে এবং সে খুঁজে পাওয়া মাত্রই ছিনিয়ে নেবে।

আজ রাতে পূর্ব পাকিস্তান ধ্বংসস্তূপ হবে, আজ রাতে এই জাতিকে পুরোপুরি নিস্তব্ধ করে দেওয়া হবে। অর্ডার হয়ে গেছে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়ে যাবে আর কিছুক্ষণের ভেতরেই। আর এর ভেতরেই তাকে তার উদ্দেশ্য পূরণ করে নিতে হবে। আজ এই ২৫শে মার্চ রাতে তাকে জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জনটা করে নিতে হবে।

.

পল্টন পর্যন্ত যেতে যেতে জায়গায় জায়গায় আরও কিছু মিলিটারি ট্রাক দেখতে পেল সে। ব্যাপার কী? এত মিলিটারি কেন। কবিরের কথা আসলেই ঠিক এই ছেলেটাকে এই কারণেই তাকে ভালো লাগে। ওর তথ্যে কখনো ভুল থাকে না।

ওপেল রেকর্ডটাকে হাফিজের বাড়ির সামনে পার্ক করে একবার চারপাশটা দেখে নিল। কেন জানি তার অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে কেউ তাদের ওপর চোখ রাখছে। পল্টনের এই অংশটা সাধারণত রাতের এই সময়েও বেশ জমজমাট থাকে। কিন্তু আজ লোকজন নেই বললেই চলে। মনিরুজ্জামান আরেকবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে হাফিজের বাসার লোহার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল।

দরজার গায়ে হাত বুলিয়ে মৃদু ঠেলা দিল। অবাক ব্যাপার দরজা খোলাই আছে। ভেতরটা অন্ধকার। কেন জানি মনিরুজ্জামানের হাত চলে গেল কোমরে রাখা পিস্তলটার ওপর। আবু আর কবিরের দিকে ইশারা করে সে ভেতরে ঢুকে গেল।

এই বাসার প্রতিটা কোণা তার চেনা। দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে ডান দিকে সুইচ বোর্ডটা। আন্দাজে হাতড়ে বোর্ডটা পেতেই সে লাইট জ্বেলে দিল। ভেতরের অবস্থা খুবই ভয়াভহ। পুরো ঘরটা এলোমেলো হয়ে আছে। প্রায় প্রতিটা জিনিস ছড়ানো-ছিটানো, বিছানা থেকে তোশক-জাজিম টেনে নিচে নামানো হয়েছে, তারপর সেগুলো কেটে দেখা হয়েছে ভেতরে, এমনকি দেয়াল থেকে ঘড়িগুলো খুলে আছড়ে ভাঙা হয়েছে। মনোযোগ দিয়ে দেখলে বোঝা যায় কেউ একজন বা একাধিক মানুষ কিছু একটা খুঁজেছে এখানে।

হাফিজের বাসাটা দুই ভাগে বিভক্ত। একপাশে ভাড়াটিয়ারা থাকে। আর এই পাশটাতে মূলত একটা রুমে হাফিজ নিজে থাকত। রুমটা বেশ বড়, আর এই রুমটার সাথে ছাদের একটা খোলা অংশ, আরেকপাশে রান্নঘর আর বাথরুম। এই রুমটাকে ছিন্নভিন্ন করা হয়েছে। মনিরুজ্জামান মনে মনে ভাবল বিকেলে যখন সে আর আবু এসেছিল তখন এটার এই অবস্থা ছিল না। তার মানে এরপর কেউ রুমটা সার্চ করেছে। প্রশ্ন হলো, যে বা যারাই এটা সার্চ করেছে তারা কি জিনিসটা পেয়ে গেছে?

“স্যার, এই অবস্থা কে করল?” আবু প্রশ্নটা করেছে।

“বুঝতে পারছি না। তবে মনে হচ্ছে…” মনিরুজ্জামান বলল। তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কবির বলল, “কে করেছে তার চেয়ে বড় কথা কেন করেছে? যদি আমরা ধরে নেই হাফিজ স্যার আত্মহত্যা করেননি, তাকে মারা হয়েছে তাহলে তার রুম কেন সার্চ করা হলো?”

“আমরা যখন দুপুরে এসেছিলাম তখন কিন্তু এটা ঠিকই ছিল,“ আবু বলল।

“তার মানে হাফিজকে মারা হয়ে থাকুক বা সুইসাইড করে থাকুক যে বা যারা তার পেছনে লেগেছিল তারা যে কারণেই পেছনে লেগে থাকুক সেটা তারা হাফিজ স্যারের মৃত্যুর সময় পর্যন্ত পায়নি। যদি পেয়েই যেত তবে স্যার মারা যাওয়ার পর এভাবে তার রুম তছনছ করতে হতো না।”

মনিরুজ্জামান রুমের চারপাশে দেখতে লাগল। হাফিজের নানা ধরনের শখ ছিল। এই রুমটা ওর বিভিন্ন শখের জিনিস দিয়ে ভরতি ছিল। একপাশের দেয়ালে ছিল সিপাহি বিদ্রোহ নিয়ে ফরাসি এক শিল্পীর আঁকা বিরাট এক পেইন্টিং। একটা শোকেস ভরতি ছিল নানা ধরনের মূর্তি আর মুখোশ। পুরো শোকেসটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের মূর্তি আর নানা ধরনের মুখোশ মাটিতে ছড়িয়ে আছে। এগুলোর বেশিরভাগই হাফিজ সংগ্রহ করেছিল আশেপাশের বিভিন্ন দেশ যেমন ভারত, থাইল্যান্ড, নেপাল থেকে।

মনিরুজ্জামান মাটি থেকে এক ফুট সাইজের একটা হাতির মূর্তি তুলে নিল। পাথরের কারুকাজ করা মূর্তিটা একটা মাস্টার ওয়ার্ক। ওটার পাশেই একটা ঘোড়ার ভাঙা মূর্তি। হাফিজ গত বছর থাইল্যান্ড থেকে একগাদা টাকা দিয়ে এগুলো কিনেছিল দেখে মনিরুজ্জামান তাকে অনেক বকা দিয়েছিল। মূর্তিটা মাটিতে রেখে সে উঠে দাঁড়াল।

ছোট্ট শোকেসটার ওপরে একটা অ্যান্টিক আয়না ঝোলানো। আয়নাটার ফ্রেমটা খুবই অদ্ভুত, ওটাতে বিভিন্ন কারুকাজের পাশাপাশি ছোট মূর্তি বসানো। আয়নাটার একদম সামনে দুটো বড় মূর্তি। একটা ঘোড়ার, অন্যটা ঈগলের। আয়নাটাকেও মুক্তি দেওয়া হয়নি। ওটার কাচের একটা পাশ ভাঙা। হঠাৎ একটা জিনিস তার চোখে পড়ল। আয়নাটার ওপরে ঝাপসাভাবে কিছু একটা লেখা। সে আরও সামনে এগোল। অস্পষ্টভাবে ওটার ওপরে লেখা, ‘টুথ ইজ অলওয়েজ ইনফ্রন্ট অভ ইউ’।

তার মাথায় একটা ব্যাপার ঝিলিক দিয়ে উঠল, ঠিক এই কথাটাই হাফিজের খামের ভেতরে থাকা ঘোড়ার ছবিটাতেও লেখা ছিল। সে আবুর দিকে ফিরে বলল, “আবু তুই গাড়িতে গিয়ে ড্যাশ বোর্ডের ওপরে দেখবি হাফিজের খামটা রাখা। নিয়ে আয় তো।” আবু চলে যেতে সে মনোযোগ দিয়ে লেখাটা দেখতে লাগল। তার মনে পড়ে গেল হাফিজের একটা কথা। হাফিজ সবসময় হেয়ালি করে কথা বলত, একটা কথা বলে বোঝাত অন্যটা। এখানেও কি সেরকম কিছু আছে নাকি বোঝার চেষ্টা করছে। কারণ আয়নাটাতে এই লেখাটা সে সম্ভবত মৃত্যুর ঠিক আগে লিখে গেছে। এটা লিখে সে আসলে কী বোঝাতে চাইছে?

আবু খামটা নিয়ে আসতে সে ছবিটা বের করে ছবির লেখাটা আর আয়নার কাচের ওপরে লেখাটা মিলিয়ে দেখতে লাগল। কী বোঝাতে চাইছে হাফিজ? কী? ‘সত্য সর্বদা সম্মুখেই বিদ্যমান’। এখানে কী আছে? তার সামনে আয়না, আয়নাতে তার নিজের প্রতিবিম্ব। আর আয়নাটার সামনে ছিল শোকেসটা। ওটা এখন ভাঙা। হাফিজ নিশ্চয়ই এমনকিছু বোঝাতে চেয়েছে যেটা একমাত্র সে বুঝতে পারবে। আয়নাটার দিকে আবারও গভীরভাবে তাকাতে আয়নাতে আরেকটা জিনিস তার চোখে পড়ল। অপরদিকের দেয়ালে ঝোলানো একটা জিনিসের প্রতিবিম্ব। সে ঝট করে ঘুরে তাকাল।

হাফিজের নানা ধরনের মূর্তি সংগ্রহের শখের ভেতরে একটা ছিল ধর্মীয় নানা ধরনের দেব-দেবীর মূর্তি। অপরদিকের দেয়ালে হিন্দুধর্মের দেবী মা—কালীর একটা ফুল সাইজ মূর্তি ঝোলানো।

“সত্য সর্বদা তোমার সামনেই থাকে,” সে বিড়বিড় করে কথাটা আওড়াল। “আবু, কবির, চল আমাদের বেরোতে হবে, আমরা এখন এক জায়গায় যাব।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *